আগের সংখ্যার গল্প– আমাদের ছোট্ট শুঁয়োপোকাটি, কোকিলের গান, লাল বেলুনের গল্প, রামধনুর গল্প, আলুর গল্প, বাড়ি আর ক্রেনের গল্প, ইদ্রিশ মিঞাঁর উটের গল্প, তিমি আর ডলফিনের গল্প জাফরি আর রেলিঙের গল্প, হাঁসুমনির গল্প
এই গল্পদের সৌরাংশু তার খুদেকে ঘুম পাড়াবার জন্য বানায়। আপনারাও আপনাদের খুদেদের এই গল্পগুলো বলে ঘুম পাড়াবেন।
নিমগাছের গল্প
নিম বানান কী? নয়ে হর্স্ব ই ম। কিন্তু ইংরিজিতে তো এন ডবল ই এম। তাহলে?
যাই হোক, আমাদের গল্পের নিমগাছটা লাগিয়েছিল আমাদের গল্পের হিরোর বাবা। ঠিক যেদিন ছেলেটির জন্ম হল সেদিন। তারপর থেকে ছেলেটির মা আর বাবা একে একে চলে গেল। কিন্তু নিমগাছটা থেকে গেছিল। রাতে যখন ছেলেটা ফিরে আসত, তখন নিমগাছের হাওয়া তার সব ক্লান্তি দূর করে দিত।
ছেলেটিকে ফুলগাছ লাগানো শিখিয়েছিল তার মা। ছোটবেলা থেকে যত্ন করে ছোট্ট জমিতে বেল জুঁই গোলাপ আর রজনীগন্ধা। বিশেষত রজনীগন্ধার গাছে এক একটা স্টিক ফুটত। এইটুকুই ছেলেটার ছিল। রাতে ফোটা ফুলগুলোকে নিয়ে সে একে একে জুড়ে মালা বানাতো ছেলেটি। আর বানাতো রজনীগন্ধার চাদর। তারপর সাইকেলে করে রওনা দিত চৌমাথার মোড়ে যেখানে একটা মন্দির, একটা গির্জা, একটা গুরদোয়ারা আর একটা পীরের মাজার রয়েছে। পীরের মাজারে সবাই ফুলের তৈরি চাদর চড়ায়। আর মানত করে। প্রার্থনা। প্রার্থনা গির্জা, গুরুদোয়ারা আর মন্দিরেও করে। তাই চৌমাথার মোড়ে তার ফুলগুলো বিক্রি হয়ে যেত।
তারপর দুপুরের খাবার গুরুদোয়ারার লঙ্গরে খেয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসত চাল বা আটা, আলু আর একটু আধটু সবজি কিনে। তারপর আগুন জ্বালিয়ে রাতের খাবার বানিয়ে একটা ছোট্ট একতারা বাজিয়ে গান করত সে। যে সব গানগুলো সে শুনে শুনে শিখেছিল মন্দির, গির্জা গুরুদোয়ারা আর পীরের মাজারে।
এই ভাবেই কাটছিল বেশ তার। এমন সময় হল কি, এক পাল গরু এসে হাজির হল তার বাগানে। গরুগুলো একটু দূরের খাটালের। গোয়ালা বিশেষ খেতে পরতে দিত না তাদের। দিনের বেলা ছেড়ে দিত চড়ে খাবার জন্য। কদিন আগে তাদের আলাপ হয়েছে এমনি ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেরানো দু তিনটে ছোকরা বলদ আর একটা ছোকরা ষাঁড়ের। আর তাদের লিডার হল একটা ইয়াব্বড় ষাঁড়। লিডার মানে নেতা মানে যার কথা সবাই শোনে। সেই ষাঁড়টার কালো রঙের ইয়াব্বড় কুঁজ। চোখের কোণে পিচুটি জমে জমে কাজল তৈরি হয়ে গেছে। ইয়াব্বড় জট পাকানো সিং। সামনের ডান পা ফেললে ডানদিকের নর্দমায় ঢেউ খেলে যায়। বাঁ পা ফেললে বাঁদিকের শুকনো পাতাগুলো মরমরিয়ে ওঠে।
তা সেই ষণ্ডামার্কা ষাঁড় দেখতে পেয়েছে যে একটা ফুলের বাগান রয়েছে, যার কোন বেড়া নেই। তাই দলবল নিয়ে এসে ঢুকে পড়ে গবগবিয়ে খেতে লেগেছে ফুলগাছ। সেদিন ভোরে ছেলেটা উঠে তো মাথায় হাত। হাতের কাছে একটা লাঠি ছিল, সেটা দিয়ে ষণ্ডামার্কাকে দু ঘা দিতেই সে এসেছে গুঁতিয়ে দিতে। কোনরকমে প্রাণ নিয়ে বাঁচিয়ে নিমগাছের কাছে এসে ছেলেটা বসে পড়ল, মাথায় হাত দিয়ে। এবারে কী হবে! সব ফুল মুড়িয়ে দিয়ে চলে গেল। আজ তো আর চৌমাথার মোড়ে যাওয়া হবে না। খাবে কী?
