আয় আয় ঘুম- লাল বেলুনের গল্প সৌরাংশু সিংহ ও ঈশান মিস্ত্রী বর্ষা ২০১৯

আয় আয় ঘুম

লেখা সৌরাংশু ছবি ঈশান মিস্ত্রি

আগের সংখ্যার গল্প– আমাদের ছোট্ট শুঁয়োপোকাটি, কোকিলের গান

রাত্রির সময় যখন বাড়ির শিশুটি আহার করিয়াও ঘুমাইতে চাহে না তখন দিল্লির কোনো এক অঞ্চলের স্নেহপরায়ণ পিতা এই গল্পগুলি বলিয়া তাহাকে ঘুম পাড়াইয়া থাকেন। সেই শিশুটি বড় হইয়াও হয়তো এই গল্পগুলির মিষ্টতা ভুলিতে পারিবে না। আশা করি আমার ঝিলিমিলি পাঠক-পাঠিকার নিকটও এগুলি মিষ্ট লাগিবে।

লাল বেলুনের গল্প

লেখাঃ সৌরংশু সিংহ  ছবি ঈশান মিস্ত্রী

ন্যু ক্যাম্পে গত মাসে যেটা দিয়ে এল ক্লাসিকো খেলা হল, সেই বলটা তারপর মাসখানেকের জন্য ছুটি পেয়েছিল। মেটারনিটি লিভ, আলট্রাসাউণ্ডে দেখা গেছে যে তার খানচারেক রংবেরং-এর বাচ্চা হবে আর একটা যমজ বাচ্চা হবে। মানে দুটো। কিন্তু যমজ বল কী ভাবে হয় এটা নিয়ে অনেকের খুব কৌতূহল ছিল। যেটা গত রবিবার মিটেছে। বল নয়, যমজটি কেমন করে জানি না দুটো মাথাওয়ালা একটা লাল বেলুন হয়ে জন্মেছে।

একে বেলুন তায় দুটো মাথা। নাইকির বলটি বুঝে পাচ্ছিল না সেটাকে নিয়ে কী করবে। এমনিতেই হপ্তা চারেক পরেই তাকে মাঠে নামতে হবে। আর তার সঙ্গে চারটে বাচ্চা বলকে বড় করাও আছে। সে অনেক হ্যাপা। নিয়মিত হাওয়া দাও রে, পরীক্ষা করাও রে, ফরওয়ার্ডদের লাথি, গোলকিপারদের থাবড়া আর ডিফেন্ডারদের গুঁতো খাওয়াও রে। এরপরে হয়তো লা লিগার কোন একটা ম্যাচে খেলার সুযোগ পাবে তারা।

মা বল ভেবে রেখে দিয়েছিল যে ছেলেমেয়েগুলোকে একসঙ্গে শেখাবে। তাহলে ওরা একই ম্যাচে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে খেলতেও পারবে। সে যা হোক। কিন্তু এই দুই মাথাওলা বেলুনটা নিয়ে যে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না সে। বার্সার বল ব্যাগের সবকটা বল একসঙ্গে একদিন মা বলের ছানাপোনা দেখতে এল। এসে বেলুনটাকে দেখে সবাই একযোগে রায় দিল একে বুকে হাওয়া ভরে ছেড়ে দাও। যা থাকে ওর কপালে, ভালো কিছুই হবে।

ভালো কিছুই হবে! মা বল এর বাইরে কিছু ভাবতে পারছিল না। কিন্তু তারও মাঠে ফেরার তাড়া ছিল। তাই এক পূর্ণিমার রাত্রে দুই মাথাওলা বেলুনটাকে বুকে জড়িয়ে বাইরে এসে গ্যাস ভরে দিয়ে জ্যোৎস্নার নদীতে ভাসিয়ে দিল। সঙ্গে প্রার্থনা করল, ‘ঠাকুর, আমার এই সন্তানটাকে একটু দেখো গো!’ অবশ্য তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বল পরিবারে বেলুনদের ফাটিয়ে দেওয়া হত। সেখানে তো সে তবু ভাসিয়ে দিতে পেরেছিল।

বার্সার যে সবথেকে বড় খেলোয়াড়, সে নাকি পৃথিবীরও সবথেকে বড় খেলোয়াড়। মানুষ হিসেবেও দারুণ। তার একটা চ্যারিটি আছে যা ক্যাটালোনিয়ার অনাথ আশ্রমগুলিতে স্বপ্ন বিলিয়ে বেড়ায়। এমনই একটা অনাথ আশ্রমে গিয়ে সে শুনল, দশ বছরের যে ছেলেটি খুব দারুণ ফুটবল খেলতে পারত তার হৃদয়ে ফুটো দেখা দিয়েছে। জন্ম থেকেই ছিল হয়তো, কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে। আর কোন আশা নেই, একমাত্র হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট না হলে।

সেই বড় খেলোয়াড় বড় মানুষও ছিল কি না, তাই সে ঠিক করল যত টাকার দরকার সে দেবে আর প্রতিদিন শুতে যাবার সময় প্রে করবে ছোট ফুটবলারটির জন্য।

এদিকে আমাদের দুমাথাওলা বেলুন। উড়তে উড়তে গেলো বার্সিলোনার বস্তিতে। যেখানে আলো ঢোকে তো হাওয়া ঢোকে না। হাওয়া ঢোকে তো আলো ঢোকে না। আর দুটো একসঙ্গে ঢুকলে কোন আশা ঢোকে না। সেখানকার ছোট ছোট বাচ্চাগুলোরও সেই অবস্থা। তবু একটা বেলুন পেয়ে তারা কয়েকদিন মজা করে খেললো। বাচ্চাগুলো যত আনন্দ পায়, ততই বেলুনের বুক ফুলে ওঠে, অক্সিজেনে। শেষে একদিন এক বুক ভর্তি তাজা অক্সিজেন নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল বার্সিলোনার সিটি হসপিটালে।

