বইপড়া

নতুন বই

অতএব আফ্রিকা

সমালোচনা-তাপস মৌলিক

bookreviewnotun (Medium)সাধারণত যে সব বইকে ছোটোদের বই বলা হয়, এ বইটা ঠিক সেরকম নয়। তবে শুধু বড়োদের বইও নয়; সবাই পড়তে পারে। আমার মতে এ বই যদি পড়তেই হয় তো ছোটোবেলাতেই পড়া ভাল, কাজে দেবে; বুড়ো বয়েসে যখন পায়ে গেঁটে বাত ধরবে তখন আর এ বই পড়ে কোনও লাভ হবে না।

লেখক শ্রী অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায় একজন অভিযাত্রী। পর্বতারোহণ তাঁর নেশা এবং পেশা। হিমালয়ে তিরিশটির বেশি অভিযান করেছেন; জয় করেছেন কামেট, নন্দাদেবী পূর্ব, শিবলিঙ্গ, ভাগীরথী, সতোপন্থ, ত্রিশূল, মনিরাং, নন্দাঘুন্টি-র মতো কিছু শৃঙ্গ। এখনকার অনেক পর্বতারোহী, যাঁরা কোনওরকমে হাঁকপাঁক করতে করতে শেরপাদের কোলেপিঠে চড়ে শৃঙ্গে উঠে একটা পতাকা পুঁতে দিয়ে নেমে আসেন, অনিন্দ্য সে দলে পড়েন না। তিনি একজন সত্যিকারের অভিযাত্রী, যাঁদের সংখ্যা এ দেশে কেন, গোটা পৃথিবীতেই খুব কমে এসেছে। অচেনা, অজানা, অখ্যাত উপত্যকা কিংবা হিমবাহে নতুন পথের সন্ধানই তাঁকে উত্তেজিত করে। অভিযান আর ভৌগোলিক অনুসন্ধানের নেশা তাঁকে টেনে নিয়ে গেছে গ্রিনল্যান্ডের সাগরপাড়ে, আইসল্যান্ডের হিমবাহে কিম্বা ইউরোপ ও আফ্রিকার নানা পর্বতে। ২০১১ -তে জেমু গ্যাপ আরোহণের জন্য অনিন্দ্য পেয়েছেন ‘জগদীশ  নানাবতী  অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সেলেন্স ইন মাউন্টেনিয়ারিং।’

       আলোচ্য বইতে লেখক শুনিয়েছেন আফ্রিকা মহাদেশে তাঁর ৪৫০০ কিলোমিটার সম্পূর্ণ একা সাইকেল চালানোর কাহিনী। বিষুবরেখা থেকে যাত্রা শুরু করে তিনি পৌঁছেছেন মকরক্রান্তিরেখা; কেনিয়ার নানইয়ুকি শহর থেকে সফর  শুরু করে,তানজানিয়ার দার-এস-সালামে আফ্রিকার পূর্ব-উপকূলে ভারত মহাসাগরকে ছুঁয়ে, তারপর আফ্রিকার মূল ভূখণ্ড পেরিয়ে, পৌঁছে গেছেন নামিবিয়ার পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে। পথে পার হয়েছেন পাঁচটি দেশ – কেনিয়া, তানজানিয়া, মালাউয়ি, জাম্বিয়া এবং নামিবিয়া। আর ভূগোল বইয়ে আফ্রিকার প্রাকৃতিক মানচিত্র সামনে রেখে দেখলে, কেনিয়ান হাইল্যান্ডে মাউন্ট কেনিয়ার পাদদেশ থেকে শুরু হয়েছে লেখকের যাত্রা, দক্ষিণে চলে মাউন্ট কিলিমাঞ্জারোর পায়ের তলা দিয়ে এগিয়ে ভারত মহাসাগর ছুঁয়ে আসা, তারপর পশ্চিমে আফ্রিকার মূল ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ে একে একে পার হতে হয়েছে লেক মালাউয়ি, লিভিংস্টোনিয়া পর্বতশ্রেণী, জাম্বেজির জঙ্গল, ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত, ওকাভাঙ্গোর জলাভূমি, কুখ্যাত ট্রান্স কালাহারি হাইওয়ে এবং শেষে নামিব মরুভূমি।

    এমন বইয়ে যাত্রাপথের বর্ণনা যে বৈচিত্র্যময় ও রোমাঞ্চকর হবে সে আর বেশি কথা কি? তবে এ বইয়ের আসল আকর্ষণ আফ্রিকার সাধারণ মানুষজনের কথা। পথ চলতে চলতে লেখকের প্রতিদিনই আলাপ জমে ওঠে নতুন নতুন লোকের সঙ্গে, কত নতুন নতুন জাতি-উপজাতি, কত নতুন ভাষা। লেখক পরম মমতায় ছবি আঁকেন সেইসব বন্ধুদের, পথচলার মাঝে যাদের সঙ্গে ক্ষণিকের আলাপ, কিছুক্ষণের বন্ধুত্ব, একসঙ্গে কিছু হাসি-গল্প-মত বিনিময়, তারপর বিদায়। আমাদেরও জানা হয়ে যায় কেমন আছে এখনকার আফ্রিকা।

