অপূর্ব বোসের ডায়েরি
অনুপম দত্ত
এক
“কী রে বাপ্পা! অঙ্ক বইয়ের নিচে লুকিয়ে কী পড়ছিস? অ্যাসটেরিক্স?”
বাপ্পা একগাল হেসে ঘুরে তাকিয়ে বলল, “আরে অপুকাকা! চেন্নাই থেকে কবে ফিরলে? তোমার পিএইচডি হয়ে গেছে? পুজো অবধি আছ তো? গতবার কিন্তু ফাঁকি দিয়েছ। এবার একসঙ্গে প্রসেশন দেখতে যাব কিন্তু!”
অপুকাকা বাপ্পার তক্তপোশে আয়েশ করে বসে মিটমিটিয়ে হাসতে হাসতে বলল, “ক্লেভার বয়! একগাদা প্রশ্ন করে আমাকে আনমনা করে দিয়ে ঠিক অ্যাসটেরিক্সটা ড্রয়ারে চালান করে দিলি! এভাবে অপুকাকার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবি ভেবেছিস?”
বাপ্পাও মুচকি হেসে বলল, “তুমি ধরে ফেলবে জানতাম। নাও পড়ো। এটা বাবা কালকেই এনে দিয়েছে। যাই, মাকে চা দিতে বলে আসি। বেগুনি খাবে?”
অপুকাকা ততক্ষণে অ্যাসটেরিক্সে মজে গেছে। অন্যমনস্কভাবে ঘাড় নাড়ল। বাপ্পা দুদ্দাড় সিঁড়ি ভেঙে একতলায় রান্নাঘরের দিকে ছুটল।
বাপ্পা চন্দননগর কানাইলাল বিদ্যামন্দিরে পড়ে। ক্লাস নাইন, রোল এইট। ফার্স্ট-সেকেন্ড না হলেও বরাবরই প্রথম দশের মধ্যেই থাকে। ওদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় অরিত্র ঘোষ প্রায় সব সাবজেক্টেই হায়েস্ট নম্বর পেলেও অঙ্কে বরাবরই তমাল মিত্র, মানে বাপ্পাই সবচেয়ে বেশি নম্বর বাগিয়ে নেয়। আর এজন্যই বোধহয় অপুকাকা ওকে এত পছন্দ করে।
অপুকাকাও কানাইলাল বিদ্যামন্দিরেই পড়ত, আর অঙ্কে ভীষণই ভালো ছিল। অঙ্ক-স্যার বামাপদবাবু এখনও অপুকাকার কথা উঠলে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। হবেন নাই বা কেন? মাধ্যমিকে একশোয় একশো, উচ্চমাধ্যমিকে দু’শোয় একশো নিরানব্বই, প্রেসিডেন্সি থেকে অনার্সে রেকর্ড নম্বর নিয়ে পাশ করে চেন্নাই ম্যাথমেটিকাল ইন্সটিটিউটে গবেষণা। এমন ছাত্রকে নিয়ে গর্ব হবে না! উমাপদবাবু এখনও সুযোগ পেলেই বলেন, “আমার সেট করা পেপারে যেদিন দিবাকর পঁচানব্বই পেল সেদিনই আমি জানতাম ও একদিন বড়ো ম্যাথমেটিশিয়ান হবে। ওর পরের জনের নম্বর কত ছিল বল তো। বাহান্ন! ভাব! আর কুশলও অঙ্কে যথেষ্ট ভালো ছেলে ছিল কিন্তু। বাট, দিবাকর ইজ ক্লাস অ্যাপার্ট।”
দিবাকর মিত্র, মানে অপুকাকা নাকি বর্তমানে টোপোলজি নিয়ে কী একটা জটিল রিসার্চ করছে। বছরে একবার পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি আসে। বাপ্পাদের বাড়ির উলটোদিকেই ওদের বাড়ি। বাপ্পার বাবা আর মা অপুকাকাকে খুবই ভালোবাসেন। আর বাপ্পাও। কাকা বললেও অপুকাকাকে আসলে একটু বড়ো দাদা বলেই মনে করে ও। অপুকাকা যখনই বাড়ি আসে, বাপ্পার জন্য কয়েকটা কমিক্সের বই নিয়ে আসে। আর অপুকাকা জানে বাপ্পা অ্যাসটেরিক্স পড়তে ভীষণ ভালোবাসে। তাই ওটা একটা থাকেই। তবে অপুকাকার সঙ্গে এত ভাব হওয়ার আরও একটা কারণ আছে। সেটা অবশ্য বাপ্পা কাউকে বলবে না। অপুকাকা একটা খুব গোপন রিসার্চ করছে। না, অঙ্ক নয়। ইতিহাস। প্রত্নতত্ত্বও বলা যায়।
