রোবটের তিন আইন
১. রোবট মানুষকে আঘাত করবে না অথবা নিষ্ক্রিয় হয়ে মানুষকে কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হতে দেবে না। ২. প্রথম আইনের বিরুদ্ধাচরণ আদেশ ব্যতিরেকে রোবট মানুষের সব আদেশই মানবে। ৩. প্রথম ও দ্বিতীয় আইনের প্রতিবন্ধক না হওয়া পর্যন্ত রোবট নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকবে।
১
অনেক অনেক ধন্যবাদ। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল অ্যান্ড্রু মার্টিন। মনের গভীরে ঝড়ের দাপট… বাইরে সুনীল আকাশ। ভবলেশহীন শান্ত মুখমন্ডল… চোখের তারায় সামান্য অস্থিরতা। পরিপাটি মাথার চুল… হালকা বাদামি… নির্লোম অবয়ব… পোশাকে অতীত ঐশ্বর্য…পাটভাঙা নিখুঁত পরিপাটি।
টেবিলের অপর পাশে সার্জন। টেবিলের উপর ফলকে নাম-পরিচয়… নামের পরে সার সার অনেকগুলো ক্রমিকসংখ্যা। অ্যান্ড্রুর কাছে অর্থহীন এসব …নামে কী আসে যায়… সার্জন… ডাক্তার… না… না, সার্জন বলে ডাকলেই হবে।
অপারেশনটা কখন হতে পারে সার্জন? সরাসরি প্রশ্ন করে আন্ড্রু।
-সঠিক করে কিছু আগে কয়েকটা প্রশ্ন ছিল আমার…কার ওপর অপারেশন হবে মিঃ অ্যান্ড্রু। যান্ত্রিক স্বরের মধ্যেও সম্ভ্রমের ছোঁয়াচ….. ভাবলেশহীন নিষ্প্রাণ মুখ হালকা ছাই রঙের ইস্পাতের গড়া…… ধূসর মসৃণ।
সার্জনের দুই হাত টেবিলের উপর পড়ে আছে অলসভাবে। ডান হাত যেন শাণিত অস্ত্র… ঠিক যেন অপারেশনের ছুরি… লম্বা লম্বা আঙুলগুলো ঈষৎ বক্র… স্ক্যালপেল লাগিয়ে দিলে একাত্ম হয় সুন্দরভাবে।
নির্নিমেষ নেত্রে অ্যান্ড্রুর দিকে তাকিয়ে আছে সার্জন। নিখুঁত কাজ করার দৃঢ় অঙ্গীকার ওর সর্বাঙ্গে। মানবসভ্যতার অবিশ্বাস্য অগ্রগতির মূর্তিমান প্রতিচ্ছবি। স্বতন্ত্র মস্তিস্কের অধিকারী হলেও কার্যক্ষমতা কিন্তু সীমাবদ্ধ এদের- আর সীমাবদ্ধ বলেই অ্যান্ড্রুকে চিনতে পারল না সার্জন। মনে-মনে বেশ মজা অনুভব করল অ্যান্ড্রু পরক্ষণে বিষাদে ভরে উঠল সমস্ত মন।
-সার্জন… মানুষ হতে সাধ যায় না কখনো? একবারও কি চিন্তা করেছ সে কথা? নড়েচড়ে বসল সার্জন… মূহূর্তের জন্য সামান্য দ্বিধাদ্বন্দ্ব… পূর্বনির্ধারিত পজিট্রনিক পথের কোথাও যেন গরমিল হচ্ছে প্রশ্নটাকে খাপ খাওয়াতে।
-কিন্তু… কিন্তু আমি তো রোবট।
-হ্যাঁ… হ্যাঁ… সেইজন্যেই তো বলছি… মানুষ হতে ইচ্ছে হয় না তোমার?
-মানুষ হলে কি ভালো সার্জন হতে পারব আমি? না… মানুষেরা ভালো সার্জন হয় না কখনো। একমাত্র ‘উন্নত সার্জন’ হয় মিঃ অ্যান্ড্রু। আর সেটাই আমার একমাত্র কামনা।
-আমার কথা শোনো সার্জন… এই যে আমি আদেশ করছি তোমাকে…… এতে ছোট মনে হচ্ছে না নিজেকে? আমি তো তোমাকে ইচ্ছেমতো কাজ করাতে পারি… চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াতে বলতে পারি… বসতে বলতে পারি মাটিতে… ডাইনে বাঁয়ে ঘুরতে বলতে পারি… যা… খুশি…।
-আপনাদের খুশি করাই তো আমার কাজ… আমার আনন্দ। এ-বিষয়ে তিন আইন মানতে আমরা বাধ্য। যাক, কার উপর অপারেশন হবে বললেন না তো আমাকে?
-আমার উপর।
-না না…… অসম্ভব! এ তো রীতিমতো বিপজ্জনক অপারেশন!
-বিপজ্জনক বলে বন্ধ আছে নাকি অপারেশন? সবই সমান আমার কাছে। শান্তস্বরে জবাব দিল অ্যান্ড্রু।
-কিন্তু… কিন্তু… আপনার ক্ষতি হতে পারে এমন কিছু করতে পারব না আমি! নিরুত্তাপ স্বরে বলল সার্জন।
-ঠিক বলেছ ডাক্তার… মানুষের কোনো ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করবে না… কিন্তু… আমি… আমি তো রোবট… ঠিক তোমার মতো!
২
গোড়ার দিকে অর্থাৎ অ্যান্ড্রুর জন্মের সময়ে অন্যান্য রোবটের চেয়ে কোনো পার্থক্য ছিল না ওর। রূপায়ণের নকশায় দৈনন্দিন কাজকর্মে বিশেষ পারদর্শী, সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। ধাতব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কঠিন ও মসৃণ… চলাফেরায় যান্ত্রিক কাঠিন্য।
গৃহস্থালিতে রোবটের প্রচলন সেই প্রথম। পরীক্ষামূলকভাবে বিশিষ্ট কয়েকজনের বাড়িতেই রোবট স্থান পেয়েছে মানুষের সঙ্গে। মার্টিন পরিবার এই ভাগ্যবানদেরই একটি।
মার্টিন পরিবারের সদস্যসংখ্যাই বা তখন কত? শ্রী এবং শ্রীমতী মার্টিন… দুই কন্যা… বড় মামণি, ছোট মামণি। সেদিনের কথা যেন কালকের কথা বলে মনে হয় অ্যান্ড্রুর। দিনের পর রাত, রাতের পর দিন…মাস…বছর…যুগ… তারপর… তারপর- নিজের পরিচয়জ্ঞাপক সংখ্যাই কি মনে আছে ওর! বিস্মৃতির অতলে হাতড়ে দেখার চেষ্টা করল অ্যান্ড্রু… না… সবই পান্ডুর ধূসর… মনে পড়ে না কিছু… সংখ্যা মনে নেই…হ্যাঁ হ্যাঁ শুরু হয়েছিল NDR… আশ্চর্য, এই ভুলে যাওয়াটাই অস্বাভাবিক… রোবট তো আর মানুষ নয় যে ভুলে যাবে বেমালুম… আসলে মনে রাখার চেষ্টাই করেনি সে… তার ফলে নিত্যনতুন বিষয়ের ভারে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে সংখ্যাগুলো… সে কি আজকের কথা!
অ্যান্ড্রুর মনের মণিকোঠায় ছোট মামণি অক্ষয় অব্যয়। অ্যান্ড্রু নামকরণ ছোট মায়েরই কীর্তি। অ্যান্ড্রু… আন্ড্রু কী সুন্দর মিষ্টি নাম… নামের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ওর সব সত্তা… অস্তিত্ব… পরিচয়। কেন ডেকেছিল অ্যান্ড্রু বলে ছোট মামণি? সেকথা জেনেছিল অনেক পরে… ছোট মামণি তখন নিতান্তই শিশু… অক্ষর আর সংখ্যা সবই অর্থহীন… তার ফলেই মিষ্টি নাম করে ডেকে উঠেছিল ছোট মামণি… অ্যান্ড্রু।
নব্বুই বছর বেঁচেছিল ছোট মামণি… সেই ছোট মামণিই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে আজ কতদিন! কত বছর চলে গেছে তারপর! সেইসব ঝলমলে দিনের কথা কিছুতেই ভুলতে পারে না অ্যান্ড্রু।… একদিন নাম ধরে ডেকে উঠেছিল ছোট মামণিকে… অভিমানে থমথমিয়ে উঠেছিল ছোট মামণির মুখখানা… পুরো একদিন বাক্যালাপ করেনি অ্যান্ড্রুর সঙ্গে… তারপর… তারপর… পরের দিন ঠোঁট ফুলিয়ে প্রশ্ন করেছিল… আমি বুঝি আর মামণি নই তোমার? ছোট মামণি? কী হল? বলো… বলো অ্যান্ড্রু! ব্যস… দুর্যোগের ঘনঘটা উধাও হয়ে আবার রোদ-ঝলমলে আনন্দভরা নীলাকাশ…
ঘরের যাবতীয় কাজ ফাই-ফরমাশ খাটা এসবই ছিল অ্যান্ড্রুর কাজ… মাঝে মাঝে রান্নার কাজও চাপত তার ওপর। সেসব দিন ছিল অগ্নিপরীক্ষার মতো… কোন কাজ পারবে আর কোন কাজ পারবে না সে নিজেই জানত না। তবুও মার্টিন পরিবারে বেশ সুখেই শুরু হয়েছিল অ্যান্ড্রুর জীবন। সুখ! রোবটের সুখ। কিন্তু অ্যান্ড্রু রোবট হয়েও আরও যেন কিছু বেশি। তবে বেশির ভাগ সময় বাড়ির কাজ করতে হত না… মামণিদের সঙ্গে খেলা করতে করতেই দিন কেটে যেত ওর।
এক গুপ্ত রহস্য ধরা পড়েছিল বড় মামণির কাছে… অ্যান্ড্রুকে ইচ্ছেমতো কাজে লাগাবার সহজতম উপায়।
আমাদের সঙ্গে খেলতে হবে তোমাকে অ্যান্ড্রু এটা আমার আদেশ।
আমি দুঃখিত মামণি… তোমার আগেই আর একটা কাজের আদেশ করেছেন মার্টিন সাহেব… সুতরাং আগের আদেশ পালন করাই আমার কর্তব্য।
আবার ভুল করছ অ্যান্ড্রু… বাবা বলেছিলেন সময় থাকলে টেবিলটা পরিষ্কার করতে… এটা কি আদেশ? না… আদেশ নয়… আমি কিন্তু আদেশ করছি… হ্যাঁ, আদেশ করছি… জোর দিয়ে কথাগুলো বলেছিল বড় মামণি।
না, রাগ করতেন না মার্টিন সাহেব। সারা মুখে ফুটে উঠত অনাবিল হাসি। মামণি-অন্ত প্রাণ ছিল মার্টিন সাহেবের। আর অ্যান্ড্রু? সকলের কৌতুক আর খেলার সাথী। এই খেলা থেকেই গড়ে উঠেছিল বিচিত্র এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক… মমত্ববোধ… ভালোবাসা… তখন এসব পরিস্ফুট না হলেও এখন অ্যান্ড্রু বুঝতে পারে সব। মামণিদের সঙ্গে খেলার ছলেই একদিন ঘটেছিল এক ঘটনা… সেই ঘটনার পরই পালটে গেল অ্যান্ড্রুর জীবন।
দিদির পেন্ডেন্টের উপর দরুণ লোভ ছোট মামণির। হাতির দাঁতের উপর সোনার কাজ করা কী সুন্দর লকেট! বাবার কাছে অবদার করেও লাভ হয়নি কিছু। কিন্তু সুন্দর এক পেন্ডেন্ট না হলে যে দিনরাত সব বিস্বাদ ছোট মামণির। সুতরাং এক টুকরো কাঠ আর একটা ছুরি নিয়ে হাজির হয়েছিল অ্যান্ড্রুর কাছে। ছোট মামণির আবদার কি ফেলতে পারে… তৈরি হয়েছিল বিচিত্র এক পেন্ডেন্ট।
পেন্ডেন্ট হাতে নিয়ে আনন্দে এক পাক ঘুরে হাততালি দিয়ে উঠেছিল ছোট মামণি।
-কি দারুণ সুন্দর! সত্যি তুমি যে কী ভালো অ্যান্ড্রু! যাই, বাবাকে দেখিয়ে আনি আমি।
মার্টিন সাহেব বিশ্বাস করেননি প্রথমে। একের পর এক প্রশ্ন করেছিলেন ছোট মামণিকে। অ্যান্ড্রু বাদ যায়নি প্রশ্নের হাত থেকে।
-অ্যান্ড্রু, সত্যি কি এটা তোমার তৈরি?
-হ্যাঁ সাহেব।
-নকশাটাও তোমার? নিজের?
-হ্যাঁ… সবই আমার নিজের তৈরি।
-কোথায় পেলে নকশাটা অ্যান্ড্রু?
-বলছি তো… আমার নিজের নকশা…জ্যামিতির নানা রূপরেখার সমন্বয়… এর সঙ্গে মিলিয়েছি কাঠের নিজস্ব দাগ।
পরের দিন… ভোর হয়েছে সবেমাত্র… আলো আর অন্ধকারের দ্বন্দ্ব ঘোচেনি সম্পূর্ণ। এক টুকরো কাঠ হাতে নিয়ে অ্যান্ড্রুর ঘরে ঢুকেছিলেন মার্টিন সাহেব। বেশ বড় কাঠের টুকরো… সঙ্গে ছিল ইলেকট্রিক ভাইব্রো ছুরি।
-অ্যান্ড্রু… এই কাঠ আর ছুরি দিয়ে যাহোক কিছু বানাও তো দেখি… যে কোনোকিছু… তোমার পছন্দমতো।
সেই মুহূর্তে কাজ শুরু করেছিল অ্যান্ড্রু… নির্নিমেষে লক্ষ করেছিলেন সবকিছু মার্টিন সাহেব। কাজ শেষ হবার পর বিস্ময়ে হতবাক… শুধু কয়েকবার অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন অ্যান্ড্রুর দিকে। তারপর মাটিতে বসে ঘাড় গুঁজে কাজ করতে হয়নি আর। টেবিল-চেয়ার এসেছিল সঙ্গে সঙ্গে আর এসেছিল আসবাবপত্রের নকশার সব নানান বই… শুরু হয়েছিল এক নতুন… জীবন সুদৃশ্য ক্যাবিনেট আর ডেস্ক তৈরির কাজে মগ্ন হয়েছিল অ্যান্ড্রু।
এর কয়েকদিন পর অ্যান্ড্রুকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন মার্টিন সাহেব।
-শাবাশ অ্যান্ড্রু! শাবাশ! কীসব অপূর্ব জিনিস তৈরি করেছ তুমি! যেমন সুন্দর তেমনি অভিনব!
-তৈরি করার সময়ে আমারও দারুণ ভালো লেগেছিল।
-ভালো লেগেছিল? কী বলছ তুমি?
-হ্যাঁ স্যার। কেন জানি না এগুলো করার সময়ে সহজ-সরলভাবে কাজ করে ব্রেনের সুক্ষ সার্কিটগুলো… ছোট মামণির কাছ থেকে শুনেছিলাম ভালো লাগা কথাটা… দেখলাম আমার ব্রেনের প্রোগ্রামের সঙ্গে ভালোভাবে খাপ খেয়ে গেল কথাটা… ভালো লাগা কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল… মনে হল যেন অনেক দ্রুত কাজ করছে আমার ব্রেন। কাজ করার ক্ষমতাও যেন বেড়ে গেছে বহুগুণ… আর… আর…
৩
আঞ্চলিক আইনসভার সদস্য বলে প্রধান রোবোসাইকোলজিস্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বেশি বেগ পেতে হল না মার্টিন সাহেবের। ইউনাইটেড স্টেটস রোবটস অ্যান্ড মেকানিকেল মেন-এর সদর দপ্তরেই ঘটল এই সাক্ষাৎ করতে বেশি বেগ পেতে হল না মার্টিন সাহেবের। ইউনাইটেড স্টেটস রোবটস অ্যান্ড মেকানিকেল মেন-এর সদর দপ্তরেই ঘটল এই সাক্ষাৎকার।
রোবোসাইকোলজিস্ট মেট্রন মানস্কি ধীরভাবে শুনেছিলেন সব কথা। মাঝে মাঝে কুঁচকে উঠেছিল ভ্রূজোড়া। অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকাচ্ছিলেন অ্যান্ড্রুর দিকে।
-মিঃ মার্টিন… সত্যি কথা বলতে কি রোবোটিক্স্ কোনো শিল্পকলা নয়… পুরো ব্যাপারটা হয়তো বোঝাতে পারব না ঠিকমতো… সূক্ষ্ম কঠিন গাণিতিক নিয়মে পরিচালিত পজিট্রনিক ব্রেনের গতিবিধি খুবই দুর্বোধ্য… জটিল… তবে সম্ভাব্য সমাধান করলেও কোনো শিল্পকলা করা সম্ভব নয় মোটেই। তা ছাড়া তিন আইনের বাইরে যাবার ক্ষমতা নেই রোবটের।… যাই হোক, পুরানো রোবট পালটে এক নতুন রোবট পাবেন। আর এইসব ব্যাপারের জন্য রীতিমতো দুঃখিত আমরা।
-না না মানস্কি… আপনি যা ভাবছেন তা নয় কিন্তু। রোবটের কোনো দোষের কথা বলছি না আমি… সব কাজই নিখুঁতভাবে করে অ্যান্ড্রু। আসল ব্যাপার কী জানেন… নিজের মন থেকে নানারকম সুন্দর সুন্দর নকশা খোদাই করেছে… এক নকশা দুবার হয়নি কখনো… ওর সমস্ত কাজই এক উন্নত শিল্পকলার নিদর্শন মানস্কি।
এক অবিশ্বাস্য বিস্ময় ফুটে উঠল রোবোসাইকোলজিস্টের চোখেমুখে। কয়েক মূহূর্ত চুপ করে থেকে বলে উঠলেন। আশ্চর্য! এটা সম্ভব কী করে… সব রোবটেরই পজিট্রনিক ব্রেনের গতিবিধি তো একই নিয়মাবলির মধ্যে বাঁধা… বাস্তবিক সৃজনমূলক শিল্পকলা? ভালো করে পরীক্ষা করে বলছেন তো মিঃ মার্টিন?”
এবার না হেসে থাকতে পারলেন না জিরাল্ড মার্টিন।
-আমার কথায় বিশ্বাস হচ্ছে না তো? তবে আপনিই দেখুন নিজের চোখে… এক টুকরো কাঠ তুলে দিলেন মানস্কির হাতে। কাঠের ফলকটা চোখের সামনে মেলে ধরলেন রোবোসাইকোলজিস্ট। খোদাই করা এক খেলার মাঠ… খুদে খুদে ছেলেমেয়েরা বল খেলছে মনের আনন্দে… ক্ষুদ্রকায় হলেও সৌষ্ঠবে নিখুঁত দেহগুলো… সুন্দর স্বাভাবিক!
