আয় আয় ঘুম আলুর গল্প সৌরাংশু সিংহ ও ঈশান মিস্ত্রী শরৎ ২০১৯

আয় আয় ঘুম

লেখা সৌরাংশু ছবি ঈশান মিস্ত্রি

আগের সংখ্যার গল্প– আমাদের ছোট্ট শুঁয়োপোকাটিকোকিলের গান, লাল বেলুনের গল্প, রামধনুর গল্প

আলুর গল্প

গল্প সৌরাংশু ছবি ঈশান

‘আ’বাড়ি বনেদি বাড়ি। এখনও তাদের ভিতর ঘরের দরজা জানলা ছাদ মেঝে সেই বনেদিয়ানার প্রমাণ দেয়। মানে বেশ পুরনো বাড়ি আর কি। ‘আ’ বাড়ির বড়ছেলে বিলেতে থাকে, নাম তার আনারস। মেজ ছেলে আম। কি তার রূপ, কি তার রঙ, কি তার গন্ধ! এক টুকরো কাটলে ম ম করতে থাকে সারা বাড়ি। আর তার কমলা হলুদ রঙ! সে রঙের জেল্লায় সারা পৃথিবী মোহিত। বড় ছেলের কথা বললাম না? সেজ ছেলে এখন পড়াশুনো করতে গেছে আনারসের কাছে। খবর এসেছে ইতিমধ্যেই বিলেতের হাওয়া জল খেয়ে সেজ ছেলে আপেল লাল টুকটুকে হয়ে গেছে। নাম জিজ্ঞেস করলে আর ‘আপেল’ বলে না! বলে ‘অ্যাপল’।

যাই হোক, আমাদের সমস্যাটা হোল ছোট ছেলেটাকে নিয়ে। আলু। তার তিন দাদার মতো তার রূপ নেই। বরং বলা চলে, চামড়া ওঠা ওঠা ময়লা ময়লা গায়ের রঙ তার। খোসা ছাড়িয়ে রাখলেও কিচ্ছুক্ষণেই হাওয়া লেগে কালো হয়ে যায়। চেহারাও এমন কিছু না। কোন ছিরি ছাঁদ নেই। এদিক ওদিক দিয়ে বেঢপ ভুঁড়ি বেরিয়ে। রাস্তায় বেরোলে পাড়ার ছেলেরা আওয়াজ দেয় ‘ইনজামাম’ বলে। মোটা মানেই কি ইনজামাম? আর ইনজামাম মানেও সে বোঝে না। তাই মন খারাপ করে থাকে।

পাড়ার মোড়েই আরেকটা বাড়ি বেশ কিছুদিন ধরে সুনাম পাচ্ছে। পড়াশুনোয়, শিক্ষা দীক্ষায়, খেলাধুলোয়। ও বাড়ির দুই মেয়ে আর দুই ছেলে। একটা আবার সর্দার। বড় মেয়ে কলা লম্বা ছিপছিপে। বড় ছেলে কমলা রসে টইটম্বুর। আর তারপর দুই যমজ- মেয়ে ফুলকপি আর ছেলেটা মাথায় পাগড়ি বেঁধে থাকে, তার নাম বাঁধাকপি।

তা আলুর সমস্যা হয়েছে ওই ফুলকপিকে নিয়েই। ফুলকপি আলুর ক্লাসেই পড়ে। একই বাসে বাড়ি থেকে স্কুলে যায় আর স্কুল থেকে বাড়ি আসে। কিন্তু আলুর সঙ্গে একদম ভাব নেই। আলুকে খুব ছ্যাড়াভ্যারা করে। ছ্যাড়াভ্যারা মানে ‘দূরছাই’। তার বন্ধুত্ব নরম নরম কিন্তু কাঠ কাঠ পনীরের সঙ্গে, গায়ে ডিও লাগানো ভেটকির সঙ্গে আর গোলমটোল কড়াইশুঁটির সঙ্গে। কড়াইশুঁটি আবার স্টাইল করে নিজের নাম বলে ‘মটর’। ‘ক’ বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক নেই কিনা তাই!

