মনুষ্যেতর
হিমাংশু চৌধুরী
জঙ্গলের বুক চিরে রাতের অন্ধকারে ছুটে চলেছে ট্রেন। ঠায় দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে সামনে দেখছে ড্রাইভার তপন গিরি। নির্ধারিত সময়ের থেকে একঘণ্টা লেটে চলছে। সামনের লাইন ক্লিয়ার দেখে ট্রেনের স্পিড বাড়ায় তপন। এই লাইনটি অপরাধপ্রবণ হওয়ায় মাঝখানে কোথাও থামার পারমিশন নেই, আর সদাসতর্ক থাকতে হয়। লাইনে নাশকতার চেষ্টা হামেশাই হয়। আশেপাশের গ্রামবাসীরাই তার হোতা, আবার তারাই ত্রাতা। কোনও নাশকতার চেষ্টা হলেই কেউ না কেউ ঠিক খবর পৌঁছে দেয় রেলের অফিসে।
নয় নয় করে প্রায় তিরিশ বছর এই লাইনে ট্রেন চালাচ্ছে তপন। প্রাথমিকভাবে ইঞ্জিন রুমের সহকারী হিসেবে চাকরিতে জয়েন করেছিল। তখনও স্টিম ইঞ্জিন চালু ছিল। কয়লা ঠেলতে হত ইঞ্জিনে। ইঞ্জিন রুমে ঢুকে একঘণ্টা কাটালেই কালিঝুলি মেখে ভূত হয়ে বেরোতে হত। তারপরে ডিজেল এল। তপন ডিজেল ট্রেন চালানোর ট্রেনিং নিয়ে ড্রাইভার পদে প্রোমোশন পেল। সেই থেকে এই এন.জে.পি নিউ বঙ্গাইগাঁও রুটে সে মালগাড়ি চালায়। আজ অবধি কোনও ভুল সে করেনি তার কাজে।
হঠাৎ হেড লাইটের তীব্র আলোয় সে দূরে রেল লাইনের উপর কতগুলো কালো কালো ছায়া দেখতে পায়। এই লাইনে গাড়ি চালানোর এতদিনের অভিজ্ঞতা থাকায় সে সহজেই নির্ণয় করে ফেলে ছায়াগুলোর অর্থ। হাতির পাল লাইন ক্রস করছে। মোটামুটি একেকটা হস্তীযূথে বাচ্চাকাচ্চা মিলিয়ে তিরিশ থেকে সত্তরটা অবধি হাতি থাকে। এদিকের জঙ্গলে খাবার অমিল হলে তারা লাইন ক্রস করে উলটোদিকের জঙ্গলে যায়। মাঝের রেল লাইনটাকে তারা পাত্তাই দেয় না। আসলে তো জঙ্গল ওদেরই, আমরাই অনুপ্রবেশ করেছি ওদের জায়গায়, ভাবে তপন। তাড়াতাড়ি করে ব্রেক কষে সে, নয়তো অনিবার্য কলিশন। পাশে বসে ঢুলতে থাকা অ্যাসিস্ট্যান্ট রতন চমকে উঠে বলে, “কী হল, দাদা?”
তপন অস্ফুটে শুধু বলে, “হাতি।”
প্রায় ষাট কিলোমিটার গতিবেগ থেকে ধীরে ধীরে কমে এসে হাতির পালের থেকে মাত্র পঞ্চাশ গজ মতো দূরে এসে দাঁড়ায় ট্রেন। সামনেই লাইন দু’ভাগ হয়েছে। চুপ করে ওরা হেড লাইটের আলোয় বসে দেখতে থাকে ওদের রাস্তা পেরনো। ইন্টারকমে ফোন বেজে ওঠে ক্রিং ক্রিং। গার্ডসাহেব ফোন করেছেন পিছনের গার্ড কামরা থেকে। “কী ব্যাপার? গাড়ি হঠাৎ দাঁড় করালে কেন? সিগনাল গ্রীন আছে, তাও? কোনও অসুবিধে আছে?”
