উপন্যাস টুপুরদের শহরে জিতু এসেছে এহসান হায়দার শরৎ ২০১৯

এহসান হায়দারের আগের লেখাপত্রঃ রুপো রঙের মাছ , একটি দোয়েলের গল্প-

এহসান হায়দার

এক

দুষ্টু বাঘের বাচ্চা

গল্পটা জিতুকে নিয়ে। জিতু সুন্দরবনের একটা দুষ্টু বাঘের বাচ্চা। কীরকম দুষ্টু তা শোনো। সে আর বনে থাকবে না, বন তার ভালো লাগে না, বনে তার মন এক মুহূর্তও যেন টিকছে না। তার ওপর জিতু বনের কাউকে আর কাছেরও ভাবছে না। বাবাকে, মাকে পর্যন্ত সে দেখতে পায় না যেন। সকাল থেকে দুপুর অবধি জিতু বনময় টো টো করে বেড়ায়। এই-ই হল তার একমাত্র কাজ। কারও কথা শুনবার তার সময় নেই। বয়স দশ বছর হল, কিন্তু সে একটুও শিকার শিখছে না, এমনকি দৌড়ে গাছে উঠতেও পারে না। কী করে সে খাবার খাবে, বেঁচে থাকবে তা নিয়ে ওর আত্মীয়স্বজন খুব শঙ্কিত। আর জিতু নাকি মাংস-টাংসও খায় না। ওর নাকি ওই মাংস ভালো লাগে না। দিন কয়েক আগে একটা কচি হরিণের মাংস দিল এনে ওর বাবা ওকে। ও বলেছিল, ওর এসব মাংস খেতে ভালো লাগে না, মাংসতে রক্ত থাকে। তাছাড়া আরেকটি প্রাণকে জিতু মারতে চায় না নিজের ক্ষুধা মেটাবার জন্য। বাঘদের বংশবিরোধী কথাতে বড্ড খেপে ওঠে ওর চাচারা, ফুপিরা।

ইদানিং নাকি সে পাড়ার ছোটো জাত বানরের বাচ্চাদের সাথে মেশে—এ খবরও ওর বাবা জানে। জিতু হল বনের রাজার ছেলে রাজপুত্র। সে, সে কিনা মেশে প্রজাদের সঙ্গে! এ কেমন কথা? জিতুর ছোটো ফুপি রেগে যায়। বলে, “বংশে এমন ছেলে আর একটিও নেই যে নিজের ভালো বোঝে না। নিজের বংশের জাত যাওয়ার কাজই ওর প্রিয় যেন।”

তবুও জিতু কারও কথা শোনে না। পাড়ার ওই বানরগুলোই জিতুর সৈন্য যেন, পরম বন্ধু যেন। আর সব বাঘদের অভিযোগ জিতুর বিরুদ্ধে—জিতু কোনও বাঘদের ঐতিহ্য রাখছে না। অন্য বাঘের বাচ্চারাও জিতুকে দেখে দেখে ওই একইরকম হয়ে যাবে—এই ভয় সবার ভেতর ঢুকে পড়েছে। জিতু যেহেতু বনে কারও কথা শোনে না, মাংসও খায় না, নিচু জাতের প্রাণীদের সাথে সে মেশে, তাহলে ওকে বনছাড়া করতে হবে, না হলে ওকে মেরে ফেলতে হবে—এই রব উঠল চতুর্দিকে। রাজার কানেও এল একটু আধটু এই কথা। রাজা ভয়ে তটস্থ হল, নিজের ছেলের মৃত শরীর সে কী করে দেখবে। ভুল তার ছেলে করেছে। তাহলে সবাই বিচার আনলে একজোট হয়ে তখন তো ছেলের বিচার তাকেই করতে হবে। ছেলের এমন বিচারের ভয় পেয়ে যায় রাজা বাঘ। রানিকে তখন শীঘ্রই বলে, “তোমার সন্তানকে কোথাও চলে যেতে বলো। বনে থাকলে ওর মৃত্যু দেখতে হবে আমাদের। ওর বিচার আমি কী করে করব, বলো?”

রাজার কথা শুনে রানিও ভড়কে যায়, বোঝে না তখন কী করবে। আর এদিকে জিতু নিজের মতো করেই ভেবেছে, সে শহর দেখবে, মানুষের শহরে ঘুরবে, মানুষের শহরে স্কুলে পড়বে। এই হল তার স্বপ্ন। তাই রাজবাড়ির কাউকে কিছু না বলে রাতের বেলা সে বেরিয়ে পড়ে। রাজার বাড়ির কেউ ওর চলে যাওয়া খেয়ালও করেনি।

জিতু বনের ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে চলে এল নদীর পাড়ে। বিকালে সে একটা গোলপাতা বোঝাই নৌকা দেখে গিয়েছিল। জিতু ওই নৌকায় করেই চলে যাওয়ার চিন্তা করেছে। মাঝরাতের জোয়ারে নৌকা ভাসাবে ওরা। নৌকার কাছে এসে দেখে, মাঝিমাল্লারা এখন রাতের খাবার খাচ্ছে। খাওয়ার পরই ওরা রওনা হবে। জিতু আর কিছু ভাবল না। চলে এল পাড়ে। নৌকার কাছে এসে গলুই বেয়ে একটা ভাঁজে নিজের শরীর লুকিয়ে ফেলল। নৌকার কেউ জানতেও পারল না যে বনের সেরা দুষ্টু বাঘের বাচ্চাটা এখন তাদের সাথে করে শহর ঘুরতে বেরোল। জানল না বাঘ রাজা কিংবা বাঘ রানি, তাদের সন্তান চলে যাচ্ছে দূরে তাদের ছেড়ে।

এমনিতে সারাদিন দৌড়ঝাঁপ করে ক্লান্ত হয়ে ছিল জিতু। কখন যে ভোর হয়েছে তা বুঝতেই পারেনি। ঘুমিয়ে গিয়েছিল সে। সূর্যের আলো পানিতে এসে পড়ছে আর সেই আলো যেন এসে জিতুর চোখকে ঝলমল করে ধুয়ে দিচ্ছে। জিতু চমকে ওঠে। জিতু চোখ মেলে দেখে, সামনেই নদীর পানি কেটে কেটে নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে। একদিকে বড়ো বড়ো উঁচু উঁচু কী যেন তাকিয়ে আছে। সম্ভবত দালান বলে একে মানুষেরা। এরকমটিই সে বনের রক্ষীদের বাড়ির সামনেও দেখেছে আর ওদের আলোচনা থেকেও জেনেছে। হালকা হালকা ঢেউয়ে দুলুনিটা তার ভালোই লাগছে। নাক ডাকিয়ে আরও একটু ঘুমিয়ে নিতে মন চাইল। বনে থাকলে সে এখন কী করত? বানরদের সাথে খেলত, না হলে হয়তো পুরনো রাজবাড়ির সিংহাসনে গিয়ে বসত। তারপর বানররা তাকে মহারাজা বলে সম্বোধন করে বলত, “হে রাজামশায়, আজ আমরা আপনাকে নতুন একটা গান শোনাব, না হলে নাচ দেখাব। কী নাচ দেখতে চান আপনি? চুংকু নাচ, নাকি টুংটুং নাচ?”

তখন রাজাবাহাদুর উঠে দাঁড়িয়ে হয়তো বলল, “না না, আমি কেবল নাচ নয়, গানও শুনতে চাই। তবে তোদের ওই চিঁইইই গান শোনাস নে রে আবার। এমন গান শোনা আমায় মনটা ভরে যায় যেন। এমন নাচ দেখা আমায় চোখ জুড়িয়ে যায় রে দেখে যেন।”

এরকম করেই কেটে যেত জিতুর সময়। জিতু ভাবনায় এল, আসার সময় কাউকে সে বলে আসেনি কোথায় যাচ্ছে, কোথায় কী করছে। কেউ জানে না তার খোঁজ। নাই জানুক, বুঝুক সবাই তার কী গুরুত্ব। বাড়ি থাকলে কেউ বোঝে না যে, তাকে তা বোঝা উচিত সবার। বাবা বকতে থাকে, মা বকতে থাকে, চাচা বকে, চাচী বকে, ফুপি বকে। জিতুর আবার রাগ হয়। জিতু ভাবে, নাহ্‌, শরহটা আগে দেখি, তারপর তো ভাবা যাবে আর কী করা যায়। জিতুর ভালো লাগে শহরে সে কী কী দেখবে তা ভাবতে। কখনও তো মানুষের সমাজে সে যায়নি; সে সমাজ কেমন তা জিতুর জানতে মন চায়। ওদের থাকা-খাওয়া দেখেছে সে বনে আসা লোকদের থেকে দূরে দাঁড়িয়ে। কাছে গেলে তো বড়ো ভয় পাবে মানুষের দল।

“ও ওস্তাদ, আমরা তো খুলনা চইলা আইলাম!”

নৌকার ভেতর থেকে কে যেন সর্দারকে ডেকে বলে। সম্ভবত তার অন্য কোনও সহকারী। কথাটা শুনে জিতুর ভাবনায় ছেদ পড়ে। দুপুর গড়িয়ে গেছে। সূর্য পুব থেকে ম্যারাথন দৌড়ে গিয়ে পশ্চিমের দিকে যাচ্ছে। এবারে ক্ষুধা পেয়েছে জিতুর। জিতু এখন কী খাবে ভাবতে থাকে। জিতু তো বনে কত কত ফলটল খায়। পাকা বটফল, পাকা গাব, পাকা ওড়া, পাকা কেওড়া সব খায়। বানরেরা রান্না করে তা খাওয়ায়। বনে কলাগাছ আছে, কলা খেতে ভালো লাগে জিতুর। জিতু কলা পাবে কোথায়? জিতু নৌকা না ভেড়ানো অবধি কিছু বলবে না কাউকে। না হলে আবার তাকে পানিতেই ফেলতে পারে। জিতু তাই চুপচাপ বসে থাকে। কথা বলে না সে। এদিকে মাঝিরা তাদের দুপুরের খানাপিনা সব নিয়ে খেতে বসে। সেই খাবারের ভুরভুর করে সুগন্ধ চলে আসে নাকে। জিতুর যেন এই গন্ধটা ক্ষুধাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। জিতু খাবারের লোভে অমনি ভুলে যায় সব। সে কোথায় আছে, কী অবস্থা—সব ভুলে যায়। অমনি জিতু তার বানানো রাজসভায় যেভাবে বানরদের সামলাত, তেমন করেই হুঙ্কার ছেড়ে ওঠে, “হালুম! হালুম! হালুম!”

এদিকে মাঝিরা তো আর জানে না যে তাদের নৌকায় এক বাঘের বাচ্চা উঠে বসে আছে, শহরে যেতে চায় সে। কী আর করা? জিতুর এমন হালুমে পুরো নৌকার সবাই ভয়ে থরহরি কম্প শুরু করে দিয়েছে। তারা খাবারদাবার সব ফেলে উঠে দাঁড়িয়েছে। দা, কুড়াল, লাঠি, সড়কি সব নিয়ে প্রস্তুত। ওরা বুঝে গেছে, নৌকায় বাঘ এসেছে বন থেকে, এখন সে তাদের খেতে আসবে। ভয়ে তাদের পিলে চমকে যায়।

দিদার মাঝি এবারই প্রথম এসেছিল জঙ্গল করতে। এবারই সে বাঘের কবলে পড়েছে। ঘাটে যেতে বেশি বাকি নেই। এরই ভেতর এই ঘটনা। ঘাটে যাওয়ার আগে দিদার অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে ভয়ে।

করিম মাঝি সবার সর্দার। তারই দায়িত্বে সবাই বনে আসে বহুবছর ধরে। করিম মাঝি সবার আগে দাঁড়িয়েছে। হাতে সড়কি। কিন্তু বাঘ তো আর ডাকে না। মজার ব্যাপার হল, জিতু ওপরের হাঁকডাক শুনে একটু চুপসে গেছে নিজেও। সে বোঝেনি যে মানুষেরা এমন ভয় পাবে, আর তাকে মারবার জন্য সবাই উদ্যত হবে। এখন কী করবে সে? এসব ভাবতে থাকে। নৌকা চলে যাচ্ছে নদীর মাঝখান দিয়ে, এর ভেতর সে কোথায় লাফাবে? কী করবে? কীভাবে সে যাবে বাকি পথটুকু? তাছাড়া সে তো কিছুই চেনে না শহরের। জিতু তখন ভাবল, এদের বলি গিয়ে তবে, ‘আমি শহর দেখতে এসেছি। তোমরা আমাকে সাহায্য করো। আমি শহর দেখে চলে যাব।’

জিতুর এই ভাবনায় আবারও ছেদ পড়ল। মাঝি দলবল নিয়ে নিচের দিকে নেমে আসছে। শব্দ হচ্ছে ওদের নামবার। কেউ কেউ বলে চলেছে, “সর্দার, সাবধানে যাইয়েন কইলাম।” তখন আর জিতু অপেক্ষা না করেই উঠে দাঁড়াল। এক লাফে সে গোলপাতার নিচ থেকে বেরিয়ে আসে। করিম মাঝি চোখের সামনে বাঘ দেখে রীতিমতো ভয়ে থরথর করতে থাকে। কিন্তু মাঝি পেছনে যায় না, আবার সামনেও এগোয় না।

করিম মাঝির বয়স আজ ষাট বছরের গোড়ায়। সেই বারো বছর বয়স থেকে জঙ্গল করে। প্রথমে বাবার সাথে জঙ্গলে যেত সে। তখন সংসারে কত কষ্ট! চারটে ভাইবোন তার। আর বাবা, মা, দাদা, দাদি সবাইকে নিয়ে এই সংসার যেন টালমাটাল। সংসার ঠেকাতে বন্যার বছর বাবার সাথে সেবার প্রথম জঙ্গলে গেল বালক করিম। তারপর কত যে ঘটনা ঘটেছে জীবনে! বাবার হাতেই সে জঙ্গল করা শিখেছে। জঙ্গলে কত সঙ্গীকে সে হারিয়েছে, বাঘে ধরেছে! একবার জঙ্গলে নৌকা ডুবে গেল। সেবার সব জিনিসপত্র হারিয়েছিল করিম সর্দার। স্বচক্ষে আগে কখনও বাঘ দেখেনি মাঝি। আজই সে প্রথম বাঘ দেখছে। চোখকে সে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। করিম সর্দার দাঁড়িয়ে যেন সব স্মৃতি হাতড়ে ফিরছিল। এরই ভেতর জিতু কথা বলে উঠল। করিম সর্দারের সাথে আর যারা দাঁড়িয়ে ছিল, তারাও এবারে ভয় পাওয়া থেকে অবাক হল। বাঘ কথা বলে কী করে! বাঘ কি কখনও কথা বলতে পারে? এটা কি সত্যি বাঘ?