প্রায় বছর তিনেক আগে একটা গরমের ছুটিতে বাপ্পা প্রথম এটা জানতে পারে। বেশ ফুরফুরে হাওয়া আসছে গঙ্গার দিক থেকে। ও আর অপুকাকা স্ট্র্যান্ডে বসে কুটকুট করে বাদামভাজা খাচ্ছে আর ওপাড় থেকে রওনা দেয়া লঞ্চটাকে দেখছে। হঠাৎই অপুকাকা ওর দিকে ঘুরে দুম করে প্রশ্ন করল, “তোর কী মনে হয়, বরুণদেবই দায়ী?” বাপ্পা ভ্যাবলার মতো চেয়ে আছে দেখে মিচকি হেসে বলল, “ও, তোকে তো সবটা বলাই হয়নি। দাঁড়া, বাদামটা শেষ করে এক প্লেট করে মোমো খাব। তারপর বাড়ি ফিরে বুঝিয়ে বলব। ডায়েরিটাও দেখাতে হবে, নাহলে বুঝতে পারবি না।”
দুই
অপুকাকা চোখ বুজে বেগুনি চিবোচ্ছিল। এতক্ষণ মা বসে ছিল বলে বাপ্পা কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেনি। আরেক রাউন্ড চা-বেগুনি আনতে মা এইমাত্র নিচে গেছে। বাপ্পা অপুকাকার গা ঘেঁষে বসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “মানাহুয়ার মুকুটের খোঁজ পেলে? গতবছর বলেছিলে একটা সূত্র পাওয়া গেছে। কী সূত্র?”
“গনগনির নাম শুনেছিস?”
“গ-গন… সেটা কী জিনিস?”
“কী নয় রে বোকা, বল কোথায়। রূঢ় শিল্পাঞ্চল মুখস্থ করছিস, তুন্দ্রার জলবায়ু জানিস অথচ ঘরের কাছের গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের খবর জানিস না! পশ্চিম মেদিনীপুরে শিলাই নদীর তীরে গনগনি। নদীর ক্ষয় কাজে ওখানে অপূর্ব প্রাকৃতিক ভাস্কর্য রচিত হয়েছে। মেদিনীপুর টাউন থেকে ঘন্টা খানেক লাগে। কাল তোর স্কুল ছুটি না? সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ব, বুঝলি।”
বাপ্পা কোনও প্রশ্ন করার আগেই অপুকাকা ঠোঁটে আঙুল চাপা দিয়ে চোখের ইশারা করল। মা চায়ের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকছে।
তিন
সেবার স্ট্রান্ড থেকে বাড়ি ফিরে অপুকাকা বাপ্পাকে ওর পড়ার ঘরে নিয়ে গিয়ে একটা ধূসর ডায়েরির পাতা খুলে এক জায়গায় আঙুল দেখিয়ে বলেছিল, “পড়।”
বাপ্পা দেখল কাঁপা কাঁপা ক্ষুদে অক্ষরে বাংলায় লেখা—‘মায়াবন্দর আসিয়াছি আজ তিন দিবস হইয়া গেল। প্রফেসর জিমেকের উল্লিখিত বাংলোটি এখনও খুঁজিয়া পাই নাই। সম্ভবত উহা ঝড়ে বিনষ্ট হইয়াছে। কাহাকেও জিজ্ঞাসা করাটাও খুব সহজ নহে। ব্রিটিশ পুলিসের সন্দেহ জাগ্রত না করিয়া খোঁজখবর নেওয়া এমনিতেই কষ্টসাধ্য, তদুপরি মোয়াগের গুপ্তচক্র যে কী ছদ্মবেশে ঘুরিতেছে তাহা চিহ্নিত করা খুবই দুষ্কর…’
বাপ্পার মুখ-চোখ দেখে অপুকাকা বুঝেছিল যে ও একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছে। ডায়েরি মুড়ে রেখে বলেছিল, “না, আগে আরও কিছু কথা তোকে বলতে হবে। নাহলে বুঝতে পারবি না।
