আয় আয় ঘুম জাফরি আর রেলিঙের গল্প সৌরাংশু সিংহ ও ঈশান মিস্ত্রী বসন্ত ২০২০

আগের সংখ্যার গল্প– আমাদের ছোট্ট শুঁয়োপোকাটিকোকিলের গান, লাল বেলুনের গল্প, রামধনুর গল্প, আলুর গল্প, বাড়ি আর ক্রেনের গল্প, ইদ্রিশ মিঞাঁর উটের গল্প, তিমি আর ডলফিনের গল্প

এই গল্পদের সৌরাংশু তার খুদেকে ঘুম পাড়াবার জন্য বানায়। আপনারাও আপনাদের খুদেদের এই গল্পগুলো বলে ঘুম পাড়াবেন।

জাফরি আর রেলিঙের গল্প

কথনঃ সৌরাংশু সিনহা  ছবিঃ ঈশান মিস্ত্রী

বোস বাড়ির ঝুল বারান্দার রেলিং ছুঁয়ে একটা কাক বসে ছিল। লোহার রেলিং, তালগাছের তারজালি কাটা আর তার উপর কাঠ বসানো। কাঠগুলো একটু আধটু ক্ষয়ে টয়ে গেছে। তবু এতদিন ধরে দাঁড়িয়ে আছে এই ঢের। প্রতিটি রেলিঙের শেষে একটা করে কাঠের পিলার আর তারপর আবার রেলিং। উপরে জাফরি। রোদ আসে, জাফরি পেরিয়ে। কিন্তু বৃষ্টি আসে না। বর্ষার মতো ফলা নিচে নিচে ঝুলে আছে যেন।
কাকটার কাল রাতে মোটামুটি কাঁটাচচ্চড়ি আর ভাতের উচ্ছিষ্ট জুটেছে। ভালোই। স্বভাবতই। বসে বসে হাগু করার জন্য ল্যাজটা তুলেছিল। অমনি রেলিঙটা দুলে উঠল। কাকটা ভড়কে গিয়ে ল্যাজ ম্যাজ গুটিয়ে ডানা ফানা ধড়ফড়িয়ে উড়ে পালাল। জাফরিটা এবারে লক্ষ করে দেখল, রেলিঙে কিন্তু একটুও নোংরা নেই।
জাফরি এদ্দিন ধরে রেলিঙকে দেখছে কিন্তু এতটা তকতকে ঝকঝকে রেলিং দেখেনি কখনও। অথচ তার আর রোদ বৃষ্টি আর কাক পায়রার হাগুর স্পর্শ থেকে বাঁচা হয়ে উঠল না এখনও। সবুজ রঙের সুন্দর জালিকাটাগুলো এখন জলের আর হাগুর দাগে মলিন হয়ে গেছে।
জাফরি একটু উৎসুক হল। জিজ্ঞাসাও করল, “হ্যাঁ গা রেলিঙের ঝি, তুমি এতো চকমকে হলে কেমনে?”
রেলিং বলতেই পারত যে আজকাল তো অয়েল অফ ওলে মাখছি। কিন্তু তা না বলে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।
জাফরি বুঝতে পারল না। কিন্তু ততক্ষণে সূয্যিমামার বাড়ি যাবার সময় হয়ে এসেছে। দূর থেকে জাফরি সেটা দেখতে পেল। “আহা কী সুন্দর!” সে বলে উঠল। রেলিং নিচ থেকে অতটা দেখতে পায় না তো! তাই সে জিজ্ঞাসা করল, “কী?” জাফরি দূরের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওই যে মামা বাড়ি চলল! সন্ধ্যা হয়ে গেলো।” একটু মনখারাপও হল তার, “এবার অন্ধকার হয়ে যাবে সব কিছু! যতক্ষণ না কেউ দোতলার বারান্দায় আসছে।”
রেলিং একটু ঘাড় ঘুরিয়ে জাফরির দিকে তাকাল বটে। কিন্তু এখুনি কিছু বলল না। বললে তো চমকটাই নষ্ট হয়ে যাবে। একেবারে নীচে, ঠাকুরদালানে তখন বাঁধাছাঁদার কাজ শেষ পর্যায়ে চলেছে।
পরের দিন সকালে জাফরির ঘুম ভাঙল একটু দেরিতেই। তবে পায়রা বা কাকের ডানা ঝাপটানিতে নয়। দড়ি বাঁধাবাঁধির শব্দে। নিচে পুজোর প্যান্ডেল হচ্ছিল বটে কিন্তু এখন তো দেখছে বাঁশটাঁশ দিয়ে জাফরি পর্যন্ত লোক উঠে এসে দড়ি বাঁধছে। একটু থতমত খেয়ে রেলিঙকে সবে জিজ্ঞাসা করতে যাবে যে ব্যাপারটা কী! নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে রেলিং-এও বাঁধাছাঁদা চলছে। রেলিং ভয়ানক ব্যস্ত। তবু তার মধ্যেই মুখ তুলে একবার জাফরির দিকে দেখল সে। জাফরিকে ভোম্বল হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে, মুচকি হেসে রেলিং বলল, “পুজো আসছে না? তাই রংচং হচ্ছে!”
পুজো আসছে! কত কথা মনে পড়ে গেল জাফরির। এই বাড়িটায় বারোমাসে তেরো পার্বণ হতো। কিন্তু তবু দুর্গাপুজো এলে আনন্দই অন্যরকম ছিল। মেয়েরা আলপনা দিত। ছেলেরা পুজোর সামগ্রী নিয়ে এসে জোগাড়যন্ত্র করত। তারপর উঠোন মোছা, ফল কাটা, আসন পাতা, ঝাড়ন, বড়ো বড়ো তালপাখা, ময়ূরের পালক পরিষ্কার, কাঁসর, ঘন্টা, ঢোল, ঢাক, শান্তির জল, শ্বেত চন্দন, রক্ত চন্দন, কলাবউ। একদম হইহই কাণ্ড রইরই ব্যাপার। শেষে বিসর্জনের দিন ছেলেরা ধাক্কা পাড় ধুতি আর গিলে করা পাঞ্জাবি পরে ছড়ি হাতে জুতো মচমচিয়ে গিয়ে উঠত গাড়িতে। মেয়েরা লালপাড় সাদা শাড়িতে দুর্গা মাকে সিঁদুরে রাঙাত। তারপর বিসর্জনের শেষে মিষ্টিমুখ আর শাঁখ বেজে উঠত। আবার আসিস মা।