জিতু তখন বলে, “হ্যাঁ, আমি সত্যি বাঘ। সুন্দরবনের বাঘ। বনের সবার সাথে কিছু না বলে তোমাদের নৌকায় উঠেছি কাল রাতে। তোমরা যদি জানতে পার তবে তো আমায় আনতে না সঙ্গে, এই কারণে আমি এই নৌকায় না বলে উঠেছিলাম। আমি তোমাদের শহর দেখতে এসেছি। তোমরা মানুষেরা কেমন করে থাকো, কী করে বাঁচো, তোমাদের সমাজ কেমন—এই দেখতে চাই। তোমরা আমাকে মেরো না। তোমরা আমায় সাহায্য করো, আমি বনে ফিরে তোমাদের এক আশ্চর্য জগত দেখাব যা মাঝি কখনও দেখনি আগে। সেখানে নিয়ে যাব, আর তোমরাও সব কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে।”

করিম মাঝি জিতুর কথা শুনে সিদ্ধান্ত নিল, বাঘটাকে সে তার বাড়িতে নেবে। তারপর ওকে শহর দেখাবে। করিম মাঝি বলল, “তা তুমি কী খাবে?”

জিতু বলল, “আমার নাম জিতু। মাঝি তুমি আমায় জিতু নামেই ডেকো। আর আমি তোমাদের খাবার খাব। কাল রাতে খেয়ে সেই নৌকায় উঠেছি, আর খেতে পারিনি। তুমি আমায় খেতে দাও বড্ড ক্ষুধা লেগেছে।” বলেই যেন জিতু হালুম করে উঠল।

করিম মাঝির সঙ্গীরা অবাক হয়ে দেখে চলেছে। সবার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে এই দেখে, বাঘেও ভাত খায়! করিম মাঝি বলল, “এসো। এসো তবে এবারে বসে খেয়ে নাও।”

মাঝি খাবার দিল। ছোটো চিংড়ি মাছ দিয়ে কাঁচকলার ঝোল, নদীর ট্যাংরা মাছ আর গোল আলু ঝোল দিয়ে জিতু হুম হুম করে খেয়ে নিচ্ছে। সকলে অবাক হয়ে দেখতে থাকল জিতুকে। তারা কেউ বিশ্বাস করতে পারছিল না, এটা সম্ভব কী করে! করিম মাঝি দেখল, জিতু গপ গপ করে খাচ্ছে। চোখেমুখে ওর কত আনন্দ। করিম মাঝি তখনও খায়নি। নিজের খাওয়ার যা ছিল সব তুলে দিল জিতুর পাতে। জিতু তো মহা আনন্দে খেতে থাকল। জিতুর খাওয়াটাও মানুষদের মতো। জিতুর খাওয়া কেমন লাগছে তা আর জানতে চাওয়া লাগল না। দৃশ্য দেখে সকলেই বুঝেছে যে জিতু খুব মজা করেই খাবারটা খেয়ে নিচ্ছে।

খাবার খাওয়া শেষে জিতুকে জানতে চাইল করিম মাঝি। “তা জিতু, তোমার এই মানুষের সমাজ দেখার সাধ জাগল কেন?”

জিতু বলল, “আমি বাবার একমাত্র সন্তান। বাড়ির কারও কথা শুনি না, চলি সাধারণত ছোটো জাতদের সাথে, এ নিয়ে বাড়ির সকলের কষ্ট আছে। আমি কারও কাছে নিজেকে জাহির করি না একটুও। একবার জঙ্গলে এক শিকারি এসেছিল। সে তার সঙ্গীর সাথে গল্প করছিল, মানুষেরা নাকি তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠায় পড়তে। সেখানে নাকি তোমরা মানুষেরা কত কী সব শেখো? আমাদের তো স্কুল নেই জানই। আমাদের যা আছে ওই অত্ত বড়ো জঙ্গল, সবুজ গাছগাছালি, শরীরের ভেতর বয়ে যাওয়া নাড়ির মতো নদী-খাল। রাতের বেলা আকাশ জুড়ে থাকে তারাদের মিছিল। আমরা তো এই-ই দেখে দেখে বড়ো হই। কিন্তু তোমরা মানুষেরা তো আলাদা। তোমাদের তো আনন্দ আছে শেখার। আমি সেইসব শিখতে চাই। তোমাদের ছেলেমেয়েরা যে ইসকুলে যায়, আমিও তা চাই। আমার এই প্রকৃতি, এই মানুষ দেখার লোভ ছিল মাঝি। তাই তো এলাম তোমাদের নৌকায়। জানো তো, আমি বাড়ির কাউকে কিছু না বলেই এসেছি। ওরা যখন জানবে, চমকে যাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু কী করে জানবে? কেউ তো জানে না আমি কোথায়। সবাই তবে ভাববে, হয়তো আমি কোথাও লুকিয়েছি। ওরা কান্না করবে কি? কে জানে, করতেও পারে।”

করিম মাঝি অবাক হয়ে শুনতে থাকে জিতুর কথা।

দুই

টুপুরদের বাড়ি এল জিতু

করিম মাঝির গোলপাতার নৌকা ঘাটে চলে এসেছে। ঘাটে অনেক লোকজনও জড়ো হয়েছে। প্রতিবার জঙ্গল থেকে সুস্থ-সুন্দরভাবে ফিরে আসবার পর বাবা গাজী কালুর প্রতি বন্দনা করা হয়। সেই বন্দনাও এক মজার আর আনন্দ প্রকাশ। গাঁয়ের সব ছেলেমেয়েরা জড়ো হয় এ বন্দনা সঙ্গীত দেখতে। আজও যথারীতি তা শুরু হল। করিম মাঝির মা এখনও বেঁচে আছেন। তিনি এখনও এই গান করে ছেলের নৌকা পাঠান সুন্দরবনে মা বনবিবি আর পীর গাজী কালু শাহর নামে। এই গান করা নিয়ম মেনে নৌকায় তাবিজ বেঁধে দেয়া যাতে নৌকায় বাঘ না ওঠে, বাঘে যেন ক্ষতি না করে। এই হল এই দোয়া-তাবিজের কারণ। কিন্তু এবারে তো সরাসরি একটা বাঘ চলে এসেছে। তার মানে কি তাবিজ মাত্রই বিশ্বাস! মায়ের বন্দনা গানের সুর যেন সকলকে মোহিত করে রেখেছে। কিন্তু কেউ জানে না এবারে বাঘ এসেছে নৌকায়। অন্যান্য মাঝিদেরকেও বলে দিয়েছে করিম, কারও কাছে যেন জিতুর কথা না বলে। মা তার নাতিপুতি নিয়ে গান করে চলে গেল। করিম একটা মধুর টিন নামিয়ে দিল। সকলে ওই মধু খাবে এখন।

জিতু নৌকায় বসে আড়াল থেকে সব দেখছিল। জিতুর মন চাইছিল গানের ওখানটাতে যেতে। ছেলেমেয়ে কীরকম মজা করে নাচছিল! জিতুরও নাচতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু মাঝি যেতে নিষেধ করেছে তাই আর যাওয়া হল না।

অবশেষে বন্দনা গান শেষ হল। করিম মাঝির মা চলে গেল। করিম মাঝির দুই সন্তান। দুপুর আর টুপুর। দুপুর পড়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে জীববিজ্ঞান স্কুলে। এর ভেতর করিম মাঝির ছোটো ছেলে এল বাবার কাছে। ওর নাম টুপুর। টুপুরের বয়স বারো বছর। ক্লাস সিক্সে পড়ে সে। বটিয়াঘাটা সরকারি স্কুলে পড়ে। স্কুলের সবাই জানে, টুপুর খুব ভালো ছেলে। টুপুর পাখি পোষে। পাখি তার খুব প্রিয়। টুপুরের পাখির একটা রাজ্যও আছে। টুপুরদের বাড়ির দক্ষিণ পাশে বিরাট বাগান, গাছের রাজ্য যেন। এই পাশেই টুপুরের পাখি-রাজ্য। এখানকার কয়েকটি গাছে সে মাটির পাতিল দিয়ে বাসা বানিয়ে দিয়েছে। ওইগুলোতে পাখিরা আসে। বিশেষত আসে শালিক, বক, চড়ুই, ঘুঘু, কাক, মাছরাঙা, কবুতর। ওরা সারাদিন কোথায় কোথায় যে ঘুরে বেড়ায় তা কোনও হিসেব নেই। কিন্তু ঠিক দিন শেষে ওরা এসে হাজির হয় টুপুরের বানানো মাটির পাতিলের বাসায়। মাটির পাত্রের ভেতর খড়ও বিছানো আছে। খড়ের ভেতর শুতে পাখিদের ভালো লাগে। টুপুর এদের নিয়ে মেতে থাকে নিজের মতো।

পাখির প্রতি টুপুরের ভালোবাসা করিম মাঝির ভালো লাগে। টুপুরের কাছে পাখিদের খাবারের একটা তালিকাও আছে। শকুরকাকা দিয়েছে। শকুরকাকা পশু চিকিৎসক। পশুপাখিদের সাথে ভালো ব্যবহার কেন করতে হয় তা বলেন টুপুরকে। টুপুর বড়ো হয়ে প্রাণীবিজ্ঞানী হতে চায়। প্রাণীদের মনের কথা বুঝতে পারলে ভালো লাগে। প্রাণীরা কখনও ক্ষতি করে না।

ছুটির দিনে সারাটা দিন টুপুর বাগানে পড়ে থাকে। বাবলাগাছ, পেঁপুলগাছ, নারকেলগাছ, শিরিষগাছ বাড়ির চারপাশ দিয়ে ঘেরা ওর জগত। একটা ছোটো ঘরের মতোও বানিয়ে নিয়েছে এখানে টুপুর। এখানে পাখিদের জন্য খাবার, ঔষধ সব রাখে সে। এখানেই যেন টুপুরের প্রাণীজগত আর পাখি-রাজ্য। টুপুরের বন্ধুরাও আসে কোনও পাখির নতুন বাচ্চা হলে তা দেখতে। টুপুর পাখিদের ডাকলে চলে আসে ওর কাছে। ওকে পাখিরাও ভালোবাসে। বাবা-মা-দাদি-ভাই সবাই টুপুরের এইরকম পাখির প্রতি ভালোবাসা দেখে খুব খুশি হয়। টুপুরের স্কুলের শিক্ষকরাও টুপুরকে খুব ভালোবাসেন।

এবারে টুপুরের পড়ার কথা বলি। টুপুর কিন্তু দারুণ ভালো ছাত্র। টুপুরের রেজাল্ট সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। পড়াশোনার পেছনে অতখানি সময় দেয় না সে। পি.এস.সি পরীক্ষায় থানার ভেতর প্রথম হয়েছে। বৃত্তির জন্য মনোনীত হয়েছে। বাবা খুশি হয়ে বলেছে, এবারে তার জন্য বড়ো একটা পুরস্কার আছে। কিন্তু বাবা এখনও দিতে পারেনি।

টুপুর বাবাকে দেখে দৌড়ে আসে। মাঝি টুপুরকে বলে, “তোমায় একটা পুরস্কার দিতে চেয়েছিলাম, দিতে পারিনি টুপুর সোনা। আজ তোমার সেই পুরস্কার দেব। কিন্তু তার ভালো করে যত্ন নিতে হবে। আমায় কথা দাও। সে আমাদের অতিথি।”

বাড়ির আর কেউ ছিল না ঘাটে। নৌকার মাঝিরাও সবাই বিদায় নিয়ে যার যার বাড়িতে ফিরেছে। অনেকদিন পর বাড়িতে ফেরার পর সবাই একটু ঘুমোয় অন্তত একটা দিন, তারপর সবাই আবার নৌকার গোল নামাতে লেগে যায় দল বেঁধে।

করিম মাঝি জিতুকে ডাকে। জিতু যেন মাঝির এই ডাকের অপেক্ষাতেই করে ছিল এতোটা সময়। মাঝির ডাকের সঙ্গে সঙ্গে জিতু হালুম করেই লাফিয়ে নামল নৌকা ভেতর থেকে এক লাফ দিয়ে। জিতু তো আর বোঝে না সবাই দেখে তাকে ভয় পেতে পারে, টুপুরও প্রথম জিতুকে দেখে ভয় পেল। ঘাবড়ে গিয়ে বাবাকে ধরে কাঁপতে লাগল। ওর বাবা অমনি হেসে উঠল। “আরে এ হল জিতু, বন থেকে এসেছে। শহর দেখবে। তোমার সাথে ঘুরবে, তোমার স্কুলে যাবে। আজ থেকে সে তোমার বন্ধু। ওই হল তোমার গিফট। সে যে ক’দিন আমাদের এখানে আছে, ওর সব দায়িত্ব তোমার। ও কী কী খেতে চায়, ঘুমোয় কখন—সব জেনে নেবে। তারপর ওকে তোমার গল্প বলবে।”

বাবার কথায় টুপুর যেন একটু আশ্বস্ত হল। জিতু এবারে বলে উঠল, “হালুম! হালুম! হালুম!”

