দৃপ্ত বর্মন রায়
এক
৬ এপ্রিল ২০১৮, দুপুর ২:৪৫
জ্যারমাট, সুইৎজারল্যান্ড
মাথার হেলমেট, গগলস আর হাতের গ্লাভসগুলো ঠিকঠাক করে নিয়ে একবার বাঁদিকে তাকাল ব্রুনো। দূরে নীল আকাশের দিকে উদ্ধতভাবে মাথা তুলে তুষারাবৃত পিরামিডের মতো বিরাজমান ম্যাটারহর্ন পিকের গায়ে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। অথচ কিছুক্ষণ আগে অবধি ঘন কুয়াশায় ঢাকা ছিল সমস্ত চরাচর। উপরি হিসেবে সাথে ছিল হিমশীতল তুমুল ঝড়ো হাওয়া। এই কিছুক্ষণ হল কুয়াশার আবরণ ভেদ করে অবশেষে সূর্যের আলো উঁকি মেরেছে। ধীরে ধীরে কুয়াশা কেটে গিয়ে দৃশ্যমান হয়েছে চারপাশ।
ব্রুনোর পুরো নাম ব্রুনো ফ্যাব্রিসিও। বাড়ি স্পেনের সেভিল শহরে। মাত্র একত্রিশ বছর বয়সেই ফ্রিল্যান্স ইনভেস্টমেন্ট কনস্যালট্যান্ট হিসেবে বেশ সুনাম অর্জন করে ফেলেছে। আঠারো থেকে অষ্টআশি পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সের মানুষদের অর্থ সঞ্চয়ের নানা উপায় বলে দিয়ে প্রচুর ইউরো কামালেও নিজে কিন্তু সে তার উপার্জনের বেশিরভাগটাই উড়িয়ে দেয় নিজের হবি, এক্সট্রিম স্পোর্টসের পিছনে। না, স্প্যানিশ হলেও প্যাম্পলোনার বুল-রান তার একেবারেই মনপসন্দ নয়। বরং তার পছন্দের এক্সট্রিম স্পোর্টস হল ফ্রি-স্টাইল স্কিয়িং। আর এই স্কিয়িং-এর নেশায় বছরে দুই থেকে তিনবার সে হাতের সব কাজ ফেলে চলে আসে আল্পস পর্বতমালার গায়ে গড়ে ওঠা ইউরোপের বিভিন্ন স্কিয়িং রিসর্টগুলোতে। সেই উদ্দেশ্যেই এবার সে হাজির হয়েছে সুইস আল্পসের কোলে ছোট্ট শহর জ্যারমাটে। জ্যারমাট তার সবচেয়ে প্রিয় স্কিয়িং ডেস্টিনেশনগুলোর মধ্যে একটা। তার অন্যতম কারণ এখানকার স্কি-রিসর্টগুলো সারাবছরই খোলা থাকে বলে ইউরোপের অন্যান্য স্কি-রিসর্টগুলোর তুলনায় স্কিয়ারদের ভিড় এখানে অনেকটাই কম হয়। আর তাছাড়াও এখানকার আবহাওয়া ও পরিবেশ-পরিস্থিতি বারো মাসই স্কিয়িং-এর জন্যে সুবিধাজনক থাকে।
কিন্তু এবার এখানে আসার পর প্রথম দু’দিন আবহাওয়া একেবারেই অনুকূল ছিল না। তাই ঘরে বসে হাত কামড়ানো ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তার। এদিকে আগামী কালকের ফেরার টিকিটও অলরেডি বুক করা। তাই আজ আবহাওয়া স্কিয়িং-এর পক্ষে ততটা উপযুক্ত না হলেও নেহাত মরিয়া হয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল সে। দেখেছিল হাতে গোনা আর মাত্র কয়েকজন অত্যুৎসাহী স্কিয়ারই আজ সাহস করে বেরিয়েছে তার মতো। একশো সুইস ফ্র্যাঙ্ক খরচ করে এখানকার সবথেকে নামী স্কি-রিসর্ট ‘ম্যাটারহর্ন গ্লেসিয়ার প্যারাডাইস’-এর লিফ্ট-পাস বুক করে সে উঠে এসেছিল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় চার কিলোমিটার উচ্চতায়। অন্যান্য ‘বেশি ট্যুরিস্ট, কম স্কিয়ার’-দের মতো ম্যাটারহর্ন ভিউয়িং প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ভূমধ্যসাগর দেখার জন্যে সময় নষ্ট না করে সোজা চলে এসেছিল ইউরোপের চতুর্থ দীর্ঘতম স্কি-পিস্টের স্টার্টিং পয়েন্টে। খানিক ওয়ার্ম আপ করে প্রস্তুতি নিয়েছিল নিজের প্রধান প্যাশনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে।
সামনে প্রায় চার কিলোমিটার লম্বা ধবধবে সাদা বরফে ঢাকা ডাউনহিল পিস্টটা দেখে মনে হচ্ছিল কেউ যেন সেখানে মোলায়েমভাবে সাদা মায়োনিজ স্প্রেড করে রেখেছে। কৃত্রিমভাবে তৈরি করা গ্রুমড স্নো নয়। গত দু’দিনের তুষারপাতের ফলে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া বরফের আস্তরণ, স্কিয়িং পরিভাষায় যাকে বলে ফ্রেশ পাউডার। এরকম পিস্টে স্কিয়িং করা প্রত্যেক স্কিয়ারের কাছেই স্বপ্নের মতো। অনেক নিচে স্টোন পাইন আর লার্চগাছে ঘেরা ছোটো ছোটো কটেজ আর লেক সহ জ্যারমাট শহরটা দেখা যাচ্ছে। ঠিক যেন একটা পিকচার পোস্টকার্ড। ওখানেই একটা কটেজে দিন তিনেকের জন্যে পেয়িং গেস্ট হিসেবে রয়েছে ব্রুনো। স্কি-ইন, স্কি-আউট বা আধুনিক স্কিয়িং রিসর্টগুলোতে পার ডে থাকার যা ভাড়া তার থেকে অনেক অনেক সস্তায়। এভাবে পয়সা বাঁচিয়ে স্কিয়িং-এর জন্যে দুয়েকটা অতিরিক্ত লিফ্ট-পাস কেনাতেই তার বেশি আনন্দ। সে তো মূলত এসেছে স্কিয়িং করতে, বাকি ওয়ান টাইম ট্যুরিস্ট বা অ্যামেচার স্কিয়ারদের মতো আল্পসের সৌন্দর্য উপভোগ করতে নয়।
শ্বাস ছেড়ে নিজের শরীরটাকে যথাসম্ভব হালকা করে নিয়ে স্কি-পোলদুটো দু’হাতে বরফে চেপে ধরে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে দাঁড়াল ব্রুনো। তারপর মনে মনে একবার জেসাস ক্রাইস্টকে স্মরণ করে নিয়ে পিছনের দিকে ইনিশিয়াল থ্রাস্টটা দিল। অভিকর্ষ বলের প্রভাবে বরফের প্রলেপের ন্যূনতম ঘর্ষণজনিত বাধা অতিক্রম করে তাকে নিয়ে তিরবেগে নিচের দিকে ছুটতে শুরু করল স্কিদুটো। প্রথমে কিছুক্ষণ স্কি-পোল আর স্কি-এজের নিখুঁত নিয়ন্ত্রণে বাম্প বা ছোটোখাটো বরফের স্তুপগুলোকে পাশ কাটিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেল সে। কিন্তু এভাবে বাম্প এড়িয়ে স্কি করাটা শিক্ষানবিসদের সাজে। তার মতো অভিজ্ঞ স্কিয়াররা এতে কোনও আলাদা কিক অনুভব করে না। তাদের কাছে এই বাম্পগুলো হল নিজেদের কেরামতি দেখানোর জায়গা। তাই পরের বাম্পটা সে আর পাশ কাটিয়ে গেল না। সোজা বাম্পটায় উঠে গিয়ে প্রচণ্ড গতিতে সেটা অতিক্রম করার সময় সে মাটি থেকে প্রায় সাত-আট ফুট উঁচুতে উঠে গেল। নিখুঁতভাবে শরীরটা ভাঁজ করে ডানহাত দিয়ে ডান স্কি-এর পিছনের অংশটা ছুঁয়ে ফ্রি-স্টাইল স্কিয়িং-এর অন্যতম কঠিন ট্রিক মিউট গ্র্যাব সম্পূর্ণ করে আবার শরীরটা সোজা করে নিখুঁত সময়জ্ঞানে সফলভাবে ল্যান্ড করল বরফপৃষ্ঠে। আনন্দে নিজের পিঠ চাপড়ে দিতে ইচ্ছে করছিল তার। কিন্তু তার বদলে পরের বাম্পে নিজের জন্যে আরও কঠিন একটা ট্রিক, সামারসল্ট দেবার টার্গেটটা সেট করে নিল মনে মনে।
সেই উদ্দেশ্যে পরের বার আরেকটু বড়ো একটা বাম্পের দিকে এগিয়ে গেল ব্রুনো। গতিজাড্যের প্রভাবে এবার বাম্প ছেড়ে সে উঠে গেল আরও উঁচুতে, প্রায় নয়-দশ ফুট ওপরে। আন্দাজ মতো প্রোজেক্টাইল মোশনের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে সামারসল্ট দেবার উদ্দেশ্যে যেই সে নিজের শরীরটাকে পিছনে হেলিয়ে দিয়ে স্কি সহ পাদুটোকে আলতো করে ওপরে তুলে দিল, ঠিক তখনই মাথা নিচে আর পাদুটো ওপরে এরকম অবস্থায় হঠাৎ করে তার চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল। দিগন্তবিস্তৃত সাদা তুষারের পরত, ম্যাটারহর্ন পিক বা তার পিছনের অসীম আকাশ সবকিছুর ওপর কেউ যেন একটা বিশাল ব্রাশ দিয়ে ক্ষণিকের মধ্যে এক পোঁচ কুচকুচে কালো আলকাতরা লেপে দিল। সাথে সাথে এতক্ষণ কানের পাশ দিয়ে তীব্রভাবে বয়ে চলা হাওয়ার যে একটানা গোঁ গোঁ আওয়াজটা শোনা যাচ্ছিল, সেটাও পলকের মধ্যে থেমে গিয়ে একটা অস্বাভাবিক শব্দহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি হল।
ব্রুনোর শিরদাঁড়া বেয়ে ঘাড় থেকে কোমর পর্যন্ত একটা হিমশীতল সর্পিল অনুভূতি কিলবিল করে ওপরে উঠে গেল। সে খোলা চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছিল না বা কানে কিছু শুনতে পাচ্ছিল না বলে নয়, দমবন্ধকর উত্তেজনায় সে উপলব্ধি করল তার শরীরের কোনও অংশ, এমনকি তার স্কি বা স্কি-পোলগুলো কোনওটাই কোনওভাবে আর মাটির সংস্পর্শে নেই।
নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এই অপার্থিব নিঃশব্দ অন্ধকারে সে নিশ্চল নিথরভাবে পা ওপরে করে অধোমুখে শূন্যে ঝুলে আছে বিন্দুমাত্র কোনও অবলম্বন ছাড়াই।
দুই
৬ এপ্রিল ২০১৮, সন্ধে ৬:১৫
কলকাতা, ভারতবর্ষ
একটানা একটা অপার নিবিড় নিস্তব্ধতার মধ্যে আচমকা কলিং বেলের তীব্র শব্দটাতে চটকা ভাঙল সমীরণবাবুর। ধড়মড় করে উঠে চোখ মেলে দেখলেন, নিজের বাড়ির ড্রয়িংরুমে থ্রি সিটার সোফা-সেটটার হাতলে মাথা রেখে শুয়ে আছেন তিনি। চার-পাঁচ সেকেন্ড সময় লাগল একটু ধাতস্থ হতে। বাইরের জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলেন সন্ধে হয়ে গেছে। আলো জ্বালানো নেই বলে ঘরটা অন্ধকার হয়ে রয়েছে। সামনে টিভিটা খুব লো ভলিউমে চলছে। বাইরে কর্মব্যস্ত রাস্তায় মানুষজন-বাস-ট্যাক্সির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সবকিছুই আরও পাঁচটা দশটা দিনের মতোই অত্যন্ত স্বাভাবিক।