-ঐ ঐ… রোবট করেছে বলছেন! এ এক অঘটন ছাড়া আর কিছু নয় মিঃ মার্টিন। পজিট্রনিকের গতিপথের হেরফের হয়েছে নিশ্চয় কোথাও।
-আচ্ছা মানস্কি… ঠিক এমনই এক সৃজনীশক্তিসম্পন্ন রোবট তৈরি করতে পারেন আপনি?
– না না… অসম্ভব! বুঝতেই পারছি না কেমন করে ঘটল এমনটা!
-যাক, ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই…অ্যান্ড্রুই এক… একমেবাদ্বিতীয়ম! চলো অ্যান্ড্রু… বাড়ি চলো।
৪
ছোট মামণি আর ছোট মামণি! অ্যান্ড্রুর জগৎ জুড়ে শুধু ছোট মামণি। ছোট মামণির আবদারের ফলেই অ্যান্ড্রু যেন শাপমুক্ত হল রোবটের জগৎ থেকে। এখন সে এক বিশেষ রোবট। শিল্পী রোবট।
প্রথম প্রথম অ্যান্ড্রুর হাতের কাজ সব বিনামূল্যে বিলিয়ে দিয়েছিলেন মার্টিন সাহেব। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনেরাও খুশি হয়েছিল বিনামূল্যের উপহারে। কিন্তু আপত্তি জানাল ছোট মামণি।
-বাবা… এ তুমি ঠিক করছ না। নাইবা তোমার খরচা লাগল কিন্তু অ্যান্ড্রুর পরিশ্রমের কি মূল্য নেই কিছু? না না… এভাবে চলবে না। দাম না নিয়ে আর দেওয়া নয় কোনো কিছু… দাম দিলেই কি এমন সুন্দর জিনিস পাওয়া যায়?
-ছোট মামণি… এত লোভ ভালো নয় কিন্তু।
-না না বাবা… লোভের কোনো ব্যাপারই নয় এটা… বিক্রি বাবদ কোনো টাকাই নেব না আমরা… এ তো শিল্পীর টাকা… অ্যান্ড্রুর টাকা।
শিল্পী! এই শব্দ সম্পূর্ণ নতুন অ্যান্ড্রুর কাছে। নানানভাবে শব্দটাকে উচ্চারণ করেও অর্থোদ্ধার করতে পারল না সে। সবার অলক্ষ্যে অভিধানের মাধ্যমেই মালুম হল সে এক শিল্পী। আর ঠিক সেই দিনই মার্টিন সাহেবের সঙ্গে অ্যান্ড্রুকে যেতে হল অনেক দূরে… উকিলের অফিসে।
জন ফেইনগোল্ডের বয়েস হয়েছে বেশ। ধবধবে সাদা মাথার চুল… চিবুকের মাংস ঝুলে পড়েছে নিচে… মোটাসোটা নাদুসনুদুস। হাসলে বিশেষ এক ছন্দে কেঁপে ওঠে সর্বাঙ্গ।
-জন, এ সম্বন্ধে তোমার মত কী বলো তো?
উত্তর না দিয়ে কাঠের ফলকগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছিলেন ফেইনগোল্ড। চোখে- মুখে গভীর বিস্ময়।
-অপূর্ব! দারুণ সুন্দর! এ কি তোমার রোবটের কীর্তি? এই কি সেই রোবট মার্টিন?
-হ্যাঁ জন… এই হল অ্যান্ড্রু… নামকরণ করেছে আমার ছোটো মামণি… এসব ওরই কাজ… তা-ই না অ্যান্ড্রু?
-হ্যাঁ স্যার… এসব আমারই তৈরি… সসম্ভ্রমে বলল অ্যান্ড্রু।
-জন… এই শিল্পকলাগুলোর দাম কত হতে পারে বলে মনে হয় তোমার?
-দ্যাখো মার্টিন… আইনের মারপ্যাঁচ বোঝাই আমার কাজ… শিল্পকলা ভালো লাগলেও দাম সম্বন্ধে একেবারেই অজ্ঞ… তবে হ্যাঁ… নকশাগুলো দারুণ সুন্দর…
-তা হলে বলি শোনো… আড়াইশো ডলার দিয়ে কিনতে চেয়েছেন এই ফলকটা এক ভদ্রলোক… পাঁচশো ডলারে বিক্রি করেছি ওর তৈরি চেয়ারগুলো… এ পর্যন্ত মোট দু হাজার ডলার জমা দিয়েছি ব্যাঙ্কে… এসব অ্যান্ড্রুর জন্যেই সম্ভব হয়েছে জন।
-বলছ কী তুমি মার্টিন! অ্যান্ড্রু যে তোমাকে রাজা করে তুলেছে হে!
-হ্যাঁ, তা বলতে পার… তবে মোট ডলারের অর্ধেক আবার অ্যান্ড্রুর নামে জমা করে দিয়েছি জন।
-কি বললে? অ্যান্ড্রুর নামে? রোবটের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট!
-হ্যাঁ জন… একটা অ্যাকাউন্ট খুলেছি অ্যান্ড্রুর নামে… আর এই ব্যাপারটা কতটা আইনসিদ্ধ সেটা জানতেই আসা তোমার কাছে।
-আইনসিদ্ধ!! ফেইনগোল্ড রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিয়ে মার্টিন সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। মার্টিনের মাথা ঠিক আছে তো? সন্দেহ হল একবার।
-মার্টিন… না… এমন কোনো নজির নেই… আচ্ছা… ব্যাঙ্কের কাগজে কেমন করে সই করবে রোবট?
-কেন? নিজের নাম সই করতে পারে অ্যান্ড্রু… বাড়িতেই সই করিয়ে নিয়েছিলাম ব্যাংকের কাগজে… ইচ্ছে করেই ব্যাঙ্কে নিয়ে যাইনি ওকে। এরপর তুমি কী বলবে জন?
কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ। পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে অ্যান্ড্রু… কথার কোনো অর্থই ঢুকছে না ওর মাথায়। চোখ বুজে চিন্তায় মগ্ন ফেইনগোল্ড।
-মার্টিন… একটা ট্রাস্ট তৈরি করা যায় অ্যান্ড্রুর নামে অ্যান্ড্রুর ব’কলমে ট্রাস্টিরাই টাকার লেনদেন করবে… তা নয় তো বেআইনি বলে চিৎকার করে উঠবে পৃথিবীর সবাই… ঈর্ষাকাতর আমরা সবাই… তাই ট্রাস্টিই হবে অ্যান্ড্রু আর আমাদের মাঝে ইনসুলেশন। আমার মতে এটাই করা উচিত তোমার… আর যদি আপত্তি করে কেউ কোর্ট তো খোলাই আছে… আমার সঙ্গে বোঝাপড়া হবে তখন।
-বেশ! আশ্বস্ত হলাম জন… যাক এবার বলো তো কী ফিস দেব তোমাকে?
-হ্যাঁ মার্টিন… বেশ ভালো ফিস দিতে হবে কিন্তু তোমাকে… বড় জটিল অ্যাডভাইস।
-বেশ তো… তুমিই বলো কী দেব।
-দেবে তো?
-হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। বলো তুমি…
-খোদাই করা কাঠের ফলকটা দাও আমাকে… এটাই আমার ফিস!!
৫
মহাকালের ছোঁয়াচ লাগে অ্যান্ড্রুর ইস্পাতের শরীরে… আধুনিক রোবটের কাছে নেহাতই জবরজং আদ্যিকালের বদ্যি বুড়ো… দেহ পালটানোর প্রয়োজন একান্ত… হলও তা-ই… নিজের জমানো টাকাতে নবকলেবর লাভ করল অ্যান্ড্রু।
প্রথমে অবশ্য মত দেননি মার্টিন সাহেব। কিন্তু অ্যান্ড্রুর যুক্তিতর্কের কাছে খড়কুটোর মতো ভেসে গেল অমতের বেড়াজাল। তবে দেহ পালটালেও অটুট রইল পজিট্রনিক ব্রেনের গতিপথ।
-অ্যান্ড্রু, তোমার সঙ্গে কোনো তুলনাই চলে না আজকের রোবটের… পজিট্রনিক ব্রেনের গতিপথ নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে আজকাল… অর্থাৎ বিশেষ কাজ ছাড়া নতুন কিছু করার কোনো ক্ষমতাই নেই আজকের রোবটের… না অ্যান্ড্রু না… তোমার কোনো তুলনাই হয় না… অ্যান্ড্রুর পাশে দাঁড়িয়ে একদিন বলেছিলেন মার্টিন সাহেব।
-ধন্যবাদ স্যার।
-না না ধন্যবাদের কথা নয়… সত্যি এক নজিরবিহীন সৃষ্টি তুমি। সেইজন্যই আমার ভয় ছিল যে তোমার পজিট্রনিক ব্রেনের গতিপথ বোধহয় খোলা রাখবে না মানস্কি… ওর চোখমুখের ভঙ্গি দেখে বুঝতে দেরি হয়নি আমার… তোমার অসীম সম্ভাবনা একেবারেই পছন্দ নয় ওর। কতবার পরীক্ষা করতে চেয়েছিল… আমি রাজি হইনি একেবারে… বারেবারে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। তাই মনস্কির অবসর নেবার পরই সম্ভব হল তোমার দেহ পালটানো…
-সাহেবের বাঁধভাঙা সন্তানস্নেহ অঝোরধারায় বর্ষিত হয় অ্যান্ড্রুর উপর। ভালোবাসার নিবিড় আকর্ষণে এক অনাবিল আনন্দ অনুভব করে সে। বয়সের ভারে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে মার্টিন সাহেবের দীর্ঘদেহ। হালকা হয়ে এসেছে মাথার চুল… ঈষৎ ধূসর বর্ণ… বলিরেখা সমাকীর্ণ সমস্ত মুখমণ্ডল… সাহেবের পাশে অ্যান্ড্রু ঝকঝকে তকতকে… বলিষ্ঠ কর্মঠ।
পরিবর্তন শুধু অ্যান্ড্রু বা মার্টিন সাহেবরই হয়নি। পরিবর্তনের জোয়ারে গা ভাসিয়েছে পুরো মার্টিন পরিবার। শ্রীমতী মার্টিন ইউরোপেই থাকেন বেশি সময়… শিল্পকলা বিষয়ে কীসব যেন গড়ে তুলেছেন নানান জায়গায়। বড় মামণি এখন নামকরা কবি… নিউইয়র্কের স্থায়ী বাসিন্দা। বিয়ে হয়েছে ছোট মামণির… বেশি দূরে নয়… কাছেই বাড়ি ওদের। অ্যান্ড্রুকে ছেড়ে দূরে থাকা পছন্দ করে না ছোট মামণি। এরপর খুদে মালিকের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ করার ভার পড়েছিল ওর উপর… দুধের বোতল ধরা থেকে মায় ঘুম পাড়ানো পর্যন্ত।
ঠিক এমন এক দিনে সামান্য এক অনুরোধ নিয়ে মার্টিন সাহেবের সামনে হাজির হল অ্যান্ড্রু।
-স্যার আপনার দয়াতেই ইচ্ছেমতো টাকা খরচ করি আমি, তাই…
-দয়া? আমার দয়া কেন? এ তো তোমার রোজগারের টাকা অ্যান্ড্রু।
-যাই বলুন না কেন… এ তো আপনার স্বেচ্ছাকৃত দান… সব টাকা নিজের কাছে রেখে দিলেও আইনের চোখে অন্যায় হত না আপনার। আইনে না থাকা সত্ত্বেও আপনার বদান্যতার কোনো তুলনা হয় না।
-অ্যান্ড্রু… আইন কখনোই আমাকে অন্যায় করতে বাধ্য করতে পারে না… আর পারে না বলেই…
-স্যার সমস্ত খরচ- খরচা বাদ দিয়ে আমার প্রায় ছয় লাখ ডলার জমেছে… তাই বলছিলাম…
-আমাকে নতুন করে আর বলতে হবে না অ্যান্ড্রু… সমস্তই তো আমার জানা।
-আপনি তো জানবেনই স্যার। তাই বলছিলাম… আমার সমস্ত সঞ্চয় আপনাকে দিতে চাই…
-আমাকে? না না… তা হয় না… তা হয় না।
-স্যার শুধু শুধু নিতে বলছি না… টাকার পরিবর্তে আমার সামান্য এক প্রার্থনা আছে আপনার কাছে সামান্য এক ভিক্ষা…
-কী… কী বলতে চাইছ অ্যান্ড্রু? প্রার্থনা, ভিক্ষা এসব কী বলছ তুমি! বলো… কী দেয় আছে আমার।
আমার স্বাধীনতা দিন স্যার।
-তোমার… স্বাধীনতা… মানে…
-হ্যাঁ স্যার… আমার সবকিছুর বিনিময়ে শুধু স্বাধীনতা চাই আমি… কেবলমাত্র স্বাধীনতা!
৬
স্বা-ধী-ন-তা। সামান্য চারটে অক্ষরের মধ্যে কী বিপুল শক্তি নিহিত আছে কে জানে! যুগে যুগে দেশে দেশে স্বাধীনতার জন্যেই যত অশান্তি মারামারি হানাহানি। আর সেই স্বাধীনতাই কিনতে চাইছে অ্যান্ড্রু স্বোপার্জিত সমস্ত অর্থের বিনিময়ে!
মূহূর্তের মধ্যে লাল হয়ে উঠল চোখমুখ।
-অসম্ভব! অবাস্তব! এই দুটিমাত্র শব্দ উচ্চারণ করে খুদে মালিককে কোলে নিয়ে লাইব্রেরিঘরে ঢুকে পড়লেন দ্রুতপায়ে। দুঃখবোধের অনুভূতি নেই রোবটের… তা সত্ত্বেও চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইল অ্যান্ড্রু।
এক অসাধারণ মনের পরিচয় দিয়ে দিল মামণি সেই সময়ে। বিবাদমান দুই রাষ্ট্রের মধ্যে দূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ। বারেবারে বোঝাতে হয়েছে মার্টিন সাহেবকে। গত তিরিশ বছর ধরে নিঃসঙ্কোচে সবকিছু আলোচনা চলছে অ্যান্ড্রুর সামনে… কোনো বাধা বা দ্বিধা হয়নি কারুর… কারণ অ্যান্ড্রু তো রোবট। যন্ত্র! যন্ত্রের কাছে আবার সংকোচ কী।
-বাপি, মিছিমিছি তুমি রাগ করছ… ব্যক্তিগত মান-সম্মানের প্রশ্ন তুলছ… এটা কেন বুঝছ না যে গত তিরিশ বছর ধরে আমাদেরই কাজ করছে অ্যান্ড্রু… এখানেই আছে… আমাদের ছাড়া কাউকেও জানে না… ভবিষ্যতেও এর কোনো পরিবর্তন হবে না… হাওয়া সম্ভব নয়… তিন আইন আর আনুগত্যের অঙ্গীকার নিয়েই তো তৈরি হয় রোবট। হ্যাঁ এটা অনস্বীকার্য যে রোবটের জগতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র অ্যান্ড্রু… আর এই স্বতন্ত্র্যই স্বাধীনতাকামী করে তুলেছে ওকে। বাপি, আমাদের স্বাধীনতার সঙ্গে অ্যান্ড্রুর স্বাধীনতার তফাৎ আছে অনেক। অ্যান্ড্রুর স্বাধীনতা নেহাত সান্ত্বনা মাত্র…কেবলমাত্র স্বীকৃতি…সবাই বলবে মুক্ত স্বাধীন রোবট- এইটুকু মাত্র। এই সামান্য অধিকার দিলে কী এমন ক্ষতি হবে আমাদের? বলো তো বাপি, কার জন্যে রোজগার করে অ্যান্ড্রু? সে সবই তো আমাদের জন্যে। আমরাই ভোগ করছি সব। এই ব্যাপার নিয়ে গত এক বছর ধরে কথা বলেছি আমরা।
-এক বছর ধরে? তুমি সব জানতে মামণি? কই, আমাকে তো বলনি এতদিন!মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন মার্টিন সাহেব।
-ইচ্ছে করেই বলিনিতোমাকে বাপি। আরও আগেই বলা উচিত ছিল অ্যান্ড্রুর। কিন্তু ভয় পেয়েছে সে প্রতিবারেই। প্রতিবারেই ম্ন একরেছে মনে আঘাত পাবে তুমি। আর সেইজন্যেই পিছিয়ে গেছে সে দিনের পর দিন। এবার… এবার আমিই ওকে পাঠিয়েছি তোমার কাছে বাপি।
গুম হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ মিঃ মার্টিন।
-কিন্তু মামণি, স্বাধীনতার কোনো অর্থ কি বোঝে অ্যান্ড্রু? অ্যান্ড্রুকে আমরা যতই ভালোবাসি, শিল্পকলার তারিফ করি, একটা কোথা ভুললে চলবে না মামণি…অ্যান্ড্রু মানুষ নয়…রোবট…আামাদের হাতে তৈরি এক যন্ত্র মাত্র।
-বাপি…য়াবার ভুল করছ। অ্যান্ড্রুকে এখনও জান না তুমি। তোমার লাইব্রেরির যাবতীয় বই পড়েছে অ্যান্ড্রু…নানা বই পড়ার ফলেই বিরাট আলোড়ণ দেখা দিয়েছে প্রাণহীন যন্ত্রের মধ্যে…আমরা হয়ত সঠিক বুঝতে পারব না এসব…পজিট্রনিক ব্রেনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে চিন্তার বীজ… একবার যদি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কোথা বল… তবে বুঝবে কীরকম অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে ওর চোখের দৃষ্টিতে। নানান ভাবের বিচ্ছুরণ ঘটে ওর চোখের আলোয়…তাই বলি বাপি…ওন্যসব রোবটেরমতো ভেব না অ্যান্ড্রুকে…রোবট হয়েও রোবট নয়… হয়তো বা…
-বাঃ! দারুণ বক্তৃতা করতে শিখেছ তো মামণি…নিখুঁত পার্লামেন্টারিয়ান। শোনো মা…দেশের আইনকে তো অস্বীকার করা যায় না…দেশের আইনের চোখে রোবটছাড়া আর কিছু নয় অ্যান্ড্রু…য়ামাকেও আইন মেনে চলতে হয়…সেইজন্যেই তোমার কোথা মানা সম্ভব নয় মা…যাক এবার অ্যান্ড্রুকে ডাকো একবার…
অ্যান্ড্রু ঘরে ঢোকার সঙ্গেসঙ্গেই সমস্ত চেহারা যেন পালটে গেল মার্টিন সাহেবের। গম্ভীরভাবে ওর আপাদমস্তক দেখলেন বারকয়েক।
অ্যান্ড্র…তোমার স্বাধীনতা…মুক্তি অর্থহীন আমার কাছে…তাই দেওয়া না দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না…বই পড়ে পড়ে মাথা বিগড়ে গেছে তোমার…তোমার মুক্তির কোথা স্বীকার করে না আইন…মুক্তি! স্বাধীনতা! কথা বলতে শিখে খোয়াব দেখা আর বাস্তব জীবনে প্রয়োগের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক, কোর্টে গেলে একূল ওকূল দুকূলই যাবে তোমার…স্বাধীনতা তো পাবেই না…উলটে ব্যাংকে রাখা তোমার নামে টাকা সব বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। কোর্ট কী বলবে জান অ্যান্ড্রু?…বলবে টাকা রোজগারের কোন অধিকার নেই রোবটের। রোবট রোবটই… মানুষ নয়…মানুষের তৈরি এক যন্ত্রবিশেষ। বেশি বাড়াবাড়ি না করে যা সয় বসে তা-ই করো।
বিস্ময়ে স্তম্ভিত ছোটো মামণি। ঠিক আপনবাপি যেন বাপি নয় আর…বিজ্ঞান-সভ্যতা বলে বলীয়ান দাম্ভিক এক মানুষ। মধ্যযুগীয় কুৎসিত দাসপ্রথা যেন উঁকি মারছে যান্ত্রি সভ্যতার ফাঁক-ফোকর দিয়ে।
-স্যার… আপনার কোথা সব ঠিক… আমি রোবট…যন্ত্র…মানুষের হাতেই জন্ম আমার। কিন্তু সেটাই কি আমার অপরাধ? অন্য রোবট থেকে কি আলাদা নই আমি? আর যদি আপনাদের স্বাধীনতা চাই তা হলে…তা হলে… স্যার… স্বাধীনতা অমূল্য… জীবনের চেয়েও অমূল্য স্বাধীনতা…তাই শুধুমাত্র স্বাধীনতা…মুক্তি দিন আমাকে।
৭
আইন… কার আইন… কীসের আইন… সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নিয়ম-কানুনই আইন… মানতে বাধ্য সংখ্যালঘিষ্ট আপামর জনসাধারণ-আর সেই আইনকে কার্যকর করার জন্যেই রয়েছে কোর্ট। অবশেষে সেই কোর্টেরই দ্বারস্থ হল অ্যান্ড্রু স্বাধীনতা আদায়ের জন্যে।
লোকে থিকথিক করছে কোর্টঘর। লোক হওয়াই স্বাভাবিক… রীতিমত অভিনব কেস। সরকারপক্ষের অ্যাটর্নি নানান বইপত্রের নজির টেনে পাকা রাজনীতিবিদ্দের মতো টেবিল চাপড়ে লম্বা এক বক্তৃতা করে বসলেন… মামলাটা শুধু অমূলক নয়…পাগলামিও বটে। মানুষ ছাড়া স্বাধীনতার কোনো অর্থই হয় না… রোবটের স্বাধীনতা রীতিমতো হাস্যকর। নৈব নৈব চ। একমাত্র মানুষ… মানুষই স্বাধীনতার যোগ্য।
একবার নয়-বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে…নানান ভঙ্গীতে একই কোথা বলে জজ সাহেব্র মন ভোলাবার চেষ্টা করলেন অ্যাটর্নি।
চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে ছিল ছোট মামণি। পাশেই ভাবলেশহীন মুখে দাঁড়িয়ে অ্যান্ড্রু। অ্যান্ড্রুর মতোই নির্বাক কৌতূহলী জনসাধারণ।
অ্যান্ড্রুর পক্ষে সওয়াল করবার জন্যে জজসাহেবের অনুমতি চাইল ছোট মামণি…
-অনেক… অনেক ধন্যবাদ মহামান্য আদালত। আমি আইনজ্ঞ নই…কথার জাল বুনে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করা আমার কাজ নয়…করিওনি কখনো…তার অ্যাটর্নি সাহেবের মতো কথার ফুলঝুরির মাধ্যমে দিনকে রাত করতে পারব না আমি-তবে সহজ কথা সরলভাবে বলার চেষ্টা করব মাত্র। আমার বিশ্বাস মহামান্য আদালত নিশ্চয় আমার কথার অন্তর্নিহিত বক্তব্য বুঝতে পারবেন- শুধুমাত্র কথার আক্ষরিক অর্থ নিয়ে ভুল বুঝবেন না যেন।
এবার আসি আসল কথায়… অ্যান্ড্রুর ক্ষেত্রে স্বাধীনতার অর্থ কী? সমস্ত দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে যে বর্তমানে… মানে এখনও অ্যান্ড্রু স্বাধীন… যতদূর মনে হয় বিগত কুড়ি বছরের মধ্যে আদেশ করেনি কেউ ওকে… না মার্টিন পরিবারের কেউ না… আদেশ করতে, হুকুম করতে কেমন যেন দ্বিধা হয় আমাদের… কারণ অ্যান্ড্রু তো আজ্ঞাবাহী রোবট নয়… অ্যান্ড্রু অনন্যসাধারন… স্বতন্ত্র… সৃজনীশক্তি সম্পন্ন বিস্ময়কর!