আর মাঝি জিতুকে বলল, “জিতু, এ হল আমার ছোটো ছেলে। স্কুলে পড়ে। সে পাখি খুব ভালোবাসে। সে তোমার বন্ধু। তুমি যা যা দেখতে চাও সে-ই তোমায় দেখাবে ঘুরিয়ে। এবারে চলো বাড়িতে যাই।”

আরেকটু পরেই তো সন্ধে হয়ে এল।

“চলো জিতু, চলো টুপুর।”

এদিকে বাড়ির ভেতর টুপুরের সাথে জিতুকে দেখে মাঝির স্ত্রী এবং মা ভড়কে গেল। তখন মাঝি ওদের সব বুঝিয়ে দিল। ওরা জিতুর এই গল্প শুনে তো অবাক হয়ে গেল। জিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল মাঝির মা। তারপর আবার সে বলে উঠল, “সবই মা বনবিবির ইচ্ছা, পীর গাজী শাহর ইচ্ছা।”

রাতে সবাই খেতে বসল। এর ভেতর বাবা এসেছে বাড়ি, এই খবর শুনে দুপুরও হাজির হল। সবাই মিলে খেতে বসল। সঙ্গে জিতুও বসেছে খেতে। জিতুর সাথে খেতে খেতে কথা বলে নিল দুপুর। দুপুর বাবাকে বলল, “বন অফিস থেকে বা থানা থেকে যদি জেনে যায় যে একটি বাঘের বাচ্চা আমাদের বাড়িতে আছে তবে নানান ধরনের ঝামেলা করবে। হয়তো চিড়িয়াখানাও কিনে নিতে চাইতে পারে।”

তাই সাবধানে জিতুকে রাখতে বলল। জিতুর খেয়াল রাখাটাও জরুরি এই কারণে। একটা প্রাণী মানুষের জগতে এসেছে তা তো বড়ো ভালো খবর। কেউ যেন কোনও কষ্ট না দেয় তাকে সেই খেয়ালও করতে বলে খেয়ে আবার রাতেই ফিরে গেল দুপুর। এদিকে এত মজার খাবার কখনও জিতু খায়নি তো, ভাতও সে খায়নি কখনও। জিতুর খুব ভালো লাগছিল ভাত-মাছ খেতে। জিতু আনন্দে আনন্দে একটু বেশিই খেয়েছে। জিতুর এমন খাওয়া দেখে মাঝির মা এবং স্ত্রী অবাকই হল। তারা ভাবল, বাঘও এত মজা করে ভাত খায়, মানুষ তা জানে না! চোখে না দেখলে তারাও কেউ হয়তো বিশ্বাস করত না।

জিতু ঘুমোতে ভালোবাসে। জিতুর আরও মজার অভ্যেস হল শোয়ার সময় আশোপাশে কারও একটু নাক ডাকলে ঘুমোতে পারে না। জিতুর এই অভ্যেসের জন্য কারও সাথে ঘুমোয়ও না। আজ কিন্তু জিতুর তা হল না। টুপুরের নাক ডাকবার অভ্যেস নেই, তবে টুপুরের দাদুর ভারি নাক ডাকবার অভ্যেস। টুপুর দাদুর কাছে ঘুমিয়েছে, আর তার পাশেই ঘুমিয়েছে জিতু। জিতু স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে টুপুর দাদুর নাক ডাকছে, কিন্তু তাতে কোনও সমস্যা হচ্ছে না জিতুর। টুপুরের দাদুর নাক ডাকছিল আর জিতুর প্রথম দুয়েকবার এরকম মনে হচ্ছিল যে এটা নাক নাকি আর কিছু—ঘরররররররঅঅঅঅঅঅঅ ঘররররররররররঅঅঅঅঅঅ ঘররররররঅঅঅঅ…

রাতভর এরকম শব্দ শুনে ভোরে উঠে পড়ল জিতু। সঙ্গে সঙ্গে টুপুরও জাগল। টুপুরের দিকে জিতু তাকিয়ে হেসে দিল। তারপর বলল, “তুমি আজ কী করবে, টুপুর?”

টুপুর বলল, “তুমি আমাদের বাড়িতে এসেছ, তুমি তো অতিথি। তোমাকে নিয়ে আমি ঘুরব। আর আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু।”

টুপুর দেখল জিতু খুব খুশি হয়েছে টুপুরের কথায়। টুপুর বলল, “মানুষের জীবন দেখবে তো? দেখে যাবে তবে ভালো করে। জঙ্গলে তোমার বন্ধুদেরকেও তো বলতে হবে গিয়ে। তো চলো আগে দাঁত পরিষ্কার করে নিই দু’জনে মিলে।”

জিতুর দাঁত পরিষ্কার করবার জন্যে নিমগাছের দিকে গেল টুপুর। টুপুর গাছে উঠে একটা বুড়ো আঙুলের মতো মোটা ডাল ভাঙল। তারপর তা নিয়ে নিচে চলে এল। একটা অংশ টুপুর জিতুকে ভেঙে দিল আর একটা অংশ টুপুর নিজের জন্য রাখল। তারপর ওটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে উঠোনের পাশে কলপাড়ে বসল।

করিম মাঝি ফলের সব গাছ বাড়িতে লাগিয়েছে। সে হাট থেকে কিছু কিনতে চায় না। একমাত্র কিছু সবজি-টবজি মাঝে মাঝে আনে। বাকি সবই তার বাড়ির ক্ষেতেই পাওয়া যায়। করিম মাঝির মা খুব ডালিম পছন্দ করে। মাঝি বাড়িতে তার মায়ের পছন্দের ফলের গাছ লাগিয়েছে। মাঝির বড়ো ছেলে দুপুরের খুব প্রিয় ফল হল পেয়ারা। কেবল দুপুর নয়, বাড়ির সকলেই পেয়ারা খেতে পছন্দ করে। টুপুর আর জিতু যে কলপাড়ে বসে দাঁত পরিষ্কার করছিল, সেখানেই একটা পেয়ারাগাছ আছে। গাছ থেকে পাকা পেয়ারা একটা পড়ল। টুপুর ফলটা হাতে নিয়ে বলল, “জিতু, চেন কী এই ফলটা? এ হল পেয়ারা। পেয়ারায় অনেক শক্তি। বাবা বলে, পেয়ারা খেলে বুদ্ধি বাড়ে। চলো, আমরা আগে সকালের নাস্তা করে নিই, তারপর পেয়ারা খাব।”

টুপুরের হাত থেকে পেয়ারাটা জিতু নিল। দেখতে লাগল, বাইরেরটা সবুজ কিন্তু পেকে যাবার কারণে রংটা হালকা হয়েছে কিছুটা হলুদাভ।

সকাল এগারোটা বাজে। টুপুর আর জিতু বসে আছে পাখি-রাজ্যে। পাখি-রাজ্য হল টুপুরের নিজের রাজ্য। এই রাজ্যে টুপুর আর তার পাখিরাই নাগরিক। টুপুর এখানে একাই কিন্তু সব না। টুপুর যেসব পাখিদের পোষে, ওরা ছাড়া টুপুর চলতে পারে না। টুপুরের কাছে পাখিরা তার প্রাণ। জিতু আর টুপুর এখানে বসে গাছ থেকে পেড়ে আনা পেয়ারা চিবোতে চিবোতে গল্প করছে। টুপুর বলে তার পাখিরা কী কী করে, পাখিদের সে কীরকম ভালোবাসে। জিতু বলে ওঠে, “হালুম! হালুম! হালুম! কী মজার পেয়ারা খেলুম।”

টুপুর হেসে উঠল জিতুর এরকম কথা শুনে। টুপুর বলল, “জিতু, তোমার কি আমার পাখির রাজ্য দেখতে ইচ্ছে করছে আরও? পাখিদের ডাকব কি?”

জিতু বলে ওঠে, “হালুম! হালুম! হালুম! ডাকো, ডাকো। আমি আজ নাচব। তোমার পাখিদের ডাকো।”

টুপুর তার পাখি-রাজ্যে হুকুম করল যেন, চিঁই চিঁই চিঁইইই ওয়া চিঁই। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি হাজির হল। টুপুর অবাক করে দিল যেন জিতুকে। জিতু হালুম, হালুম, হালুম করে আনন্দে নাচতে লাগল। কাক, বক, চড়ুই, মাছরাঙা, ঘুঘু, কবুতর সব এসে দলে দলে বসতে লাগল। সবাই ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে। টুপুর আর জিতুর সারাদিন দুপুর অবধি চলল এই আজব মজার নাচ আর আনন্দ করা।

পাখিরা গাইল-
কিচির কিচির
মিচির মিচির
কিচির মিচির
মিচির কিচির।

তিন

বাঘ রাজার বাড়িতে কান্না

তিনদিন হয়ে গেছে যুবরাজের কোনও খোঁজ নেই। কেউ বলতে পারে না। যেসব বানরেরা যুবরাজের সাথে মিশত, ঘুরতো, সবার ডাক পড়েছে রাজবাড়িতে। সবার কাছে মহারাজ নিজেই জানতে চাইছেন, কী হয়েছে যুবরাজের, যুবরাজ কোথায় গেছে। কিন্তু সবার উত্তর একটাই, মহারাজ, আমি জানিনে! আমি জানিনে মহারাজ। গত দুইদিনে রানি কিছুই খায়নি। তার কথা হল, আমার ছেলেকে এনে দাও। আমি আমার ছেলে চাই। রাজা জঙ্গলের সব জায়গায় সৈন্য পাঠাল, কোথায় আছে যুবরাজ। আর যারা যুবরাজের বিরুদ্ধে বিচার এনেছিল তাদেরও ডেকে পাঠাল। রাজার সন্দেহ, ছেলেকে এরাই মেরে ফেলেছে। সবাই ভয়ে ভয়ে রাজদরবারে হাজির হল। এবারে তাদের কল্লা নেবে মহারাজ। একজন আরেকজনকে বলছিল, “আগেই বলেছিলাম যে, রাজার বাড়ি যবার দরকার নেই। রাজার ছেলে কী করবে না করবে তা আমাদের কী? এখন বোঝো। ছেলে হারিয়েছে কোথা কে তা জানে। এখন ডাকল আমাদের, হয়তো দোষও আমাদের দেবে এখন। দেখো আমরা বিচারে পড়ে গেলাম। এখন ওই সমস্ত দোষ আমাদের। রাজার দুষ্টু ছেলে কোথায় গেছে বা লুকিয়ে আছে তা কে জানে।”

সবাইকে আলাদা করে করে জিজ্ঞাসা করে তবে ব্যবস্থা নেবেন রাজা। কে জানে কার কপালে কী আছে। এদিকে সব বানরকে বলা হল, “দেখো বনে কোনও শিকারি এসেছে কি না। ওরা কোনও কিছু করেনি তো? ওদেরও তো লোভ আছে।”

শিকার হাতে পেলে মানুষ লোভ সামলাতে পারে না। এরা সুযোগ পেলে যেকোনও ঘটনা ঘটিয়ে দেয়।

বানরের দল কাজে নেমে পড়ল। যুবরাজ হারিয়ে গেছে। যুবরাজকে খুঁজে বের করার কাজ এখন তাদের। না হলে রাজা তাদের ওপরেও চটে যেতে পারেন আরও বেশি। ফলে বানরের দল খুব জোর তল্লাশি করল। কিন্তু কোত্থাও যুবরাজের খোঁজ পেল না বানরের দল। কিছু বানর আবার গাছের ডালেই বসে বসে দেখতে লাগল দেখা যায় কি না। কিন্তু যুবরাজকেও কোত্থাও দেখা গেল না।

দিন পেরোতেই থাকল যেন। আর রানির খাওয়া, নাওয়া কিছুরই খেয়াল নেই। রাজার মন নেই রাজকার্যে। একমাত্র ছেলে তাদের, এই অল্প বয়সে ছেলেটা হারিয়ে গেল! শোকগ্রস্ত রাজপরিবারে এখন যেন নীরব শোক পালন চলছে। শোকে সামান্য কথাও বলতে পারে না কেউ রাজাকে। রাজার সামনে দাসদাসী কেউ যায় না ভয়ে, কখন কী বলে বসে। সবাই জানে যে মহারাজা খুব খ্যাপা আর রাগী।