আস্তে আস্তে সবটা মনে পড়ে গেল তাঁর। টিভিতে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে আফ্রিকার মাসাইমারা ন্যাশনাল রিজার্ভের ওপর একটা ডকুমেন্টারি দেখছিলেন তিনি। মনে হয় দেখতে দেখতে চোখদুটো কোনও একসময় লেগে গিয়েছিল। যাক! তার মানে ওটা একটা স্বপ্ন ছিল। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল তার বুকের ভিতর থেকে। বাপ রে! কী বিদঘুটে স্বপ্ন রে বাবা। কেমন একটা নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ঘরের মধ্যে সহায়হীন অবস্থায় রয়েছেন তিনি। নড়াচড়া করতে পারছেন না। চারপাশটাও যেন একেবারে নিঝুম নিস্তব্ধ। চোখের পলক পড়লেও যেন তার শব্দ শোনা যাবে। তার ওপর অন্ধকারটাও এমনই, যেন তাঁকে গিলে খেতে আসছে। উফ্, বুকটা এখনও কেমন জানি ঢিপঢিপ ঢিপঢিপ করছে। এই বয়সে এরকম একটা স্বপ্ন ভিতর থেকে সবকিছু নাড়িয়ে দিয়ে যায়। মনে পড়তেই শরীরটা আবার কাঁপুনি দিয়ে উঠল তাঁর।
বছর তিনেক হল স্ত্রী মারা যাবার পর থেকে গড়িয়ার এই পৈতৃক ছোট্ট একতলা বাড়িটাতে একলাই থাকেন তিনি। একটাই মেয়ে, বিয়ের পর সংসার করছে বেঙ্গালুরুতে। রিটায়ার্ড, নির্ঝঞ্ঝাট এই মানুষটার বন্ধুবান্ধবের সংখ্যাও খুব একটা বেশি নয়। ফেসবুক বা হোয়াটস-অ্যাপে সময় কাটানোর চেয়ে প্রতিদিন সকাল-বিকেলে রাস্তার মোড়ে হরির চায়ের দোকানে এক কাপ চায়ের সাথে আড্ডা, আর দু-তিনটে খবরের কাগজে চোখ বোলানোতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন তিনি। এছাড়া বাড়িতে ষোলো বছরের পুরনো টিভিটাই তাঁর সর্বক্ষণের সময় কাটানোর একমাত্র সঙ্গী।
কলিং বেলটা আবার বাজতেই সমীরণবাবু উঠে পড়লেন সোফা থেকে। দেওয়ালের কাছে গিয়ে টিউবলাইটটা জ্বালালেন। এতক্ষণ অন্ধকারে ছিলেন বলে হঠাৎ করে আলো জ্বলে ওঠায় চোখটা প্রথমে একটু ধাঁধিয়ে গেল। আলোটা একটু সয়ে আসার পর দেখলেন, দেওয়ালে টাঙানো ওয়াল-ক্লকটায় সোয়া ছ’টা বাজছে। সাথে সাথে এটাও চোখে পড়ল, ঘড়িটার তলা থেকে মুখ বের করে দেওয়ালের গায়ে একটা টিকটিকি স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সেটার থেকে হাত পাঁচেক দূরে দেওয়ালেতেই বসা একটা মথের দিকে। টিকটিকিটাকে দেখামাত্রই গোটা শরীরটা কেমন একটা শিরশির করে উঠল সমীরণবাবুর। ডাইনোসর গোত্রের এই প্রাণীটাকে কেন জানি তিনি একদমই সহ্য করতে পারেন না। দেখলেই গা ঘিনঘিন করে ওঠে। নিশ্চয়ই জানালা খোলা পেয়ে কোনও এক ফাঁকে ঢুকে পড়েছে ঘরে। এখন এটাকে না তাড়ানো পর্যন্ত একটা অস্বস্তি থেকেই যাবে মনের মধ্যে।
আবার কর্কশ শব্দটা করে এই নিয়ে তৃতীয় বার বেজে উঠল কলিং বেলটা। এই সময় আবার কে এল রে বাবা? মনে মনে একটু ভাবতেই অবশ্য সন্তোষজনক একটা উত্তর পেয়ে গেলেন সমীরণবাবু। গতকাল ছিল তাঁর জন্মদিন। রাতে মেয়ে আর জামাই ফোন করেছিল। বলেছিল, ওঁর জন্যে নাকি একটা গিফট ওরা ক্যুরিয়ার করে পাঠিয়ে দিয়েছে। হয়তো সেটাই এসেছে। কিন্তু এক মিনিট! হঠাৎ করে তাঁর মনে পড়ে গেল একটু আগে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যে দুঃস্বপ্নটা তিনি দেখছিলেন সেটাতেও কলিং বেল বাজিয়ে কেউ একটা এসেছিল না? হ্যাঁ, ঠিক তো। ক্যুরিয়ার কোম্পানির লোকই তো এসেছিল বলে মনে হচ্ছে। নিশ্চয়ই কাল মেয়ের মুখে গিফট পাঠানোর কথাটা শোনার পর থেকে তাঁর মনে অবচেতনে এটাই ঘুরপাক খাচ্ছে। আর স্বপ্ন তো অবচেতন মনেরই একটা প্রতিফলন। মনে মনে একটু হাসিই পেল তাঁর।
দরজাটা খুলতে না খুলতেই আবার একটা ঝটকা লাগল সমীরণবাবুর। যে লোকটা সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে যেন খুব চেনা চেনা ঠেকছে। আগেও কোথাও দেখেছেন বলে মনে হচ্ছে। লোকটাও কেমন একটা ভেবলে যাওয়া মুখ করে পিঠে একটা মস্ত ব্যাগ আর হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনও কারণে যেন খুব অবাক হয়ে রয়েছে। তাঁর সাথে চোখাচোখি হতেই একটু দ্বিধাগ্রস্তভাবে আনমনে বলল, “স্যার, আপনার জন্যে একটা পার্সেল আছে। আরও আগেই আসতাম, কিন্তু রাস্তায় বাইকটা গণ্ডগোল করল বলে দেরি হয়ে গেল।”
আশ্চর্য! লোকটার কথা শুনে সব পরিষ্কারভাবে মনে পড়ে গেল সমীরণবাবুর। আর কোনও সন্দেহ নেই। একটু আগের সেই ভয়ংকর স্বপ্নটায় একেই দেখেছিলেন সমীরণবাবু। হ্যাঁ, এই লোকটাই এসেছিল পার্সেলটা নিয়ে আর ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিল তখন। মানে কী এটার? এটাকেই কি বলে ‘দেজা ভ্যু’? নাকি হঠাৎ করে কোনও ভূতের রাজার বরে ভবিষ্যতের সবকিছু স্বপ্নে আগাম দেখে ফেলার ক্ষমতা জন্মাল তাঁর? ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি। ভাবলেন কথাটা একবার জিজ্ঞেস করবেন লোকটাকে। কিন্তু মনে মনে চাইলেও মুখ থেকে কোনও কথা বেরোল না তাঁর। বাধ্য ছেলের মতো পার্সেলটা নেবার জন্যে নিঃশব্দে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন তিনি।
পার্সেলটা নিয়ে লোকটার এগিয়ে দেওয়া কাগজটায় সই করে তাকে বিদায় দিয়ে ফেরার সময় সমীরণবাবুর দৃষ্টিটা আবার গিয়ে পড়ল দেওয়ালে টিকটিকিটার প্রতি। এইটুকু সময়ে নিঃশব্দে মথটার আরেকটু কাছে এসে গেছে সেটা। ওদের মধ্যে দূরত্ব এখন দুই হাতের মতো। অসীম ধৈর্যের সাথে একটু একটু করে এগোচ্ছে শিকারের দিকে। একবার মনে হল এক্ষুনি তাড়িয়ে দেবেন আপদটাকে। কিন্তু তারপরই মনে হল, নাহ্ থাক! খাদ্য আর খাদকের চিরন্তন সম্পর্কের মধ্যে এই মুহূর্তে কাবাব মে হাড্ডি হয়ে ঢোকাটা উচিত হবে না তাঁর।
পার্সেলটা উলটেপালটে দেখে বুঝলেন তাঁর অনুমানই ঠিক। বেঙ্গালুরু থেকে মেয়ে আর জামাই-ই পাঠিয়েছে সেটা। কী পাঠিয়েছে সেটা অবশ্য বলেনি ফোনে। সেটা নাকি সারপ্রাইজ। পার্সেলের সাইজটা দেখেও কিছু আন্দাজ করা যাচ্ছে না। খোলার জন্যে একটা কাঁচি দরকার। হাত থেকে পার্সেলটা সেন্টার টেবিলের ওপর রেখে কাঁচি আনতে পাশের শোবার ঘরে গেলেন তিনি।
কাঁচি নিয়ে ফিরে এসে পার্সেলের মুখটা কেটে ভিতরের জিনিসটা বের করে আনার জন্যে হাতটা যেই ঢোকাতে যাবেন, এমন সময় হঠাৎ বাইরে জানালা দিয়ে একটা হইচই শোনা গেল। একসাথে অনেকে মিলে যেন তারস্বরে চিৎকার করে উঠল। চমকে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন সমীরণবাবু। কিন্তু কিছু বুঝতে পারলেন না কী হল। রাস্তায় কিছু না কিছু উটকো ঝামেলা-টামেলা সবসময় লেগেই থাকে। নিশ্চয়ই সেরকমই কিছু একটা হয়েছে। জানালা থেকে দৃষ্টিটা ঘরে ফেরানোর সময় আবার না চাইতেও চোখটা চলে গেল টিকটিকিটার দিকে। এখন মথটার একহাতের থেকেও কাছে চলে এসেছে সরীসৃপটা। ঘাড় ফুলিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে ঝাঁপ দেবার। নিশ্চিত মৃত্যু যে এত কাছে চলে এসেছে টেরই পায়নি মথটা। এখনও নিশ্চিন্তে বসে আছে দেওয়ালে।
হতভাগ্য মথটার জন্যে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সমীরণবাবু আবার মন দিলেন হাতের পার্সেলটার দিকে। পার্সেলের খোলা মুখে হাতটা ঢোকাতে ভিতরে একটা কাগজ আর একটা কার্ডবোর্ডের বাক্সে হাতটা ঠেকল তাঁর। কিন্তু যেই বাক্সটাকে ভিতর থেকে বের করে আনতে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে দুম করে চারপাশটা অন্ধকার হয়ে গেল। ঠিক যেন একটা প্রকাণ্ড ব্ল্যাক-হোল আশেপাশের সমস্ত আলো শুষে নিল এক পলকে। এমন নিকষ কালো অন্ধকার যে নিজেই নিজেকে দেখতে পাচ্ছিলেন না তিনি। ঠিক আগের সেই দুঃস্বপ্নটার মতো। একইসঙ্গে তিনি খেয়াল করলেন, এতক্ষণ জানালা দিয়ে রাস্তার যে অস্ফুট আওয়াজগুলো ভেসে আসছিল, সেগুলো এক লহমায় বন্ধ হয়ে গিয়ে চারদিকে বিরাজ করছে এক থমথমে অদ্ভুত নৈশব্দ। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে অন্ধকারেই জানালার দিকে এগোতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করলেন, তার পাদুটো কেউ যেন সিমেন্ট দিয়ে আটকে দিয়েছে ঘরের মেঝের সাথে। শুধু পা নয়, হাত, মাথা, মুখ, চোখ কিছুই আর নাড়াতে পারছেন না তিনি। নিজের শরীরটাই যেন আর তাঁর নিজের বশে নেই। ভয়ে চিৎকার করে সাহায্য চাইতে গেলেন। কিন্তু হাজার চেষ্টাতেও মুখ থেকে একটা আওয়াজও বের করতে পারলেন না তিনি।
গাঢ় অন্ধকারে লাশকাটা ঘরের মৃত্যুশীতল নিস্তব্ধতার মধ্যে অনড় অচল অবস্থায় সমীরণবাবুর মনে হল, তাহলে বাকি সবকিছুর মতো এই ভয়ংকর বিপদের পূর্বাভাসই কি তিনি পেয়েছিলেন আগের দুঃস্বপ্নটাতে? নাকি তিনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সেই আগের দুঃস্বপ্নটাই দেখে চলেছেন এখনও?