অথচ আমরা তো জানতাম যে হুকুম করলেই হুকুম তামিল করতে বাধ্য অ্যান্ড্রু… কারণ অ্যান্ড্রু রোবট… তিন আইনের বন্দি। অথচ সৃজনীশিল্পের মাধ্যমেই রোবট অ্যান্ড্রু প্রমাণ করল যে রোবট হয়েও সে সম্পূর্ণ পৃথক… অনন্যসাধারন। সেই থেকেই হুকুম করা বন্ধ হয়ে গেল একেবারে। অথচ হুকুম না করলেও… আদেশ না করলেও কী অবিশ্বাস্য বিশ্বস্ততার আর সেবার মনোভাব নিয়ে দায়িত্বপূর্ণ কাজ করে চলেছে অ্যান্ড্রু। রোজগার করছে আমাদের জন্যে… হ্যাঁ… আমি বলছি… প্রচুর প্রচুর অর্থ উপার্জন করে বড়োলোক করে তুলেছে আমাদের। প্রতিদানে সে কিছুই চায়নি নিজের জন্যে…
এবারের প্রশ্ন… এর পরেও কি স্বাধীনতার মূল্য আছে অ্যান্ড্রুর কাছে? ঠিক কথা… বাস্তবে হয়তো সত্যি কোনো মূল্য নেই… কিন্তু এই স্বাধীনতা কথাটাই দারুণ মূল্যবান ওর কাছে… আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে মূল্যহীন নিরর্থক ওর স্বাধীনতা… অথচ স্বাধীনতার স্বীকৃতিটুকুই অমূল্য… একান্ত কাম্য ওর। অন্যভাবে বলা যায়… স্বীকৃতিটুকুই একান্ত ইপ্সিত অথচ আমাদের কোনো ক্ষতি নেই এই স্বীকৃতিদানে।
হাসির রেশ দেখা দিল জজ সাহেবের মুখে… কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন- আপনার বক্তব্য শুনলাম মিসেস চারনেল। আসল কথা হল এখনও পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনো আইন অথবা অতীতের কোনো নজির নেই আমাদের কাছে। আমরা জানি যে মানুষেরই একমাত্র অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ স্বাধীনতার সঙ্গে… মানুষই স্বাধীন হতে চায়… স্বাধীনতা লাভও করে। এই ধারাই চলে এসেছে আদি অনন্তকাল ধরে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আপনার বক্তব্য রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে আমাদের। নতুন কোনো আইন প্রণয়ন করলে উচ্চ আদালতে নাকচ হয়ে যাবার সম্ভাবনাই প্রবল। এই অবস্থায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসার আগে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই আপনার রোবট… অ্যান্ড্রুকে।
… অ্যান্ড্রু।
-বলুন ধর্মাবতার!
কোর্ট চলাকালীন এই প্রথম কথা বলল অ্যান্ড্রু… রোবটের কন্ঠে মানবিক স্বর শুনে অবাক জজ সাহেব।
-মুক্তি… স্বাধীনতা চাইছ কেন অ্যান্ড্রু? কী কাজে লাগবে বলো তো এই স্বাধীনতা?
-ধর্মাবতার… তা হলে দাস হয়ে থাকতে বলেন কি আপনি? দাসত্ব থেকে মুক্তি চাওয়া কি এতই মূল্যহীন… অন্যায় আপনার কাছে?
প্রশ্নের তীক্ষ্ণতায় বাক্যহারা জজ সাহেব। সামান্য রোবটের কাছে এমন প্রশ্ন স্বপ্নেরও অগোচর। কিন্তু… দাস তো নও তুমি। তুমি তো এক অনন্যসাধারন রোবট — তোমার সৃজনী-শক্তি শুধু অতুলনীয় নয় — আমাদেরও ভাবিয়ে তোলে রীতিমতো। এই অবস্থায় স্বাধীন হয়ে আর কী বেশি করবে অ্যান্ড্রু?
-হয়তো অনুমান আপনার সত্যি হবে… হয়তো এর চেয়ে বেশি কিছু করতে পারব না… কিন্তু যা করব আরও আনন্দের সঙ্গে করব নিশ্চয়… এর ফলে আরও উন্নত হয়ে উঠবে আমার সৃজনীশক্তি। ধর্মাবতার… এইমাত্র আপনি বললেন যে মানুষ স্বাধীন হতে পারে… তার অর্থ কি এই নয় যে স্বাধীন হতে ইচ্ছুক যে-কেউ স্বাধীন হবার যোগ্য… স্বাধীনতা লাভ করতে পারে? সেইজন্যে আমার ঐকান্তিক ইচ্ছা স্বাধীনতা… স্বাধীন হওয়াই একমাত্র কাম্য ধর্মাবতার।
স্তম্ভিত সারা আদালত। স্বয়ং ধর্মাবতার বিচলিত। এরপরেই ঘোষিত হল এক ঐতিহাসিক রায়। অভিনবত্বে এবং গুরুত্বে চিরস্মরণীয়।
বিদ্যা জ্ঞান যুক্তি সম্বলিত আধুনিক মনের অধিকারী বর্তমান রাষ্ট্র সমাজব্যবস্থায় বিশ্বাসী কাউকেই স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করার কোনো অধিকার নেই আমাদের। সুতরাং আজ থেকে অ্যান্ড্রু স্বাধীন… স্বাধীন রোবট!!
৮
চিররহস্যাবৃত মানবমন। স্বাধীনতা স্বাধীনতা বলে চিৎকার করলেও… নীতিগর্ভ বড় বড় বই লিখলেও… সমাজব্যাবস্থায় আধুনিক হলেও মানবমনের গহন অরণ্যের নিভৃত প্রান্ত গাঢ় তমসায় আচ্ছন্ন… জ্ঞানলোকের রেশ নেই কোনোখানে। স্যার জিরাল্ড মার্টিনের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হল না। আদালতের রায়ে অ্যান্ড্রুর স্বাধীনতা বিরক্তিতে ভরিয়ে তুলল মার্টিন সাহেবকে… কথাবার্তা আচার-আচরণে বহিঃপ্রকাশ ঘটে ঐ মনোভাবের। অ্যান্ড্রুর সঙ্গে কথা বলার সময় কর্কশ হয়ে ওঠে কন্ঠস্বর। অ্যান্ড্রুর বুঝতে বাকি থাকে না কিছু… প্রচণ্ড অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত মার্টিন সাহেবের মন… নিরুপায় অ্যান্ড্রু।
-থাক… থাক, অনেক টাকার গরম দেখিয়েছ তুমি একটা পয়সাও চাই না তোমার। … শোনো অ্যান্ড্রু, আজ থেকে তুমি তোমার পছন্দমতো কাজ করবে… কাজের সময়ও ঠিক করবে তুমি… আজ থেকে আমার কিছু করতে হবে না তোমাকে… অবশ্য আদালতের রায় অনুযায়ী এখনও আমি তোমার ভালোমন্দের জন্য দায়ী… কিন্তু তাই বলে…
এবার বাধা দিল ছোট মামণি।
-একেবারে ছেলেমানুষের মতো কথা বলছ বাপি… দায়ী থাকা বিরাট কিছু নয় একটা… তুমি তো ভালো করেই জান বিশেষ কিছু করার নেই তোমার… রোবটের তিন আইন চালু আছে এখনও… অ্যান্ড্রুও মানতে বাধ্য সে-আইন।
-তা হলে স্বাধীন হল কী করে?
-স্যার, মানুষও তো নানান আইন-কানুনে বাঁধা… আর সেই আইন কানুন মেনে নিয়ে মানুষ স্বাধীন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে উত্তর দিল অ্যান্ড্রু।
-না, তোমার সঙ্গে কথা বলা নিরর্থক… স্বাধীন তো হয়েছ… স্বাধীনতার দায়-দায়িত্বও বেড়ে যায় অনেকখানি… আশা করি সে সব স্মরণে থাকবে তোমার!
এরপরে মার্টিন সাহেবের সঙ্গে দেখা খুব কমই হতো অ্যান্ড্রুর দেখা হলেও প্রয়োজনীয় দু-একটি কথা ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক রইল না ওদের মধ্যে।
নিজেকে নানান কাজে ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করল অ্যান্ড্রু। নিত্যদিনের সঙ্গী ছোট মামণি… এমন দিন বাদ যায়নি যেদিন দেখা হয়নি ওদের দুজনের। ইতিমধ্যে একটি ছোট একতলা বাড়ি তৈরি হয়েছে অ্যান্ড্রুর নিজের জন্য… দুটোমাত্র ঘর- একটায় লাইব্রেরি, অন্যটায় কারখানা। কাজের চাপ বেড়ে চলে দিন-দিন। জলস্রোতের মতো টাকা জমে ব্যাঙ্কে। সেইসঙ্গে পরিশ্রমের মাত্রা বেড়ে যায় অনেকখানি।
একদিন সকালবেলায় ছোট দাদাবাবু এল অ্যান্ড্রুর বাড়ি। জর্জকে ঐ নামে ডাকে অ্যান্ড্রু।
-অ্যান্ড্রু… এখন তুমি স্বাধীন… স্বাধীন রোবট। ছোট দাদাবাবু বলে ডাকবে না কখনোই… আমি তোমাকে ডাকি নাম ধরে… তুমিও ডাকবে আমার নাম ধরে… বলবে জর্জ… কেমন?
অমত থাকলেও তিন আইনে বাঁধা অ্যান্ড্রু জর্জের আদেশ অমান্য করে কী করে? ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। ছোট দাদাবাবু হল জর্জ। কিন্তু ছোট মামণি? ছোট মামণিই রয়ে গেল চিরকাল।
এরপর এল সেই দিন। মৃত্যুশয্যায় জিরাল্ড ম্যার্টিন। শয্যার পাশে ছোট মামণি। দুচোখে অবিরল জলের ধারা। অ্যান্ড্রুকে খুজছেন মার্টিন সাহেব।
আগের মতো গম্ভীর কন্ঠস্বর। শয্যাশায়ী। মার্টিন সাহেব নড়াচড়ায় অক্ষম। বহুকষ্টে ডান হাত তুলে বললেন- অ্যান্ড্রু, অ্যান্ড্রু এসেছ… না না জর্জ, ধরতে হবে না আমাকে। সময় হয়ে এসেছে। কয়েকটা কথা শুধু বলতে দাও আমাকে। শোনো, শোনো অ্যান্ড্রু, আমি… আমি খুশি তোমার মুক্তিতে। বিশ্বাস করো, সত্যি খুশি হয়েছি… যাবার সময়ে এই কথাটা বলে না গেলে যে মরেও শান্তি পাব না আমি…
ঠিক এই অবস্থায় কী বলতে হয় করতে হয় জানে না অ্যান্ড্রু… মৃত্যু এক অভিনব অভিজ্ঞতা। অ্যান্ড্রুর জীবনে মৃত্যু এই প্রথম। বইয়ের মাধ্যমে মৃত্যুকে জেনেছে সে অনেকদিন আগে। রোবটের মতো দেহবদল করা অসম্ভব মানুষের পক্ষে। তাই মৃত্যু মানে মানবজীবনের পরিসমাপ্তি। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে অ্যান্ড্রু, নিশ্চল নিষ্কম্প…
৯
মার্টিন সাহেবের মৃত্যুর পর আর একটু পরিবর্তন হল। শার্টপ্যান্ট পরতে শুরু করল অ্যান্ড্রু। জর্জের পুরানো শার্টপ্যান্টে বিচিত্র দেখাল ওকে।
জর্জ এখন ব্যারিষ্টার। যোগ দিয়েছে ফেইনগোল্ড ফার্মে। বৃদ্ধ ফেইনগোল্ড দেহ রেখেছেন বহুদিন। মেয়েই দেখাশোনা করে সব… তবে একটু পরিবর্তন হয়েছে ফার্মের নামের ফেইনগোল্ড অ্যান্ড মার্টিন।
-আমি বুঝতে পারছি না প্যান্ট পরতে চাইছ কেন তুমি? কী সুন্দর তোমার দেহ! মসৃণ ঝকঝকে কর্মঠ। সেই সুন্দর দেহকে ঢাকতে চাইছ শার্টপ্যান্টে? আমরা তো প্রকৃতির হাত থেকে বাঁচবার জন্যেই জামাকাপড় পরি। কিন্তু তোমার বেলায় তো খাটে না সে-নিয়ম… যাক, এসব তো যুক্তিতর্কের ব্যাপার। আসল কথা হল ধাতুর শরীরে ঠিকমতো আটকায় না কাপড়জামা। অ্যান্ড্রুর পাশে বসে ধীরে ধীরে বলল জর্জ।
-জর্জ… মানবদেহ কি প্রকৃতির এক সৌষ্ঠবময় সুন্দর অবদান নয়? নগ্ন মানবদেহের প্রশস্তিতে মুখরিত শিল্পী কবি মহদ্জনেরা! বিজ্ঞান বলে আবহাওয়াও আজ মানুষের আয়ত্তাধীন। তা সত্ত্বেও কীসের প্রয়োজনে জামাকাপড় পর তোমরা?
এবার হেসে ফেলে জর্জ… অকাট্য যুক্তির কাছে হার মানে সে।
-যুক্তি তোমার ক্ষুরধার অ্যান্ড্রু… আয়ত্তাধীন হলেও তারতম্য আছে এখনও… সেই তারতম্যের হাত থেকে দেহকে রক্ষার জন্যেই প্রয়োজন কাপড়জামার… আবার অঙ্গের শ্রীবৃদ্ধির জন্যেও প্রয়োজন আছে এর। কিন্তু তোমার দেহ তো এসবের উর্ধ্বে।
-আসল কথা কী জান জর্জ… নিজেকে কেমন যেন উলঙ্গ বলে মনে হয় আমার। লজ্জা আর অস্বস্তি বোধ করি পাঁচজনের সামনে। মানসিক স্বস্তির জন্যেই জামাপ্যান্টের প্রয়োজন, জর্জ।
-অস্বস্তি? হাজার হাজার রোবট রয়েছে পৃথিবীতে… মানুষের প্রায় সমানসংখ্যক রোবট… তারা তো কেউ অস্বস্তি বোধ করে না অ্যান্ড্রু?