সেটা ছিল আরেক পূর্ণিমার দিন। বার্সা চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফাইনাল খেলছে। সবাই উৎসাহ উৎকণ্ঠা নিয়ে খেলা দেখছে। এমন কি অনাথ আশ্রমের সেই হৃৎপিণ্ডে ফুটোওলা বাচ্চাটাও।

কিন্তু শুরুতেই জুভেন্টাসের কাছে এক গোল খেয়ে গেল বার্সা। আর বাচ্চাটারও শ্বাস কষ্ট বেড়ে গেলো। ডাক্তার ছুটে এলো, নার্স, প্যারামেডিক্স, অক্সিজেন সিলিন্ডার, আর্টিফিশিয়াল হার্ট স্টিমুলেটর, স্টেরয়েড ইনজেকশন। সবাই ছুটে এলো। লাল বেলুনটা এসব কিছুই হাসপাতালের জানলা দিয়ে দেখছিল। সিটি হসপিটাল।

তারপর রাত গভীর হতে লাগল, আর বার্সাও তিন গোল করে দিল। ৩-১। তাদের সবথেকে বড় আর তারপরের দুই বড় খেলোয়াড় তিনজনেই গোল করল। আর সারা ক্যাটালোনিয়ায় উৎসব সে রাতে। সবাই উৎসব করছিল। শুধু সিটি হসপিটালের ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিক্স, অক্সিজেন সিলিন্ডার, আর্টিফিশিয়াল হার্ট স্টিমুলেটর, স্টেরয়েড ইনজেকশন। এরা কেউই আনন্দ করতে পারছিল না। আশা ছেড়ে দিয়েছিল তারা। বেলুনটা সবকিছুই দেখছিল। বার্সার চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জেতাও। শেষে অনেক রাতে, যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ল তখন ধীরে ধীরে গিয়ে ছেলেটির মুখের অক্সিজেন মাস্ক একটু সরিয়ে মুখের ভিতর দিয়ে বুকের মধ্যে সেঁধিয়ে গেলো।

পরদিন সকালে সবাই অবাক হয়ে দেখল, যে ছেলেটার আশা সবাই ছেড়ে দিয়েছিল, সে কি সুন্দর হাসি হাসি মুখ করে ভোরের আলো মুখে নিয়ে তাকিয়ে আছে। কেউ বুঝতে পারল না কী করে হল, ছেলেটিও না। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারল, কোন অজানা আনন্দে তার বুকটা ভরে আছে।

ন্যু ক্যাম্পে আজ খুব আনন্দের দিন। অনাথ আশ্রমের ছেলেমেয়েগুলো সেদিন বার্সার প্র্যাকটিসে এসেছে। সেই ছেলেটিও এসেছে। সব থেকে বড় খেলোয়াড়ের সঙ্গে সে বল দেওয়া নেওয়া প্র্যাকটিস করছিল।

ঘটনাক্রমে যে বলটা নিয়ে তারা বল দেওয়া নেওয়া করছিল, সেটা ছিল সেই আমাদের মা বল। আর যেই সেই ছোট ছেলেটা বুকে করে বল রিসিভ করেছে অমনি মা বল বুঝতে পেরেছে তার সেই হারিয়ে যাওয়া বেলুন সোনা ছেলেটির বুকের মধ্যেই আছে। হাজার হোক মা বলে কথা। সন্তানের বুকের স্পন্দন তারা ঠিক শুনতে পায়। আমাদের যমজ বেলুন, যার দুটো মাথা, যার রঙ লাল, যাকে ঠিক হৃদয়ের মতো দেখতে, সেও বুঝতে পেরেছে যে সে মায়ের কাছে পৌঁছেছে। তার আনন্দ আর ধরে না।

তারপর? তারপর আর বেশি কথা বলে কি হবে! সেই ছোট্ট ছেলেটি বার্সার সাবজুনিয়র অ্যাকাডেমিতে সুযোগ পেয়েছে। যে ছেলেটির হৃৎপিণ্ডের ফুটো অদ্ভুতভাবে জোড়া লেগে গিয়েছিল। সেই ছেলেটি তার হৃৎপিণ্ডের দম আর ছোটার ক্ষমতা নিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। বল তার পায়ে আঠার মতো লেগে থাকে। আসলে কেউ তো জানতে পারে না, বার্সিলোনার সাবজুনিয়র অ্যাকাডেমির বলগুলো সব বেলুনটিরই ভাইবোন। লাল বেলুনটির। আর কে না জানে ভাইবোনেরা একসঙ্গে থাকতে কতটাই না ভালোবাসে! মায়ের পেটের ভাই বোন বলে কথা!

মা বলের মনে খুব আনন্দ। হাজার হোক অন্যরকম বেলুন সন্তানকে ছেড়ে দিয়ে সেও খুব খুশী ছিল না। সারাদিন সেও বড়দের প্র্যাকটিসে থাকে ব্যস্ত। আর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, তখন লাল যমজ বেলুনটা চুপিচুপি ছেলেটির বুক থেকে বেরিয়ে আসে। হৃদয়ের ফুটোয় চাপাচুপি দিয়ে। তারপর তাদের চাঁদের আলোয় গল্প শুরু হয়। বাকি ভাইবোন বল আর মা বলের সঙ্গে। হৃদয়ের গল্প!  

 আগের আয় আয় ঘুম পরের গল্প–>

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s