আগের সংখ্যার গল্প– আমাদের ছোট্ট শুঁয়োপোকাটি, কোকিলের গান, লাল বেলুনের গল্প, রামধনুর গল্প, আলুর গল্প, বাড়ি আর ক্রেনের গল্প, ইদ্রিশ মিঞাঁর উটের গল্প, তিমি আর ডলফিনের গল্প
এই গল্পদের সৌরাংশু তার খুদেকে ঘুম পাড়াবার জন্য বানায়। আপনারাও আপনাদের খুদেদের এই গল্পগুলো বলে ঘুম পাড়াবেন।
হাঁসুমনির গল্প
কথনঃ সৌরাংশু সিনহা ছবিঃ ঈশান মিস্ত্রী
রাজহাঁসের বাচ্চাগুলোকে এমনিতে ভালো দেখতে হয় না। কিন্তু তাতে টেনশনের কিছু নেই। ভাল্লুকের বাচ্চারাও তো কুট্টিটি হয়। এত্তোই ছোট যে মা ভাল্লুক বসে পড়ার ভয় থাকে। হাতির বাচ্চা, ঘোড়ার বাচ্চা, গরু আর গাধার বাচ্চারা জন্মেই ন্যালপ্যাল করতে থাকে। আর মানুষের বাচ্চাগুলোর কথা তো ছেড়েই দিলাম। “জম্মে বড় হয় না,” বলছিল তারাপিসি। তারাপিসি বুঁচুনদের ডোবাটায় থাকে। দিনের বেলায় গেঁড়িগুগলি, চুনো মাছ, মৌরলা আর এটা সেটা খেয়ে দেয়ে পাড়া বেড়াতে বেরোয়।
হাঁসুমনি একটু ভয়ে ভয়ে থাকে তারাপিসির থেকে। তারাপিসির অদ্ভুত ক্ষমতা। কতদিনের বাসি, পচা, ভুলে যাওয়া পেটের কথা টেনে আনতে তারা পিসির জুড়ি নেই। আর সব থেকে ভয়ের যেটা, সেটা হল মুখের ফিকে তাকিয়েই সেসব কথা বলে দেয়, যা সত্যি হতেও পারে আবার নাও। কিন্তু সত্যিই সত্যি হলে মুশকিল।
এই যেমন এখন, উপরের কথাগুলো তারাপিসি বলে দিল, যার আসলে কোন মানে নেই। কিন্তু কথাগুলো শোনার পর থেকেই হাঁসুমনির ভিতরের ভয়টা বাইরে লাফিয়ে পড়ে আরকি।
আমাদের হাঁসুমনিটা খুব মিষ্টি। বড়ো বড়ো টানাটানা চোখ। সুন্দর সবুজ কমলা রঙের ঠোঁট। লম্বা গলা। সমস্যা বলতে একটুই, ডান পাটা বাঁ পায়ের থেকে একটু ছোট। সেই নিয়ে অবশ্য পাড়াপড়শির চিন্তার শেষ নেই। হাবুলদের বাড়ি থেকে যখন দানা দেওয়া হয় তখন সবাই হুড়মুড়িয়ে ছুটতে থাকে। আর যত সমস্যা হয় হাঁসুমনির মায়ের। বাকি ছেলেমেয়েগুলো নিজের নিজের মতো খেয়ে পাড়ায় বেরিয়ে গেলেও, হাঁসুমনি পৌঁছয় সবার পরে, যখন দুটো চারটে দানা পড়ে থাকে শুধু। মায়েরও পেট ভরে না, হাঁসুমনিরও না।
সেই হাঁসুমনির মা পরশুদিন খানচারেক ডিম পেড়েছে আবার। মা কিছু বলেনি। একমনে তা দিচ্ছে। কিন্তু পাড়াপড়শিরা বলেছে যে, হাঁসুমনির মার এখন আরও ছোট্ট ছানাপোনা হবে ফলে হাঁসুমনির দিকে মা নজর দিতে পারবে না খুব একটা। চিন্তার কথা। তাহলে খাওয়াদাওয়াটা কী হবে?
এই প্রশ্নটা নিজেরা করেই পাড়াপড়শিরা হয় বিজ্ঞের মতো হাসছে, নয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। তারাপিসি ব্যাপারটা দেখেছে। কিন্তু একে বেপাড়ার, তার উপর পানকৌড়ি। তাই রাজহাঁসদের ব্যাপারে নাক গলাতে যায়নি এদ্দিন।
আজ একা পেয়ে হাঁসুমনিকে উপরের কথাগুলো বলল সে। হাঁসুমনি এসবে একদিন একটু ঘাবড়েই ছিল। আজ একটু খোঁচাতেই চোখের জল বাঁধ মানল না।
“আমার কী হবে গো তারাপিসি? মা না গেলে আমি তো খেতেই পাই না। এরপর তো মা ভাইবোনগুলোকেই বেশি সময় দেবে?”