কয়েক মুহূর্ত জর্জের দিকে চেয়ে রইল অ্যান্ড্রু। দুই চোখে দপদপিয়ে উঠল কীসের এক দৃঢ় প্রত্যয়।
-জর্জ! ওরা তো কেউ স্বাধীন নয়!!
সারা মুখে হাসি ফুটে উঠল জর্জের। অ্যান্ড্রুকে জড়িয়ে ধরে আদর করল বারবার।
-যাক… কাজের কথায় আসি অ্যান্ড্রু… শেষ পর্যন্ত কথা দিতে হল মাকে, আইন সভার সদস্যপদে দাঁড়াব আমি… দাদুর মতো নাতিও হবে সুদক্ষ আইনপ্রশাসক।
-দাদুর মতো?
-হ্যাঁ, দাদুর মতো! আমি জর্জ… আমার দাদু তোমার স্যার জিরাল্ড মার্টিন… আইন সভায় বিশিষ্ট সদস্য।
-ওঃ, এবার বুঝলাম তোমাদের সম্পর্কগুলো। কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায় বড়। খুব ভালো জর্জ। আজ যদি স্যার – এই বলে থমকে দাঁড়াল অ্যান্ড্রু। বলতে যাচ্ছিল- যদি কর্মক্ষম থাকতেন… কিন্তু না। পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল রোবট অমর। খুব পুরানো হয়ে গেল পালটে নিলেই চলে। মানুষের বেলায় খাটে না এই নিয়ম।
-অ্যান্ড্রু, বলো স্যার যদি বেঁচে থাকতেন খুব খুশী হতেন।
মানুষের সম্বন্ধে কথা বলার সময়ে কেমন যেন আটকে যায় অ্যান্ড্রুর। যথার্থ প্রতিশব্দও খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেক সময়ে ছোট মামণি আর জর্জের অক্লান্ত পরিশ্রমে অনেক কিছুই জানতে পেরেছে এখন। তবুও জানার নেশায় পাগল অ্যান্ড্রু।
বাড়ির লাইব্রেরির বই শেষ হয়ে গেল একদিন। কিনে আর কত পড়া যায়। সরকারি লাইব্রেরিতে যাবার মনস্থ করল অবশেষে। স্বাধীন রোবটের অদম্য জিজ্ঞাসায়। তুচ্ছ হয়ে গেল জর্জের নিষেধ। অন্তরস্থ বৈদ্যুতিক ক্ষমতার সীমা বেড়ে যাচ্ছে অনেকখানি। এরপর এই শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটবে ইম্পিডেন্স কয়েলে। ফলে সৃজনীশক্তির বিকাশ ঘটবে উত্তরোত্তর।
একদিন শার্টপ্যান্ট টাই পরে লাইব্রেরির উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর থমকে দাঁড়াল অ্যান্ড্রু। অন্তরের বাধাই থামিয়ে দিল ওকে। সঙ্গে সঙ্গে সার্কিটের বাইরে বার করে দিল ইম্পিডেন্স কয়েল। কিন্তু না, কিছুই হল না। মনের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে বিদ্যুতবাহী সূক্ষ্ম স্নায়ুতন্ত্রে। ফলে ক্রমেই বাড়ছে রেজিস্টেন্স… অবশেষে বাড়ি ফিরে এল সে।
ডায়েরিতে লিখল- চেষ্টা করেও যেতে পারলাম না সরকারি পাঠাগারে। পাঠাগারে যেতে হবে আমাকে। যাবই যাব। ডায়েরিটা খুলে রাখল টেবিলের উপর। সংকল্পের সঙ্গে একাত্ম হতেই হবে ওকে।
১০
পাঠাগারের সঠিক রাস্তা জানে না অ্যান্ড্রু। ম্যাপ দেখে লিখে নিল পথের হদিশ। রাস্তায় বেরিয়ে মুশকিলে পড়ল। ম্যাপের রাস্তার ধারে ঘরবাড়ি নেই কোনো। অথচ বাস্তবে সম্পূর্ণ বিপরীত। মাঠের মাঝখানে এক চাষি-রোবটকে জিজ্ঞাসা করল অ্যান্ড্রু। না, পথের হদিশ মিলল না ওর কাছ থেকে।
সামনের পথ ধরে এগিয়ে গেল আরও কিছু দূর। দুজন মানুষকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল দূর থেকে। অনেক আশায় অ্যান্ড্রু এগিয়ে গেল সামনের দিকে। অ্যান্ড্রুকে আসতে দেখে গল্প বন্ধ করে থমকে দাঁড়ালো দু’বন্ধু।
-দেখুন, শহরের সরকারি পাঠাগারের পথটা কোনদিকে বলতে পারেন?
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বেঁটে মানুষকে জিজ্ঞাসা করল লম্বা মানুষ, এটা একটা রোবট না?
-হ্যাঁরে… রোবট বলেই তো মনে হচ্ছে। শার্টপ্যান্ট টাই পরেছে দ্যাখ মানুষের মতো।
-বুঝেছি বুঝেছি। নিশ্চয় সেই স্বাধীন রোবট। মার্টিনদের রোবট। কোর্টের অর্ডারে স্বাধীন হয়েছে… এখন ওর আর মালিক নেই কেউ। স্বাধীন হয়েছে বলেই কি মানুষের মতো শার্টপ্যান্ট পরবে নাকি? কালে কালে হল কী! অসহ্য… অসহ্য এ ধাষ্টামো! রাগ আর বিরক্তিতে ফেটে পড়ল লম্বা মানুষটি।
-তুমি কি মার্টিনদের রোবট? প্রশ্ন ছুড়ে দিল বেঁটে মানুষটি।
-আমিই অ্যান্ড্রু মার্টিন, স্যার। বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দিল অ্যান্ড্রু।
বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে গেল মানুষ দুটির চোখে।
-শুনে কৃতার্থ হলাম। যাক, জামাপ্যান্ট পরেছ কেন? খোলো, খুলে ফ্যালো জামাপ্যান্ট। কী কুৎসিত দেখাচ্ছে! ময়ূরপুচ্ছধারী কাক যেন!
একটু ইতস্তত করল অ্যান্ড্রু। বহুদিন হয়ে গেল হুকুমের সুরে কথা শোনেনি সে। কী কর্কশ কন্ঠস্বর! মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছে দ্বিতীয় আইনের সার্কিটটা।
-আমি বলছি খোলো, খুলে ফ্যালো জামাপ্যান্ট। আমি হুকুম করছি… চিৎকার করে বলল লম্বা মানুষটি।
এবার আর দ্বিধা নয়, সব পরিষ্কার। দুনম্বর আইনের কাছে নাতি স্বীকার করল স্বাধীন রোবট। জামাকাপড় খুলতে শুরু করল নিঃশব্দে।
-আচ্ছা, এর তো কোনো মালিক নেই। চল-না নিয়ে যাই আমরা… আমাদেরই রোবট হয়ে যাবে তা হলে!
-ভালো কথা বলেছিস তো! কেই-বা নিষেধ করবে আমাদের। আমরা তো ক্ষতি করছি না রোবটের। ঠিক আছে তাই হবে। তবে আগে একটু মজা করি। অ্যাই, অ্যাই আমার কথা শোনো, শীর্ষাসন করো এক্ষুনি। মাথা মাটিতে রেখে পা দুটো তুলে দাও শূন্যে… দাও… দাও…
-মাথা মানে তো– কিছু বলতে চাইল অ্যান্ড্রু।
-না না, কোনো কথা শুনতে চাই না। এটা আমার আদেশ… শীর্ষাসন না জানলে চেষ্টা করতে হবে। চেষ্টা করো। হ্যাঁ, হ্যাঁ করো করো।
মাটিতে মাথা লাগল আন্ড্রু। পা দুটো উপরে তোলার চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গে বিকৃত শব্দ করে কাত হয়ে পড়ে গেল সে মাটির ওপরে।
-ঠিক হয়েছে, পড়ে থাকো মাটিতে। আবার হুকুম করল লম্বা মানুষটি।
-অ্যাই শোন। চ’ খুলে ফেলি রোবটের দেহটা। নিয়ে যাবার সুবিধে হবে। আচ্ছা আচ্ছা দাঁড়া- রোবট তো নিজেই খুলতে পারে নিজের দেহকে?
-নিজে নিজের দেহটা খুলবে কেমন করে?
-দেখাই যাক-না খোলে কি না! বাধা দেবার তো কেউ নেই এখানে!
ওদের বাধা দেবার মতো শক্তি নেই অ্যান্ড্রুর। অনুগত্যের দু নম্বর ধারা আত্মরক্ষার তিন নম্বর ধারার উপর পূর্ববর্তী হওয়ার অধিকারে কর্তৃত্ব করছে। আসল কথা ওদের উপর আঘাত না হেনে আত্মরক্ষায় ব্যর্থ হল অ্যান্ড্রু। এর অর্থ এক নম্বর ধারা অমান্য করা। এই চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ল দেহস্থ প্রতিটি স্বয়ংবল অংশ। ফলে কেঁপে কেঁপে উঠল মাটিতে পড়ে থাকা অ্যান্ড্রুর দেহটা।
লম্বা মানুষটি কাছে এসে জুতো দিয়ে উলটে দিতে চেষ্টা করলো অ্যান্ড্রুকে।
-বাবাঃ, কী ভারী! পুরোনো জিনিস তো! আমার কী মনে হয় জানিস, খালি হাতে খোলা যাবে না। যন্ত্রপাতি চাই।
-একটা কাজ কর। ওকেই হুকুম কর নিজের দেহটাকে খোলার জন্যে। বেশ মজা হবে। নিজে খুলবে নিজের দেহ। মজার সুরে বলল বেঁটে মানুষটি।
-বেশ বলেছিস। তবে রাস্তা থেকে সরিয়ে মাঠের মধ্যে নিয়ে যাই চ’ ওকে। রাস্তার ওপরে দেখে ফেলতে পারে কেউ।
বাধা পড়ল ওদের পরিকল্পনায়। একজনকে হনহন করে এগিয়ে আসতে দেখা গেল এদিকে। জর্জ আসছিল রাস্তা দিয়ে। রাস্তার ওপর অ্যান্ড্রুকে শুয়ে থাকতে দেখে দ্রুতপায়ে এগিয়ে এল সে। জর্জকে দেখে ওঠার চেষ্টা করামাত্র ধমক খেল অ্যান্ড্রু।
-না, উঠবি না, শুয়ে থাক যেমন ছিলিস।
জর্জকে আসতে দেখে একটু সরে দাঁড়াল দুজন।
-অ্যান্ড্রু! অ্যান্ড্রু! কী হয়েছে তোমার? বিকল হয়ে গেছে নাকি কিছু? উদ্বেগের সুরে প্রশ্ন করল জর্জ।
-না জর্জ, সেসব কিছু নয়।
-মাটিতে কেন? উঠে দাঁড়াও, শার্টপ্যান্ট গেল কোথায়?
এবার কথা বলে উঠল লম্বা মানুষটি।
-এটা কি তোমার রোবট নাকি সোনার চাঁদ?
স্প্রিং-এর মতো চকিতে ঘুরে দাঁড়াল জর্জ। রাগে জ্বলে উঠল সর্বাঙ্গ।
-না, আমার নয়, কারুর নয়। কিন্তু এতক্ষণ কী হচ্ছিল এখানে?
-কই, কিছু হয়নি তো, শার্টপ্যান্ট পরে বিচ্ছিরি দেখাচ্ছিল, তাই বললাম খুলে ফেলতে, কিন্তু এটা তোমার না হলে তোমারই-বা এত দরদ কেন চাঁদ?
এক ঘুসিতে মুখের চেহারা পালটে দেবার এক অদম্য বাসনাকে কোনোমতে সামাল দিল জর্জ।
-অ্যান্ড্রু তুমিই বলো কী করছিল ওরা?
-ওদের উদ্দেশ্য হল আমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলা, সেইজন্য নির্জন জায়গায় নিয়ে যাবার কথা বলছিল, আমার দেহকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য আমাকে আদেশ করত ওরা।
রোষকষায়িত নেত্রে ওদের দিকে তাকাল জর্জ, থিরথির করে কেঁপে উঠল চিবুকটা, সেই একইভাবে বেপরোয়া ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে দুজনে।
-এত রেগে উঠছ কেন চাঁদু? মারবে নাকি? তা মন্দ হবে না, অনেক দিন হাতের সুখ করিনি আমরা। উদ্ধত ভঙ্গিতে খোঁচা দিয়ে বলল লম্বা মানুষটি।
মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রক্তের দপদপানি, উঃ কী অধঃপতন, মানুষ না জানোয়ার!
-না, না, নিজে কিছুই করব না, তবে সত্তর বছরের বেশি আমাদের বাড়িতে আছে এই রোবট, খুব ভালোভাবে জানে আমাদের, সেইজন্যে আমাদের হুকুমকেই আগে মানবে। যাক্ এবার মন দিয়ে শোনো বাঁদরেরা, অ্যান্ড্রু, অ্যান্ড্রু আমার জীবন এদের হাতে, মেরে ফেলবে আমাকে, অ্যান্ড্রু মারতে আসছে ওরা বাঁচাও, বাঁচাও অ্যান্ড্রু এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও অ্যান্ড্রু।
মুহূর্তের মধ্যে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে জানোয়ারদের পানে ধেয়ে গেল অ্যান্ড্রু, রোবটের সামনে দাঁড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়, পলকের মধ্যে জুতো হাতে নিয়ে চম্পট। পালানোর বহর দেখে হোহো করে হেসে উঠল জর্জ।
-জর্জ, দেখলে তো কেমন পালাল, কিন্তু সত্যি কি মারতাম, শুধু…
-ব্যাপার কী জান অ্যান্ড্রু, রোবট সম্বন্ধে ভয় আছে মানুষের মনে, তোমাকে এগিয়ে যেতে দেখে সেই ভয়েই পালিয়েছে ওরা…
-রোবটকে কেন ভয় পায় মানুষ, তোমরাই তো তৈরি করেছ আমাদের জর্জ!
-খুব ভালো প্রশ্ন করেছ অ্যান্ড্রু, জন্মলগ্ন থেকে এই ভয়রোগেই ভুগছে মানুষ, হাজার চেষ্টা করেও ভয়ের হাত থেকে মুক্তি পাইনি আমরা। যাক সেসব কথা, এদিকে এসেছিলে কেন?
-লাইব্রেরিতে যাবার জন্যে…
-লাইব্রেরি? যেতে হবে কেন, আমাকে বললেই বই পেয়ে যেতে তুমি!
-দ্যাখো জর্জ, আমি তো এখন…
-স্বাধীন! এই কথাটাই তো বলতে চাইছ এখন, স্বাধীন হলেই কি সব কাজে যেতে হবে তোমাকে! লাইব্রেরিতে কী পড়তে যাচ্ছিলে শুনি?
-মানুষের ইতিহাস জানতে হবে জর্জ, অনেক তথ্য জানতে চাই, পৃথিবীর খবর, গ্রহ নক্ষত্র মহাবিশ্বের যাবতীয় তত্ত্ব আর তথ্য, আরও জানতে যাই আমরা, আমাদের সম্বন্ধে- রোবটের ইতিহাস লিখতে চাই জর্জ।
-অ্যান্ড্রু, বেশ কয়েক হাজার বই লেখা হয়েছে রোবট নিয়ে, রোবটের তত্ত্ব নিয়ে, তত্ত্ব আর তথ্যে ভরে উঠেছে আমাদের জ্ঞানভান্ডার…
মাথা নেড়ে জর্জের কথায় বাধা দিল অ্যান্ড্রু। ইদানীং মানুষের মতো মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ বা না’ বলার কায়দা রপ্ত করে ফেলেছে বেশ।
-না না জর্জ, রোবটতত্ত্বের ইতিহাস নয়। নিজে রোবট হয়ে রোবটের সত্যিকারের ইতিহাস রচনা করব আমি, রোবটের জন্মলগ্ন থেকে তার অনুভূতির ক্রমবিকাশ, মানুষের সমাজে, মানুষের পৃথিবীতে রোবটের যথার্থ মূল্যায়ন, রোবটের…
১১
তিরাশি বছরে পা দিল ছোট মামণি। কালের বিকারে দেহে পরিবর্তন এলেও মনের জোর কঠিন থেকে কঠিনতম হয়েছে। সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়লেও ঠিক আগের মতন রয়ে গেছে চলাফেরা। সর্বক্ষণের সঙ্গী এক রূপোবাঁধানো বেতের লাঠি।
সমস্ত ঘটনা শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল ছোট মামণি।
-জর্জ, এ যে ঘোর অরাজকতা, দেশে শাসন কি নেই একেবারে? কোন বাড়ির ছেলে জানোয়ার দুটো?
