বুড়ির ঘর
রাজীবকুমার সাহা
হিরুদের পুকুরপাড়ে ঘরটা তুলেছে তিন বন্ধুতে মিলে। শীত পড়তেই এক আঁটি দু’আঁটি করে পুকুরপাড়ের উলুবন কেটে এনে শুকিয়ে রেখেছিল তারা স্কুলে যাওয়ার আগে আগে। তারপর পৌষসংক্রান্তির আগের দিন সন্ধে অবধি খেটে সে দিয়ে বেড়া বেঁধে বুড়ির ঘরটা তুলেছে। বাড়ি থেকে তার টেনে বাবা একটা বালবও লাগিয়ে দিয়ে গেছে। হলুদ ঘরের ভেতরটা আরও বেশি হলদে দেখাচ্ছে। হাঁড়ি-কড়া, খুন্তি-বটি ধার দিয়েছে মা। ইট পেতে উনুন করেছে।
মুড়িমাখা খাওয়া শেষ। এইবারে রান্না বসবে। মাংস নেই, রাঁধার মতো লায়েক হয়নি কেউই। মা রেঁধে দেবে তাতেও রাজি নয়। তাই ভাত, বেগুন ভাজা, ডিম-আলু ঝোল আর পায়েস। পায়েসটা অবশ্য হিরুর মা দুপুরে রেঁধে রেখেছিল। তিন বাটি দিয়ে যাবার সময় বলে গেল, “বুড়ির ঘর তো তোদের খাসা হয়েছে রে, ভয় শুধু ওই বদমাশ লখুটাকে।”
সাউন্ড বক্স আর ক্যাসেট প্লেয়ারটা এনেছে কাজু। বেগুন ভাজা উলটে দিতে দিতে, আলু সাঁতলাতে সাঁতলাতে চলছিল এলোপাথাড়ি নাচ। এরই ফাঁকে ওপাড়ার লখু এসে উঠল অন্ধকার ফুঁড়ে। বুক শুকিয়ে এল তিন বন্ধুর। লখু বেশ প্রশংসা করল ঘরটার। চোখে লালসা। সারারাত ঘুরে বেড়ায় সে এদিন। আর মাঝরাতের পর থেকে থেকে বুড়ির ঘরে আগুন জ্বলে ওঠে এদিক ওদিক।
এগারোটার পরপরই ডাক পড়ল বাড়ি থেকে। লখু বিদেয় হয়েছে অনেক আগেই। কাজু আর নন্দুও আজ গোঁজাগুঁজি করে শুয়ে পড়বে হিরুর লেপের তলায়। ভোর ভোর ওঠে পুকুরে ডুব দিয়ে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে এসে বুড়ির ঘরে আগুন দিতে হবে। তার আগে সে ঘরে রেখে দিতে হবে কদবেল আর গোটা কতক কাঁচাপাকা কুল। তারপর পুবে সুয্যিমামার উঁকি দেওয়া অবধি চলবে সে আগুন পোয়ানো। চোখে মুখে এসে লাগা আগুনের সে মিঠে তাত বড্ড আরামের। তারপর পোড়া বেল আর কুল মুখে দিয়ে যে যার বাড়ি ফিরে থালাভর্তি পিঠেপুলি। আহা!
হিরু ঘুমোয়নি একটুকুও। দেয়াল ঘড়িটার প্রত্যেকটা টিকটিক শুনেছে সে। পঞ্চম বার ঘড়ি দেখার পর পুকুরমুখো জানালাটা ফাঁক করল সে। ঠেলে তুলল কাজু আর নন্দুকে। বুজে আসছিল গলাটা। বলল, “উঠে দ্যাখ, লখু আমাদের বুড়ির ঘরটা জ্বালিয়ে দিয়েছে রে! ঘরটা নেই। অল্প অল্প ধোঁয়াও উঠছে।”
এক ঝটকায় উঠে দুধঘন কুয়াশায় দৌড়ে মিলিয়ে যায় তিন বন্ধু। দু’হাত দূরের কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না আজ, অমন কুয়াশা পড়েছে। কোনওমতে হেঁচড়ে নেমে আসে পুকুরপাড়ে। নজরে আসে আবছা আগুন। লখু সামান্য দূরে আলাদা আগুন করে পাশে বসে রয়েছে। দেঁতো হেসে বলে, “যদি কেউ জ্বালিয়ে দেয়?”
পুকুরঘাটে সকালে বাসন নিয়ে নেমেছে হিরুর মা। হিরু পাড়ে দাঁড়িয়ে। “হ্যাঁ রে, পায়েসের বাটি আরেকটা কোথায়? তিনটে দিলাম না?”
“ও পেয়ে যাবে মা। লখু বাড়ি ঘুরে এলেই… রাতে নিজে না খেয়ে বাড়ি নিয়ে গেছিল। ওদের বাড়ি পায়েসে নাকি কাজু-কিশমিশ দেয় না।”
অলঙ্করণঃ অংশুমান
অলঙ্করণঃ অংশুমান