“ইতিহাসে হিটলারের কথা পড়েছিস নিশ্চয়ই। ক্ষমতার মোহে উন্মাদ হয়ে জার্মানির চ্যান্সেলর হিটলার তখন গোটা পৃথিবীটাকেই গিলে খেতে চাইছে। ওর সঙ্গে জুটেছে আরেক হিংস্র ক্ষমতালিপ্সু ইতালির মুসোলিনি। রাশিয়া আর ইংল্যান্ডের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য নিত্যনতুন অস্ত্রের আবদারে হিটলার ওর সেনাপ্রধানদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলছে। আরেকটু বড়ো হলে এগুলো ভালো জানতে পারবি। আপাতত শুনে রাখ, হিটলারের ডানহাত হিমলারের নেতৃত্বে নাৎজি দলের মধ্যে এক গুপ্ত সংগঠন গড়ে উঠেছিল—আহনেনার্বে। অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে সঙ্গে এরা জাদুশক্তির খোঁজ পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। আসলে হিটলার খুব ভালোই জানত, ভয় দেখিয়ে ওরা চিরদিন জনগণকে ওদের অনুগত রাখতে পারবে না। আর জনসমর্থন না থাকলে গোটা বিশ্ব কেন, নিজের দেশকেই দখলে রাখতে পারবে না। আহনেনার্বের নজর একসময় পড়ল এই ভারতের পশ্চিম প্রান্তে, যেখানে একসময় সিন্ধুসভ্যতা গড়ে উঠেছিল।”
“কিন্তু… এখানে যে আন্দামান…”
“শোন না চুপ করে! ভিয়েনায় এক অপেরা হাউসে একদিন প্রফেসর কার্ল জিমেকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল হিমলারের। নাৎজি বাহিনী তখনও ক্ষমতায় আসেনি। তলে তলে শক্তি বাড়িয়ে চলেছে। প্রফেসর জিমেকের কাছে হিমলার প্রথম মানাহুয়ার মুকুটের কথা শোনেন। গোয়েটিংগেনের লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করতে করতে প্রফেসর জিমেক একদিন একটা খুব পুরনো সংস্কৃত পুঁথি পান। পুঁথিটি বৈদিক অঙ্কশাস্ত্রের। যদিও সুপরিচিত পুঁথিগুলোতে এর নাম পাননি তিনি। যাই হোক, রাতে ডিনারের পর পুঁথিটি পড়তে পড়তে একটা অনুচ্ছেদে এসে প্রফেসর জিমেক চমকে ওঠেন। ওখানে মানাহুয়ার মুকুটের কথা বলা হয়েছে। এর ক্ষমতা নাকি অসীম। এর বলে বলীয়ান হয়েই নাকি শিম্ভিরালায় নেকড়েদের মোকাবিলা করেছিলেন মোয়াগ।
“বন্ধু ইতিহাসবিদদের সঙ্গে কথা বলে প্রফেসর জিমেকের ধারণা হয় যে এই শিম্ভিরালা হল সিন্ধু নদ আর মোয়াগ আর্য অধিপতি। হিমলারকে প্রফেসর বলেন যে মানাহুয়ার মুকুটের সন্ধান পেলে নিশ্চয়ই হিটলার জার্মানিকে একটা অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত করতে পারবেন।”
“তারপর?”
“অনেক রাত হয়ে গেছে। আজ আর না। বাড়ি যা। কাল বাকিটা বলব।”
পরেরদিন ও-বাড়িতে গিয়ে শোনে অপুকাকা নাকি খুব ভোরে চলে গেছে। হতাশ হয়ে ফিরে এসে পড়তে বসেছে, এমন সময় একটা মেসেজ এল—‘দিবাকরবাবুকে সাবধানে থাকতে বলবে।’
অচেনা একটা নম্বর থেকে এসেছে।
চার
সেকেন্ড রাউন্ড চা শেষ করে অপুকাকা বাপ্পাকে বলল, “চ’, একটু স্ট্র্যান্ড থেকে ঘুরে আসি।”
বাপ্পা তো তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। তার মানে গোপন কিছু নিয়ে কথা হবে। মাকে বলে তরতর করে সিঁড়ি টপকে নেমে রাস্তায় এসে দেখল অপুকাকা বাইকে চাবি গুঁজছে।
আইসক্রিমের খালি কাপটা ডাস্টবিনে ফেলে এসে অপুকাকা বাপ্পাকে জিজ্ঞেস করল, “আরেকটা খাবি?”