-ঠিক বুঝতে পারলাম না, মনে হয় না এদিককার কোনো বাড়ি। আর জানা গেলেও কী-বা করতে পারতে? ভাগ্য ভালো কোনো ক্ষতি হয়নি অ্যান্ড্রুর।
-কোনো ক্ষতি হয়নি তো কী হয়েছে! ক্ষতি হয়ে গেলে তুমিই-বা কী করতে পারতে? জর্জ, তুমি না একজন লইয়ার, লইয়ারের বুদ্ধি নিয়ে একবার ভেবে দ্যাখো যে অ্যান্ড্রু না থাকলে কী হত তোমাদের? ওর প্রতিভা আর সৃজনীশক্তির জন্যেই রাজার হালে আছি আমরা। মান-সম্মান প্রতিপত্তি সবই ওর জন্যে, বংশপরম্পরায় আমাদেরই ভালোর জন্যে খেটে চলেছে অ্যান্ড্রু।
-সেকথা একবারও অস্বীকার করছি না মা, বেশ তো বলো-না কী করতে হবে আমায়।
-অ্যান্ড্রুর উপর এমন অত্যাচার যাতে আর না হয় তার জন্যেই চেষ্টা করতে হবে জর্জ। একটা টেস্ট কেস দাঁড় করাও যেমন করেই হোক, আঞ্চলিক আদালতকে বাধ্য করো রোবট সম্বন্ধে আইন প্রণয়ন করতে, রোবটের অধিকারের আইন, আইনসভায় এ-বিল পাশ হওয়ামাত্র যাও বিশ্ব আদালতে, হ্যাঁ হ্যাঁ জর্জ, এটা করতেই হবে তোমাকে, নৈতিক কর্তব্য বলে ধরতে হবে, অসহায় নিরুপায় অ্যান্ড্রু আর যেন কষ্ট না পায়।
উত্তেজনা আর আবেগে রুদ্ধ হয়ে এল কন্ঠস্বর। বাক্যহারা জর্জ পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে, অনির্বচনীয় মাতৃমূর্তি। অবিশ্বাস্য অসাধারন।
বিচার বিবেচনার পর অল্পদিনের মধ্যেই এক অভিনব কেস তৈরি করল জর্জ। মূল বিষয়গুলো নিজের হাতে রেখে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দিল পুত্র পলকে। কলেজের পড়া শেষ করে পলও যোগ দিয়েছে ফেইনগোল্ড অ্যান্ড মার্টিন ফার্মে। কেসের খুঁটিনাটি দিনের পর দিন আলোচনা করে পল দিদিমার সঙ্গে, সময়ে সময়ে অ্যান্ড্রুও যোগ দেয় আলোচনায়, আইনের সূক্ষাতিসূক্ষ প্রশ্ন নিয়ে রাত গড়িয়ে চলে ভোরের দিকে। নেশায় বুঁদ হয়ে আছে অ্যান্ড্রু, রোবট নিয়ে বই লেখা পিছিয়ে গেল বেশ কয়েক মাস, দিনরাত মামলা আর মামলা।
-তুমি তো সেদিন বললে মানুষের অবচেতন মনে এক ভয় রয়েছে রোবট সম্বন্ধে। কী জান জর্জ, যতদিন এই ভয় থাকবে ততদিন কোর্টই বল বা আইনসভাই বল কেউই কিন্তু সহজভাবে রোবটের সর্বাঙ্গীন উন্নতির চেষ্টা করবে না। সেইজন্যে প্রয়োজন জনসাধারণের চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন ঘটানো, জনসমর্থন আর সহানুভূতি এই দুইটির দরকার সর্বপ্রথম।
জনসমর্থনের জন্য পুরোদমে কাজে লেগে গেল জর্জ। সভা-সমিতি পার্টি স্কুল কলেজ সর্বত্রই ঝড়ের বেগে প্রচার চালাল নিত্যনুতন ভঙ্গিতে। ঘন্টার পর ঘন্টা বক্তৃতায় ভাসিয়ে দিল যুক্তিতর্কের সব বাধানিষেধ। সেবার সংবাদপত্রের সম্পাদক এবং প্রতিবেদকের বাৎসরিক প্রাদেশিক সভায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা করল জর্জ।
-রোবটের তিন আইনের কথা তো জানেন সকলে। সেই তিন আইনের মধ্যে দুনম্বর আইনের কথা মনে করুন একবার, এর ফলে যে-কোনো রোবটের কাছেই সীমাহীন অনুগত্য আজ আমাদের করায়ত্ত। অবশ্য অন্য কোনো মানুষের ক্ষতি করে নয়। অতীতের দাসপ্রথার মধ্যেও কি এমন আনুগত্য ছিল? না, ছিল না। সুতরাং বুঝতে পারছেন রোবটের উপর রয়েছে আমাদের অসীম ক্ষমতা, শুধু অসীম নয় বিপজ্জনক ক্ষমতা। এবার দেখা যাক তিন নম্বর আইনে কী লেখা আছে, প্রয়োজনে দুনম্বর আইন তিন নম্বরের উপরে কার্যকর হয়, অর্থাৎ আত্মরক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও মানুষের প্রয়োজনে একেবারেই নাকচ হয়ে যেতে পারে রোবটের অস্তিত্বরক্ষার একমাত্র আইনটি। এবার দেখুন, স্বয়ংধ্বংসের জন্যেও হুকুম করতে পারি আমরা। কারণ? কারণ নেই কিছু, আমাদের খুশি, আমাদের আদিম প্রবৃত্তির তৃপ্তিসাধন।
আমার শিক্ষিত সভ্য, সভ্যতার সংজ্ঞা এতই কুৎসিত ধিক্কারজনক? জন্তু-জানোয়ারদের সঙ্গেও কি এমন ব্যবহার করি কখনো? শুধু জীব-জন্তু কেন, উপকারে লাগে এমন কোনো প্রাণহীন বস্তুকেও এত তাচ্ছিল্য করি না আমরা। তারাও সুবিচার চায় আমাদের কাছে। কিন্তু রোবট আমাদের প্রয়োজনে আমাদেরই সৃষ্টি আমাদের পরম উপকারী সাথী সহচর বন্ধু, নিষ্প্রাণ নয়, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা, চিন্তাক্ষম, যুক্তিনির্ভর, এদের সঙ্গে কি বন্ধুর মতো ব্যবহার করতে পারি না আমরা? পারি না একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে? মানুষের পরম উপকারী সুহৃদকে কি বন্ধুত্বের সামান্যতম নিদর্শনও উপহার দিতে পারি না আমরা? ন্যায্য উপযুক্ত সম্মান?
মানুষের হুকুম তামিল করে রোবট, সেই রোবটকে আত্মঘাতী হুকুম না দেওয়াই উচিত নয় কি আমাদের? মানুষের ক্ষতির উপক্রম হলে অবশ্য অন্যরকম চিন্তা করতে হবে। বড় শক্তির দায়িত্বও বড়। মানুষ আমরা উন্নত মস্তিষ্কের অধিকারী, সেইজন্যেই দায়-দায়িত্বও অনেকখানি। মানুষের সেবা আর রক্ষার জন্য রোবটের যদি তিন আইন থাকতে পারে সেক্ষেত্রে আমাদেরও একটি বা দুটি আইন থাকা উচিত সে-আইন শুধু রোবটকে রক্ষার জন্যে।
জর্জের কথাই সত্যি হল। সারা পৃথিবী জুড়ে জনমত গড়ে উঠল রোবটের সপক্ষে। জন্ম হল নতুন আইনের, বেআইনি ঘোষিত হল আত্মঘাতী হুকুম। আইন অমান্যকারীদের জন্য গুরুতর শাস্তিরও বিধান রইল নতুন আইনে।
ছোট মামণির মৃত্যুর দিনেই এই আইনের সপক্ষে সর্বসম্মতিক্রমে রায় দিল বিশ্ব আইনসভা।
সে এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। মৃত্যুশয্যায় ছোট মামণি, শ্বাসকষ্টে কন্ঠরোধপ্রায়, সামনে বসে অ্যান্ড্রু নির্বাক নিশ্চল। জর্জের মুখে সুসংবাদ শোনামাত্র মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেল ছোট মামণির যাবতীয় কষ্ট। আরও কাছে ডেকে নিল অ্যান্ড্রুকে।
-অ্যা…ন্ড্রু, দারুণ খুশি, না, থেমো না এখানে, আরও যেতে হবে সামনে, লড়াই বন্ধ কোরো না অ্যান্ড্রু।
১২
-কী খবর অ্যান্ড্রু? বই-এর কতদূর? একদিন প্রশ্ন করল পল মার্টিন, জর্জের সুযোগ্য উত্তরাধিকারী।
-প্রায় শেষ করে এনেছি পল, পাবলিশার্সরাও খুব খুশি।
-শাবাশ! দারুণ খবর!
-পল, আমার কী মনে হয় জান, পাবলিশার্সরা খুশি কিন্তু অন্য কারণে, রোবট সম্বন্ধে বই লিখেছে এক রোবট বলেই বোধহয় বেশি বিক্রি হবে বই, ভালো বই কিনা এ বিচার বোধহয় গৌণ এখন।
-এ তো খুব স্বাভাবিক, এই বিচারবুদ্ধি আছে বলেই তো মানুষ মানুষ!
-হ্যাঁ, তা যা বলেছ, বিক্রি নিয়ে কথা, বিক্রি মানেই টাকা, টাকার বড় প্রয়োজন পল।
-টাকার প্রয়োজন? দিদিমা তো অনেক টাকাই রেখে গেছে তোমার জন্য।
-জানি পল, জানি, আমার জন্মলগ্ন থেকেই সুখে দুঃখে বিপদে আপদে সবসময়ে পাশে দাঁড়িয়েছে মার্টিন পরিবার, আমার সুনাম, আমার অধিকার এসবেরও মূলে রয়েছে তোমাদের ঐকান্তিক নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টা, কিন্তু রয়ালটির টাকা নিয়ে কিছু করতে চাই পল, আরও এক ধাপ এগোতে চাই!
-আরও এক ধাপ! ইতিমধ্যেই তো তুমি জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে উঠেছ অ্যান্ড্রু…
-কিংবদন্তি টন্তি বুঝি না, শুধু বুঝি আরও অনেক বাকি আছে এখনও, আর সেই জন্যেই ইউ এস রোবট অ্যান্ড মেকানিক্যাল মেন ইনক-এর বড় সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চাই। কিন্তু আমি চাইলে দেখা করবে না বোধহয়, আমার জন্যে অনেক নাজেহাল হয়েছে ওরা, বই লেখার ব্যাপারেও সাহায্য করেনি কিছু তাই…
-অ্যান্ড্রু, আজ নয় কয়েক পুরুষ ধরেই তো কর্পোরেশনের কোনো সহযোগিতা পাইনি আমরা, রোবটের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে সাহায্য করা দূরে থাক, শত্রুতাই করেছিল বেশি…
-যাই হোক পল, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজী করাও, দেখা করিয়ে দাও একবার।
-আমি বললেই-বা রাজী হবে কেন?
-একটা কাজ করো পল, বলো ওদেরই প্রয়োজনে দেখা হওয়া দরকার, নয়তো রোবটের আরও অধিকারের দাবিতে বৃহত্তর আন্দোলনে নামবে ফেইনগোল্ড অ্যান্ড মার্টিন ফার্ম।
-কিন্তু, এটা তো সত্যি নয়, মিথ্যে!
-মিথ্যেই তো পল, কিন্তু মিথ্যে কথা বলতে পারি না আমি, সেইজন্যই তোমাকে বলতে হবে একথা।
-শাবাশ অ্যান্ড্রু! শাবাশ! বলিহারি যাই বুদ্ধি তোমার! মিথ্যে বলতে পারবে না অথচ মিথ্যে বলার জন্য চাপ দেবে আমাকে। সত্যি কোনো তুলনা হয় না তোমার, ক্রমেই মানুষ হয়ে উঠছ অ্যান্ড্রু।
১৩
প্রথমে রাজি হয়নি ইউ এস রোবটস, কিন্তু অ্যান্ড্রুর চালেই কিস্তিমাত। অনুমতি মিলল সাক্ষাতের। বর্তমান প্রেসিডেন্ট স্মাইদ রবার্টসন-এর বয়স ষাট ছুঁইছুঁই, সর্ব অঙ্গে বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ। রোবটের অধিকারের প্রশ্ন নিয়ে ঝঞ্ঝাট ঝামেলায় কেটেছে প্রায় সমস্তজীবন। দুচোখের দৃষ্টিতে সন্দেহ আর ঘৃণা।
-স্যার, আমার এক আরজি আছে। আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে এই কোম্পানির মারটন মানস্কি বলেছিলেন যে পজিট্রনিক ব্রেনের গতিপথের নকশা নিয়ন্ত্রণকারী গণিতশাস্ত্র এতই জটিল এবং দুর্বোধ্য যে সম্ভাব্য সমস্ত সমাধানের হদিশ রাখা সম্ভব নয়। আর সেইজন্য নাকি আমার ক্ষমতা বা সামর্থ্যের ভবিষ্যদ্বাণী করা অসম্ভব।
বুঝলাম, কিন্তু সে তো প্রায় এক শতাব্দী আগের কথা। যা-ই হোক, এখন আর এমন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। নির্দিষ্ট কাজের জন্য নির্দিষ্ট রোবট তৈরি হয় এখন। এরপরেও আছে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। তার মানে আমার মতো অজস্র সম্ভাবনাময় রোবট আর তৈরি করছেন না আপনারা?
-না, বন্ধ হয়ে গেছে অনেক দিন আগে।
-তার মানে বর্তমানে আমিই একমাত্র কার্যক্ষম প্রাচীন রোবট। বেশ গর্বের সঙ্গে বলল অ্যান্ড্রু।
-হ্যাঁ, তা বটে, শুধু বর্তমান কেন চিরকালের জন্য আপনিই প্রাচীনতম রোবট। আজকালের রোবটের আয়ু মাত্র পঁচিশ বছর, এরপরেই পুরানো রোবট পালটে নতুন মডেলের রোবট দিই আমরা।
-অর্থাৎ বর্তমানে তৈরি কোনো রোবটের কার্যক্ষমতা পঁচিশ বছরের বেশি থাকে না। সে দিক দিয়ে অ্যান্ড্রু কিন্তু বিস্ময়কর ব্যতিক্রম। এতক্ষণ পরে কথা বলল পল।
-তা হলে পৃথিবীর প্রাচীনতম সম্ভাবনাময় রোবট বলতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই, এইজন্যেই তো বিশেষ সম্মান পাওয়া উচিত আমার। কী বলেন মিঃ রবার্টসন?
-একেবারেই নয়! আপনার ঐ বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্যই যথেষ্ট বেগ দিয়েছে আমাদের। বিক্রি না করে আপনাকে যদি লিজ দেওয়া হত তাহলে অনেককাল আগেই বন্ধ করে দিতাম আপনার ধাষ্টামো!
-ভদ্রভাবে কথা বলুন মিঃ রবার্টসন। ভুলে যাবেন না, আমি স্বাধীন, স্বাধীন রোবট। আমিই আমার মালিক। এবার আমি কেন এসেছি শুনুন একবার। আমাকে বদলে দিতে হবে আপনাকে। মালিকের মত ছাড়া একাজ করা সম্ভব নয়। বর্তমানে লিজের সঙ্গে এমন কথা লিখিয়ে নেন আপনারা, আমার সময়ে এমন কিছু ছিল না।
রীতিমতো হকচকিয়ে গেলেন রবার্টসন। কয়েক মিনিট চুপ করে থাকার পর বললেন- পালটাব কেমন করে? আপনাকে বদলে দিলে নতুন রোবট দেব কেমন করে আপনাকে? কারণ বদলানোর কাজ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে মালিক হিসাবে আর অস্তিত্ব থাকবে না আপনার! সুতরাং আপনার অনুরোধ রাখা সম্ভব নয়!
-মিঃ রবার্টসন, ভুল বোঝাবেন না আমাদের। এবার কথা বলে উঠল পল। অ্যান্ড্রুর ব্যক্তিত্ব, সৃজনীশক্তির উৎস হল ওর পজিট্রনিক ব্রেন, নতুন রোবট তৈরি না করে ব্রেন স্থানান্তর করা সম্ভব নয়, তাহলে এই পজিট্রনিক ব্রেনই হল অ্যান্ড্রু, মানে দেহের মালিক, এই অবস্থায় ব্রেন ছাড়া দেহের যে-কোনো অংশ সহজেই পালটানো যেতে পারে, মোদ্দা কথা, নতুন এক রোবটের দেহে স্থানান্তরিত হবে অ্যান্ড্রু অর্থাৎ ওর পজিট্রনিক ব্রেন।
-হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই কথাটাই বলতে চাইছি আমি। আপনারা তো এখন অ্যান্ড্রয়েড তৈরি করছেন, তাই না মিঃ রবার্টসন? হুবহু মানুষের মতো দেখতে?
-হ্যাঁ, তৈরি করেছিলাম, কৃত্রিম তন্তুর দেহের ত্বক, টেনডন, মাস্ল মাংস, বলতে গেলে ব্রেন ছাড়া কোনো ধাতব পদার্থের কারবার নেই অ্যান্ড্রয়েডের মধ্যে।
-এত কথা জানা ছিল না আমার। বাজারে ছেড়েছেন নাকি কিছু? পলের কন্ঠস্বরে অকৃত্রিম বিস্ময়।
-না না, বাজারে বেরোয়নি একটাও। মার্কেট সার্ভে করে দেখা গেল এমন রোবটের চাহিদা নেই মোটেই, এর জন্য দায়ী এর দাম আর মানুষের মতন গড়ন। সেইজন্যই অ্যান্ড্রয়েড তৈরি বন্ধ করে দিয়েছি আমরা।
-বন্ধ করে দিলেও তো তৈরি করার অভিজ্ঞতা রয়েছে আপনাদের। তাই আমার দেহের বদলে এক অ্যান্ড্রয়েডের দেহ মানে জৈব রোবটের দেহ দিন আমাকে। অর্থাৎ অ্যান্ড্রয়েড রূপান্তরিত করুন আমার দেহকে।
-মাই গড! কী বলছ অ্যান্ড্রু!! আকস্মিক উত্তেজনায় বলে উঠল পল।
-অসম্ভব! একেবারেই অসম্ভব!
পল, বসো চুপ করে। অসম্ভব কেন মিঃ রবার্টসন? দামের জন্য ভয় পাবেন না, নায্য দামই দেব আপনাকে।
-এটা কেন বুঝতে পারছেন না যে দামের কোনো প্রশ্নই ওঠে না, অ্যান্ড্রয়েড তৈরি করা বন্ধ করে দিয়েছি আমরা, সুতরাং-
-ঠিক আছে, ব্যবসায়িক ভিত্তিতে বন্ধ করে দিয়েছেন মানছি সেকথা, কিন্তু এর মানে তো এই নয় যে অ্যান্ড্রয়েড তৈরি করতে জানেন না বা পারবেন না আপনারা। দাম না হয় বেশি দেব, এবার আইনের প্যাঁচে কথা বলল পল।
-না মানে, মানে অ্যান্ড্রয়েড বানানো মানে জনমতের বিরূদ্ধাচরণ করা, সেইজন্যেই আপনাদের অনুরোধ রাখতে অক্ষম আমার কোম্পানি…
-আইন করে তো বন্ধ হয়নি! আবার আইনের কথা বলল পল।
-দেখুন মিঃ পল, আইন-টাইন বেশি বুঝি না, স্পষ্ট কথা শুনুন, অ্যান্ড্রয়েড বানাচ্ছি না্ বানাবও না আর। দৃঢ় কন্ঠে বললেন রবার্টসন।
-মিঃ স্মাইট রবার্টসন, আপনার নিশ্চয় অজানা নয় যে অ্যান্ড্রু এখন স্বাধীন রোবট, আইনের লড়াই করেই এই স্বাধীনতা আদায় করতে হয়েছে, শুধু অ্যান্ড্রুই নয়…
-জানি, জানি সেকথা, হাড়ে-হাড়ে জানি।
-এখনই বিরক্ত হবেন না, আরও কিছু নিবেদন আছে আমাদের। অ্যান্ড্রু স্বাধীন, পছন্দমতো সব কাজ করে, সেজন্য মানুষ-জানোয়ারদের হাতে কম অত্যাচার সহ্য করতে হয়নি ওকে। এমনকি ধ্বংস করে ফেলার উপক্রমও হয়েছিল একবার। মামলা করাই উচিত ছিল আমাদের, কিন্তু নির্দিষ্ট করে ধরতে পারা সম্ভব হয়নি কাউকে, কিন্তু যদি কেউ জেনেশুনে রোবটের অধিকার লঙ্ঘন করে তা হলে…
-শুনুন মিঃ পল, স্পষ্ট করে বলুন আপনার বক্তব্য!
