সৌগত সেনগুপ্ত
সে অনেকদিন আগের কথা। একটা ছোট্ট ছেলে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকত কলকাতা শহর থেকে একটু দূরে, যাকে বলে শহরতলীতে। কলকাতা শহরে আসতে হলে তাদের ট্রেনে চড়তে হত। ছেলেটার বাবা কাজ করতে যেত উলটোদিকে, অনেক দূরে গ্রামের মধ্যে একটা ছোট্ট ইস্টিশনে। সেখানে যেতে লাগত দু’ঘণ্টা আর চড়তে হত কয়লার ইঞ্জিনে টানা ট্রেনে। কোনও দিন সাত-সক্কালে তার বাবা বেরিয়ে যেত আর ফিরতে হয় অনেক রাত, নয়তো রাত পার করে পরের দিন। কখনও আবার দু’দিন বাদেও ফিরত। ছেলেটা তার মায়ের কোলে বসে বসে ট্রেন গুনত আর ভাবত, এই পরের ট্রেনেই বাবা এল বুঝি।
শীতকাল এলে দু’গুণ মজা। ঠাণ্ডায় কষ্ট হয় বটে, কিন্তু আনন্দও অনেক। ইস্কুল ছুটি হয়ে যাবে পরীক্ষার পরে, তারপর আর পড়াশোনা নেই। বাবা বাড়ি থাকলে পরের ক্লাসের অঙ্ক করাতে নিয়ে বসে ঠিকই, তা ওটুকু করতে আর কতক্ষণ লাগে। শেষ করেই একরাশ ছবির বইয়ের মধ্যে ডুবে যাওয়া—হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টে, বাঁটুল। এমনিতে হাসির গল্প, কিন্তু নেংলুকার কলা নিয়ে যাওয়ার গল্পটা পড়লেই চোখ উপচে জল আসে। বইগুলো নিয়ে আসে কাকা, দমদম স্টেশন থেকে। আর আছে ছবিতে রামায়ণ, আর ছবিতে মহাভারত। ওগুলো আনে বাবা, বারাসত স্টেশনের বইয়ের স্টল থেকে।
শীতের দিনে একটা ছুটির দিন দেখে বাবা-মায়ের হাত ধরে যেতে হবে কলকাতায়। বেড়াতে। সেদিনটা বাবার ছুটি নাও থাকতে পারে। হয়তো বারো বা চব্বিশ ঘণ্টা টানা কাজ করার পর সকালবেলা বাড়ি ফিরেই স্নান করে মুখে দুটো খাবার গুঁজে বেড়িয়ে পড়া। বাসে চড়লে ছেলের বমি হয়, তাই ট্রেন। একটু দেরি করে বেরোলে অফিসের ভিড় নেই। ক’টা স্টেশন পেরিয়ে ট্রেন পৌঁছাবে শিয়ালদা। শিয়ালদা থেকে বারো নম্বর ট্রাম। ঘড় ঘড় করতে করতে উড়ালপুল পার করে ডানদিকে ঘুরে সোজা চলে আসে ধর্মতলা, ট্রাম খালি হয়ে যায়। ওরাও নেমে পড়ে। বাবা বলেছে, এখান থেকে ময়দান শুরু, সামনে উঁচু শহিদ মিনার। আগে নাম ছিল অক্টারলোনি মনুমেন্ট।
এসপ্ল্যানেড স্টেশন থেকে থেকে মেট্রো-রেলে চড়ে ওরা। বাবা বলে পাতালরেল। ছোটো ছোটো কার্ডবোর্ডের টিকিট, লোকাল ট্রেনের মতোই। একজন ইউনিফর্ম পরা লোক দাঁড়িয়ে আছে গেটের সামনে। একটা চিমটির মতো যন্ত্র দিয়ে টিকিটগুলো ফুটো করে দিচ্ছে। বাবা দুটো টিকিট কেটেছিল। লোকটা বলল, ওরও টিকিট লাগবে। বাবা তাড়াতাড়ি গিয়ে একটা টিকিট কেটে আনল। ওমা, ওর টিকিটটা লোকটা হাত দিয়ে ছিঁড়ে দিল! বাবা-মার টিকিটে কী সুন্দর একটা ত্রিভুজের মতো ফুটো। ওর বেলাতেই কেমন এবড়োখেবড়ো। খুব রাগ হয়ে গেছিল, মার হাত ধরে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল।
একটু এগিয়েই তিনটে চলমান সিঁড়ি। সিঁড়ি আবার চলে নাকি? এই জিনিস নাকি কলকাতায় নতুন। বাবা-মা এর আগে দিল্লিতে চড়েছে। এবারে ওর পালা। ইংরিজি নামটাও বাবা বলেছে, এসক্যালেটর। কী দারুণ জিনিস, দুটো সিঁড়ি উপরের দিকে উঠছে আর একটা নিচের দিকে নামছে। বাবা ওর হাত শক্ত করে ধরে সিঁড়িতে উঠে পড়লেন। তুরতুর করে সিঁড়ি ওদের নিচের প্লাটফর্মে পৌঁছে দিল। মাঝখানে প্লাটফর্ম দু’দিকে লাইন। পাশাপাশি দুটো, না না, তিনটে লাইন। একদম ধারেরটায় বিদ্যুৎ চলে, আর তার জোরেই মেট্রোর চাকা ঘোরে। উপরে সাদা বোর্ডে লেখা এসপ্ল্যানেড। নিচে দুটো তিরচিহ্ন দিয়ে লেখা চাঁদনি চক আর পার্ক স্ট্রিট।