তিন
৬ এপ্রিল ২০১৮, রাত ১০:৪৫
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
নতুন করে মিডল আর লেগ স্টাম্পের মাঝামাঝি গার্ড নিয়ে শেষবারের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে আরেকবার অন সাইড আর অফ সাইডের ফিল্ড প্লেসমেন্টটা দেখে নিল বিরাজ। বাউন্ডারি আটকানোর জন্যে ইনার সার্কেলে মাত্র চারজন ফিল্ডারকে রেখে বাকি পাঁচজনই গিয়ে দাঁড়িয়েছে বাউন্ডারি লাইনে। দুই মুহূর্তের জন্যে চোখদুটো বন্ধ করে নিজের মনকে কনসেনট্রেট করে নিল সে। তারপর চোখ খুলে এক ঝলক তাকাল জায়ান্ট ইলেকট্রনিক স্কোর-বোর্ডটার দিকে। সেখানে ডিজিটাল অক্ষরে বড়ো বড়ো করে লেখা ‘টু উইন ইন্ডিয়া নিডস থ্রি রানস ইন দ্য লাস্ট বল’। অদম্য স্নায়ু-চাপটাকে বশে আনার জন্যে একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে ম্যাচের শেষ বলটা ফেস করার জন্যে স্টান্স নিল বিরাজ। এই নিয়ে পঞ্চমবার।
না, পুরো ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কেরিয়ারে সে পঞ্চমবার ম্যাচের লাস্ট বল ফেস করছে তা নয়। এই একই সন্ধ্যায়, এই একই ম্যাচে এই নিয়ে পাঁচ নম্বর বার সে ম্যাচের লাস্ট বলটা ফেস করছে।
অবিশ্বাস্য হলেও ব্যাপারটা সত্যি। কিন্তু কেন যে এরকমটা হচ্ছে সেটা বিরাজ কিছুতেই বুঝতে পারছে না। শুধু সে কেন, বিরাজের মনে হচ্ছে যে উলটোদিকের রানার্স এন্ডে দাঁড়ানো নন স্ট্রাইকার, এগারোজন অসি ফিল্ডার, দু’জন আম্পায়ার আর আজকে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার এই আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমি ফাইনাল ম্যাচটা দেখতে উপস্থিত আশি হাজার দর্শকের কেউই বুঝতে পারছে না শেষ কয়েক মিনিট জুড়ে কী ঘটে চলেছে।
অথচ কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত সবকিছু ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। রবিবারে অনুষ্ঠিতব্য আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনাল ম্যাচে ভারত আর অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে কারা প্রথম সেমি ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারানো পাকিস্তানের মুখোমুখি হবে সেটা জানতে আজ প্রচুর দর্শকের সমাগম হয়েছিল শতাব্দী প্রাচীন এই স্টেডিয়ামে। টসে জিতে ভারতের অধিনায়ক হিসেবে বিরাজ অস্ট্রেলিয়াকে প্রথমে ব্যাট করতে পাঠায়। প্রবল জন সমর্থনের সুযোগ নিয়ে অস্ট্রেলিয়া পুরো পঞ্চাশ ওভার ব্যাট করে সাত উইকেট খুইয়ে রান তোলে তিনশো একান্ন। অসি মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান গ্রেন ফ্যাক্সওয়েল একাই একশো তেত্রিশ রান করে অপরাজিত থাকে। জবাবে ব্যাট করতে নেমে দুই ওপেনার লোহিত ভর্মা আর গৌতম হাসমুখের ঝড়ো ব্যাটিং-এর সুবাদে ভারত মাত্র বারো ওভারেই একশো রান তুলে ফেলে। কিন্তু পনের নম্বর ওভারে লোহিত সাতান্ন রান করে আউট হতেই শুরু হয় ব্যাটিং বিপর্যয়। পরের পাঁচ ওভারের মধ্যে পরপর আরও চারটে উইকেট পড়ে গিয়ে ভারতের রান দাঁড়ায় কুড়ি ওভারে পাঁচ উইকেটে একশ চৌত্রিশ। ফার্স্ট ডাউনে নেমে বিরাজ অসহায়ভাবে নন-স্ট্রাইকিং এন্ড থেকে একের পর এক ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের হারাকিরি দেখছিল আর মনে মনে প্রার্থনা করছিল যাতে অন্তত একজন ব্যাটসম্যান উইকেট ছুড়ে না দিয়ে একটু বিচক্ষণভাবে ওর সাথে একটা পার্টনারশিপ তৈরি করার চেষ্টা করে। কিন্তু বারবারই হতাশ হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকছিল না তার। জেতার জন্যে একশো আশি বলে তখনও চাই আরও দুশো আঠারো রান, হাতে মাত্র পাঁচটা উইকেট। পরপর তিন ওভারে তিন উইকেট পেয়ে অসি ফাস্ট বোলার রস হ্যাজেলগুড তখন রক্তের গন্ধ পাওয়া হাঙরের মতো চেগে উঠেছে। অসি ফিল্ডাররাও ক্রমাগত স্লেজিং করে করে চাপ বাড়িয়ে তুলছিল। তারা বুঝে গিয়েছিল, এটাই শেষ হার্ডল। একবার এই উইকেটটা তুলে নিতে পারলেই ফাইনালে খেলাটা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। এইরকম পরিস্থিতিতে সাত নম্বরে নামা শেষ প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যান এবং টিমের উইকেট কিপার সিদ্ধিমান রাহা ক্রিজে আসতেই বিরাজ এগিয়ে গিয়ে ওকে বলেছিল কোনওমতে সে যেন পরের চার-পাঁচটা ওভার কোনওরকম শট না খেলে জাস্ট উইকেটে টিকে থাকার চেষ্টা করে। তারপর একটা শেষ চেষ্টা করা যাবে না হয়। যদিও সিদ্ধিমানের টেনশনগ্রস্ত মুখ দেখে সে যে খুব একটা ভরসা পেয়েছিল তা নয়।
কিন্তু বিরাজ অবাক হয়ে দেখল, তার কথায় কর্ণপাত না করে ফেস করা প্রথম বলটাতেই হ্যাজেলগুডকে একটা কপিবুক থেকে তুলে আনা কভার ড্রাইভে বাউন্ডারির বাইরে ফেলে দিল সিদ্ধিমান। শুধু প্রথম বলটাই নয়, একটা সপাট পুলে হ্যাজেলগুডের পরের পাঁজর লক্ষ্য করা স্লাইটলি শর্ট পিচ বলটারও ঠিকানা হল একই জায়গায়। পরপর দুই বলে দুটো বাউন্ডারি খেয়ে ক্ষেপে গিয়ে এবার মিডল-লেগ স্টাম্পে একটা বাউন্সার ঠুকল হ্যাজেলগুড। কিন্তু যখন ডাক করার বদলে নির্ভীকভাবে একটা হুক করে ঘণ্টায় একশো চল্লিশ কিলোমিটারেরও বেশি স্পিডের সেই বাউন্সারটাকে হেলায় ফাইন লেগের ওপর দিয়ে দর্শক স্ট্যান্ডে ফেলে দিল সিদ্ধিমান, তখন বিরাজ বুঝল আজ একটু অন্যরকম চিন্তাভাবনা করে ক্রিজে এসেছে বাঙালি ছেলেটা। অসি বোলারদের মাথায় চড়তে না দিয়ে পাল্টা আক্রমণের পথই বেছে নিয়েছে সে।
সিদ্ধিমানের আত্মবিশ্বাসী স্ট্রোক প্লে দেখে আস্তে আস্তে বিরাজও ভরসা পেয়ে হাত খুলে মারতে শুরু করেছিল। উইকেটে কোনও জুজু ছিল না, তাই সহজেই রান তরতর করে বাড়তে শুরু করেছিল। উইকেটের চারপাশে স্ট্রোকের ফুলঝুরি ফুটিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই বিরাজের পরে ক্রিজে এসেও ওর আগে হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করে ফেলেছিল সিদ্ধিমান। এরপর বিরাজও পঞ্চাশ রান করে ফেলার পর দু’জন মিলে ছোটো ছোটো টার্গেটে রান এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। মাঠে উপস্থিত অল্প সংখ্যক ভারতীয় সমর্থকরা, একটু আগেও যারা হতাশ হয়ে বাড়ি ফেরার কথা ভাবছিল, তারাই অপ্রত্যাশিতভাবে ভারত আবার ম্যাচে ফিরে আসায় ফের জাঁকিয়ে বসে তুমুল হইচই হট্টগোল করে সমর্থন জানাতে শুরু করে দিয়েছিল ‘মেন ইন ব্লু’দের।
এত সহজে হাল ছেড়ে দেবার দুর্নামটা আর যাদেরই থাকুক না কেন, ব্যাগি গ্রিনদের কোনওকালেই ছিল না। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে তারাও দাঁতে দাঁত চেপে চেষ্টা করছিল ম্যাচে ফেরার। পার্টনারশিপটা ভাঙার আপ্রাণ চেষ্টা করা সত্ত্বেও বিরাজ আর সিদ্ধিমানের দুর্ভেদ্য রক্ষণে তারা কোনওভাবেই ফাটল ধরাতে সক্ষম হতে পারছিল না। ম্যাচের প্রায় শেষলগ্নে এসে প্রথমে বিরাজ আর তার কয়েক মিনিট পরে সিদ্ধিমান দু’জনেই তাদের নিজের নিজের সেঞ্চুরি পূর্ণ করে ফেললেও ম্যাচ ছিল তখনও ফিফটি ফিফটি। শেষ ওভারে জেতার জন্যে ভারতের দরকার ছিল বারো রান। হাতে সেই পাঁচ উইকেট। শেষ ওভারটা করার জন্যে অসি অধিনায়ক ভিভ স্মিথ বল তুলে দিয়েছিল অভিজ্ঞ বাঁহাতি পেসার মিচেল স্পার্কের হাতে। প্রথম চার বলে বিরাজ আর সিদ্ধিমান আট রান করায় জেতার জন্যে শেষ দুই বলে মাত্র চার রান দরকার ছিল ভারতের। প্রায় হারা ম্যাচ জেতার আশায় মাঠে উপস্থিত প্রবাসী ভারতীয় সমর্থকদের চিৎকারে তখন কান পাতা দায়। স্পার্কের পঞ্চম বলটা ছিল অফ স্টাম্পের সামান্য বাইরে। সিদ্ধিমানের মারা বিদ্যুৎগতির স্কোয়ার কাটটা পয়েন্টে দাঁড়ানো অসি ওপেনার ডেভিড গার্নার বাঁদিকে ঝাঁপিয়ে অবিশ্বাস্যভাবে না বাঁচালে সেখানেই জিতে যেত ভারত। কিন্তু গার্নার শুধু যে বাউন্ডারিটাই বাঁচাল তা নয়, ছোঁ মেরে বলটা তুলে নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে এক টিপে বলটা ছুড়ে ভেঙে দিয়েছিল স্ট্রাইকিং এন্ডের উইকেট। শেষমুহূর্তে বিপদ বুঝে শরীরটা ছুড়ে দিয়েছিল বিরাজ। তা না হলে আর থার্ড আম্পায়ারের দরকার পড়ত না, ফিল্ড আম্পায়াররাই নির্দ্বিধায় আঙুল তুলে রান আউট ঘোষণা করতেন তাকে।