“স্যার, হাতির পাল লাইন ক্রস করছে।”
“কতক্ষণ লাগবে মনে হচ্ছে?” উদ্বিগ্ন হয়ে গার্ড অনিমেষ চক্রবর্তী জিজ্ঞাসা করেন। যেহেতু এলাকাটি অপরাধপ্রবণ, হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়া গাড়িতে ওয়াগন লুঠের ব্যাপার আগেও ঘটেছে, তাই উদ্বেগের কারণ স্বাভাবিক।
“এই আরও পাঁচ-দশ মিনিট স্যার।” রতন উত্তর দেয়।
“বেশি দেরি হলে জানিও, আমি এখনই লাইন ট্রিপ করছি না তাহলে।”
একটা লাইন থেকে ট্রেন পাস হয়ে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লাইনে সিগনাল রেড হয়ে যায়। সেই সময়ে যদি উলটোদিকের কোনও ট্রেন আসার থাকে, তবে সেই ট্রেন গ্রীন সিগনাল পায়। এই স্বতঃক্রিয় ব্যবস্থাটি সাধারণত কোনও জংশনের আগে থাকে। তপনের গাড়ি সেই জংশনটি পেরিয়ে এসেছে, স্বাভাবিকভাবেই উলটোদিকের সিগনাল খুলে যেতে পারে। এখনই কোনও ট্রেন আসার নেই, তাই রক্ষে, তা নাহলে অ্যাক্সিডেন্টের আশঙ্কা থাকত। এখন যদি দেরি হয়, তাহলে গার্ডসাহেবকে ম্যানুয়ালি সিগনাল ওভার রাইড করতে হবে, যাতে পিছন বা সামনে, কোনও দিক থেকেই ট্রেন এসে ঢুকে না পড়ে। সিঙ্গল লাইনের এই এক অসুবিধা।
হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ শুনে চমকে ওঠে ওরা। তাকিয়ে দেখে, একটা ছোট্ট হাতি লাইন যেখানে ভাগ হয়েছে, সেখানে দাঁড়িয়ে ঊর্ধ্বমুখে শুঁড় তুলে আওয়াজ করছে। সবক’টি হাতিই পেরিয়ে গেছে লাইন, তারা পাশেই জঙ্গলের ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের ছায়াকালো অবয়ব দেখা যাচ্ছে। শুধু একটা হাতি, পুচকেটার মাই হবে নিশ্চয়ই, এদিক ওদিক করছে। একবার পুচকেটার কাছে এসে ঠেলাঠেলি করছে, একবার সাথীদের দিকে তাকাচ্ছে। ছানাটাও পরিত্রাহি চিৎকার করে চলেছে। সম্ভবত সে পায়ে কোনও চোট পেয়েছে অথবা লাইনে পা আটকে গেছে। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা হাতির পাল খানিকক্ষণ নিঃস্পৃহ ভঙ্গিতে এদের দেখে মুখ ঘুরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল।
তপন একবার ভোঁ বাজাল। বাচ্চাটা চঞ্চল হয়ে উঠল; মা লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে অসহায়ের মতো তাকাল, তারপর ধীরে ধীরে জঙ্গলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
“কী করবে, দাদা?” রতন জানতে চায়।
ইশারায় রতনকে চুপ করতে বলে তপন গার্ডসাহেবকে ফোন করে জানাল এই নতুন পরিস্থিতির খবর। অনিমেষ চক্রবর্তীও বললেন, “তাহলে কী করবে এখন?”