আনন্দমেলা থেকে বাবা পড়ে শুনিয়েছে, দমদম থেকে টালিগঞ্জ পর্যন্ত চলবে এই পাতাল রেল। আপাতত এসপ্ল্যানেড থেকে টালিগঞ্জ পর্যন্ত চালু হয়েছে। একটু দাঁড়াতেই সুন্দর হলুদ সবুজ রঙের ট্রেন এসে গেল। ট্রেনের দরজা বন্ধ। ওরা উঠবে কী করে? ট্রেন থামতেই দরজা খুলে গেল। ওরা উঠে বসলেই ঘোষণা হল, দরজা বন্ধ করা হচ্ছে।
ট্রেন দৌড়ে অন্ধকারের মধ্যে ঢুকে পড়ল। সুড়ঙ্গে মাঝে মাঝে আলো জ্বলছে। পার্ক স্ট্রিট, ময়দান হয়ে ট্রেন রবীন্দ্র সদন স্টেশনে এসে দাঁড়াল। ওরা এখানেই নামবে। বাবা বুঝিয়ে দিল, ওদের মাথার উপরে ছিল ময়দান। গর্ত খুঁড়ে সুড়ঙ্গ বানিয়ে পাতাল রেল চালানো হচ্ছে। ওরা নামতেই ঘোষণা করে ট্রেন ছেড়ে চলে গেল টালিগঞ্জের দিকে। এসপ্ল্যানেড স্টেশনে ছিল পুরনো কলকাতার ঘরবাড়ির ছবি। রবীন্দ্র সদন স্টেশনে দেখল রবীন্দ্রনাথের লেখা আর আঁকা ছবি।
ও তো রবীন্দ্রনাথের নাম শুনে একবারেই চিনতে পারল। চিনবে না কেন? পিসি যে এবারের জন্মদিনে শিশু বইটা উপহার দিয়েছে। রোজ একটা করে কবিতা শোনা চাই ওর। এখানে চলমান সিঁড়ি নেই, হেঁটে হেঁটে উপরে উঠে আসে ওরা।
এইবারে বাবা আসল গন্তব্য ফাঁস করে। ওরা যাবে বইমেলাতে। রাস্তা পার করে একটা ঘেরা জায়গায় ঢুকে পড়ে তিনজনে। বাবা চিনিয়ে দেয় শিশির মঞ্চ, তথ্যকেন্দ্র। নন্দনের সামনে গিয়ে চিনিয়ে দেয়, এটা সত্যজিৎ রায়ের ভাবনা থেকে বানানো। পুরোটা জলের উপরে। তখন মৃণাল সেনের ‘বাইশে শ্রাবণ’ ছবিটা চলছে। পুকুরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বাঁদিকে রবীন্দ্র সদনও দেখিয়ে দেয় বাবা।
রাস্তার উলটোদিকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল দেখা যাচ্ছে। যদিও আজকে ওরা যাবে না। মা আঙুল তুলে পরি দেখায়। কখনও দমকা হাওয়ার ঘোরে।
রাস্তা পার হয়ে বইমেলায় ঢোকে ওরা। সারি সারি দোকান চারদিকে। ল্যাম্প-পোস্টে মাইক বাঁধা, তাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে।
একটা দোকান থেকে নতুন বাঁটুল আর হাঁদা-ভোঁদা কেনা হল ওর। কাকা শেষ যত পর্ব এনে দিয়েছে তারও পরে এটা বেরিয়েছে। মাথা উঁচু করে দোকানটার নাম দেখে নিল ও, দেব সাহিত্য কুটির। আরেকটা দোকানের উপরে লেখা, আনন্দ। কী ভিড় সেখানে! লোকজন লাইন করে ঢুকছে।
বাবা-মা ওই ভিড়ে ঢুকল না। তার পাশ দিয়ে অন্য আরেকটা দোকানে এসে হাজির হল, যার উপরে লেখা, পত্রভারতী। দু’পাশে দুটো নন্টে-ফন্টের ছবি আঁকা। সেখান থেকে কেনা হল নতুন নন্টে-ফন্টে। সঙ্গে একটা কমলা রঙের পেন পাওয়া গেল। পেনটা ও পকেটে রাখবে ভেবেছিল। কিন্তু মা নিয়ে ব্যাগে রেখে দিল। ও নাকি হারিয়ে ফেলবে।
এরপর একটা বড়ো স্টলে ঢোকা হল। বাবা একটা অভিধানের পাতা উলটিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখতে শুরু করল। মাও রান্নার বই নেড়েচেড়ে দেখছিল। ও মায়ের হাত ছাড়িয়ে একটু ভিতর দিকে দেখতে পেল অনেক রংচঙে ছবির বই সাজানো একটা টেবিলে। ওমা, এগুলোর একটাও ওর পড়া নেই যে!