খেলার এরকম একটা উত্তেজক মুহূর্তে, যেখানে একটা ডিসিশন পুরো খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে, সেখানে কোনও আম্পায়ারই চাইবেন না তাড়াহুড়ো করে ভুল সিদ্ধান্ত দিতে। তাই বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে স্লো মোশন রিপ্লে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে তৃতীয় আম্পায়ার অনেকটাই সময় নিচ্ছিলেন। মনে মনে ভগবানকে ডাকতে ডাকতে সিদ্ধান্তের জন্যে অপেক্ষারত বিরাজের এই এক একটা সেকেন্ডকে মনে হচ্ছিল যেন এক একটা শতাব্দীর সমান। উৎকণ্ঠায় হৃৎপিণ্ডটা যেন গলা অবধি উঠে এসেছিল তার। কিন্তু শেষপর্যন্ত জায়ান্ট স্ক্রিনে সবুজ আলোয় ‘নট আউট’ লেখাটা ফুটে উঠতে প্রাণ ফিরে এসেছিল তার শরীরে। পাশে দাঁড়ানো হাঁপ ছেড়ে বাঁচা সিদ্ধিমানের সাথে গ্লাভস নকিং করার সময় গোটা স্টেডিয়ামের হিরণ্ময় নিস্তব্ধতার মধ্যে মাত্র হাজার পাঁচেক ভারতীয় সমর্থকদের উল্লাস স্পষ্টভাবে কানে ভেসে এসেছিল তার।
গোটা অসি টিম দৃশ্যত মুষড়ে পড়লেও ভিভ দ্রুত সামলে নিয়ে প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিল শেষ বলে তিন রান আটকানোর। পিচ থেকে বাউন্ডারি লাইনের দূরত্বের নিরিখে বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো মাপের এই ক্রিকেট মাঠে বাউন্ডারি মারাটা এমনিতেও বেশ কঠিন। তাও বাউন্ডারি বাঁচানোর জন্যে ত্রিশ গজের মধ্যে চারজন ফিল্ডারকে রেখে বাকি পাঁচজনকে পুরো মাঠে যথাসম্ভব ছড়িয়ে দিয়েছিল ভিভ। পিঠে হাত রেখে উৎসাহ দিতে দিতে স্পার্ককে এগিয়ে দিয়ে এসেছিল তার রান-আপের দিকে। পুরো অস্ট্রেলিয়া টিমটাই চিৎকার করে, হাততালি দিয়ে একে অপরকে উজ্জীবিত করে তুলছিল।
অন্যদিকে অ্যাড্রিনালিন রাশটাকে বশে এনে নিজের মাথাটা যতটা সম্ভব ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করছিল বিরাজ। তার মনে হয়েছিল, বিগ হিট আটকানোর জন্যে স্পার্ক নিশ্চয়ই শেষ বলটা ইয়র্ক করার চেষ্টা করবে। তাই আবার নতুন করে গার্ড নিয়েছিল মিডল আর লেগ স্টাম্পের মাঝখানে। তার অনুমান একেবারে নির্ভুল প্রমাণ করে লেগ স্টাম্পের ওপরেই ইয়র্কারটা দিয়েছিল স্পার্ক। কিন্তু ডেলিভারির সেকেন্ডের ভগ্নাংশ আগে এক পা এগিয়ে লেগ স্টাম্পের বাইরের দিকে একটু শাফল করে বিরাজ সেই নিখুঁত ডেলিভারিটাকেও লোয়ার ফুল টস বানিয়ে নিয়ে সজোরে ব্যাটটা চালিয়েছিল। বলটা ব্যাটের সুইট স্পটে লেগে বুলেটের মতো কভার আর মিড অফের মাঝখান দিয়ে উড়ে গিয়ে এক ড্রপে সোজা আছড়ে পড়েছিল বাউন্ডারির বাইরের অ্যাডভার্টাইসিং বোর্ডে।
একটা পাহাড় প্রমাণ চাপ বুকের ওপর থেকে এক নিমেষে সরে যাওয়ায় আর প্রায় অসম্ভব একটা ম্যাচ জেতার আনন্দে এরপরের ঘটনাগুলো বিরাজের আর ভালো করে কিছু খেয়াল ছিল না। শুধু মনে আছে ব্যাটটা ছেড়ে দিয়ে দুটো হাত মুঠো করে হাঁটু গেড়ে সে বসে পড়ছিল মাটিতে। কয়েকটা কাট-শট হিসেবে চোখে ধরা পড়েছিল দর্শক স্ট্যান্ডে কিছু কিছু জায়গায় আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওড়ানো কয়েকটা তেরঙ্গা, ম্যাচ হারার দুঃখে আর হতাশায় স্পার্কের মুখ ঢেকে বসে পড়া আর পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতে ছুটে আসা সিদ্ধিমানকে।
ঠিক এরপর থেকে শুরু হল অদ্ভুত ব্যাপারটা।
সিদ্ধিমান এসে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তেই হুট করে চারপাশটা কেমন যেন ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল। যে সে অন্ধকার নয়, ছুরি দিয়ে কাটা যাবে এমন পুরু ঘন কালো অন্ধকার। যেন হাজার হাজার ওয়াটের ফ্লাড লাইটগুলো কোনও বৈদ্যুতিক গোলযোগের জন্যে ঝুপ করে নিভে গেল একসাথে। শুধু তাই নয়, দর্শকাসনে ভারতীয় সমর্থকদের বাঁধনছাড়া উল্লাস, সিদ্ধিমানের চিৎকার সবকিছু মিলিয়ে যে শব্দব্রহ্মটা সৃষ্টি হয়েছিল সেটাও এক লহমায় নিশ্চুপ হয়ে গেল। যেন প্রচণ্ড আওয়াজে চলতে থাকা একটা টিভি কেউ অফ করে দিল এক সেকেন্ডে। নীরবতারও যে এমন একটা নিজস্ব গুরুগম্ভীর আওয়াজ হতে পারে সেটা বিরাজ রন্ধ্রে রন্ধ্রে উপলব্ধি করছিল তখন। প্রথমে সে ভেবেছিল, স্টেডিয়ামে পাওয়ার কাট হয়ে গেছে বোধহয়। সিদ্ধিমানও কেমন একটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়ভাবে তাকে জড়িয়ে ধরেই স্থির হয়ে গেছে। এরকম অস্বাভাবিক পরিবেশেও কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না তার। অবাক হয়ে সিদ্ধিমানকে সরিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে জীবনের সবচেয়ে বড়ো শকটা খেল বিরাজ। কোনও এক অদ্ভুত যাদুমন্ত্র বলে তার গোটা শরীরটা যেন ফ্রিজ হয়ে গেছে। নিজের ইচ্ছেয় নড়াচড়া করার ক্ষমতাটাই লোপ পেয়েছে তার। বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটাও যেন আচমকা ব্রেক কষে থেমে গেছে অজানা কোনও কারণে।
এরকম আশ্চর্যজনক পরিস্থিতিতে কয়েক মুহূর্ত, না জানি কয়েক সেকেন্ড, না জানি কয়েক মিনিট কাটানোর পর আবার দুম করে আলো জ্বলে উঠল চারদিকে আর বিস্ময়ে বিহ্বলভাবে বিরাজ নিজেকে আবিষ্কার করল মাটিতে হাঁটু গেড়ে সিদ্ধিমানকে বুকে নিয়ে নয়, বরং দুই উইকেটের মাঝখানে, সিদ্ধিমানের পাশে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে জায়ান্ট স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থার্ড আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।
প্রথমটায় কিচ্ছু বুঝতে পারছিল না সে। তাহলে কি শেষ বলে চার মারার ঘটনাটা আদপেই ঘটেনি? পুরো ব্যাপারটাই কি ছিল তার মনের বিভ্রম জাতীয় কিছু? অবাক হয়ে সিদ্ধিমানের দিকে তাকাতেই তার মনে হল সিদ্ধিমানের চোখে মুখেও যেন বিস্ময়। সেও যেন কিছু একটা বলতে চাইছে, কিন্তু বলতে পারছে না। মাঠের বাকি খেলোয়াড়দের হাবেভাবেও পরিষ্কার ফুটে উঠছে অবিশ্বাসের ছোঁয়া। কিন্তু এই রহস্যের সমাধান হবার আগেই তৃতীয় আম্পায়ারের সবুজ সংকেত ভেসে উঠল স্ক্রিনে। যন্ত্রচালিতের মতো সিদ্ধিমানের বাড়ানো গ্লাভসে গ্লাভস ঠুকে বিরাজ ফিরে এসেছিল ক্রিজে। অবাক হয়ে দেখেছিল মনশ্চক্ষে দেখা সেই আগের ঘটনাটার মতোই অবিকল একরকমভাবে ঘটে চলেছে সবকিছু।
শেষ বলে তিন রান বাঁচানোর জন্যে যেকোনও বোলার একশোর মধ্যে নিরানব্বই বারই ইয়র্কার দেবে, এটা জেনেও হয়তো একটু আগে দেখা ঘটনাটার কথা মাথায় রেখেই বিরাজ ঠিক করেছিল কোনও ইম্প্রোভাইজেশন না করে শেষমুহূর্ত পর্যন্ত বলটা দেখে তারপর স্ট্রোক নেবে। বলা তো যায় না যদি স্পার্ক চেস্ট হাইটে বাউন্সার দেয়। তাছাড়া রান-আপে যাবার আগে স্পার্কের দ্বিধাগ্রস্ত চোখমুখ দেখে কেন জানি তার মনে হচ্ছিল স্পার্ক মরে গেলেও ইয়র্ক করার চেষ্টা করবে না। কিন্তু অবাক হয়ে সে দেখল ঠিক আগের ঘটনার অ্যাকশন রিপ্লের মতোই ইচ্ছে না থাকলেও স্পার্ক বলটা ছাড়ার আগের মুহূর্তে সে যন্ত্রচালিতের মতো ঠিক একইরকমভাবে লেগে শাফল করে সরে এল, আর স্পার্কের সেই একই গতিতে একই লেংথে ফেলা ইয়র্কারটাকে ঠিক আগেরবারের মতোই ইনসাইড আউট করে চাবুক কভার ড্রাইভে বাউন্ডারি সীমানার বাইরে পাঠিয়ে দিল মাঠের একটাও অসি ফিল্ডারকে বিন্দুমাত্র নড়ার সুযোগ না দিয়ে। পরের ঘটনাগুলোও ঘটল যেন গতে বাঁধা নিয়ম মেনে। রহস্যময় কোনও শক্তির প্রভাবে ব্যাট ছেড়ে সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মাঠে, জেতার আনন্দে সিদ্ধিমান বিস্ময়াবিভূত কলের পুতুলের মতো ছুটে এল তার দিকে; তারপর যেন খানিকটা অনিচ্ছার সাথেই ঝাঁপিয়ে পড়ল তার বুকে, আবার আচমকা নিস্তব্ধ অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক আর কিছুক্ষণ পরে আলো ফিরে এলে বিরাজ আবার নিজেকে খুঁজে পেল সেই বৃত্তাকার অনুক্রমের প্রারম্ভিক বিন্দুতে, থার্ড আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষারত অবস্থায়।
সমস্ত বিজ্ঞান, সমস্ত লজিককে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে এই একই ঘটনাক্রম আবারও পুনরাবৃত্ত হল। একবার নয়, পরপর আরও দু’বার। এবার পাঁচ নম্বর বার স্পার্ককে বল হাতে ছুটে আসতে দেখতে দেখতে বিরাজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে জানান দিচ্ছিল, সেই একই কার্যকলাপ আবারও একইভাবে সম্পন্ন হতে চলেছে। বিরামহীনভাবে এরকমই হতে থাকবে আরও অনেক অনেকবার। কে জানে হয়তো বা অনন্তকাল পর্যন্ত। ঠিক যেন কেউ একটা রিমোট কন্ট্রোল নিয়ে বসে পরপর তাতে পজ, রিওয়াইন্ড আর প্লে বাটনটা টিপে চলেছে ক্রমাগত, আর তারা সবাই অদৃশ্য সেই ব্যক্তির খেয়ালখুশিতে একই চিত্রনাট্য অনুসরণ করে পুতুলের মতো নেচে চলেছে বারবার।
চার
৬ এপ্রিল ২০১৮, সকাল ৮:৪৫
ওয়াশিংটন ডি সি, ইউ.এস.এ
“হোয়াট দ্য হেল ইজ দিস? ইজ ইট রিয়েলি হ্যাপেনিং অর অ্যাম আই গোয়িং নাটস?”
