আগের সংখ্যার গল্প– আমাদের ছোট্ট শুঁয়োপোকাটি, কোকিলের গান, লাল বেলুনের গল্প, রামধনুর গল্প
বাড়ি আর ক্রেনের গল্প
লেখা সৌরাংশু ছবি ঈশান মিস্ত্রি
আজকের সূয্যিমামার রঙটা সবুজ হয়ে গেছিল। আর ঘাসগুলো নীল। সোনা রঙের তালগাছটার উপর বসে ছিল একটা গোলাপি রঙের তাজঝিম পাখি। ক্রেনটার উপর থেকে এক ফালি ধোঁয়া ওঠা সিমেন্টের টুকরো ফসকে পড়ে যেতেই ঝটপটিয়ে উড়ে গেল সে। ক্রেনটা জিজ্ঞাসা করল বাড়িটাকে, ‘কী ভাবছিস রে?’
বাড়িটা বলল, ‘আচ্ছা বল, এই যে সব চেনাচেনা রঙ এগুলো যদি সব পালটে যেতো তাহলে কেমন হতো বলত?’ ক্রেন এসব তত্ত্বকথা বোঝে না। তার কাছে লোহার বিম যা, তারজালির জাফরিও তাই। শেষমেষ নিচ থেকে ওপরে আর ওপর থেকে নিচ করতে হবে। এই যে বাড়িটা তিল তিল করে বেড়ে উঠে আজ একুশ তলায় ক্রেনের সমান দাঁড়িয়ে আছে, সেটা কার জন্য? ক্রেন নিজেই তুলে তুলে এনেছিল বলে তাই না এতটা উঠতে পারল!
বাড়িকে একদিন একথা বলতে, বুকের ভিতরের ভরা বাতাস দিয়ে ক্রেনের গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়েছিল সে। বলেছিল, ‘তুমি আছো বলেই তো আমি আছি!’ এই যে একটা বাড়ি তার তেষট্টিটা ফ্ল্যাট। তার যে সাজগোজ, পোশাক আশাক, গয়নাগাটি, এসব কে তুলে তুলে নিয়ে আসে? কেন ক্রেন?
তবু ক্রেনের ভয় করে যখন বাড়ি তৈরি হয়ে যাবে তখন তাকেও তো অন্য জায়গায় চলে যেতে হবে। বাড়িটার হয়তো মনেও থাকবে না। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করে বাড়িটাকে, ‘হ্যাঁ রে বাড়ি, আমাকে ভুলে যাবি না তো?’ বাড়ি হাসে। এখনও তার দেওয়াল লাগেনি, তাই ফোকলা হাসিই হাসে, ‘আহা তুই তো আমার প্রথম বন্ধু রে! এই যে মাটির ভিতর থেকে এতখানি উঠে উঠে এলাম। কে দেখল সবসময়? সারাক্ষণ? তুই না থাকলে আমি থাকতাম নাকি রে? আর তোকেই ভুলে যাব?’
