অনন্যা ও অরুণাংশু দাশ আয়োজিত গল্প প্রতিযোগিতা’২০১৯ আফশোস সুদীপ জোয়ারদার শীত ২০১৯

সুদীপ জোয়ারদার

সায়ন একে এইট, তার উপর পৌষসংক্রান্তির মেলাটা বসে বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে। এই দূরত্ব হেঁটেই যাওয়া যায় এবং যে রাস্তা দিয়ে যেতে হয় সেটাতে গাড়িঘোড়াও কম। তাছাড়া যাবেও ওরা তিনজন। সুতরাং বাড়ি থেকে একা মেলা দেখতে যাওয়ার আর্জি মঞ্জুর না হবার কোনও কারণ নেই। সায়নের সঙ্গী প্ৰসাদ আর বিরু। ওরাও এইট এবং একই স্কুল। মেলা দেখার জন্য সায়ন বাড়ি থেকে পঞ্চাশ টাকা পেয়েছে। কিছু জমানো ছিল। তাই দিয়ে সায়নের হাতে এখন একশো এগারো টাকা। প্রসাদ-বিরুকে দেখে মনে হচ্ছে ওদেরও এ বাবদে পকেট বেশ ভারীই। রাস্তায় নেমে সায়ন বিরুদের একটা প্রস্তাব দিল। মেলায় খাবার জন্য পঞ্চাশ টাকা করে দিয়ে একটা ফান্ড করলে কেমন হয়! সায়নের প্রস্তাবে বিরু-প্রসাদ সঙ্গে সঙ্গে রাজি। তবে সায়ন যেহেতু বিষয়টার প্রস্তাবক, তাই দেড়শো টাকার দায়িত্বটা ওকেই নিতে হল।

মেলাটা বেশ বড়ো। প্রতিবারই এই মেলায় আসা হয়। তবে এবারে প্রথম সবাই বাড়ির লোক ছাড়া। তিনজনের মনেই তাই বেশ একটা অন্যরকম অনুভূতি। মেলায় ঢুকে প্রসাদ বলল, “খাব পরে, আগে মেলাটা ঘুরে নিই।”

বিরু বলল, “তা কি হয়! আগে অন্তত একটা করে পাঁপড় খেয়ে নিই।”

সায়ন পকেট থেকে পাঁপড়ের টাকা বের করল। তিনটে পাঁপড় তিনজনে দাঁড়িয়ে খেল বেশ তৃপ্তি করে।

মেলাতে বেশ ভিড়। সামনে গঙ্গা। ওখানে স্নান করবার ধুম এই অবেলাতেও। যদিও ঠাণ্ডা কিন্তু খুব। একটা কনকনে হাওয়াও দিচ্ছে। সোয়েটার জ্যাকেট ওরা তিনজনেই পরে এসেছে। কিন্তু সায়ন টুপিটা আনেনি। এখন টুপির অভাবটা বোঝা যাচ্ছে।

“খাবি নাকি একটা করে চপ?” তেলেভাজার দোকানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে সায়ন শুধোয় বন্ধুদের।

“খাব পরে। আগে চল নাগরদোলায় চাপি।” বিরু বলে।

মেলার একপাশে নাগরদোলা বসেছে। কুড়ি টাকা করে টিকিট। সায়ন বলে, “আমার নাগরদোলা চাপলে ভয় করে। তোরা চাপ।”

এটা খাবার বাইরে, তাই খরচটা ফান্ড থেকে নয়। বিরু আর প্রসাদ টাকা হাতে নিয়ে নাগরদোলার দিকে এগিয়ে যায়। সায়ন একটা ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়ায়। চড়তে ভয় লাগলেও নাগরদোলার ওঠানামা দেখতে ভালোই লাগে। সায়ন দেখছিল একমনে। হঠাৎ গায়ে একটা হাত ঠেকতে ও তাকায় পিছনে। এক বুড়ি লাঠি হাতে ভিক্ষা চাইছে। সায়ন একটা টাকা বের করে বুড়ির হাতে দেয়। কিন্তু কেমন যেন চেনা লাগছে বুড়িকে। বুড়িও তাকিয়ে আছে সায়নের দিকে।

“আরে গৌরীদিদা!” হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে সায়ন।

বুড়ির মুখে হাসি। সায়নের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “ভালো আছ দাদু? লোকের বাড়ি আর তো কাজ করতে পারি না, তাই এই চেয়েচিন্তে… মা-বাবা কেমন আছে?”

সায়ন গৌরীদিদার এই অবস্থা দেখে অবাক। আস্তে আস্তে বলে, “ভালো, সবাই ভালো আছে।”

“আচ্ছা, আমি কাজ ছাড়ার সময় চায়নাকে দিয়ে এসেছিলাম। ও-ই আছে, না অন্য কেউ?” গৌরীদিদা শুধোয়।

সায়ন বলে, “হ্যাঁ, চায়নাদিদিই আছে। আচ্ছা দিদা, তোমার এই অবস্থা, তুমি একবার যেতে তো পারো আমাদের বাড়ি।”

গৌরীদিদা বলে, “আমি তো এখানে থাকি না দাদু। মেয়ের বাড়ি কলতলি। ওখানেই থাকি, ভিক্ষে করি। পৌষসংক্রান্তির এই মেলায় প্রতিবার আসি। তাই এসেছি এবারেও।”

সায়ন বলে, “কিন্তু মা যে বলে তোমার মেয়ের অবস্থা ভালো। তাহলে ভিক্ষে কেন!”

গৌরীদিদা ফ্যাকাশে মুখে বলে, “এককালে ভালো ছিল যখন জামাই বেঁচে ছিল। অকালে চলে গেল ছেলেটা। তারপর থেকে মেয়ে লোকের বাড়ি কাজ করে আর আমি এই…”

নাগরদোলায় বিরুদের পাক শেষ। এদিকে গৌরীদিদাও ভিক্ষা চাইতে অন্য লোকের কাছে। সায়ন আবার বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে থাকে মেলায়। খাবার ছাড়াও মেলায় নানান জিনিসের দোকান। বিরু একটা দোকানে ঢুকে একটা কলমদানি পছন্দ করে। কিন্তু দাম শুনে সঙ্গে সঙ্গে রেখে দেয়। ওখান থেকে ও অবশ্য খালি হাতে বেরোয় না। নানা জিনিসের দরদাম করে শেষপর্যন্ত একটা দু-মুখো ডটপেন কিনে বাইরে আসে।

এক জায়গায় পোস্টার বিক্রি হচ্ছে। প্ৰসাদ ব্যাট হাতে বিরাট কোহলির পোস্টারটা কুড়ি টাকা দিয়ে নেয়। ওরা আরও কয়েকটা জিনিস ঘুরে ঘুরে কেনে। যেমন বিরু ছোটো ভাইয়ের জন্য বেলুন, মাটির পুতুল, প্রসাদ দিদির জন্য মাথার ক্লিপ।

“তুই কিছু কিনলি না?” ওরা দু’জনেই শুধোয় সায়নকে।

সায়ন বলে, “এসব কিনে পয়সা নষ্ট করে কী হবে?”

“চল খাই এখন কিছু।” প্ৰসাদ বলে।

“কী খাবি?” সায়ন শুধোয়।

“মোগলাই খেলে কেমন হয়!” বিরু বলে।

প্রসাদও মোগলাইয়ের দিকে। তিনজনে মোগলাইয়ের দোকানে হাজির হলে সায়ন দুটো মোগলাইয়ের অর্ডার দেয়।

“কী রে, তুই খাবি না!” বিরু, প্রসাদ দু’জনেই আশ্চর্য।

“না রে। আমার পেটটা কেমন ব্যথা ব্যথা করছে। যা, খাবার তোরা দু’জনেই খা।”

“তাহলে পাপড়ের টাকা বাদ দিয়ে তোর টাকা তুই তুলে নে।” প্রসাদ মোগলাই খেতে খেতে বলে।

পাঁপড় বাদে নিজের খাওয়ার টাকাটা অনেকক্ষণ আগেই ফান্ড থেকে তোলা হয়ে গিয়েছে। সেটা আর সায়ন বলে না। কারণ, বললে ও নিয়ে অনেককিছুই হয়তো বলতে হবে। সবকথা এই মুহূর্তে ওদের বলতে ইচ্ছে হয় না। প্রসাদের কথায় শুধু ‘ঠিক আছে’ বলে মৃদু হাসে।

মেলা থেকে ফেরার সময় সায়ন আরেকবার গৌরীদিদাকে খোঁজে। কিন্তু এত ভিড়ে আর খুঁজে পায়? গৌরীদিদাকে মেলা দেখার প্রায় সবটা টাকা দিয়েও কিন্তু সায়নের মন ভার। আসলে মনের মধ্যে পাক খাচ্ছে একটা আফসোস। কেন যে মেলায় ঢুকেই পাঁপড়টা খেতে গেল! না হলে তো গৌরীদিদাকে আরও তিনটে টাকা…

অলঙ্করণঃ মৌসুমী

২০১৯ কলকাতা বইমেলা উপলক্ষ্যে অনন্যা ও অরুণাংশু দাশ আয়োজিত গল্প প্রতিযোগিতার পুরস্কৃত গল্প।

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s