আলো ফিরে আসার পর নিজেকে আবার সেই আগের জায়গায় নিজের সিটে, নিজের ম্যাকবুকের সামনে সেই একই মেল আবার পড়তে দেখে রাগের চোটে চিৎকার করে ঠিক এই কথাগুলোই বলতে ইচ্ছে করছিল ক্রাম্পের। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও শত চেষ্টা করেও মুখ থেকে একটা শব্দও বের করতে পারলেন না তিনি।
রাগ হওয়াটা একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। তিনি রোনাল্ড ক্রাম্প, প্রেসিডেন্ট অফ ইউ.এস.এ, পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী দেশের সবথেকে প্রভাবশালী মানুষ। আর তাঁকে কিনা এমনভাবে হেনস্থা হতে হচ্ছে অসহায়ভাবে! অবশ্য শেষ কিছুক্ষণ ধরে যা ঘটে চলেছে তাতে শুধু রাগ নয়, তার সাথে বিস্ময়, ভয়, হতাশা এইসব জৈবিক অনুভূতিগুলোও একে একে এসে ভর করছিল ক্রাম্পের মনে। কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে কিছুই মাথায় ঢুকছিল না তাঁর। সকাল থেকে একই জায়গায় চক্কর খেয়ে চলেছেন তিনি। একই কাজ করে চলেছেন বার বার। কিছুতেই এই সর্বনাশা চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না তিনি।
বাকি দিনগুলোর মতো আজকেও সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে হোয়াইট হাউসে নিজের অফিসে চলে এসেছিলেন তিনি। ন’টার সময় এইচ ওয়ান বি ভিসা এবং ইললিগ্যাল ইমিগ্রেশনের ব্যাপারে অন্যান্য ক্যাবিনেট মিনিস্টারদের সাথে আলোচনায় গৃহীত কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার জন্যে একটা প্রেস কনফারেন্স রয়েছে। সেটারই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মনে মনে। এরকম সময় হোয়াইট হাউসের ইন্টারনাল সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্ট থেকে ক্লিয়ারেন্স পেয়ে ক্রেমলিন থেকে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুলিনের তরফে আইসিস জঙ্গিদের দমন করার ব্যাপারে রাশিয়ার অবস্থান সংক্রান্ত একটা ইমেল তাঁর ইনবক্সে আসে। সেটা মন দিয়ে পড়ে সেটার একটা জুতসই রিপ্লাই টাইপ করছিলেন তিনি। সমস্যাটার সূত্রপাত হয় সেখান থেকে। রিপ্লাইটা লেখা শেষ করে পাঠানোর আগে সেটা ভালোভাবে রি-চেক করে দেখছিলেন। এতে দোষের তো কিছু নেই, বরং এটা ভালো অভ্যাস। কিছুদিন আগে এক গভীর রাতে ঘুম চোখে টুইট করতে গিয়ে একটা হাস্যকর টাইপো করে ফেলেছিলেন তিনি। নিমেষে নেটিজেনদের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায় সেটা। সকালে উঠে খেয়াল করে সেই টুইটটা ডিলিট করার আগেই হাজার হাজার মিম আর ইন্টারনেট জোক তৈরি হয়ে যায় সেটা নিয়ে। বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল সেবার ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতে। তারপর থেকেই মেল করার আগে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু পোস্ট করার আগে ভালোভাবে রি-চেক করে নেন তিনি।
যাই হোক, শেষপর্যন্ত মেলটা সেন্ড করে তিনি প্রেস কনফারেন্সে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছিলেন। সবে দরজা অবধি পৌঁছে দরজাটা খুলতে যাবেন, অমনি কোনও অজ্ঞাত কারণে ঝুপ করে চারপাশটা অন্ধকার হয়ে যায়। যেন চোখের সামনে আচমকা একটা কালো পর্দা নেমে আসে। এরকম বলা নেই কওয়া নেই সবকিছু অন্ধকার হয়ে যাওয়াটা আশ্চর্যজনক ঠিকই, কিন্তু তার থেকেও বেশি আশ্চর্যজনক হল সেই অন্ধকারে স্ট্যাচুর মতো দরজার হাতল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কিচ্ছু করা যাচ্ছিল না। যেন তাঁর নিজের শরীরটাই নিজের অধীনে না থেকে অন্যের অধীনে চলে গিয়েছিল। নড়াচড়া করা যাচ্ছিল না। তবে ক্রাম্প খেয়াল করে দেখেছেন, শরীরের বাকি সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলেও তাঁর মাথাটা অন্তত কাজ করে চলছিল তার নিজের মতন। মানে স্বাধীনভাবে চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতাটা অন্তত লোপ পায়নি। কিছুক্ষণ এরকমভাবে কাটানোর পর যেমন দুম করে চারপাশটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, তেমনই হঠাৎ করে আবার আলো ফিরে আসে। আর সবচেয়ে উদ্ভট ব্যাপার হল, আলো ফিরে এলে তিনি নিজেকে আবার নিজের সেই আগের সিটে বসে পুলিনের মেলটার রিপ্লাই করার অবস্থায় দেখতে পান। তারপর থেকে এই পুরো সিকুয়েন্সটা একটা বৃত্তাকারে বার বার ঘটতে শুরু করেছে। মনে মনে হিসেব করে দেখেছেন তিনি কম করে সাত থেকে আটবার এই একই জিনিস ঘটেছে এবং এখনও ঘটে চলেছে।
প্রথম এক-দু’বারে অবাক হয়ে গেলেও তিনি এটাকে তাঁর মনের ভুল অথবা কাল রাতের পার্টির পানীয়র প্রভাব ভেবে ততটা পাত্তা দেননি। কিন্তু যখন বার বার এই একই জিনিস রিপিট হতে থাকল তখন তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন। আরও একটা আজব ব্যাপার হল, আলো ফিরে আসার পর তিনি বহুবার চেষ্টা করেছেন সাহায্যের জন্যে চেঁচিয়ে লোক ডাকতে বা মেলটার রিপ্লাই না করে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে। কিন্তু প্রত্যেকবারই ইচ্ছা না থাকলেও তিনি মেশিনের মতো একই সময়ে একই কাজ করে যেতে বাধ্য হয়েছেন। হাজার চেষ্টা করেও এই এক রুটিনের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেননি। আগেকার দিনে লং প্লেয়িং রেকর্ডগুলো খারাপ হয়ে গেলে যেমন গানের একই কলি বারবার বাজতে থাকত, ঠিক সেরকমই ঘটে চলেছে এখানে। প্রথম চার-পাঁচ বার এরকম হবার পর কোনও একবার নিছক কৌতূহলের বশেই অন্ধকারে কিছু করার না পেয়ে কতক্ষণ অন্ধকারটা থাকে সেটা দেখার জন্যে সেকেন্ড কাউন্ট করেছিলেন তিনি। দেখেছিলেন ঠিক পনেরো সেকেন্ড ছিল অন্ধকারটা। তার পরের বারগুলোতেও একইভাবে গুনে দেখেছেন প্রত্যেকবারই আলো চলে যাবার ঠিক পনেরো সেকেন্ড পর আবার আলো ফিরে আসে।
কিন্তু কেন এরকম হচ্ছে? অনেক মাথা খাটিয়েও এর সদুত্তর পাননি তিনি। এটা কি তবে রাশিয়ার কোনও কারসাজি? কোনও অপরিচিত বায়ো-নিউক্লিয়ার ওয়েপন মেল-এ অ্যাটাচ করে পাঠিয়েছে পুলিন, যার প্রভাবে এরকম হচ্ছে? নাকি গতমাসে উত্তর কোরিয়ার স্বৈরাচারী শাসক ডিম-সং-নুনের সাথে তাঁর যে বৈঠকটা ছিল সেখানে কায়দা করে তাঁর খাবারে কোনও দীর্ঘমেয়াদী ড্রাগস মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল যার ফলে তাঁর এরকম হ্যালুসিনেশন হচ্ছে? অনেক ভেবেও কূলকিনারা না পেয়ে শেষপর্যন্ত তিনি ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় খুঁজে পাননি।
এবারেও তাই ঠিক আগের বারগুলোর মতোই তিনি নিরুপায়ভাবে রোবটের মতো পুলিনের মেলের রিপ্লাই হিসেবে সেই একই শব্দগুলো আরও একবার টাইপ করতে শুরু করলেন। বারবার একই জিনিস টাইপ করতে করতে প্রত্যেকটা শব্দ এমনই আঙুলস্থ হয়ে গেছে যে তিনি বলতে গেলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও রিপ্লাইটা করে দিতে পারতেন। পুরোটা লেখা শেষ হয়ে গেলে সেই আগেও রিভিউ করা একই মেল আবার তিনি বার দুয়েক পড়লেন। তারপর মেলটা সেন্ড করে ম্যাকবুকটা অফ করে উঠে দাঁড়ালেন নিজের চেয়ার ছেড়ে। টেবিলের ওপর থেকে আইফোনটা তুলে নিয়ে দেওয়ালজোড়া আয়নাটার সামনে গিয়ে একবার নিজের স্যুট-টাইটা ঠিক করে নিলেন। মাথার সোনালি চুলগুলোতে একবার হাত বুলিয়ে সেট করে নিয়ে একই ঘটনা আবারও পুনরাবৃত্ত হবে জেনেও পা বাড়ালেন দরজার দিকে। দরজার হাতলটা ছোঁয়ামাত্রই প্রত্যাশিতভাবেই আবার সব অন্ধকার হয়ে গেল। অন্যান্যবারের মতো এবারেও অন্ধকারে নট নড়নচড়ন অবস্থায় সেকেন্ড গুনতে শুরু করলেন তিনি। ওয়ান মিসিসিপি, টু মিসিসিপি, থ্রি মিসিসিপি, ফোর মিসিসিপি, ফাইভ মিসিসিপি, সিক্স মিসিসিপি, সেভেন মিসিসিপি, এইট মিসিসিপি, নাইন মিসিসিপি, টেন মিসিসিপি, ইলেভেন মিসিসিপি, টুয়েলভ মিসিসিপি, থার্টিন মিসিসিপি, ফোর্টিন মিসিসিপি, ফিফটিন মিসিসিপি…
কী হল? এবার তো পনেরো সেকেন্ড পূর্ণ হবার পর আগেরবারগুলোর মতো আলো ফিরে এল না। বুকের ভিতরটা যেন ধক করে উঠল ক্রাম্পের। শ্বাসবন্ধ করে আলো ফেরার জন্যে অপেক্ষা করে রইলেন তিনি। কিন্তু পনেরো সেকেন্ডের পর আরও পাঁচ সেকেন্ড, দশ সেকেন্ড, পনের সেকেন্ড কেটে গেল। আলো আর ফিরে এল না।
ঘন কালো অন্ধকারে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ক্রাম্প টের পেলেন, তাঁর বুকের রক্ত যেন আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হতে হতে হিমাঙ্কের ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে। তবে কি এটাই সেই শেষের শুরু, পৃথিবীর ধ্বংসের প্রাকমুহূর্ত? আজই কি তবে সেই তথাকথিত ডুমস ডে, দ্য লাস্ট ডে অফ ওয়ার্ল্ডস এক্সিসটেন্স?
পাঁচ
“হ্যালো স্যার! বলুন।”
“হ্যাঁ, হ্যালো। আমি না, আপনি বলুন কী হয়েছে? হোয়াট ইজ হ্যাপেনিং? হঠাৎ করে এরকম ম্যাসিভ একটা অ্যালার্মিং সিচুয়েশন! ব্যাপারটা কী?”
“না মানে, স্যার, এখনই তো কিছু কনফার্ম বলা যাচ্ছে না। তবে উই আর সাস্পেক্টিং সাম বাগ ইন দ্য সফটওয়্যার।”
“বাগ! আর্থ সফটওয়্যারে বাগ? ওহ্ মাই গড! ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াট ইউ আর টকিং? ডু ইউ নো দ্য ইমপ্যাক্ট অফ দিস? আমাকে ডিটেলে খুলে বলুন তো কী হয়েছে।”
“হ্যাঁ স্যার, বলছি। আসলে কী হয়েছে, ডিউ টু সাম রিজন কিছুক্ষণ আগে থেকে আর্থ সফটওয়্যারটা আচমকা হ্যাং করে যাচ্ছে। রিজনটা এখনও আইডেন্টিফাই করা যায়নি, বাট উই আর ইনভেস্টিগেটিং। এবার যে মুহূর্তে সিস্টেম হ্যাং হয়ে যাচ্ছে, ঠিক তক্ষুনি সিস্টেমের অটো-রিকভারি মড্যুলটা অ্যাক্টিভেট হয়ে গিয়ে সিস্টেমটাকে কিছুক্ষণ সাসপেন্ডেড অবস্থায় রেখে রিকভার করার চেষ্টা করছে। কিন্তু আনফরচুনেটলি দ্যাট রিকভারি অ্যাটেম্পট ইজ অলসো ফেলিং। তখন অটোরিকভারি মড্যুল অ্যাজ পার দ্য ডিজাইন সিস্টেমটাকে লাস্ট রেকর্ডেড স্টেবল স্টেটে নিয়ে গিয়ে রিস্টার্ট করে দিচ্ছে। সেখান থেকে ফের এক্সিকিউশন চালু হয়ে সেই আগের পয়েন্টে ফিরে এসে আবার সিস্টেমটা হ্যাং করে যাচ্ছে। এভাবে পুরো সিকুয়েন্সটা বারবার একটা ইনফাইনাইট লুপে ঘুরে চলেছে।”
“অসাম! গ্রেট! ওয়ান্ডারফুল! আই মাস্ট সে, অসাধারণ একটা সুখবর শোনালেন আপনি। নাও টেল মি, হোয়াটস দ্য রিজলিউশন ইউ হ্যাভ টেকেন ফর সলভিং দিস সো-কল্ড বাগ?”