এতগুলো প্রশ্নের মধ্যেই হঠাৎ করে শুনল, কে যেন বেশ মায়াজড়ানো গলায় বলছে, ‘চিন্তা নেই!’ হুঁ চিন্তা নেই। খেতে পাচ্ছি না আমি আর বলে কিনা চিন্তা নেই। হঠাৎ খেয়াল হল, ত্রিসীমানায় কেউ নেই। তাহলে ‘চিন্তা নেই!’ কে বলল? এদিকে ওদিকে খুঁজেপতে দেখে কেউ নেই! সত্যি তো! কে বলল? এবারে একটু ভয় ভয় করল ছেলেটির।
বুকের মধ্যে ধুকপুক শব্দ নিয়ে কোনরকমে জিজ্ঞাসা করল, ‘কে?’
উত্তর এলো, ‘আমি! আমি নিমগাছ!’
ছেলেটা এবার সত্যিই ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু আবার সেই আওয়াজটা এলো, ‘ভয় নেই। সেই যবে থেকে তোমার বাবা আমায় লাগালো, সেদিন থেকে আমি আছি। আর যেদিন তোমার বাবা চলে যাবার সময় আমায় বলল তোমায় দেখতে, সেদিন থেকেই তোমার দেখা শোনা করি। তুমি যখন ঘুমোতে যাও তখন সব মিষ্টি হাওয়া আমি তোমার দিকে ঘুরিয়ে দিই। সকালে যখন দাঁত মাজো তখন দেখে দেখে কম তেতো ডাল আমি তোমার হাতের কাছে রাখি। মাঝে মাঝে শুকনো পাতা ওলা ডাল আমি টুপ করে তোমার ঘরের দাওয়ায় ফেলে দিই যাতে ঘর সাফ করতে পার। অসুখ বিসুখ যাতে না হয় সেদিকে নজর রাখি। আর আজ! আজ যখন তোমার রুজি রোজগারের সর্বনাশ হতে বসেছে, তখনও আমি তোমাকে সাহায্য করব। সঙ্গে থাকব।’
ছেলেটা আশ্চর্য হয়ে গেলো। কিন্তু ভয়টা চলে গেছিল। নিমগাছ তখন বলল, ‘শোন আমি ডাল নামিয়ে দিচ্ছি। মোটামোটা দেখে নিমপাতাগুলো তুমি নিয়ে যাও আর সব ফুলগাছের সঙ্গে সুতো দিয়ে বেঁধে দাও, যাতে সুতো দেখা না যায়। বড় বড় ফুলগুলোর মধ্যে আমার ফলগুলো রেখে দাও। আর তারপর দেখো কাল কী হয়!
কাল আর কী হবে? পরের দিন ষণ্ডামার্কা তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের নিয়ে এসেছে ফুল গাছ খেতে। বেঁচেকুঁচে আছে যে সব রজনীগন্ধা তাতে দেখে ফুলের সঙ্গে কাঁকরিকাটা বাহারি পাতা লাগানো। ষণ্ডামার্কা তো দারুণ খুশি। আরেব্বাস এ যেন সেই আলুভাতের সঙ্গে ধনেপাতা মাখা হয়েছে, মুগডালে কারিপাতার ফোড়ন। তাইরে নাইরে করে লেজ আর মাথা নেড়ে খপাৎ করে কামড় বসিয়েছে সে। আর বসিয়ে একেবারে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ঘুলিয়ে উঠেছে। ইয়েক্ক্যাহ তেতো রে বাবা। আলুস ফুঃ ফ্রুঃ ছ্যাঃ ছোঃ ভ্রুমম! বাপরে বাপরে ল্যাজে কেউ পাক দিয়ে দিয়েছে, চোখে ধুতরো ফুল পিঠে হাতুড়ি আর পায়ে সাবান জল। ল্যাজ তুলে ষণ্ডামার্কা ‘ঘ্যাঁ ঘ্যাঁ’ চিৎকার করতে করতে নিমেষে পগারপার!
দলের গরুগুলো হাঁ! বলদগুলোও হাঁ! একটা বাছুর ছিল, চালিয়াৎ মার্কা! এঁড়ে। সে মাথা নাড়িয়ে গেল হলুদ ডালিয়ার ফুলটা খেতে, খেতে যার মধ্যে বিষকষটা নিমফল ছিল খান পাঁচেক। এক কামড় মারতেই চক্ষু সুপুরিগাছ। খড়াং করে মাথায় উঠে গেল বোঁ বোঁ করে ঘুরতে লাগল আর ‘হাম্বা’ ডাক ভুলে ‘ম্যা’ ‘ম্যা’ করে ডাকতে ডাকতে ল্যাজ তুলে হিসু করতে করতে দে ছুট!
আগেরটা যদিও বা ঠিক ছিল, বাছুরের ছাগলের মতো ডাকে আর বাকি সাঙ্গোপাঙ্গোদের মাথার ঠিক থাকলো না। তারা ঝড়তে পড়তে নিজের পায়েই ল্যাং খেতে খেতে ছুট লাগালো।
আর আমাদের সেই ছোট্ট ছেলেটি? যে এখন আর তত ছোট্ট নেই। সে ছুটে এসে নিমগাছকে জড়িয়ে ধরল আনন্দে। নিমগাছ কিন্তু শান্ত স্বরে বলল, ‘শোন, এখনই এতো উল্লাসের কিছু নেই! তুমি গিয়ে আমার বড় বড় ডালগুলো নিয়ে ভালো করে একটা বেড়া দাও দেখি উৎপাত কমাতে!’ যেমন কথা তেমন কাজ। ছেলেটা তক্ষুনি গিয়ে বেড়া দিল তার বাগানে।
আর ওদিকে ষণ্ডামার্কা আর তার সাঙ্গোপাঙ্গো? তারা তখন একটা নয় দুটো নয় একেবারে তিন তিনটে রাজ্য পেরিয়ে গিয়ে হাজির হল হরিয়ানা পাঞ্জাবের ক্ষেতে। যেখানে রবিশস্য পেকে গেলে ফসল তুলে চাষিরা খড়ের গাদা তৈরি করে রেখেছে আগুন জ্বালাবে বলে। আর আগুন জ্বালালেই ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় সারা আকাশ ছেয়ে গিয়ে মানুষ পশু পাখির নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আর গরুর দল হাজির হয়েই মহানন্দে সেই সব খড় চিবুতে শুরু করে দিল। রাস্তার পাশেই তারা থাকছিল দেখে চাষিরা ঠিক করল একটা খড়ের ছাদ করে দেবে। আর তাদের দেখাদেখি আরও গরু পুষবে। যাতে খড় জ্বালিয়ে পরিবেশ নষ্ট না করতে হয়।
আর সেই ষণ্ডা মার্কা? সে এখন অনেক সুবোধ হয়ে গেছে। রোজ সকালে উঠে পড়ে চুল টুল আঁচড়ে বাদ বাকি বলদগুলোকে নিয়ে লাঙল জুততে যায়। আচ্ছা তাহলে সেই বাছুরটার কী হল? যে ‘ম্যা’ ‘ম্যা’ ডাকতে শুরু করেছিল। সে এখন পেটভরে খড় খেয়েদেয়ে ‘হাম্মা’ ‘হাম্মা’ ডাকতে শুরু করেছে। আশা করা যাচ্ছে, এরকম চলতে থাকলে আর কদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে সে ‘হাম্বা’ ডাকে ফিরে আসবে।