সেই টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ছবির বই দেখতে দেখতে ঠিক কতক্ষণ পার হয়েছে খেয়াল করেনি ছেলেটা। আচমকা খেয়াল হওয়াতে এদিক ওদিক তাকিয়েও চেনা কাউকে দেখতে পেল না। না বাবা, না মা! শুধু টেবিলের উলটোদিকে একজন দাড়িওয়ালা মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আন্দাজে বুঝল, ওর জ্যাঠামশায়ের মতো বয়স হবে। ভদ্রলোক ওকে অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করেছেন আর ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছেন।
স্টলের বাকি এলাকা একপাক ঘুরে এসেও বাবা-মাকে খুঁজে পেল না। কী করবে ভাবতে ভাবতে দেখে, ওই জেঠুটা হাতছানি দিয়ে ডাকছেন ওকে।
“তাহলে কী হল? তুমি হারিয়ে গেলে?”
“আমি কেন হারাব? আমার বাবা-মা হারিয়ে গেছে।”
“তুমি কী করে তাঁদের খুঁজে পাবে?”
“ওরাই খুঁজুক না! আমি তো কোথাও যাচ্ছি না। আমাকে ওই বইটা তাক থেকে পেড়ে দাও তো!”
বাবা-মার খোঁজ ভুলে ও তখন জেঠুর কাছে বইয়ের আবদার করছে।
ভদ্রলোক বেশ মজা পান। স্টল ঘুরে তখন তাঁর পাশেই এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর দুই মেয়ে। ও দেখতে পায় বইয়ের প্যাকেট নিয়ে দুই দিদি। ঠিক যেন ওর বড়দিদি আর মেজদিদির মতো। বড়দিদিটা প্রশ্ন করে, “তুমি কোথায় থাকো?”
গড়গড় করে বাড়ির ঠিকানা বলে একেবারে পিনকোড পর্যন্ত বলে থামে। তারপর পাল্টা প্রশ্ন করে, “তুমি কোথায় থাকো?”
“আমরা তো থাকি অনেক দূর, রাঁচিতে। তুমি রাঁচি জায়গাটার নাম শুনেছ?”
“আমার মাসি-মেসো রাঁচিতে থাকতেন শুনেছি। কিন্তু রাঁচি তো অনেক দূর, ট্রেনে করে যেতে হয়। তোমরা কলকাতায় কোথায় থাকো?”
“আমরা ঠিক কলকাতায় থাকি না, আমরা থাকি হাওড়াতে। তুমি হাওড়া চেনো?”
“হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে করে আমরা পুরী যাই!”
এবার জেঠু ও দুই দিদির হেসে ওঠার পালা।
***
ওদিকে মা আর বাবা আলাদা হয়ে পড়েছিল। দু’জনেই ভাবছে ছেলে অন্যজনের সঙ্গে রয়েছে। একটা স্টলের সামনে দু’জনের দেখা। দু’জনের মুখ থেকে এক সঙ্গে বেরিয়ে এল, “ছেলে কোথায়?”
“ছেলে তো তোমার সঙ্গে ছিল!”
“না তো, আমি তো অভিধান দেখছিলাম। ছেলে তোমার সঙ্গে ছিল!”
“মোটেই না! ছেলেকে তোমার কাছে দিয়েই আমি রান্নার বই দেখছিলাম।”
“রান্নার বই দেখতে গিয়েই ছেলেকে হারালে? এখন কোথায় খুঁজে পাব?”