কিন্তু আলুকে নিয়ে খুব সমস্যা হচ্ছে। যত বড় হচ্ছে ততো তার মনের দুঃখ বাড়ছে, ততই শুকিয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। আসলে ফুলকপিটাও যে কেন ওকে নিয়ে ঠাট্টা করে, সেটাতেই সবথেকে বেশি সমস্যা হয়েছে। কেউ তলিয়ে দেখে না আলুর মনটা কত ভালো। ও সবার সঙ্গে মিলে মিশে থাকতে পারে। রান্নায় নুন বেশি হলে ঝোলের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে নেমে সব নুনও শুষে নিতে পারে। সবজি কম হলে আয়তন বাড়াতে পারে। আর ভাজা বা ভাতে বা ভর্তা বা ছেঁচকির টেস্ট তো ছেড়েই দিলাম। সবাই আসলে বাইরের রূপই দেখে।

তা সেদিন আম বসেছিল বারান্দায়। আলু মনমরা হয়ে স্কুল থেকে ফিরেছে। ফুলকপিকে গল্প করতে শুনেছে যে স্কুলে একটা মাইক্রো ওভেন কেনা হয়েছে নাকি। সেখানে ফুলকপি নিজে নিজেই রোস্ট হবে। তখন তার আর কাউকে বন্ধু দরকার নেই।

আম আলুকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে রে? খাস না নাকি? শুকিয়ে শুকিয়ে যাচ্ছিস? সব ঠিক আছে তো?’

আলু চুপ করে থাকে, কিছু বলে না। তখন আম ডেকে বলল, ‘কেউ কিছু বলেছে তোকে?’ আলু তবু চুপ। আম নিজেই বলল, ‘দেখ খোকন, আমি জানি, আমাদের বাড়িতে সবাই রাজপুত্রের মতো দেখতে আর তোকে সেরকম দেখতে না বলে তোর মন খারাপ থাকে! এটা কোন ব্যাপার হল?’

আলু এবারে মুখ খুলল, ‘আরে আমাকে দেখতে ভালো না তো কি হয়েছে! আমার কাজগুলো তো কেউ দেখে না!’

আম নিজের থেকে দু চোকলা কেটে একটা আলুকে দিয়ে আর একটা নিজে খেতে খেতে বলল, ‘শোন খোকন। আমায় দেখতে শুনতে ভালো, লোকে মুখে দিয়েই ‘আহা’ ‘উহু’ করে পাগল হয়ে যায় বলে ‘ক’ বাড়ির কলারও অসুবিধে হত। ও আর আমি এক বয়সী তো! কিন্তু লোকে খালি তুলনা করত! তা তুই বরং কলার কাছে যা। ওই বলবে ও কীভাবে এসব ম্যানেজ করেছিল।’

যেমন বলা তেমন কাজ। আলু ছুটতে ছুটতে ‘ক’বাড়িতে গেল। দরজা খুলল সর্দার, বাঁধাকপি। সে আবার ঠেট গুরমুখীতে বলল, ‘তেনু কী চাহিদা?’ আলু অতশত বোঝে না। সে মুখ নিচু করে বলল, ‘চাহিদা কিচ্ছু নেই। শুধু কলাদির সঙ্গে দেখা করতে চাই। এটাই চাহিদা!’ বাঁধাকপি কী বুঝল কে জানে? আলুর কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘চল ইয়ার ফিন!’ আলু বলল, ‘ওকে’।

কলা তখন সবে কলেজ থেকে ফিরেছে। ব্যাগট্যাগ নামিয়ে রেখে জুতোটুতো খুলেছে। আলু এসে বলল, ‘কলাদি, কলাদি! দাদা বলল তুমি আমার সমস্যা সমাধান করতে পারবে!’

