অণুগল্প আমরা হারব না কিছুতেই সুনৃতা মাইতি শীত ২০১৯

       জয়ঢাকের সমস্ত  অণুগল্প

আমরা  হারব না কিছুতেই

সুনৃতা  মাইতি

সে একেবারে হই-হই কাণ্ড, রৈ-রৈ ব্যাপার। যেমন তেমন  নয়, একেবারে  নিখিল বিশ্ব সম্মেলন। একটু খোলসা করে বলতে গেলে, সারা বিশ্বে যতরকমের মশা আছে তাদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন। মশা মিলনের মহাক্ষেত্র এই কলকাতা শহরে। মশাদের বিশ্ব মানচিত্রে কলকাতা কিন্তু একটুও হেলাফেলার স্থান নয়। ম্যালেরিয়ার ওষুধ আবিষ্কার করতে স্বয়ং রোনাল্ড রসকেও এই কলকাতাতেই আসতে হয়েছিল। ক্রম প্রসারিত কলকাতার একচিলতে মেঠো জমিতে বসেছে  মশক মহা সম্মেলন। 

মশাদেরও রকমফের আছে বৈকি। আছেন মান্যগণ্য দশবরেণ্য মশক প্রজাতি। ঘাসপাতার মঞ্চে সসম্মানে উপবিষ্ট আছেন ম্যালেরিয়ার আদিমাতা শ্রীমতী অ্যানি অ্যানোফিলিস। তিনি এই সম্মেলনের সভাপতি। বয়স হয়েছে, শুঁড়ে পাক ধরেছে,  চোষক নলও একটু নড়বড়ে হয়েছে তাঁর। তাঁকে কচুরিপানার ফুল দিয়ে বরণ করে নিলেন সুদূর আফ্রিকা থেকে আগত শ্রীমতী অ্যানোফিলিস গ্যামবিল।

এরপর বিশেষ বক্তব্য রাখলেন সাউথ এশিয়ার টাইগার মশা এডিস অ্যালবো পিকটাস। দর্শকাসনে সার দিয়ে বসে আছেন ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু জ্বর, পীতজ্বর, নীল ভাইরাস, রস রিভার, এনসেফ্যালাইটিস পরিবাহী কতশত কৃতী মশক। বসে আছেন পীতজ্বর, এনসেফ্যালাইটিস এবং ডেঙ্গু পরিবাহী বহুগুণা ইডিস ইজিপ্টাই। ডেঙ্গু বিষয়ে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে এই বছর ‘ডেঙ্গুশ্রী’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা হবে। এছাড়াও জিকা জ্বরকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিচ্ছেন যেসব  আন্তর্জাতিক পরিশ্রমী  মশকবৃন্দ, তাঁদের জন্যও আছে বিশেষ পুরস্কার। সভাপতির হাত থেকে প্রত্যেকে পুরস্কার নিচ্ছেন এবং সমবেত প্যান প্যান স্বরে তাদের উৎসাহ বর্ধন করছেন দর্শকবৃন্দ।

এরপর শুরু হল কিউলেক্স মশাদের কোরাস গান এবং সব প্রজাতির মশাদের একটি সমবেত নৃত্য। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শেষে  আছে একটি সামাজিক নাটক যার মুখ্য বিষয় মশাদের জীবনে ঘনিয়ে আসা কিছু মহাবিপদ।

নাটক শেষ হল। মুহূর্তে  আনন্দঘন পরিবেশটাই গেল আমূল বদলে। সকলের কপালে গেড়ে বসল চিন্তার কালো রেখা।

এরপর চলল সুদীর্ঘ গুরুগম্ভীর আলোচনা। প্রত্যেক প্রজাতির মশক প্রতিনিধি এই বিষয়ে নিজেদের মতামত রাখলেন। আসলে বিষয়খানি সেই দু’পেয়ে প্রাণীদের নিয়ে যাদের ছাড়া জীবন চলে না, আবার যাদের জন্য মশাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। মিনসেগুলো শুধু আবিষ্কারের পর আবিষ্কার করেই চলছে। আজ এই প্রলেপ তো কাল ওই স্প্রে। আশার কথা, এই সমস্ত ওষুধ সহ্য করে মশার দল ক্রমশ জেনেটিক্যালি আরও উন্নত হয়ে উঠছে। তবে এই মানুষগুলো কি বসে থাকবার পাত্র? নানারকম ভ্যাকসিন তো বানাচ্ছেই, তার ওপরে নাকি আবার জমা জলে ছাড়বে ব্যাকটেরিয়া। ব্যস, অবোধ মশাশিশুর দল যাবে শেষ হয়ে। এছাড়াও আছে  হরেকরকম মশারির ইতিকথা, আল্ট্রাসনিক সাউন্ড কিংবা মশা মারার নিত্যনতুন বিষ।

এই নিয়ে বাকি সময়টায় চলল কতই না বক্তিমে, কতই না জল্পনা-কল্পনা। কী হবে! মশক প্রজাতির বিরুদ্ধে মানব প্রজাতির এই বিপুল অবরোধ সফল হলে তো মহাবিপদ! সারাদিন এত আলোচনার পর সন্ধ্যার দিকে সব নিস্তব্ধ। মশার দল পিনপিন বন্ধ করে ভাবছে, কিংবা ভাবা প্র্যাকটিস করছে। আকাশেরও মুখ ভার। থমথম করে ওঠে চারপাশ।

এমন সময় হঠাৎ একটি শব্দ।  ভেঙে যায় নিস্তব্ধতা। কারা যেন একগাদা বাতিল প্লাস্টিক, ফাটা বালতি, আধভাঙা মগ ছুড়ে ফেলে দেয় মাঠের পানে। সাথে একগাদা পচা-গলা আবর্জনাও। ঝমঝম করে বৃষ্টিও নামে তক্ষুনি। ভাবা থামিয়ে অমনি মশারা হই-হই করে উঠে সমবেত উল্লাসে। এবার জমবে মজা! ওই নোংরা স্তূপের ফাটা পাত্রে জমবে জল, বাড়বে মশক বংশ। নো চিন্তা, ডু ফুর্তি। কত আর মারবে এই রক্তবীজের ঝাড়কে!

আহা! মানুষই গড়ে তো মানুষই ভাঙে। বেঁচে  থাক ওই ওঁচা মানুষের দল।

অলঙ্করণঃ অংশুমান

অলঙ্করণঃ অংশুমান

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

1 thought on “অণুগল্প আমরা হারব না কিছুতেই সুনৃতা মাইতি শীত ২০১৯

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s