উপন্যাস সোমু ও তার প্রফেসর দাদাই সঞ্জয় মণ্ডল শীত ২০১৯

সোমু ও তার প্রফেসর দাদাই

সঞ্জয় মণ্ডল

এক

গাঢ় সবুজ রঙের সামুদ্রিক মাছের মতো মহাকাশযানটা দুরন্ত গতিতে নিকষ কালো অন্ধকার ফুঁড়ে সামনের দিকে ছুটে চলেছে। হঠাৎই দূরে একটা আবছা নীল রঙের বিন্দু দেখা গেল। বিন্দুটা খুব দ্রুত বড়ো হচ্ছে। আরও বড়ো হচ্ছে। মহাকাশযানের ককপিটের প্যানেল বলছে আর মাত্র দেড় লক্ষ মাইল দূরে নেপচুন গ্রহ রয়েছে। অন্য একটি প্যানেল দেখাচ্ছে মোটামুটি কুড়ি থেকে ত্রিশ মিনিটের মধ্যে সেখানে পৌঁছে যাওয়া যাবে। অতএব আর মাত্র আধঘণ্টার মধ্যে এই ব্রহ্মাণ্ডে এক বিস্ময়কর ইতিহাস তৈরি হতে চলেছে সোমু স্যান্যালের হাত ধরে। মহাকাশযানের ককপিটে একা বসে থাকতে থাকতে সোমু পলকে পলকে শিহরিত হয়ে উঠছিল। সে ভাবতে চেষ্টা করছিল কীভাবে তার এই মহাকাশযান পৃথিবী থেকে যাত্রা শুরু করে মাত্র একবছর সাতদিনের মাথায় নেপচুনের মাটিতে পা দিতে চলেছে।

প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। মহাকাশযানের স্বচ্ছ জানালার ওপারে নেপচুনের স্থলভাগ দেখা যাচ্ছে। হালকা নীল রঙের মাটি? নাকি পুরোটাই নীল বরফে ঢাকা? অনেক ধরনের নীল মিলিয়ে মিশিয়ে রয়েছে মনে হচ্ছে। আকাশি নীল, গাড় নীল, হালকা নীল কিংবা সামুদ্রিক নীলের ছোপ মিলেমিশে একাকার। দূর থেকে গ্রহটাকে অনেকটা ময়ূরের ডিমের মতো দেখতে লাগছে। আচ্ছা, নেপচুনেও কি মাটি পাওয়া যাবে? পৃথিবীর উপরিভাগকে তো মাটি বলে। এখানে স্থলভাগ কী দিয়ে তৈরি সেটা অবিলম্বে পরীক্ষা করে দেখা দরকার। পরে ভেবেচিন্তে দেখা যাবে নতুন কিছু নাম দেওয়া যায় কি না।

একদম কাছাকাছি চলে এসেছে। সোমু মহাকাশযানের গতি কমিয়ে আনল। যানের আটখানা যন্ত্র-পা আস্তে আস্তে পেট থেকে বেরিয়ে আসছে। এই… এইমাত্র মহাকাশযানের পাগুলো একই সাথে, একই মুহূর্তে নেপচুনের মাটিতে পা ফেলতে যাচ্ছে…

সঙ্গে সঙ্গে সোমু একটা বিরাট চিৎকার শুনতে পেল। শব্দটা যেন চারপাশ থেকে অক্টোপাসের মতো তার মহাকাশযানের দিকে ধেয়ে আসছে। সোমু কান খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করল। এবার সোমু স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। ডাকাত, ডাকাত… ডাকাত পড়েছে…

প্রচণ্ড ভয় পেয়ে সোমুও সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল। “নেপচুনে ডাকাত পড়েছে, নেপচুনে ডাকাত…”

চেঁচিয়ে ওঠার সাথে সাথে ঘুমটা ভেঙে গেল।

চোখ খুলেই সোমু দেখল বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে ঠেলতে ঠেলতে দিম্মা তখনও চেঁচিয়ে যাচ্ছেন, “ওরে সোমু, তাড়াতাড়ি ওঠ, ডাকাত পড়েছে, ডাকাত…”

সোমু চোখ খুলতেই দেখল তার মাথার পেছনে পুবদিকের জানলা থেকে আলো এসে বিছানা ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আর দিম্মা তখনও চেঁচিয়ে যাচ্ছেন, “ওরে সোমু ওঠ, ডাকাত পড়েছে…”

সোমুর বড্ড রাগ হল। “দিলে তো তুমি আমার নেপচুনের অভিযানটা ভণ্ডুল করে! মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য নেপচুনে নামা হল না।”

“ওরে খেপচু, তুই নেপচুনে গিয়ে কী করবি? এদিকে ডাকাত পড়েছে যে!”

সোমু বিড়বিড় করতে শুরু করল। “কী গো দিম্মা, এই সাতসকালে কোথায় ডাকাত পড়েছে? দাদাইয়ের মতো তোমার মাথাটাও কি খারাপ হয়ে গেল নাকি? এ কাদের নিয়ে যে সংসারে থাকব জানি না। নাহ্‌, এবার এ বাড়িতে একটা মামিমা আনতেই হচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি হোক। মামা আজ অফিস থেকে ফিরুক। আজই এর একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে। বুঝলে দিম্মা?”

দিম্মা একটু মুচকি হেসে বললেন, “তুই তো আর বিয়ে করছিস না। তোর মামাকে বলে দেখ কী বলে।”

দুই

গতকাল রাত্রে ঋকের জন্মদিন ছিল। সোমু দিম্মাকে বলে রেখেছিল যে বাড়ি ফিরতে দেরি হবে না, তবুও দেরি হয়ে গিয়েছিল। সোমু বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গেলে দিম্মাকে তখন একা একা বাড়িতে বসে থাকতে হয়। এদিকে সন্ধে হবার পর সোমু কাছাকাছি না থাকলে দিম্মা আবার মাঝে মাঝে ভূতের ভয় খান। মামা তো সেই কোন সকালে অফিসে চলে যায়। অনেক রাত্রি করে বাড়ি ফেরে। তাই সারাদিন দিম্মা সোমুর জিম্মাতেই থাকে।

বাড়িতে অবশ্য আরেকজন থাকেন, তবে দিম্মা তাঁকে বিশেষ ধর্তব্যের মধ্যে রাখেন না। তিনি সোমুর দাদাই। দাদাইয়ের কথা না হয় ছেড়ে দেওয়াই গেল। দিম্মা বলেন, পঁয়ত্রিশ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর পরেও এখনও দাদাই পড়াশোনা ছাড়তে পারলেন না। ভাবলেই ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত লাগে সোমুর। স্কুলের বইগুলো একবছর ধরে পড়তে পড়তে পরীক্ষার আগে কেমন যেন বিরক্ত এসে যায়। তাহলে দাদাই সারাদিন এতসব কী পড়েন? অবশ্য দাদাইকে বছরের শেষে কোনও পরীক্ষা দিতে হয় না। সোমু বিকেলবেলা মাঠে খেলতে গিয়ে দেরি করে ফিরলে দিম্মা তাকে হাতমুখ ধুয়ে তক্ষুনি পড়তে বসতে বলেন। অথচ দাদাই বেশিক্ষণ পড়াশোনা করলে মাঝে মাঝে বেদম রেগে যান। ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হয় না সোমুর। এদিকে দাদাই বছর খানেক আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়েছেন। এখন কিছুদিন হল বাড়িতে ছাত্রছাত্রীদের পড়তে আসার ভিড় একটু কম থাকে। আগে সকাল-বিকেল এত ছাত্রছাত্রী পড়তে আসত যে, তাদের যাতায়াত করার জন্য দিম্মা বাড়ির পেছনে বাগানের ভেতর দিয়ে একটা দরজা পর্যন্ত তৈরি করে দিয়েছিলেন। এখনও বাইরের লোক এলে সেই দরজা দিয়ে ঢুকে সোজা দোতলায় দাদাইয়ের কাছে চলে যান।

মাস খানেক হল সারাদিন দাদাই পারতপক্ষে দোতলা থেকে নামছেনই না। ঘরসুদ্ধু লোককে আগাম বলে রেখেছেন তিনি কী যেন একটা জরুরি গবেষণা করছেন। বিশেষ প্রয়োজন না হলে কেউ যেন অহেতুক তাঁকে ডাকাডাকি করে বিরক্ত না করে। একমাত্র সোমু এই নিয়মের বাইরে। যদিও সে সবসময় দাদাইকে বিরক্ত করতে যায় না। সোমু জানে কখন দাদাই বিশ্রাম নেয়। তখন দাদাইয়ের কাছে গেলে দাদাই মজার মজার গল্প বলেন। আগের দিন দাদাই নেপচুনের গল্পটা বলেছিলেন বলেই কিনা সারারাত ধরে নেপচুন অভিযানের স্বপ্ন দেখছিল!

সকালে ঘুম থেকে উঠেই দাদাই স্নান সেরে নেন। একটা ধোপদুরস্ত পাটভাঙা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে চা খেয়ে সোজা দোতলায় উঠে যান। এদিকে দিম্মার কোমরে ব্যথা। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় ওঠানামা করতে পারেন না। তাই মাঝে মাঝে দাদাইয়ের জলখাবার, ওষুধপত্র সোমুকেই দাদাইয়ের গবেষণাগারে পৌঁছে দিয়ে আসতে হয়। ব্যাপারটা একদিক থেকে বেশ ভালোই হয়েছে। দাদাই হাসতে হাসতে বলেন, “তোর দিম্মা দোতলায় উঠে এ ঘরের চৌকাঠে দাঁড়ালেই ভিরমি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে যেত আর আমার কাজও ভণ্ডুল করে দিত।”

অবশ্য দাদাইয়ের গবেষণাগার আর লাইব্রেরিতে ঢুকলে অচেনা লোকের ভিরমি খাওয়ার মতোই দশা হতে পারে।

দোতলায় দু’খানা ঘর। ঢুকতেই দাদাইয়ের লাইব্রেরি সহ পড়ার ঘর। দু-দু’খানা কাঁচের আলমারি বই আর ম্যাগাজিনে ভর্তি হয়ে গেছে কবেই। আরও অনেক বই আলমারির পাশে কয়েকটা বেঞ্চিতে উপচে পড়ে আছে। পড়ার ঘরে একটা ছোটো খাট আছে। দাদাই টেবিলে বসে কাজ করার সময় সোমু মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। দাদাইয়ের খেয়ালই থাকে না কে কখন ঢুকছে আর কে কখন বেরোচ্ছে।

পাশের ঘরেই দাদাইয়ের ল্যাবরেটরিতে ঢুকলে যে কেউ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। ঘরটার দরজার পাশ থেকে অন্য পাশের দেওয়াল পর্যন্ত লম্বা টেবিলটাকে দেখলে সোমুদের স্কুলের ল্যাবরেটরির মতো লাগে। যত রাজ্যের কাচের বোতল, জার, টেস্ট টিউব, ছোটো ছোটো বার্নার রাখা থাকে। লম্বা লম্বা পেট মোটা বোতলের ছিপি ফুঁড়ে কাচের পাইপ টেবিলের এদিক থেকে ওদিকে চলে গেছে। হরেকরকমের রঙিন জলে ভর্তি কাচের বোতল। দাদাই বলেন, ওগুলোতে নাকি বিষাক্ত সব রাসায়নিক আছে। তাই সোমুকে কাচের বোতলে হাত দিতে বারণ করে দিয়েছেন।

একদিন দাদাইয়ের হাত ফসকে ওইরকম একটা বোতল মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল। সেটা ভেঙে গিয়ে জলের মতো কিছুটা তরল ছিটকে এসে তার কয়েক ফোঁটা দাদাইয়ের হাতে পড়তেই সেখানে ফোস্কা হয়ে গিয়েছিল। দাদাই বলেছিলেন, ওটা নাকি একধরনের অ্যাসিড। দাদাই কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ছিলেন। সোমুকে অবশ্য হাতে ধরে অনেক যন্ত্রপাতির নাম শিখিয়েছেন। আজকাল দাদাই অবশ্য ল্যাবরেটরিতে থাকেন না বললেই চলে। সেখানে ঢুকলেই কেমন যেন পচা ডিমের মতো গন্ধ লাগে। তাই ল্যাবরেটরি সোমুর ভালো লাগে না। তার চেয়ে দাদাইয়ের কম্পিউটারগুলো অনেক ভালো। কী জানি কেন, কয়েক মাস হল ল্যাবরেটরিতে না গিয়ে দাদাই এখন সারাক্ষণ কম্পিউটারের সামনে বসে থাকেন।

দিম্মা কান্না কান্না সুরে গড়গড় করে কী যে বলে যাচ্ছিলেন, সোমু ঘুমের ঘোরে কিছুই বুঝতে পারছিল না। সোমুদের স্কুলে ইতিহাসের মাস্টারমশাই ঠিক ওইরকম জড়ানো জড়ানো গলায় তাদের পড়ান। ক্লাসে এসেই তিনি একটা পরিচ্ছেদের শুরু থেকে পাতার পর পাতা গড়গড় করে পড়তে থাকেন। কোনও দিকে না তাকিয়ে পড়তেই থাকেন। সোমুরা তখন কাগজের গোল্লা পাকিয়ে কিংবা এরোপ্লেন তৈরি করে ক্লাসের মধ্যে ছুড়তে থাকে। মাঝে মাঝে বেশি হট্টগোল করলে স্যার যদি কোনওদিন বকাবকি করেন তখন তারা খাতার পেছনের পাতায় কাটাকুটি খেলে। এদিকে মাস্টারমশাই নিজে নিজে পড়েই যান। যেদিন একটু দেরি করে ক্লাসে ঢোকেন সেদিন তিনি আরও দ্রুতগতিতে পড়তে শুরু করেন। ঘণ্টা পড়ার আগে পড়া শেষ হলে ভালো, না হলে যতদূর তিনি পড়তে পেরেছেন ততখানি পর্যন্ত বাড়ির জন্য পড়া দেওয়া থাকে।

দিম্মা যখন দুশ্চিন্তা করেন তখন তাঁর কথাগুলো কেমন যেন জড়িয়ে যায়। সোমুর খাটের পাশে বসে সোমুকে ঠেলতে ঠেলতে তিনি কী যে বলে গেলেন তার সবকিছু সোমু ঘুমের ঘোরে বুঝতেই পারল না। শুধু শুনতে পাচ্ছে, “এই সোমু, ঘুম থেকে ওঠ এবার। সব্বোনাশ হয়ে গেছে। চুরি হয়ে গেছে সব।”

সোমু প্রথমে বুঝতে পারেনি। ধড়ফড় করে উঠে ভাবল দাদাইয়ের আবিষ্কার করা কোনও ফর্মুলা চুরি হয়ে যায়নি তো! সোমু জানে, অনেক গোয়েন্দা গল্পে সে পড়েছে, বিদেশি দেশের গুপ্তচরেরা এদেশে এসে দামী দামী ফর্মুলা চুরি করে নিয়ে বিদেশে চলে যায়।

চোখে জলের ঝাপটা নিয়ে আসার পরে দিম্মা বললেন, পাশের সেনদাদুদের বাড়িতে কাল রাত্রে নাকি সবকিছু চুরি হয়ে গেছে। ঘুম ভাঙার পরে প্রথম কয়েক মিনিট এমনিতেই সোমুর মাথায় সবকিছু যেন তালগোল পাকিয়ে থাকে। কোথায় যে সে এখন আছে, সেখানে দিন না রাত্রি, সোমুর সামনে কে বসে আছে এসব বুঝতে পারলে তবেই সে চোখ খোলে। চোখ খুলে দেখল দিম্মা কাঁদো কাঁদো মুখ করে সোমুর সামনে বসে আছেন। বাঁহাতে এক গ্লাস দুধ জাতীয় কিছু আর ডানহাতে চারখানা বিস্কুট। এটা সোমু বিছানায় বসে খাওয়া শেষ হলে তবেই সে বিছানা থেকে নেমে আসবে।

মিনিট খানেক পরে সোমু আশ্বস্ত হল যে চুরিটা তাদের বাড়িতে হয়নি। অবশ্য সোমুদের বাড়িতে চোর এসে পাবে কী! এমনিতে চুরি করার মতো কিছুই তো পাবেই না, উলটে তারা যদি দাদাইয়ের ল্যাবরেটরিতে ঢোকে তাহলে গন্ধের চোটে সেখানেই অজ্ঞান হয়ে যাবে। চোরেরা সব ধরা পড়ে যাবে।

দিম্মা কোনওরকমে বললেন, “এই সোমু, যা না, ছাদের দরজাটা বন্ধ আছে কি না একবার দেখে আয়।”

দুধ-বিস্কুট খাওয়ার পরেই সোমুর মাথার কলকব্জাগুলো সব চালু হয়ে যায়। সোমু এবার ফিক করে হেসে ফেলল। “দিম্মা, তুমি কী বলছ বলো তো! আরে বাবা, দরজা যদি রাত্রে খোলা ছিল, তাহলে এতক্ষণ দোতলার সবকিছু তো চুরি হয়েই গেছে। এখন দরজা বন্ধ করে কী হবে? আর দরজা যদি বন্ধ থাকে, তাহলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল! অতএব এখন দেখতে যাওয়া আর না যাওয়া একই ব্যাপার। ঠিক কি না বলো?”

“তবুও যা না একবার। দেখে আয় দাদা। আর দেখে আসিস তো তোর দাদাই কী করছে। টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল কি না। যদি আবার চা খেতে চায়, তাহলে আমাকে দোতলা থেকেই হেঁকে জানাস।”

সোমু উঠে দেখল ছাদের দরজা বন্ধই ছিল। সোমু ছাড়া ছাদে খুব একটা কেউ আসে না। শীতকালে দাদাইয়ের লেপ গরম করতে দেয় মামা। তাও ছুটির দিন। এছাড়া কে আর ছাদে আসবে?

ছাদে উঠে সোমুর বেশ ভালো লেগে গেল। ছাদের কার্নিশ থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখল সেনদাদুদের বাড়ির সামনে তখন লোকে লোকারণ্য। গেটের সামনে একজন পুলিশ লাঠি হাতে পাহারা দিচ্ছে পাড়ার লোকজন যাতে বাগানের ভেতর ঢুকে হট্টগোল করতে না পারে। সেনদাদু একটা চেয়ারে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। সামনে একজন পুলিশ অফিসার একটানা কিছু বলে যাচ্ছেন। কীসব কথা বলছে সেসব কিছুই এতদূর থেকে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না।

গেটের সামনে এত লোক আর পুলিশ রয়েছে যে গেট পেরিয়ে বাগানে ঢুকতে যাওয়া এখন মুশকিল। তাই সোমু নিজেদের ছাদ থেকে সেনদাদুর ছাদে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল। তারপর সিঁড়ি বেয়ে বাড়ির একতলায় নেমে এল। সেনদাদুদের ড্রয়িংরুমে তখন সেনদিম্মা আর পাড়ার আরও একজন কাকিমা বসে ছিলেন। সোমুকে কেউ লক্ষ করল না।

সোমু বাগানে গিয়ে পুলিশ অফিসারের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই সেনদাদু একটু হাসলেন। “এই যে সোমুদাদা, তুই কোথায় ছিলি এতক্ষণ! এক্ষুনি ঘুম থেকে উঠলি বুঝি!”

সেনদাদুর কথা শুনে পুলিশ অফিসার সোমুর দিকে একবার তাকিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশকাকুকে ধমক দিতে শুরু করলেন। “তোমাকে বললাম না এখানে এখন কাউকে ঢুকতে দেবে না! তাহলে এই ছেলেটা ঢুকল কী করে?”

সেনদাদু সোমুকে বড্ড ভালোবাসেন। সোমুকে কাছে টেনে নিয়ে পাশে দাঁড় করালেন। পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আরে, ও তো আমাদের সোমুদাদা।” সোমুদের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওই বাড়িতে থাকে। সোমু আমাদের দারুণ বুদ্ধিমান ছেলে।”

পুলিশ অফিসার একটু বোধহয় ঘাবড়ে গেলেন। বললেন, “ও, তাহলে এখানে এল কী করে?”

অফিসারের কথা শেষ হওয়ামাত্র সোমু আর সেনদাদু চোখে চোখে হাসলেন। সেনদাদু বললেন, “কেন! সোমুদের ছাদ থেকে আমাদের ছাদে লাফ দিয়ে চলে এসেছে। এ আর এমন কী ব্যাপার!” তারপর সোমুর দিকে একগাল হেসে বললেন, “হ্যাঁ রে সোমু, তুই কি কখনও গেট পেরিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছিস? আমার তো বাপু মনে পড়ে না।”

অফিসার সামান্য মুখ কুঁচকে ছাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বললেন, “আগে বলেননি তো আপনাদের ছাদ থেকে ওই ছাদে লাফানো যায়।”

“কেন? আপনি কি ভাবছেন ছিঁচকে চোরগুলো ছাদ পেরিয়ে এ বাড়িতে এসেছিল? তাহলে তারা অত কষ্ট করে রান্নাঘরের লোহার গ্রিল ভাঙতে যাবে কেন?”

“সেটা আমাদের চোখে ধুলো দেবার জন্যও হতে পারে।”

সেনদাদু একটু ভাবলেন। “তা কী করে হয়? আবার হতেও যে পারে না সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তাছাড়া ছাদের দরজা বন্ধ ছিল। আমি সকালে উঠে নিজের হাতে দরজা খুলেছি। আমার স্পষ্ট মনে আছে।”

অফিসার তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন। “ওই বাড়িতে একবার যেতে চাই। এই ছোকরা, আমার সাথে এসো তো একবার।”

সোমু রেগে গেল। বলল, “আমি মোটেই ছোকরা নই। আমার বয়স বারো বছর। ক্লাস সেভেনে পড়ি।”

অফিসার হেসে ফেললেন। “তাহলে কি খোকা বলব?”

“আমাকে সোমু স্যানাল বলতে পারেন।”

“ঠিক আছে। বেশ। জুনিয়র স্যানাল বলে ডাকব। তোমার বাড়িতে কে কে আছেন?”

“এখন দাদাই, দিম্মা আছেন। মামা অফিসে চলে গেছে। কিছুদিন পরে মামি আসবেন।”

“মামি কোথায় গেছেন?”

“কোথাও যাননি। এখন বাপের বাড়িতে থাকেন। বিয়ে হলে তবে তো এ বাড়িতে আসবেন!”

সেনদাদু আর অফিসার দু’জনেই জোর হেসে উঠলেন। “তাই তো। আমার তো জানা ছিল না যে মামার এখনও বিয়ে হয়নি।”

অফিসার সোমুর মতোই সেনদাদুদের ছাদ থেকে সোমুদের ছাদে লাফ দিয়ে উঠে এলেন। ছাদের চারদিকে একবার চক্কর কাটলেন। কার্নিশ থেকে মুখ বাড়িয়ে নিচের রাস্তার দিকে তাকালেন। বোধহয় সিঁড়ি জাতীয় কোনও কিছু দেওয়ালে লাগানো আছে কি না দেখছিলেন। আরে বাবা, চোরেরা কি সিঁড়িটাকে সেখানেই রেখে দিয়ে চলে যাবে নাকি! পাশাপাশি বাড়ির লোকজন যারা বাড়ির জানালা কিংবা ছাদ থেকে উঁকিঝুঁকি মারছিলেন তারা সকালবেলাতেই পুলিশ দেখে একটু অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দাঁত না দেখিয়ে হাসলেন।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে দোতলায় আসতেই সোমুরা দিম্মার মুখোমুখি পড়ে গেল। দিম্মাও হঠাৎ করে বাড়ির ভেতর পুলিশ দেখে হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। মলিমাসি নিশ্চয়ই এখনও কাজে আসেনি। নইলে মলিমাসিই দাদাইকে চা-জলখাবার পৌঁছে দিয়ে যায়। দিম্মার হাত থেকে চায়ের কাপটা আর একটু হলেই পড়ে যাচ্ছিল। ভয় পাবারই কথা। একজন অচেনা লোক, তায় পুলিশ, হঠাৎ করে দোতলায় সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সোমুকে দেখে বললেন, “অ তুই এখানে? তুই আবার সেনবাবুদের ছাদে ছাদে চরে বেড়াচ্ছিস বুঝি? ইনি কে?”

অফিসার জিজ্ঞাসু চোখে সোমুর দিকে তাকাতেই বলল, “আমার দিম্মা। দাদাই পাশের ঘরে বসে পড়াশোনা করছে।”

দিম্মা সঙ্গে সঙ্গে নালিশ করে ফেললেন। “বুড়ো দাদাই পড়তে বসে গেছে আর তুই এই ছাদ থেকে ওই ছাদে লাফিয়ে বেড়াচ্ছিস?”

“দিম্মা, তুমি আবার ভুলে গেছ। আমার যে পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। তাছাড়া দাদাই তো রিসার্চ করছে। তাই দাদাইকে পড়াশোনা করতেই হবে।”

অফিসার দিম্মার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যে কাল সেনবাবুদের বাড়িতে চুরি হয়ে গেছে। সেই ব্যাপারেই একটু খোঁজ নিতে এসে আপনাদের ছাদে গিয়েছিলাম।”

“সকালে উঠেই শুনেছি। এ পাড়ায় এর আগে কোনওদিন চুরি হয়নি। চোরেরা কি সবকিছু নিয়ে চলে গেছে?”

“কিছু জিনিসপত্র খোয়া গেছে বৈকি। তবে ছিঁচকে চোর। অনেক চেষ্টাচরিত্র করেও স্টিলের আলমারিটা খুলতে পারেনি। একটা ল্যাপটপ আর কিছু ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্র নিয়ে গেছে।”

দিম্মা একটু ভরসা পেলেন এই শুনে যে বেশি কিছু চুরি যায়নি। এদিকে সোমুর খুব খারাপ লাগছে যে সেনদাদুর ভালো ল্যাপটপটা চুরি হয়ে গেল। কয়েকমাস আগেই কিনেছিলেন। সোমুকে দেখিয়েছিলেন। সোমু সেনদাদুকে কয়েকটা কম্পিউটার গেমস খেলা শিখিয়ে দিয়েছিল।

দিম্মা সোমুর হাতে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিলেন। “যা, এটা তোর দাদাইকে দিয়ে আয়।” তারপর অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি বসুন, আমি চা নিয়ে আসছি।”

“আপনি একদম ব্যস্ত হবেন না, মাসিমা। আমি একটু আগেই ওঁদের বাড়িতে চা খেয়েছি। আপনি নিচে গিয়ে বসুন। আমি সোমুর দাদাইয়ের সাথে একবার দেখা করে আসি। কই হে সোমু স্যানাল, তোমার দাদাই কোথায়?”

দিম্মা সিঁড়ি ধরে একতলায় নেমে যেতেই সোমু দাদাইয়ের ঘরে এসে ঢুকল। দাদাই কম্পিউটারের সামনে বসে কিছু একটা টাইপ করছিলেন। সটান দরজার সামনে একজন পুলিশের পোশাকে কাউকে দেখে একটু হকচকিয়ে গেলেন। দাদাই সোমুদের দিকে মুখ ঘোরাতেই অফিসার আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলেন, “স্যার, আপনি? এটা আপনার বাড়ি!”

দাদাই তখনও ঠিকমতো বুঝতে পারেননি। তবে উঠে দাঁড়িয়েছেন। অফিসার ধুপ করে দাদাইকে একটা প্রণাম করে সোজা দাঁড়িয়ে বললেন, “স্যার, আমি দীপাঞ্জন। দীপাঞ্জন বোস।”

দাদাই হালকা হাসলেন। বোধহয় আবছা চিনতে পেরেছেন। “নব্বইয়ের ব্যাচ?”

“ঠিক ধরেছেন, স্যার।” মুখচোখ উজ্জ্বল করে অফিসার সোমুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “জানো, স্যার আমাদের কেমিস্ট্রি পড়াতেন। আমার অঙ্কে অনার্স ছিল। কী দারুণ পড়াতেন কী বলব।”

সোমু ভাবল, কেমিস্ট্রি পড়লে দাদাইয়ের মতো রিসার্চ করেন না কেন! কেমিস্ট্রি পড়ে পুলিশ হওয়া যায়! কী জানি।

দাদাই সামনের সোফায় বসতে বললেন। সেনবাড়িতে চুরির হয়ে যাওয়ার খবরটা দাদাই বোধহয় জানতেন না। পুলিশের মুখে শুনে বেশ অবাক হয়ে গেলেন।

একতলা থেকে দিম্মা ডাকতেই সোমু এক কাপ চা নিয়ে ফিরে এল। ততক্ষণে অফিসার উঠে পড়েছেন। “স্যার, আপনি কাজ করছিলেন। দুঃখিত, আমি এসে বিরক্ত করলাম। তবে না এলে আপনার সাথে এতদিন পরে দেখা হত না। আমি কি আপনাদের বাড়ির আশপাশটা একটু ঘুরে দেখতে পারি? বুঝতেই পারছেন চুরির তদন্তে সুবিধা হতে পারে। যদি অনুমতি করেন…”

দাদাই সোমুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “নিশ্চয়ই ঘুরে দেখতে পারো। এই বিচ্ছু ছোঁড়াটাকে নিয়ে যাও। এই শর্মা আমাদের বাড়ির আনাচ-কানাচ আমার থেকে বেশি চেনে।” তারপর সোমুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “দাদুভাই, তোমার সময় হলে আমার কাছে একবার এসো তো। একপাতা টাইপ করে দিতে হবে।”

দাদাই আবার পড়ার ঘরে ঢুকে যেতেই সোমুরা একতলার বারান্দায় নেমে এল।

তিন

“বাহ্‌, তোমাদের বাগানটা তো বেশ বড়ো! এত গাছপালা কে লাগিয়েছেন? দাদাই, না দিম্মা?”

অফিসার বাড়ির চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। একতলায় সোমুর পড়ার ঘর দেখে ফেরার পথে দিম্মার ঘরের লাগোয়া বারান্দায় উঁকি মারলেন। একটা প্লাস্টিকের ঢাকনার আড়ালে একটা কাচের বাটিতে কালো রঙের থকথকে জেলির মতো কিছু দেখে অফিসার সেদিকে এগিয়ে গেলেন। হাতের ডাণ্ডা দিয়ে দেখতে যেতেই সোমু চেঁচিয়ে উঠল, “হাত দেবেন না। ওটাতে দিম্মার হাঁপানির ওষুধ আছে। কাল দাদাই আমাকে বড্ড বকেছে হাত দিতে গিয়েছিলাম বলে।”

অফিসার একটু ঘাবড়ে গেলেন। “হাঁপানির ওষুধ বারান্দায় কেন? আমি তো ভাবলাম তোমার দিম্মা বোধহয় আমের আচার রোদে দিয়েছেন। অবশ্য আচার তো কাচের বয়ামে থাকে।”

“আরে বাবা, ওটা আচার নয়। বললাম তো ওটা দিম্মার হাঁপানির ওষুধ।”

“কেমন ওষুধ? শুঁকতে হয়, নাকি চ্যবনপ্রাশের মতো চেটে চেটে খেতে হয়?”

“না রে বাবা, না। ওটা একধরনের ব্যাকটেরিয়া।”

“ব্যাকটেরিয়া!” বলেই অফিসার একহাত পিছিয়ে গেলেন। “ব্যাকটেরিয়াকে রোদে গরম করতে দিয়েছেন?”

“আরে বাবা, ওটা যে সে ব্যাকটেরিয়া নয়। এটা একধরনের ব্যাকটেরিয়া যেটা একমাত্র আমার দাদাই আবিষ্কার করেছেন।”

“মানে? স্যার ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার করেছেন!” অফিসারের তখন প্রচণ্ড রকমের দিশেহারা অবস্থা।

“আপনাকে বোঝানো বড্ড মুশকিল তো! দাদাই বলেছে, এই ব্যাকটেরিয়া নাকি সব জায়গাতেই প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। তবে এরা নাকি বড্ড কুঁড়ে। বেশিরভাগ সময়ে এরা কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমিয়ে থাকে। আজ পর্যন্ত কেউ জানতই না যে এরা কখন জেগে উঠে আর কখন ঘুমোয়। তাছাড়া এরা কীভাবে জেগে উঠে সেটাও দাদাই ছাড়া কেউ জানে না। দাদাই একধরনের বিশেষ ফর্মুলার এনজাইম তৈরি করেছে। সেই এনজাইম এই ব্যাকটেরিয়াদের খেতে দিলেই এরা জেগে ওঠে। আর ঘুম থেকে জেগে উঠলেই এদের প্রচণ্ড খিদে পায়। আপনি তো জানেন, কুম্ভকর্ণ যখন ছ’মাস পরে জেগে উঠত ওর কী প্রচণ্ড খিদে পেত!”

অফিসার কুম্ভকর্ণের সাথে ব্যাকটেরিয়ার এমন তুলনামূলক আলোচনার একটু ভড়কে গেলেন। বললেন, “ঘুম থেকে উঠে এরা কী খায়?”

সোমুর বেশ আনন্দ লাগছে। অফিসার পুলিশ হলেও জানার বেশ আগ্রহ আছে। বলল, “ব্যাকটেরিয়াদের পাত্রে এনজাইম ছড়িয়ে দেবার পর যখনই এদের আলোর সংস্পর্শে আনবেন তখন এরা বাতাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইড খেতে শুরু করে দেয়। দাদাই বলেছে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মধ্যে একটা কার্বন আর দুটো অক্সিজেন পরমাণু থাকে। এরা কার্বন-ডাই-অক্সাইড খেয়ে কার্বন পরমাণুটাকে গিলে হজম করে নেয় আর অক্সিজেন পরমাণু দুটোকে হেঁচকি তুলে উগরে দেয় বাতাসে।”

অফিসারের চোখ ততক্ষণে কপালে উঠে গেছে। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়া অবস্থায় বললেন, “ওয়াও! তাই নাকি? এ তো বেশ অদ্ভুত ব্যাপার, সোমু স্যান্যাল! এরা তো বড্ড ভালো ব্যাকটেরিয়া। তো আর কী কী কাজে লাগবে এই ব্যাকটেরিয়াগুলো?”

সোমু দারুণ উত্তেজিত। বলল, “দাদাই বলেছে, গবেষণা এখনও শেষ হয়নি। এখনও অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করতে হবে। তবে এটা হলে আমাদের বায়ুদূষণের যে সমস্যা আছে, সেই সমস্যার চিরদিনের মতো একটা ভালো সমাধান হয়ে যেতে পারে। আপনি কী বলেন?”

অফিসার সোমুর দিকে চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে বললেন, “পারেই তো। নিশ্চয় হতে পারে।”

অফিসার বেশ উৎসাহী হয়ে পড়লেন আর ঘন ঘন হাতের ঘড়ির দিকে তাকাতে থাকলেন। “এবার যে আমাকে আবার থানায় ফিরে যেতে হবে। কিন্তু স্যার ব্যাকটেরিয়াগুলো এখানে কেন রেখেছেন?”

“দাদাই ব্যাকটেরিয়ার সাথে এনজাইম মিশিয়ে সূর্যের আলো থেকে আড়ালে রেখে দিয়েছেন। আলো পড়লেই এরা জেগে উঠবে আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড খেতে শুরু করে দেবে। আসলে আমার দিম্মা তো হাঁপানিতে কষ্ট পায়। মাঝে মাঝে হাঁপানির কষ্টে রাতে ঠিকমতো ঘুমোতেও পারে না। যখন কষ্ট খুব বেড়ে যায় তখন হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে অক্সিজেন দিতে হয়। ডাক্তার বলেছে, দিম্মার নাকি বেশি বেশি বিশুদ্ধ বাতাস চাই। যে বাতাসে বেশি অক্সিজেন থাকে সেই বাতাসে দিদিমা ভালো থাকে। তাই দিদিমা ঘুমোতে যাবার আগে দাদাই কয়েক ফোঁটা এনজাইম দিয়ে এদের টেবিল-ল্যাম্পের আলোর সামনে রেখে দেন। ঘরের কার্বন-ডাই-অক্সাইড খেয়ে নেয় আর বিশুদ্ধ অক্সিজেন ছাড়ে। দাদাই বলে, এরা যত কার্বন-ডাই-অক্সাইড খাবে এরা তত বেশি বংশবৃদ্ধি করে। তাহলে আরও অনেক অনেক ব্যাকটেরিয়া জন্মাবে। তারা আরও বেশি বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড খায় আর বেশি বেশি অক্সিজেন ছাড়ে।”

“ওরে বাপরে! এরকম হলে তো বেশ মুশকিল হতে পারে। ধরো, এই ব্যাকটেরিয়াগুলো এই হারে যদি বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে, তাহলে তো একদিন তোমাদের বাড়িঘর সব কার্বনে ঢাকা পড়ে যেতে পারে। সেটা হলে তো উলটো বিপদ বাড়বে।”

“বললেই হল বিপদ বাড়বে!” সোমু একটু রেগে গেল। “দাদাই কি আর সেটা আগে থেকে ভেবে রাখেনি ভাবছেন? আসলে ব্যাকটেরিয়াগুলো তো জানে না কতটা খেতে হয়। এরা পেটভর্তি করে কার্বন খেতে খেতে এক সময় পেট ফেটে মরে যায়। সেই মরা ব্যাকটেরিয়াগুলো যখন শুকিয়ে যায় তখন এদের দেখে একটুকরো কয়লার মতো দেখতে লাগে। তাছাড়া এরা আলো না পেলেই আবার ঘুমিয়ে পড়ে। তাই যখন অক্সিজেনের দরকার হবে না তখন এদের অন্ধকারে রেখে দিলেই হল। সহজ সমাধান।”

অফিসার বেশ খুশি হলেন। চলে যাবার আগে সোমুর সাথে হাত মিলিয়ে বললেন, “এমন স্যারের নাতি হওয়াটা খুবই ভাগ্যের ব্যাপার। বুঝলে হে সোমু স্যানাল?”

