আয় আয় ঘুম কুয়োর ব্যাং সৌরাংশু শরৎ ২০২০

আগের সংখ্যার আয় আয় ঘুম-এর গল্প– আমাদের ছোট্ট শুঁয়োপোকাটি, কোকিলের গান, লাল বেলুনের গল্প, রামধনুর গল্প, আলুর গল্প, বাড়ি আর ক্রেনের গল্প, ইদ্রিশ মিঞাঁর উটের গল্প, তিমি আর ডলফিনের গল্প জাফরি আর রেলিঙের গল্প, হাঁসুমনির গল্প, নিমগাছের গল্প

কুয়োর ব্যাং

লেখা সৌরাংশু, ছবি: ঈশান মিস্ত্রী

এই গল্পদের সৌরাংশু তার খুদেকে ঘুম পাড়াবার জন্য বানায়। আপনারাও আপনাদের খুদেদের এই গল্পগুলো বলে ঘুম পাড়াবেন।

ভুলোদের বাড়িতে একটা পুরনো পাতকুয়ো আছে। নিচদিকে সবুজ সবুজ শ্যাওলা পড়া। ভুলোরা সেই কুয়োর জল আগে খাবার জন্য ব্যবহার করত। কিন্তু এখন শুধু বাগানে জল দিতে আর বাসন মাজতেই ব্যবহার করে।

কুয়োর মধ্যে থাকত একটা প্রকাণ্ড মাগুর মাছ। আর নিচের দিকে, জল ছুঁই ছুঁই ফাটলে থাকত একটা ব্যাঙের পরিবার। ব্যাংবাবা ব্যাংমা আর খান তিনেক ছানাপোনা। তারা কুয়োর গায়ের শ্যাওলা পোকামাকড় খেয়েই থাকত। কক্ষনো ভাবেনি যে ইলিশ মাছের ভাপা বা মুরগির রোস্ট খাবে। এমন কি খমন ধোকলা কি সেট দোসা কাকে বলত তাও জানত না। বাবা ব্যাঙের আসলে কোন উচ্চাশা ছিল না। উচ্চাশা মানে আরও বড় কিছু করতে হবে এমন ইচ্ছে। মা ব্যাঙও সংসার নিয়ে জেরবার হয়ে যেত। বড় দুটো ব্যাঙের বাচ্চা বাবার মতোই। দিনের বেলা জিভ উলটে একটা আরশোলা ফড়িং ধরতে পারলেই দেমাকে শ্যাওলায় পা পড়ত না তাদের।

এদের মধ্যে সবথেকে ছোটটা একটু অন্যরকম ছিল। অ্যালগি আর শ্যাওলা তার মোট্টে খেতে ভালো লাগত না। তাই কোন রকমে ছোটখাটো পোকামাকড় খেয়ে বাকিটা জল খেয়েই কাটাত। আর মাঝে সাঝে ভুলোরা যদি জলের মাগুর মাছটার জন্য আটাটা কেঁচোটা ছুঁড়ে দিত, তার ঝড়তিপড়তি দু একটুকরো ব্যাঙেদের দিকেও আসত। সেগুলো একদম কাড়াকাড়ি করে খেত তারা।

বুড়ো মাগুরটার আবার এসব খাবার লোভ ছিল না। আটার গুঁড়ো বা চিনি জলে পড়লে সেদিকে ফিরেও তাকাত না। দু একটা কেঁচো ফেঁচো লোভ সামলাতে না পেরে চেটেপুটে সাবড়ে দিত বটে। তবে তাতে যে ওই বিশাল আয়তনের শরীরের কী হবে তা বোঝা যেত না।

অথচ মাগুরটার বাড়বাড়ন্তের অভাব ছিল না। ব্যাপারটা বাকিদের চোখে না পড়লেও ছোট্ট ব্যাঙটার নজর এড়ায় নি। সে তাই জুলজুল চোখে মাগুর মাছটার দিকে তাকিয়ে থাকত।

মাগুর মাছটার বয়স হলেও চোখের জ্যোতি হারায় নি। তাই সেও খেয়াল করেছিল যে আর বাদবাকি ব্যাঙগুলো আধুলির এদিক ওদিক হলেও এটা বোধহয় স্পেশাল।

তবু বুদ্ধিমান আর বিচক্ষণ ছিল বলে সাড়া করত না। তা ছোট্ট ব্যাঙটাই একদিন ফাটলের পাড়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কী খাও গো?” মাগুরটা কপট রাগ করল, “বড়দের একেবারেই তুমি করে কথা বলতে হয় নাকি? আপনি আজ্ঞে করে সম্মান দিতে হয়, জানিস না?”

ব্যাঙটাও কম তেএঁটে ছিল না। সে বলল, “ছোট বলে কি আমারও সম্মান নেই? একেবারে তুইতোকারি করতে আছে নাকি?”