বাপ্পা মাথা নেড়ে না করতে বেঞ্চে বসে পা-দুটো ছড়িয়ে দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাসল।
“সেবার মেসেজটা পেয়ে খুব ভয় পেয়ে গেছিলি, না? আসলে আমিও একটু তাড়াহুড়ো করে চলে গেছিলাম, তোকে বলে গেলে ভালো হত। সেদিন তুই চলে যাওয়ার পরে খেয়েদেয়ে রাতে বারান্দায় পায়চারি করছি, এমন সময় দেখলাম গলির মুখের পানের দোকানে দাঁড়িয়ে সুধাকর পান কিনছে। তখনই ঠিক করি, ভোরে বেরিয়ে পড়তে হবে।”
“সুধাকর কে?”
বাপ্পার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অপুকাকা বলে চলে, “প্রায় বছর তিনেক আগের কথা। খবর পেলাম প্রফেসর অগুস্তো লেভি আমাদের ইন্সটিটিউটে লেকচার দিতে আসছেন। আমাদের মতো আহেলা রিসার্চ ফেলোদের কাছে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো অবস্থা। আবেলিয়ান ফাংশন নিয়ে ওঁর যুগান্তকারী কাজ সারা বিশ্বের অঙ্কবিদ মহলে সুপরিচিত। অন্য সাবজেক্টের বাঘা বাঘা গবেষকদের কাছেও উনি খুবই সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। মাত্র বত্রিশ বছর বয়েসে ফিল্ডস মেডেল পেয়েছেন। ইকোল নর্মাল সুপিরিয়রের চেয়ার প্রফেসরশিপ পঁয়ত্রিশে। টোপোলজির কোনও পেপার ওঁর সাইটেশন ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যাই হোক, হইহই করে সেমিনার হল। আমরা টুকটাক প্রশ্ন করলাম। উনি স্মিত হেসে সবার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন, জিজ্ঞেস করছেন কে কী বিষয়ে কাজ করছি, কোথা থেকে এসেছি।
“আমি চন্দননগরের ছেলে শুনে মনে হল উনি একটু থমকালেন, তবে তখন কিছু বললেন না। পরে ফেলিসিটেশন ডিনারে ওঁর সঙ্গে ভালো করে আলাপ হল। মনে হল উনি আমাকে কিছু একটা বলতে চাইছেন, কিন্তু সবার মাঝে ইতস্তত করছেন। ডিনার শেষে ওঁকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আসার পথে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি আমায় কিছু বলবেন প্রফেসর?’
“উনি একটু দোনোমনা করে বললেন, ‘ইয়ং ম্যান, যখনি শুনেছি তুমি চন্দননগরে থাকো তখন থেকেই মনে হচ্ছে, তুমিই পারবে। আচ্ছা, কাল তো তোমার ছুটি, দুপুরের দিকে একবার আমার রুমে এস। টু জিরো টু। আচ্ছা, কাল কথা হবে।’
“পরদিন প্রফেসর লেভি আমায় ওই ডায়েরিটা দেন, তুই দেখেছিস তো! ওই ডায়েরিটা কার জানিস? অপূর্ব বোসের নাম শুনেছিস? আচ্ছা, মেরীর মাঠের ধারে বোসভিলা তো দেখেছিস নিশ্চয়ই। খুবই প্রাচীন বাসিন্দা এখানকার। শুনেছি এই বংশের এক পূর্বপুরুষের একসময় লক্ষ্মীগঞ্জে বিশাল আড়ত ছিল। ইংরেজ, ফরাসি, ডেনিশ—সব ব্যবসায়ীদের সঙ্গেই ওঁর কারবার চলত। ওঁদের বাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজো চাউলপট্টির পুজোর প্রায় সমসাময়িক শুনেছি। মজার ব্যাপার হল, কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির সঙ্গেও নাকি দোস্তি ছিল তাঁর। তা এই বংশের ছেলে হয়েও অপূর্ব বোস ব্যাবসার দিকে গেলেন না। ফরাসি সরকারের একটা খুব নামকরা ফেলোশিপ নিয়ে চলে গেলেন প্যারিস। সেটা গত শতাব্দীর চারের দশকের কথা। প্রথমে ইকোল নর্মাল সুপিরিয়রে গবেষণা। তারপর সোজা গোয়েটিঙ্গেন। আর সে-সময় গোয়েটিঙ্গেনের কেমন রমরমা তোকে তো বলেছি। নারায়ণ সান্যাল মশাইয়ের বিশ্বাসঘাতক পড়েছিস? তাহলে ওখানকার পরিবেশ জানিসই। ওখানে পৌঁছেই অপূর্ববাবু প্রফেসর হিলবার্টের সুনজরে পড়ে যান। ওঁর তত্ত্বাবধানে কাজ করতে করতে একের পর এক পেপার পাবলিশ করেন সেই সময়ের নামজাদা সব রিসার্চ জার্নালে। সবাই ধরে নিয়েছিল যে আরেক রামানুজনকে পেতে চলেছে গণিতজগত। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে একদিন অপূর্ব বোস উধাও হয়ে যান। এক উইক-এন্ডে লং ড্রাইভে বেরিয়ে কোথায় যে হারিয়ে গেলেন! ইউনিভার্সিটির তরফে খোঁজার ত্রুটি হয়নি, বোস পরিবারের লোকেরাও ফ্রেঞ্চ অ্যাম্বাসিকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছিল বহুদিন। কিন্তু কোনও খোঁজই পাওয়া গেল না।”
“তাহলে ওঁর ডায়েরি কোথা থেকে পাওয়া গেল?”
“শোন না! প্রফেসর লেভি আমাকে বললেন, উনি এই ডায়েরিটা পেয়েছেন ইকোল নর্মাল সুপিরিয়রের লাইব্রেরির বেসমেন্টে একটা প্যাকিং বক্সের মধ্যে। উনি আমায় একটা অদ্ভুত কথা বলেন। এই অপূর্ব বোসের সঙ্গে নাকি একসময় প্রফেসর জিমেকের যোগাযোগ হয়েছিল। সেটা অবশ্য আশ্চর্যজনক কিছু নয়। দু’জনেই জার্মানির বিজ্ঞানী মহলে পরিচিত ব্যক্তিত্ব। তবে এই দু’জনই আহনেনার্বের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েছিলেন। তোকে তো বলেছি হিটলার তখন পাগলের মতো নতুন নতুন মারণাস্ত্রের খোঁজ করছে। অপূর্ব বোসের কাছে সিন্ধু সভ্যতার অবক্ষয় বিষয়ে জেনে প্রফেসর জিমেক নিশ্চিত হন যে কোনও প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, কোনও এক বিধ্বংসী অতীন্দ্রিয় শক্তি নিশ্চয়ই এই সভ্যতার ধ্বংসের কারণ। প্রফেসর জিমেক ভারতে গিয়ে এ ব্যাপারে অনুসন্ধান করবেন ঠিক করেন। বোসকেও সঙ্গে যেতে বলেন। কিন্তু মারণাস্ত্রের খোঁজ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে অপূর্ববাবুর ছিল না। তিনি রাজিও হননি। তবে এই ডায়েরিটা পাওয়ার পর মনে হচ্ছে তিনি পরে মত বদলেছিলেন। কিন্তু কেন?”
পাঁচ
‘ক্ষমতার লিপ্সায় অস্ত্র উদ্ভাবনের ইতিহাস অতি প্রাচীন। গ্রিক ফায়ার, মহাকাব্যে বর্ণিত বলা-অতিবলা, পাশুপত ইত্যাকার মারণাস্ত্রের কথা সকলেই জানি। হিটলারের ন্যায় ঘৃণ্য ব্যক্তিত্ব উহার সন্ধানে উন্মাদ হইবে ইহা আর আশ্চর্য কী! কিন্তু কার্লের ন্যায় বিজ্ঞানী উহাতে সহায়তা করিবে কেন? এই প্রশ্ন এককালে আমায় বিচলিত করিয়াছিল। গোয়েটিঙ্গেনে যখন অধ্যাপকের মেধার পরিবর্তে তাঁহার রক্তের বিশুদ্ধতাকে অধিক মান্যতা দেওয়া শুরু হইল, আমি তত্র স্থান ত্যাগ করিতে দুইবার চিন্তা করি নাই। কিন্তু আজ জিমেকের পত্র পড়িয়া বিষয়টি অন্যভাবে ভাবিতে বাধ্য হইলাম।’
বাপ্পা উত্তেজিত হয়ে বলল, “তার মানে অপূর্ববাবু জিমেককে পরে সাহায্য করেছিলেন? কিন্তু কেন?”