“স্যার, এরর রিপোর্টটা পাবার সাথে সাথে পুরো প্রোগ্রাম এক্সিকিউশনটা টেম্পোরারিলি স্টপ করে দেওয়া হয়েছে যাতে অ্যাকচুয়াল ইস্যুটা ইনভেস্টিগেট করা যায়। এছাড়া একটা…”
“ওয়েট ওয়েট। হ্যাং অন আ সেকেন্ড। প্রোগ্রামটা স্টপ কেন করা হয়েছে? চালু অবস্থায় ইনভেস্টিগেট করা যাচ্ছিল না?”
“না স্যার। আসলে কী হচ্ছিল, সিস্টেমটা ইনফাইনাইট লুপে ঘুরে চললেও সিস্টেমের সব অবজেক্টগুলোর মেমরি কিন্তু রিফ্রেশ হচ্ছিল না। সেগুলো ক্রমাগত অ্যাক্যুমুলেট হতে থাকছিল। ফলে র্যা মের ওপর একটা হিউজ প্রেশার এসে পড়ছিল। এরকম চলতে দিলে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই স্ট্যাক ওভার ফ্লো হয়ে পুরো সিস্টেমটা ক্র্যাশ করে যেত। তাই এক্সিকিউশনটা বন্ধ করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না।”
“হুম। ওকে। গট ইট। এনিওয়ে, তারপর…”
“হ্যাঁ, যা বলছিলাম। দেন অ্যান্ড দেয়ার উই হ্যাভ ফর্মড অ্যান ইমার্জেন্সি ডিজ্যাস্টার কন্ট্রোল টিম টু ট্রাবলশুট দ্য ইস্যু। কয়েকজন ইম্মেন্সলি এক্সপিরিয়েন্সড প্রোগ্রাম্যার, প্রোগ্রাম অ্যানালিস্ট, সিস্টেম আর্কিটেক্টরা রয়েছে সেই টিমে। পুরো আর্থ সফটওয়্যারটাকে জিওগ্রাফিক্যালি বিভিন্ন রিজিয়নে ডিভাইড করে সমস্ত এক্সিকিউশন লগস আর ট্রেস ফাইলসগুলো অ্যানালাইজ করা হচ্ছে। অল অফ দেম আর ব্রেকিং দেয়ার হেড টু ফাইন্ড আউট আ সলিউশন অ্যাজ আর্লি অ্যাজ পসিবল।”
“গুড! এনি প্রোগ্রেস সো ফার?”
“নট ইয়েট। বাট উই আর এক্সপেক্টিং টু গেট সাম গুড নিউজ ভেরি সুন। ইনফ্যাক্ট স্যার, আমাদের ডিজ্যাস্টার কন্ট্রোল টিমের টিম-লিড এইমাত্র আমার ডেস্কে এসে দাঁড়িয়েছে আর ওর মুখ দেখে আমার মনে হচ্ছে দে হ্যাভ ফাউন্ড সামথিং।”
“গ্রেট। লেটস কিপ আওয়ার ফিঙ্গারস ক্রসড। কিপ মি পোস্টেড অল দ্য টাইম। অ্যান্ড লিসন, আয়্যাম গোয়িং টু ইনিশিয়েট আ কনফ-কল রিগার্ডিং দিস ইস্যু অ্যাজ আর্লি অ্যাজ পসিবল। ভাইস প্রেসিডেন্ট, ম্যানেজিং ডিরেক্টর অ্যান্ড অল দ্য বোর্ড মেম্বারস অ্যান্ড আদার স্টেক হোল্ডারস উইল জয়েন দ্য কল। আমি কল ডিটেলটা আপনাকেও ফরওয়ার্ড করব। প্লিজ জয়েন দ্যাট কল। অ্যান্ড রিমেমবার, প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে সবাই কিন্তু আপনার কাছ থেকে আপডেটটা জানতে চাইবে। সো ইটস বেটার ফর ইউ টু কাম আপ উইথ সাম পজিটিভ ভাইব বাই দ্যাট টাইম।”
“ওকে স্যার। শিওর স্যার।”
“ওকে দেন, সি ইয়া।”
***
“কে ছিল ফোনে? বড়দা?”
“আরে না, বড়দা নয়, মেজদা। অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট। উফ! আর বোলো না। এবার মনে হয় খাঁড়াটা পড়ল আমার ঘাড়ে। আর রক্ষে নেই। খুব শিগগিরি কোনও ভালো খবর দিতে না পারলে নেক্সট কলে বড়দা, মেজদা, সেজদা, ছোড়দা সবাই মিলে আমার মুণ্ডুটা চিবিয়ে খাবে।”
“হুম, সেটা আপনার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি।”
“অত দাঁত কেলিও না, বুঝলে? ভেব না যে আমার মাথাটা গেলে তোমাদের গর্দানগুলো অক্ষত থাকবে। যাক গে, ছাড়ো ওসব কথা। এনি লাক?”
“ইয়েস। উই হ্যাভ ট্র্যাকড দ্য ইস্যু।”
“হোয়াট! সিরিয়াসলি? ওহ্ গ্রেট! বলো বলো, হোয়াট ওয়াজ দ্য ইস্যু?”
“কিছুই না স্যার, ইট ওয়াজ অ্যা সিম্পল বাগ।”
“বাট হাও কাম? প্রোডাকশন সিস্টেমে বাগ কীভাবে এল? হোয়াই ইট ওয়াজ নট আইডেন্টিফায়েড আর্লিয়ার? নিশ্চয়ই ভালো করে টেস্টিং করা হয়নি।”
“টেস্টিং-এ কি আর সব বাগ ধরা পড়ে স্যার?”
“মানে? তুমি ভাবতে পারছ? এতদিন ধরে চলছে, এতটা রবাস্ট, এতটা স্টেবল একটা সিস্টেম। হুট করে একটা বাগ এসে পড়বে আর সবাই চুপচাপ ভালো ছেলের মতো মেনে নেবে ব্যাপারটা? কী লেভেলের একটা হইচই হবে বুঝতে পারছ?”
“হুম, তা কি আর পারছি না?”
“হোয়াটএভার। ডিটেলে বলো তো অ্যাকচুয়ালি হয়েছেটা কী।”
“কিছুই না স্যার, লগ ট্রেস করে ধরা পড়ল যে একটা হিউম্যান অবজেক্ট একটা ক্যুরিয়ার ক্লাসের ওপেন মেথডটা ইনভোক করায়…”
“এই দাঁড়াও দাঁড়াও। এইসব টেকনিক্যাল জার্গনস অন্য কোথাও কপচিও, বুঝলে। আমাকে পাতি ভাষায় বুঝিয়ে বলো কী হয়েছে।”
“উমম, ওকে। লেট মি ট্রাই দিস ওয়ে। প্রোগ্রাম স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী এশিয়া প্যাসিফিক রিজিয়নে একটা হিউম্যান অবজেক্টের কাছে একটা ক্যুরিয়ার অবজেক্ট আসে। নাও, অ্যাজ পার দ্য ডিজাইন, ওই ক্যুরিয়ারে একটা পার্সেলে একটা টাইমপিস অবজেক্ট থাকার কথা। এখন কোনওভাবে প্রোগ্রামিং এররের জন্যে সেই টাইমপিস অবজেক্টটা ইন্সট্যানশিয়েটেড হয়নি। নাল অবস্থাতেই, মানে অস্তিত্বহীন অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। এখন প্রথম হিউম্যান অবজেক্টটা ক্যুরিয়ার অবজেক্টটা রিসিভ করে যেই সেটার ওপেন মেথডটা কল করে মানে ক্যুরিয়ারে আসা পার্সেলটা খোলে, তখনই সেই টাইমপিস অবজেক্টটার ডিসপ্লে মেথডটা ইন্টারনালি ইনভোকড হয়। এখন যেহেতু সেই টাইমপিস অবজেক্টটার আদপে কোনও অস্তিত্বই নেই, তাই সেটা দেখতে পাবারও কোনও প্রশ্ন ওঠে না, তাই না? সেই কারণেই যখন প্রোগ্রাম অনুযায়ী সিস্টেম সেই অস্তিত্বহীন বস্তুটাকে ডিসপ্লে করার চেষ্টা করে তখনই গণ্ডগোলটা শুরু হয়। মানে একটা নাল পয়েন্টার এক্সেপশন রেইসড হয়। এই নাল পয়েন্টার এক্সেপশন মানে হল…”
“হ্যালো! এক্সকিউজ মি! ফর ইয়োর কাইন্ড ইনফরমেশন, আজকে তুমি আমাকে প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে দেখছ ঠিকই। কিন্তু এককালে আমিও তোমার মতো প্রোগ্রামিং করতাম, ওকে? কোড লেখার অভিজ্ঞতা আমারও আছে। তাই নাল পয়েন্টার এক্সেপশন কী সেটা আমাকে অন্তত বোঝাতে এসো না, বুঝলে?”
“ওকে, সরি স্যার। যাই হোক, এখন আনফরচুনেটলি প্রোগ্রামিংটা যে করেছিল সে ওই কোডটায় কোনও এক্সেপশন হ্যান্ডলিং করেনি। ফলে সেখানেই সিস্টেম হ্যাং করে যায় এবং পুরো সিস্টেমটা একটা ইনফাইনাইট লুপে ঘুরতে শুরু করে। এই হল গিয়ে ব্যাপার।”
“মাই গুডনেস। আর্থের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ সফটওয়্যারের প্রোগ্রামিং করেছে অথচ এক্সেপশন হ্যান্ডলিং করেনি। কে এই মহাপুরুষ? দাঁড়াও, তার ব্যবস্থা আমি করছি। কিন্তু তার থেকেও আশ্চর্য ব্যাপার এরকম একটা নাল অবজেক্ট ড্যাং ড্যাং করতে করতে চলে এল প্রোডাকশন সিস্টেমে! এতদিন ধরে কোয়ালিটি সিস্টেমে এত থরো টেস্টিং করেও সেটাকে আইডেন্টিফাই করা গেল না?”
“সেটাই তো প্রশ্ন।”
“তুমি তো প্রশ্ন করেই খালাস বাপু, উত্তরটা তো আমাকে দিতে হবে বোর্ড মিটিং-এ। যখন সবাই মিলে আমাকে ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড় করিয়ে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে জিজ্ঞেস করবে এতদিন ধরে সিস্টেমটা এত স্মুদলি চলছে, আজ অবধি একটা বাগও ধরা পড়েনি, হঠাৎ করে উইদাউট এনি নোটিস খোদ প্রোডাকশন সিস্টেমে বাগ কী করে চলে এল, সেটার কী জবাব আমি দেব, বলতে পার?”
“না স্যার, এর কোনও উত্তর আমার কাছেও নেই। আসলে কোয়ালিটি সিস্টেম আর প্রোডাকশন সিস্টেমের এনভায়রনমেন্ট টোট্যালি ডিফারেন্ট। আমরা টেস্টিং করার সময় প্রোডাকশন এনভায়রনমেন্টটা অনেকটাই সিম্যুলেট করার চেষ্টা করি ঠিকই কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক পার্থক্য থেকে যায়। তাছাড়া টেস্ট ডেটা আর রিয়েল টাইম ডেটার মধ্যেও আকাশপাতাল ফারাক। হয়তো সেই কারণেই আগে ধরা পড়েনি ইস্যুটা। তবে একটা কথা না বলে পারছি না, স্যার।”
“কী?”
“না বলছিলাম, প্রোডাকশন সিস্টেমে আগে আর কখনও কোনও বাগ রিপোর্টেড হয়নি, এটাও কি ঠিক স্যার? মনে তো হয় না।”
“মানে কী বলতে চাইছ। খুলে বলো। প্রোডাকশন সিস্টেমে আগে আবার কখন বাগ রিপোর্টেড হল?”