ক্রেন ছড়ানো হাতটা দিয়ে মাথাটা চুলকে নেয়, তারপর মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বলে, ‘কি জানি!’ বাড়ি তাও শুনতে পায়। আর আবার হাত বাড়িয়ে আদর করে দেয়। এখন অবশ্য নিচের দিকের দেওয়ালগুলো উঠতে লেগেছে। বাড়ির পা, কোমর, তারপর সারা শরীর শক্তপোক্ত হয়ে উঠছে। মাঝে মাঝে ভারা বেয়ে রাজমিস্ত্রি মজুররা ক্রেনের গায়ে উঠে বাড়িটাকে স্নান করায়। ইঁট, সিমেন্ট, বালির শরীরের গাঁথুনি শক্ত করে।
এরপর, এক এক করে ঘর তৈরি হবে। দরজা, জানলা, হাওয়া বাতাসও তখন গৃহস্থের অনুমতি নিয়ে তবেই ঢুকবে বেরোবে। ক্রেন কিচ্ছু বলে না, দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
বাড়ির গায়ে তখন রঙ লেগেছে। ঠিক যেভাবে সে পৃথিবীটাকে দেখতে চায়, সেইভাবেই। সূর্যটা নীল, আকাশটা আসমানি সবুজ, ঘাস গোলাপি, পাখি চাঁদভাসি রঙের আর আর আর কত্তো কি। ক্রেনটা ঝড়জলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেজে, আর দেখে বাড়ির গায়ে তখন ওয়াটারপ্রুফ লাগছে। ক্রেনের গায়ে তখন মরচের বাতাস। মন খারাপ, মন খারাপ খুব। কত দিনের সম্পর্ক, আর তো মোটে কদিন পরেই ফুরিয়ে যাবে। বাড়িটা তখন নিজের ভিতরের লোকজন, বাচ্চাকাচ্চা, টিভি ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ, গিজার আর বারান্দায় ঝোলানো নেহাত না হলেই নয় দুচারতে মিনিয়েচার গাছ নিয়ে সংসার করবে। ভরন্ত সংসার।
বাড়িটাও ভাবে, চলে গেলে তো আর ক্রেনের দেখাও পাবে না সে। আজ তার শরীর ভরে এসেছে। গায়ে গতরে সে বিশশাল পালোয়ানের মতো দাঁড়িয়ে। কিন্তু ক্রেনকে কী করে ভুলবে সে? যার জন্য আজ তার রমরমা। অনেক ভাবল সে। অনেক অনেক অনেক। যদ্দিন ধরে বাড়িটাকে সাজানো গোছানো হল। আজ সন্ধ্যায় সব কাজ প্রায় সারা হয়ে গেছে। কাল বা পরশু হয়তো ক্রেনও চলে যাবে। ক্রেন এখন বাড়ির মুখটা দেখতে পায় না। পিছনের দিকে থাকে তো! আর তো কটা দিন। তারপর সেও… মনকে এর মধ্যেই বুঝিয়ে নিয়েছে সে। আবার নতুন কাউকে তৈরি করবে। নতুন বাড়ি অথবা ব্রিজ অথবা মেট্রো রেল। এরকম তো কতই… মন বার বার খারাপ হয় বটে। কিন্তু কী আর করা যাবে।
বাড়িটা কিন্তু এর মধ্যেই ভেবে নিয়েছে। রাজমিস্ত্রির সঙ্গে কথাও হয়েছে। যেদিন বাড়ির রঙ শেষ হল, সেদিন বাড়তি সব রঙ দিয়ে সারা রাত ধরে কাজ করল রাজমিস্ত্রি রঙের মিস্ত্রিরা। সারারাত!
পরদিন সকালে ক্রেন ঘুম থেকে উঠে দেখল তার গায়ে সবুজ রঙের সূর্য, নীল রঙের ঘাস, সোনা রঙের তালগাছ, চাঁদভাসি পাখি ছেয়ে আছে। ক্রেন চমকে উঠল, ‘এগুলো কী?’ আস্তে আস্তে ক্রেন সরিয়ে নিয়ে বাড়ির সামনের দিকে নিয়ে আসতেই ক্রেন দেখল, সুন্দর মনের বাড়িটা আরও সুন্দর সেজে ওর দিকে মিষ্টি করে হাসছে।
ক্রেন জিজ্ঞাসা করল, ‘এগুলো সব কী?’
বাড়িটা তার সব জানলা সব দরজা খুলে দিয়ে বুকের বাতাস দিয়ে ক্রেনকে আদর করে বলল, ‘আজ থেকে আমার স্বপ্নগুলো তোমায় দিয়ে দিলাম। আমার সব রঙগুলোও! এখন তো আর আমায় ভুলতে পারবে না তুমি। আমাকেও সবসময় মনে পড়বে! আর কি! চিঠি লিখো তাহলে?’
ক্রেনের মনে খুব আনন্দ হল। তার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটাতে একটা থামস আপ দেখিয়ে বলে উঠল, ‘লিখব লিখব! তুমিও লিখো কিন্তু!’ পূব আকাশের সূর্যটা তখন সত্যিই আনন্দে সবুজ হয়ে উঠেছে।