অপুকাকা মৃদু হেসে চায়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে ভাঁড়টা ডাস্টবিনে ফেলে এল। রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস ছাড়তে এখনও একটু দেরি আছে। ট্রেনে বেশ ভিড় হয়ে গেছে এর মধ্যেই। আজ ছুটির দিন। নাহলে আরও ভিড় হয়। ঠাণ্ডাটা এখনও বেশ হুল ফোটাচ্ছে। বাপ্পা মাফলার দিয়ে কানদুটো আরেকটু ভালো করে ঢেকে নিল।
“এই কথাটাই প্রফেসর লেভিও বললেন। উনি প্রফেসর বোসের কাজের বিশেষ গুণগ্রাহী, তাই বিষয়টা তাঁকেও বিচলিত করেছিল। ডায়েরিটা আমার হাতে তুলে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ইয়ং ম্যান, এই কাজটা দূর দেশে বসে করা যাবে না। আর এই ভাষাটাও আমি খুব ভালো বুঝি না। আমি চাই তুমি এ-ব্যাপারে একটু খোঁজখবর নাও। অপূর্ব বোস এই বিষয়ে জড়িয়ে পড়লে বিজ্ঞানের স্বার্থে, মানবতার কল্যাণেই তা করেছিলেন বলে আমার বিশ্বাস। এটা দেখো একটু। তবে খুব গোপনে কোরো কাজটা। কারণটা আমি বলছি না। তুমি নিজেই বুঝতে পারবে। আচ্ছা, সুধাকর রাও, মানে তোমার টিমেরই ওই ছোকরা, মানুষ হিসেবে কেমন? একটু বেশি গায়ে পড়া, না?”
“এই সুধাকরকে দেখেই তুমি গতবার চলে গিয়েছিলে না?”
অপুকাকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “হ্যাঁ, ও যে ওরকম সেটা আগে জানতাম না। তবে ও যেদিন আমার রুম থেকে ডায়েরিটা হাতানোর চেষ্টা করল, সেদিন থেকেই ওকে ফলো করে গেছি। ও চুনোপুঁটি, তবে ওর পেছনে যারা আছে তাদের অবহেলা করা ঠিক হবে না। এই ওঠ ওঠ, গড়বেতা এসে গেছে!”
বাপ্পা আর অপুকাকা গনগনিতে পৌঁছে হাঁ হয়ে গেল। প্রকৃতি যখন ছেনি হাতুড়ি হাতে নেয় তখন এরকম ভাস্কর্যই বোধহয় জন্ম নেয়। সুন্দর, কিন্তু একটা ভয়ের আভাসও প্রতিটা গুহাকন্দরে যেন অপেক্ষা করছে। নদী অনেক নিচে এলিয়ে আছে। চারপাশে লোকজন মোবাইলে ছবি তুলতে ব্যস্ত। অপুকাকা বাপ্পাকে নিয়ে কাজুবাদামের জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। এখান থেকে আড়াবেড়ির জঙ্গল খুব দূরে নয়। যদি হাতি আসে! অপুকাকার অবশ্য সেসব চিন্তা আছে বলে মনে হচ্ছে না। দূরে দূরে কিছু লোক দেখা যাচ্ছে। কোমরে কাটারি গুঁজে শুকনো পাতা জড়ো করে বোধহয় আগুন জ্বালানোর তোড়জোড় করছে। অপুকাকা একবার দেখে আবার চলতে শুরু করল। ওরা কাজুবাগান পাহারা দিচ্ছে। চোরছ্যাঁচড় আসতে পারে, মাঝেমধ্যে হাতির দলও এদিকে ছিটকে চলে আসে। এরা তখন ফরেস্টের লোকদের খবর দেয়, মশাল জ্বেলে হাতি খেদাতে লেগে পড়ে।
“আয়, এখানে।”
মন্দিরটা ছোট্ট। সর্বমঙ্গলা মন্দিরের জাঁকজমক কিছু নেই। দিনান্তে একবার প্রদীপ জ্বালানো হয় হয়তো। এখন বোধহয় বুড়ো পুরোহিত সেজন্যই মন্দিরে ঢুকেছে। পুজো শেষ হওয়া পর্যন্ত অপুকাকা একটা গাছের নিচে পা ছড়িয়ে বসে ছোটো একটা নোটবুক বের করে কীসব লিখল। বাপ্পা নদীর ধারটা ঘুরে এল একবার। ফিরে দেখে অপুকাকা নোটবুক বন্ধ করে উঠে দাঁড়িয়েছে। বুড়ো পুরোহিত মন্দিরের বারান্দায় এসে সপ্রশ্ন চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।
“নমস্কার বাড়ুজ্জ্যেমশাই! আমি দিবাকর মিত্র, আর ও বাপ্পা, মানে তমাল। আপনি আমার চিঠি পেয়েছিলেন তো?”
“হ্যাঁ, কিন্তু আপনি অপূর্ব-স্যারের ব্যাপারে উৎসাহী হলেন কেন বুঝতে পারছি না। স্যার সারাজীবন আমাদের গড়বেতা স্কুলে অঙ্ক করিয়ে গেছেন। আমি লেখাপড়া বেশিদূর করতে পারিনি, তবে আমাদের ক্লাসের বিশ্বনাথ ভালো রেজাল্ট করে বিদেশে আছে, কোন একটা কলেজে নাকি পড়ায়। মাঝেসাঝে দেশে এলে ও স্যারকে দেখতে আসত। এছাড়া কাউকে স্যারের খোঁজ নিতে দেখিনি। স্যার যেদিন মারা গেলেন, আমরা ক’জন দাহ করতে নিয়ে গেলাম শ্মশানে। কী দুর্যোগ সেদিন! স্যারের পরিবার-পরিজনও কেউ ছিল বলে মনে হয় না। ওই তো, বিডিও অফিসের কাছে ছোটো একটা ঘরে ভাড়া থাকতেন। থাকার মধ্যে ছিল এক বাক্স বই আর ক’টা জামাকাপড়। আসুন, রাত হয়ে আসছে। এখন আর জঙ্গলে থাকা নিরাপদ নয়। একটা খ্যাপা শেয়াল নাকি বেরোচ্ছে রোজ। চলুন, কাছেই আমার বাড়ি।”
রাতটা ওরা গড়বেতা কলেজের কাছে একটা লজে কাটিয়ে দিল। লজের লাগোয়া রেস্তোরাঁয় ডিনার। মুগডাল, আলু-পোস্ত আর দেশি মুরগির ঝোল। আহ্! বাপ্পা ঘুমিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত অপুকাকাকে দেখেছে একটা খাতা বাগিয়ে বালিশে উপুড় হয়ে আছে। আধো ঘুম আধো জাগরণে বাপ্পার কানের কাছে কে যেন বিড়বিড় করছিল, ‘টরব্লেডনাম… টরব্লেডনাম…’
ছয়
আন্দামানে প্রায় দুই সপ্তাহ কাটাইয়াও জিমেকের বাংলোর হদিস করিতে পারিলাম না। হতাশভাবে আর্মেনিয়ান জেটির নিকটে বসিয়া আছি, এমন সময় এক দীর্ঘদেহী সন্ন্যাসী আসিয়া পাশে বসিলেন। “মানাহুয়ার মুকুটের সন্ধান করছিস কেন?”
“আ-আপনি কীভাবে জানলেন?”
“জিমেককে ওরা হত্যা করেছে। তোর ওপরও নজর রাখছে, সাবধান।”
আমি আশ্চর্য হইয়া সন্ন্যাসীকে পুনঃ পুনঃ জিমেকের কথা জিজ্ঞাসা করিতে তিনি আমায় নিকটস্থ এক নির্জন শ্মশানে লইয়া গেলেন। ম্লান চন্দ্রালোকে তাঁর চোখ জ্বলজ্বল করিতেছিল। যাহা শুনিলাম তাহাতে আমার অন্তরাত্মা শুকাইয়া গেল।
তখন দিল্লীর তখতে বাদশাহ আকবর। একদিন এক পারস্যদেশীয় মিশকিন দরবারে আসিয়া বাদশাহের সহিত একান্তে আলাপ করিবার প্রার্থনা করেন। তিনি বাদশাহকে এক দুর্লভ পুঁথি প্রদান করেন। পুঁথিটি তিব্বত হইতে কোনও এক ভারতীয় শ্রমণ আনিয়া ছিলেন। তাহাতেই মানাহুয়ার মুকুটের উল্লেখ ছিল। প্রাচীনকাল হইতে বেশ কয়েকবার এই মুকুটের সাহায্যে দুর্দম সেনার আহ্বান করা হইয়াছিল। ইহারা অজেয়, ক্রুর, অবিনাশী। সিন্ধু সভ্যতা এদের হাতেই ধ্বংস হয়। স্কন্দগুপ্ত হুণদের বিতারণকালে ইহাদের জাগ্রত করিয়াছিলেন বলিয়াও শোনা যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইহাদের সংবরণ করিবার বিদ্যা কালের গর্ভে হারাইয়া গেছে। অতি প্রাচীনকাল হইতে এক গুপ্ত সংগঠন ইহার খোঁজে সসাগরা ধরণী তোলপাড় করিতেছে। এই সংগঠন অতীব গোপনাচারী ও শক্তিশালী। ইহারা যদি এই বিদ্যা আয়ত্ব করিতে পারে, তবে পৃথিবীর ধ্বংস হওয়া মুহূর্তেকের অপেক্ষামাত্র। তবে ইহাদের প্রতিরোধ করিবার জন্য এক সংগঠনের কথাও শোনা যায়। কালপুরুষগণ। ইহারা যুগে যুগে দেশে দেশে এই গুপ্ত বিদ্যার সন্ধানকারীদের উপর নজর রাখিয়া চলিতেছে। সন্ন্যাসী তাহাদেরই একজন। তিনি আমায় এই সংগঠনে যোগ দিতে বলিয়াছেন। আমি সম্মত হইয়াছি। যাহাই মানবজাতির পক্ষে শুভ, তাহার সহিত আমি আমৃত্যু থাকিব।
অপুকাকার চোখ চকচক করছিল। গঙ্গার জলে অপূর্ব বোসের ডায়েরির পাতাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে ভাসিয়ে দিতে দিতে বলল, “মানাহুয়ার মুকুট কী তা আমায় জানতেই হবে। প্রফেসর লেভি আমায় একবছরের জন্য ইকোল নর্মাল সুপিরিয়রে ডেকেছেন। রিসার্চের ফাঁকে ফাঁকে বাকি সময়টা এই কাজেই কাটিয়ে দেব। হয়তো বাকি জীবনটাই।”
“আমি? আমাকেও এই কাজে নাও না!”
“না রে বাপ্পা। তোকে এখনও আরও অনেক পড়াশোনা করতে হবে। এই ডায়েরি আমার মাথায় ধরা আছে। তুই যদি মাধ্যমিকে অঙ্কে একশোয় একশো পাস, তাহলে তোকে গোটাটা বলব। আপাতত বলে রাখি, এর একটা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হল টরব্লেডনাম। কিছু বুঝলি? আচ্ছা, আমার ঘরে পেনরোজের এম্পারার্স নিউ মাইন্ড থেকে ম্যান্ডেলব্রট সেটটা দেখে নিস।”
হাওড়া লোকালের জানালা থেকে হাত নাড়তে নাড়তে অপুকাকা বাপ্পাকে বলল, “মনে রাখিস, বিজ্ঞান আমাদের বিপুল শক্তির অধিকারী করে তুলতে পারে। কিন্তু তার ব্যবহার শুভকাজে হচ্ছে কি না সেটা দেখাটাও বিজ্ঞানীর দায়িত্ব। অন্তত আমি এই দায়িত্ব এড়াতে পারব না। চলি, মন দিয়ে পড়াশোনা করিস। আর মনে রাখিস, অঙ্কের মধ্যে জীবন আর জীবনের মধ্যে অঙ্ক লুকিয়ে আছে। টা টা। পরেরবার তোকে মানাহুয়ার মুকুটের কাহিনি বলব।”
ছবি শিমুল
চমৎকার লাগলো। এক নিঃশ্বাসে পড়লাম। টানটান গল্প, গল্পবলার বৈঠকী শৈলী দুটোই ভালো।
LikeLike
অত্যন্ত তথ্যবহুল লেখা। কিন্তু তাতে গল্পের গতি একটুও আটকায়নি। মুকুটের স্বরূপ জানার অপেক্ষায় রইলাম।
LikeLike