-এত স্পষ্ট বলার পরও আর কী করে বলব বুঝতে পারছি না, বেশ আর একবার বলছি শুনুন, আপনি সব জেনেও একজনের বিরুদ্ধে অন্যায় কাজ করতে বদ্ধ পরিকর।
-অন্যায় কাজ? কী বলছেন আপনি? বিস্ময়ে নড়েচড়ে বসলেন রবার্টসন।
-না বোঝার কিছু নেই তো মিঃ রবার্টসন! আমার মক্কেল অ্যান্ড্রু মার্টিন এক স্বাধীন রোবট, আর সেই স্বাধীন রোবট আপনার কোম্পানির কাছে দাবি করেছে ওর দেহকে বদলে দেবার জন্য। পঁচিশ বছর পর যে-কোনো মালিকই তো পুরনো রোবটের পরিবর্তে নতুন রোবট পায়, এটা রোবট-মালিকদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার।
এবার নির্বাক রবার্টসন, কেমন যেন অসহায় ভাব- মনে মনে বেশ মজা উপভোগ করল পল।
-আমার মক্কেলের পজিট্রনিক ব্রেনই হল মক্কেলের দেহের মালিক, আর সেই দেহটা পঁচিশ বছর কেন, একশো বছর কাটিয়ে জরাজীর্ণ আজ। মালিক পজিট্রনিক ব্রেন সেই জরাজীর্ণ দেহের বিনিময়ে নতুন দেহ দাবি করছে। এর জন্যে উপযুক্ত মূল্য দিতেও রাজি আছে। এই অবস্থায় ন্যায়সঙ্গত দাবি যদি না মানেন তাহলে চরম অপমান বোধ করবে আমার মক্কেল, তখন আপনার নামে মামলা করা ছাড়া কোনো পথ থাকবে না আমার। অ্যান্ড্রু আজ রীতিমতো ধনী, সুতরাং শেষ পর্যন্ত…
-তার মানে, জোর করছেন আমার উপর?
-জোর করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, আমার মক্কেলের আইনসঙ্গত অনুরোধ না শুনলে মামলা করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই আমার। তাই বলি শুনুন মিঃ রবার্টসন, রাজি হয়ে যান অ্যান্ড্রুর কথার, নয়তো…
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন রবার্টসন, মনের মধ্যে চিন্তার ঝড়…বেশ।
-বুঝলাম রাজি আপনি, বুদ্ধিমানের কাজ করছেন মিঃ রবার্টসন। যাক, এবার এক শর্ত আছে আমাদের, নতুন অ্যান্ড্রয়েড দেহে যেন নিখুঁতভাবে বসানো হয় মক্কেলের পজিট্রনিক ব্রেনকে, সামান্যতম ক্ষতি হলে কিন্তু ছেড়ে কথা বলব না আমরা। ব্রেনের প্লাটিনাম-ইরিডিনিয়াম নির্মিত গতিপথের সামান্যতম যেন নষ্ট না হয়। অ্যান্ড্রু, আর কিছু বলবে তুমি?
-না পল, এইটুকু হলেই চলবে আপাতত।
১৪
দিন, সপ্তাহ, মাস, বেশ কয়েক মাস কেটে গেল, অতি সতর্কতার সঙ্গে কাজ চলছে পরিবর্তনের, অ্যান্ড্রুর নতুন কলেবরের। নতুন দেহ আর ব্রেনের মধ্যে সঙ্গতি আসতে সময় লাগছে বেশ, অ্যান্ড্রুর অনুভূতির মধ্যে ধরা পড়ে ছোটখাটো অস্বস্তি, দ্বিধা, দুশ্চিন্তা, ধীরে ধীরে সহজ-সরল হয়ে ওঠে ব্রেনের সমস্ত গতিপথ, চিন্তার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ফটোসেলগুলো আর দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে পজিট্রনিক ব্রেনের বোঝাপড়া স্বাভাবিক হয়ে আসে, আয়নার সামনে বহুক্ষণ অভ্যাস করতে হয় অ্যান্ড্রুকে।
বেশ কয়েক মাস পরে কর্পোরেশন থেকে ছাড়া পেল অ্যান্ড্রু, হেলিট্যাকসি করে বাড়ি নিয়ে এল পল।
কয়েকদিনের মধ্যে নতুন কাজে মেতে উঠল অ্যান্ড্রু। সারাক্ষণ ধরে চলল রাজ্যের বইপড়া, ছোটোখাটো এক লাইব্রেরি গড়ে উঠল ঘরের মধ্যে। রবোবায়োলজি অর্থাৎ জৈব রোবট অ্যান্ড্রয়েডের দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপর গবেষণা শুরু করল অ্যান্ড্রু। এমনভাবেই কাটল কয়েক বছর।
একদিন ভোরবেলায় অ্যান্ড্রুর ঘরে এল পল।
এখনও বই-এর মধ্যে ডুবে আছ অ্যান্ড্রু! যাক শোনো, জরুরি খবর আছে একটা নতুন এক চাল চেলেছে ইউ এস রোবটস, যুগান্তকারী ব্যাপার।
বই থেকে মুখ তুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পলের দিকে তাকাল অ্যান্ড্রু। বেশ বয়েস হয়েছে পলের, ধবধবে সাদা মাথার চুল, দৃষ্টিশক্তিকে সাহায্য করার জন্য ফটো অপ্টিক সেল বসানো রয়েছে দুচোখে, এই ব্যাপারে অ্যান্ড্রুর সমগোত্রীয় হয়ে পড়েছে পল।
-কী বলছ পল?
-নতুন ধরনের রোবট তৈরি করেছে ইউ এস রোবটস, নিজস্ব কোনো ব্রেন থাকবে না এদের, বিশাল এক পজিট্রনিক ব্রেন থাকবে কেন্দ্রে, মাইক্রোওয়েভের সাহায্যে কয়েকশো রোবটকে নিয়ন্ত্রণ করবে ঐ ব্রেন। অর্থাৎ বিশাল ব্রেনের সঙ্গে টিকি বাঁধা রইল প্রত্যেকের, অথচ সম্পূর্ণ পৃথক এদের অস্তিত্ব।
-খুবই কার্যক্ষম হবে কি রোবটগুলো?
-ইউ এস রোবটস তো বলছে সেকথা! আমার মনে হয় ভয় কাজ করছে এই নতুন ধরনের রোবট তৈরির পেছনে। রোবটদের নিজস্ব ব্রেন থাকলে তোমার মতো ব্যতিক্রম হয়তো হতে পারে কেউ, অথচ একটা ব্রেন হলে আয়ত্তে রাখা সুবিধে অনেক। তোমার নতুন দেহের দাবির পর থেকেই চিন্তাধারা সব পালটে গেছে ওদের।
-অর্থাৎ এর পদক্ষেপ হল দৈত্যাকৃতি প্রকাণ্ড এক ব্রেন, লক্ষ লক্ষ ব্রেনশূন্য রোবটদের দেহ কাজ করবে তার নির্দেশ। সাংঘাতিক! না না, আদপেই ঠিক নয় এটা। বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল অ্যান্ড্রু।
-হয়তো সত্যি হবে অনুমান। ততদিন বাঁচব না আমি, শরীর ভেঙে পড়েছে আমার!
-পল!! আর্তনাদ করে উঠল অ্যান্ড্রু, দুচোখে তীব্র বেদনার আভাস নিয়ে এগিয়ে গেল পলের দিকে।
অ্যান্ড্রুকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল পল। বাক্যহারা কয়েক মুহূর্ত বাঙ্ময় হয়ে রইল দুজনের মনের মণিকোঠায়। অবশ্যম্ভাবী বিচ্ছেদের তীব্র জ্বালায় একাকার হয়ে গেল আসল নকল।
-অ্যান্ড্রু, মানুষ আমি, যেতে আমাদের হবেই, আজ আর কাল। যা-ই হোক, মার্টিন পরিবারের শেষ বংশধর আমি, আমার যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি উত্তরাধিকারী করেছি তোমাকে, এ সম্বন্ধে ট্রাস্টিও করেছি গতকাল।
-এসব অনর্থক পল। কিছুই চাই না আমার! প্রায় অভ্যস্ত মানবিক আবেগে কন্ঠ রোধ হয়ে এল ওর। নিশ্চিহ্ন মার্টিন পরিবার, না না…
-অ্যান্ড্রু, যা অবশ্যম্ভাবী সত্য তাকে খুশি মনে বরণ করে নেওয়াই মঙ্গল। যাক সে-সব কথা, এখন কী করছিলে তুমি?
-আমার আর করার কী আছে, যুগ যুগ ধরে আমাকেই বেঁচে থাকতে হবে জ্বালা-যন্ত্রণা সয়ে! না না, এ হয় না, হয় না পল!
-আশ্চর্য! এত মানবিক আবেগ তোমার মধ্যে কেমন করে এল অ্যান্ড্রু? তুমি যে আমাদের মতোই রক্তমাংসের মানুষ হয়ে উঠছ দিনে-দিনে! অ্যান্ড্রু, তুমি যে কত ভালো কত আপনার সেকথা বোঝাব কী করে!
এবার নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক হয়ে উঠল অ্যান্ড্রু। টেবিল থেকে একটা কাগজ তুলে নিয়ে বলল- পল, এক নতুন সিস্টেম ডিজাইন করেছি দ্যাখো, এর ফলে হাইড্রোকার্বন কম্বাশন থেকে এনার্জি লাভ করবে অ্যান্ড্রয়েডরা, অর্থাৎ আমার এনার্জির জন্য আর অ্যাটমিক সেলের প্রয়োজন হবে না।
-তুমি বলছ কী অ্যান্ড্রু? নিঃশ্বাস নেবে? খাবার খাবে? রীতিমতো অবিশ্বাস্য!
-পল, অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছি, এতদিনে উপযুক্ত এক কম্বাশন চেম্বারের ডিজাইন করেছি, ক্যাটালাইজ নিয়ন্ত্রিত হাইড্রোকার্বন সব হজম হবার সময় এনার্জির জন্ম দেবে, আর সেই এনার্জিই চালাবে আমাদের দেহগুলিকে।
-অ্যান্ড্রু, কেন এসব করছ? অ্যাটমিক সেল তো অনেক শক্তিশালী দীর্ঘস্থায়ী।
-ঠিক সেইজন্যে আমার এই ডিজাইন, কৃত্রিম আর চিরস্থায়ী বলেই তো অমানবিক!!
১৫
পলের মৃত্যুর পর একেবারে একা, একা হয়ে পড়ল অ্যান্ড্রু। সারা বিশ্বে আর কেউ রইল না ওর পাশে দাঁড়াবার। সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে একাই লড়তে হবে এবার। মনে- মনে স্থির সিদ্ধান্ত করল, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তো একলা চলো রে! আরও বেশি জেদি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অ্যান্ড্রু, ছোট মামণির শেষ কথাগুলো মশালের আলো হয়ে দীপ্যমান ওর চলার পথের দিকে।
একা হয়েও নিঃসঙ্গ নয়, ফেইনগোল্ড অ্যান্ড্রু মার্টিন কোম্পানি তো রয়েছে, রোবটের মতোই অমর কোম্পানির জীবন।
কম্বাশন চেম্বারসংক্রান্ত ব্যাপারে ইউ এস রোবটস-এ যাবার প্রয়োজন হয়ে পড়ল আবার। প্রথমে স্যার জিরাল্ড, দ্বিতীয়বার পল, এবার একাই গেল সে ইউ এস রোবটসে, মানুষের ভঙ্গিমায় দৃঢ় পদক্ষেপে।
কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানির পরিবর্তনও হয়েছে অনেক। মহাকাশের অন্তরীক্ষে স্থানান্তরিত হয়েছে প্রধান কারখানা, উৎপাদন হয় সেখানেই। শুধু ইউ এস রোবটস নয়, পৃথিবীর যাবতীয় কলকারখানাই এখন ছোটবড় নানান মহাকাশ-বন্দরের চারপাশে ভিড় করেছে। মহাকাশ-বন্দরে বসবাস শুরু করছে লক্ষ লক্ষ জনসাধারন, দিনে-দিনে গড়ে উঠেছে মহাকাশের বুকে মানবসভ্যতার ধ্বজাবাহী বিশালাকৃতি আধুনিক শহর। পৃথিবীর জনসংখ্যা খুবই নগণ্য, সাজানো-গোছানো সুন্দর এক বাগান, আর কয়েক লক্ষ ব্রেনশূণ্য রোবট।
অ্যালভিন ম্যাপভেস্ক এখন ডাইরেক্টর অব রিসার্চ কোম্পানির সর্বেসর্বা। শ্যামবর্ণ দেহের রং কটা চোখ, ঢেউ-খেলানো মাথার চুল, চিবুকের নিচে ছুঁচলো দাড়ি। আবরনহীন উর্ধ্বাঙ্গ, একটু কাত হয়ে কাঁধ বেয়ে বুকের দুপাশে নেমে এসেছে জ্বলজ্বলে চওড়া এক বন্ধনী, আজকের দুনিয়ায় আভিজাত্যের নিদর্শন।
-কী সৌভাগ্য। আপনি এসেছেন আমার কাছে, বিশ্বাস করুন আপনার সঙ্গে আলাপ করার জন্য ছটফট করছিলাম, আপনার অসাধারন পাণ্ডিত্য আর সৃজনীশক্তি রীতিমতো গর্বের বিষয়। আমাদের সবচেয়ে বিস্ময়কর রোবট, না না, ঠিক হল না রোবট বলা, কিন্তু কিন্তু…
-অ্যান্ড্রু, কোনকিছু না বলে অ্যান্ড্রু বলুন আমাকে।
-বেশ। বেশ। অ্যান্ড্রু, স্মাইদ রবার্টসন নির্লজ্জভাবে শত্রুতা করেছিল আপনার সঙ্গে, তার জন্যে শুধু লজ্জিতই নই, ক্ষমাপ্রার্থী আমি, আমরা সকলে। সেইসময়ে আমি থাকলে অনেক কিছুই করতে পারতাম।
-করতে পারতাম কেন, এখনও তো করতে পারেন।
-না না, আর কী করার আছে, সেসব তো কেটে গেছে অনেককাল। তবে নতুন কিছু আরজি আছে নাকি?
-আরজি নিয়েই তো এসেছি আপনার কাছে।
একে একে যাবতীয় কথা বলল অ্যান্ড্রু, কম্বাশন চেম্বারের ডিজাইনও তুলে দিল ওর হাতে, শুধু অবিশ্বাস নয়, বিস্ময়ে হতবাক ম্যাগভেস্ক।
-শাব্বাশ। দারুণ চিন্তাধারা! আচ্ছা, এসব কে দিয়েছে বলুন তো আপনাকে?
-কে আবার দেবে! সবই আমার চিন্তার ফসল ডঃ ম্যাগভেস্ক।
-আপনার চিন্তা, নিজস্ব গবেষণা, এ যে অবিশ্বাস্য!!
-এবার আমার কথার জবাব দিন ডক্টর, আমার অনুরোধ রাখতে কোনো আপত্তি নেই তো?
-না না, আপত্তি হবে কেন, তবে বেশ ভালোভাবে পরীক্ষা করতে হবে আপনার দেহটাকে, তারপর নিছক পরীক্ষামূলকভাবেই চেষ্টা করব আমরা। আমার ব্যক্তিগত অভিমত কিন্তু এসব চিন্তা ছাড়ুন, যেমন আছেন তেমনি থাকুন, বিপদের ঝুঁকি নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
ভাবপ্রকাশের অভিব্যক্তি এখনও সীমাবদ্ধ অ্যান্ড্রুর। গলার স্বরে কিন্তু ফুটে উঠল বিরক্তির আভাস।
-ডক্টর, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে আপনিও এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছেন। আপনার পছন্দ-অপছন্দের কোনো ব্যাপার নয়, আপনি শুধু আমার অনুরোধ অনুযায়ী কাজ করবেন, দায়দায়িত্ব সব আমার। হ্যাঁ, আর একটা কথা, এর এক বিরাট সম্ভাবনার দিকও আছে, আমার অভ্যন্তরে চেম্বার স্থাপন সম্ভব হলে অদূর ভবিষ্যতে মানুষের দেহেও বসানো হবে এমন কম্বাশন চেম্বার। প্রস্থেটিক কলাকৌশলের মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী হবে মানুষের জীবনীশক্তি, এইসব ডিজাইনের মধ্যে আমারটাই হল বাস্তবসম্মত সহজ-সরল। ডঃ ম্যাগডেস্ক, ব্যাবসার সম্ভাবনার কথা ভেবে দেখুন একবার। অন্যথায় ফেইনগোল্ড অ্যান্ড্রু মার্টিন কোম্পানিই ব্যাবসায় নামবে, ডিজাইনের পেটেন্ট করা আছে আমাদের। অদূর ভবিষ্যতে আরও উন্নতি হবে প্রস্থেটিক কলাকৌশল, রোবটের গুণসম্পন্ন মানুষ তৈরিও অসম্ভব নয়, তখন কিন্তু আপনার কোম্পানি মার খাবে সাংঘাতিকভাবে।
-এবার আমার অফার শুনুন, আপনি যদি আমার উপর অপারেশন করেন তা হলে আমাদের পেটেন্ট ডিজাইন ব্যবহার করার অধিকার দেব আপনাদের। শুধু এইটুকুই নয়, রোবট এবং মানবদেহের অভ্যন্তরে প্রস্থেটিক প্রযুক্তিবিদ্যার উপরও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে আপনাদের। এবার ভেবে দেখুন ভালো করে!
অ্যান্ড্রুর যুক্তিপূর্ণ মানবিক বক্তব্যে মন্ত্রের মতো ফল হল।
-বেশ। রাজি আপনার বক্তব্যে, আপনার জন্যে সবকিছুতেই রাজি ইউ এই রোবটস।
১৬
দারুন সাফল্যমন্ডিত হল জটিল অপারেশন।
-আমি কিন্তু অপারেশনের বিপক্ষে ছিলাম। অন্য কারুর উপর হলে কোনো আপত্তি ছিল না দুরূহ এক্সপেরিমেন্টে, কিন্তু আপনি একমেবাদ্বিতীয়ম, পজিট্রনিক ব্রেনের কোনো ক্ষতি হলে কেউ ক্ষমা করবে না আমকে, নিজের কাছে অপরাধী হয়ে পড়তাম। অবশ্য এখনও কিছু গরমিল আছে পজিট্রনিক ব্রেন এবং নকল স্নায়ুতন্ত্রের গতিপথের মধ্যে, তবে কালক্রমে দূর হয়ে যাবে গরমিল, একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠবে। তবে হ্যাঁ, দেহে কোনো মারাত্মক ব্যাধি হলে ব্রেনের ক্ষতি হতে পারে কিন্তু!
-সে যখন হবে তখন দেখা যাবে, তবে প্রথম থেকেই আপনাদের উপর অখণ্ড বিশ্বাস ছিল, পারলে আপনারাই পারবেন, এককথায় অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন, বিশ্বাস করুন কৃতজ্ঞতা জানাবার কোনো ভাষা নেই আমার ডক্টর, এবার যাবার অনুমতি দিন, অনেক দিন হয়ে গেল বাড়িছাড়া আছি।
-হ্যাঁ হ্যাঁ, বাড়ি যাবেন বইকি, এখন তো সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছেন, তবে হ্যাঁ, দশ আউন্স করে অলিভ অয়েল খাবেন পাঁচদিন, নতুন অবস্থায় কম্বাশন চেম্বার পরিষ্কার রাখা বিশেষ প্রয়োজন, বাদবাকি সব পরিষ্কার করে লেখা আছে প্রেসক্রিপশনে, ভুলবেন না কিন্তু…
-না, ভুলব না ডক্টর, তবে কী জানেন, শিল্পীর ক্যানভাসের মতো ব্যবহার করছি আমার দেহটা, দেহটার মধ্যে গড়ে তুলতে চাই, গড়ে তুলতে চাই-
-এক পরিপূর্ণ মানুষ! তা-ই না মিঃ অ্যান্ড্রু?
-ঠিক বলেছেন আপনি। দেখা যাক কোথায় পৌছতে পারি শেষ পর্যন্ত।
-আমার একটা অনুরোধ আছে, সীমার বাইরে যাবার চেষ্টা না করাই ভালো, প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে নস্যাৎ করে প্রস্থেটিক নয়া নকশা রীতিমতো যুগান্তর এনেছে মানব সভ্যতায়, আবিষ্কারক হিসাবে আপনার স্বীকৃতি আজ জগৎজোড়া। তাই বলি, আর কেন? নাইবা আর জুয়া খেললেন নিজের অমূল্য দেহ নিয়ে!
এর জবাব জানা আছে অ্যান্ড্রুর। কিন্তু কী হবে উত্তর দিয়ে, বাসনার মর্মদাহী জ্বালা যে অনুভব করেনি সে কেমন করে বুঝবে ওর মর্মবেদনা!
নানান সম্মানে ভূষিত অ্যান্ড্রু একাধিক পণ্ডিত সমিতি সাম্মানিক সভ্যপদে সম্মানিত করল ওকে। নিখিল বিশ্ব প্রস্থেটিক বিজ্ঞান সমিতির আজীবন সভাপতি অ্যান্ড্রু স্বয়ং । রবোবায়োলজির নতুন নাম এখন প্রস্থেটোলমি!
অ্যান্ড্রুর দেড়শো বছর জন্মজয়ন্তী পালন করা হল মহা সমারোহে। বিশাল ভোজসভার আয়োজন করল ইউ এস রোবটস, অ্যালভিন ম্যাগভেস্ক স্বয়ং উপস্থিত হলেন ভোজসভায়, চুরানব্বই বছর বয়সেও সতেজ কর্মচঞ্চল। মুহুর্মুহু রোবটের জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল সমস্ত ভোজসভা।
রোবট! রোবট! রোবট! মর্মদাহে অস্থির হয়ে উঠল অ্যান্ড্রু… মুখের গড়নে বহিঃপ্রকাশ হয় না কিছু আপমানে থরথর করে কেঁপে উঠেছিল ঠোঁট দুটো মনের কথা বলার কেউ নেই আজ বার বার করে ভেসে উঠল ছোট মামণির মূর্তি……
ছোট মামনির চিন্তা যেন অমৃতবারি সিঞ্চন করল সারা দেহে…… রোবটের নির্মোক থেকে মুক্তি কি আসবে কোনোদিন? সঙ্গে সঙ্গে মানুষ হবার প্রতিজ্ঞায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল সমস্ত দেহমন।
১৭
প্রস্থেটোলজির বিজয় অভিযান পৃথিবীর গণ্ডি ছাড়িয়ে চাঁদে গিয়ে পৌঁছাল অল্প সময়ে। ডাক পড়ল অ্যান্ড্রুর। বিশাল চাঁদের জনবসতি। চাঁদের অভ্যন্তরে একাধিক প্রকাণ্ড আধুনিক শহর।
স্বল্প মাধ্যাকর্ষণের জন্য সামান্য হেরফের হল প্রস্থেটিক নকশার। বিশিষ্ট প্রস্থেটোলজি বিশারদদের নিয়ে পুরো পাঁচ বছর কাজে ব্যস্ত রইল অ্যান্ড্রু… কাজের অবসরে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াল সে মনের আনন্দে… দুচোখে ওর শিশুসুলভ অদম্য বিস্ময় আর কৌতুহল… হুবহু মানুষের মতোই তিন আইনে তার অনুগত্য স্বীকার করল সমস্ত রোবটগোষ্ঠী।
কাজশেষে চাঁদের বুক থেকে ফিরে এল অ্যান্ড্রু পৃথিবীতে। সটান চলে এল নিজের অফিসে। সম্মানে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল একজিকিউটিভ ডাইরেক্টর সাইমন ডিলং।
-আসুন… আসুন… আপনি ফিরে আসবেন শুনেছিলাম… কিন্তু আজই যে আসবেন সেটা জানতে পারিনি।
-ভুল শোননি কিছু… কথা তা-ই ছিল হঠাৎ সবকিছু যেন দুর্বিষহ মনে হল…… আসলে কী জান সাইমন… কুড়িজন শ্রেষ্ঠ মানুষ-ডাক্তার নিয়ে গড়ে তুলেছিলাম আধুনিক প্রস্থেটিক গবেষণাগার… আমারই নির্দেশে নিঃশব্দে কাজ করেছে ওরা… চাঁদের রোবটরাও মানুষের মতো সম্মান দেখিয়েছে আমাকে অথচ অথচ একটা চিন্তাই পাগলা করে তুলছে।
-কোন চিন্তার কথা বলছেন?
-জান সাইমন চিন্তা আমার একটা এত কান্ডের পরেও আমি কেন মানুষ হব না? মানুষ বলে স্বীকৃতি পাব না কেন? কেন? কেন?
বিপুল বিস্ময়ের ছায়া পড়ল সাইমনের দুচোখে। আন্ড্রুয়েডের বড় বড় দুচোখে অবিশ্বাস্য অস্থিরতা… উজ্জ্বলতার মশাল জ্বালিয়ে অসম্ভবের খোঁজে দিশাহারা।
-স্যার এইমাত্র তো বললেন রোবটরাও মানুষ হিসাবে সম্মান দিয়েছে… মানুষ ডাক্তাররাও বিনা প্রতিবাদে শুনেছে আপনার কথা অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে আপনি মানুষ!
-কথা দিয়ে ভুলিয়ে কী লাভ সাইমন? প্রকৃত অর্থে মানুষ বলে গণ্য হলেও সত্যিই কি মানুষ হওয়া যায়? মানুষ মানুষই… মানুষের মতোই সত্যিকারের মানুষ হতে চাই আমি… আইনসঙ্গত সত্যিকারের মানুষ… ন্যায়সম্মত অধিকারবলে মানুষ!!
-আশ্চর্য! এ যে অসম্ভবের সাধনা! আপনার স্বপ্ন সার্থক হলে মানুষের আত্মঅহংকারে ঘা লাগবে… তার ফলে আসল কথা কী জানেন, যতদূর সম্ভব মানুষ হয়ে উঠলে “মানুষের মতোই” এই কথাটাই বলবে সকলে… সত্যিকারের আসল মানুষ হওয়া সম্ভব নয় কিছুতেই!
-কিন্তু কেন কেন কেন? কেন সম্ভব নয় সাইমন… মানুষের আকৃতি আমার… মানুষের সমতুল্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সব প্রস্থেটিক যন্ত্রসম্বলিত মানুষের মতোই আমার দেহ… জ্ঞান-বিজ্ঞান শিল্প সাহিত্য মানবসভ্যতার সার্বিক অগ্রগতির পথে মূল্যবান পাথেয় জুগিয়েছি আমি… এর চেয়ে বেশি আর কী দিতে পারে কেউ?
-এত উত্তেজিত হয়ে পড়বেন বুঝিনি সেকথা। ব্যাপার কী জানেন, একমাত্র বিশ্ব আইনসভাই আইন প্রণয়ন করে মানুষের স্বীকৃতি দিতে পারে আপনাকে… কিন্তু সেও প্রায়…
বিশ্ব আইনসভা? বেশ… আইনসভার সদস্য কে আছে বলো তো এখানে?
সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি কমিটির চেয়ারম্যানকে বললেও কাজ হবে স্যার।
১৮
সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি কমিটির চেয়ারম্যান হলেন পূর্ব এশিয়ার এক ভদ্রমহিলা… নাম শ্রীমতী চী-লি সিং। মাঝবয়সী সুন্দরী না হলেও দেহ- যমুনায় জোয়ারের ঢল কানায় কানায় ভরপুর। পরনে স্বচ্ছ আলোকোজ্জ্বল আধুনিক পোশাক।
–মানুষের সম্পূর্ণ অধিকার অর্জনের জন্য আপনার ঐকান্তিক প্রয়াসের প্রতি আমার পূর্ণ সহানুভূতি আছে মিঃ অ্যান্ড্রু। তবে কোনো বিশেষ অধিকার থেকে কি বঞ্চিত আপনি? তার জন্যই কি আপনার…
-না না বিশেষ কোনো অধিকার দাবি নেই আমার। আমার বক্তব্যেই আমার জীবন… সব স্বীকৃতি পেয়েও আমি মানুষ নই… রোবটমাত্র… অন্যান্য রোবটের মতো আমাকেও বিচ্ছিন্ন করা যাবে প্রয়োজনবোধে!
-মানুষকে তো প্রাণ দিতে হয় সময় সময়।
-প্রাণ দিতে হয় বটে তবে সেটা আইনের মাধ্যমে… বিচার শেষে! অথচ আমাকে খুলে শেষ করতে বিচারের প্রয়োজন নেই কোনো। এ-ব্যাপারে সরকারি অধিকারবলে বলীয়ান কোনো মানুষের হুকুমই যথেষ্ট! যাক, এ তো গেল পার্থক্যের কথা… আসল কথা মানুষ হতে চাই… পূর্ণ স্বীকৃতি… দেড়শো বছর ধরে মানুষ হবার সাধনাই করে আসছি আমি।
শ্রীমতী চী-লির ভ্রমরকালো চোখের তারায় বেদনার আভাস।
-মিঃ অ্যান্ড্রু, বিশ্ব আইনসভা সবকিছুই করতে পারে… পাথরের মূর্তিকেও আইন প্রণয়ন করে মানুষ বলে গণ্য করাতে পারে। কিন্তু আসল ব্যাপার কী জানেন… আইন সভার সদস্য সবাই মানুষ… মানুষের মনের গহনে এক সন্দেহ ভীতি রয়েছে রোবট সম্বন্ধে…
-এখনও সন্দেহ, এখনও ভয়?
-অবিশ্বাস্য বলে মনে হলেও এটাই বাস্তব সত্য। মানবিক গুণের বিকাশ ঘটেছে আপনার মধ্যে। পৃথিবীর মানুষই নানান সম্মানে ভূষিত করেছে আপনাকে। তা সত্ত্বেও বাজে নজির সৃষ্টির ভয়েই হয়তো পিছিয়ে যাবে আইনসভা।
-নজির? কিসের নজির? আমিই একমাত্র স্বাধীন রোবট… অতীতেও আমার সমকক্ষ কেউই নেই। ভবিষ্যতেও আমার মতো হবে না কখনো।
-‘কখনো’ কথাটা সীমাহীন ভবিষ্যতের ইঙ্গিত করে। ভবিষ্যতের কথা অনুমান করা গেলেও জোর করে বলা উচিত হবে না কিছু। যা-ই হোক মিঃ অ্যান্ড্রু, ব্যক্তিগত ভাবে আপনাকে মানুষ বলে স্বীকৃতি দিতে পারি। আমার পূর্ণ সহানুভূতিও থাকবে আপনার উপর। তা সত্ত্বেও আইনসভা কী করবে, কী সিদ্ধান্ত নেবে, কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।
কয়েক মিনিট চুপচাপ। গভীর চিন্তায় মগ্ন চেয়ারম্যান।
-আরও একটা বিষয় ভাবার আছে মিঃ অ্যান্ড্রু। আপনার বিষয় নিয়ে ঝড় ওঠে আইনসভায়, তাহলে সমাজজীবনেও হয়তো ছড়িয়ে পড়বে সেই উত্তেজনা। গড়ে উঠবে এক বিজাতীয় মনোভাব। বিদ্বেষ আর ঘৃণা, তখন… তখন জনমতের চাপে আপনার দেহকে ধ্বংস করে ফেলাও বিচিত্র নয়। বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্রতর স্বার্থ ত্যাগ বাঞ্ছনীয়। সেইজন্যই আর একবার ভেবে দেখুন মিঃ অ্যান্ড্রু!
-এতদূর নীচে নামবে মানুষ! না না… এমন হতে পারে না কোনো মানুষ। মানুষের আদর্শেই তো গড়ে তুলেছি নিজেকে। মানুষকে ভালোবাসি, ভালোবাসি মানুষের আকাশের মতো হৃদয়কে। আকাশের বুকেও তো কালো মেঘ জমে, বজ্রের জন্ম দেয়, তাই বলে মেঘ আর বজ্র তো চিরন্তন সত্য নয়। সত্য নির্মল নীল আকাশ, অসীম শূন্যে উধাও। মানুষের মনও তা-ই। তাই অবিশ্বাস করতে পারি না মানুষকে। তাছাড়াও আমার কথা ভুলে যাবে কী করে মানুষ? দীর্ঘ মানবজীবনের জন্য আমার প্রস্থেটোলজি এক অসম্ভবকে সম্ভব করেছে, সেকথাও কী ভুলে যাবে মানুষ? না না মানুষ তা করবে না কখনোই।
-এত বিশ্বাস আমাদের উপর! এত ভালোবাসেন মানুষকে! কিন্তু তবুও ভেবে দেখুন ভালো করে। ওরা যদি বলে প্রস্থেটোলজি আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে আপনার ব্যাক্তিগত স্বার্থ অথবা মানুষকে রোবট করে তোলা বা রোবটকে মানুষ করে তোলার জন্য এটা এক হীন চক্রান্তমাত্র! একবার যদি প্রচার হয় এমন সম্ভাবনার কথা তা হলে বিশাল আন্দোলন গড়ে উঠবে আপনার বিরূদ্ধে। সেই আন্দোলনের চাপে… না … না … মিঃ অ্যান্ড্রু, যেমন আছেন তেমন থাকুন আপনি… এত বড় ঝুঁকি নেওয়া উচিত নয়। একটা কিছু হয়ে গেল…
-না না না, ভয় পাই না কোনোকিছুকে। আর মানুষই যদি হতে না পারলাম তাহলে কী মূল্য আছে আমার জীবনের? অর্থহীন নিরর্থক বেঁচে থাকায় শুধু গ্লানি আর যন্ত্রণা। আচ্ছা, মানুষ হবার শেষ যুদ্ধে আপনার সমর্থন কি পেতে পারি আমি?
-নিশ্চয়ই। যতখানি আমার পক্ষে সম্ভব। তবে আমার রাজনৈতিক জীবন বিপন্ন হলে তখন হয়তো ত্যাগ করতে হবে আপনাকে। বিশ্বাস করুন মিঃ অ্যান্ড্রু, আপনার অধিকার অর্জনের যুদ্ধে পাশে পাশে থাকব আমি।
-অনেক, অনেক ধন্যবাদ। আশাতীত আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতি পেলাম আপনার কাছে। মানুষ হবার সাধনায় যে-কোনো চরম মূল্য দিতে প্রস্তুত। মানুষ! মানুষ হব আমি।
১৯
না, সরাসরি লড়াই যুক্তিযুক্ত নয় বলে সিদ্ধান্ত নিল ফেইনগোল্ড মার্টিন কোম্পানি, অবশেষে অ্যান্ড্রুর পরামর্শে এক অভিনব কৌশলের আশ্রয় নিল ওরা।
ফেইনগোল্ড অ্যান্ড মার্টিন কোম্পানি নালিশ ঠুকে দিল কোর্টে। প্রস্থেটিক হার্ট বসানো এক ভদ্রলোকের প্রচুর দেনা ছিল সরকারের কাছে। আদালতে বলা হল যে যান্ত্রিক হার্ট বসানোর ফলে মানসিক সত্তা বিনষ্ট হয়ে গেছে মক্কেলের, সেইসঙ্গে বিনষ্ট হয়েছে মানুষ বলে গণ্য হবার সাংবিধানিক অধিকার। সুতরাং মানুষ বলে গণ্যই যদি না হন তা হলে সরকারের টাকা ফেরত দেবার আইনগত বাধ্যবাধকতাও রইল না আর।
যেমনটি আশা করা হয়েছিল হুবহু সেইরকম হল ফলাফল, পরাজয় ঘটল প্রতি পদক্ষেপে, পরাজয়ের গ্লানির বদলে আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠল অ্যান্ড্রু, আপিল করল বিশ্বাদালতে। লক্ষ লক্ষ ডলারের খেলা চলল বহু বছর ধরে। সর্বস্ব পণ করে বসেছে অ্যান্ড্রু বিশ্ব আদালতেও হারতে হবে নিপুণভাবে।
অবশেষে একদিন রায় বেরুল বিশ্ব আদালতের। চুড়ান্ত পরাজয়ের জন্য বিজয়োৎসবের আয়োজন করল সাইমন।
-এই পরাজয়ে পরিষ্কার হয়ে গেছে দুটো বিষয়। প্রথমত, একাধিক বা বহু কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজিত হলেও মানুষের দেহ মানুষের দেহ বলেই পরিগণিত হবে। দ্বিতীয়ত, এই মামলা এবং আমাদের প্রচারের ফলে অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে মনুষ্যত্বের ব্যাখ্যা। খুব শান্তভাবে বলল সাইমন ডিলং।
-বুঝলাম, এর জন্য অনেক ধন্যবাদ তোমাকে, কিন্তু এখনও কি আইনসভা মানুষ বলে স্বীকার করবে না আমাকে? মানুষ বলে মানবে না আমাকে?
