আয় আয় ঘুম ইদ্রিশ মিয়াঁর উটের গল্প সৌরাংশু সিংহ ও ঈশান মিস্ত্রী শীত ২০১৯

আগের সংখ্যার গল্প– আমাদের ছোট্ট শুঁয়োপোকাটিকোকিলের গান, লাল বেলুনের গল্প, রামধনুর গল্প, আলুর গল্প, বাড়ি আর ক্রেনের গল্প

এই গল্পদের সৌরাংশু তার খুদেকে ঘুম পাড়াবার জন্য বানায়। আপনারাও আপনাদের খুদেদের এই গল্পগুলো বলে ঘুম পাড়াবেন।

ইদ্রিশ মিয়াঁর উটের গল্প

কথনঃ সৌরাংশু সিনহা  ছবিঃ ঈশান মিস্ত্রী

খুমান শহরের ইদ্রিশ মিয়াঁর একটা উট ছিল, লাবু নাম তার। দু কুঁজওলা ব্যাক্ট্রিয়ান উট। কালচে সোনালি বাদামি লোমে কুঁজ, মাথা এবং পায়ের গোছ ঢাকা। বাকিটা বেশ বাদামি সোনালি গোছের, ঠিক যেমনটা সিংহের হয়। ইদ্রিশ মিয়াঁর কাঠের ব্যবসা। লাবু গাড়ি টানত। সকাল সকাল ইদ্রিশ মিয়াঁ লাবুর গাড়িতে চেপে যেত জঙ্গলে। প্রতিটি বার্চ পপলার গাছের গুঁড়ি কাটার পরিবর্তে সেখানে আরও পাঁচটা গাছ লাগাত, নিয়ম করে।

লাবু দাঁড়িয়ে থাকত, প্রয়োজনে দড়ি দিয়ে বড় বড় গুঁড়ি টানত। আর ঘাস পাতা চিবোত। শেষে, দিনের শেষে কাঠ বোঝাই গাড়ি নিয়ে ফিরে আসত শহরে। খুমান শহরটা এমনিতে খুব সুন্দর। দূরে পাহাড় দেখা যায়, আরও দূরে গেলে দুএকটা নদী, ঝর্ণাও দেখা যেতে পারে। শহরটাই অতিরিক্ত যানবাহন যেমন নেই, তেমনই নেই এলইডি হোর্ডিং বা উজ্জ্বল আলোর চিৎকারও।

সন্ধ্যা হবার মুখে লাবু ফিরে এলেই দেখতে পেত, অবিনা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। হাতে এক কাপড় ভর্তি ঘাসপাতা। বিকেলে ইশকুল থেকে ফিরে অবিনা কুড়িয়ে রাখত সে সব। ইদ্রিশ মিয়াঁ অবিনার আব্বু। অবিনা ইদ্রিশ মিয়াঁর বড় মেয়ে। কত আর বয়স হবে? এই বছর ছয় সাত। সা’জোয়ান লাবু সে সব ঘাস পাতা চিবোত বসে বসে। আর অবিনা গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকত তার। ভাই গুলাব, তখন সবে হামাগুড়ি দিচ্ছে। খাওয়া দাওয়া হলে লাবু অবিনার কানের কাছে মুখ এনে বলত,

চড় যা বেটি, পিঠের উপর। সামলে বসিস।

খুশি হয়ে কুঁজ জড়িয়ে খচমচিয়ে উঠে বসত অবিনা। হামি খেত কুঁজে। ছোট্ট অবিনাকে নিয়ে লাবু পাড়া বেড়াতে বেরোত। দুজনে মিলে সুখ দুঃখের কত কথা বলত তারা। অবিনার ইশকুলের দিদিমণিরা অঙ্ক শেখায় অবিনার অঙ্ক শিখতে দারুণ মজা লাগে। লাবুর আবার মজা লাগে পপলারের বনে প্রজাপতি উড়তে দেখতে। প্রাণের বন্ধুদের প্রাণের গল্প। যদিও লাবুর মোটামুটি বয়স হয়েছিল, ছেলেপুলেরাও কাজে কর্মে লেগে গেছে। তবু অবিনাকে পিঠে নিয়ে গল্পস্বল্প চলতেই থাকত। বড় ক্লাসে উঠে যাবার পরেও।

কিন্তু মজার ব্যাপার হল, গুলাব লাবুর ভাষা বুঝতে পারত না। খালি ‘হেউ’ ‘হেঁউ’ আর ‘ঘিঁয়াও’ এই দিয়ে কি আর বার্তালাপ চলে? কিন্তু গুলাব, সাত আট বছরের গুলাব অবাক হয়ে দেখত, তার দিদি কি অদ্ভুত ভাবে উটটার সঙ্গে প্রাণের গল্প করে চলেছে। গুলাবেরও তখন একটা ছোট বোন হয়েছে। এরিনা নাম তার।

বছর ঘোরে, অবিনা আরও একটু বড় হয়। লাবু আরেকটু বুড়ো। তখন সে আর জঙ্গলে যেত না। খালি ছুটির দিনে ইদ্রিশ মিয়াঁ এক দুবার লাবুর পিঠে চেপে ব্যবসার আলোচনা করতে যেত। সেলাম ঠুকত লোকে। কত লোকের কাজ দিত ইদ্রিশ মিয়াঁ যে! জঙ্গলে যেত লাবুর ভাই পিরিক।