“একবার নেমে দেখি কী হয়েছে। আপনি সিগনাল রেড করুন।”
অনিমেষ গার্ড কম্পার্টমেন্ট থেকে একটা লম্বা লোহার তার বের করে সিগনাল লাইনের দুটো তারের উপর ফেলে লাইন ট্রিপ করে দিলেন সাথে সাথে। সিগনাল রেড হয়ে গেল। না হলে লাইনে অন্য ট্রেন ঢুকে যেতে পারে। এরপরে ফোনে কন্ট্রোল কেবিনে খবরটা পৌঁছাতে গিয়ে দেখলেন মোবাইলের সিগনাল নেই। অগত্যা উনিও চুপ করে বসে রইলেন তপনের ফোনের অপেক্ষায়।
খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে মা হাতিটা একটু শান্ত হবার পরে তপন টুল বক্সটা খুলে দেখল রেঞ্চ, বড়ো হাতুড়ি, প্লায়ার্স এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি আছে কি না। সেগুলো যথাস্থানে আছে দেখে ও এবার ড্রাইভার কেবিনের কোনায় রাখা একটা লোহার শাবল হাতে তুলে নিল। রাতবিরেতে বিপদে পড়লে লাগবে বলে এগুলো এই লাইনের সব ট্রেনেই একটা করে রাখা থাকে।
ফোনে অনিমেষকে জানিয়ে দিল এগিয়ে আসতে, আর রতনের হাতে টুল বক্স দিয়ে সন্তর্পণে ট্রেন থেকে নামল তপন। খুব আস্তে আস্তে তারা এগিয়ে গেল বাচ্চাটার দিকে যাতে মা হাতি, যে তখনও লাইন থেকে একটু দূরে জঙ্গলের ধারে অপেক্ষা করছে, সে যেন না ভাবে বাচ্চার কোনও ক্ষতি হবে। বাচ্চাটা একটু চুপ করেছিল, তপনদের এগোতে দেখেই আবার চিৎকার করতে শুরু করল। ওর মাও একটু ছটফট করতে লাগল, কিন্তু নিজের জায়গা ছেড়ে এগোল না। তপনরা একটু থেমে, একটু হেঁটে ধীরে ধীরে অকুস্থলে পৌঁছাল। ততক্ষণে গার্ডসাহেব অনিমেষবাবু আর আর.পি.এ-এর সিকিউরিটি দু’জনও কী ব্যাপার বুঝতে ট্রেন থেকে নেমে এসেছেন।
তপন সামনে পৌঁছে দেখে, বাচ্চা হলেও হাতিটার একটা প্রমাণ সাইজের গরুর মতো আয়তন। অবশ্য তার হাবভাব বাচ্চারই মতন। তপনকে দেখে করুণভাবে তাকাল তার দিকে। ফোকলা শুঁড়টা নাড়িয়ে চঞ্চলতা প্রকাশ করল। তপন দেখে, বাচ্চাটার চোখের কোল থেকে একটা জলের ধারা নেমে এসেছে। যেখান থেকে লাইন ভাগ হয়েছে তার ভি আকৃতির ফাঁকের মধ্যে তার পিছনের একটা পা ঢুকে আটকে গেছে। ছাড়ানোর জন্য টানাটানি করতে গিয়ে জখম হয়ে কেটে গিয়ে রক্তও বেরিয়েছে বেশ খানিকটা। আহা রে, কত কষ্টই না পাচ্ছে বাচ্চাটা!