এদিকে ছেলের শোকে না খেয়ে, না ঘুমিয়ে, না গা ধুয়ে একদম অসুখে পড়েছে রানি। রানির অসুস্থতার খবর অন্দরমহল থেকে আসার পর থেকে রাজা হনহন করে অন্দরমহল গেল। গিয়ে রানির পাশে বসে বলল, “এমন চিন্তা করো না গো, যা হবার তা তো হবেই। জিতু ঠিক ফিরবে দেখো।”

রাজা মন্ত্রীমশায়কে ডেকে বলল, “রাজবদ্যিকে রানির জন্য ঔষধ দিতে বলো। রানির সুস্থ হওয়া চাই আগামীকালের মধ্যে।”

রাজার এরকম আদেশে তো মন্ত্রীমশায়ও ভয় পেল। বুঝল যে, মহারাজ ছেলের শোকে এখন চিন্তিত। এ কারণে আর কোনও দেরি না করেই রাজবদ্যিকে খবর পাঠাল মন্ত্রীমশায়। মন্ত্রীর খবর পেয়ে ঔষধের বাক্সপ্যাঁটরা আর স্টেথোস্কোপ নিয়ে হাজির হল রাজবদ্যি। রাজবদ্যিকে দেখে মন্ত্রী বলল, “মহারাজের আদেশ, আগামীকালের ভেতরেই রানিমা যেন সুস্থ হয়ে ওঠেন।”

এদিকে হঠাৎ সন্ধের দিকে খবর এল, গত দিন কয়েক আগে যুবরাজ একবার কুঁচিয়ার খালপাড়ে বিকালে বেড়াতে গিয়েছিল। আর সেদিন রাত থেকেই যুবরাজকে দেখা যায় না। তাহলে কী হয়েছে যুবরাজের? ওই সময় ওখানে একটা গোলপাতার ব্যাপারীর নৌকাও ছিল। তারা তো সেই রাতেই নৌকা ছেড়ে চলে গেছে। তাহলে কি যুবরাজকে মেরে ফেলেছে শিকারি? যুবরাজকে মারবার জন্য কী অস্ত্র ব্যবহার হতে পারে তা ভাবছিল রাজা বসে বসে। রানিকে কোনও খবর দিতে মানা করে দিল রাজা। কেননা রানি আবার কান্নাকাটি করে অসুস্থতা বাড়াবে। যাই হোক, মা তো সে। ছেলের দুঃসংবাদ শুনলে মা কাঁদবে, এটা পৃথিবীর সব মায়ের ধর্ম। আর এমন মিষ্টি চটপটে ছেলের জন্যে মায়ের চিন্তা করা, না খাওয়া এ তো স্বাভাবিক নিয়ম। তবুও বদ্যি আজ রানিকে সুস্থ করে তুলছে, চেষ্টা করছে যেন সকালে মোটামুটি কথা বলতে পারে। বদ্যি বলেছে, রানি প্রচুর কান্না করবার ফলে, গরমে ঘামবার ফলে লবণ ঘাটতি শরীরে। যে জন্যে একটা স্যালাইন দেয়া দরকার। রাজার কাছে বদ্যি গিয়ে বলল, “রানিমাকে স্যালাইন দিতে হবে। তা না হলে শারীরিক দুর্বলতা কাটছে না।”

রাজামশায় বলল, “এক্ষুনি রানিকে স্যালাইন দিন, মশায়।”

বদ্যি দৌড়তে দৌড়তে গিয়ে রানিকে স্যালাইন দিল। তারপর দাসীরা সব রানির পাশে বসে খাইয়ে দিল। রানি খাওয়ার পর বদ্যি রানিকে একটা ঘুমের ঔষধ দিয়ে দিল। রানি ঘুমোতে থাকল।

জঙ্গলের কেউ কিচ্ছু জানে না বলে সবাই চলে গেলেও রাজার সন্দেহ রয়ে গেল মন্ত্রীর ছেলের প্রতি। এ কারণে রাজা ওর পেছনে চর লাগিয়ে রেখেছিল যাতে ও কোথায় কী করছে তা জানতে পারে মহারাজা। মহারাজা জানত, তার ছেলের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ওই টাপলু। টাপলুরও রেকর্ড ভালো নয়। কারও কথা শোনে না। রাতবিরেতে বাড়ি ফেরে, তাই নিয়ে মন্ত্রী কম রাগ করেনি। কিন্তু টাপলুর তাতে যায় আসে না। কোনোরকম বাড়ি খেতে আসে, আর রাতে ফেরে সেই গভীর অন্ধকারে। কী করে টাপলু আর যুবরাজ তা ওরাই জানে। রাজা একবার জানতে চাইছিল যুবরাজ কোথায় আছে তা জানে কি না সে। টাপলু বলেছে, না সে কিছুই জানে না। মহারাজা আর কিছুই বলেনি, যেতে বলেছিল টাপলুকে। টাপলু চলে এসেছিল। টাপলুর জানা ছিল এটা কেবল যে যুবরাজের আলাদা একটা জায়গা আছে। কিন্তু কোথায় সে জায়গা তা জানত না টাপলু। টাপলুর ধারণা যুবরাজ ওখানেই আছে। টাপলু এখন ওই জায়গাটা খুঁজে পেতে তৎপর হল।

দক্ষিণ ভেলুয়ার চর পার হলে ছোট্ট টিলা পড়ে। মাঝে মাঝে যুবরাজকে এই টিলার এ-পথে দেখা যেত। এইদিকেই কী গুপ্ত জায়গাটা? গুপ্ত জায়গায় কী আছে তাও তো টাপলু জানে না। টাপলুকে কখনও বলেনি কোথায় জায়গাটা। তবে জায়গাটা যে দারুণ একটা বসবাসের জায়গা, তা বোঝা যায়। ফলে টাপলুর এই জায়গার প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকে। তার এখন একটাই ইচ্ছে, যুবরাজের গুপ্ত জায়গাটা খুঁজে পেলে যুবরাজকেও পাবে সে। মহারাজাকে গিয়ে গোপনে বলে সে, পুরস্কার নেবে তখন। রাজবাড়ির পুরস্কারের মূল্য অনেক।

চার

শহরে জিতু

বিকালে বেরোলো টুপু আর জিতু শহর দেখতে। সঙ্গে আর কেউ নেই ওদের। টুপু প্রথমে জিতুকে নিয়ে গেল ওর স্কুলের মাঠে। সেখানে জিতু দেখল টুপুর মতো অনেকেই খেলছে। কেউ দৌড়চ্ছে, কেউ ব্যায়াম করছে, কেউ কেউ আবার বসে বসে গল্প করছে। টুপু জিতুকে নিয়ে মাঠে নামল। তারপর বন্ধুদের ডাকল। সবাইকে বলল জিতু কী করে তাদের বাড়িতে এসেছে। জিতুর আসবার খবর শুনে সবাই জিতুকে বাহবা দিল। টুপুর বন্ধুরা সবাই এল জিতুর সাথে কথা বলতে। জিতু এত আনন্দ পেল যে বলে শেষ করা যাবে না। জিতু পুরো স্কুলের মাঠে লাফিয়ে লাফিয়ে দেখাল। তারপর কী করে শিকারের সময় একটা শিকারি বাঘ বসে থাকে তা দেখাল। টুপুর বন্ধুরাও খুব মজা পেল আর অবাক হল। সবাই সন্ধেয় বসে বসে আনন্দে মাতল।

চাঁদনি রাতে গেল ধানক্ষেত দেখতে। ধানক্ষেতে বসে টুপুরের আরেক বন্ধু গান শোনাল সবাইকে। মটরভাজা খাওয়াল গোপী। গোপী হল টুপুরদের আরেক বন্ধু খুব দুষ্টু সে। সবাইকে কী করে ভোগাতে হয় সেই বুদ্ধি সবটাই যেন প্রকৃতি থেকে পেয়েছে সে। সেবারে গোপী পণ্ডিত স্যারকে ভড়কে দিয়েছিল। স্কুলের পণ্ডিত স্যার দারুণ ঝামেলা করেন সবসময়। এই পণ্ডিত স্যারের হাতের বেত খুব কড়া। সবাই পণ্ডিত স্যারকে ভয় পায়। গোপী পণ্ডিত স্যারের বাংলা ব্যাকরণ একদিন পড়া পারেনি। গোপী বলল, “স্যার, আমার তো জ্বর ছিল।”

কিন্তু স্যার গোপীকে দেখেছিলেন মাঠে আড্ডা মারতে। মিথ্যে কথা বলাতে পণ্ডিত স্যার ক্ষেপে গেলেন। পণ্ডিত স্যার খুব মার দিলেন গোপীকে। পাছার ওপর বেত দেয়ায় গোপী দু’দিন পাছা মোড়ায়ে মোড়ায়ে হাঁটত। আর সবাই হাসত। বলত, “কী রে গোপী, তোর জ্বর হইছিল? পড়তে পারিসনি?”

গোপী রাগে গরগর করত। পরে তো পণ্ডিত স্যারকে নিয়ে এক মহা কাণ্ড বাধিয়ে দিল গোপী। ভর সন্ধেয় দিল ভূতের ভয়। বেচারা সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন গ্রামের পথ দিয়ে। ব্যস, গোপী আগেই আলখাল্লা পরে ছিল গাছের আড়ালে তৈরি হয়ে। এবারে পণ্ডিত স্যারের বারোটা বেজে গেল। স্যারের সাইকেলের সামনে দিয়ে দৌড় দিল। একটু দূরে গিয়ে আবার দৌড় দিল। এভাবে স্যারের অবস্থা কাহিল হল। স্যার সাইকেল থেকে পড়ে গিয়েছিলেন, আর তারপর অজ্ঞান। পরে অবশ্য বিষয়টি সবাই জেনে গিয়েছিল গোপীর ছোটো ভাইয়ের কারণে। গোপীর ছোটো ভাই না বললে আমরা কেউ জানতেই পারতাম না।

গোপী জিতুকে বলল, “করিমচাচাকে বলে নিয়ে আমরা সবাই তোমার সঙ্গে বনে বেড়াতে যাব। এবারে খুব মজা হবে তবে। চাচারা সবসময়ই যায়। আমরা তো গেলাম না কখনও। এবারে জিতুকে দিয়ে আসবার সময় আমরাও যাব।”

টুপুরও বলল, “হ্যাঁ রে, আমি তো যাবই। বাবাকে বলে রেখেছি, জিতুকে এগিয়ে দিতে আমিও যাব।”

রাত প্রায় দশটা বেজে গেল। টুপুর-জিতুরা ফেরেনি বাড়ি। করিম মাঝি বাড়ি পৌঁছে চিন্তায় পড়ে গেল। এগিয়ে গেল নিজেই ওরা কোথায় আছে তা দেখতে। জঙ্গলের প্রাণী, তার ওপর এরকম করে এসেছে আজ দু’দিন হল। যত দ্রুত সম্ভব জিতুকে বনে পৌঁছে দিতে হবে।

একটু চিন্তামনস্ক হয়ে মাঝি রাস্তায় হাঁটছিল। রাস্তায় বেরিয়েই দেখা হয়ে গেল খয়ের আলির সাথে। “কী খবর করিমভাই, শুনলাম তুমি নাকি জঙ্গলের থেকে একটা বাঘের ছাও নিয়ে আইচো?”

খয়ের আলির বাবা বড়ো শিকারি ছিল। খয়ের আলি নিজে কখনও এসব করেনি, তবে তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চব্বিশ ঘন্টা পাক খায়। এই কারণে খয়েরকে সবাই বলে ‘দুষ্টু খয়ের’। তো এই খয়েরের অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে মাঝি একটু ভড়কে গেল বটে, কেননা অচেনা জায়গায় একটা ছোট্ট বাঘের বাচ্চা আবার কী বিপদে পড়বে কে জানে! তাই মাঝি উত্তর দিল, “না রে খয়ের, তেমন কিছু না। ওই তো ছোটো একটা বাচ্চা।”

খয়ের তখন বলে ওঠে, “না না, লোকের মুখে মুখে শুনলাম করিম মাঝি একটা বাঘের বাচ্চা আনছে। সেই বাঘ আবার কথাও বলে নাকি। তো আমারে একটু দেখাও তোমার বাঘের বাচ্চাটারে। দেখে নয়ন জুড়োই। আজব জিনিস! জঙ্গলে মানুষ শিকার করতে যেত আর তুমি আনলে তা পোষার জন্য।”

কথা বলতে বলতে টুপুররাও হাজির হল। টুপুর ওর বাবাকে দেখে আজকে কোথায় কোথায় গিয়েছিল তা সব বলে দিল। আর খয়ের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনল। জিতু বলল, “মাঝি, খুব মজা হয়েছে আজ।”

খয়ের আলি জিতুর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল। এবারে জিতুর কথা বলতে দেখে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। এটা কী করে সম্ভব? আগেও কারও কাছে শোনেনি এরকম যে বাঘে কথা বলে! পুরো চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল খয়ে আলির। খয়ের আলি আর কথা বাড়াল না। করিম মাঝির থেকে বিদায় নিয়ে নিজের কাজের দিকেই গেল। করিম মাঝিও টুপুর-জিতুদের নিয়ে এগোলো বাড়ির পথে। তারপর জিতু গল্প করতে লাগলো আজ সে কী কী দেখেছে। বড়শিতে করে কেমনভাবে মাছ ধরে—জিতুও জঙ্গলে ফিরে ওরকম করে নিজের মতো করে একটা বড়শিতে করে মাছ ধরবে। জিতু রান্না শিখবে। এমন লোভাতুর খাবার জিতু না খেয়ে থাকতে পারবে না। তাই নিজে রান্না শিখতে চায়। অন্তত মাছ রান্নাটা তার দারুণ লেগেছে।

