চশমা
সুদীপ চ্যাটার্জি
স্কুল থেকে এসে জুঁই চাকরি করতে যায়।
বেশি দূরে অবশ্য যেতে হয় না। তিনটে ঘর আর বারান্দা পেরোলেই একটা ছোট্ট ঘর। সেখানে রেডিও চালিয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করে থাকে অফিসের বস, জুঁইয়ের ফর্সা মা। সম্পর্কে জুঁইয়ের পিসি হলেও পাড়ার সবাই তাকে ফর্সা মা বলে। এখনও তার গায়ের রং সোনার মতো। গত তিরিশ বছর ধরে সেলাই-বোনাই করছেন তিনি; সেলাই করা তাঁর নেশা। লোকেদের অনুরোধে আজকাল সেটা খানিকটা পেশায় পরিণত হয়েছে।
কিন্তু কয়েকদিন ধরে অসুবিধেয় পড়ে গেছেন ফর্সা মা। চোখের দৃষ্টি দুর্বল হয়ে গেছে বলে সূচে সুতো পরাতে পারেন না আর। উপায় না দেখে সূচে সুতো পরানোর চাকরিতে তিনি বহাল করেছেন চার বছরের জুঁইকে। রোজ পাঁচ টাকা মাইনের এই চাকরি পেয়ে জুঁইও বেজায় খুশি।
সুতো অবশ্য দু’বার-তিনবারের বেশি পরাতে হয় না। বাকি সময়টা সেলাই মেশিনের ঘরঘর শব্দের মধ্যে বসে বকবক করে সে। রংবেরঙের সুতো, কৌটাতে রাখা ছোটোবড়ো বোতাম নিয়ে খেলা করে। একের পর এক প্রশ্ন করে ফর্সা মাকে। তার উদ্ভট সব প্রশ্নের উত্তর একমাত্র দিতে পারেন ফর্সা মা। এই কারণে জুঁই চাকরিতে কামাই করে না।
সেদিন জুঁই ফিরে এসে বলল, “ফর্সা মা, আমার স্কুল যে বিকেল অবধি হয়ে যাচ্ছে পরের সপ্তাহ থেকে। এইবার কী হবে?”
ফর্সা মা মুখ তুলে বললেন, “সে কি রে! কেজি ক্লাসে এত পড়া কীসের? কীসের এক্সট্রা ক্লাস?”
জুঁই বলল, “ফ্যামিলি কন্ডাক্ট। বাড়ির লোকের সঙ্গে যাতে সকলে ভালো বিহেভ করে, সেই ট্রেনিং দেবে ম্যামরা।”
“তাহলে তো যেতেই হয়। কী আর করবি?”
“তাহলে তোমার সূচে সুতো পরিয়ে দেবে কে?”
“দেখি যদি চশমা করে সুবিধে হয়! তাহলে আমিই পরিয়ে নিতে পারব।”
“চশমা পড়লে ভালো দেখা যায় বুঝি?”
“তা তো যায়ই।”
কথাটা জানা ছিল না চার বছরের জুঁইয়ের। সেই জন্যেই বাবা চশমা পরে রাস্তায় বেরোয় অফিসে গেলে। মাও মাঝে মাঝে বাজার করতে গেলে চশমা চোখে দেয়। মনে মনে একটা প্ল্যান ঠিক করে নিল জুঁই।
দিন চারেক পর দুপুরবেলা হাসিমুখে জুঁই এসে দাঁড়াল ফর্সা মায়ের সামনে। তাকে দেখে তিনি বললেন, “হাসছিস কেন রে বুড়ি?”
জুঁই হাসতে হাসতে বলল, “তোমার চশমা নিয়ে এলাম।”
“সে কি রে!” ফর্সা মা অবাক।
“নয়তো কী?” জুঁই বলল, “তোমার মাইনের টাকা জড়ো করে রেখেছিলাম। কাল বিকেলে বাবাকে সঙ্গে করে গিয়ে কিনে এনেছি। আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছিল বাবা, কিন্তু আমি সারপ্রাইজ দেব বলে কিচ্ছু বলিনি। এই নাও।”
ফর্সা মা হতভম্ব হয়ে দেখলেন, ছোটো হাতটা খুলে তার সামনে মেলে ধরেছে জুঁই। তাতে রাখা আছে একটা কালো রঙের রোদ চশমা। একগাল হেসে ফর্সা মা তাকে কাছে টেনে এনে বললেন, “এইবার আমি সব পরিষ্কার দেখতে পাব।”
অলঙ্করণঃ অংশুমান