কলাও আমকে পছন্দ করত। বিশেষ করে গরম কালে দুধ মুড়ি চিঁড়ে আর সন্দেশের সঙ্গে দুজনে মিলে হইচই করত, সেটা কলার দারুণ মজা লাগত। সে আদ্যোপান্ত শুনল মন দিয়ে। তারপর বলল, “আমারও এরকম হত জানিস! তোর মেজদাকে সবাই খুব ভালোবাসত। আর আমাকে খুব একটা পাত্তা দিত না। আম কিন্তু এমন নয়। সে একদিন আমায় ডেকে বলল, ‘দ্যাখ কলা, আমি তো মরশুমী! দুদিনের জন্য আসি, আর তিনদিন পরেই চলে যাই। অথচ তুই শীত গ্রীষ্ম বর্ষা সবসময় আছিস। মানুষের সুখে দুঃখে তাদেরকে শক্তি দিস। কাজ করার শক্তি, খেলার শক্তি, ফসফরাস দিস।’ ফসফরাস মানে জানিস তো? ফসফরাস বুকের মধ্যে আলো জ্বালায়। বুদ্ধিশুদ্ধি বাড়ায়। আমিও ভাবলাম, সত্যিই তো। মানুষ যখন একদম টায়ার্ড হয়ে ক্লান্ত হয়ে যায়, তখন তো আমারই ডাক পরে। আর আমিও বাইরে রেখে দিলেই তোর মতো কালচে মেরে যেতাম। তাই সবাইকে ডেকে ডেকে বললাম। দেখো ফেলে রেখো না। যখনই দরকার হবে, আমায় খেয়ে নেবে। পেটও ভরবে আর মাথাও ভরবে। তুই তোর কথা ভাব। তুই এত ভালো, সবার সঙ্গে মিশে যাস। আবার নিজে কার্বোহাইড্রেট হিসাবেও কাজ করতে পারিস! কার্বোহাইড্রেট মানে জানিস তো? ভাত রুটির মতো আলু সেদ্ধ দিয়েও খাওয়া যায়। বিদেশে তো ম্যাসড পটেটোটাই মেন ডিশ। তাহলে?’

আলু এতক্ষণ ধরে সব মন দিয়ে শুনছিল! এখন সব অভিমান ঝরে পড়ল, ‘তাহলে ফুলকপিটা আমায় পাত্তা দেয় না কেন? আমি কতবার বলেছি আলুফুলকপির তরকারি হলে দারুণ লাগে। এমন কি ধনেপাতা কাঁচালংকা আর জিরে ফোড়ন দিয়ে আলুফুলকপি ভাজাও রুটি দিয়ে বা ডাল ভাত দিয়ে ফ্যান্টাস্টিক লাগে। কে শোনে কার কথা!’

কলা হেসে ফেলল, ‘ও এই ব্যাপার? আমি ওকে বুঝিয়ে দেব। আসলে ও ছোট তো! ও অতশত বোঝে না। সকলে ওকে দারুণ বলে ও তাতেই খুশি। বড় হোক, তুইও বড় হ। তখন দেখবি তোর মর্ম বুঝেছে! আর শোন, অত মন খারাপ করে থাকিস না। যারা তোকে নিয়ে ঠাট্টা করে তারাও দেখবি দুদিন পরে তোর মর্ম বুঝবে। এটাও বুঝবে যে ফলের মধ্যে আম যেমন রাজা, তেমনই সবজির মধ্যে আলু হল রাজা। তোর ভিতরের সুন্দর দিকটা আস্তে আস্তে প্রকাশ পাবে। তখন দেখবি কি কদরটাই না পাচ্ছিস! বুঝলি?’

সটাং ঘাড় নেড়ে আলু যখন বেরিয়ে এলো ‘ক’ বাড়ি থেকে তখন দেখে ফুলকপি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে হাতও নাড়ল। আলুর খুব আনন্দ হল। আর আমাদেরও হল। ঠিক যেরকম ফুলকো লুচি দিয়ে আলুফুলকপিভাজা খেতে লাগে। সেরকম আনন্দ।

<–আগের আয় আয় ঘুম

Leave a comment