চার

বিকেলে ফুটবল নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ না খেললে সোমুর একদম ভালো লাগে না। সেদিন বেশ কিছুক্ষণ আগে খেলা শেষ হয়ে গেছে। সন্ধে হয়ে আসছে। বন্ধুরা তখনও মাঠের মধ্যে গোল হয়ে বসে গল্প করছে। এদিকে দাদাইয়ের কড়া নির্দেশ আছে, অন্ধকার হওয়ার আগে সোমুকে বাড়ি পৌঁছতেই হবে। সোমু মাঠ ছেড়ে ঘরের দিকে এগোতেই দেখে মাঠের শেষপ্রান্তে রাস্তার উপর একটা পুলিশের গাড়ি এসে থামল। সোমু ভাবল, আবার পুলিশ? কিন্তু এখনও তো রাত হয়নি। এরই মধ্যে আবার কারও বাড়িতে চুরি হয়ে গেল নাকি?

পুলিশ অফিসার এদিকে আসতেই সোমু চিনতে পারল। ইনি তো সেদিনের সেই পুলিশকাকু।

“আরে, সোমু স্যান্যাল যে! ভালোই হল তোমার সাথে দেখা হয়ে গেল। স্যার কি এখন বাড়িতে আছেন?”

সোমু খেলতে আসার সময় দেখেছিল দাদাই ঘুমিয়ে পড়েছে। বলল, “দাদাই তো বিকেলে বেড়াতে যায় না।”

“তবে আমার সাথে এসো। স্যারের সাথে একটা খুব জরুরি বিষয়ে আলোচনা করতে হবে।”

সোমু বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ল। পুলিশকাকু দাদাইয়ের সাথে জরুরি আলোচনা করতে চায় মানেই বেশ গুরুতর কোনও ব্যাপার। পুলিশকাকুর সাথে সে গাড়িতে উঠে বসল। পেছন ফিরে দেখল, পাড়ার অন্য ছেলেরা তখনও কেমন অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সোমুর বেশ মজা লাগছিল। ভালোই হয়েছে, ভাগ্যিস দীপাঞ্জনকাকু দাদাইয়ের ছাত্র ছিলেন। এখন থেকে আর অন্য পাড়ার ছেলেরা তাদের খেলার সময় এই মাঠ থেকে তাড়িয়ে দিতে পারবে না।

দাদাই কম্পিউটার ঘরেই বসে ছিলেন। ঘুম থেকে উঠে বিছানায় হেলান দিয়ে বই পড়ছেন। পুলিশকাকু একতলায় বসে দিম্মার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে দাদাইয়ের ঘরে এসে বসলেন।

দাদাই বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছেন। “কী ব্যাপার দীপাঞ্জন, আবার কী সমস্যায় পড়লে? এ-পাড়ায় কি আবার চুরি হল নাকি!”

সঙ্গে সঙ্গে অফিসারের মুখখানা কেমন যেন নিভে গেল। “না স্যার, আমি এবার চোর ধরতে আসিনি।”

“চোর ধরাই তো তোমাদের কাজ। তোমার পোস্টিং কোথায় এখন? গ্রামের দিকে পাঠিয়ে দিয়েছে নাকি?”

“আগে কাঁকুড়গাছিতে ছিলাম স্যার। গতমাস থেকে আমি সাইবার ডিপার্টমেন্টে বদলি হয়ে গেছি।”

“সেটা তো বেশ ভালো খবর। এবার থেকে তাহলে পেশি শক্তি না দেখিয়ে মগজের ব্যায়াম হবে ভালো।”

“ঠিক বলেছেন স্যার। এদিকে এই ডিপার্টমেন্টে আসতে না আসতেই একটা বিরাট সমস্যায় ফেঁসে গেছি। জানি না কার কাছে গেলে সমাধান পাব। তাই ভাবলাম আপনার কাছে গিয়ে একবার দেখি।”

“ব্যাপারখানা একটু খুলে বলো তো দেখি।”

অফিসার বলতে শুরু করলেন, “আমি এই দপ্তরে আসার কয়েকমাস আগে থেকেই কলকাতার বেশ কয়েকটা জায়গা থেকে আমরা ল্যাপটপ চুরি যাবার অভিযোগ পাচ্ছিলাম। ঠিক যেমন দেখুন এই সেনবাবুদের বাড়িতে বিশেষ কিছুই চুরি যায়নি, শুধু একটা ল্যাপটপ আর গোটা কয়েক মোবাইল নিয়ে পালিয়েছে।”

“সেটাই তো স্বাভাবিক। এই একবিংশ শতাব্দীতে শহুরে চোরেরা কি এখন থালা-বাসন চুরি করার জন্য আসবে?”

“সেটা নিয়ে আমরা চিন্তিত নই। কয়েকজনকে ধরতে পেরেছি। কয়েকখানা ল্যাপটপ উদ্ধার করা গেছে। কিন্তু কয়েকদিন আগে থেকে যা সব ঘটতে শুরু করেছে তাতে আমাদের ডিপার্টমেন্টে সবারই ঘুম ছুটে গেছে। গত সপ্তাহের আগের সপ্তাহে প্রথম ঘটনাটি ঘটে। ধর্মতলার কাছে একটা নামকরা কোম্পানির একটি কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার আছে। ধরুন সেখানে প্রায় পঞ্চাশ-ষাটখানা কম্পিউটার ছিল। হঠাৎ করে একদিন সকালে ছাত্রছাত্রীরা যখন ক্লাস করছে, চালু কম্পিউটারগুলো দুদ্দাড় করে একটার পর একটা বন্ধ হয়ে গেল।”

“হতে পারে। কখনও কখনও ভাইরাসের জন্য হয়।”

সোমু মাঝখান থেকে ফোড়ন কাটল, “সেদিন কী তারিখ ছিল কাকু? সেদিন কি শুক্রবার ছিল?”

অফিসার বেশ অবাক হয়ে সোমুর দিকে তাকাতেই দাদাই হেসে ফেললেন। “সোমু, এখন একটাও কথা বলবি না। সমস্যাটা আগে বুঝতে দে।” তারপর অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “সোমু ট্রোজান ভাইরাসের কথা বলছে। কিছু কিছু ট্রোজান ভাইরাস আছে যেগুলো মাসের তেরো তারিখে যদি শুক্রবার পড়ে তাহলে কম্পিউটারগুলোকে আক্রমণ করে। কম্পিউটারের প্রোগ্রামগুলোকে একেবারে শকুনের মতো ছিঁড়েখুঁড়ে শেষ করে ফেলে আর কী। ফাইলপত্র, তথ্য যা কিছু থাকে সব গুবলেট হয়ে যায়।”

অফিসার কেমন যেন ভেবলে গেলেন। সোমু মনে মনে ভাবল, এ কেমন সাইবার পুলিশ রে বাবা! এখনও ফ্রাইডে-দ্য-থার্টিন ভাইরাসের নাম শোনেননি! তবুও চুপ করে বসে রইল।

অফিসারের মুখের দিকে তাকিয়ে দাদাই গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, “আটাশ বছর আগে প্রথম এই কম্পিউটার ভাইরাসের কথা পৃথিবী জানতে পারে। সেটা ১৯৮৮ সাল। ভাইরাসটার আসল নাম ছিল ‘জেরুজালেম’। ইহুদি রাষ্ট্রের চল্লিশতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতেই নাকি ভাইরাসটি তৈরি করা হয়েছিল। সত্যি-মিথ্যে জানি না। তবে ওই ভাইরাসের আক্রমণে পরের বছর তেরোই জানুয়ারি সারা পৃথিবী জুড়ে প্রচুর কম্পিউটার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তোমাদেরও কি সেরকম কিছু সমস্যা? তবে আজকাল অনেক দুর্ধর্ষ সব ট্রোজান ভাইরাস বেরিয়েছে। আচ্ছা, ওদের কম্পিউটারগুলোতে কি অ্যান্টি-ভাইরাস আপডেট করা ছিল না?”

“ঠিক কী ভাইরাস বলতে পারব না স্যার। তবে সেই ট্রেনিং স্কুলের কথা অনুযায়ী তারা নিয়মমতো অ্যান্টি-ভাইরাসের সর্বশেষ আপডেট রাখে। তাছাড়া বেশিরভাগ সময়ে অ্যান্টি-ভাইরাস চালানোর পর ক্ষতিগ্রস্ত কম্পিউটারগুলোকে চালু করতে খুব একটা ঝামেলা হয় না। অথচ এরা নাকি এখনও পর্যন্ত একটা কম্পিউটারকে আর দ্বিতীয়বারের জন্য চালু করতেই পারেনি।”

দাদাইয়ের কপালে ভাঁজ পড়ল। চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে কিছু একটু ভাবছেন। অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আর কী কী জেনেছ বলো তো। তোমরা ঘটনাটা জানলে কী করে?”

“ওই কোম্পানির মালিক এই ঘটনাটাকে সাধারণ ঘটনা বলে দেখতে চাননি। তাই পুলিশে অভিযোগ করেছেন। কোনও অজ্ঞাতপরিচয় মানুষ কিংবা সংস্থা তাদের ব্যাবসায় ক্ষতি করতে চাইছে। আমরা অবশ্য জানি না এর জন্য কোনও বীমা সংস্থা থেকে কোম্পানির ক্ষতিপূরণ দাবি করার ব্যাপার আছে কি না।”

“বীমার কথা ছাড়ো। সেটা আমাদের দেখার কথা নয়। তোমরা এখন পর্যন্ত কী কী তদন্ত করেছ?”

“গত সোমবার থেকে আজ শুক্রবার, এই পাঁচদিনে সেক্টর ফাইভে আরও অন্তত আধ ডজন অফিসের কাজকর্ম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। সবগুলোই অবশ্য ছোটো ছোটো সফটওয়্যার কোম্পানি। যেসব কম্পিউটারগুলো বন্ধ হয়ে গেছে সেগুলোকে আর কোনওমতেই চালু করা যায়নি। আমাদের এখন পর্যন্ত যে তদন্ত হয়েছে, সেটা অনুযায়ী সবারই অ্যান্টি-ভাইরাস ছিল। তাই আমরা আরও বেশি ঘাবড়ে গেছি।”

দাদাইয়ের কপালে ভাঁজগুলো গাঢ় হতে থাকল। ভ্রূ কুঁচকে একবার সোমুর দিকে তাকালেন। সোমু জানে, এটা একই সঙ্গে বিস্ময় আর চিন্তার লক্ষণ। দাদাই বললেন, “আর একটু বিস্তারিত বলো। বিশেষ কোনও ঘটনা, মানে তুমি কি দেখেছ কম্পিউটারগুলো কীভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে? মানে তোমার চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা হয়েছে?”

“আজ সকালে এরকম একটা খবর পেয়ে আমি একটা কোম্পানির অফিসে গিয়েছিলাম। এই ধরুন সেখানে পঞ্চাশ জন লোক কাজ করে। ওখানে অবশ্য তিন শিফটে কাজ হয়। তাই যারা সকালে এসে কাজ শুরু করেছিল, তারা কম্পিউটার চালু করার কিছুক্ষণ পর থেকেই একটার পর একটা বন্ধ হয়ে গেছে। যারা দুপুরে আসবে তাদের কম্পিউটারগুলো তখনও চালু হয়নি। বেশ কয়েকজন দুপুর বারোটা নাগাদ এসে কয়েকটা কম্পিউটার চালু করল। আমি সেখানেই বসে ছিলাম। একটা কম্পিউটার চালু করার মিনিট খানেক পরে পর্দায় ফুটে ওঠা সমস্ত কিছু মুছে গিয়ে একটা নীল রঙের পর্দা ভেসে উঠল। কয়েক সেকেন্ড পরে কম্পিউটারটা পুরোপুরি বন্ধ হয় গেল।”

“এরকম তো হতেই পারে। এটা বেশ পুরনো রোগ। যখন কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম আচমকা কাজ করা বন্ধ করে দেয় তখন এরকম হয়। আমাদের ভাষায় একে ‘ব্লু স্ক্রিন অফ ডেথ’ বলে। তবে বেশিরভাগ সময়ে আবার চালু করলেই কম্পিউটার চলতে শুরু করে। কিন্তু তুমি তো বলছ যে কম্পিউটার আর চালুই করাই যাচ্ছে না। ওদের জিজ্ঞেস করেছিলে, ওরা কেউ কোনও অচেনা ই-মেল পেয়েছে কি না? অনেক সময় ভুয়ো ঠিকানা থেকে অনেক ভুয়ো ই-মেল আসে। অনেক সময় সেইসব ই-মেলে লুকিয়ে রাখা অজানা ফাইল খুলে ফেললেই বিপদ। সেই ফাইলের মাধ্যমে ভাইরাস কম্পিউটারে ছড়িয়ে যায়। আর যেহেতু আজকাল অফিসের সমস্ত কম্পিউটার তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত থাকে তাই সেই ভাইরাস খুব দ্রুত অন্য কম্পিউটারগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কি সেরকম ই-মেল পেয়েছে? এসব ব্যাপারে কিছু জানতে পেরেছ?”

“সেরকম কেউ কিছু বলেনি। তাছাড়া এরকম কেউ করে থাকলেও এখন এগিয়ে এসে বলতে চাইবে না।”

“হুম। তবে কোথা থেকে শুরু হয়েছিল সেটার চিহ্ন বের করা এখন বেশ মুশকিল। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে।” দাদাই চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভাবলেন। হঠাৎ করে আবার অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আচ্ছা, কম্পিউটার বন্ধ হবার সময় তার পর্দায় কোনও লেখা ফুটে উঠেছিল?”

অফিসারের চোখদুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, “হ্যাঁ স্যার, কম্পিউটারে নীল রঙের পর্দা ফুটে ওঠার আগে বেশ কয়েকটা হিজিবিজি অক্ষর ফুটে উঠেছিল। অক্ষরগুলো আগে কখনও কেউ দেখেছে বলে তো মনে হয় না। আমার মোবাইলে তার একটা ছবি আছে।”

“কই, দেখাও তো। যদি কিছু বোঝা যায়।”

অফিসার তাঁর মোবাইলের পর্দায় একটি ছবি দেখালেন।

দাদাই অনেকক্ষণ ধরে অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। “বেশ অদ্ভুত। দেখতে অনেকটা ছবির মতো অথচ ইংরেজি অক্ষরের গড়ন।”

সোমুর চোখে মুখে উত্তেজনা স্পষ্ট। বলল, “দাদাই, এবার একটা কথা বলি? অক্ষরগুলোকে তুমি যদি ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী একশো আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে দাও তাহলে পাঁচটা ইংরেজি অক্ষর দেখা যাবে – J q Y T K। তবে অবাক কাণ্ড, বাকি অক্ষরগুলো বড়ো হাতের হলেও q অক্ষরটা সাইজেও ছোটো এবং ছোটো হাতের অক্ষর।”

দাদাই প্রশংসার দৃষ্টিতে সোমুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “বাহ্‌, তোর বুদ্ধিগুলো তো দেখছি রাজধানী ট্রেনের মতো ছুটছে। এত তাড়াতাড়ি তুই একটা ছবি তৈরি করে ফেললি! তবে কী জানো হে সোমু সান্যাল, আমার মনে হচ্ছে এগুলো ইংরেজি অক্ষরই নয়। যাই লেখা থাক না কেন, এভাবেই এগুলোকে লেখা হয়। উলটে লেখা হয়নি। আসলে কী জানিস, ইংরেজি অক্ষরগুলো সবই ল্যাটিন থেকে নেওয়া। আবার ইংরেজি অক্ষরের মতো দেখতে বলেই যে সেগুলো বিদেশি অক্ষর হবে তার কোনও মানে নেই।”

অফিসার সোমুর দিকে তাকিয়ে আছেন। সোমু বলল, “দাদাই, এটা কোনও সন্ত্রাসবাদী দলের সংক্ষিপ্ত নাম নয়তো? যেমন ধরো, Joint Qualition of Young Terrorists  of  Kazaminstan।”

দাদাই প্রচণ্ড জোরে হেসে ফেললেন। “তোর কল্পনা শক্তির দৌড় আছে বটে। একটা নামও তৈরি করে ফেলেছিস। এই যে খুদে গোয়েন্দা, তুই কি জানিস, যারা কাজে সন্ত্রাসবাদী হয়, তারা তাদের দলের নামের মধ্যে সন্ত্রাসবাদী শব্দটা রাখে না? কারণ, সারা পৃথিবী যতই ওদের কাজকে খারাপ মনে করুক না কেন, সন্ত্রাসবাদীরা নিজেরা মনে করে ওরা বিপ্লব করছে। খারাপ কিছু করছে না।”

“তাহলে? আর কী হতে পারে?”

“আমি তো বললাম, আমার তো মনে হচ্ছে এগুলো ইংরেজি অক্ষরই নয়।” বলেই দাদাই তড়াক করে উঠে গিয়ে বইয়ের আলমারির কাছে চলে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর একটা বইয়ের পাতা উলটোতে উলটোতে বললেন, “বুঝলি সোমু, যা আন্দাজ করেছিলাম। এটা হল আমাদের দেশের সবচেয়ে পুরনো ভাষার কিছু অক্ষর।”

“সিন্ধু লিপি?”

দাদাই আবার হেসে উঠে বললেন, “অনেকটা কাছাকাছি গেছিস। এখনও পর্যন্ত যীশুর জন্মের তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগেকার সিন্ধু যুগের লিপির সন্ধান আমরা খুঁজে পেয়েছি। তবে কী জানিস, আমরা এখনও সেই লিপির পাঠোদ্ধার করে উঠতে পারিনি। শুধুমাত্র এইটুকু জানতে পেরেছি যে উর্দু, আরবি কিংবা হিব্রু ভাষার মতো সিন্ধু লিপিটি ডানদিক থেকে বাঁদিকে লেখা হত।”

সোমু বলল, “এটা সিন্ধু লিপিতে লেখা হলে তো আমরা জানতেই পারব না কী লেখা আছে।”

“ঠিক তাই। এখনও পর্যন্ত পুরনো যে লিপিটি আমরা পড়তে পেরেছি সেটা হল অশোকের লিপি। প্রাকৃত আর তামিল-ব্রাহ্মী ভাষায় লেখা হয়েছিল। আমার মনে হচ্ছে এই অক্ষরগুলো সেই তামিল-ব্রাহ্মী লিপি থেকে নেওয়া। তামিলনাড়ুতে আদিচান্নালুর বলে একটা জায়গা আছে। অনেকদিন আগে একজন জার্মান ভদ্রলোকের উদ্যোগে সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি করার সময় একটা সমাধিস্থান খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে কিছু মানুষের মাথার খুলি, ভাঙা মাটির পাত্র পাওয়া গিয়েছিল। আর সেই সমাধির গায়ে তামিল-ব্রাহ্মী লিপিতে কিছু শব্দ খোদাই করা ছিল।”

অফিসার অধৈর্য হয়ে যাচ্ছিলেন। বললেন, “এই কম্পিউটারগুলো এভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার সাথে তামিল-ব্রাহ্মী লিপির কী সম্পর্ক থাকতে পারে?”

দাদাই মৃদু হাসলেন। বললেন, “আরে বাবা, সেটাই তো আমাদের খুঁজে বার করতে হবে। হতে পারে এটা স্রেফ আমাদের চোখে ধুলো দেবার জন্য কিংবা নিছকই মজা করে চমকে দেবার জন্য। প্রায় চার হাজার বছর আগেকার লিপির মাত্র কয়েকটা অক্ষর ফুটে উঠেছে। তাই সবার আগে জানতে হবে এই অক্ষরগুলোর মানে কী? তবে যাই হোক না কেন, এটা একটা প্রাথমিক হুমকি ছাড়া বেশি কিছু মনে হচ্ছে না। সেটা যে ভাষাতেই হোক না কেন। হতে পারে কেউ আমাদের একটু পরখ করে দেখতে চাইছে। তাই যদি হয়, তাহলে তোমাদের জন্য আরও বড়ো আক্রমণ অপেক্ষা করছে। হতে পারে, এরা প্রথমে ছোটো ছোটো সংস্থার কয়েকটা কম্পিউটারে ব্যাপারটা ঘটিয়েছে। দেখতে চাইছে তোমাদের প্রতিক্রিয়া কী হচ্ছে।”

“তার মানে কে বা কারা কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এটা করছে?”

“অবশ্যই। উদ্দেশ্য তো কিছু একটা আছেই।”

“তারা কি এদেশের, নাকি বিদেশের?”

দাদাই আবার হেসে ফেললেন। “এই কৃত্রিম বুদ্ধির যুগে এদেশ আর বিদেশ বলে কি কিছু আছে?”

অফিসার কেমন যেন মুষড়ে পড়লেন। “তাহলে তো সমস্যা বাড়ল বলেই মনে হচ্ছে।”

“দেখো দীপাঞ্জন, পৃথিবীতে বুদ্ধিমান মানুষের কোনও অভাব নেই। এদিকে তথাকথিত সমাজ-দেশ-সভ্যতা যেভাবে আমাদের চালাতে চায়, সব বুদ্ধিমানেরাই যে সেইসব হুকুম মেনে চেনা পথেই চলবে তারও কোনও মানে নেই। তাছাড়া জানোই তো, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। এখন এই ইন্টারনেটের যুগে পৃথিবীটা একটা রুবিক কিউব ছাড়া কিছুই নয়। যারা খেলার সূত্র জানে তাদের কাছে সমাধান করাটা যেমন কিছুই নয়, তেমনি সমস্যা তৈরি করাটাও বাঁহাতের খেল।”

“কেন? কী চায় তারা?”

“কে কী চায় বলা খুব মুশকিল। তবে সবাই যে খারাপ কিছু চাইবে সেটা নাও হতে পারে। এমনও হতে পারে যে পৃথিবীর কোনও এক সুদূর প্রান্তে বসে কোনও এক অসম্ভব বুদ্ধিমান মানুষ নিছকই তার মগজের খেলা দেখাচ্ছে। তুমি হয়তো জানো না, তবে তোমাদের সাইবার ডিপার্টমেন্ট নিশ্চয়ই খবর রাখে যে পৃথিবীতে এমন অনেক সংগঠন আছে যারা এই পৃথিবীর সমস্ত কম্পিউটার সিস্টেমগুলোকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে চায়।”

“কেন? তাদের উদ্দেশ্যটা কী?”

“তারা মনে করে এই প্রযুক্তির উন্নতি শুধুমাত্র মানুষের মধ্যে বৈষম্য বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক বৈষম্য দ্রুত হারে বাড়ছে। যাদের হাতে উন্নত প্রযুক্তি আছে তারা দিনের পর দিন আরও বড়লোক হচ্ছে। আর যারা প্রযুক্তির ব্যবহার জানে না তারা আরও গরিব হবে। তাই বুদ্ধিমান মানুষদের একটা ক্ষুদ্রতম গোষ্ঠী প্রযুক্তির জোরে পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষকে একদিন তাদের ক্রীতদাস বানাতে চায়।”

“তাই নাকি!”

“আমেরিকাতে তো আছেই, তাছাড়া সারা পৃথিবী জুড়ে এমন কিছু অ্যান্টি-টেকনোলজি সংস্থা আছে যারা সমস্ত রকমের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করে। তারা চায় ডিজিটাল জগতে সবার সমান অধিকার থাকুক। তাদের মতে, পেটেন্ট আর কপিরাইট ব্যবস্থা তুলে দিতে হবে। তুমি জেনে অবাক হবে যে, এরা কিন্তু কম শক্তিশালী নয়। এদের সাথে সমস্ত মানুষের সমান অধিকারে বিশ্বাসী অনেক অর্থবান ও বুদ্ধিমান বিশেষজ্ঞের দল আছে। এমনকি কিছু নামকরা টেকনোলজি কোম্পানিও গোপনে তাদের সাথে যুক্ত আছে। যাই হোক যেটা বলছিলাম, এত কম তথ্যের উপর ভিত্তি করে বোঝা যাচ্ছে না আগামীদিনে কী হতে চলেছে।”

“আপনি তো আমাদের ভয় খাইয়ে দিচ্ছেন স্যার! এটা কি সম্পূর্ণ নতুন কোনও ভাইরাস?”

“সোজা কথায় এবং সাধারণ মানুষের ভাষায় এটাকে ভাইরাস বলা যেতে পারে। তবে যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো তাহলে বলব এটা ভাইরাসের থেকে অনেক অনেক গুণ মারাত্মক হতে পারে। আমি জানি না, যে বা যারা এটাকে তৈরি করেছে তারা কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে এটা ছড়ানোর চেষ্টা করছে কি না। তবে তারা যে এখানেই থেমে যাবে এটা ভেব না। তোমরা আগে খুঁজে বার করো এর সূত্রটা কোথায়। যেমন তোমাদের দেখতে হবে এটার মেইল-ট্রেইলটা যদি খুঁজে বের করতে পারো। কে বা কারা ই-মেইলটা প্রথম পেয়েছিল। তারা সেই ই-মেইলটা কাদের পাঠিয়েছিল। তবে সেটা বের করা একপ্রকার অসম্ভব বলতে পার। কারণ এখন অনেক সফটওয়্যার আছে, এমনকি কিছু ইন্টারনেট ব্রাউজার আছে যেখানে তোমার ডিজিটাল গতিবিধির কোনও পদচিহ্ন রাখে না।”

“তাহলে কম্পিউটারগুলোকে কি আর কোনওভাবেই চালানো সম্ভব নয়? মানে সেগুলো কি সোজা বাতিলের দলে?”

“এখনই বলা মুশকিল। তুমি ওই ছবিটা সোমুর কাছে রেখে যাও। আমার একজন বন্ধু আছেন। ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁকে ছবিটা একবার পাঠিয়ে দেখি। যদি ছবিটার মানে উদ্ধার করতে পারেন।”

“কম্পিউটারে যেসব তথ্য ছিল সেগুলো কি আর উদ্ধার করা যাবে?”

“প্রাথমিকভাবে তোমরা প্রথমে যেকোনও একটা কম্পিউটার থেকে হার্ড ডিস্কটাকে আলাদা করে অন্য কম্পিউটারের সাথে জুড়ে দেখতে পারো আগের তথ্যগুলো উদ্ধার করা যাচ্ছে কি না। যদি উদ্ধার করা যায় তাহলে এ যাত্রায় তোমরা হয়তো বেঁচে গেলে। সেক্ষেত্রে হার্ড ডিস্কের তথ্যের ব্যাক-আপ রেখে হার্ড ডিস্কগুলোকে আবার ফরম্যাট করতে পারো। নতুন করে অপারেটিং সিস্টেম ইন্সটল করতে হতে পারে। তবে নেটওয়ার্কের সঙ্গে জুড়লেই আবার যে একই ঘটনা ঘটবে না এটা হলফ করে বলা মুশকিল।”

দাদাই আবার গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। চোখ বুজে কিছু একটা ভাবতে লাগলেন। সোমু আর অফিসার একে অপরের দিকে তাকাল। অফিসার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। সোমু ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে অফিসারকে কথা বলতে বারণ করল। ইশারায় পাশের ঘরে যেতে বলল।

সোমু ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “আপনার মোবাইলে ফাইল পাঠানো যায় এমন কোনও অ্যাপ ইন্সটল করা আছে? যেমন ধরুন যেন্ডার, য্যাপয়া, এয়ারড্রয়েড, ওয়াই-এফ-টি এরকম কিছু।”

অফিসার বেশ ঘাবড়ে গেলেন। “কীসব বলছ সোমু! আমি তো একটা শব্দেরও মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“আরে বাবা, এগুলো ওয়াই-ফাই ফাইল ট্রান্সফার অ্যাপ। বিনা তারে ফাইল, ছবি, গান এক মোবাইল থেকে অন্য কোনও মোবাইলে পাঠানোর জন্য। যেমন ধরুন আপনার মোবাইল থেকে আমার মোবাইলে পাঠাতে চাইছেন।”

“না নেই। তাছাড়া তোমার মোবাইলে কেন?”

“দাদাইয়ের মোবাইল দাদাই কাউকে দেয় না। এটা দিম্মার মোবাইল। আমার কাছে থাকে। কোনও চিন্তা নেই। ব্লু-টুথ আছে?”

এতক্ষণে অফিসার একটু হাসলেন। সোমু দুটো মোবাইলের ব্লু-টুথ চালু করে ছবিটা সোমুর মোবাইলে রেখে দিল।

বেশ কিছুক্ষণ পরে দাদাই চোখ খুলল। দেখে মনে হবে দাদাই সোমুদের দিকে তাকিয়ে আছেন, অথচ সোমু জানে দাদাই মোটেই তাদের দিকে তাকিয়ে দেখছেন না। বললেন, “দীপাঞ্জন, তোমাকে যেটা বললাম, তুমি প্রথমেই গিয়ে দেখো হার্ড ডিস্কের তথ্য আদৌ উদ্ধার করতে পারছ কি না। তাহলেই আমরা বুঝতে পারব সে কতদূর এগিয়েছে।”

বলেই দাদাই আবার চোখ বুজে ফেললেন। সোমু জানে দাদাই কিছুক্ষণ এভাবে ভাববেন। সে আর অফিসার পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

পাঁচ

বেশ কিছুদিন ধরেই দাদাই বিভিন্ন ধরনের খাবার খেতে চাইছেন। আগে দুপুরবেলা খেতে বসে আলু-পোস্ত, বড়ির ডালনা, পটলের দোরমা কিংবা উচ্ছেভাজা দেখলেই একগাল হেসে খেতে বসতেন। গরমকালে আম পাকতে শুরু করলে দাদাই আরও খুশি। সোমুকে পাশে বসিয়ে দিম্মাকে বলেন, “দেখো, এই বয়সেও আমার রক্তচাপ নেই। মধুমেহ নেই। এদিকে আজকাল লোকে চল্লিশ পেরোনোর আগেই চায়ে চিনি দেবে না। লুচির সাথে আলুর দম খাবে না। বিয়েবাড়িতে গিয়ে রসগোল্লা নিংড়ে রস বার করে খায়। আরে বাবা, রসগোল্লার রস নিংড়ে বের করে দিলে তো ওটা ছানার গোল্লা হয়ে গেল! রসগোল্লা কি আর রইল? কী বলো সোমু?”

দিম্মা পাশে বসে থাকলে সোমু দেখে দিম্মার চোখে-মুখে প্রশংসা ঝরে পড়ছে। দিম্মা নিজে সারাদিন কোমরের ব্যথায় কাহিল হয়ে থাকেন। বিশেষ করে অমাবস্যা আর পূর্ণিমার দিনে তো নড়াচড়া করতেই পারেন না। সিঁড়ি ওঠানামা করা তো দূরের কথা, সদর দরজায় একখানা চৌকাঠ আছে, সেটা ডিঙোতে গিয়েই দিম্মার চোখে জল এসে যায়। তবে দাদাই যে আর পাঁচটা বুড়োমানুষের দলে পড়ে যাননি এটা ভেবেই দিম্মা খুব খুশি থাকেন। তবে মুখে বলতে ছাড়েন না। বলেন, “ওইসব কথা ছাড়ো। তোমাকে আর অত বড়াই করে বলতে হবে না। হয়নি, হয়নি। আজকাল এসব হতে কতক্ষণ! তুমি তো দিনের দিন আর ছোকরা হচ্ছ না!”

দাদাই একবার দিম্মার দিকে তাকান আর হেসে ফেলেন। বলেন, “এই বয়সে আমি ছোকরা হয়ে গেলে ভালো হত কি?” সোমুর দিকে তাকিয়ে বলেন, “এই সোমু, কাল থেকে কম্পিউটারের গবেষণা ছেড়ে দিয়ে আমি আবার ওই লাল-নীল জলের বোতলগুলো নিয়ে বসে পড়ব। এবার আমি এমন একটা সিরাপ তৈরি করব যে দিনে দু’চামচ করে খেলেই একবছরের মধ্যে পাঁচ বছর বয়স কমে যাবে। তখন তোর দিম্মারও বয়স কমে যাবে। হাঁটুর ব্যথাও আর থাকবে না।”

দাদাই আবার কাজ নিয়ে ক্ষেপে গেছেন। আজকাল সারাদিন ল্যাবরেটরিতেই পড়ে থাকেন। তবে বয়স কমানোর জন্য কোনও সিরাপ তৈরি করছেন না। বেশ কিছুদিন ধরেই দাদাই একটা বিশেষ ধরনের যন্ত্র তৈরি করছেন। যন্ত্রটা বাইরের থেকে দেখতে অনেকটা ওলটানো কড়াইয়ের মতো। দাদাই বলেছেন এটা নাকি ‘গন্ধরোবট’। গন্ধরোবটের মাথার দিকে বেশ অনেকগুলো এল.ই.ডি লাইটের মতো ক্ষুদে ক্ষুদে দশখানা বাল্ব লাগানো আছে। কড়াইটার কানা ঘেঁষে বেশ কয়েকটা ক্ষুদে ক্ষুদে বোতামের মতো সুইচ। মাঝামাঝি জায়গায় একটা নীল রঙের ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে প্যানেল আর মাথায় বামুনের টিকির মতো একটা অ্যান্টেনা।

গতকাল দুপুরে দিম্মা খেতে ডাকা মাত্র দাদাই দুদ্দাড় করে দোতলা থেকে নেমে এসে চেয়ারে বসে পড়লেন। সঙ্গে সেই গন্ধরোবট। দিম্মা টেবিলের উপরে খাবারের বাটিগুলো সাজিয়ে রেখেছেন। খাবারগুলো তখনও বেশ গরম আছে আর ধোঁয়া উঠছে। বেশ দারুণ সুন্দর গন্ধ আসছে। সোমু হাত বাড়াতেই দাদাই বললেন, “দাঁড়া সোমু, কয়েকটা জিনিস একটু পরীক্ষা করে নিই।” বলেই দাদাই ঝিঙে-পোস্তর বাটিটা তুলে নিয়ে পাশে একটা ছোট্ট টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। বললেন, “এখানে সব খাবারের গন্ধ একসাথে মিশে যাচ্ছে।” বাটিটার উপর গন্ধরোবটটাকে বসিয়ে দেওয়া মাত্র সেটা পুরোটাই ঢাকা পড়ে গেল। অদ্ভুত ব্যাপার, ঢাকা দেবার পরে একফোঁটা গন্ধ বাইরে আসছে না। গন্ধরোবটের গায়ে লাগানো একটা কম্পিউটারের USB পোর্টের মতো একটা ছোট্ট যন্ত্র সেখানে লাগিয়ে দিলেন। USB পোর্টের সাথে মাউসের তারের মতো তার আর সেই তারের অপর প্রান্ত দাদাইয়ের মোবাইলের USB পোর্টে ঢোকানো। বেশ কিছুক্ষণ সেই বোতামগুলো নিয়ে খেলা চলল আর সেই আলোগুলো নাচতে শুরু করল। ডিসপ্লে প্যানেলে অবশ্য কিছু দেখা যাচ্ছিল না।

আজ সকাল থেকেই দাদাই বড্ড ব্যস্ত আছেন। সকাল থেকে একবারের জন্যও একতলায় নামেননি। অন্যদিন ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে বাগানে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেন। সোমুকেও উঠিয়ে দেন কিছুক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করার জন্য। আজ সকালে তাই সোমুর স্কুল যেতে দেরি হয়ে গিয়েছিল।

বিকেলবেলায় খেলতে যাবার আগে সোমু দাদাইয়ের ঘরে ঢুকে দেখে দাদাই গন্ধরোবটকে নিয়ে পরীক্ষা করছেন। বোতামগুলো টিপলেই কয়েকটা আলো জ্বলছে-নিভছে আর সেই ডিসপ্লে প্যানেলে একটা করে বড়ো অঙ্কের গাণিতিক সংখ্যা ফুটে উঠছে।

সোমুকে দেখামাত্র দাদাই একগাল হেসে ঘরের ভেতরে ডাকলেন। চেয়ার টেনে কাছে এসে বসতেই পকেট থেকে রুমাল বের করে সোমুর চোখদুটোকে বেশ কষে বেঁধে দিলেন।

“কী করছ, চোখ বেঁধে দিলে কেন?”

“চুপটি করে বসে থাক। একদম নড়াচড়া করবি না। একটা পরীক্ষা করব।”

সোমুর বেশ মজা লাগছে। তবুও দাদাইকে একটু ভয় খাওয়ানোর জন্য বলল, “তুমি আবার আমাকে নিয়ে পরীক্ষা করছ! অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে যাব না তো? দিম্মা দেখলে তোমারই একদিন কি আমারই একদিন।”

“তোর দিম্মাকে আমি ভয় খাই নাকি? চুপ করে বসে থাক।”

“আমি কি দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আসব? দিম্মা যদি চলে আসে!”

“একদম উঠবি না। আজ পূর্ণিমার দিন পড়েছে না! তোর দিম্মার কোমর ব্যথাটা একটু বেড়েছে। এদিকে পূর্ণিমার দিনটাই এইসব পরীক্ষানিরীক্ষার সবচেয়ে ভালো দিন। বুঝলে হে সোমু সান্যাল?”

দাদাই বেশ খুশিতে ডগমগ। যেদিন কোনও কারণে দাদাইয়ের খুব আনন্দ হয় সেদিন সোমুকে পুরো নাম ধরে ডাকেন। কিন্তু সোমুর মাথাটা একেবারে গুলিয়ে গেল। দাদাই চোখদুটো বেঁধে দিয়েছেন। কিছু দেখতেও পাচ্ছে না। আবার বলছেন পূর্ণিমার দিন নাকি এইসব পরীক্ষা করতে হয়। দাদাই বিজ্ঞানী থেকে তান্ত্রিক হয়ে গেলেন না তো! ঐ তারানাথ তান্ত্রিক না কী। দিম্মা টিভিতে সিরিয়াল দেখেন। তবে দাদাইয়ের চুলে জটাও নেই, কপালে লাল সিঁদুরও পরেননি।

এবার দাদাই নাকের উপর রবারের মুখোশ পরানোর মতো একটা কিছু সেঁটে দিয়েছেন। কখনও কম্পিউটারের বোতাম টেপার শব্দ শুনতে পাচ্ছে আবার কখনও পিঁক পিঁক আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। সোমু জানে এটা ওই গন্ধরোবটের চালু হবার আওয়াজ।

একটা দারুণ খাবারের গন্ধ পাওয়া গেল। অনেকটা মাটন বিরিয়ানির মতো। সঙ্গে সঙ্গে সোমুর জিভে জল এসে গেছে। দাদাই জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁ রে, কিছু গন্ধ পাচ্ছিস?”

“পাচ্ছি তো! মাটন বিরিয়ানির গন্ধ।”

“ধূর! আবার মাটন বিরিয়ানি! কবে একদিন খেয়েছিলি, তাই এখনও তুই ঢেঁকুর তুলছিস? আবার ভালো করে শুঁকে দেখ।”

আবার সেই সুন্দর গন্ধটা আসছে। সোমু বলল, “দাদাই, তুমি কি আমার চোখ বন্ধ করে দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে মাটন বিরিয়ানি খাচ্ছ?”

“ধূর ছাগল! এটা চিকেন বিরিয়ানির গন্ধ।” বলেই দাদাই সোমুর নাকে লাগানো যন্ত্রটা খুলে নিলেন আর চোখের বাঁধনও খুলে দিলেন।

সোমু দেখল, সেই গন্ধরোবটের ছোট্ট নীল রঙের পর্দায় একটা দশ অঙ্কের সংখ্যা জ্বলজ্বল করছে আর কম্পিউটারের পর্দায় থালা ভর্তি চিকেন বিরিয়ানির ছবি। নাদুসনুদুস মুরগির ঠ্যাংগুলোর উপর তেল চকচক করছে।

“ও দাদাই, তুমি করছটা কী বলো তো? সত্যি বলছি, আমি কিন্তু মাটন বিরিয়ানির গন্ধ পাচ্ছিলাম।”

দাদাই চোখ বন্ধ করে মিনিট খানেক কিছু একটা ভাবলেন। “তার মানে আমাকে আরও একটু গবেষণা করতে হবে। আসলে কী জানিস, গন্ধ ব্যাপারটাই বেশ ঝকমারি রকমের গণ্ডগোলের জিনিস। অনু-পরমাণুগুলোর মেলামেশা একটু এদিক ওদিক হয়ে গেলেই গন্ধটা আলাদা হয়ে যায়। তাছাড়া হরেক দোকান হরেক রকমের গরম মশলা দেয়। ফলে অমুক দোকানের বিরিয়ানি আর তমুক দোকানের বিরিয়ানির মধ্যে স্বাদ আর গন্ধ পালটে যেতেই পারে। তবে এমনটা যেন না হয় তুই বিরিয়ানির ছবি দেখছিস আর নলেনগুড়ের সন্দেশের গন্ধ পাচ্ছিস।”

গন্ধরোবটের সুইচ বন্ধ করে দাদাই চেয়ার ঘুরিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসে পড়লেন। “এখনকার মতো ঠিক আছে। আমাকে আরও একটু ভাবতে দে। তুই কিছুক্ষণ খেলাধুলো করে আয়। সন্ধেবেলায় পড়তে বসার আগে আমার কাছে আরেকবার আসবি। ভুলে যাস না যেন।”

“আবার তুমি আমাকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করবে? দিম্মা জানতে পারলে না…”

একগাল হেসে দাদাই বললেন, “তোর দিম্মাকে এসব বলার কী দরকার! বললাম তো তোর দিম্মা আজ রান্না করতে পারবে না। কোমরের ব্যথাটা বেড়েছে। তাই ভাবছি আজ রাত্রে মাটন বিরিয়ানি কিনে আনলে কেমন হয় রে সোমু?”

“মাটন বিরিয়ানি! গোটা একটা সেদ্ধ ডিম থাকবে তো? আগেরবার কিন্তু ওরা দেয়নি।”

দাদাই মুখখানা কেমন ব্যাজার করে বললেন, “নাহ্‌, দরকার নেই। তুই তো আবার এইসব খাবার নিয়ে পরীক্ষা করার সময় আমাকে সাহায্য করতে চাইছিস না। আজ তাহলে ছেড়ে দে। তুই কী বলিস?”

“না না দাদাই, তুমি যত পারো এক্সপেরিমেন্ট করো। আমি চলে আসব। তবে মাঝে মাঝে দিম্মাকে দিয়েও ওইসব পরীক্ষানিরীক্ষা করালে আরও ভালো হবে। দিম্মা কত ধরনের দারুণ দারুণ খাবার রাঁধে বলো তো। দিম্মা হয়তো গন্ধগুলো ঠিকঠাক চিনতে পারবে।”

দাদাই কেমন যেন মিইয়ে গেলেন। বললেন, “তোর দিম্মা কি আর আমাকে সাহায্য করবে? কী জানি।”

“তাহলে আমি কি খেলার শেষে ফিরে আসার সময় দোকানে বিরিয়ানির অর্ডার দিয়ে আসব? তোমাকে আর তাহলে যেতে হবে না। আমি জানি, বড়ো রাস্তার ওপারে দুটো বিরিয়ানির দোকান আছে। কোনটা থেকে অর্ডার দেব দাদাই?”

দাদাই চমকে উঠলেন। “না না, তোকে রাস্তা পেরিয়ে দোকানে যেতে হবে না। আমি মোবাইলেই খাবারের অর্ডার দিয়ে দেব। ওরা বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যাবে।”

ছয়

বিরিয়ানির দোকানটা বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। স্কুটিতে গেলে মিনিট তিন লাগে। সোমু দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। দাদাইয়ের কড়া নির্দেশ, দোকানের লোক খাবারটা ঘরে পৌঁছে দিলেই সোমু যেন একটা প্যাকেট নিয়ে সোজা দোতলায় উঠে আসে। সেইমতো সোমু খাবারের দুটো প্যাকেট টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে একটা প্যাকেট নিয়ে সোজা দাদাইয়ের ল্যাবরেটরির টেবিলে চলে গেল।

দাদাই বিরিয়ানির প্যাকেটটা খুলে সঙ্গে সঙ্গে সেই গন্ধরোবট দিয়ে ঢাকা দিয়ে দিলেন। তারপর কয়েকটা বোতাম টিপতেই গন্ধরোবটটার সাথে জুড়ে থাকা কম্পিউটারের পর্দায় একটা ছবি ভেসে উঠল।

“ইউরেকা! ইউরেকা! সোমু, ও সোমু, এদিকে দেখে যা। শেষমেশ কম্পিউটারটা এবার মাটন বিরিয়ানির গন্ধ চিনতে পেরেছে। মনে আছে আগের দিন এই কম্পিউটারটাকে মাটন বিরিয়ানির গন্ধ শুঁকতে শিখিয়ে দিয়েছিলাম? আজ গন্ধ শুঁকেই মনে করতে পেরেছে।”

এদিকে বিরিয়ানির গন্ধে সোমুর জিভে জল আটকানো যাচ্ছিল না। সোমু আর থাকতে পারছিল না, আবার বুঝতেও পারছিল না যে দাদাই এই গন্ধরোবট বানিয়ে কী করবেন? সোমু বলল, “দাদাই, বড্ড খিদে পেয়েছে। চলো, এবার খেতে চলো। না হলে দিম্মা খাবার না খেয়েই শুয়ে পড়বে।”

দাদাই একবার দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন। “উরিব্বাস! অনেক দেরি হয়ে গেছে রে সোমু। তুই গিয়ে দিম্মাকে ঘুম থেকে ওঠা আর মলিমাসিকে বলে দে টেবিলে খাবার সাজাতে।”

খাওয়ার সময় দাদাইয়ের সাথে মৌখিক চুক্তি হয়ে গিয়েছিল, রাতের খাওয়া শেষ হলেই গন্ধরোবটের পুরো গল্পটা সোমুকে শোনাতে হবে। সেইমতো খাওয়ার শেষে দিম্মা পাশের ঘরে শুয়ে পড়তেই তারা এক গ্লাস লস্যি নিয়ে ল্যাবরেটরিতে এসে বসল। দাদাই বলতে শুরু করলেন, “শোন, আমরা যখন কম্পিউটারে কিংবা মোবাইলে কোনও খাবারের অর্ডার দিতে যাই, তখন শুধু খাবারের ছবি দেখতে পাই। তাই তো! কোনও একটা পাত্রে একটা রান্না করা খাবারের ধোঁয়া ওঠা ছবি। কিন্তু তুই বল, আমরা কোনও একটা বিশেষ রেস্তোঁরায় বারবার কেন খেতে যাই বল তো? সেখানের খাবারের স্বাদ ভালো বলে। এই যে এত ধরনের খাবারের স্বাদ, আমাদের জিভ কি সেই স্বাদগুলোকে ধরে রাখতে পারে? না, পারে না। কারণ জিভে তো আর মেমরি-কার্ড নেই। আসলে ভালো স্বাদের খাবার হলেই সেই খাবার থেকে ভালো গন্ধ আমাদের নাকে ঢোকে। জানিস, আমাদের মস্তিষ্ক দশ হাজারের মতো গন্ধ মনে রাখতে পারে। তাই রেস্তোঁরায় গিয়ে আমরা সেই গন্ধের স্মৃতির অলিগলিতে ঢুঁ মেরে সেই বিশেষ খাবারটাকে খুঁজে বেড়াই। শুধু খাবারের ছবি দেখেই আমরা খাবারের হুকুম করি না। বেয়ারা যখন টেবিলে খাবার নামিয়ে দিয়ে যায় তখন না দেখেও আমরা তার গন্ধ থেকেই বুঝতে পেরে যাই খাবারটা কী। যেমন ধর, এই আমরা যখন ইন্টারনেটে এপাং-ঝপাং থেকে জামাকাপড় কিনি তখন আমরা রঙ দেখতে পাই, ডিজাইন দেখতে পাই, কত সাইজ সেটা জানতে পারি কিন্তু কাপড়টা ভালো না খারাপ, মোটা না ফিনফিনে এটা তো আর জানতে পারি না। তাই না!”

সোমু হেসে ফেলল। দাদু কিছুতেই ওয়েবসাইটের নাম ঠিকঠাক মনে রাখে না। “দাদাই ওটা এপাং-ঝপাং নয়, জ্যাবং, জ্যাবং।”

সোমু কী বলল দাদাই খেয়ালই করলেন না। “ওই হল। নামগুলো একটু এদিক ওদিক হয়ে যায়।”

“দাদাই, তাহলে কি এবার থেকে আমরা কম্পিউটারে বসেই জামাকাপড় হাতে ছুঁয়ে দেখার মতো দেখে নিতে পারব?”

“এই তুই দাঁড়া তো। কম্পিউটারের পর্দায় কাপড় ছুঁয়ে দেখা যেতে পারে, সেটা নিয়ে কেউ হয়তো এখনও ভাবেনি। তবে এমনটা যে কখনও হবে না সেটাও বলা মুশকিল। আগে তুই আমার গন্ধরোবটের গল্পটা শোন।”

“বলো, শুনছি।”

“আমি যে এই রোবটটা তৈরি করছি, যদিও এখনও কিছুই হয়নি বলতে পারিস, তার একটা বিশেষ কারণ আছে। সেটা হল আমি এমন একটা যন্ত্র তৈরি করতে চাইছি, যেমন এই গন্ধরোবটকে যেকোনও গন্ধ একবার চিনিয়ে দিলে পরেরবার থেকে সে যেন গন্ধটা চিনতে পারে এবং বলতে পারে সেটা কীসের গন্ধ। ঠিক আমাদের নাকের মতো। নতুন কোনও গন্ধ চেনার পরে সেই গন্ধটাকে কম্পিউটারের স্মৃতিতে রেখে দেওয়া যেতে পারে। সাথে একটা বিশেষ নম্বর কিংবা নাম জুড়ে দিলেই হবে। তবে ব্যাপারটা বেশ জটিল একটা বিষয়। আসলে কী জানিস, গন্ধ মানেই সেটা কিছু রাসায়নিক অণু-পরমাণু। যেগুলো গন্ধরোবটের কাছে এলেই সেটা একটা তরলে মিশে যাবে। গন্ধরোবটের ভেতরের সেই তরল পদার্থটা অনেকটা ভারী থকথকে তেলের মতো। তার না আছে নিজস্ব কোনও গন্ধ, না আছে নিজস্ব কোনও রঙ। অনেকগুলো চুলের থেকেও সরু রিসেপটরের একপ্রান্ত সেই তরলে ডুবে আছে আর অন্য প্রান্ত একটা ইলেকট্রনিক সার্কিটের সাথে জুড়ে দেওয়া আছে। একেকটা রিসেপটর সেই গন্ধটার সাথে যুক্ত একটা নির্দিষ্ট অণু-পরমাণুকে চিনতে পারে। সেই রিসেপটরগুলো যখনই ওই বিশেষ অণুর সংস্পর্শে আসবে, অমনি সেগুলো সক্রিয় হয়ে উঠবে। আর সেগুলো সক্রিয় হয়ে উঠলেই গন্ধরোবটের সার্কিট সেটা রেকর্ড করে রাখে। রিসেপটরগুলো ঘুমিয়ে আছে মানে ‘শূন্য’ আর জেগে উঠেছে মানে ‘এক’। তাহলে যদি চব্বিশটা রিসেপটর থাকে তাহলে যখন কোনও গন্ধ নেই তখন গন্ধরোবটের সার্কিটটা এরকম দেখাবে।

দাদাই একটা নোটবইয়ের পাতায় লিখলেন-

০ ০ ০ ০ ০ ০ ০ ০                ০ ০ ০ ০ ০ ০ ০ ০      ০ ০ ০ ০ ০ ০ ০ ০

এবার কোনও একটা গন্ধ পেলেই গন্ধ অনুযায়ী রোবটের ডিসপ্লে প্যানেল এরকম দেখাতে পারে-

০ ০ ১ ১ ১ ০ ০ ১                 ০ ১ ০ ১ ১ ০ ০ ০       ০ ০ ১ ০ ০ ১ ১ ১

এভাবে ৮টা অঙ্ক নিয়ে একটা গ্রুপ বানালে সেটা খুব সহজেই কম্পিউটারে গুণে নেওয়া যায়। তুই যদি গন্ধরোবটকে আরও বেশি সংবেদনশীল করতে চাস তো রিসেপটারের সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে পারিস। তাহলে আরও সূক্ষ্মভাবে গন্ধগুলোর নাম দেওয়া যাবে। যেমন ৩২টা রিসেপটর থাকলে দেখতে এমন হবে-

০ ০ ১ ১ ১ ০ ০ ১         ০ ১ ০ ১ ১ ০ ০ ০     ০ ০ ১ ০ ০ ১ ১ ১       ০ ১ ০ ০ ১ ০ ০ ০

কম্পিউটারে এদের ফেললে চারখানা সংখ্যা আসবে।

৫৭        ৮৮    ৩৯   ৭২

এবার এই নম্বরটাকে জুড়ে দিলাম একটা খাবারের নামের সাথে। যেমন ধর, আলু-পোস্ত।”

সোমু বলে উঠল, “দাদাই, তুমি খুব আলু-পোস্ত খেতে ভালোবাসো, তাই না?”

“ঠিক বলেছিস সোমু। আমাকে কেউ যদি রাজভোগের বদলে আলু-পোস্ত দেয় আমি তাই নেব আর সাথে নিম-বেগুন। তো শোন যা বলছি।”

সোমু আবার থামিয়ে বলল, “আচ্ছা দাদাই, এই যে দিম্মা আমাকে বলে, সোমু এখন বাচ্চা ছেলে। ওকে তোমার এত বড়ো বড়ো কথা যে শোনাচ্ছ ও কি সব বুঝতে পারে, নাকি মনে রাখতে পারবে? দাদাই, কথাটা কি ঠিক?”

দাদাই একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন। সোমু জানে দাদাই এর উত্তরটা কী হবে সেটা জানেন, তবে কীভাবে বললে সে বুঝতে পারবে সেটা ভাবছেন। সোমু জানে, দাদাই এটা মাঝে মাঝে করেন তার সাথে।

দাদাই বললেন, “বাচ্চাদের আমরা যাই বলি না কেন, সেগুলো স্মৃতির কোথাও না কোথাও ঠিক জমা থাকে। পরে জীবনের কোনও এক মুহূর্তে দরকারমতো সেই ধরে রাখা স্মৃতি ঠিক মনে পড়ে যায়। অতএব অনবরত শিখে যাওয়াটা খুব জরুরি। প্রয়োজনমতো যতটুকু স্মৃতিতে রাখার ঠিক থেকে যাবে।”

দাদাই কী বললেন সেটা বুঝতে গিয়ে সোমু একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল।

“এই, এবার যেটা বলছিলাম সেটা শোন। ওই চারটে নম্বর মিলে তাহলে একটা খাবারের সাথে জুড়ে গেল।”

“আচ্ছা দাদাই, কোথায় লাগবে তোমার এই যন্ত্র?”

“কেন, রেস্তোঁরায় লাগবে! তাছাড়া বিভিন্ন রাসায়নিক কারখানায় লাগতে পারে। ল্যাবরেটরিতে লাগতে পারে। তার জন্য আমাকে একটা হাতের মুঠোয় ধরা যায় এমন একটা ছোট্ট যন্ত্র বানাতে হবে। অনেকটা মোবাইলের মতো। সেই যন্ত্রটা যেকোনও গন্ধকে একটা সংখ্যায় ধরে রাখবে। আবার প্রয়োজন হলে স্মৃতিতে ধরে রাখা সংখ্যার সাথে জুড়ে থাকা গন্ধকে হাজির করবে তোর নাকের সামনে। যেমনভাবে শব্দকে আমরা ধরে রাখি। গান বা কথা রেকর্ড করে রাখার পর সেই স্বরকে আবার আমরা প্রয়োজনমতো যন্ত্র থেকে শুনতে পারি। তাই তো?”

“শুধু কি এটা করার জন্যই গন্ধরোবট তৈরি করছ?”

দাদাই একটু হাসলেন। “সেটা তো জানি না। আসলে কী জানিস, যখন নতুন কিছু আবিষ্কার করা হয়, তখন সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায় না সেটা আর কী কী কাজে লাগতে পারে। আমরা বেশ কিছুদিন ব্যবহার করলে কিংবা সেটা নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা করার পর আরও অনেক কিছু জানা যায়। এই যেমন যেদিন প্রথম দুটো কম্পিউটার নিজেদের মধ্যে কথা বলেছিল, সেদিন কি কেউ জানত একদিন ফেসবুক, ট্যুইটার এভাবে আমাদের কব্জা করে ফেলবে?”

হঠাৎ কোথাও একটা ফোন বেজে উঠল। দাদাই ঠিক শুনতে পেয়েছে। “এই, দেখ তো আমার ফোনটা বাজছে মনে হল।”

“এত রাত্রে ফোন তো কেউ করে না!”

দাদাই ফোন ধরে হুঁ হুঁ করে যাচ্ছে আর কপালের ভাঁজগুলো গাঢ় হতে শুরু করেছে। মিনিট তিন পরে ফোন নামিয়ে দাদাই বললেন, “সোমু, কাল তোর স্কুল আছে?”

“কেন বলো তো? কাল তো আমাদের ছুটি আছে।”

“ভালো হয়েছে। কাল সকালেই আমাদের একবার বেরোতে হবে। দীপাঞ্জন ফোন করেছিল। আরও কয়েকটা অফিসের যত কম্পিউটার ছিল, সেগুলো আজ বন্ধ হয়ে গেছে। সেগুলোকে কিছুতেই নাকি চালু করা যাচ্ছে না।”

“আচ্ছা দাদাই, কম্পিউটারগুলো কি তাহলে মরে যাচ্ছে? কিন্তু ওগুলো তো যন্ত্র। যন্ত্র আবার মরে যায় নাকি? মরে গেলে তো ভূত হয়। তাহলে এরা কি তবে যন্ত্র-ভূত হবে?”

“যন্ত্র-ভূত!” বলেই দাদাই হো হো করে হেসে উঠলেন। “তুই কিন্তু একটা দামী কথা বলেছিস। কম্পিউটারের মৃত্যু। তবে কী জানিস, ভবিষ্যতে কোনও একদিন কম্পিউটারের মৃত্যুও ঘনিয়ে আসতে পারে। যতদিন যাচ্ছে আমরা কম্পিউটারকে আরও বেশি বেশি বুদ্ধিমান বানিয়ে ফেলছি। একদিন এমন আসতে পারে এই কম্পিউটারই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো হয়তো মানুষের টুঁটি চেপে ধরল। আবার এমনও হতে পারে, ধর আজ থেকে একশো বছর পরে, এমন এক পরিস্থিতি এল, যখন কিছু ধুরন্ধর, লোভী আর অসৎ অথচ প্রচণ্ড বুদ্ধিমান মানুষ, যারা ভীষণ অনৈতিক উপায়ে পৃথিবীর বাকি মানুষদের ক্রীতদাস বানানোর জন্য কম্পিউটারকে কাজে লাগাতে চাইতে পারে। তবে ভালো বুদ্ধিমান মানুষের অভাব নেই। তখন একদল ভালো মানুষ জোট বেঁধে দুষ্টু মানুষদের কম্পিউটারগুলোকে ধ্বংস করার জন্য অস্ত্র তৈরি করতে পারে যাতে কম্পিউটারগুলোকে দ্রুত মেরে ফেলা যায়। এদিকে যত দিন যাচ্ছে, পৃথিবীর সমস্ত কম্পিউটারই কোনও না কোনওভাবে একে অন্যের সাথে জুড়ে থাকে। তাই হঠাৎ একদিন হয়তো দেখা গেল সারা পৃথিবী জুড়ে সমস্ত দুষ্টু কম্পিউটারগুলো একের পর এক মরতে শুরু করেছে।”

সোমু হাঁ করে প্রচণ্ড মনোযোগ দিয়ে দাদাইয়ের কথা শুনছিল। সে পুরোটা বুঝতে না পারলেও এটা বুঝতে পারছে যে তার দাদাই তাদের সবাইকে বড্ড ভালোবাসেন। পৃথিবীর মানুষদের অসম্ভব ভালোবাসেন। তাই তো তাদের জন্য এত ভাবেন। সত্যিই তো, ভালো বিজ্ঞানীরা কত কিছু আবিষ্কার করেছেন। মানুষের ভালো করার জন্যই তো সেইসব আবিষ্কার করা হয়েছে। দাদাই বলেন, কিছু দুষ্টু লোক সেগুলোকেই কাজে লাগিয়ে অনেক মানুষের ক্ষতি করে। তবে একটা বিষয়ে সোমুর ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। দাদাইকে জিজ্ঞেস করল, “সব কম্পিউটার মরে গেলে কী হবে, দাদাই?”

“কী আর হবে? কিছুই হবে না। আজ থেকে একশো-দেড়শো বছর আগে পর্যন্ত যখন কম্পিউটার ছিল না তখন কি মানুষ বেঁচে ছিল না?”

“তাহলে এই যে কম্পিউটারগুলো দুম দুম করে মরে যাচ্ছে, কেউ কি সেগুলোকে ইচ্ছে করে মেরে ফেলছে?”

“কেউ যে করছে সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। এখন আমাদের জানতে হবে তার উদ্দেশ্যটা কী। জানতে হবে সে এই ব্যাপারে কতদূর এগিয়েছে। মানে ঠিক কতখানি ক্ষতি করার ক্ষমতা সে রাখে এবং কত তাড়াতাড়ি সে ক্ষতি করতে পারে। কাল ওদের অফিসে গিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করে দেখি। নিজের চোখে দেখা যাক আসলে কী হচ্ছে। তবে কী জানিস সোমু, মনে হয় ব্যাপারটা আমি কিছুটা ধরে ফেলেছি।”

“তাহলে বলে দিচ্ছ না কেন?”

“ধুর বোকা! এ কি তোদের হাতুড়ে ডাক্তারি যে গা গরম হয়েছে দেখেই ওষুধ লিখে দেব? আগে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে না কম্পিউটারগুলোর অসুখটা আসলে কী! আচ্ছা, দীপাঞ্জন যে ছবিটা দেখাচ্ছিল, সেটা আরেকবার আমাকে দেখা তো। এক্ষুনি এটা প্রফেসর গাঙ্গুলির কাছে পাঠিয়ে দিই।”

সোমু বেশ কয়েকবার বলব বলব ভেবেও দাদাইকে বলতে পারেনি। এখন বলেই ফেলল। “জানো দাদাই, আমার মনে হয় পুলিশকাকু সেদিন নিজে কোম্পানির অফিসে গিয়ে ছবিটা তোলেননি।”

“তাই নাকি! তুই কী করে বুঝলি?”

“দিম্মার মোবাইল আর পুলিশকাকুর মোবাইলটা একই মডেলের। আমি ব্লু-টুথ দিয়ে ছবিটা পাঠানোর সময় দেখলাম ওটা মেসেজ বক্সে ছিল। নিজে ছবি তুললে ছবিটা মোবাইলের ছবির গ্যালারিতে থাকত। তার মানে ছবিটা কেউ মেসেজ করে পুলিশকাকুকে পাঠিয়েছিল।”

দাদাই প্রশংসার চোখে সোমুর দিকে তাকিয়ে থুতুনি নেড়ে দিয়ে বললেন, “সাব্বাশ দাদুভাই! আমি ওর কথা বলার সময় বেশ বুঝতে পারছিলাম যে দীপাঞ্জন ঘটনাটা মনে হয় স্বচক্ষে দেখেনি। এইসব ভয়ংকর ঘটনা কেউ নিজের চোখে প্রথমবার দেখলে সেটা নিয়ে যে প্রবল উত্তেজনা তৈরি হয় সেই উত্তেজনার রেশ ওর কথার মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছিল না। পুলিশগুলো না আজকাল এইরকম করেই ফাঁকি মারে। তাই তো অনেক সময় তারা সমস্যাটার গভীরে পৌঁছাতে পারে না। আর চোর-ডাকাতগুলো তাদের নাকের ডগা দিয়ে ড্যাং ড্যাং করে পালিয়ে যায়।”

ছবিটা প্রফেসর গাঙ্গুলিকে পাঠিয়ে দেবার পর দাদাই আবার গভীর মনোযোগ সহকারে ছবিটা দেখতে লাগলেন। বললেন, “বুঝলি রে সোমু, এই ছবিটার সাথে ওই কম্পিউটারগুলোর নষ্ট হয়ে যাবার কোনও সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। যেসব লোকজন এই ভাইরাসটা ছড়িয়ে দিচ্ছে, তারা তো সাধারণ মানুষদের থেকে বেশ কিছুটা বেশি বুদ্ধি ধরে। হয়তো সে আমাদের ভড়কে দেবার জন্যই এরকম একটা প্রাচীন লিপির কয়েকটা অক্ষর এটার সাথে জুড়ে দিয়েছে। তবে এই লিপিটার কিছু মানে তো আছেই আছে। যদি লিপিটার পাঠোদ্ধার করা যায় তাহলে ভালোই হবে। তবে কাল ওদের অফিসে গিয়ে দেখি তো আসলে হচ্ছেটা কী!”

“দাদাই, আমি বড়োদের অফিসে গিয়ে কী করব? আমাকে যদি ঢুকতে না দেয়!”

“তুই আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট। তাছাড়া গোয়েন্দার সাগরেদকে কেউ আটকায় না। কার ঘাড়ে দুটো মাথা আছে যে তোকে ঢুকতে দেবে না? তুই এক কাজ করিস। আমরা ওখানে গিয়ে যেসব কথা বলব সেই কথাগুলো মন দিয়ে শুনবি আর আমার মোবাইলে রেকর্ড করে রাখবি। বুড়ো হচ্ছি তো, সবকথা যদি আমি মনে রাখতে পারি না। তোকে পরে জিজ্ঞেস করব। যা এখন, অনেক রাত হয়ে গেছে। দিম্মার কাছে গিয়ে শুয়ে পড় গে যা। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে।”

দাদাইয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির কাছাকাছি গিয়ে আবার ফিরে এল সোমু। দাদাই তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই বলল, “আচ্ছা দাদাই, তোমার ওই গন্ধরোবট আর কম্পিউটারগুলো এভাবে মরে যাবার মধ্যে কোনও মিল নেই তো?”

দাদাই মশারির দড়ি টাঙাতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। কয়েক সেকেন্ড কিছু একটা ভেবে আবার সোমুকে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন বল তো? তোর কি মনে হয় সেরকম কিছু ব্যাপার আছে?”

সোমু দেখতে পেল দাদাই প্রশ্নটা করার ফাঁকে মুচকি মুচকি হাসছেন।

সোমু এবার রেগে গেল। বলল, “দাদাই, তুমি কিন্তু বড্ড দুষ্টু হয়ে যাচ্ছ। আমার মনে হয় তুমি এরকম কিছু একটা আগেই ভেবে রেখেছ। তাই না? কী ভেবেছ আমাকে বলো।”

দাদাই সোমুকে কোলে তুলে নিলেন। বিছানায় বসিয়ে বললেন, “তুই বুদ্ধিমান ছেলে সন্দেহ নেই। তবে এটা বুঝতে গেলে তোকে এখন আরও বেশি পড়াশোনা করতে হবে। তবে তুই ঠিক বলেছিস। আমার এই গন্ধরোবট আর কম্পিউটারগুলোকে বাঁচিয়ে তোলার উপায় কিছুটা মিলে যেতে পারে। তবে আগে মরা, রোগ-ধরা কম্পিউটারগুলোকে না দেখে কিছু বলা যাচ্ছে না।”

“তাহলে তুমি পরে আমাকে বলবে তো?”

“নিশ্চয়ই বলব, দাদুভাই। কিন্তু এখন আর বেশিক্ষণ জেগে থাকলে তোর দিম্মা যদি জানতে পারে, তাহলে আমাদের দু’জনকেই বকুনি দেবে। তুই কি তাই চাস?”

“তাহলে আমি ঘুমোতে যাই।” বলেই সোমু দুদ্দাড় শব্দে ছুটে একতলায় চলে গেল।

সিঁড়িতে সোমুর পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাবার আগেই প্রফেসর সান্যালের মোবাইলটা পিঁক পিঁক করে বেজে উঠল। এত রাতে মেসেজ আসছে! মোবাইলের মেসেজ খুলে দেখলেন প্রফেসর গাঙ্গুলির ক্ষুদে বার্তা। কী লিখেছেন সেটা পড়তে পড়তে প্রফেসর সান্যালের কপালের ভাঁজ গাঢ় হচ্ছিল। তিনি তাহলে ঠিকই ধরেছিলেন। ওই অক্ষরগুলো তামিল-ব্রাহ্মীতেই লেখা। কারণ ক্ষুদে বার্তা বলছে-

এর মানে, ANTAVAN – means a person charged with the direction or control of an institution, society, etc. (Governor or Ruler or Master) – যে ব্যক্তি কোনও প্রতিষ্ঠান কিংবা সমাজকে একাই নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। হয়ে উঠতে চায় একনায়কতন্ত্রের প্রভু কিংবা শাসক।

সাত

বাড়ির সামনে থেকেই একটা ট্যাক্সি ডেকে নিয়েছিলেন দাদাই। ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস ধরে যেতে যেতে ধাপার মাঠকে ডানদিকে রেখে চিংড়িঘাটা মোড় থেকে ডানদিকে বাঁক নিলেই সল্টলেক ঢোকা যায়। ট্যাক্সিটা নিকোপার্কের পাশ দিয়ে ঢুকতেই সোমু বিশাল বিশাল বাড়িগুলো দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিল। উরিব্বাস! এত লম্বা লম্বা বাড়িগুলোতে সব কম্পিউটারের অফিস আছে! সোমু দুয়েকটা বাড়ি গুনতে থাকল তারা কত উঁচু হতে পারে। কিন্তু কিছুতেই গুনে শেষ করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি তিনখানা বিশাল বাড়িকে একসাথে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একটা বড়ো গেটের সামনে এসে ট্যাক্সিটা থামল। সোমু দেখল দীপাঞ্জনকাকু আগে থেকেই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। গেটের দারোয়ান সোমুকে দেখে কেমন গোল গোল চোখে তাকাচ্ছিল। নিশ্চয়ই ভাবছিল, এই বাচ্চা ছেলেটা কেন অফিসে এসেছে? দীপাঞ্জনকাকু বলে দেবার পর সোমুকে ঢুকতে দিল। আসলে ওরা তো জানে না সোমু আর দাদাই এখানে তদন্ত করতে এসেছে। বেশি বেগড়বাই করলে দীপাঞ্জনকাকু সবাইকে পুলিশের গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে যাবে।

চারতলায় লিফট থেকে নামতেই দরজার সামনে তখন বিরাট জটলা। কাল বিকেলের পর থেকে এদের কম্পিউটারগুলো নাকি সব মরে পড়ে আছে। চারতলায় লিফট থেকে নেমে দাদাই আর সোমুকে একটা ঘরে এনে বসালেন দীপাঞ্জনকাকু। ঘরে একটা বড়ো লম্বা টেবিল আর টেবিলগুলোকে ঘিরে কয়েকটা চেয়ার পাতা রয়েছে। টেবিলের উপর একটা কম্পিউটার রাখা আছে। দীপাঞ্জনকাকু প্রফেসর স্যান্যালের দিকে তাকিয়ে বললেন, “স্যার, আপনি এই ঘরে বসে নিশ্চিন্ত মনে কাজ করতে পারেন।”

দাদাইয়ের উলটোদিকে পুলিশকাকু ছাড়াও আরও তিনজন দাদাইয়ের চেয়ারের পেছন এসে দাঁড়ালেন। এঁরা এই অফিসেই কাজ করেন বলে মনে হল। দাদাই একটা কম্পিউটারের সামনে বসে সেটাকে অনেকভাবে চালু করার চেষ্টা করতে চাইলেন। প্রথমেই একবার চালু হবার সঙ্গে সঙ্গে সেই ছবিটা ভেসে উঠল যে ছবিটা দীপাঞ্জনকাকু সোমুদের দেখিয়েছিল। ছবিটা প্রায় এক মিনিটের মতো পর্দায় ফুটে উঠেই কম্পিউটারটা আবার বন্ধ হয়ে গেল। দ্বিতীয়বার সেই কম্পিউটারটাকে আর কোনওমতেই চালু করা গেল না।

কাজ করার ফাঁকে একটা নোটবুকে দাদাই কীসব টুকে রাখছিলেন। সোমু একবার উঁকি মেরে দেখল। কিচ্ছু বোঝা যায় না। দাদাইয়ের নেওয়া নোটগুলোকেও যেন অনেকটা সিন্ধু যুগের লিপির মতো মনে হচ্ছিল। একেবারেই অপাঠ্য। দাদাই সোমুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “বুঝলি সোমু, কম্পিউটারের ঘিলুটা একেবারে চেটেপুটে খেয়ে ফেলেছে মনে হচ্ছে।”

কম্পিউটারের ঘিলু! দীপাঞ্জনকাকু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে সবার দিকে তাকাতেই দাদাই বললেন, “আসলে কম্পিউটারের মেমরিটা পুরো নষ্ট করে দিয়েছে। আমি মেমরি মানে হার্ডওয়্যারের কথা বলছি না। সেখানে রাখা তথ্যের কথা বলছি।” তারপর সোমুর দিকে ফিরে বললেন, “বুঝলি সোমু, আমরা যেমন আমাদের মেমরি কিংবা স্মৃতিতে স্থায়ীভাবে অনেক কিছু জমিয়ে রাখি, সেরকম কম্পিউটারের মেমরিতে কিছু তথ্য স্থায়ীভাবে রাখা থাকে যেটা প্রতিবার কম্পিউটারকে চালু করার সময় কাজে লাগে।”

তারপর দাদাইকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা অফিসের লোকজনদের উদ্দেশ্য করে দাদাই বললেন, “আপনারা তো জানেনই, যখন কোনও প্রোগ্রাম চালানো হয় তখন সেটা এই কম্পিউটারের মেমরিতে প্রথমে তুলে আনা হয় এবং সেখান থেকেই পুরো প্রোগ্রামটা চলতে শুরু করে। আর এটাও জানেন, আমাদের লেখা প্রোগ্রাম কিংবা কোনও সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন চালানো মানে সেটা শেষমেশ কম্পিউটার সেটা তার নিজস্ব ভাষায় মানে মেশিনের ভাষায় রূপান্তরিত করে ফেলে। আমাদের যা কিছু প্রোগ্রাম, যেটা বেশিরভাগ সময়ে আমরা ইংরেজি ভাষায় লিখি সেটাও শেষমেশ মেশিনের ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে যায়। তবেই কম্পিউটার সেটাকে পড়তে পারে। ফলে কম্পিউটারের নামের মেশিনটি শুধুমাত্র ০ আর ১ বুঝতে পারে। আর এই ভাইরাসটি কম্পিউটারের স্থায়ী মেমরিতে যে তথ্য থাকে সেটাকে পুরোপুরি নষ্ট করে দিচ্ছে। তাই কম্পিউটারকে কোনওমতেই চালু করা যাচ্ছে না।”

দীপাঞ্জনকাকুর দিকে তাকিয়ে দাদাই জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা, তোমাদের কাছে এমন একটা কম্পিউটার আছে যেটা বেশ কিছুদিন চালানো হয়নি? মানে এমন একটা কম্পিউটার যেটা হয়তো অনেকদিন কেউ ব্যবহার করেনি।”

দীপাঞ্জনকাকু দাঁড়িয়ে থাকা অফিসের লোকজনদের দিকে তাকালেন। পাশেই দাঁড়ানো একজন মহিলা বললেন, “একটা কম্পিউটার আছে যেটা মাস তিনেক ধরে বন্ধ হয়ে পড়ে আছে।”

“কেন?”

“আসলে যিনি ওটা ব্যবহার করতেন তিনি অসুস্থ বলে লম্বা ছুটি নিয়েছেন।”

সেই কম্পিউটারটিকে তুলে এনে টেবিলে রাখা হল। দাদাই মেশিনটা চালু করতে বললেন। সেই ভদ্রমহিলা ছুটিতে থাকা সহকর্মীর সাথে মোবাইলে কথা বলে পাসওয়ার্ড জেনে নিলেন। কম্পিউটারটিকে চালু করার আগে তার সাথে সমস্ত নেটওয়ার্ক তারের যোগাযোগ ছিন্ন করা হল। মেশিনটা চালু করে দাদাই বললেন, “ওটা চালু অবস্থায় দশ-পনেরো মিনিট থাকুক। আমার মনে হচ্ছে এটা বন্ধ হয়ে যাবে না। সোমু, তুই একটু নেড়েচেড়ে দেখ, ততক্ষণ আমরা একটু কফি খেয়ে আসি।”

অফিসের ম্যানেজার গোছের একজন ভদ্রলোক প্রচণ্ড শশব্যস্ত হয়ে দাদাই আর দীপাঞ্জনকাকুকে তাঁর সাথে নিয়ে গেলেন।

সোমু কম্পিউটারটা নাড়াচাড়া করতে থাকল। একটাও গেম দেখতে পাচ্ছে না। সোমু ভাবল, এরা কেমন লোক রে বাবা! এদের এতগুলো কম্পিউটার আছে, অথচ একটাও গেম থাকে না কেন? এরা কি গেম খেলতে ভালোবাসে না? এরকম লোকও আছে তাহলে!

বেশ কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে পাশে বসে থাকা সেই ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, এই কম্পিউটারে একটাও গেম নেই কেন? আপনারা গেম খেলেন না?”

ভদ্রমহিলা খুব সুন্দর করে হেসে উঠলেন। বললেন, “আমাদের অফিসে সারাদিন শুধু কাজ করতে হয়। গেম খেলার সময় পাওয়া যায় না। আচ্ছা, তুমি বুঝি খুব গেম খেলতে ভালোবাসো?”

“খুব ভালোবাসি না, তবে মাঝে মাঝে খেলি। দাদাইয়ের একটা পুরনো কম্পিউটার আছে। মাঝে মাঝে সেখানে খেলতে পাই।”

“কী কী গেম আছে তোমার?”

“অ্যাংরি বার্ডস আছে। ডিজনি আছে। হ্যারি পটারের অ্যাডভেঞ্চার আছে। পোকেমন গো আছে। তবে এগুলো এখন আর বেশি খেলি না। দাদাই একটা নতুন স্পাই গেমস এনে দিয়েছে, ‘আই স্পাই ট্রেজার হান্ট’। সেটা খুব ভালো গেম।”

তাদের কথা বলার ফাঁকে দাদাই আর পুলিশকাকু কখন ঘরের মধ্যে চলে এসেছে সোমু খেয়াল করেনি। ম্যানেজার সোমুদের সবাইকে একটা বড়ো ক্লাসরুমে নিয়ে গেলেন। সঙ্গে সেই কম্পিউটারটিকে নিয়ে গেলেন। এত বড়ো একটা ক্লাসরুম সোমু আগে কখনও দেখিনি। সব চেয়ার ভর্তি হয়ে যাবার পর অফিসের বাকি লোকজন সবাই সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

দাদাই পকেট থেকে একটা পেন ড্রাইভ বের করে কম্পিউটারের ইউ.এস.বি পোর্টে লাগিয়ে দিলেন। অফিসের সেই ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এটাকেও যদি মেরে ফেলি ক্ষতি নেই তো? মানে এই কম্পিউটারে কোনও জরুরি তথ্য নেই তো?”

ভদ্রমহিলা হেসে ফেললেন। বললেন, “আমাদের এতগুলো কম্পিউটারের একটাও যখন কাজ করছে না, তখন মাত্র একটা কম্পিউটার চালু না থাকলে কী আর বিশেষ ক্ষতি হবে? তাছাড়া ওটা এমনিতেই তিন মাস ধরে বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। ওখানে জরুরি কিছু থাকলে কেউ না কেউ চালু করত।”

দাদাই বললেন, “ঠিক বলেছেন। আমার ধারণা বলছে যে ভাইরাসটা ছড়িয়েছে সেটা এসেছে আপনাদের ই-মেলের মাধ্যমেই। তার মানে এই কম্পিউটারটাকে চালু অবস্থায় নেটওয়ার্কে জুড়ে দিলে এটারও ওই একই অবস্থা হবে।”

“স্যার, কিছই কি করা যাবে না!” এবার সেই ম্যানেজার গোছের ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন।

“আপনারা তো বললেন যে সর্বশেষ অ্যান্টি-ভাইরাস ইন্সটল করা আছে। তার মানে এটা সেইসব অ্যান্টি-ভাইরাসকে তুড়ি মেরে ধরাশায়ী করে ফেলেছে আর নয়তো ফাঁকি দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। আসলে আমরা যতই অস্বীকার করি না কেন, আসল কথাটা হল, পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত এমন কোনও কম্পিউটার সিস্টেম তৈরি হয়নি আর হবেও না যেখানে আপনি নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারবেন। একদল বুদ্ধিমান মানুষ যখন কোনও প্রযুক্তি কিংবা সিস্টেম তৈরি করতে পারে, তখন তাদের থেকে আরও বেশি বুদ্ধিমান অন্য একদল মানুষ সেই প্রযুক্তি কিংবা সিস্টেমকে ভেঙে ফেলতেও পারে। এ আর নতুন কী! আরে বাবা, লখিন্দরের ঘরেও যে ছিদ্র ছিল সেটা চাঁদ সদাগরের মতন সাহসী আর ধুরন্ধর ব্যবসায়ী তো আগে থেকে জানতে পারেনি।”

কথা বলার ফাঁকে দাদাই পেন ড্রাইভ থেকে একটা প্রোগ্রাম চালানো মাত্র কম্পিউটারে একটা নীল পর্দা ভেসে উঠল। সেটা কিছুক্ষণ সেই অবস্থায় থাকার পর কম্পিউটারটা আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে গেল। তারপর অন্য কম্পিউটারগুলোর মতোই সেটাকেও আর কোনওভাবেই চালু করা গেল না।

সবাই যখন নিরাশ মুখে দাঁড়িয়ে আছে, দাদাই তখন একগাল হেসে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী, ঠিক এভাবেই আপনাদের কম্পিউটারগুলো একটার পর একটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তো?”

সবাই সমস্বরে হাঁ হাঁ করে উঠতেই দাদাই বললেন, “একটা ছোট্ট তফাত আছে। আপনারা হয়তো লক্ষ করেননি যে এই কম্পিউটারটা বন্ধ হবার আগে সেই অজানা ছবিটা ভেসে ওঠেনি। কারণ, এটা আমার তৈরি একটা প্রোগ্রাম।”

দীপাঞ্জনকাকু প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। হঠাৎই বলে ফেললেন, “মানে আপনিই কি এই ভাইরাসটা তৈরি করেছেন?” তারপর সেখানে উপস্থিত সবার মুখের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে একটুখানি থেমে বললেন, “মানে এইরকম একটা কিছু…”

দাদাই এবার হো হো করে হেসে উঠলেন। “আরে বাবা, আমি তো আপনাদের প্রথমেই বলেছি যে এটাকে ঠিক ভাইরাস বলা যায় না। তবে একজন সাধারণ কম্পিউটার ব্যবহারকারীর দিক থেকে দেখলে এটাকে ভাইরাস বলাটা কিছু অস্বাভাবিক নয়। আমাদের ভাষায় এদের বলা হয় একধরনের disruptor। মানে বিনা নোটিশে মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু তছনছ করে দেওয়া বিধ্বংসী কোনও ঘটনা। যেমন হঠাৎ করে সাইক্লোন অথবা সুনামি আসে কিংবা যখন ভূমিকম্প হয় কিংবা কোথাও যখন উগ্রপন্থীরা হামলা করে। এটাও সেইরকম একটা আপাতপক্ষে বিনা কারণে ঘটনাটাকে আটকানোর বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়ে আমাদের স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত করেছে। এমন ঘটনা যেকোনও দেশে যেকোনও সময় ঘটতেই পারে।”

“তার মানে আগে এরকম হয়েছিল?”

“এদেশে হয়নি, তবে হতে কতক্ষণ? আসলে কী জানো, কম্পিউটারের কি-বোর্ড থাকলে বন্দুকের দরকার কী!”

“তাহলে?”

“তাই সব দেশের প্রশাসকদের প্রতিমুহূর্তে এরকম বিভিন্ন ধরনের ঘটনার জন্য অনেক আগে থেকে প্রস্তুত থাকতে হয়। আজকের যুগে সাইবার আক্রমণই একটা যুদ্ধ। দেশের বিভিন্ন ধরনের কম্পিউটার সিস্টেমকে বাঁচাতে আগের থেকে তৈরি থাকতে হয়। তাই এই প্রোগ্রামটা অনেকদিন আগেই তৈরি করা হয়েছিল। ধরে নিন এটা কোনও বিধ্বংসী সাইবার আক্রমণকে আগাম ঠেকানোর জন্য করা হয়েছিল। অনেকটা সতর্কতা হিসেবে বসন্ত রোগের টিকা নিয়ে রাখার মতো যাতে বসন্ত রোগ শরীরকে আক্রমণ করতে না পারে। আমার প্রোগ্রামটাও অনেকটা সেইরকম। এই প্রোগ্রামটা আমরা বেশ কয়েক বছর আগে তৈরি করেছিলাম যদি কোনওদিন কোনও শত্রু-দেশ আমাদের দেশে কোনওরকম সাইবার আক্রমণ করে, তাকে জরুরি ভিত্তিতে ঠেকানোর জন্য। বলতে গেলে শুধুমাত্র শত্রুদের ঠেকানোর জন্যই নয়। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে রাখা। আমাদের তৈরি সেই বিশেষ মারাত্মক বিষাক্ত ভাইরাস যেকোনও শত্রু-দেশের সমস্ত জরুরি ব্যবস্থা, যেখানে যেকোনও ধরনের কম্পিউটার তারা ব্যবহার করে সেগুলোকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে লোহার বাটখাড়া বানিয়ে দিতে পারে।”

সোমু দাদাইয়ের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনতে শুনতে ভাবছিল, দাদাইকে এতটা গম্ভীর হতে কখনও সে দেখেছে কি না। মাঝে মাঝে ঘরে অন্যদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছিল তারা প্রচণ্ড বিস্মিত চোখে অথচ গভীর আগ্রহ নিয়ে দাদাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখের পলক পড়ছে বলে মনে হচ্ছে না। সোমুর মনে হচ্ছিল সবাই বোধহয় নিঃশ্বাস আটকে রেখে দাদাইয়ের কথাগুলো শুনছেন।

দাদাইয়ের বলার শেষ হবার পরেও ঘরে উপস্থিত সবাই একেবারে চুপ। একটা আলপিন পড়লেও যেন তার শব্দ শোনা যাবে। এমন নীরবতার মধ্যে হঠাৎ পুলিশকাকুই প্রথমে কথা বলে উঠলেন। “তাহলে আপনারা যে প্রোগ্রামটা শত্রু-দেশ থেকে সাইবার আক্রমণ ঠেকানোর জন্য তৈরি করেছিলেন, এমনও তো হতে পারে সেটাই কেউ এখন অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে। এরকম কি হতে পারে না?”

সোমু দাদাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখল, কথাটা শুনে দাদাইয়ের কপালে কয়েকটা গভীর ভাঁজ পড়েছে। তার মানে দাদাই একটু অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তবুও দাদাই ঠাণ্ডা মাথায় আবার বোঝাতে শুরু করলেন। বললেন, “আসলে আমার মতো যারাই যখন এইধরনের কাজের সাথে যুক্ত থাকেন, তারা শুধুমাত্র দেশের কথা ভেবেই কাজ করেন। তাই সেইসব তথ্য কোনওমতেই দেশের বাইরে যাবার কোনও সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে মানুষের বুদ্ধি বাড়ছে বই কমছে না। আজ থেকে দশ বছর আগে মানুষ যেটা ভাবতে পারেনি, সেরকম অনেক কিছুই আজকের মানবসভ্যতার কাছে অজানা নয়। কে বলতে পারে আজ পৃথিবীর কোনও এক প্রান্তে কোনও এক অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ এইধরনের গবেষণা করছে না! আর এটা তো আমরা সবাই জানি যে সাপের বিষে মানুষ মারা যায়। আবার সেই সাপের বিষেই মানুষের জীবন বাঁচানোর ওষুধ তৈরি হয়। মানুষের বুদ্ধির ক্ষেত্রেও সেই কথাটা খাটে। মানুষ বুদ্ধিমান। তবে সব বুদ্ধিমান মানুষই যে ভালোমানুষ হবে এটা কে দিব্যি দিয়ে বলতে পারে?”

সবাই নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ছিল। দাদাই আবার বলতে শুরু করলেন। বললেন, “এই প্রোগ্রামটা আমি নিজে অনেকদিন আগে তৈরি করেছিলাম। বিদেশি ভাইরাসকে ঠেকানোর জন্য। ভাইরাস তৈরি করার জন্য নয়। এখন হয়তো পৃথিবীর কোনও এক প্রান্তে কোনও একজন মানুষ ঠিক একই ধরনের একটা প্রোগ্রাম তৈরি করেছে। তবে তার উদ্দেশ্য যে ভালো নয় সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। সে এটাকে দেশ কিংবা সমাজের ক্ষতি করার জন্য তৈরি করেছে। সে হয়তো দূর থেকেই বুঝতে চাইছে আমাদের প্রতিক্রিয়া কী হচ্ছে, তার তৈরি এই ভাইরাস কতটা জোরালো মারণাস্ত্র হতে পারে। এই কম্পিউটারটিকে এক্ষুনি আবার চালু করা সম্ভব। কারণ এটাকে সেই ভাইরাস এখনও ছুঁতে পারেনি। কিন্তু অন্যগুলোকে এখনই চালু করা যাবে না। আমার ধারণা, এখনও পর্যন্ত আপনাদের কম্পিউটারগুলোর বিশেষ কিছু ক্ষতি হয়তো সে করতে পারেনি। তবে আমাকে জানতে হবে কতখানি ক্ষতি সে করতে পেরেছে।”

কথা বলার ফাঁকে দাদাই আবার পেন ড্রাইভ থেকে অন্য একটা প্রোগ্রাম চালিয়ে কম্পিউটারকে চালু করে দিলেন।

অফিসের লোকজন একসাথে হাততালি দিয়ে উঠল। সোমু সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছিল। সবাই দারুণ খুশি। সোমুর খুব খুব খুব ভালো লাগছিল। সোমুর দাদাই এমন একটা জটিল সমস্যার সমাধান করে দিলেন। সোমু জানে লোকে যতই ভাবুক না কেন ব্যাপারটা কিন্তু এত সহজ নয়।

দাদাই বললেন, “যে ভাইরাস কম্পিউটারগুলোকে নষ্ট করেছে সেই ধরনের ভাইরাস শুধুমাত্র মেশিন চালু হবার সময় প্রথম যে প্রোগ্রামটা চলে সেটাকেই নষ্ট করে দিয়েছে। ফলে কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম চালু করতে পারা যাচ্ছে না।”

সামনের সারিতে যারা বসেছিলেন, তাদের উসখুস করতে দেখে কোম্পানির ম্যানেজার দাদাইয়ের কাছে গিয়ে কিছু একটা বললেন। দাদাই একটু হেসে বললেন, “আমি বুঝেছি। আসলে এটা আমারই ভুল। এখানে যারা কাজ করেন তারা সবাই কম্পিউটার ব্যবহার করেন। সত্যিই তো, কম্পিউটারের খুঁটিনাটি বোঝার দরকার হয় না। দেখছি আমি ওঁদের মতো করে বোঝাতে পারি কি না।

“ব্যাপারটা একটু সহজ করে বোঝাই। এই ভাইরাস কম্পিউটারের ROM-এ লিখে রাখা প্রোগ্রামকে পুরোপুরি পালটে দিয়েছে। কীভাবে? যেমন ধরুন, আপনারা যদি কয়েক পাতার একটা চিঠিকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলেন কিংবা আপনাদের প্রিন্টার রুমে যে একটি কাগজ কাটার মেশিনটি রয়েছে, সেখানে যদি একটি মোটা বইকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া হয়, সেই ছেঁড়া পাতাগুলো থেকে সেই বইটি কি আবার আগের মতো পড়তে পারবেন? কখনওই পারবেন না। ঠিক সেইরকম এই ভাইরাস ROM-এ লিখে রাখা প্রোগ্রামকে সম্পূর্ণ নষ্ট করে দিয়েছে।”

একটু থেমে দাদাই সবার দিকে একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, “আমি কি আপনাদের মতো করে বোঝাতে পারলাম? আমি চেষ্টা করছি আপনাদের কম্পিউটারগুলোকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে।”

ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে সোমু দাদাইয়ের সাথে আবার সেই আগের বসার ঘরে ফিরে এল। দাদাই কম্পিউটারগুলোকে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চাইছেন। নিজের ল্যাপটপ চালু করতে করতে ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “অফিসে কতগুলো কম্পিউটার আছে?”