“কেন স্যার, সেই মেসোজোয়িক এরর শেষে যখন সমস্ত ডাইনোসর অবজেক্টগুলো ডেস্ট্রয় হয়ে গেল, তখন?”
“এই, ভুলভাল বোকো না তো। এমনিতেই মাথা আজকে গরম আছে। সত্যি বলছি, নিতে পারব না। তোমায় কে বলেছে ওটা বাগ ছিল? না জেনেশুনে কমেন্ট করছ। দ্যাট ওয়াজ নট অ্যাট অল আ বাগ। ইট ওয়াজ ইন্টেনশনাল সিস্টেম আপগ্রেডেশন। ম্যানেজমেন্ট রীতিমতো মিটিং করে স্ট্র্যাটেজিক ডিসিশন নিয়েছিল যে পুরনো অবসলিট অবজেক্টগুলো সব ডেস্ট্রয় করে দেওয়া হবে। ওই ডাইনোসর অবজেক্টগুলোর ডিজাইনে গলদ ছিল। একেবারেই রাবিশ ডিজাইন, একগাদা মেমরি আর রিসোর্স কনজিউম করত, অথচ এফিশিয়েন্সি ওয়াজ জিরো। জেনেবুঝে সেইসব অবজেক্টগুলো ডিলিট করে পুরো সিস্টেমটা ফরম্যাট করে নতুন ভার্সনের অপারেটিং সিস্টেম ইন্সটল করা হয়েছিল। বুঝলে?”
“ওহ্, তাই নাকি? আমি আসলে এত ডিটেলে জানতাম না।”
“তাহলে? ফট করে একটা কথা বলে দিলেই হল?”
“আয়্যাম সরি, স্যার!”
“ইটস ওকে। অবশ্য তোমার কথাও যে একেবারে ফেলনা, তা নয়। এতদিনে কোনও বাগই রিপোর্টেড হয়নি এটা বলাটাও ঠিক না। এই তো যেমন বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কেসটা। দুমদাম কয়েকটা জাহাজ আর এরোপ্লেন অবজেক্ট হুস করে কথা নেই বার্তা নেই ডিলিট হয়ে যাচ্ছিল। কম কাঠখড় তো পোড়াতে হয়নি বাবা সেই বাগ সলভ করতে। তবে দ্যাট ওয়াজ জাস্ট আ সিম্পল বাগ। নট অ্যাট অল আ শো-স্টপার লাইক দিস।”
“হুম, সেটাও ঠিক।”
“যাই হোক, ফালতু এতক্ষণ বকালে। এখন বলো ইস্যুটা কীভাবে সলভ করা হবে, ঠিক করেছ কিছু? এনি প্ল্যান অফ অ্যাকশন?”
“হ্যাঁ, স্যার। আপাতত ইমিডিয়েট স্টেপ হিসেবে সিস্টেমটা স্টপ অবস্থাতেই প্রোডাকশন সার্ভারে ফায়ার ফাইটার মোডে লগ ইন করে প্রোগ্রাম স্ক্রিপ্টটা মডিফাই করতে হবে। মানে ওই নাল টাইমপিস অবজেক্টটাকে ডাইরেক্টলি হার্ড কোড করে একটা ইন্সট্যানশিয়েটেড অবজেক্ট দিয়ে রিপ্লেস করে লাস্ট রেকর্ডেড স্টেবল স্টেট থেকে সিস্টেম এক্সিকিউশনটা চালু করে দিতে হবে।”
“সে কি! কেন? হার্ড কোড করবে কেন? নাল অবজেক্টটা এল কীভাবে সেই রুট কজটা খুঁজে বের করো।”
“সরি স্যার, উই ডোন্ট হ্যাভ দ্যাট মাচ টাইম টু ফাইন্ড আউট দ্য রুট কজ। প্রথমত পুরো ইস্যুটা কোয়ালিটি সিস্টেমে রিপ্রডিউস করতে হবে। মাস্টার ডেটা রিক্রিয়েট করতে হবে। তারপর ডিবাগ করে দেখতে হবে নাল অবজেক্টটা কীভাবে তৈরি হল। দিস ইজ সাচ আ ভাস্ট সফ্টওয়্যার, এত বিশাল একটা প্রোগ্রাম, এত কম্পলিকেটেড স্ক্রিপ্ট, মিলিয়ন্স অফ লাইনস অফ কোড। তার মধ্যে থেকে ডিবাগ করে একটা বাগ খুঁজে বের করা তো এত সহজ নয়। ইটস নট আ ইজি টাস্ক টু ডু। সেটার জন্যে প্রচুর টাইম লাগবে, আর এতটা সময় জুড়ে আর্থের মতো একটা ইম্পরট্যান্ট সফটওয়্যার স্টপ করে রাখাটা ঠিক হবে না। তার চেয়ে হার্ড কোড করে যদি আপাতত কাজ চালানো যায়, আমার মনে হয় সেটাই বেটার অপশন হবে। ওয়ান্স দ্য সিস্টেম ইজ আপ অ্যান্ড রানিং আগেইন, তখন আমরা রুট কজ অ্যানালাইসিস করার জন্যে অঢেল সময় পেয়ে যাব।”
“হুম ওকে। যা ভালো বোঝো তাই করো। বাট মেক দ্য ব্লাডি সিস্টেম রানিং এসাপ।”
“শিওর স্যার। ডোন্ট উওরি। দ্যাট উইল নট টেক মাচ টাইম। আমরা এক্সেপশনটা কোথায় রেইসড হয়েছে যখন খুঁজে পেয়ে গেছি, তখন সোর্স কোডে গিয়ে চট করে নাল অবজেক্টটাকে রিপ্লেস করে আরেকটা অবজেক্ট বসিয়ে দেওয়া ইজ জাস্ট ম্যাটার অফ সেকেন্ডস। তবে…”
“আবার তবে কী?”
“না মানে, এমনি কৌতূহল হচ্ছিল আর কী, হাউ উইল ইট বি এক্সপ্লেনড? মানে দেখুন, সিস্টেমটা আবার ফাংকশনাল হলেও কিন্তু সব অবজেক্টগুলোর মেমরি ইন্ট্যাক্ট থেকে যাবে। ধরে ধরে এই লক্ষ কোটি অবজেক্টের মেমরি ডিলিট করা সম্ভব নয়। আবার আমাদের ডিজাইন অনুযায়ী হিউম্যান অবজেক্টগুলোর মোস্ট ইম্পরট্যান্ট প্রপার্টি হল ইনক্যুইজিটিভনেস। উই অনলি প্রোগ্রামড দেম টু আস্ক কোয়েশ্চেনস এভরিহোয়্যার। তাই সিস্টেম আপ হলেই দে উইল স্টার্ট লুকিং ফর এক্সপ্ল্যানেশন। তখন সেটা কীভাবে অ্যাড্রেস করা হবে?”
“সেটা নিয়ে তোমায় মাথা ঘামাতে হবে না। দ্যাটস নান অফ আওয়ার বিজনেস। কীভাবে এই পুরো মিসহ্যাপটা এক্সপ্লেন করা হবে, নাকি পুরো ব্যাপারটাই ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হবে ম্যানেজমেন্ট উইল টেক দ্যাট কল। খুব বেশি হলে তোমাকে নতুন রিকোয়্যারমেন্ট ডক অনুযায়ী ফিউ লাইনসের একটা প্রোগ্রাম লিখে সেটাকে প্যাচ হিসেবে নেক্সট আপডেটের সাথে ইনক্লুড করে দিতে হবে। দ্যাটস অল।”
“হেঁ হেঁ! তার মানে হয় কোনও রিলিজিয়াস হিউম্যান অবজেক্টের মুখ দিয়ে বলাতে হবে এটা কোনও গডস মিরাকল অথবা কোনও সায়েন্টিস্ট হিউম্যান অবজেক্টেকে দিয়ে আবিষ্কার করাতে হবে কোনও কসমিক ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফ্লাকচুয়েশনের জন্যে এরকম হয়েছে, তাই তো?”
“এছাড়া আর কী? দ্যাখো, এই হিউম্যান অবজেক্টগুলো যতই প্রশ্ন করুক বা যতই উত্তর খুঁজুক না কেন, এরা তো ততটুকুই জানবে যতটুকু আমরা ওদের জানাব। আফটার অল দে আর আওয়ার ক্রিয়েশনস, আওয়ার ডিজাইন অনলি। এদের ওঠা, বসা, হাসা, কাঁদা মানে যাবতীয় অ্যাকশনস সবই তো আমাদের নিয়ন্ত্রণে। আমরা যেরকম কোড লিখব, ওরা সেরকমই বিহেভ করবে। প্রয়োজন হলে ওদের ক্রিয়েট করা হবে। আবার প্রয়োজন ফুরোলে দে উইল বি ক্লিয়ারড ফ্রম দ্য সিস্টেম। দে আর ক্রিয়েটেড বাই দ্য সিস্টেম, উইল বি কন্ট্রোলড বাই দ্য সিস্টেম বাট নেভার নো অ্যাবাউট দ্য সিস্টেম।”
“হুম, তা অবশ্য ঠিক।”
“নাও, অনেক ফালতু টাইম ওয়েস্ট করলে। এবার গিয়ে চট করে ফিক্স করো ইস্যুটা। রিমেমবার, কেয়ারফুলি কাজটা কোরো, যাতে ফারদার কোনও গণ্ডগোল না হয়। আর এদিকে আমি কলে জয়েন করে আমার আর সাথে তোমাদের সবার গর্দানটা বাঁচানোর চেষ্টা করি। যাও।”
ছয়
৬ এপ্রিল ২০১৮, সন্ধে ৬:১৫
কলকাতা, ভারতবর্ষ
এবার যেন আলো ফিরে আসতে অনেকটা বেশি সময় লেগে গেল। দরজাটা খুলতে খুলতে মনে মনে এটাই ভাবছিলেন সমীরণবাবু। প্রথমদিকে যেটাকে দুঃস্বপ্ন ভাবছিলেন, পরে যখন দেখলেন সেই একই ব্যাপার বারবার ঘটে চলেছে তখন বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলেন তিনি। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পার্সেলটা খোলামাত্র কোনও কারণ ছাড়াই সমস্ত কিছু অন্ধকার হয়ে যাবার কিছুক্ষণ পরে কলিং বেলের আওয়াজে যখন তাঁর ঘুম ভাঙছিল, তিনি অবাক হয়ে দেখছিলেন তিনি আবার সেই সোফায় মাথা রেখে অস্বস্তিকর ভঙ্গিতেই শুয়ে আছেন। শুধু তিনি নন, টিভিতে চলা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলের মাসাইমারার রুক্ষ প্রান্তর, ঘড়ির ঘণ্টা আর মিনিটের কাঁটাদুটো, ঘড়ির তলা থেকে মুখ বের করা টিকটিকিটা, তার নিশানায় থাকা দেওয়ালের গায়ে বসা মথটা, পার্সেল ডেলিভারি দিতে আসা লোকটা সবাই যেন রেকারিং ডেসিম্যালের মতো বারবার একই নাটকের মহড়া দিয়ে চলেছে। যেন সমস্ত বিশ্বসংসার অদ্ভুত এই অন্ধকারে ঢেকে যাওয়ামাত্র পৃথিবীটা তার স্বাভাবিক আহ্নিকগতির উলটোদিকে ঘুরে আবার ফিরে আসছে তার কিছুক্ষণ আগের অবস্থানে।
ধর্মভীরু সমীরণবাবু এই আশ্চর্য পরিস্থিতির কারণ হিসেবে নিশ্চিতভাবে ধরেই নিয়েছিলেন যে এটা কলিকালের বিনাশের সেই চরম মুহূর্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। এর জন্যে যদিও মনে খুব একটা আক্ষেপ হচ্ছিল না তাঁর, খালি মনে হচ্ছিল একটা নাতি বা নাতনির মুখ দেখে যেতে পারলে হয়তো আরেকটু ভালো হত। সমস্যার সমাধান খোঁজার জন্যে সময় নষ্ট না করে অন্ধকার হওয়ার সাথে সাথে মনে মনে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করতে শুরু করছিলেন। এতে অবশ্য কাজও হচ্ছিল। মন্ত্রোচ্চারণ পুরোটা শেষ হবার আগেই সশব্দে কলিং বেলটা বেজে উঠছিল আর আলো ফিরে এসে সেই একই দৃশ্যাবলী আবারও পুনরাভিনীত হতে শুরু করছিল।
কিন্তু শেষবার অন্ধকার হয়ে যাবার পর গায়ত্রী মন্ত্রতেও আর কাজ হল না। একবার, দু’বার, পাঁচবার, দশবার মন্ত্র জপেও যখন আলো আর ফিরে এল না, ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন সমীরণবাবু। ভেবেছিলেন, ইহজীবনে পৃথিবীর আলোকিত রূপ বোধহয় আর দেখা হবে না তাঁর। অবশেষে কলিযুগের অবসান হল।