মাগুর বুঝল এ ব্যাঙ ছোট হলে কী হবে, একেবারে গভীর জলের মাছ। তা সে গভীর জলের মাছ সে নিজেও, তাই একেবারে তাদের ভাব হয়ে গেল। একদিন মাগুর ব্যাঙকে বলল, “যাবি নাকি আমার সঙ্গে মণ্ডা মিঠাই পোলাও কোফতা খেতে?” ব্যাঙ তো অবাক! সে জন্মেও শোনেনি তাকে কেউ এরকম অফার করছে। সে রাজি হয়েই গিয়েছিল। কিন্তু চালাক চতুর ছিল তো, তাই জিজ্ঞাসা করল, “কী করে?” তখন মাগুর বলল, “তুই কতক্ষণ দম বন্ধ করে থাকতে পারিস?” ব্যাঙটা ছোট ছিল বলে ঘণ্টা-মিনিটের হিসাব জানত না। সে অনেক ভেবে বলল, “এএতোওওক্ষণ” বলে গলা ফুলিয়ে বুক ফুলিয়ে দেখাল। মাগুর বুড়ো হলেও কি হবে, বুদ্ধিমান আর বিচক্ষণ। তাই সে ভাবনা চিন্তা করে বলল, “ঠিক আছে হয়ে যাবে। শোন, তুই আমার পিঠে চেপে বসবি। চেপ্পে ধরবি। খবরদার হাত যেন ছেড়ে না যায়। তারপর আমি এক নিঃশ্বাসে তোকে নিয়ে পুকুরের নিচ দিয়ে একদম পাশের নদীতে গিয়ে পড়ব। তার ধারে কতরকম খাবার দোকান। প্রাণ খুলে খাস কিন্তু খবরদার! আমাকে না জিজ্ঞাসা করে কোত্থাও যাবি না। আর ইয়ে বাবা-মাকে বলবি না কিন্তু। তারা নিজেরা কখনই যায়নি বাইরে, তোকেও যেতে দেবে না।”

কিন্তু ব্যাঙটা ছোট হলেও ভালো ছিল, সে জানত বাবা-মাকে বোঝাতে পারলে তারা কখনই বারণ করবে না। করলও না। দাদাগুলো অবশ্য ভয়ে শিঁটিয়ে গিয়েছিল। কারণ তারা তো মাগুর মাছের বন্ধু ছিল না। কিন্তু ছোট্ট ব্যাঙটি একেবারেই ভয় পায়নি। কারণ সে জানত মাগুর খুব ভালো। সে তদ্দিনে মাছ চিনতে শিখে গেছে।

তারপর নির্দিষ্ট দিনে বাবা- মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে নতুন জামাকাপড় পরে ব্যাঙ সোনা মাগুর বাবাজীর পিঠে চেপে নদীর ধারে গিয়ে পৌঁছল। জলের গভীরে অন্ধকারে একেবারেই ভয় করেনি যে তা নয়। কিন্তু সে জানতো তার বন্ধু মাগুর আছে তার সঙ্গে। নদীর ধারে পৌঁছেই দেখল সারি সারি খাবার দোকান। চাউমিনও আছে, চিকেন চাঁপ আর রুটিও আছে। আছে চিঁড়ে গুড় দই। আছে মিষ্টি সন্দেশ রাজভোগ। আছে এগরোল আরও কত কী। খেয়ে দেয়ে ব্যাঙ যখন ফিরে এলো তখন তার দাদাদেরও ইচ্ছে হল বাইরে যেতে। কিন্তু মাগুর সাফ বারণ করে দিল। “তোদের ভরসা ছিল না তো! ছোটটা ভরসা করতে পেরেছে। ও তোদের থেকে বেশী দূর যাওয়া ডিজার্ভ করে। দাদারাও মেনে নিল। কিন্তু ছোট মানতে পারল না। শেষে আরেকটু বড় হলে সে পুকুরের ধারে একটা কপিকল লাগাবার ব্যবস্থা করল। কপিকল জানো তো? লিফট বা এলিভেটরের মতো বালতি উপর তো ব্যাঙ নিচে আর ব্যাঙ উপর তো বালতি নিচের পলিসিতে চলে।

এইভাবেই ভয়কে জয় করতে শিখে ব্যাঙ অজানাকে জানতে আর অচেনাকে চিনতে শিখল। ব্যাঙ সমাজেও সে একদিন নাম করল এই বলে যে প্রথম ব্যাঙ, যে শুধুমাত্র কুয়োর ব্যাঙ হয়ে রইল না! ঠিক যেভাবে আমরাও নতুন নতুন দেশ দেখতে, নতুন নতুন কাজ করতে শিখি। আর ছোট ছোট পায়ে অচেনাকে চিনতে আর অজানাকে জানতে শিখি।

 

2 thoughts on “আয় আয় ঘুম কুয়োর ব্যাং সৌরাংশু শরৎ ২০২০

  1. অসাধারণ শিশু সাহিত্য। দ্বিতীয় বাক্যে- নীচের দিকে হবে।

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s