    শুধু পথচলার বিবরণ আর পথচলতি আলাপ হওয়া লোকজনের কথাই তো নয়, লেখকের ডায়রির পাতায় পাতায় মিশে আছে ইতিহাস; যে জায়গা দিয়ে চলেছেন তার ইতিহাস, আফ্রিকা মহাদেশের ইতিহাস। তাঁর সঙ্গে চলতে চলতেই আমরা জেনে যাই কেমন করে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো ‘বাঁদরের পিঠে ভাগ’ করার মতো আফ্রিকাকে কেটে টুকরো টুকরো করে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়ে উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল, প্রায় দুই শতাব্দী ধরে চলেছিল লোভের, শোষণের গল্প; আফ্রিকার খনিজ সম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রাণী সম্পদ, এমনকি মানবসম্পদও লুণ্ঠিত হয়ে ভরে তুলছিল ইউরোপের তথাকথিত ধনী, সভ্য ও উন্নত দেশগুলির কোষাগার। জানতে পারি ভয়াবহ ক্রীতদাস প্রথার ইতিহাস, জাঞ্জিবার বন্দরের কথা, নামিবিয়ার হেরেরো উপজাতির মর্মান্তিক ইতিহাস – মাত্র তিন বছরের মধ্যে জার্মানরা যাদের প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল।

    অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়ের লেখার ধরণ অনায়াস, বাহুল্যবর্জিত, ঝরঝরে; কোথাও কোনও দেখনদারি নেই, মাত্রাছাড়া আবেগ নেই। আপনমনে সাইকেল চালাতে চালাতে, চারদিক দেখতে দেখতে, ভাবতে ভাবতে, যেন নিজের সঙ্গেই একা একা কথা বলে চলেছেন তিনি। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছি; আর সেই সুযোগে ঢুকে পড়ছি এক দুরন্ত অভিযাত্রীর মনের ভেতর, যিনি বলতে পারেন… ‘আমি একজন অতি সাধারণ মানুষ, যার ভুল হয়, ক্লান্তি আসে, আঘাত লাগে, মন খারাপ হয়, এমনকি মাঝেমধ্যে রীতিমতো ডিপ্রেসড লাগে, কিন্তু তবুও সে এগিয়ে চলতে চায়।’ শুধু তাই? লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব কিনা তাই নিয়ে দ্বিধা তৈরি হয় না? জনমানবহীন ধুধু মরুভূমি, দুর্ভেদ্য জঙ্গল বা পার্বত্য উপত্যকায় রাস্তা ধরে একা একা সাইকেল চালিয়ে যেতে যেতে ভয় হয় না? হ্যাঁ, তাও হয়! অনিন্দ্য লিখছেন… ‘প্রতিদিন সে আসে। সে আমার ক্লান্ত পেশিতে একটা কালো মেঘের মতো ছায়া ফেলে। আমার মনে দ্বিধার জন্ম দেয়। আমাকে নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে সন্দিহান করে তোলে। আমাকে হেরে যাওয়ার আগেই হারিয়ে দিতে চায়। আমি দুর্বল হয়ে যাই। মনের মধ্যে নানা দুশ্চিন্তা দানা বাঁধে। আমি হেরে যাওয়ার আগে আর একবার নিজের দিকে চাই। এরকম কথা তো ছিল না। আর একটু লড়াই করাই যাক না। দেখাই যাক না শেষপর্যন্ত কী হয়। আমি আরও এক পা ফেলি সামনে। আরও একটা চড়াই পার হয়ে যাই। আমার ভয় দশ পা পিছিয়ে যায়। আমি এবার দশ কদম এগিয়ে যাই, ভয় এবার আমাকে ভয় পায়। সে দূর থেকে আমায় দেখে। আমার দেখার সময় নেই ওকে। আমাকে এগিয়ে যেতেই হয়। আমি জানি ও দূর থেকে আমায় দেখছে। আমার দুর্বলতার সুযোগের অপেক্ষায় সে ওত পেতে বসে আছে। আমার মনের আলোক বিন্দুগুলি ছুঁয়ে চলি আমি। তাদের সযত্নে লালন করি। ভয় আসলে আমার কল্পনায়।’

    অনিন্দ্যর কথায়… ‘অ্যাডভেঞ্চার জীবনের প্রতি পদে করা যায়। অ্যাডভেঞ্চার এমন একটা পথ যে পথ সবার জন্য সবসময় খোলা। সেটা ছোট মাপের না বড়, তাৎপর্যপূর্ণ না একঘেয়ে, তার বিচার বাকিরা করে। কিন্তু যে অ্যাডভেঞ্চার করে সে কেবল আনন্দ পাওয়ার জন্যই করে।’

    এসব কথাবার্তা শুনলে মনে হয়, ধুত্তোর, কী ঘরের মধ্যে পচে মরছি! বেরিয়ে পড়ি। একটা সাইকেল জোগাড় করতে হবে শুধু। প্রথমদিন নয় ত্রিশ কিলোমিটার চালিয়ে দেখব, তার পরদিন পঞ্চাশ, তারপর একশো। তারপর একটা লম্বা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ব। একা।

    অনিন্দ্য তাঁর লেখার মাধ্যমে পারেন অ্যাডভেঞ্চারের এই ‘স্পিরিট’-টাকে খুঁচিয়ে জাগিয়ে তুলতে। বাংলার নাতিস্ফীত অভিযান সাহিত্যে এ বই একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

 

বই:অতএব আফ্রিকাঃ সাইকেলে ৫ দেশ

লেখক:অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়

প্রকাশক:উত্তর পাবলিকেশনস

১৪এ মনোহরপুকুর রোড, কলকাতা ২৬

ফোনঃ ২৪৫৪ ৩০৪৪; প্রকাশকালঃ জানুয়ারি ২০১৫

পৃষ্ঠাসংখ্যা:২৩২; দাম:১০০ টাকা

তাপস মৌলিক