পরদিন ভোরবেলা টুপুর জিতুকে নিয়ে গেল খুলনা শহরে। গল্লামারীতেই ওরা নেমে গেল। দু’পাশের হাওয়া খেতে জিতুর বেশ লাগছিল। গাড়িতে করে ঘুরছিল ওরা। টুপুরের বড়ো ভাই দুপুর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। এখানে ঘুরে ঘুরে বিশ্ববিদ্যালয় দেখল। বিশ্ববিদ্যালয়টা ওর খুব ভালো লাগল। অনেকটা জায়গা। মাঠ আছে। সেখানে ছেলেরা খেলছে। মাঝে মাঝে রাস্তা। রাস্তার দু’পাশে প্রচুর গাছ। সব গাছ টুপুর আর জিতু চেনে না। দুপুর চিনিয়ে দিল। দুপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার দেখাল। জিতুকে বলল, “১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা নিয়ে যে আন্দোলন হয়েছিল সেই আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর গুলি করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। সেই গুলিতে শহীদ হয় আমাদের ভাইয়েরা। সেই থেকে এই শোক সৌধ। এর নাম শহীদ মিনার। শহীদ মিনারে প্রতি বছর আমরা ২১শে ফেব্রুয়ারি ফুল নিয়ে প্রভাত ফেরিতে যাই, শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। বাংলা মায়ের এই সন্তানেরা চিরকাল অমর হয়ে রয়েছেন বাংলা ভাষাভাষীর কাছে।”

জিতু দুপুরের কথা শুনছিল চুপ করে। কোনও কথা বলেনি। মনটা জিতুর খুব খারাপ হয়ে গেল যেন। এবারে জিতুকে নিয়ে ক্যাফেটেরেয়িাতে ওরা মজা করে চা-শিঙাড়া খেল। তারপর বেরুলো খুলনা শহর দেখতে।

গাড়ি করে যখন নিরালা পার হয়ে ময়লাপোতা মোড় পার হচ্ছিল তখন জিতু চেয়ে চেয়ে দেখছিল। এত সুন্দর গোছানো নগর, কিন্তু কী যেন নেই। চারদিকে কত সুন্দর করে সাজানো। রয়েল মোড়ে গিয়ে দেখে বিরাট একটা চিংড়ির ছবি। সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল দুপুর। নতুন বাজারের বিরাট মাছ-বাজার দেখে তো চোখ ছানাবড়া জিতুর। এত মাছ কখন ধরে মানুষ!

দুপুরে ওরা খেয়ে নিল বাইরে। তারপর গেল ক্যান্টনমেন্টের সামনে দিয়ে। পথে যেতে যেতে দেখল বাঘের ভাস্কর্য। দৃশ্যটি দেখে তার ভালো লাগল। দুপুর বলল, “জিতু, তোমরা হলে আমাদের দেশের লোগো। জাতীয় প্রতীক। সাহস এবং উদ্যম। কিন্তু ওই দেখো, আমরাই আবার তোমাদের আটকে রেখেছি।”

দূরে বাঘের খাঁচায় একটা বাঘ আটক আছে দেখে জিতুর মনখারাপ হল। আরও কত প্রাণী বন্দী এখানে! জিতুর খুব মনখারাপ হল। জিতুর চোখ ছলছল করে উঠল ওই প্রাণীগুলোর জন্যে।

জিতুর মনের কষ্ট দুপুর আর টুপুর বুঝল। ওরা দ্রুত রওনা হল বাড়ির পথে। সন্ধের দিকে ওরা বাড়ি গিয়ে পৌঁছল। রাতে দ্রুত খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে গেল সবাই। টুপুর আর জিতু ঘুমোল একসাথে।

পাঁচ

জিতু নিখোঁজ হলো

ভোরের আলো ফুটেছে। সূর্যের আলো চকমক করছে। বাড়ির উঠোনে এসে করিম মাঝি ডাকছে তার ছেলে টুপুরকে। টুপুর উঠল বাবার ডাকে। টুপুর পাশ ফিরে দেখল জিতু নেই। ও ভাবল, বোধহয় বাবার কাছে গল্প করছে। টুপুর আস্তে আস্তে উঠে হাঁটতে হাঁটতে চোখ মুছতে মুছতে বাবার কাছে গিয়ে বসল। টুপুর বাবাকে বলল, “আচ্ছা বাবা, জিতু কই?”

“জিতু কই মানে! জিতু তো তোমার সাথে ঘুমিয়েছিল!” করিম মাঝি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে বসে।

টুপুর বলে, “না বাবা, জিতু তো ওখানে নেই।”

“তাহলে দেখো উঠে কোথাও গেছে কি না।”

টুপুর বলল, “না বাবা, জিতুর তো কিছু চেনা নেই। ও কোথাও গেলে তো হারিয়ে যাবে।”

মাঝি মনে মনে একটু উদগ্রীব হয়ে উঠল। ছেলেকে বলল, “একটু দেখো তো আশেপাশে কোথাও গেল কি না জিতু।”

টুপুর আর সময় নিল না। পাশের সবুজদের বাড়ি গেল, মোহনদের বাড়িতে গেল, তারপর সব বাড়ি খুঁজে খুঁজে দেখল টুপুর। পুরো সকালটাই এরকম করে পুরো গ্রামটা টুপুর খুঁজে শেষ করেছে, কিন্তু জিতুর কোনও খোঁজ নেই। বাড়ি ফিরে বাবাকে জানাল। মাঝি চিন্তিত হয়ে পড়ল। রাতে খেয়েই তো ঘুমিয়ে গিয়েছিল! তবে জিতু গেল কোথায়? মাঝি ভাবতে পারল না। এখন কী করবে, কীভাবে খুঁজে পাবে মাঝি এই বাঘের বাচ্চাকে? মাঝি চেয়েছিল যে করে হোক জিতুকে শহর দেখানো শেষ হলে আবার জঙ্গলে পৌঁছে দেবে। এখন তো ঘটল উলটো ঘটনা। মাঝি এখন কোথা থেকে জিতুকে খুঁজে বের করবে?

দুপুর গড়িয়ে এখন বিকাল। তবুও জিতুর কোনও খোঁজ নেই। টুপুরের সব বন্ধুরা জিতুকে খুঁজতে বেরিয়েছে। এর ভেতর গোপী ছিল না। গোপীর সাথে দেখা হল পথে। গোপী ওর মামার বাড়ি থেকে ফিরছিল। গোপী টুপুরকে দেখে বলল, “কী রে, তোরা জিতুকে বিক্রি করে দিয়েছিস নাকি? খয়েরকাকা তো দেখলাম লোকজন নিয়ে আসছে।”

টুপুর বলল, “মানে কী? আমরা জিতুকে বেচব কেন? কাল রাতে একসাথেই জিতু আর আমি ঘুমিয়েছিলাম। সকালে উঠে দেখি জিতু ওখানে নাই। তারপর থেকে আমি সহ অন্যরা জিতুকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।”

“বুঝে গেছি রে টুপুর! খয়েরকাকা কোনও ঔষধ ব্যবহার করেই রাতে তোদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে। এখন ওটা বেঁচে দেবে নিশ্চয়ই। ওই লোক আসলেই দুষ্টু খুব। আমি দেখলাম গল্লামারী মোড়ের বটগাছটার ওই পাশে দুইজন স্যুটেড-বুটেড লোককে সাথে নিয়ে কী আলোচনা করছে যেন। মিষ্টি কিনে নিয়ে ফিরছি, তখন কানে এল পাশের চশমা পরা গুণ্ডা টাইপ লোকটার কথা। আমি কানটাকে আরও খাড়া করলাম। আবার যাতে খয়েরকাকা না দেখে, লুকিয়ে শুনেছি সব। ‘খয়ের আলি এত সুন্দর বাচ্চা কোথায় পেলে? বিদেশে কী দাম হবে তা তুমি জানো না! তুমি লাল হয়ে যাবা বাঘের টাকায়। সাবধান, কেবল যাদের বাড়ি এসেছিল তারা যেন না জানে দেখো। ওরা হয়তো খোঁজাখুঁজি শুরু করেছে, আর থানাপুলিশ জানলে আমরা পুরো দল বিপদে পড়ব। তখন মরার জন্য লালদালানই চূড়ান্ত হয়ে যাবে।’

“কথাগুলো শুনে হা হা হা করে হেসে উঠল খয়ের আলী। ‘আরে করিম মাঝি, সে হল বোকা মানুষ। সে আমাকে চেনে না। তার ভাবনায়ও এমন কিছু আসবে না। সে ভাববে হয়তো বাঘটা কোথাও পালিয়েছে। এখন আজই বাড়ি থেকে বাচ্চাটাকে সরিয়ে নিতে হবে। রাতে একটা ‘জরুরি ঔষধ সরবরাহ’ লেখা গাড়ি এনো আমার বাড়ির পেছনে। এখন ইজেঞ্জকশন দেয়া আছে, বাঘটা ঘুমোচ্ছে। সহজে জাগবে না। দীপঙ্কর ডাক্তার পশু বিষয়ে বেশ দক্ষ। তার ঔষধেই এই কাজ করতে পারলাম। এখন তোমরা যাও, রাত বারোটায় এসো আমার বাড়ির পেছনে। তখন সবকথা হবে। আজই সরাতে হবে বাঘটাকে। দেরি হলে বিপদ হতে আর কতক্ষণ? তাছাড়া করিম মাঝির ছেলে দুইটা পড়ালেখা করে বুদ্ধিও আছে। কী করে কী ঘটিয়ে ফেলবে তার ঠিক নাই। সুতরাং তার আগেই বাঘটাকে সরানো দরকার। আর বিদেশে পার্টির সাথে আজই কথা বলো। দুইদিনের ভেতর আমরা হ্যান্ড ওভার করব বাঘ।’

“খয়ের আলির চোখ চকচক করছে তৃপ্তিতে। প্রচুর টাকা পাবে বাঘটাকে পাচার করে।”

গোপীর কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল টুপুর। বলে কী, “খয়েরকাকা এরকম বাজে লোক? কী করে সম্ভব এটা? একটা বাঘ এসেছে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আর তা খয়েরকাকা তাকে চুরি করে নিয়ে বেঁচে দিচ্ছে? জাতীয় পশু পাচার করা কিংবা হত্যা করা অন্যায়। খয়েরকাকা তো আইনত অন্যায় করেছেন। আমরা এখন কী করবো তবে? গোপী চল, আগে বাড়ি যাই, বাবাকে বলি। সবটা জানাই, তারপর বাবাকে বলে কিছু তো করা দরকার। এভাবে জিতুকে বিক্রি হতে দিতে পারি না।”

টুপুরের কথার সাথে ওর আরও তিন বন্ধু ছিল মণি, রফি আর নিলু, ওরাও টুপুরের সাথে জোর দিয়ে বলল, “চল গোপী, এবারে এর একটা হেস্তনেস্ত করি। চোর খয়ের আলিকে সাইজ করা দরকার।”

বাড়ির সামনেই টুপুরের বাবা দাঁড়িয়ে ছিল। টুপুরকে ওর বন্ধুদের সাথে আসতে দেখে করিম মাঝি বলল, “তোমরা কোনও খবর পেলে?”

তারপর টুপুর আর গোপী সব বলল। রাতেই আজ জিতুকে ওরা পাচার করবে। মাঝি রাগে ক্ষেপে গেল। বলল, “তোমরা খয়েরকে চোখে চোখে রাখো বাবা। ও কোথায় কোথায় যাচ্ছে আর ওর বাড়িতে কারা আসে কারা যায় সাবধানে দেখো। খয়ের শয়তান লোক জানতাম, কিন্তু এমন বদমায়েশ তা জানতাম না। আমি থানায় গিয়ে ওসি সাহেবকে সব খুলে বলি। তারপর এর একটা বিহিত করতে হবে রাতে।”

মাঝি চলে গেল থানার দিকে।

রাত প্রায় বারোটা বাজে। কোনও আলো নেই কোথাও। মফস্বল শহরের গ্রাম। করিম মাঝি তার ছেলে দুপুর, টুপুর আর টুপুরের বন্ধুদের নিয়ে অপেক্ষা করছে। সামনেই খয়ের আলির বাড়ির গেট। ওসি সাহেবেরও আসবার কথা। ওসি সাহেব আসছেন না কেন এখনও! গেটটা আটকানো। ওখানে কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

গেটের কাছে হঠাৎ একটা টর্চ জ্বলে উঠল। মাঝি আর ছেলেরা সচেতন হয়ে উঠল। এরই মধ্যে আবার একটা গাড়ির আলো আসতে দেখা গেল। মাঝি ভাবল ওসি সাহেব আসছেন। কিন্তু না, ওসি সাহেব নন। একটা পিক-আপ ভ্যান আসছে।

ভ্যান থেকে কালো পোশাকওলা দু’জন লোক নামল। গেট খুলে একজন লোক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল।

“দৌড় দাও, দৌড় দাও! তোমাদের ফোন বন্ধ ছিল ক্যানো? ওরা পুলিশের কাছে গিয়েছিল। ওসি সাহেব ফোন করেছিল। দ্রুত সরাতে হবে। দ্রুত করো। মেলা টাকা ঘুষ নেবে এখন এই ওসি। চলো, চলো।” লোকদুটোকে টানা এসব কথা বলে যাচ্ছিল খয়ের আলি।

