পিকুর রাঙাজ্যাঠা
শাশ্বতী চন্দ
বাড়িসুদ্ধ সবাই উচ্ছসিত হলেও গম্ভীর হয়েছিল পিকু,”একটা মানুষ স্বার্থপরের মত কাড়ি কাড়ি টাকা রোজগার করবে বলে বিদেশে পালিয়েছিলেন। তিনি যদি এতদিন পর দেশে ফিরে আসেনই বা তা নিয়ে এত হইচই করার কী আছে?”
মা অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন,”এসব কী বলছিস তুই? এত বড় একটা লেখক। রাঙাদা আমাদের পরিবারের গর্ব।”
“ইংরাজী ভাষার লেখক মা। বাংলায় এক লাইনও লেখেননি।সুনাম খ্যাতি সবই বিদেশি ভাষায় সাহিত্যচর্চা করে।”
মা গজগজ করেন,”তাতে কি মানুষটার দাম কমে গেল? তবে তো সব ইংরাজী মাস্টারমশাইদের মেরে ধরে দেশ থেকে বের করে দিতে হয়।”
“আচ্ছা মা, আমি যদি তোমাকে মা না বলে অন্য কাউকে মা বলে ডাকি,কেমন লাগবে তোমার?খারাপ লাগবে। তাই তো?মনে হবে বেঈমানি করছি। না?সেরকম মাতৃভাষাকে ভুলে যাওয়াও বেঈমানি। “
“আচ্ছা আচ্ছা।” মা যেন বিতর্ক এড়াতে চান,”কালই তো আসছেন তোর রাঙা জ্যাঠা। বলিস একটা বাংলা গল্প লিখতে। তোর আবদার নিশ্চয় রাখবেন তিনি।”
বছর পনেরোর পিকু আবদারের পথে না হেঁটে সরাসরি অভিযোগ করে বসল খাবার টেবিলে বসে, “আপনি বাংলা ভাষাকে ভুলে গেলেন কেন?”
হকচকিয়ে গেলেন সরোজ চৌধুরী, “ভুলে গেলাম?কই? আমি তো বাংলাতেই কথা বলছি। এমনকি অনাবশ্যক ইংরাজী শব্দ ব্যবহারের প্রবনতাকেও এড়িয়ে চলছি।”
“তবে আপনি ইংরাজীতে লেখেন কেন?বাংলায় নয় কেন?”
সোজা হয়ে বসেন সরোজ চৌধুরী, “অনেকবার এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি। উত্তরও দিয়েছি অনেক রকম। কিন্তু তোমাকে কী যে বলি!তুমি এত ছোট!”
পিকুর বাবার মনোজ চৌধুরী সামাল দিতে চান.”তুই খা দাদা। ও পাগলের কথায় কান দিতে হবে না।”
“না। মনে যখন হয়েছে—ছোট বলে উপেক্ষা করা উচিত না। শোনো,উচ্চ শিক্ষা নিতে ও দেশে গিয়েছিলাম।চাকরিও হল ওখানেই। যখন লেখালেখির কথা ভাবলাম দেখলাম চার পাশের সব মানুষ ইংরাজিতেই কথা বলে। তাই ইংরাজীতেই শুরু।সাফল্য পেলাম। তাছাড়া–” মাথা নিচু করে পাতের কাঁচা লংকাটাকে নাড়াচাড়া করেন,’আন্তর্জাতিক খ্যাতির লোভও ছিল। তবে মাতৃভাষা তো একটা আবেগ। মা কে কেউ ভোলে বুঝি! যত দূরের যাই এ আবেগ স্বপ্নে হানা দেয়। চেতনায় হানা দেয়। নরম হাতে জড়িয়ে ধরে।”
চিকচিক করে পিকুর চোখ, “কাল তাহলে বাংলায় কিছু লিখুন। কাল মাতৃভাষা দিবস।”
“ডান।” বলেই জিভ কাটেন সরোজ চৌধুরী, পিকুর রাঙা জ্যাঠা,” কথা দিলাম।”
অলঙ্করণঃ অংশুমান দাশ