চট করে তপন ভেবে নেয় কী করতে হবে। এটা হল রেলের পরিভাষায়, পয়েন্ট জংশন। অটোমেটিক সিগনালিং ব্যবস্থা এই লাইনে আছে, যদিও খুব কম ট্রেনই এই লাইন দিয়ে যায়, যার বেশিরভাগই আবার গুডস ট্রেন। ফোনের সিগনাল থাকলে কন্ট্রোল রুমে জানালে তারা ওখান থেকে সিগনাল ডাউন করে এই লাইনটা আলগা করতে পারত। কিন্তু এদিকে কন্ট্রোল রুম দশ কিমি দূরে। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দু’ঘণ্টা লেগে যাবে। তপন জানে, আধঘণ্টার মধ্যে সামনের জংশন থেকে লাইন চেঞ্জ করে সাইড লাইনে না ঢুকলে উলটোদিক থেকে ডাউন সরাইঘাট আসছে, বিরাট দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
গার্ডসাহেব অনিমেষবাবু আর সিকিউরিটিদের ও বুঝিয়ে বলল, কী করতে যাচ্ছে, আর কেন। ডিপার্টমেন্টাল এনকোয়ারি হবে নিশ্চিত, সেখানে যাতে কেউ ফেঁসে না যায়, তার জন্য সব ব্যবস্থা করে রাখা আর কী। সবাই মিলে তাদের ফোনে ফটো তুলে রাখল আটকে পড়া বাচ্চা হাতিটার। এরপরে তপন কাজে নেমে পড়ল।
প্রথমে হাতুড়ি দিয়ে ও লাইনের পাশের পোস্টে লাগানো মোটর বক্সটা ভেঙে মোটরটা ম্যানুয়ালি অফ করল। এই মোটরটাই পয়েন্ট জংশন কন্ট্রোল করে। এটা চালু থাকলে কাজটা হাজার গুণ কঠিন হয়ে যাবে। এরপরে বড়ো রেঞ্চটা বের করে দু’জনে মিলে ধরে অনেক কষ্ট করে ফিশ প্লেটের বল্টু চারটে আলগা করে শাবলটা দিয়ে সবাই মিলে চাড় দিতেই এক মিনিটের মধ্যে সাইড রেলটা সরে এল, আর পুচকেটা নিমেষে পা ছাড়িয়ে দৌড়াল মায়ের দিকে।
মায়ের কাছে পৌঁছানোর পরে মায়ের যে কী আদর ওকে! শুঁড় বুলিয়ে বুলিয়ে গোটা গায়ে আদর করল, আর বাচ্চাটা মায়ের পেটের নিচে ঢুকে পড়ল। এই স্বর্গীয় দৃশ্য দেখে কী তৃপ্তি যে পেল, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না ওরা কখনও।
তারপরে মায়ে-পোয়ে মিলে ওদের দিকে তাকিয়ে একবার শুঁড় তুলে যেন অভিবাদন জানিয়ে আস্তে আস্তে জঙ্গলে ঢুকে গেল বারে বারে পিছন পানে চাইতে চাইতে। রাতের জঙ্গলে চাঁদের আবছা আলোতেও তাদের চোখের কৃতজ্ঞতার ভাষা পড়তে তপনদের কোনওই অসুবিধে হল না।
এরপরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। গার্ডসাহেব আর রতন ট্রেন লাইন ধরে মাইলটাক হাঁটার পরেই ফোনের লাইন পেয়ে গেলেন। কন্ট্রোল রুমে খবর দেওয়া হলে তারা একঘণ্টার মধ্যে নিকটবর্তী স্টেশন থেকে ট্রলি করে গ্যাংম্যান আর অন ডিউটি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে পাঠিয়ে দিল। দু’ঘণ্টার মধ্যে সব রিপেয়ার হয়ে লাইন ক্লিয়ার হয়ে গেল। ডাউন সরাইঘাট তখন আগের স্টেশনে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস ফেলছে।
তপনদের জন্য একটা রুটিন ইনভেস্টিগেশন হলেও রেলদপ্তর বনসম্পদ রক্ষা করার দৃষ্টান্তমূলক কাজের জন্য তপনকে পুরস্কৃতও করে এরপর। কিন্তু তপনের কাছে সেরা পুরস্কার মা আর বাচ্চা হাতিটার সেই শেষ চাউনিটা। মনুষ্যেতর হয়েও ওরা যেভাবে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল, মানুষও ওভাবে কৃতজ্ঞতা জানাতে পারে না।
অলঙ্করণঃ রাহুল মজুমদার
২০১৯ কলকাতা বইমেলা উপলক্ষ্যে অনন্যা ও অরুণাংশু দাশ আয়োজিত গল্প প্রতিযোগিতার পুরস্কৃত গল্প।
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস