ছেলেবেলার দিনগুলো ভালো কাটে না অনেকেরই। বিবিধ কারণেই,স্কুলের বছরগুলো অনেকেরই অসুখী হয়। হয় পড়ায় ভালো নয় সে, নয় শরীর খারাপ তার। অনেক সময় শরীর খারাপের দরুনই সে পড়াশোনায় পিছিয়ে থাকে। মনের পর্দা নামিয়ে আনতে সময় লাগে। আদৌ নামে কিনা জানি না।
আজ অবধি আমার জীবনের কাহিনি খানিকটা সেই রকমই। আমার জন্ম আজ থেকে প্রায় ৫২ বছর আগে কলকাতার থিয়েটার রোডের প্রাক্তন মেট্রোপলিটন নার্সিং হোমে। বছরের মাঝখানে,বর্ষার আগমনে আমি জন্মেছিলাম। জীবনের প্রথম পাঁচ বছর অসুস্থতায় কেটেছে।
স্টিয়াটোরিয়া নামের এক অসুখে প্রায়ই জ্বরে ভুগতাম। লোয়ার ইনটেসটাইন কাজ না করার ফলে এই অসুখ। সেদ্ধ খাবার ছাড়া কিছুই খেতে দিতেন না ডাক্তারবাবুরা। শেষে তৎকালীন প্রসিদ্ধ গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট, ড কমল জালানের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। তাঁর সাহায্যে আর চিকিৎসায় আমি বেশ খানিকটা সেরে উঠি। পাঁচ বছর বয়সে প্রথম যখন অমলেট আর পরোটা খাই তার গুণ বর্ণনা করে আমার ঠাকুরদাদা বসন্তকুমার দে-কে অতিষ্ঠ করে তুলেছিলাম বোধহয়।
অল্প বয়স থেকে আমার দিদি উর্মিলা আর আমি কুকুর এবং বেড়াল,দুইই খুব ভালোবাসি। বিশেষ করে কুকুর,কারণ তারা আমাদেরকে ঘিরে থাকে। ‘মানুষের পরম বন্ধু’ কথাটা যে কতটা সত্যি তা একটা কুকুরকে ঘরে না আনলে বোঝা যায় না। একজন অসুস্থ সন্তানের জীবনে একটা কুকুরের ঠিক কতটা অবদান থাকতে পারে তাও বোঝা কঠিন যদি না ঘরে একটা কুকুর নিয়ে আসা হয়। সেরকমই আমার জীবনে এসেছিল আমার বোন ইগলু। মা রমা আর বাবা বরুণের মুখে তাদের বাল্যকালের কুকুর প্রিন্স, রুবি আর ব্ল্যাকির গল্প শুনে বড়ো হয়েছি। দাদামশাই বারীন্দ্রকুমার দত্ত গুপ্ত আর দিদিমা রানি দত্ত গুপ্তের কুকুর দম্পতি, জার্মান শেফার্ড,প্রিন্স আর তার সহধর্মিনী রুবি এবং তাঁদের সাতটি সন্তানের কীর্তির গল্পে ছোটোবেলার দিনগুলো ভরিয়ে রাখতেন মা। প্রিন্সের চোরের হাতে বিষ খেয়ে মর্মান্তিক মৃত্যু আর রুবির বার্ধক্যের গল্পের মাধ্যমে আমি চিনতে শিখেছি ১৯৫০-এর দশকের কলকাতার সচ্ছল মধ্যবিত্ত জীবনের পরিকাঠামো।
এছাড়াও ১৯৪০-এর দশকে আদ্রায় একজন ভারতীয় রেল আধিকারিকের ঘরে একটি ছোটো বিলিতি কুকুর স্প্যানিয়ালের জীবনীও আমাকে কুকুরদের প্রতি বিশেষ অনুরাগী করে তোলে। ব্ল্যাকি আমার ঠাকুরমা, প্রমীলা দে-র, কুকুর। সাদা কালোয় মেশানো গায়ের রং তার। সে খুব বেশিদিন বাঁচেনি বোধহয়। বাবা ব্ল্যাকির বিষয়ে, এর চেয়ে বেশি গল্প আমাকে কখনো বলেননি। তার চলে যাওয়ার পর ঠাকুরদাদার অফিশিয়াল বাংলোর বাগানের এক কোনায় তাকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৮০-র মাঝামাঝি বাবা আদ্রায় শেষবার ফিরে যান বাগানটাকে আর একবার দেখে আসবার জন্য।
কাজের চাপে বেশ কিছুদিন মা কুকুর রাখবেন না বলে মনস্থির করেছিলেন। কিন্তু কুকুর প্রেমিক পরিবার আমরা। ঘরে কুকুর না এনে থাকা যায় নাকি? ১৯৮৫ সালের জুন মাসে ইগলু আসে আমাদের জীবনে। আমার ১৭ বছরের জন্মদিনের দিন। তার নিজের জন্ম ১৮ মার্চে। তার প্রায় তিন মাস বয়সে আমি তাকে প্রথম দেখি।
বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ট্যাক্সি থেকে মার কোলে নামতে দেখি তাকে। প্রথমে খানিকটা উত্তেজিত হয়ে পড়ি। ছোট্ট,সাদা-কালোয় মেশানো,এই অদ্ভুত প্রাণীটি আমাকে তৎক্ষণাৎ অভিভূত করে তোলে। শুধু আমাকে নয়, বাড়ির আর সকলকেই। পাশের বাড়ির মিসেস কোহলি আর তাঁর দুই কন্যা, যারা কিছুদিন বাদেই যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায়,তারাও ছুটে আসে ইগলুর সঙ্গে আলাপ করতে। এস্কিমোদের বাড়ির ইগলুর মতন দেখতে এই তিব্বতের কুকুর লাসা অ্যাপসো।
গুগলুর ছোটো বোনও বটে। তাই ঠিক হয় তার নাম দেওয়া হবে ইগলু। ভালো নাম হবে জীজাবাঈ। মা রমাবাঈয়ের নামের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে। অবশ্য ওর ভালো নাম ম্যাড্রাস কেনেল ক্লাবে কখনো লেখানো হয়নি, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও।
ইগলু এসেছে শোনা মাত্র দাদামশাই কড়া গলায় বলে উঠলেন, “কুকুর রাখলে তার যত্ন নিতেই হয়। তার পরিচর্যা ভুললে চলবে না; এবং গ্রুমিং, রোজ হাঁটাতে নিয়ে যাওয়া, দিনে তিনবার ঠিক পরিমাণে মাংস আর ওষুধ মিশিয়ে দুধ খেতে দেওয়া।” জানিয়ে দিলেন এসব নিয়ম পালন করতেই হবে। তা নইলে কুকুরকে ঘরে নিয়ে আসা নিষিদ্ধ।
কুকুরদেরকে তাদের মা-বাবা-ভাই-বোনদের থেকে বিচ্যুত করে,কোনো এক অপরিচিত পরিবেশে আর নতুন পরিবারে নিয়ে আসার দাম হল প্রায় প্রতিটি মুহূর্তে তাদের মায়েদের অভাব পূরণ করা। তাদেরকে জানানো যে তাদের দুঃখের কোনো কারণ নেই, তাদের নতুন আত্মীয়স্বজনরা তাদের পুরোনো আত্মীয়দেরই সমান। ইগলুর জীবনের বিবরণ দেওয়া এখানে আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার উদ্দেশ্য পাঠকদের জানানো কেমন করে আমার এই বোন আমাকে স্বনির্ভর করে তুলেছে। আজ হয়তো সে আর সশরীরে নেই। কিন্তু প্রতিটি মুহূর্তে আমি তাকে স্মরণ করি। আমাদের বাগানের সেই কোণটি,যেখানে সে ঘুমিয়ে আছে,সেদিকে চেয়ে চেয়ে তার আশীর্বাদ প্রার্থনা করি।
লেখার শুরুতেই জানিয়েছি নিজের শারীরিক অসুস্থতার দরুন স্কুলের পড়ায় দুর্বলতার কথা,বিশেষ করে অংকে। স্কুল জীবনে অংকে গোল্লা, ক্লাসে শুধু আমারই বরাদ্দ ছিল। যে একজন প্রাণী আমাকে এই কঠিন বছরগুলিকে উত্তীর্ণ করতে সাহায্য করেছে সে নিঃসন্দেহে ইগলু। আমার জীবনে একটা নতুন দিশা দেখিয়েছে সে। কীভাবে একজন ছোটো অবলা প্রাণীকে আমি ভালোবাসা দিতে পারি আর সেই সম্পর্কের থেকে মনের জোর পেতে পারি তা ইগলুর সঙ্গে সাড়ে তেরো বছর থেকে আমি শিখেছি। অসহায় হওয়া যে পাপ নয়,তা ইগলু তার ব্যবহার দিয়ে আমাকে বুঝিয়েছে। ইগলুর যত্ন নিতে গিয়ে – বিশেষ করে ১৯৯৫ সালে গরমের ছুটিতে যখন মা-বাবা প্যারিসে যায় তখন – আমি শিখেছি কীভাবে আর একজন প্রাণীর ভার নিতে হয়, যেমন তাকে রোজ নিয়ম করে খাওয়ানো, সঙ্গ দেওয়া, ঘুম পাড়ানো, ইত্যাদি। আর তার বিনিময়ে আমার মন খারাপ হলেই ইগলু দৌড়ে এসে আমার পায়ের আঙুলে কুট করে চেটে যেত। তাতে আমার মন খানিকটা ভালো হতো বইকি।
এই সূত্রে একটা গল্প বলি। রোজ রাতে বসবার ঘরের কার্পেটে বসে ইগলুকে চামচে করে দুধ খাওয়ানোর ভার ছিল বাবার। খেতে গন্ডগোল করত রোজই। আকাশের দিকে গাল ফুলিয়ে চেয়ে বসে থাকত। বাবা যে তার মহামূল্য মার্কসবাদী বইগুলোকে বন্ধ রেখে ওকে আদর করে দুধ খাইয়ে দিচ্ছেন, ও কি তা বুঝত? একদিন ভীষণ রেগে বাবা চেঁচিয়ে উঠে বললেন, “দেখো ইগলু, তুমি যদি দুধ না খাও, তবে লোরেটো হাউসের সিস্টারদের বলে তোমাকে ক্লাস ৫ থেকে ক্লাস ৪-এ ডিমোট করিয়ে দেব।”
আশ্চর্য বিষয়, ইগলু এই কথা শোনা মাত্র তড়িঘড়ি চুকচুক করে দুধ খেতে শুরু করে দিল। শান্ত স্বভাবের ইগলু বাড়ি থেকে বেরোতে খুব একটা ভালোবাসত না। বেশি উত্তেজিত হয়ে গেলে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অথবা ঠাকুরদাদার সোফায় বসে অথবা মা বা বাবার মাথার পাশের বালিশের আড়াল থেকে মুখ বার করে কলিং বেলের আওয়াজে খুক খুক করে চেঁচিয়ে যেত মাত্র। হাসি আসত ওর এই কুঁড়েমিতে। পরে জেনেছি সব লাসা অ্যাপসোদের একই কাজ। গত ২০০০ বছর ধরে এই কাজই ওরা করে আসছে তিব্বতের মনাস্ট্রিগুলোতে। তাই ওদেরকে ইনটিরিয়র সেন্টিনেল (অন্দরমহলের প্রহরী) নামে ডাকা হয়।
বাইরের জগতের প্রতি বিশেষ আগ্রহ না থাকায় ইগলু দিশিদের প্রতি বেশ নারাজ ছিল। তোয়াক্কা করত না তাদেরকে। রাস্তায় হাঁটতে গেলে মুখ ফিরিয়ে,নরম ভেজা নাকখানা উঁচিয়ে চলে যেত। ১৯৮০ আর ১৯৯০-এর দশকের কলকাতায়,মার্কসবাদী চিন্তাধারার প্রেক্ষাপটে,তার এরকম আচরণ বোঝা কঠিন। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাড়ির কুকুরের পক্ষে চারধারের বস্তির কুকুরদের সঙ্গে ভাব জমানো আর মার্বেল নিয়ে খেলা করাটাই তো ঠিক। এ-বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে যে আমার এই এলিটিস্ট বোনটি আমার ব্যক্তিগত চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়ে উঠেছিল। ইগলুর শেষ বয়সটা কষ্টে কেটেছে। নানান ব্যাধি ছিল তার। বিবাহিত জীবনের সুখ ও পায়নি কখনো। তবু ওর মিষ্টতা শেষ দিন পর্যন্ত অক্ষত ছিল। ঘোর অসুখেও ওকে কারুর উপর মেজাজ দেখাতে দেখিনি। আমার বোনপোকে কম ভালোবাসা দেখায়নি। কুকুরেরা শিশুদের প্রতি সবসময়ই সদয় থাকে। এক্ষেত্রে ইগলুও আলাদা ছিল না। শেষের তিন-চার মাস,দৃষ্টি হারানোর পর,আলোর দিকে তাকিয়ে বারান্দার এক কোণায় বসে থাকত। বাগানে নিয়ে গেলে আপত্তি জানাত না। আমি ওকে কতটা ভালোবাসা দিতে পেরেছি জানি না, শুধু জানি ও আমাকে আমার ঝিমন্ত শৈশব থেকে ডেকে এনে কৈশোরের দ্বারে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিল। তাই আমি ওর কাছে চিরঋণী। ইগলুর চলে যাওয়ার পরে আর কোনো কুকুর ঘরে আনার কথা আমরা ভাবিনি। মা রাজি হয়নি। কে দেখবে তাকে। কুকুরেরা খেলনা নয়। ওরা আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে ওঠে। ভাই, বোন কিংবা ছেলে-মেয়ের সমান। আমাদের দায়িত্ব ওদেরকে আপন করে নেয়া। ঘরে বন্ধ করে রাখা নয়। অসুখ করলে ওদের চিকিৎসা করা। ওদের জন্য মেডিক্যাল ইনসিওরেন্স পলিসি কেনা। যাতে খরচের ধাক্কার কথা ভেবে ওদেরকে শেষে ঘুম না পাড়িয়ে দিতে হয়। কাউকে – মানুষ কিম্বা কুকুরকে – ইউথেনেসিয়ার নামে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া অন্যায় আর অবিচার।