আয় আয় ঘুম রঙমিলান্তি পেনসিলের গল্প সৌরাংশু শরৎ ২০২০

আগের সংখ্যার আয় আয় ঘুম-এর গল্প– আমাদের ছোট্ট শুঁয়োপোকাটি, কোকিলের গান, লাল বেলুনের গল্প, রামধনুর গল্প, আলুর গল্প, বাড়ি আর ক্রেনের গল্প, ইদ্রিশ মিঞাঁর উটের গল্প, তিমি আর ডলফিনের গল্প জাফরি আর রেলিঙের গল্প, হাঁসুমনির গল্প, নিমগাছের গল্প

রঙমিলান্তি পেনসিলের গল্প

সৌরাংশু। ছবি: ঈশান মিস্ত্রী

পেন্সিল কলোনির সবথেকে যে বড় বাড়িটা সেখানে ছোট্ট এইচবি পেন্সিল থাকে। সে এখন একটু বড়সড় হয়েছে। ভালো করে ছুলে দিলে একটা পুরো বাক্য নিজে নিজে লিখতে পারে। অন্ত্যমিল শিখছে, ক”দিন পরেই কবিতা লিখে ফেলবে। বড় বাড়িটার আশেপাশেই এইচবিদের অ্যাপার্টমেন্টস। এইচবিরা প্রচুর পড়াশুনো জানে, ক্রিয়েটিভ কাজকর্মে অতটা দড় না হলেও কলোনির ম্যানেজমেন্টে তারা সিদ্ধহস্ত। তবে কবিতাটবিতা লিখতেটিখতে পারে তারা।

ছবি আঁকা, বাড়ি তৈরি এসবের জন্য রয়েছে স্কেচ পেন্সিলরা। ২বি, ৪বি, ৬বি আর ৮বি। যেমন তাদের নাম, তেমনই তাদের চেহারা। ২বিগুলো পাতলা। তারা বর্ডারে থাকে কলোনির। বর্ডার দিতে কাজে লাগে। আর ৮বিরা হেঁইসান পেটমোট্টা। তারা বিভিন্ন শেড দেবার কাজে লাগে। রোদ যেখানে কম যায়, ৮বিরা সেই অঞ্চলেরই রাজা।

সে যা হোক, আজ পেন্সিল কলোনিতে বড় উৎসব। আজ মানুষের ছবি আঁকা হবে। বিভিন্ন দেশের মানুষ। সাদা কালো ধূসর বাদামি সোনালি। না না ভুল বললাম, বাদামি আর সোনালি তো পেন্সিল কলোনিতে তো হয় না। তারা জানেই না। তারা জানে দাগ থাকলে কালো, দাগ না থাকলে সাদা আর হালকা করে ঘষা দাগ হলে তা ধূসর। এই নিয়ে তাদের বেশ চলে যাচ্ছিল। কিন্তু কথায় আছে না সুখ থাকলে ভুতের কনুই সুড়সুড় করে। সেই হয়েছে মুশকিল। ৪বিদের একটা দাদা টাইপের পাবলিক হঠাৎ বলেছে উৎসব করতে হবে। কী খালি লেখা আর বাড়ির আর গাছের ছবি আঁকা।

অবশ্য গাছ বললেই তো হল না। পেন্সিল কলোনির গাছের গুঁড়ির রঙ গাঢ় ধূসর। পাতা হালকা ধূসর, ফুল সাদা, আকাশ ওই হালকা ধূসর আর অন্ধকার ভীষণ রকমের কালো। তবুও আঁকতে হবে। ৪বির দাদা বলেছে বলে কথা। আঁকা শুরু হল। অ্যাফ্রোঅ্যামেরিকান আর আফ্রিকানদের নিয়ে সমস্যা নেই। ফ্যাকাসে ককেশিয়ানদের নিয়েও নয়। সমস্যা হল সোনালি চুলের পশ্চিম ইউরোপীয় আর দক্ষিণ এশিয়ার লোকজনদের নিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার লোকের গায়ের রঙ আবার গাঢ় থেকে হালকা বাদামি। ধূসর না হয় বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই চেনে। কিন্তু পেন্সিল কলোনিতে সাত জন্মে কেউ বাদামিই দেখেনি তো তার আবার গাঢ় আর হাল্কা। একই কথা সোনালির ক্ষেত্রেও। ওই যে মেয়েটা সাদা রঙের ফুলকাটা ফ্রক পরেছে। মানে যার ছবিটা ম্যুরাল হিসেবে আঁকা হয়েছে, তার মাথার চুল বুড়োদের মতো সাদা। আর সেই যে ছেলেটা সাদা ধুতি আর কিউট দেখতে গিলে করা পাঞ্জাবী পরে ছবি হয়ে আছে। তার গায়ের রঙ? হা বাদামি! পেন্সিল কলোনির বাদামের রঙও ধূসর। কিন্তু তাই বলে তো আর পাঞ্জাবী ধুতি পরা ছেলেটিও ধূসর হয়ে যাবে? তা হয় নাকি!