তাই তাঁকে চমকে দিয়ে অনেক অনেকক্ষণ পর যখন আবার কলিং বেলের শব্দে তাঁর ঘুমটা ভাঙল, শুরুতে আগের কথা কিছুই আর মনে পড়ছিল না তাঁর। টিকটিকিটাকে দেখে সব মনে পড়ে যেতেই প্রথমেই তাঁর মনে হল শেষবারে যেন অন্ধকারের স্থায়িত্বটা আগেরবারগুলোর তুলনায় অনেক বেশি ছিল। নাকি এটা তাঁর মনের ভুল? হয়তো তিনিই ভুলভাল ভাবছেন। এসব সাতপাঁচ চিন্তা মাথায় নিয়ে দরজাটা খুললেন তিনি।
দরজা খুলে তাঁরই মতো হতভাগ্য হতভম্ব ডেলিভারি পার্সনের কাছ থেকে আবার সইসাবুদ করে পার্সেলটা নিয়ে ঘরে ঢুকে ক্রমাগত মথটাকে কব্জা করার বৃথা চেষ্টা করে চলা টিকটিকিটার প্রতি করুণা অনুভব করে পাশের ঘর থেকে কাঁচি এনে পার্সেলটা কেটে তার ভিতরে হাত ঢোকানোর ঠিক আগে অন্যান্যবারগুলোর মতোই আবার রাস্তার হট্টগোলটা শুরু হল। এতবার শুনে শুনে অভ্যাস হয়ে গেছে, তাই জানালা দিয়ে যান্ত্রিকভাবে বাইরের দিকে তাকালেও ভিতর ভিতর আর নতুন করে চমকালেন না তিনি। ঘরে চোখ ফিরিয়ে মথটার ওপর টিকটিকিটার ঝাঁপ দেবার শেষ প্রস্তুতিটা আরেকবার দেখে নিয়ে হাত ঢোকালেন পার্সেলটার ভিতরে। হাতটা আবারও গিয়ে ঠেকল কাগজ আর কার্ডবোর্ডের বাক্সটার গায়ে। কোনও লাভ হবে না জেনেও দুরুদুরু বুকে পার্সেলটা থেকে বাক্সটা টেনে বের করে আনতেই সবকিছু আবার অন্যান্যবারের মতো অন্ধকার হয়ে গেল।
কিন্তু দুয়েক সেকেন্ড অন্ধকারে থাকার পরই কেমন একটা খটকা লাগল তাঁর। আগেরবারগুলোতে অন্ধকার হবার সাথে সাথে চারপাশের সব আওয়াজ থেমে গিয়ে যে কেমন একটা হাড় হিম করা মৌনতার সৃষ্টি হচ্ছিল, কই এবার তো যেন সেরকমটা নয়। এই তো, খোলা জানালা দিয়ে দিব্যি বাসের হর্ন শোনা যাচ্ছে। আরও খেয়াল করে দেখলেন, এবার আর তিনি অন্যান্যবারের মতো স্থবির অবস্থায় নেই, সহজেই নাড়াতে পারছেন নিজের হাত-পা।
ও হরি! হঠাৎ করে খেয়াল হল তাঁর, অন্যান্যবারের বিভীষিকাময় পরিস্থিতির আশঙ্কা করে এবার বাক্সটা বের করেই তিনি প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলেন। তাই তিনি কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। চমকে উঠে চোখটা মেলতেই তিনি দেখলেন, নাহ্, এবার আর আগের মতো সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়নি। টিউবলাইটের আলোয় ঝলমল করছে সারাঘর। জানালা দিয়ে ভেসে আসছে কর্মব্যস্ত মানুষের কোলাহল। সময় যেন তার স্বল্পস্থায়ী বিপত্তিকে অতিক্রম করে আবার এগিয়ে চলেছে তার স্বাভাবিক ধীরগতিতে, তার নিজস্ব লয়ে।
উজাড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তাঁর বুক থেকে। অবশেষে মৃতপ্রায় শরীরে যেন প্রাণ ফিরে এল। আনন্দে, উত্তেজনায় হাত পা কাঁপছিল তাঁর। তাহলে কি শেষপর্যন্ত সব ঠিক হয়ে গেল? কলিযুগ কি তাহলে এ-যাত্রা রক্ষা পেল বিনাশের হাত থেকে? আনন্দে চিৎকার করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে ইচ্ছে হল তাঁর। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, ইচ্ছে থাকলেও তাঁর শরীর যেন এতে সঙ্গ দিল না তাঁকে। বাধ্য হয়ে মনে-মনেই বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে শতকোটি প্রণাম জানালেন ভগবানকে।
মনের অবস্থা একটু স্বাভাবিক হবার পর হাতে ধরা বাক্সটার দিকে তাকালেন তিনি। বাক্সটার গায়ের ছবি দেখে মনে হচ্ছে টেবিল ক্লক রয়েছে তাতে। পার্সেলটার ভিতর একটা কাগজও ছিল মনে পড়ল তাঁর। বের করে এনে দেখলেন একটা ছোটো দু-তিন লাইনের চিঠি। মেয়ের লেখা। জন্মদিনের উইশ জানিয়ে লিখেছে সে, আর তার বর জন্মদিনে তাঁর জন্যে একটা ছোটো টেবিল ক্লক পাঠিয়েছে উপহার হিসেবে।
চিঠিটা পড়া শেষ হবার আগেই জানালার ঠিক বাইরে একটা প্রচণ্ড জোরে শব্দ হল। বোম ফাটার। সাথে বেশ কিছু মানুষের হইচই হট্টগোলও শোনা যেতে থাকল। এবার আর অবহেলা করতে পারলেন না তিনি। জানালার কাছে গিয়ে উঁকি মারলেন বাইরে। দেখলেন, পাড়ার ছেলেপুলেগুলো একযোগে চিৎকার চেঁচামেচি করে পটকা ফাটাচ্ছে। দুয়েকজনের হাতে ধরা জাতীয় পতাকা। সবাই আনন্দ করছে ঠিকই, কিন্তু প্রত্যেকের মুখে কেমন একটা হতচকিত ভাব। যেন যা হচ্ছে সেটা কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না মন থেকে।
হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল, আজকে অস্ট্রেলিয়ার সাথে ভারতের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমি ফাইনাল ম্যাচটা ছিল না? হ্যাঁ, টিভিতে সেটাই তো দেখছিলেন তিনি। কিন্তু পরপর ভারতের পাঁচটা উইকেট পড়ে যাবার পর উৎসাহ হারিয়ে তিনি চ্যানেল সার্ফ করতে শুরু করে দেন। তাহলে কি ভারত ম্যাচটা জিতে গেল নাকি? তড়িঘড়ি রিমোটটা নিয়ে স্পোর্টস চ্যানেলটা খুললেন। হ্যাঁ, ভারত জিতেই গেছে বলে মনে হচ্ছে। পুরো ইন্ডিয়ান টিম মাঠে নেমে এসেছে। মরণ-বাঁচন ম্যাচ জেতার উচ্ছ্বাস ভাগ করে নিচ্ছে বিরাজ আর সিদ্ধিমানের সাথে। প্রত্যেকের চোখে মুখে আনন্দ। ওদিকে অস্ট্রেলিয়ান প্লেয়াররা বিমর্ষ মুখে অভিনন্দন জানাচ্ছে ভারতীয় খেলোয়াড়দের। গ্যালারিতে ভারতীয় সমর্থকরাও জয়োৎসবে মত্ত। কিন্তু ম্যাচ জেতার আনন্দ বা ম্যাচ হারার দুঃখ ছাড়াও প্রত্যেকের মুখে আরেকটি অভিব্যক্তি পরিষ্কার ধরা পড়ছে। সেটা হল অবিশ্বাস। প্রত্যেকেই যেন যা ঘটে চলেছে সেটায় যারপরনাই বিস্মিত, আশ্চর্যান্বিত।
যাক, সবকিছু ভালোয় ভালোয় মিটল শেষপর্যন্ত। এবার বাক্স থেকে গিফটটা বের করতে হবে। টিভি থেকে দৃষ্টিটা সরাতে গিয়ে চোখ পড়ল দেওয়ালের গায়ে টিকটিকিটার দিকে। কেমন একটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে আছে সামনে। একটু ঘাড় ঘোরাতেই চোখে পড়ল শেষমুহূর্তে মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে মথটা উড়ে গিয়ে বসেছে দশ হাত দূরে পাশের দেওয়ালে। বেশ হয়েছে। বোকা বনে যাওয়া টিকটিকিটাকে দেখে মনে মনে একটু হাসিই পেয়ে গেল সমীরণবাবুর।
কার্ডবোর্ডের বাক্সটা খুলে ভিতর থেকে টেবিল ক্লকটা বের করে আনতেই আরেক দফা অবাক হলেন সমীরণবাবু। সঙ্গের চিঠিটাতে মেয়ে পরিষ্কারভাবে লিখেছে যে তারা বাবার জন্যে বাবার প্রিয় লাল রং-এর একটা টেবিল ক্লক পাঠিয়েছে। অথচ বাক্স থেকে যে টেবিল ক্লকটা তিনি এইমাত্র বের করে আনলেন সেটার রং লাল নয়, ক্যাটক্যাটে হলুদ।
অলঙ্করণঃ শিমুল
পড়ে ফেললাম। জোরদার কনসেপ্ট। দারুন ভাবনা। বিশেষ করে প্রোগ্রামিং করতে গিয়ে যাদের আকছার ঝাড় খেতে হয়, তারা বেশ রিলেট করবে।
আমি রিলেট করেছি জেরম্যাটের সাথে। বহু শহরের মাঝে এই শহরটিকে আলাদা করে ভালোবেসে ফেলেছি। পাহাড় পাগলদের জন্যে সাক্ষাৎ স্বর্গ। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। সব মনে পড়ে গেল।
LikeLike
সুদীপ, জেরম্যাটের টং এর ওপরে হোটেল কাম অবজারভেটরিটা খেয়াল আছে? ওখানে রাতে থাকলে অবজারভেটোরিটা ইউজ করতে দেয়। আর ঢপ দিল কি না জানি না, ওর দুরবিণ নাকি ইএইচটি প্রোজেক্টের অংশ ছিল। যা লোভ হচ্ছিল না! ফের গেলে ওইখানে রাত্তিরে থাকব।
LikeLike
আমিও সেই আশাতেই আছি।
LikeLike
ধন্যবাদ সুদীপ, পড়ে মন্তব্য করার জন্যে। ঠিকই বলেছ প্রোগ্রাম্যার, ডেভেলপাররা খুব রিলেট করতে পারবে। আসলে সেই অনুপ্রেরণাতেই তো লেখা। ভুক্তভোগী কিনা।
আর আরেকটা কথা চুপিচুপি বলে রাখি, জেরম্যাট এর বিবরণ পুঙ্খানুপুঙ্খ বলছ ঠিকই, কিন্তু বিশ্বাস কর পুরোটাই কিন্তু নেট ঘেঁটে লেখা 😀😀😀
LikeLike
সেটা আমি বুঝেছি একটা ব্যাপারের উল্লেখ না দেখে। সেটা হল যান্ত্রিক শব্দের অনুপস্থিতি। 😊 আসলে জেরম্যাটে সশরীরে গিয়ে উপস্থিত হলে সবচেয়ে বেশি যেই জিনিসটা অনুভব করা যায় সেটা হল রাস্তায় একটাও গাড়ির শব্দ না থাকা। একটা আস্ত ‘কার ফ্রি’ শহর। পাখিদের ডাক পরিষ্কার শোনা যায়। পাহাড়ের পাশ দিয়ে মাইলের পর মাইল হাইকিং পথ চলে গেছে ম্যাটারহর্ন এর দিকে। আমাদের মত ট্রাফিকে যাদের অর্ধেক জীবন কাটছে, তারা জাস্ট পাগল হয়ে যাবে।
LikeLike