ম্যানেজার বললেন, “ধরুন দু’শোর মতো।”

“অপারেটিং সিস্টেমের লাইসেন্স কতগুলো আছে?”

“কয়েকটা পুরনো কম্পিউটার ছাড়া বাকি সবার লাইসেন্স আছে। আমাদের একটাই গ্রুপ লাইসেন্স আছে। আড়াইশো কম্পিউটারের জন্য নেওয়া একটাই লাইসেন্স।”

দাদাইয়ের মুখে হাসি ফুটল। বললেন, “তাহলে ব্যাপারটা কিছুটা সহজ হবে।” বলেই দাদাই ওঁদের কাছ থেকে লাইসেন্স নম্বরটা নিয়ে নিজের ল্যাপটপে বসে কিছু একটা করলেন। তারপর একটা নতুন কমপ্যাক্ট ডিস্ক নিয়ে সেটাতে দাদাই নতুন তৈরি প্রোগ্রামটা ভরে দিলেন। বললেন, “আপনাদের প্রতিটা ডেস্কটপে নতুন করে অপারেটিং সিস্টেম ইন্সটল করতে হবে। যখন ইন্সটল করবেন তখন প্রথমে ইন্টারনেট কিংবা অন্য নেটওয়ার্ক থেকে কম্পিউটারগুলোকে আলাদা করে রাখবেন। অপারেটিং সিস্টেম ইন্সটল হয়ে যাবার পরে অন্য কোনও প্রোগ্রাম ইন্সটল করার আগে আমার এই প্রোগ্রামটা একবার চালিয়ে দেবেন। তারপর আরও একবার কম্পিউটারকে বন্ধ করে আবার চালু করবেন। দ্বিতীয়বার চালু হবার পর নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত করলেও আর কোনও সমস্যা হবার কথা নয়। তবে আগে আপনারা যেকোনও দুটো কম্পিউটার ঠিক করে নিন। আমাকে কাল জানাবেন সেগুলো ঠিকঠাক কাজ করছে কি না। তারপর আমি বললে বাকি সবগুলোর কথা ভাববেন। এর মধ্যে অন্য নতুন কোনও সমস্যা আসে কি না সেটা দেখে নিতে চাইছি।”

দেখতে দেখতে বেশ বেলা হয়ে গেছে। সোমুরা সেই কোন সকালে বেরিয়েছে। দাদাইও অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করছিল। প্রায় এগারোটা বেজে গেছে। এবার বাড়ি না ফিরলে দিম্মা রাগ করবে। স্নান করে খাওয়াদাওয়া করতে দাদাইয়ের অনেক দেরি হয়ে যাবে।

এদিকে একের পর এক অনেকগুলো প্রশ্ন সেই কখন থেকে সোমুর মনে জমে উঠেছে। প্রশ্নগুলোর ঠিকঠাক উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত সোমুর পেটটা কেমন যেন গুড়গুড় করে।

ট্যাক্সিতে সোমুদের উঠিয়ে দিয়ে দীপাঞ্জনকাকু বললেন, “স্যার, দুয়েকদিনের মধ্যে আমি আপনাদের বাড়ি যাব। তবে অন্য আরও যেসব অফিসে এমন ঘটনা ঘটেছে, তারা নিজেরা সেই সমস্যার সমাধান না করতে পারলে তাদের আপনার সাথেই যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়ে আসব।”

আট

ট্যাক্সিতে উঠেই সোমু দাদাইয়ের দিকে তাকাল। দাদাইকে জিজ্ঞেস করার জন্য অনেকগুলো প্রশ্ন জমে আছে। দাদাই জানালার কাচের ওপারে রাস্তায় লোকজনের চলাফেরা দেখছিলেন। বললেন, “জানিস সোমু, আমি যখন কলেজে পড়া শুরু করেছিলাম, ধরে নে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে, তখন এই অঞ্চলটা ঘন জঙ্গলে ঢাকা ছিল। আর আজ কী হয়েছে দেখতেই পারছিস।”

বড়ো রাস্তায় উঠে চিংড়িঘাটা মোড়ে এসে গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেল। সামনে বাইপাসের রাস্তায় সারি সারি গাড়ি আটকে পড়েছে। সোমু জানে এখন অফিস টাইম। কলকাতার রাস্তায় যানজট লেগেই থাকে। দাদাই সোমুর দিকে তাকালেন। বললেন, “সোমু ওই অফিসে যা যা বললাম তুই অনেকটাই হয়তো বুঝতে পারিসনি।”

সোমু ঘাড় নাড়তেই দাদাই বললেন, “ঠিকই তো, তোর মতো বয়সে বোঝাটা একটু কঠিন। তবে তোদের স্কুলে তো এখন অনেক নিচু ক্লাস থেকেই কম্পিউটার পড়ানো হয়। ঠিক আছে, আমি তোর মতো করে বোঝাই।”

দাদাই বলতে শুরু করলেন, “ধর, আমরা সবাই মিলে যখন কোথাও বেড়াতে যাই তখন বাড়িতে তালাচাবি লাগিয়ে যাই। এবার ধর, যেদিন বাড়ি ফিরেছিস সেদিন রাত্রি হয়ে গেছে। তুই সদর দরজার তালাচাবি খুলে প্রথমেই কী করবি?”

“কেন? দরজা খুলেই ড্রয়িংরুমের আলোটা জ্বালিয়ে দেব।”

“কীভাবে?”

“বা রে! ড্রয়িংরুমের আলোটা না জ্বালালে দেখতে পাব না তো।”

“কী করে জানবি ড্রয়িংরুমের আলোর সুইচটা কোথায় আছে?”

“আমি জানি তো। দরজা খুলে ঢুকলেই ডানহাতে।”

“ব্যস। এবারে শোন। তুই জানিস দরজার ডানদিকে সুইচ আছে। তাই অন্ধকারের মধ্যেই সেই সুইচ টিপে প্রথম আলোটা জ্বালালি। পরে ঘরে ঢুকে তুই অন্য আলোগুলো জ্বালাবি। ব্যাপারটা একেবারে জলবৎ তরলং। এবার যদি তুই বেড়িয়ে ফেরার আগে আমি ডানদিকের সুইচটা সেখান থেকে সরিয়ে ফেলি?”

“তাহলে আলো জ্বালাতে পারব না।”

“ঠিক তাই। আমি যদি সুইচটা দরজার মাথার উপরে লাগিয়ে রাখি তুই জানতেই পারবি না। ফলে আলো জ্বালাতে পারবি না। ড্রইংরুমের আলো না জ্বালাতে পারলে বাড়ির অন্য আলোগুলো জ্বালাতে পারবি না। এই ভাইরাস এইধরনের এক পদ্ধতিতে চালাকি করেছে।”

“কীভাবে?”

“কম্পিউটারের ভেতরে একটা বিশেষ ধরনের চিপ থাকে যেটাতে আগে থেকে প্রোগ্রাম করা থাকে কম্পিউটারের সুইচ অন করলেই কোন প্রোগ্রামটা চালু হয়ে যাবে। সেই প্রোগ্রামটা আবার হার্ড ডিস্কের কোথায় অপারেটিং সিস্টেম প্রোগ্রামগুলো আছে সেই ঠিকানাটা জানে। এখন কেউ যদি সেই চিপের প্রোগ্রামটাকেই খিচুড়ি পাকিয়ে দেয়, তাহলে কী হবে?” বলেই দাদাই পকেট থেকে নোটবই বের করে সেখানে একটা বেশ বড়ো শব্দ লিখলেন, pneumonoultramicroscopicsilicovolcanoconiosis।

বললেন, “এটাই ইংরেজি ভাষায় সবথেকে লম্বা শব্দ।”

সোমু হাঁ করে দাদাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেই দাদাই পেন দিয়ে কয়েকটা দাগ কেটে দিলেন-

pneumono। ultra। microscopic। silico। volcano। coniosis

“এটা হল একধরনের ফুসফুসের রোগের নাম। যেটা আগ্নেয়গিরি থেকে খুব সূক্ষ্ম সিলিকন কণা প্রশ্বাসের সাথে ফুসফুসে গেলে এই রোগ হয়। সেসব কথা এখন থাক। খেয়াল করলে দেখতে পাবি এই শব্দটাতে পঁয়তাল্লিশটা অক্ষর আছে। এখন এই অক্ষরগুলো যদি আমি টুকরো টুকরো করে ঘেঁটে চচ্চড়ি বানিয়ে দিই তাহলে কেমন হবে?”

“তাহলে শব্দটা আর আমরা চিনতে পারব না।”

“ঠিক তাই। ওই ভাইরাসটা ঠিক এই কায়দায় কম্পিউটারের ROM-এ যে প্রোগ্রামটা থাকে সেটাকে পুরোপুরি গুবলেট করে দিয়েছে। প্রোগ্রাম মানেই আসলে কতগুলো নির্দেশ। সেই নির্দেশগুলো মেশিনের ভাষায় লেখা থাকে। মেশিনের ভাষায় লেখা কোনও একটা প্রোগ্রাম তুই যদি একটা পাতায় ছেপে বার করিস, গোটা পাতা জুড়ে দেখবি শুধু ০ আর ১। এখন ভাইরাসটা যদি দুষ্টুমি করে ০ গুলোকে ১ আর ১ গুলো ০ করে দেয়! তাহলে কেমন হবে? তাহলে সেখানে লিখে রাখা নির্দেশগুলো কম্পিউটার আর পড়তে পারবে না। সে তো একটা যন্ত্রমাত্র। ঠিক যেমন আমি যদি তোকে হিব্রু কিংবা ল্যাটিন ভাষায় লেখা একটা বই পড়তে দিই, তুই কি পড়তে পারবি?”

“তাহলে সেই ভাইরাসটা তোমার প্রোগ্রামটাকেও তো একইভাবে নষ্ট করে দিতে পারে।”

“নিশ্চয় পারে। এখন দেখতে হবে কে আগে থেকে কম্পিউটারের মেমরিতে গিয়ে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকছে। যুদ্ধের সময় কী হয়? যে পক্ষ বুদ্ধিমান তারা বুদ্ধি খাটিয়ে শত্রুর অজান্তেই তাদের গতিবিধি আগাম জেনে নেয়। তারপর আগে থেকেই ঘাপটি মেরে বসে থাকে। শত্রুদের সৈন্যরা জানতেই পারে না। ঠিক তেমনি কম্পিউটার চালু হতেই আমার প্রোগ্রামটা ROM-এ গিয়ে চুপচাপ বসে থাকবে। এমনকি অপারেটিং সিস্টেম চালু হবার আগেই। এটা কেন করলাম জানিস? কারণ কম্পিউটার চালু করলেই আমার প্রোগ্রামটা সবার আগে চলবে, আর সেটা গিয়ে মেমরিতে নিজের একটা অবিকল যমজ বানিয়ে সেখানেই বসে থাকবে। যদি ওইধরনের কোনও ভাইরাস আবার আক্রমণ করে, তাহলে আমার প্রোগ্রাম আগেভাগেই জেনে যাবে এবং সেই প্রোগ্রামটাকে নষ্ট করে দেবে।”

“সে তো সব অ্যান্টি-ভাইরাস তাই করে।”

“তাহলে আমার প্রোগ্রামটাকেও অ্যান্টি-ভাইরাস বলতে পারিস। তবে বিশেষ ধরনের অ্যান্টি-ভাইরাস।”

“জানো তো দাদাই, যারা অ্যান্টি-ভাইরাস তৈরি করে তারাই নাকি আগে ভাইরাস তৈরি করে সব কম্পিউটারে ছড়িয়ে দেয়। তারপর আমাদের অ্যান্টি-ভাইরাস কিনতে বাধ্য করে। এটা কি ভালো?”

“একদম ভালো নয়। তবে সবাই সেটা করে না।” বলতে বলতে দাদাই পকেট থেকে একটা ব্যাঙ্কের চেক বের করে দেখালেন। সোমুর চোখের সামনে রেখে বললেন, “এখানে কী লেখা আছে বল।”

সোমু দেখল, ‘টু ল্যাকস ফিফটি থাউসেন্ড ওনলি’। পড়তে পড়তেই সোমুর চোখগুলো গোল্লা পাকিয়ে গেল। “তোমাকে ওরা এত টাকা দিল কেন?”

দাদাই হেসে ফেললেন। বললেন, “দেবে না! আমি ওদের কোটি কোটি টাকা লোকসানের হাত থেকে বাঁচালাম। তাছাড়া ডাক্তারদের কাছে গেলেও তো পারিশ্রমিক দিতে হয়। তাই না? আমি ওদের কম্পিউটারগুলোর অসুখ সারিয়ে দিলাম যে। কী, সারিয়ে দিলাম না, বল?”

সোমু খুশিতে দাদাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরল। বলল, “দাদাই, আরও একটা প্রশ্ন আছে।”

“এখনও তোর প্রশ্ন আছে?” বলেই সোমুর মাথার চুলের ভেতর হাত ডুবিয়ে ঘেঁটে দিয়ে বললেন, “বেশ করেছিস প্রশ্ন করেছিস। যখনই মনে কোনও প্রশ্ন আসবে তখনই প্রশ্ন করবি। অবশ্য বেশিরভাগ সময়ে নিজেকেই প্রশ্ন করতে হবে। কখনও কখনও অন্যদের। কিন্তু সারাজীবনে কখনওই প্রশ্ন করতে ছাড়বি না। এবার বলে ফেল তোর কী প্রশ্ন আছে।”

“দাদাই, তুমি ওদের কাছ থেকে লাইসেন্স নম্বরটা নিলে কেন?”

“আসলে কী জানিস সোমু, অনেকেই বিনা লাইসেন্সে সফটওয়্যার ব্যবহার করে। সেটা আসলে বে-আইনি। তাছাড়া আমি যদি আমার প্রোগ্রামটা ওদের এমনি এমনি দিয়ে দিই, কেউ সেটাকে চুরি করে ব্যাবসা শুরু করে দিতে পারে। তাই আমার প্রোগ্রামটার সাথে ওদের যে লাইসেন্স নাম্বারটা আছে সেটা জুড়ে দিয়েছি। খুব সহজ ব্যাপার নয়। অনেক জটিল করে লেখা লজিক আছে সেখানে।”

“অন্য কম্পিউটারে কাজ করবে না?”

“না, শুধুমাত্র ওদের অফিসে যে কম্পিউটারগুলো আছে শুধু সেগুলোর জন্যই কাজ করবে। এরপরেও যদি কেউ চুরি করে অন্য কোথাও ব্যবহার করে তাহলে ওদের কোম্পানি নিজেই ফেঁসে যাবে। কোনও নামী কোম্পানি এটা করার ঝুঁকি নেয় না।”

“তাহলে ওরা তোমার প্রোগ্রামটাকে নিয়ে ব্যাবসা করতে পারবে না।”

“ঠিক। লাইসেন্স নম্বরটা জুড়ে দিয়েছি এই কারণে যে যখনই ওরা আমার প্রোগ্রামটা চালাতে যাবে তখন সেটা দেখে নেবে সেটার সাথে জুড়ে থাকা লাইসেন্স নম্বর আর অপারেটিং সিস্টেমের লাইসেন্স নাম্বার একই কি না। যদি হয় তাহলে চালু হবে আর তা না হলে চালু হবে না।”

“তার মানে যারা মরা কম্পিউটারকে জ্যান্ত করতে চাইবে তাদের সবাইকে তোমার কাছে আসতেই হবে।”

“নিশ্চয়ই আসতে হবে। আমাকেও কাজ করতে হবে। শুধু তাই নয়, ওদের যতগুলো লাইসেন্স আছে ততগুলো কমপ্যাক্ট ডিস্ক বানাতে হবে।”

“তুমি কি এবার নতুন কোম্পানি খুলবে, দাদাই?”

দাদাই আবার হেসে ফেললেন। বললেন, “আমার কি আর সেই বয়স আছে রে! তুই তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে যা, তুই নাহয় কোম্পানি খুলবি। তোকে সবকিছু শিখিয়ে দেব।”

“আর ওই টাকাটা?”

“টাকাটা তো ওরা আমাকে দেয়নি।”

“তবে?”

“আমি টাকাটা বাচ্চাদের একটা সংগঠনকে দিতে বলেছিলাম। তোর দিম্মা বাচ্চাদের একটা আশ্রমে মাঝে মাঝে যায়। আমিও একবার গিয়েছিলাম। ওরা অনেক অনাথ শিশুদের আশ্রয় দেয়। পড়াশোনার সুযোগ করে দেয়। অনেক ভালো ভালো কাজ করে। টাকাটা ওদের বেশি দরকার। তাই না সোমু?”

সোমুর খুব ভালো লাগল দাদাইকে দেখে। সোমু আবার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি আমার খুব ভালো দাদাই। তাড়াতাড়ি বাড়ি চলো। আমার বড্ড খিদে পেয়েছে।”

“অনেক দেরি হয়ে গেছে, তাই না? তোর দিম্মা যদি আমাদের বকুনি দেয়!”

“আজ তো দিম্মা তোমাকে বকবে না। জানো, দিম্মা আজ পায়েস রান্না করবে।”

“কেন রে?”

“বা রে, তুমি নিজেই ভুলে গেলে! আজ যে সোমু স্যানালের দাদাইয়ের জন্মদিন।”

অলঙ্করণঃ শিমুল

 জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s