চতুষ্পদ
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
পরাণ মাঝিকে গ্রামের লোকে বলেছিল, ‘ছেলেকে কুম্ভে নিয়ে যাও। ওখানে অনেক সন্ন্যাসী ঠাকুরের দেখা মেলে। দেখো, তোমার পরাগ ঠিক ভালো হয়ে যাবে।’
সেই ভরসায় কষ্টার্জিত টাকা জমিয়ে এলাহাবাদের ট্রেন ধরে ফেলেছিল পরাণ। বউ বিমলা জেদ ধরল সেও যাবে। বিয়ের পর থেকে গাঁয়ের বাইরে তার নাকি যাওয়াই হয়ে ওঠেনি কোনওদিন। বলল, “না হয় দুটো ভাত কম খাব। তবুও নিয়ে চলো আমাকে।”
পরাগ এখন আঠারো। চার হাত-পায়ে হাঁটে। দেখে মনে হয় যেন এক চতুস্পদ জন্তু। মায়ের পেটে থাকার সময়েই নাকি বেঁকে যায় তার মেরুদণ্ড। তাই জন্ম-কুঁজো পরাগ। পীরের থান, মালিশ, হোমিওপ্যাথি, কবিরাজি, কোনও কিছুই পরাগকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিতে পারেনি।
কুম্ভের মেলায় প্রয়াগে এসে অবধি পরাণ মাঝি সন্ন্যাসী দেখলেই ডেকে ডেকে দাঁড় করিয়ে অনুনয় করেছে, “আমার ছেলেটাকে ভালো করে দাও, বাবা। অনেকদূর থেকে বড়ো সাধ নিয়ে এসেছি।”
অবলীলায় পরাণকে উপেক্ষা করে সাধুর দল কখনও নির্বিকার মুখে স্নানের ঘাটের দিকে, কখনও বা লঙ্গরখানার দিকে দৌড়ে গেছে। কেউ আবার ধমকে গালাগাল দিয়েছে।
গঙ্গার ধারে চটের থলের উপর পরাগ আর তার মাকে বসিয়ে রেখে রোজ সকাল থেকে বিকেল, একটানা সাধুদের বিনতি করে চলেছে পরাণ। পরাগ কিন্তু নতুন জায়গায় মনের আনন্দে চার হাত-পায়ে ছাগলের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে।
গঙ্গায় ক’টা ডুব দিয়ে এসে গামছা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে পরাণ মাঝি দেখে, লাফাতে লাফাতে ছুটে এসে তার দিকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দেয় পরাগ। কিছু দূরে এক বিদেশি দম্পতি পরাণ আর পরাগের দিকে ক্যামেরা তাক করে।
চটের থলের পাশে একটা ছেঁড়া মাদুর এনে বিছিয়ে দেয় পরাণ। পরাগ এখন থেকে এখানেই বসে থাকবে। সামনে কিছু ছড়ানো খুচরো পয়সা, দশ টাকার নোট। পরাণ ভাবে, প্রয়াগে আসার প্রথমদিনই এই কথাটা মাথায় আসেনি কেন? এখন তার মুখে ক্রূর এক অদ্ভুত হাসি খেলা করে। বেলা শেষ হতে না হতেই কী স্বচ্ছন্দে পুণ্যার্থীদের সামনে হাত বাড়াতে শিখে যায় পরাগ! বিমলা মনে মনে বলে, মা গঙ্গা, কাল তোমার মন্দিরে একান্ন টাকার পুজো দেব। পরাগকে ভালো রেখো।
অলঙ্করণঃ অংশুমান