খয়ের আলির কথা শুনে ওরাও একটু দ্রুততর হল। দ্রুত গাড়ি নিয়ে বাড়ির পেছনে চলে যাচ্ছিল। আর আস্তে আস্তে মাঝি এবং তার ছেলেরাও এগিয়ে গেল সেদিকে।

ঠিক তখনই জিতুকে নিয়ে ওরা ধরাধরি করে এসে গাড়ির সামনে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে ওরা জিতুকে গাড়িতে ওঠানোর জন্যে গেল দরজা খুলতে। আর আর অমনি করিম মাঝি চিৎকার করে উঠল, “কেউ নড়বে না, কেউ নড়বে না! জিতুকে ফেরত দাও। জিতুকে নিতে পারবে না কেউ। ছাড়ো জিতুকে।”

তখনই ওদের ভেতর থেকে একজন করিম মাঝিদের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে তাক করল। করিম মাঝির সাথে তার ছেলে দুপুরও দাঁড়ানো। বাকিরা অন্যদিকে। ওরা চুপ করেই ছিল। টুপুর ওর বাবার দিকে বন্দুক তাক করতে দেখে আস্তে আস্তে সরে গেল গাড়ির চাকার কাছে। যেখান থেকে কেউ খেয়াল করবে না, এমনভাবে দাঁড়ানো আর গোপীরা পাশের একটা গাছের আড়ালে দাঁড়ানো। ওরা লাঠি জোগাড় করে ফেলেছে। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে, একসাথে লাঠিসোটা দিয়ে লোকগুলোর ওপরে ওরা মার শুরু করবে। এর ভেতর টুপুর ধুম করে ইট মেরে বসেছে বন্দুকওলা লোকটার হাতে।

“ওরে বাবা রে!” বলে বন্দুক ছেড়ে দিয়েছে লোকটা। বসে পড়েছে হাতের ব্যথায়। আর এদিকে থেকে হাজির হয়েছে গোপীরা সবাই। এসে একবারে মেহগনি গাছের চ্যালা করা কাঠ দিয়ে উলটোপালটা মারতে লাগল। খয়ের আলি দুই বাড়ি খাবার পরে পড়ে গেল মাটিতে। ছেলেদের এলোপাথাড়ি বাড়িতে সবাই ধরাশায়ী পাচারকারী দলের সদস্যরা।

পুলিশও এল এরপর। পুলিশ ওদের সবাইকে ধরে নিয়ে গেল। আর টুপুররা সবাই ব্যস্ত হয়ে গেল জিতুকে নিয়ে। জিতুর তখনও জ্ঞান ফেরেনি। সবাই ধরে জিতুকে নিয়ে বাড়ি নেয়া হল। পশুর ডাক্তার আনা হল। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার জিতুকে একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে দিলেন। জিতু তার মিনিট বিশেকের ভেতর উঠে গেল ঘুম থেকে। এরপর সব বলা হল জিতুকে।

রাতের ভেতরই করিম মাঝি তার সব মাঝিদের খবর দিল। এরকম ঘটনার পর আর দেরি করা ঠিক মনে হল না তার। মাঝি যে করে হোক সকালেই নৌকা ভাসাবে জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। কেননা, যেভাবে হোক জিতুর সুরক্ষা দরকার সবকিছুর আগে। প্রাণীর প্রতি মানবগোষ্ঠীর দায়িত্ব আছে। দায়িত্বটা এবারে যেহেতু এসেছে মাঝির ভাগ্যে তো মাঝি পুরোটা ভালো করেই করবে। আর অবহেলা নয়।

জিতুর জন্যে সারাদিন কেউ ঠিকঠাক খায়নি। টুপুর তো কিছু মুখেই তোলেনি। টুপুর খুব পছন্দ করে নিয়েছে জিতুকে। জিতুও পছন্দ করেছে টুপুরকে। রাতে আর কেউ বাড়ি গেল না টুপুরের বন্ধুরা। সবাই রাতে টুপুরদের বাড়িতে খেল, আনন্দ করল। এভাবে আনন্দ করতে করতে সবাই বেশ সময় পার করল, আর ভোরে ভোরে রওনা করল বন্দনা শেষ করে। বাবার সঙ্গে গেল টুপুরও। টুপুর কখনও জঙ্গলে যায়নি আগে। এবারই প্রথম যাচ্ছে। এমনিতে নৌকায় ঘুরেছে, কিন্তু দূরপাল্লার যাত্রায় যায়নি কখনও।

টুপুর আর জিতু বসে আছে নৌকার ছাদে। ভোরের আলো ফুটেছে। সূর্য ধীরে ধীরে আলো ফেলছে পৃথিবীর বুকে। বেশ ভালোই লাগছে দেখতে। নদীর ভেতর দিয়ে ওরা যাচ্ছে। ওদের সাথে আরও কত কত নৌকা, ট্রলার যাচ্ছে ওদের উলটোদিক থেকে। নদীপথের যাত্রায় ওরা অনেক কিছু দেখছে। আগে এভাবে কখনও দেখেনি টুপুর কিংবা জিতু দু’জনেই। নদীর পাশে কেউ জাল দিয়ে মাছ ধরছে, গাছ দাঁড়িয়ে আছে, ছেলেরা লাটাই নিয়ে ঘুড়ি উড়োবার চেষ্টা করছে। গরু-ছাগল নিয়ে নদীর চরে রাখাল আসছে। ওই দূরে একটা গ্রাম যেন দ্রুত সরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে গ্রামটা দৌড়চ্ছে। টুপুর আর জিতু হেসে দিল দু’জনের দিকে তাকিয়ে।

সামনেই একটা খেয়া যাচ্ছে। পাল তোলা নৌকা। মাঝি গান ধরেছে। বেশ লাগছিল। একটু পরই বসে যাবে ওরা সকালের নাস্তা করতে। টুপুরের মা সবার জন্য খাবার দিয়ে দিয়েছে।

দুপুর হয়ে গেল। পশুর নদী পার হয়ে গেছে টুপুরদের নৌকাটা। এখন সবাই গোসল করবে। নৌকাটা থামল তীর ঘেঁষে। সবাই গা ধুয়ে নিচ্ছিল ছোটো বালতিতে করে। টুপুর নামল নদীর চরে। জিতু নৌকায় থাকল। নৌকা থেকে দেখল, টুপুর দৌড়চ্ছে নদীর চরে। টুপুরের আনন্দ দেখে জিতুও নেমে গেল। তারপর দু’জনে এমন ঝাঁপানো ঝাঁপাল আর কী বলি। মাঝি শেষমুহূর্তে বকা দিল, “এত ঝাঁপালে শরীর খারাপ করবে!”

ওরা দু’জনেই উঠে এল। তারপর সেইরকম মজা করে টুপুরেরা খেল দুপুরবেলা। খাওয়া শেষে নৌকার ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়ল জিতু আর টুপু। কেননা, রাত হয়ে যাবে জঙ্গলে পৌঁছতে। তারপর জোয়ার-ভাটার খেলা পুরোটাই। চাইলেই এই বড়ো নদী দিয়ে শাঁ শাঁ করে চলে যাওয়া যায় না। প্রচণ্ড ভাটায় যেতে পারলে ভালো, কষ্ট কম হয়। উজানে নৌকা চালানো বেশি কষ্টের। আগে তো পারত না মাঝিরা। জঙ্গলে যেতে কারও কারও তিনদিন চারদিন সময় লাগত। এখন ইঞ্জিন নৌকা হয়ে সুবিধে হয়েছে অনেক। তবুও দেখেশুনে চলে মাঝিরা। নদীপথে একবার বিপদে পড়লে তখন রক্ষা করবে কে? তাছাড়া করিম মাঝি নৌকায় ইঞ্জিন চালাতে আগ্রহী নয়। দাঁড় আর বৈঠা সব রেখেছে সে তার নৌকায়, ইঞ্জিনও রয়েছে।

পশুরের একপাশে বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে। করিম মাঝি দেখাল তার ছেলে টুপুরকে। টুপুর আবার তা জিতুকে বলল। জিতু এই কয়দিনে কত কী শিখেছে, দেখেছে মানুষের জীবন। মানুষের ভেতর ভালোমন্দ দুইই আছে। মানুষ তাদের নিজেদের প্রয়োজনে সব বানিয়ে নিয়েছে। তেল দিয়ে আগে আলো জ্বলত। কিন্তু তাতে পোষাত না, তাই বিদ্যুৎ আবিষ্কার করেছে। সবচেয়ে মজার হল, মানুষ এখন কেবল টেলিভিশনে দেখে না। তারা মোবাইল নামের এক যন্ত্র ব্যবহার করে। তা টেলিভিশনের চেয়েও আরও শক্তিশালী। টেলিভিশনে তো কেবল আগে রেকর্ড করা কথা আর ছবি দেখা এবং শোনা যেত। মোবাইলে তা নয়। সব হয় মোবইলে। ছবি দেখা, ছবি তোলা, কথা বলা, অন্যকে বলা, ভিডিও করা, সম্পাদনা করা—কত কী করা যায়। টুপুর সব বলেছে জিতুকে। কিন্তু এসবের কারণে মানুষ আর আবেগপ্রবণ নেই। মানুষের আবেগ নষ্ট হয়ে গেছে। আগে মানুষ অল্পে খুশি ছিল, এখন তা নেই। যত পাই, তারও চেয়ে বেশি চাই। বেহিসেবে সব চাওয়া। মানুষ চাঁদে গেছে তা জিতু জানত না। আকাশে আরও একটা জগত আছে তা জিতুর ধারণার বাইরে ছিল। শুনে অবাক হয়ে গেছে জিতু। অত দূরে মানুষ কীভাবে যায়? জিতু ভেবে পায় না। জঙ্গলের কাউকে কিছু না বলেই এসেছিল। মাঝিও জানত না যে জিতু গোপনে রাতের বেলা উঠেছে। ওরকম করে না উঠে পড়লে হয়তো মাঝি নিতই না। দেখা হত না এই মানুষের জীবন, মানুষের সভ্যতার বিরাট ইতিহাস। জিতু এসব গিয়ে তার বন্ধুদের আর বাবা, চাচাদের বলবে। কত গল্প সে জানল এই নগরের। এখানে ট্রেন চলে। ট্রেনের ভেতর খোপ খোপ করা। ওই খোপের ভেতর চেয়ার বসানো যাতে মানুষেরা বসতে পারে। ট্রেনের জানালা আছে। জানালা দিয়ে কত কী দেখা যায়! ট্রেন ছুটে চলে ঝিকঝিক ঝিকঝিক করে। মনে হয় ছবির ভেতর বসে আছি, ছবিটা দৌড়চ্ছে। লম্বা সে ট্রেন গাড়ি। লোহার পাটির ওপর দিয়ে চলে। যারা গরিব মানুষ, সিট পায় না, তারা এই ট্রেনে ওরা হাতল ধরে ঝুলে ঝুলে যায়। কেউ কেউ ছাদে ওঠে। অনেকে বোঁচকা বা কাপড়ের বস্তা নিয়ে উঠতে গিয়ে পড়ে যায়। তারপর আর খোঁজ থাকে না তার শরীরের। এভাবেই মানুষের সমাজ বেড়ে উঠেছে। ক্ষমতার লড়াই সবখানে। জিতু ভাবত, কেবল বনের ভেতর বুঝি ঝগড়াঝাঁটি। কিন্তু তা নয়। সর্বত্রই ক্ষমতা আর দম্ভের জয়। কিন্তু টুপুর বলে ভালোরা শেষাবধি জয়ী হয়। ওর বাংলা বইয়ে এরকম লেখা হয়েছে। আর জিতুরা বাঙালির জাতীয় পশু। ইংরেজি নামখানও সুন্দর দিয়েছে, রয়েল বেঙ্গল টাইগার।

রয়েল বেঙ্গল টাইগার, আর বাংলায় বাঘ। এই নাম জিতুদের আগে জিতু জানতই না। হয়তো বনের কেউই জানে না। জিতুর খুব ভালো লাগে যে ওদের এত সম্মান দিয়েছে মানুষ। স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পশু বাঘ। সারা পৃথিবীতে বাঘকে চেনে সবাই তা জিতু এতদিন পর জানল। এসব ভাবছিল। কত কী জেনে এল নগর থেকে! মনে মনে তার এই জানার জন্যও আনন্দ হচ্ছিল।

ছয়

সুন্দরবনে এল টুপুরদের নৌকা

রাত দুটো। আকাশে চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। নৌকাটা এগিয়ে চলেছে। ছলাৎ-ছল, ছলাৎ-ছল করে মাঝিরা দাঁড় টেনে চলেছে। হালকা হালকা ছায়া ছায়া। মনে হচ্ছে চাঁদে কেউ আজ বসেছে। পান চিবুচ্ছে, না হলে বুড়িটা চরকা বুনতে শুরু করেছে। টুপুরের দাদু বলেন, চাঁদে এক বুড়ি আছেন, চাঁদের বুড়ি তার নাম। কখনও ওই বুড়ির বয়স বাড়ে না। দাদু তাঁর নিজের বয়স থেকে এখনও দেখে আসছেন, তবুও বুড়ি আগের মতোই।