কেউ কোনও উত্তর খুঁজে পেল না। একগাদা প্রশ্ন নিয়ে সকলেই ঘুমোতে চলে গেল। কিন্তু আমাদের ছোট্ট এইচবি পেন্সিলটির রাতের ঘুম গায়েব। সে ভেবেই চলেছে, ভেবেই চলেছে।

রাত গভীর হল। ধূসর আকাশে একফালি নখছেঁড়া সাদা চাঁদ, কালো অন্ধকার চিড়ে ছোট্ট এইচবির দিকে তাকিয়ে আছে। সে তখনই মনস্থির করে ফেলল। দোতলার বারন্দায় বেরিয়ে পাইপের ইতিউতি খাঁজে পা দিয়ে দিয়ে নেমে পড়ল সে। নেমে পড়েই দে ছুট, দে ছুট। সাদা গ্যাসলাইটের আলো তখন কমে এসেছে। কালো কালো গাছের পাতারা সব ঘুমিয়ে পড়েছে। চকচকে শানবাঁধানো ধূসর রাস্তারা তখন অনেকটা ম্লান। তার উপর দিয়ে ছটফটিয়ে ছুটে চলে গেল ছোট্ট এইচবি। কলোনির গেট বেয়ে পেরিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে উত্তর খুঁজতে।

কতক্ষণ চলেছে সে, তার হিসেব নেই। হঠাৎ দেখল দূরের আকাশে এক অদ্ভুত অনির্বচনীয় রঙ। এইচবির ভোরবেলা ওঠা অভ্যাস। সকালে সে এক মনে এক ঘন্টা অন্ত্যমিল প্র্যাকটিস করে। ভোরের সূর্য সে প্রায়ই দেখে। কিন্তু এই রঙ! এ রঙ সে প্রথম দেখল জীবনে। ঠিক সামনের গাছের যে ফলটা কমলা লেবুর মতো দেখতে, তার মতো রঙ। চোখ জুড়িয়ে গেল তার। সামনেই দেখল অন্য রঙের একটা বোন। বেশি নয়, গলা উঁচু। আর সেই বনে থরে থরে সাজানো হরেক রঙের ফুল। এসব ফুলের নাম সে জানে না। এসব রঙের নাম সে জানে না। কিন্তু তাতে কী! এক ছুট্টে ঝাঁপিয়ে গিয়ে হুটোপুটি খেলা খেলতে লাগল সে, ফুলের সঙ্গে, পাতার সঙ্গে আর ফুলের উপর উড়ে বেড়ানো প্রজাপতির সঙ্গে।

অনেকক্ষণ খেলার পর পর একটু ক্লান্ত ক্লান্ত হয়ে এসেছিল এইচবি। তখনই মনে পড়ল, “আরেহ! বাড়িতে তো মা আর বাবা খুব চিন্তা করবে!” এইচবির বাবা বড় এইচবি পেন্সিল কলোনির নেতা। উঠতে বসতে সকলেই তাঁর পরামর্শ নেয়। তিনিও ধীর স্থির স্বরে মতামত রাখেন। তাঁর মেয়ে হারিয়ে গেছে শুনলে সারা পেন্সিল কলোনিতেই হুলুস্থুল পড়ে যাবে।

বাড়ির কথা মনে পড়তেই হু হু করে উঠল এইচবির মন। সে যে পথে এসেছিল সেই পথেই হুড়মুড়িয়ে ছুটতে শুরু করে। ছুটতে ছুটতে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে সারা গায়ে থোকা থোকা রঙ। এই মরেছে! এসব রঙ কোত্থেকে এল? আর এদের নামই বা কী! কিন্তু মুছলে তো যাচ্ছে না! তাহলে কি এইচবির গায়ের চামড়াই পালটে যাচ্ছে? রঙ পালটে যাচ্ছে? আর পেন্সিল থাকা হবে না তার?

এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ছুটতে ছুটে বড় রাস্তায় উঠতেই ধাক্কা খেলো সে। কাঠের সরু মতো একটা লোক, মাথায় তার হেব্বি উড়ুক্কু চুল, সাইকেল চালিয়ে, “আইল্যা ইয়াপ্পাডাম” বলে একটা গান গাইতে গাইতে আসছিল। নতুন একটা সিনেমায় সে এই গান শুনেছে। ভালো লেগেছে তার।

এইচবির সঙ্গে জড়ামড়ি করে পড়ে গিয়ে সে গেল রেগে, “বুড়বক, দেখকে নেহি চল সকতে!”

এইচবি এমনিতেই ভয় পেয়েছিল। বকা খেয়ে হাঁউমাউ কেঁদে ফেলল, “আমি বাড়ি যাব কী করে! আমার গায়ের রঙ পালটে গেল! আমাকে কেউ আর পেন্সিল কলোনিতে নিজেদের বলে মানবে না!” (এইসব আর কি!)