তারাপিসি তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল হাঁসুমনির দিকে তারপর বলল, “ডানাটা ছড়া দিকি? এই এরকম করে কাঁধের দুপাশে।” বলে নিজেই দেখালো।
হাঁসুমনি ছোট্টটি হলেও সে রাজহাঁস। ডানায় সাদা সাদা পালক আসতে শুরু করেছে তার। তারাপিসির কথায় একটু লেংচে নিয়ে দু’ডানা ছড়ালো সে। তারাপিসি ভালো করে দেখল। তারপর মুচকি হেসে বলল, “চল এতেই হবে! ফি সন্ধেয় আমার কাছে আসবি আর খুব ভোরে। খবরদার কেউ যেন না দেখে। তোদের রাজহাঁসেদের আবার এসবে প্রচুর গোঁড়ামো, বাছবিচার। তাই তোর ডানার জোর দেখলাম। দিবি একদম মুখ ঝামটা দিয়ে কেউ কিছু বলতে এলে।”
কী বুঝল কে জানে, হাঁসুমনি তারাপিসির কথায় সাহস পেল খুব। সটাং তাই ঘাড় নেড়ে দিল সে। ডান দিকে। পাটা ছোট হওয়ায় একটু বেশিই যেন ঘাড় হেলাতে পারল।
তারপর? তারপর আর কী! সকাল সন্ধ্যা প্র্যাকটিশ চলল হাঁসুমনির, তারাপিসির তত্ত্বাবধানে। তারা মাসি তাকে মাছও চেনালো। ছোট পোনা, বড় রুই, ভীষণ বড় কাতলা, কালচে কালবোশ, রুপালি মৃগেল, ছোট বড় সরপুঁটি, সটাং পারসে, মেটে রঙের বেলে, কালচে মোষে ট্যাংরা, সাদা পাবদা ট্যাংরা, কাজলি, বাঁশপাতা আর গভীর জলের ছোট ছোট গুলে।
আর ক’দিন পর যখন হাঁসুমনির মার নতুন ডিমগুলো ফুটে বাচ্চা বেরোল, তখন ইয়াব্বড়ো একটা বানমাছ ঠোঁটে নিয়ে তারাপিসির সঙ্গে হেঁটে এসে হাজির করল আমাদের হাঁসুমনি। “বানমাছে নাকি খুব প্রোটিন থাকে। তোমার আর আমার ছোট্ট ভাইবোনেদের দরকার হবে।”
পাড়াপড়শিরা হইহই করে উঠল। একী একী একী! এই সব ম্লেচ্ছ পানকৌড়িদের পাল্লায় জাত খোয়াবে নাকি রাজহাঁসের বাচ্চা? হায় হায় সব গেলো।
হাঁসুমনির এখন ভয়ডর কমে গেছে। সে-ও মুখে মাছটা নিয়ে ডানা ছড়ালো। তারাপিসি তো ছিলই। কিন্তু মারপিট উদ্যত দুইপক্ষকে এক ধমকে থামিয়ে দিল হাঁসুমনির মা।
“থামো তোমরা। আমার মেয়েটা খোঁড়া বলে মনের দুঃখে যখন ঘুরে বেরাত তখন কোথায় ছিলে তোমরা? আমি না হয় ডিমে তা দিচ্ছিলাম। কিন্তু তোমরা ওকে ভয় দেখানো ছাড়া কিস্যুটি করনি। সেখানে বেজাতই হোক আর যাই হোক তারা এগিয়ে এসে বেঁচে থাকার জন্য জরুরি সাঁতার কেটে শিকার করতে তো ওকে শিখিয়ে দিয়েছে। তাই কেউ একটাও কথা বলবে না।”রাজহাঁসের দল গোঁড়া হলেও সদ্য মায়ের গম্ভীর হুকুম অমান্য করতে পারল না। গাঁইগুঁই করতে করতে সরে যেতে লাগল। আর তাদের মধ্যে একটু নতুন বা আধুনিক যারা ছিল তারা বরং ঘাড় নেড়ে হাঁসুমনির মাকে সমর্থনও করল। দু’একজন আবার তারাপসির পিঠে ডানা বুলিয়ে সাবাশিও দিল। একজন নতুন মা, যার নাম শচিদুলালী সে আবার চুপিচুপি তারাপিসির ফোন নম্বরটাও নিয়ে নিল, তার চারটে ছেলেমেয়েকে তারাপিসির কাছে ট্রেনিং-এ পাঠাবে বলে।
এরপর হাঁসুমনির মা আদর করে ডাকল হাঁসুমনিকে, “আয় দেখি মা আমার। এ কদিনে কত্তো বড়ো হয়ে গেলি রে! কত বড়োদের মতো ভাবতে শিখে গেলি। বাহ বা! মা’র জন্য মাছ নিয়ে এসেছিস। আহা আমার আর কোন চিন্তা নেই।”
মা’র কোলের কাছে বাকি ছোট ভাইবোনেদের সঙ্গে ঘুচিমুচি করে জড়িয়ে হাঁসুমনি বলল, আমার বড়ো দাদা আর দিদিগুলোকেও ডেকে নাও মা। আর তারপর ওদেরও মাছ ধরা শিখিয়ে দেবে। আর রেগুলার মাছ খেলে চোখের জোর বাড়ে। আর আমার ছোট্ট ভাইবোনগুলো বড়ো হলে আমি নিজে শেখাব ওদের। কেমন?”
খুব খুশি হয়ে হাঁসুমনির মা ঘাড় নাড়ল আর সব ক’টা ছানাপোনাকে আদর করে জড়িয়ে ধরল সে।
তারাপিসির এসব ভালোই লাগে। মনে মনে ভাবল, রিস্ক নিয়ে বেশ বিজনেসও জুটে গেল তো। এবারে তাহলে একটা ফিশিং ট্রেনিং স্কুল খুলবে সে। ফাইভ স্টার ফিশিং অ্যাণ্ড সুইমিং স্কুল।
সবার জন্যই দরজা খোলা থাকবে। আমাদের জন্যও।
<–পরের আয় আয় ঘুম