টুপুর আর জিতু কিন্তু এখনও জেগে আছে। টুপুর আর জিতুর বন্ধুত্ব বেশ জমেছে। টুপুর জিতুকে চাঁদের বুড়ির গল্প বলে গেল। জিতুও খুব খেয়াল করে সে গল্প শুনছিল। টুপুরদের নৌকার পাশ দিয়ে দুয়েকটা ছোটো ছোটো মাছধরা নৌকা চলে যাচ্ছে। এরা অবশ্য কেরোসিনের ল্যাম্প জ্বালিয়ে রেখেছে নৌকার ছাউনির ভেতর। একটা নৌকা থেকে গানের সুর ভেসে আসছে। গানটা বেশ দারুণ। টুপুরও ওর বইয়ে পড়েছিল, ‘মাঝি বাইয়া যাও রে, অকূল দরিয়ার মাঝে কূল নাই রে…

টুপুরের এরকম আগে কখনও নদীতে রাতে থাকাও হয়নি, আর এরকম করে জঙ্গলেও আসা হয়নি। ফলে টুপুরের কাছে যেন খুব আশ্চর্য লাগছে। জিতুরও আজ বেশি ভালো লাগছে, আর মনটাও তার খারাপ। কালই তো টুপুর ফিরে যাবে। আর কখনও দেখা হবে কি না কে জানে! জিতু এসব কথাই ভাবছিল। এরই মধ্যে বড়ো একটা নদী পড়ল, রায়মঙ্গল নাম। এই নদী পার হয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়বে করিম মাঝির নাও। তারপর এক খাল পার হয়ে, আরেক খাল পার হয়ে চলে যাবে আগের জায়গায় যেখান থেকে জিতু মাঝির নাওয়ে উঠেছিল। ব্যস, তারপর কালই ফিরবে আবার মাঝি আর তার লোকজন। মাঝির মনটাও একটু ভারীই যেন। সাথে সাথে নৌকার অন্য মাঝিদেরও মন সেঁটে আছে বিষণ্ণতায়। ওরাও আর ভালো নেই। জিতু একটা বাঘের বাচ্চা, কিন্তু যেন সব বোঝে সে। একটুও পশুর মতো নয়, বরং মানুষের ভেতরেই এরকম পশুর চেহারা নিয়ে মানুষ রয়েছে লুকিয়ে, পশুর মন এত ভালো।

একটু একটু করে নৌকা চলে এল জঙ্গলের সেই চিঁচুয়ার খালের কাছে। নৌকা থামল। মাঝি নাওয়ে বসে মা বনবিবি আর পীর গাজী কালুকে স্মরণ করে নিল। টুপুরকে বলল, “এখন আর জঙ্গলের মালে নামা ঠিক হবে না। তুমি এসেছ টুপুর প্রথম এই জঙ্গলে। কাল তোমায় নিয়ে নামব। রাত এখন অনেক। জিতু, তুমিও থাকো, না হলে নামতেও পার। সকালে এসে আবার আমাদের সাথে খাবে।

জিতু সবার থেকে বিদায় নিয়ে নেমে গেল নৌকা থেকে। এক, দুই, তিন লাফে কূলে পৌঁছে গেল। টুপুর চেয়ে চেয়ে দেখল তা। আর সকালে ফিরবে তাও জানিয়ে গেল জিতু।

ভোরের আলো এসে গাছের আড়াল থেকে সবুজ পাতার স্পর্শ নিয়ে যেন ছিটকে ছিটকে পড়ছে খালের পানিতে। পানিও যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে তা মেখে নিয়ে আবার ফেরত পাঠাচ্ছে। টুপুরের চোখে ওই আলো এসে পড়ায় চোখ মুচড়ে টুপুর উঠে বসল। নৌকায় কেউ নেই ভেতরে। বাবাকে ডাকল টুপুর। বাবা নেমে এল উপর থেকে। “ওহ্‌, টুপুর তুমি উঠে গেছ? ভালো হয়েছে। জাফর, হাকিম, মুন্নুরা নেমে গেছে একটু মধু আর মাছ ধরতে, কেওড়া পাড়তে। রান্নাও শেষ। জিতু আসেনি এখনও। ও এলেই খেয়ে নেব। আজই তো চলে যাব। আর কখনও তো একসাথে খাওয়া হবে না এমন। তাছাড়া বাঘের বাচ্চা এত ভালো হয় তা আগে কখনও জানতাম না।”

বাবার কথা শুনে টুপুর নিমের ডাল নিয়ে দাঁত পরিষ্কার করতে গেল। এর ভেতর জিতু এসে হাজির হল। খালপাড় থেকেই হালুম, হালুম, হালুম করতে থাকল। তারপর, “মাঝি, ও মাঝি, টুপুর, কোথায় তোমরা? আমি এসেছি তো।”

মাঝি জিতুর কাণ্ড দেখে হেসে দিল। নৌকার গলুইতে গিয়ে বলল, “এই তো, এই যে আমরা। তোমার জন্য এখনও খাইনি। এসো, খাব একসাথে।”

ঝপাৎ, ঝপাৎ, ঝপাৎ করে চলে এল নৌকায় জিতু। টুপুর হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে এল। জিতুকে দেখে টুপুর হেসে দিল। টুপুর বলল, “তুমি তো গা-টা ভিজিয়েছ দেখছি। একটু বসো গামছা আনি। গা মুছে দিই, খেতে বসবে।”

এরপর টুপুর গামছা দিয়ে জিতুর গা মুছে দিয়ে খেতে বসল তিনজনেই। খুব মজা করে খেল আলু, ট্যাংরার ঝোল, ছোটো মাছ আর করলা ভাজা। তারপর পাকা পেঁপে খেল। জিতু কিন্তু প্রথমে পেঁপে খোসা সহ খেয়ে নিয়েছিল। টুপুর দেখিয়ে দিল কী করে খেতে হয় পেঁপে খোসা ছাড়া। জিতু সেভাবেই খেয়ে নিল। এরপর জিতু ওর বাড়ি ফেরার পর মজার যে কাণ্ড ঘটেছে তা বলল।

বাড়িতে বাবা-মা দু’জনেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। জিতুর মা নাকি একটুও খায়নি কিছু। ওর বাবা নাকি আশাই ছেড়ে দিয়েছিল খুঁজে পাওয়ার। জিতুর এই আচমকা শেষরাতে ঘরে ফেরা এবং এতদিন পর তা নিয়ে বাবা-মা কিছুই বলেনি। মা তাকে বুকে জড়িয়ে অনেক আদর করেছে। বাবা বলেছে, আর কখনও সে বকবে না। এখন থেকে যেন কোথাও গেলে মাকে অন্তত বলে যায়। জিতু বলেছে, “ঠিক আছে, তাই হবে বাবা। তবে মজার অনেক ঘটনা আছে। আমি গিয়েছিলাম মানুষের নগরে। মানুষের সভ্যতা, শিক্ষা, জীবন এসব দেখেছি। কী দারুণ মানুষেরা যে বাবা তা বলে বোঝানো যাবে না। ওখানেও আমাদের মতো সব নিয়ম আছে। ওরা ওদের সুবিধের বাইরে আর কিছুই বোঝে না, তবে কিছু মানুষ আছে অন্যের উপকার করাই তাদের কাজ।”

এসব কথা যখন বলছিল জিতু, ওর মা তখন অবাক হয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে শুনছিল। ওর মা কখনও এ বয়স অবধি জানে না মানুষ কেমন, কী করে মানুষেরা। ওরা জঙ্গলে আসে কাজ করতে, তারপর আবার কাজ শেষে ফিরে যায় নিজেদের বাড়ি। ওর মা বলল, কী করে মানুষের সমাজ দেখল সে, কীভাবে পৌঁছল ওদের ওখানে। মায়ের এমন প্রশ্ন শুনে হেসে দিয়েছিল জিতু। ওর মা যে ওকে দেখছে অবাক হয়ে তা জিতু জানে। বাবা তেমন কিছু বলেনি, কিন্তু পরে যে সবটা শুনবে তা জানে। আর জিতুর ফিরে আসা নিয়ে জঙ্গলে একটা সভা হবে। তারপর আনন্দ উৎসব হবে। ওর বাবা রাজসভায় বলে দিতে বলেছে। মন্ত্রীমশায় তিনদিনের আনন্দ উৎসব ঘোষণা করেছে। বলেছে, “রাজা মহাশয়ের একমাত্র পুত্র আমাদের প্রিয় যুবরাজ সুস্থভাবে নগর থেকে যে সভ্যতা দেখে ফিরে এসেছেন তা নিয়ে যুবরাজ বলবেন আমাদের, যা এই জঙ্গলবাসীর জন্যে খুব জরুরি। শেখার কত কী যে আছে আমাদের তা বলা মুশকিল। আজ থেকে যুবরাজ একটা স্কুল চালাবেন মানুষের সভ্যতা নিয়ে, আর সভায় রাজা মহাশয়ও বক্তৃতা করবেন। যে কয়দিন উৎসব চলবে সেই কয়দিন রাজার বাড়ি থেকে খাবার দেয়া হবে।”

এই শাহী এলান দেয়ার দায়িত্ব পড়েছে জঙ্গলের সব জায়গায়। মন্ত্রীর অর্ডারের পর চলে গেল ঢোলক দল। কতকগুলো উটকোমুখো বানর এসেছে বাড়ির গেটে। বড্ড খাবারের আয়োজন সাধারণ পশুগুলোর জন্য। এই আয়োজনে জিতু কিন্তু খুশিই হয়েছে। ওর বাবার এই সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয় বরাবরই ওর ভালো লাগে।

টুপুরের সাথে জিতু সব বলছিল। টুপুরের খুব ভালো লাগল, তার বন্ধু বাড়ি ফিরেছে এ কারণে এমন আয়োজন। এবার জিতু বলল, “এবারে চলো তোমাকে নিয়ে আমার নিজের রাজ্য দেখাব। মাঝি তুমি চিন্তা কোরো না, আমি ঠিক ওকে ফিরিয়ে আনব আর তোমাদের জন্য একটা দুনিয়ার খবর আছে। আমিই জানি ওই জায়গার খবর কেবল।”

সাত

জিতুর রাজ্যে টুপুর

অজানা এক রহস্যময়তার দিকে জিতু আর টুপুর রওনা হল তা কিন্তু নয়। জিতু টুপুরকে তার রাজ্যে নিয়ে যাবে আজ। টুপুরকে তার খুব ভালো লেগেছে। টুপুর খুব বুদ্ধিমানও। বন্ধু হিসেবে দারুণ টুপুর। আর জিতুর রাজ্যটা যেখানে সেখানে জঙ্গলের অন্য প্রাণীরা যায় না। জঙ্গলের একেবারে গহিনে। চেনা নেই, জানা নেই বনের অন্যদের জন্য এমন একটি জায়গা সে। ঘন জঙ্গলের ভেতর একটুকরো শহর যেন। দেবদূতদের বসবাসের জায়গা। এমনকি রাজবাড়ির সেনারাও চেনে না এই জায়গা। জিতু খুঁজে খুঁজে ওই জায়গাটিই নিয়েছে নিজের পছন্দে। পছন্দটা তার দারুণ এ কারণেই বলতে হয় কেবল তা নয়। বনের গাছে ঘেরা এই ছোট্ট রাজ্য তার। একদিকে এই জায়গার গরানবন, একদিকে সুন্দরীগাছ, একদিকে কেবল গোলপাতার বাগান সে। তারপর রয়েছে কেওড়া, ওড়া আর গেওয়াগাছের সার। এখান থেকে কখনও গাছও কাটে না কেউ। অনেকদিন পরে পরে দুয়েকটা ডাল গুঁড়ো হয়ে পড়ে যায় শুকিয়ে, তখনকার শব্দটাও মজার হয়। এখানে সিংহাসনও বানিয়েছে মাটির ঢিবি করে। তারপর রাজকার্য পরিচালনা করবার মতো সব ব্যবস্থাও করেছে। রাজ্যটা গুছিয়ে নিয়েছে নিজের মতো করে।

জিতুর সেনাসামন্ত সব ওই ছোটো ছোটো বানরের দল। ওরাই সব গোছায়। এই জায়গায় মাঝে মাঝে যুদ্ধ বাধিয়ে দেয় জিতু। দেশ দখল করবার সবকিছু মতো সে লড়াই। সেরা যোদ্ধাকে কলা ফুলের মালা উপহার দেয় যুবরাজ। এসব জিতুর বেশ ভালোই লাগে। জিতু ভাবেনি যে এমন সুন্দর করে সে শহর ঘুরতে পারবে। সবটাই সম্ভব হয়েছে টুপুরের কারণে। তাই সে তার বন্ধুকে একটা চমৎকার উপহার দিতে চায়। টুপুরের বাবা করিম মাঝিকে বললে মাঝি হয়তো তা নেবে না। এ কারণে জিতু টুপুরকেই দিতে চায়। তাই জিতু টুপুরকে নিয়ে আসছে নিজের রাজ্যে।

সেই কতক্ষণ ধরে দেখছে টুপুর জঙ্গল ঘুরে ঘুরে। ভালোই লাগছে। পাখিরা শব্দ করছে। একটা বনমোরগ ডাকতে ডাকতে একটা গাছ থেকে আরেক গাছে উড়ে গেল। জিতু সঙ্গে সঙ্গে থেকে দেখাচ্ছে। জিতু হঠাৎ দৌড়ে এল। “দেখো তোমার পছন্দের খাবার গোল সবুজ বেশ বড়ো একটা পেয়ারাগাছ।”

টুপুর বলল, “পেয়ারাগাছ! চলো পেয়ারা খাই। আমি পেড়ে আনি।”

টুপুর গাছে উঠতে গেল। কিন্তু জিতু বলল, “থামো, তুমি না। হাঁচিপাঁচি হালুম! হাঁচিপাঁচি হালুম! হাঁচিপাঁচি হালুম!” বলে হুঙ্কার দিল। অমনি সব হাজির হল চারদিক থেকে লেজওলা, লেজ ঝোলা, হঁকোমুখো, মুখপোড়া সবরকমের বানর আর হনুমান। চিঁইঁচিই করে শব্দ করল। ওরা তিন-চারটে পেয়ারাগাছে উঠে গেল আর পেয়ারা পেড়ে আনল দশটা-পনেরোটা। টুপুর ভীষণ অবাক হল এরকম কাণ্ডে। খুব অবাক হল, আবার মজাও পেল। তারপর হাঁটতে হাঁটতে সেই পেয়ারা খাওয়া শুরু করল। এবারে আর ওরা দু’জনে নয়, পেছনে বানরের দলও আছে। সবাই একসাথেই হাঁটছে। টুপুর বেশ মজা পাচ্ছে। বাড়ি গিয়ে গোপীদেরকে ও বলতে পারবে এই জঙ্গলে আসবার গল্প। মনে হচ্ছে যেন কোনও দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এসেছে। তেমন করেই ওরা টুপুরকে নিয়ে যাচ্ছে।

কিছু পথ হাঁটবার পর জিতুর দিকে তাকিয়ে টুপুর বলল, “আমি আর হাঁটতে পারছি না। তুমি কোথায় নেবে আমাকে?”