কাঠের সরু মতো একটা লোক, মাথার তার হেব্বি উড়ুক্কু চুল, তার নাম তুলি! মাথার চুল তার শুয়োরের লোম দিয়ে তৈরি। তাই বেশ বুদ্ধি রাখে। চট করে বুঝে ফেলল কী হয়েছে, “আরে ভাই কাঁদো কেন? আরে তোমার গায়ে তো রঙ লেগেছে! রঙ লাগলে কেউ কাঁদে নাকি? আরে এ তো দারুণ মজার ব্যাপার হয়েছে।”

“রঙ?” অবাক হল এইচবি, “কিন্তু এগুলোকে তো আমি চিনি না! নামও জানি না!” বলল সে।

“আরে দেখ, এই যে পায়ের কাছের যে রঙ, সেটা হল মেটে হলুদ। এঁটেল মাটির এই রঙ হয়। প্যান্টের জায়গায় এত্তোটা করে লেগেছে সবুজ। সবুজ তো পাতার রঙ। আর তোমার ডান ঘাড়ের কাছে লাল, বুকে হলুদ, কানের নিচে কমলা, বাঁহাতের কড়ে আঙুলে নীল আর কনুইয়ে আকাশী, কপালের উপর যে রঙটা আছে সেটা আবার গোলাপি। আর ওইটা লাইল্যাক, এইটা ভায়োলেট, সেইটা ইন্ডিগো আর হুইটা সোনালি!”

“সোনালি!” শুনেই লাফিয়ে উঠল এইচবি, “তাহলে বাদামি কোথায়?”

“আরে বাদামি তোমার পিঠে লেগে আছে। দাঁড়াও আমি এঁকে দিই আর লিখে দিই রঙের নাম।”

এই বলে তুলি ম্যাপের মত করে এঁকে লিখে দিল এইচবির পিঠে পেটে বুকে মাথায় নাকে কানে পায়ে যে যেখানে রঙ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের নাম। ফিরে চলল এইচবি। খুব ফুর্তি তার।

এদিকে ভোর হতেই খোঁজ খোঁজ পড়ে গেছে পেন্সিল কলোনিতে। বড় এইচবির মেয়ে নিখোঁজ! ভাবা যায়! সবাই খোঁজাখুঁজি করছে, গুঞ্জন, জটলা। এমন সময় লাফাতে লাফাতে হবি ঢুকল পেন্সিল কলোনির গেট দিয়ে। “আরে বড় এইচবির মেয়ে ফিরে এসেছে।” ভিড় ছুটে গেল তার দিকে। গিয়েই চমকে গেল সবাই! এ কী চেহারা হয়েছে মেয়ের! এইচবি কিন্তু নিরুত্তাপ। সে বলল, “বাবাকে ডেকে আনো।” বড় এইচবি হাঁকডাক শুনে এলেন সেখানে। তিনি আবার কোনও কিছুতেই চট করে ঘাবড়ান না।

আমাদের এইচবি বাবাকে দেখে যারপরনাই খুশি হয়ে বলল, “বাবা বাবা! আমি রঙ খুঁজে পেয়েছি!”

বাবা খুব আনন্দে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু মেয়েই আটকাল। তারপর পকেট থেকে তুলির দেওয়া কাগজ বার করে জোরে জোরে প্রতিটি নাম পড়ে শোনালো সবাইকে। আর শেষে ৪বির দাদাটাকে বলল, “ওই ছেলেটার পাঞ্জাবীর রঙ সবুজ করে দাও। আর মেরুন ধুতি। অবশ্য মেয়েটার ফ্রকটা লালের উপর হলুদ ফুল করে দিলে ক্ষতি নেই!”

তারপর সবাই মিলে ঠিক করল, প্রতিটি আঁকার পেন্সিলের দল তৈরি হবে। ২বি, ৪বি, ৬বি আর সূর্যের আলো কম পৌঁছয় যেখানে সেখানকার ৮বি। তারা দলে দলে গিয়ে রঙ নিয়ে এলো রঙিন ফুলের বন থেকে। তারপর সূর্যকে কমলা, আকাশকে আসমানী, আপেলকে লাল, অপরাজিতাকে নীল আর সকলের ঠোঁট গোলাপি রঙে রাঙাল। অবশ্য বড় এইচবি বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি বলে দিয়েছিলেন, “এক এক দল যেন রঙ ফুরলে অন্য রঙ মেখে আসে। সারা জীবন ধরে একই রঙের গল্প শুনবে এ ঠিক নয়। সকল রঙের গল্প সবাইকে জানতে হবে। তাহলে কাউকে বুঝতে অসুবিধা হবে না কারুর!”

এইভাবে রংহীন পেন্সিলের কলোনি রংমিলান্তি নাম নিল। আর একদিন সবাই ঘটা করে তুলিকে ডেকে খাইয়েও দিল।

তুলি এখন আমাদের ছোট্ট এইচবির খুব বন্ধু হয়ে গেছে। দুজনে মিলে ঠিক করেছে, এবার পুজোয় মা দুর্গার চক্ষুদান করবে। আর এইচবি সেই নিয়ে কবিতা লিখবে। রঙ মিলাতে গিয়ে এখন কবিতার অন্ত্যমিলও আমাদের ছোট্ট এইচবি ভালোভাবে মেলাতে শিখে গেছে যে!

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s