কাঠপুতুল
সুস্মিতা কুণ্ডু
রাতের আঁধার নেমে এলেই জীবন্ত হয়ে ওঠে কাঠপুতুলটা। কাগজের রঙিন বাক্স থেকে বেরিয়ে খুটুর-খুটুর করে হাতড়ে হাতড়ে ঘুরে বেড়ায় আনাচে-কানাচে। তার নীল চোখের তারা ঢাকা থাকে কাঠের পাতা দিয়ে। তবুও সে খোলা জানালার বাইরে পা ঝুলিয়ে বসে চাঁদের আলোয় চান করে। মাঝে মাঝে রূপকথারা ফিসফিসিয়ে কথা বলে এসে ওর সাথে, চুপিসাড়ে। কানের পাশের আলগা সোনালি চুলের গোছা উড়ে যায় ওদের কথার তালে। মসৃণ শক্ত গালে শিরশিরে অনুভূতি হয়। বোজা চোখের কৃত্রিম অন্ধকার ঘিরে থাকে কাঠপুতুলকে। শ্রবণেন্দ্রিয় তাই বড়ো সজাগ থাকে ওর।
ইস্পাতের রেল লাইনে কান পেতে যেমন দূরপাল্লার ট্রেন আসার ঝমঝম শব্দ শোনা যায়, তেমনি আঁধারের বন্ধ দরজায় কান পাতে কাঠপুতুল। দরজার ওই পারে হারিয়ে যাওয়া গল্পগুলো কথা বলে। দুধসাদা পক্ষীরাজের ডানা ঝাপটানো, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর ঝগড়া—সব শুনতে পায়। কাঠপুতুল দরজার কড়ায় হাত রেখে বলতে যায়, ‘ওগো তোমরা ঝগড়া করো না। সবাই যে মিলেমিশে থাকতে হয়।’
কিন্তু কোথায় দরজা, কোথায় কড়া! সামনে একরাশ আলো! ইস! ভারি ভুল হয়ে গেছে। উত্তেজনায় চোখদুটো খুলে ফেলেছে কাঠপুতুল। নিমেষে রূপকথারা হারিয়ে গেছে আঁধারে। বড়ো বড়ো জলের ফোঁটা কাঠপুতুলের খোলা চোখের পাতা উপচে ঝরে পড়ে। ভাবছ, এত কান্নার কী আছে? ফের চোখ বুজে কান পাতলেই তো হয় আকাশের গায়ে।
না, তা যে আর হয় না। ওই দেখো, অশ্রুকণার স্পর্শে কাঠের গাল নরম গোলাপি ত্বকে পরিণত হচ্ছে। পরি-মার আশীর্বাদে প্রতিরাতে কাঠপুতুল জীবন্ত হয়ে খেলা করতে পারে। আবার ভোরের আলো ফুটলেই ফের কাঠপুতুল হয়ে যায়। শুধু একটাই শর্ত, চোখ খোলা চলবে না। পরি-মা তাকে বলে দিয়েছিল, চোখ খুললেই কাঠপুতুল চিরতরে মানবশিশু হয়ে যাবে! কিন্তু কাঠপুতুল ভুলবশত চোখ খুলে ফেলেছে। এবার তাহলে ও ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে যাবে। তখন সব স্বপ্ন, রূপকথা হারিয়ে যাবে। ফুলের গন্ধ, প্রজাপতির রঙ, পাখির গান, কোনও কিছুই আর ভালো লাগবে না।
কাঠপুতুল আকুলিবিকুলি করে, ডুকরে ওঠে। “পরি-মা, আমায় ফের কাঠপুতুল করে দাও! আমি মানুষ হতে চাই না! কোনও কি উপায় নেই?”
কাঠপুতুলের করুণ ডাকে সাড়া দেয় পরি-মা। “কাঠপুতুল, তুমি মানুষ হতে চাও না?”
“পরি-মা, মানুষ হলে যে বড়ো হয়ে যেতে হবে একদিন না একদিন। বড়ো হওয়া একদম ভালো নয়। আমি যে ছোট্টটিই থাকতে চাই।”
পরি-মার কাঠপুতুলের কান্না দেখে বড়ো মায়া হল। “বড়ো হলেও ছোট্ট থাকা যায় বৈকি, কাঠপুতুল। তুমি তো এখন কাঠ থেকে রক্তমাংসের মানুষ হবে। একটু পরে বুঝবে তোমার বুকের খাঁচায় একটা হৃদয় আছে, সেটা ভালোবাসায় ভরে রেখ। তোমার একটা মন আছে, তাতে কল্পনা জমিয়ে রেখ। আর তোমার এই দু’চোখে স্বপ্ন মেখে রেখ। তাহলেই দেখবে তুমি বড়ো হলেও আসলে ছোট্টটিই রয়ে গেছ। খুব কঠিন কাজ কিন্তু। তুমি পারবে কি, কাঠপুতুল?”
কাঠপুতুল তার আশায় ভরা নীল চোখদুটো মেলে বলে, “পারব আমি, পরি-মা! আমায় পারতেই হবে।”
অলঙ্করণঃ অংশুমান
্বাঃ বেশ স্বপ্নমাখা গল্প।
LikeLike
কি মিষ্টি করে সব বললে, দারুণ গো
LikeLike