জিতু টুপুরের কষ্ট হচ্ছে তা বুঝেছে। এ কারণে বলল, “আর দূরে নয়, ওই তো সামনেই। এই একটু হাঁটতে হবে, টুপুর। জানি তোমার কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু এখানে তো তোমাদের শহরের মতো আর গাড়ি নাই। নাই কোনও সাইকেল, ভ্যান বা অন্যান্য যানবাহন। তাই বন্ধু, এই কষ্টটুকু করো। তারপর বিশ্রাম নিতে পারবে অনেক। আজ তুমি আমার অতিথি বন্ধু। আমিও তোমার যেমন অতিথি ছিলাম কয়দিন আগে, তেমনটাই তুমিও আমার অতিথি।”

টুপুর জিতুর কথায় হেসে ফেলল মিষ্টি করে। বলে ফেলল, “সে তো হতে আমার আপত্তি নেই, তুমি নিয়ে চলো তোমার রাজ্যে আমায়।”

তারপর আবারও হাঁটতে শুরু করল। জঙ্গলের শূলের ভেতর দিয়ে হাঁটা টুপুরের অভ্যাস না থাকায় তা একটু লাগছে বেশি পায়ে। এজন্যে টুপুরের দেরি হচ্ছে হাঁটতে। তবুও আরও মিনিট কুড়ি হাঁটার পরে হাজির হল গিয়ে জিতুর রাজ্যে। চারদিকে এত সুন্দর করে গোছানো দেখে মন ভরে গেল টুপুরের। কী সুন্দর! একটা ময়লাও নেই কোথাও। একদিকে ছোটো ছোটো চারা ফুলের গাছ, গাছে ফুল ধরেছে। সে দৃশ্য বড়ো সুন্দর। এই সুন্দর দৃশ্যে এসে যোগ হয়েছে আরও ভালো করে সবুজের সমারোহ। টুপুরের মন ভরে গেল দেখে। সব মাটির ঢিবির মতো করে বানানো। এর ওপর বসল সব বানরেরা আর জিতু টুপুরের হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বসল ওই উঁচু গাছের নিচে, বড়ো ঢিবির উপর। এটাই তার সিংহাসন। সিংহাসনের চারপাশ জুড়ে বড়ো বড়ো ছাতা বানানো ছাউনির মতো। সবটাই গাছের পাতা জুড়ে। বানরের দলের কাজ। ঘাসফুলগুলো এমন চমৎকার করে লাগানো, নিজের চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না কী সুন্দর শিল্প বানিয়েছে বানরেরা!

জিতু এবারে খাবার আনতে বলল বন্ধুর জন্যে। বানরেরা সঙ্গে সঙ্গে আনল পাকা গাব, পাকা ওড়া, পাকা বুনো কলা, বুনো কাঁঠাল, বুনো পেয়ারা, ডাব আরও কত কত ফল সব। এত খাবার ফল টুপুর একসাথে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। টুপুরের বিশ্বাস হচ্ছিল না এত ফল কী করে পেল ওরা খুঁজে। আর এইসব ফল এখানে পাওয়া যাবে তা টুপুর জানত না। যা হোক, বাঘের রাজ্য সুন্দরবন। সেই রাজ্যের রাজার ছেলের অতিথি নগরের ছোট্ট শিশু টুপুর দারুণ আনন্দে আপ্যায়িত হচ্ছে দেখে টুপুরের নিজেরও খুব ভালো লাগল। টুপুর বলল, “এসো বন্ধু, খাই দু’জনেই।”

জিতু হালুম, হালুম, হালুম করে খেতে বসল। দুই বন্ধুতে খেল। তারপর হাঁটতে বেরুলো। ঘুরে ঘুরে বন দেখাতে থাকল জিতু। তারপর কোন গাছ দিয়ে কী উপকার হয় তাও বলছিল জিতু, ওদের শরীরে ব্যথা হলে কী গাছ চিবিয়ে খায়, জ্বর এলে বদ্যিজী ওদের কী ফল খেতে দেয়। এভাবে ঘুরে ঘুরে টুপুরের জন্য বিস্ময়ের জায়গায় আনল জিতু। জিতু টুপুরকে বলল, “দেখো বন্ধু, সব তোমাদের নগরের মতো কী সুন্দর। আমার ধারণা, অনেক অনেক দিন আগে কেউ এটা বানিয়েছিল। এখন এখানে তারা আর কেউ বেঁচে নেই। তারপর ওই জঙ্গলে ডাকাতরা আসে শুনেছ, এখানে থাকে ওরা। কিন্তু অনেকদিন ওরা আসে না আমাদের একটা বাঘকে মেরে ফেলার পর। আমি এটা দেখে রেখেছি। কেউ নেই এই সম্পত্তির মালিক।”

টুপুর আর জিতু এবারে ঢুকে পড়ল ওই বাড়িতে। টুপুর বাড়ির ভেতর ঢুকে দেখল গিয়ে বাড়িটায় মোট তিনটি ঘর। সবগুলো ঘরেই ছিটকিনি দেয়া। জিতু আগেও এসেছে বার কয়েক এখানে। বেশ ভালোই লাগে। অনেক কিছু আছে এখানে। কোনটা কী তা সে জানে না। জিতু বুঝতে পারে, এই বাড়ির সবকিছুর নাম জানে টুপুর। তাছাড়া টুপুরদের সংসারে এই এখানকার জিনিসগুলো পেলে উপকার হবে। আর মাঝিও খুব খুশি হবে, বেচারার বয়সও হয়েছে যথেষ্ট। জিতু এই মাঝির পরিবারটিকে নিজে দেখে এসেছে। ওর ভালো লেগেছেও অনেক।

জিতুর সাথে সাথে তিনটে ঘরই দেখল টুপুর। ঘরের ভেতর কেবল বাক্স। বাক্সগুলোও আটকানো, বড়ো বড়ো তালা ঝুলছে এককটার সাথে। টুপুর উঁচু করতে চেষ্টা করল। বেশ ভারী লাগল। একটা ছোটো বাক্সে তালা নেই। কাঠের বাক্স ওটা। ওর ঢাকনা খুলে দেখে টাকার বাণ্ডিল, থরে থরে সাজানো। থরে থরে সোনার বাঁট, আর রয়েছে গয়না। টুপুর বিস্ময়ে চেয়ে রইল। টুপুর কী বলবে জিতুকে ভেবে পেল না। বাকি বাক্সগুলোতেও টাকা, না হয় স্বর্ণ কিংবা অন্য কোনও মূল্যবান জিনিস। টুপুর বলল, “জিতু, এ তো প্রচুর টাকা! এত টাকা কারা এনেছে? সব কি ওই ডাকাতদের কাজ?”

ভেবে টুপুর অবাক হয়ে রইল। তারপর বলল টুপুর, “সব শয়তান লোকদের কাজ যেহেতু, ওরা তো আবার আসবে! তখন কী করবে বন্ধু?”

জিতু ঘাড় নেড়ে বলল, “হুঁউ হালুম! তুমি ঠিকই ধরেছ, বন্ধু। ওদেরই কাজ। কিন্তু ওরা আর আসবে না। অনেকদিন দেখি না আমি এদিকে ওদের। তুমি না নিলে এইসব জিনিস এভাবে একদিন সব নষ্ট হয়ে যাবে।”

“তবে আর দেরি নয়, ফিরে চলো বাবার কাছে। বাবাকে গিয়ে সব বলি, তারপর আমরা আসব আবার বিকালে সবাই এখানে।”

এরপর জিতু আর টুপুর চলে গেল করিম মাঝির কাছে।

বিকালে যখন সবাই ওরা আবার ফিরে এল তখন একটু একটু আলো কমে এসেছে। জিতু মাঝিকে বলল, “মাঝি, তোমার আর কষ্ট করতে হবে না। তুমি এই ঘরের ভেতর যে ধনসম্পত্তি আছে তা নিয়ে যাও, বাকি জীবনটা তোমার আনন্দে কাটবে। ছেলেদের পড়াতেও পারবে, স্বপ্ন পূরণ হবে।”

কিন্তু তারপরই ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। আলো জ্বলে উঠল ওই ঘর-টরগুলো সহ পুরো বাড়িটা জুড়ে। চারদিকটা আলোকিত হল। কে জ্বালল আলো? সবাই বেশ চমকে গেল। ভৌতিক কাণ্ড মনে হল ওদের কাছে। ভয়ও পেল জিতুরা। তারপর বন্দুক উঁচিয়ে একজন হাসতে হাসতে এগিয়ে এল। লোকটা বেজায় কালো, গা তেল-চুকচুকে, গোঁফগুলো সেইরকম বাঁকানো। চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। চোখের ভেতর আগুন যেন ঠিকরে বের হচ্ছে। রাগে গরগর করছে। বলল, “সবাই হাত তোলো, সবাই তোলো। না হলে গুলি করে মাথার খুলি একদম উড়িয়ে দেব। আমার রাজ্যে এসে মাতব্বরি? দাঁড়াও, তোমাদের দেখাচ্ছি। কালু গুণ্ডার আস্তানায় এসে ঢুকেছ তোমরা। এই কে কোথায় আছিস? ধর সবগুলোকে। বেঁধে ফ্যাল।”

এই কথার সাথে সাথে দড়ি হাতে জোকারের মতো একটা লোক এসে হাজির। হাসতে হাসতে বলল, “এবারে বুঝবা ব্যাটারা।”

তখন করিম মাঝি বলল, “দেখো ভাই কালু, আমরা এমনিই দেখতে এসেছি। আমরা তোমার আস্তানা তো আর তা জানতাম না, আমাদের যেতে দাও।”

কালু তার ভয়ংকর চেহারায় রাগ দেখিয়ে হুঙ্কার দিয়ে বলল, “পুলিশ খুঁজছে আমায়। পুলিশ আমায় পেলে ধরে ফেলবে। আর তোমাদের ছেড়ে দিলে তোমরাও বলে দেবে। তখন পুলিশ খুঁজে পাবে কালু ডাকাতকে। তোমাদের ছাড়ব না।”

এতসব কথা এতক্ষণ শুনছিল চুপচাপ পাশ থেকে, তারপর আস্তে আস্তে পেছনে সরে গিয়েছিল জিতু। সে তার দলের সৈন্যদের খবর পাঠিয়ে দিল। একটু পর ঝাঁকে ঝাঁকে বানর এল ডাকতে ডাকতে আর সবার হাতে গোল ফল। তা ছুড়ে মারতে লাগল কালুর লোকদের ওপর। আর জিতু কালুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কালু বন্দুক নিয়ে পড়ে গেল। তারপর এবারে মাঝি গিয়ে কালুকে বেঁধে দিল। আর ঘরগুলো থেকে সব বাক্সগুলো করিম মাঝি তার লোকদের দিয়ে নৌকায় ওঠাল। তারপর কালু আর তার লোকদের হাত বেঁধে নৌকায় নিয়ে স্থানীয় রেঞ্জের পুলিশের হাতে দিয়ে আবার ফিরে এল।

সবশেষে রাতের জ্যোৎস্নায় জিতু এবং তার সৈন্য বনে আসা বন্ধু টুপুরকে বিদায় দিল। জিতু কেঁদে ফেলল। টুপুরও কাঁদল। করিম মাঝিরও চোখে লোনা পানির দেখা দিল। মাঝির সঙ্গীরাও কাঁদল। তারপর ধীরে ধীরে নৌকা ছাড়ল মাল থেকে।

নৌকা ছেড়ে যাচ্ছে দূরে। চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে। তার মধ্যে মনে হল ছোট্ট বাঘের ছানা জিতু কাঁদছে, চোখ চিকচিক করছে। টুপুর দাঁড়িয়ে আছে নৌকায় ভেজা চোখে। জিতুর জন্যে কষ্ট হচ্ছে খুব ওর।

 

অলঙ্করণঃ ইন্দ্রশেখর

 জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s