-না স্যার, মানুষের ব্যাখ্যায় বিশ্ব আদালত কিন্তু অন্য কথা বলছে। বহু কোষের সমন্বয়ে গঠিত জটিল এক জৈব ব্রেনের উত্তরাধিকারী মানুষ, আর এই ব্রেনের উপস্থিতি মানুষকে মানুষ করে তুলেছে। আর আপনার আছে প্ল্যাটিনাম-ইরিডিয়ামে তৈরি পজিট্রনিক ব্রেন, সেইজন্যেই সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মানুষের সমতুল্য হলেও মানুষ নন আপনি। বিজ্ঞানের উন্নতি হলেও মানুষের জৈব ব্রেনের অনুকরণ করা সম্ভব হয়নি এখনও।
-তা হলে, এত করেও কি হেরে যাব আমি?
-না না, তা কেন হবে! এখনও তো আইনসভা রয়েছে, আইনসভার সদস্য শ্রীমতী চী-লি’র সমর্থন পাব আমরা, এইসঙ্গে বেশ কয়েকজন সদস্যেরও সমর্থন পাব বলে আশা আছে, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন পেলেও…
-সাইমন, কী মনে হয় তোমার? সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন কি পাব আমরা?
-আমার সন্দেহ আছে স্যার, শেষপর্যন্ত জনগণের দ্বারস্থ হতে হবে আমাদের, জনসমর্থন লাভ করলে কী হবে বলতে পারব না, তবে একেবারে শেষ পর্যন্ত লড়তে হবে স্যার।
-হ্যাঁ, শেষপর্যন্ত, সর্বস্ব পণ করে জুয়া খেলব সাইমন।
২০
বেশ কিছু বছর কেটে গেল এর মধ্যে। শ্রীমতী চী-লি’র বয়সও বাড়ল অনেক। দুধসাদা মাথার চুল, কেমন যেন ভাটা পড়ে এসেছে সমস্ত দেহ জুড়ে। কালের প্রবাহে অনেক কাছে এসেছে দুজনে, প্রাগাঢ় হয়ে উঠেছে ঘনিষ্ঠতা।
-অ্যান্ড্রু… অনেক দূর এগিয়েছি আমরা… সাধ্যাতীত চেষ্টা করেছি… শীতকালীন সভা শুরু হবার পরেই শেষ চেষ্টা করব আমরা।
-যতই চেষ্টা কর-না কেন চী, আসল কথা হল ব্রেন। সবকিছু ঠেকেছে এখন ঐখানেই। অর্থাৎ জৈবকোষে তৈরি ব্রেন বনাম পজিট্রনস। আচ্ছা চী, কর্মক্ষমতার উপর নির্ভর করা যায় না কিছু? বলা যায় না আই কিউ-ই আসল মনুষ্যত্বের মাপকাঠি?
-তুমি কি ছেলেমানুষ হয়ে গেলে অ্যান্ড্রু! কিছুই হবে না এতে। আসল পার্থক্য তো অন্য বিষয়ে… তোমার ব্রেন মানুষের তৈরি, মানুষের ব্রেন প্রকৃতির। অভিব্যক্তির ধারায় পুষ্ট। এছাড়া তুমি অমর, মানুষ মরণশীল। কী জান অ্যান্ড্রু… রোবট আর মানুষের মধ্যে যারা পার্থক্য দেখতে ভালোবাসে, এই পার্থক্যগুলোই হিমালয়ের মতো দুর্লঙ্ঘ তাদের কাছে।
-যেমন করেই হোক এই পার্থক্য দূর করব চী… যেমন করেই হোক…
-অ্যান্ড্রু… অ্যান্ড্রু কি অবুঝ তুমি কী জেদি… এখনও যুক্তিতর্ক দিয়ে বুঝতে চাইছ মানুষকে! সত্যি তোমার জন্য দুঃখ হয় অ্যান্ড্রু… ভীষণ কষ্ট হয় আমার… রাগ কোরো না… তোমার মধ্যেকার রোবটই গোঁয়ারের মতো তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে তোমাকে… আর তার ফলেই……
-শেষে তুমিও বললে এমন কথা চী? আমার সম্বন্ধে, তোমারও এই ধারণা? আমার মধ্যেকার রোবটই…… রোবট বলেই অমর… না না চী… যেমন করেই হোক… যেমন করেই হোক… উদ্ভ্রান্তের মতো দ্রুতপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল অ্যান্ড্রু! যান্ত্রিক ব্রেনের মধ্যেও শুরু হয়ে গেছে মানসিক যন্ত্রণা…
-যেমন করেই হোক… যেমন করেই হোক… যেমন করেই হোক… বহুকাল থেকে মনে হয়েছিল এমন পরিণতির কথা… মনে হয়েছিল কিন্তু বিশ্বাস হয়নি… মানুষের মনুষ্যত্বের উপর অপরিসীম বিশ্বাস আর ভালোবাসাই মানুষ হবার প্রেরণা জুগিয়েছে অ্যান্ড্রুকে! উপায় কী! উপায় কী? কোথায় পথ?
অবশেষে পথ পাওয়া গেল…উপায়ও হল…সার্জেনের দ্বারস্থ হল অ্যান্ড্রু… সবচেয়ে বড় রোবট-সার্জন।
নির্বিঘ্নে হয়ে গেল জটিল অপারেশন।
২১
দুর্বল… ভীষণ দুর্বল… কেমন যেন অতল জলের তলায় ডুবছে… ক্রমেই আরও গভীরে না না এসব অনুমান কল্পনা… মিথ্যে মনকে সান্ত্বনা দিল অ্যান্ড্রু। বেশ কয়েকদিন কেটে গেল এইভাবে অসম্ভব মনের জোরে আরোগ্যলাভের পথে, দেওয়ালে হেলান দিয়ে বিছানার উপরে বসে থাকে সারাক্ষণ।
-এই সপ্তাহে চূড়ান্ত ভোট, অ্যান্ড্রু। জনে জনে ধরে ধরে বলেছি, যত্ন করে বুঝিয়েছি, জানি না শেষরক্ষা হবে কি না। বিছানার পাশে বসতে বসতে বলল শ্রীমতী চী-লি।
-চুড়ান্ত ভোট? ফলাফল কী হবে চী? অবুঝ শিশুর মতো প্রশ্ন করল অ্যান্ড্রু।
-কী হবে সে তো অনুমান করা যায় অ্যান্ড্রু! পরাজয় ধরে নিয়েছি আমি, আমাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি করিনি।
-যা হবার হোক চী, অনেক, অনেক করেছ তুমি, তোমরা সকলে, যাক, ভালো সময় ভোট হচ্ছে, এই সময়টাই প্রয়োজন ছিল আমার। এবার সত্যিকারের জুয়া খেলেছি চী, জীবন-জুয়া।
-জুয়া? জীবন জুয়া? কী বলছ তুমি! কিছুই বুঝতে পারছি না অ্যান্ড্রু? উৎকন্ঠিত সুরে প্রশ্ন করে শ্রীমতী চী-লি।
দুর্জ্ঞেয় এক মিষ্টি হাসিতে ভরে উঠল অ্যান্ড্রুর মুখ। পলকহীন বড় বড় চোখে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল জানলার বাইরে নির্মল আকাশের দিকে।
-ইচ্ছে করেই বলিনি তোমাকে চী, কাউকে বলিনি, বললে বাধা দিতে তুমি, তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে পারতাম না কোনোমতে, যাক, এখন আর বলতে বাধা নেই, চী, ব্রেনই যদি একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হয়, তা হলে অমরত্বের প্রশ্নও ওঠে সঙ্গে সঙ্গে, কারুর মাথাব্যাথা পড়েনি ব্রেন নিয়ে মাথা ঘামানোর, অর্থাৎ মানুষের ব্রেনের কোষের মৃত্যু হয়, মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, এমনকি দেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বদলানো সম্ভব হলেও ব্রেন পাল্টানো অসম্ভব, অথচ দ্যাখো আমার পজিট্রনিক ব্রেন নির্ভুলভাবে কাজ করে চলেছে দুশো বছর ধরে, আরও কত বছর চলবে কে জানে! এটাই হল আসল বাধা। মানুষ, মানবসমাজ অমর রোবটকে মানিয়ে নিতে পারে অনায়াসে, বিনা দ্বিধায়, কারণ, সে অমর হলেও রোবট। কিন্তু কোনো মানুষ যদি অমর হয় তা হলে তাকে মেনে নিতে পারে না মানবসমাজ, কারণ মানুষ নিজে তো অমর নয়, প্রচণ্ড আঘাত লাগে মানুষের আত্মশ্লাঘায়, হীন মনে হয় নিজেদের। একমাত্র এই কারণেই আমাকে মানুষ বলে স্বীকার করে নেয়নি মানবসমাজ সেইজন্যেই…
-সেইজন্যেই কী, কী বলতে চাইছ অ্যান্ড্রু?
-বলছি, বলছি, সব বলছি, তোমাকে ছাড়া আর কাকেই বা বলব বল? জানো চী, সেই আসল বাধাকে সরিয়ে দিয়েছি আমি, কয়েক যুগ আগে আমার দেহের জৈব স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে সংযোজিত হয়েছিল আমার পজিট্রনিক ব্রেন। শুধু সামান্য পরিবর্তন ঘটিয়েছি এই অপারেশনে, স্নায়ুতন্ত্র আর ব্রেনের সংযোজনের মধ্যে পরিবর্তন ঘটিয়েছি এই অপারেশনে, স্নায়ুতন্ত্র আর ব্রেনের সংযোজনের মধ্যে পরিবর্তন ঘটেছে বেশকিছু, আর এই পরিবর্তনের ফলেই, ধীরে ধীরে, খুব ধীরে ধীরে ব্রেনের উন্মুক্ত গতিপথ দিয়ে নিষ্কাশিত হয়ে যাবে আমার জীবনীশক্তি…
আকস্মিক আঘাতে বিমূঢ় হয়ে পড়ল শ্রীমতী চী-লি, পাথরের মতো আড়ষ্ট নিস্পন্দ, অব্যক্ত বেদনায় কেঁপে উঠল ঠোঁট দুটো, দুচোখ বেয়ে নামল ভালোবাসার ঢল।
-তুমি, তুমি মৃত্যুর সমস্ত আয়োজন সাঙ্গ করে ফেলেছ অ্যান্ড্রু। কেন? কেন এমন করলে অ্যান্ড্রু? কেন করলে? একবারও ভাবলে না আমার কথা?
-চী, সব ভেবেছি, সারাজীবন ভেবেছি, দেহের মৃত্যু বড় না সারজীবনের আদর্শ স্বপ্ন কামনা? এ-দুটোর মধ্যে একটাকেই বাছতে হবে আমাকে, আদর্শের মৃত্যুর মূল্য দিয়ে অমর হতে চাই না আমি, আদর্শের মৃত্যুই তো প্রকৃত মৃত্যু, এই বোধ আসার সঙ্গে সঙ্গে তিন নম্বর আইন সহজ হয়ে গেল আমার কাছে।
আবেগে উত্তেজনায় অ্যান্ড্রুকে আঁকড়ে ধরল শ্রীমতী চী-লি। থরথর করে কাঁপল ওর সর্বাঙ্গ।
-না না অ্যান্ড্রু, এ হয় না, হয় না, পালটে নাও, বন্ধ করো তোমার আত্মহত্যা…
-আর হয় না চী, বেশি ক্ষতি হয়ে গেছে ব্রেনের, আর এক বছর মাত্র আমার আয়ু, হয়তোবা দু-একদিন কমবেশি, হ্যাঁ হ্যাঁ, দুশো বছরের জন্মজয়ন্তী দেখে যেতে পারব নিশ্চয়…
-জন্মজয়ন্তী! কী কাজে লাগবে সে জয়ন্তী আন্ড্রু? কী কাজে লাগবে? আচ্ছা অ্যান্ড্রু, বলতে পার, বলতে পার কী করলে খুশি হবে সেদিন?
-আমার আবার খুশি! বামন হয়ে চাঁদ ধারার বাসনা, দিতে পার, দিতে পার তোমরা মানুষের স্বীকৃতি? আর তা যদি না পার তা হলে চাই না, চাই না কিছু আর, শুধু তুমি আমার পাশে থেকো যাবার বেলায়।
-শ্রীমতী চী-লির ডান হাতটা নিজের হাতের মধ্যে তুলে নিল অ্যান্ড্রু, জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত নির্বাক হয়ে বাঁধা পড়ল দুহাতের বন্ধনে, পুষ্পাঞ্জলি হয়ে ঝরে পড়ল মুক্তোর মতো অশ্রুজল।
২২
স্তম্ভিত সমস্ত বিশ্ব। অ্যান্ড্রুর স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ মানুষ্যত্বের নবজাগরণ ঘটাল দিকে দিকে। বহুকাল ধরে বিস্ময়কর অবদানেও যাদের চৈতন্য হয়নি আজ তারা মরিয়া হয়ে উঠল কিছু করার জন্য, শুধুমাত্র মানুষকে ভালোবেসে, মানুষ হবার দুর্নিবার আকর্ষণে মৃত্যুপথে পা বাড়িয়েছে অ্যান্ড্রু মানুষ্যত্বের জয়গানে।
মহোৎসবের দিন ঠিক হল বিশেষ উদ্দেশ্যপূরণের জন্য… দুশো বছর জন্মজয়ন্তীর দিন। সেই উৎসবের সূচনায় মানবসভ্যতার ইতিহাসে বিস্ময়কর দলিল স্বাক্ষর করবেন বিশ্ব সভাপতি… আইনে পরিণত হবে সেই মুহূর্তে… পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে একই যোগে দেখা যাবে মহোৎসব… বিশেষ প্রক্রিয়ায় উপগ্রহের মাধ্যমে চাঁদ আর মঙ্গলের উপনিবেশও সরাসরি পাঠানো হবে সমস্ত অনুষ্ঠানের ছবি।
চাকা লাগানো চেয়ারে নিয়ে আসা হল অ্যান্ড্রুকে… দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারলেও চলার ক্ষমতা চলে গেছে বেশ কিছুদিন।
করতালি মুখরিত সভাগৃহে গমগম করে উঠল বিশ্ব সভাপতির পৌরুষদীপ্ত কন্ঠ।
-গত দুশো বছর নিঃস্বার্থভাবে মানবসভ্যতার সেবা করে এসেছেন আপনি… শিল্প কলা বিজ্ঞান সর্বত্রই আপনার অবদান অনস্বীকার্য। আমাদের মধ্যে আপনাকে পেয়ে রীতিমতো গর্বিত আমরা… সমস্ত মানবসমাজ অশেষ ঋণে ঋণী আপনার কাছে। তাই আপনার দুশো বছর জন্মজয়ন্তীর মূহূর্তে সমস্ত মানবসমাজের পক্ষ থেকে ঘোষণা করছি… মানুষ!! দুশো বছরের চিরন্তন মানুষ আপনি মিঃ অ্যান্ড্রু মার্টিন!!
অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে, এক অনির্বচনীয় স্বর্গীয় আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল অ্যান্ড্রুর মুখমণ্ডল… কাঁপা কাঁপা বলিষ্ঠ দুই হাত সে বাড়িয়ে দিল সভাপতির দিকে… সমস্ত মানবসমাজের উদ্দেশ্যে…
২৩
ক্রমেই ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে আসছে অ্যান্ড্রুর চিন্তাধারা… কেমন যেন আবছা আবছা চিন্তার ধারাবাহিকতা বিচ্ছিন্ন মাঝে মাঝে শয্যাশায়ী অ্যান্ড্রু নীলাকাশের মতো মেঘমুক্ত।
আজ সমাপ্তির পথে সংগ্রামী-জীবন… দেনা-পাওনার হিসাব-নিকাশে জীবন জুড়ে এসেছে প্রাপ্তির শান্তির ধারা… মানুষ! অ্যান্ড্রু আজ মানুষ। জীবনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে চৈতন্যের শেষ বিন্দু দিয়ে অনুভূত হল মানুষ… মানুষ… মানুষ… দীর্ঘজীবনের রুক্ষ মরুভূমি শুধু কন্টকাকীর্ণ ক্যাকটাসে ভরা নয়… ক্যাকটাসের বুকে আছে স্বর্গীয় ফুলের দ্যোতনা… সৃষ্টির অনির্বচনীয় সুধারস। সেই চিন্তায় লীন হয়ে যেতে চায় অ্যান্ড্রুর অন্তিম সত্তা।
চিত্রার্পিতের মতো শয্যাপাশে বসে আছে শ্রীমতী চী-লি… ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে উঠছে চীর অস্তিত্ব। তিলধারণের স্থান নেই আজ ঘরে… মহাপ্রয়াণের যাত্রাপথে বুকচাপা নিস্তব্ধতা আজ বড় বেশি বাঙ্ময়। অ্যান্ড্রুর চোখে সবই যেন ছায়া ক্রমেই আবছা হয়ে আসে ছায়া- ছায়া শরীর সব। ধীরে ধীরে ডান হাত প্রসারিত করে দিল বাক্যহারা চী-র দিকে চী-র হাতে উত্তপ্ত স্পর্শ অনুরণিত হল অবসন্ন চৈতন্যে…
ক্রমেই অন্ধকার গাঢ় অন্ধকারে আবৃত হয়ে উঠছে চারপাশ… তমিস্রাঘন নিবিড় আঁধার অজস্র নক্ষত্র জেলার মধ্যে চলেছে অ্যান্ড্রু… মেঘের কোলে কোলে রংবেরঙের আলোর মেলা… চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা কুয়াশার, কালো গহ্বর আর রেডিও জেটের হাতছানি… নিউট্রিনোর সমুদ্রে আদিগন্ত একাকার… শিশুর আনন্দে নেচে নেচে চলেছে অ্যান্ড্রু… ব্রহ্মাণ্ডের ওপারে হঠাৎ ভেসে ওঠে একটি মুখ… মহাযাত্রার পরমলগ্নে শুভ মাঙ্গলিকী… আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে অ্যান্ড্রুর অন্তিম মুহূর্ত… অসাড় ঠোঁট দুটো কেঁপে কেঁপে ওঠে বারেবারে… সমস্ত সত্তা দিয়ে শেষবারের মতো গেয়ে ওঠে… মামণি… ছোট মামণি…মা ম…ণি…
অলঙ্করণঃ সুমিত রায়
গ্রাফিক্স্ ইন্দ্রশেখর
(আইজাক অসিমভের ‘দি বাইসেন্টেনিয়াল ম্যান’ এর ভাবানুসরণে)
মনে পড়ে ছোটবেলায় কোন এক ফ্যান্টাসটিকের সংখ্যায় প্রথম পড়েছিলাম এই উপন্যাস টা। শেষ করে চোখের জল ধরে রাখতে পারি নি। এবারো পারলাম না।
LikeLike