“চলো ওই স্টলে গিয়ে দেখি।”
“তার চেয়ে বরং অফিসে গিয়ে ঘোষণা করাই।”
***
এমন সময় ঘোষণা শোনা যায় ছেলেটার নামে। মেলাসুদ্ধু লোক সেই ঘোষণা শুনতে পান। কেউ ভাবেন, কী অপদার্থ বাবা-মা, ছেলেকে আগলে রাখতে পারে না!। কেউ ভাবেন, ইস, কী হবে গো, ছোটো বাচ্চা হারিয়ে গেছে। কেউ আবার তাঁদের বাচ্চাদের বলেন, ‘হাত শক্ত করে ধরে থাক, নইলে হারিয়ে যাবি!’ ছোটো বাচ্চারা ভাবে, হারিয়ে গেলে তো বেশ হয়, মাইকে নিজের নাম শোনা যায়।
ওদিকে সেই স্টলের মধ্যে সেই জেঠু আর দুই দিদিও সেই ঘোষণা শুনতে পান। ছেলেটাও শোনে। জেঠু বলেন, “চলো, তোমার বাবা-মা খোঁজ করছেন। তোমাকে অফিসে নিয়ে যাই।”
সেই ছেলে তো গোঁ ধরে আছে যাবে না, সে তো হারিয়ে যায়নি। বাবা-মাই তো হারিয়ে গেছে। অগত্যা দুই মেয়ের কাছে সেই ছেলেকে রেখে তার বাবা-মাকে খবর দিতে অফিসের দিকে এগিয়ে যান জেঠু।
ফিরে এসে তিনজনে দেখেন নতুন পরিচয় হওয়া দুই দিদির সঙ্গে দিব্যি জমিয়ে গল্প করছে ছেলেটা। এর মধ্যে রিঙ্কু আর টিঙ্কু দুই দিদিকে ডাকতেও শুরু করে দিয়েছে। বাবা-মাকে দেখতে পেয়ে প্রথম কথা ছিল, “যাক খুঁজে পেয়েছ তাহলে। আমি তো ভাবছিলাম দিদিদের সঙ্গে জেঠুর বাড়ি চলে যাব!”
ছোটো ছেলের মুখে এরকম পাকা পাকা কথা শুনে সবাই হেসে ওঠেন। মা চোখ কটমট করে তাকাতে ছেলেটা আরও হেসে বলে, “তুমি কী রান্নার বই কিনলে গো মা? এত মনযোগ দিয়ে দেখছিলে যে আমি যে পাশে নেই খেয়ালই করনি?”
এবার মা অপ্রস্তুত। নতুন জেঠু সামাল দিলেন, “আপনার ছেলে কিন্তু খুব স্মার্ট! হারিয়ে গিয়েও একটুও ঘাবড়ে যায়নি। এমনকি যখন আমরা অফিসে নিয়ে যেতে চাইলাম আমাদের সঙ্গে গেল না, পাছে আমরা অন্য কোথাও নিয়ে যাই!”
জেঠুর পরিচয় পাওয়া গেল। তাঁর নাম ডঃ জ্যোতিকিরণ দাশ। উনি একটা বহুজাতিক সংস্থার কেমিক্যাল ল্যাবরেটরিতে কাজ করেন। কাজের সুবাদে ওঁকে হিল্লি-দিল্লি ঘুরে বেড়াতে হয়। তাঁর দুই মেয়ে তাই তাদের মাসির বাড়ি রাঁচিতে থেকে পড়াশোনা করে। যাওয়ার আগে জেঠুকে যে বইটা পেড়ে দিতে বলেছিল সেই বইটা ওকে উপহার দিয়ে গেলেন। বাবা-মা কারোর আপত্তি শুনলেন না।
তারপর অনেক বছর কেটে গেছে। এখন ছেলেটা একা-একাই বইমেলায় যায়। রিটায়ার করার পরে জেঠু এখন একটা লিটল ম্যাগাজিন চালান। বইমেলা গেলেই তাই দেখা হয়। আর সেই দুই দিদির এক দিদি রিঙ্কু আমেরিকা, আর অন্যজন টিঙ্কু ইউরোপে। আমেরিকা থেকে ছোটোদের জন্য অনেক অনেক লেখাও লেখেন রিঙ্কুদি। তোমরা কি সেসব লেখা পড়নি?
২০১৯ কলকাতা বইমেলা উপলক্ষ্যে অনন্যা ও অরুণাংশু দাশ আয়োজিত গল্প প্রতিযোগিতার পুরস্কৃত গল্প।
অলঙ্করণঃ মৌসুমী
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস
Sundor
LikeLike