আঠারোর অবিনা যখন বাকুর কলে পড়তে গেল, তখন লাবুর চুলে পাক ধরেছে। কালচে সোনালি বাদামি হয়ে পড়েছে ধূসর। চোখের উপর সেই ধূসর চুল এসে পড়লে বোঝা যায় না যে লাবু জেগে আছে না ঘুমোচ্ছে। শুধু ঠোঁটদুটো অভ্যাসবশত নড়তে থাকে। দাঁতও দু চারটে পড়ে গেছে তার। কষ্ট হয়েছিল যদিও। তবুও অবিনা গলা জড়িয়ে লাবুকে প্রমিস করেছিল যে প্রতি হপ্তায় সে চিঠি লিখবে। যদিও লাবু পড়তে পারে না, তবুও গুলাবকে প্রমিশ করিয়ে নিয়েছিল যে দিদির চিঠি এলেই সে যেন লাবু পড়ে শোনায়। এরিনাও এসে শুনত সে চিঠি। 

একটা চিঠিতে লিখেছিল অবিনা, ভালো আছে সে, তার রুমমেট জর্জিয়া থেকে এসেছে। কুনিকা নাম তার। জর্জিয়ানদের নাচের পোশাক একদম আলাদা। সাদা ফুলহাতা ফুলকাটা ব্লাউজ আর ইয়াব্বড় ঘেরের লাল জরি বসানো ফুল তোলা লঙস্কার্ট। অবিনারা পায়জামা পরত। ক্রুশের কাজ করা। সঙ্গে ঘেরওলা সালোয়ার আর হাফকোট। রকমারি ডিজাইন তার। ভালো আছে সে। শুনে ভালোই লাগত লাবুর। দেখতেও কম পায় আজকাল সে।

শেষে একদিন গুলাব লিখল, লাবুর এতটাই বয়স হয়ে গেছিল যে সে ‘নেই’ হয়ে গেছে। তবে তার জায়গায় লাবুর ছেলেকে নিয়ে এসেছে আব্বুমিয়াঁ। অনক তার নাম। অনককে দেখতে নাকি লাবুর মতোই। ছুটিতে দিদি এলে দেখতে পাবে অনককে। আর এরিনাও তখন বড় হয়ে যাচ্ছে।

খুমন শহরে যখন হালকা হালকা গ্রীষ্মের আমেজ, তখন ছুটি পড়ে বাকুতে। মাস খানেকের। বাড়ি এলো অবিনা। এসে অবাক হয়ে দেখল, বাড়ির সামনের গাছটায় দাঁড়িয়ে যে উটটা জাবর কাটছে, সে যেন তার লাবুই। যদিও তার কথা সে বুঝতে পারল না। খালি ‘হেউ’ ‘হেঁউ’ আর ‘ঘিঁয়াও’ এই দিয়ে কি আর বার্তালাপ চলে? কিন্তু অবাক হবার পালা বোধহয় এতেই শেষ নয়। অনকের সঙ্গে তারই মতো গলা জড়িয়ে কথা বলছে তারই ছোটবোন এরিনা। গুলাব অবশ্য এসব কথাফতা কিসসু বুঝতে পারে না। খালি বুঝতে পারে যে তার দুই বোনকে পাগলের মতো ভালোবাসে।

গুলাব এসে দিদির হাত থেকে ব্যাগ আর স্যুটকেস নিল। দাওয়ায় নামিয়ে রাখার পর আবার ছুটে এসে দিদিকে জড়িয়ে ধরল। আর অবিনা এক হাতে গুলাবকে জড়িয়ে আরেক হাত বাড়িয়ে দিল এরিনার দিকে। এদ্দিন পরে বারোবছরের বড় দিদিকে দেখে এরিনাও খুশি খুব। ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল তাকে। অবিনা চোখ বন্ধ করে এরিনার চুলের গন্ধ নিল। ঠিক যেন তার দাদির গন্ধ। দাদিকে তো অবিনা ছোটবেলায় দেখেছিল, এরিনা দেখেইনি। তবুও।

হঠাৎ অনুভব করল ঘাড়ের কাছে একটা সুড়সুড়ি দিচ্ছে কেউ। চমকে চোখ খুলেই দেখে অনক এসেও গা ঘষছে অবিনার ঘাড়ে। চোখ বন্ধ করল অবিনা। আবার চমকে উঠল। আরে এতো লাবুরই স্পর্শ। তাহলে লাবুই…? চোখ খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, না না, এ তো অনকই। চোখ বন্ধ করলে অবশ্য লাবু চলে আসছিল। অবিনা এবার বুঝতে পারল যারা চলে যায়, তাদের চোখ বন্ধ করে ভাবলেই অনুভব করা যায়। আশেপাশেই থাকে তারা। ভালোবাসার লোকজন তো দূরে গেলেও দূর হয় না। তাহলে চলে গেলেই বা চলে যাবে কেমন করে। ডান হাত বাড়িয়ে অনকের গলাটাও জড়িয়ে ধরল সে। এভাবেই জুড়ে জুড়ে থাকলেই ভালবাসা বাড়ে কি না!

<–পরের আয় আয় ঘুম

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s