পুজো আসছে! কত দিন হয়ে গেল এই বাড়িতে খুব বেশি ছেলেমেয়েদের চেঁচামেচি শোনা যায় না। সবাই বড়ো হয়ে গেল। তারপর যে-যার কাজটাজ নিয়ে চলে গেল বিদেশ বিভূঁই। প্রতিবছর নমোনমো করে সবকিছু সারা হয়। তাহলে এবারে কী পাল্টাল? জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে দেখল এবারে সত্যিই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে রেলিং। জাফরির গায়েও শিরিষ কাগজ ঘষা শুরু হয়ে গেছে। এই হাল্কা হাল্কা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়ায় গা ঘষে ঘষে ময়লা তুলতে বেশ আরাম বোধ করছিল জাফরি। এখন তো আর কেউই নজরই দেয় না। নোংরা মলিন ধূসর হয়ে অযত্নে পড়ে থাকা জাফরিগুলো একটু তো যত্ন পাচ্ছে। পুজো আসছে।
দিন দুই পরে ফুরসত পাওয়া গেল। ভোরবেলায় সকলে তখন মহালয়া শুনছে। সূয্যিমামাও বোধহয় মহালয়া শুনছে। একেবারে সুপ্রীতি ঘোষের গলায় ‘বাজল তোমার আলোর বেণু’ শুনেই বেরোবে। তবে পাখিটাখিরা সে-সবে মন দেয় না। কাল রাতে কে কোন স্বপ্ন দেখেছে সেই নিয়ে কাক চড়ুই শালিক বেনেবউ ঘুঘু পায়রা ইতিউতি বকবকম করতে লেগেছে। কাল রাতে বোধহয় রেলিঙকে নতুন রঙে সাজিয়েছে ওরা। আধো আলোছায়ায় জাফরি রঙটা দেখতে পাচ্ছিল না। তবে বুঝল রেলিং ঘুম থেকে উঠে পড়েছে, গুনগুন করছে, ‘জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিনী।’ আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসা করল জাফরি, রেলিঙকে, “হ্যাঁগা, ব্যাপারখানা কী গা?”
রেলিং হেসে বলল, “ওমা, তুমি তো দেখছি কোনদিকেই খেয়াল রাখো না। দিন দশেক আগে কত্তামা আর কত্তাবাবার মধ্যে কথা হচ্ছিল, ছেলেরা আর মেয়েরা ঠিক করেছে এবার থেকে পুজো দেশের বাড়িতেই কাটাবে। সবাই মিলে একসঙ্গে উৎসব হবে, আনন্দ হবে, দেখাসাক্ষাতও হবে। যে যেখানেই থাকুক না কেন এই কটা দিন সবাই মিলে একসঙ্গে থাকবে! তাই তো এতো সাজগোজ। এই যে আমার রঙ গাড় সবুজ করা হয়েছে। আর আজ তোমার জন্য কচি কলাপাতা রঙ সাজছে। আর তো মাত্র দিন ছয়েক তারপরেই দেখো না কী হয়!”
জাফরিরও মনে আনন্দ হল বটে। আবার! আবার সবাই মিলে আনন্দ করবে? আলোর মালা, ধূপ ধুনোর গন্ধ, ঢাক ঢোল কাঁসর, মেয়েদের উলুধ্বনি। আহা ভাবতেই কেমন আনন্দ হচ্ছিল। ততক্ষণে সূয্যিমামা উঠেও পড়েছে। আর রেডিওতে গান বাজছে, উৎপলা সেন, ‘শান্তি দিলে ভরি!’
জাফরি দেখল। রঙের বালতি নিয়ে মিস্ত্রিরা উঠে পড়েছে তার গায়ে গায়ে। আহা কচি কলাপাতার গন্ধ। তারপর কলাবউও আসবে। একচালার ঠাকুরও। আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে! ভাবতে ভাবতেই সদর দরজায় গাড়ি এসে উপস্থিত হল। বড়দি এসে পড়েছে, টুকুন আর বাপ্পাকে নিয়ে সঙ্গে বড় জামাইবাবু। এরপর একে একে চলে আসবে বড়দা, ছোড়দা, মেজদি, ছোড়দি আর রাঙা। রাঙা এখন সবে কলেজ পাস করে বড় কলেজে ঢুকেছে। মেজোপিসি, বড় মামা, ছোটো কাকু আর মিতিনমাসির পরিবারও আসবে বোধহয় আর আসবে সব গেঁড়িগুলো। নিও, নেমো, নিমো, জোরো, টায়রা, পিকু, নীল, নীতিন, মিঠি, আকাশ আরও সব্বাই! উফফফ কী আনন্দটাই না হবে। সত্যিই পুজো আসছে তো! সত্যিই পুজো আসছে তো!
রেলিঙের দিকে তাকিয়ে জাফরি বলল, “আহা পুজো আসছে!”

কথনঃ সৌরাংশু সিনহা  ছবিঃ ঈশান মিস্ত্রী

 

<–আগের আয় আয় ঘুম

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s