উপন্যাস মিত্র ও মিথ রুমেলা দাস শরৎ ২০১৯

রুমেলা দাসের আগের গল্পঃ বাদুড় মানুষ

স্বপ্ন না সত্যি?

(১)

তাহলে কী জ্বরের ঘোরে ভুল দেখল সৌরীশ? মাথার মধ্যেটা একেবারে জটলা পাকিয়ে আছে। খুব অস্থির লাগছে। ঘামে ভেজা টি-শার্টটা মাথা গলিয়ে খুলে ফেলে, ফ্যানের স্পিডটা আরও দু’দাগ বাড়িয়ে দেয়। বোতলের ছিপি খুলে এক ঢোঁক জল খেতে তরল ঠাণ্ডার রেশ ছড়িয়ে পড়ে গোটা শরীরে। পূর্বের মুখ হাঁ করা, কাচের জানালার কাছে আসে ও। বাড়ির সামনের সবুজ আগাছায় লুটোপুটি খাচ্ছে নরম সকালের আলো। মন জুড়ে অদ্ভুত অস্বস্তি। খোলা ছাদ এখনও তেতে ওঠেনি। চৌকাঠ ডিঙিয়ে উত্তেজিত নার্ভগুলোকে শান্ত করতে আকাশের নিচে দাঁড়ায় সৌরীশ। জেগে ওঠা পাখিগুলো ডানা ঝাপটিয়ে আকাশের এ-মুড়ো থেকে ও-মুড়ো উড়ে যাচ্ছে দিব্যি। সবটাই তো স্বাভাবিক! তবে… রাতে কী দেখল? কেন এত বছর পরেও এমনটা দেখল? অতীতের ঝড়গুলোকে আগলে, মুড়ে রেখেছিল। কিন্তু তাও… সেগুলো কোথাও সুপ্ত, অবচেতনে থেকে গেছে কি? আর তাই হয়তো… শিরশির করে এক পরত হিম চলাফেরা করে শিরদাঁড়া বেয়ে। কাঁটা দিয়ে ওঠে রোমকূপ। মনে পড়ে যায়, টলটলে আবছা অস্পষ্ট অবয়ব। ঠিক খাতায় আঁকা জলরঙের মতো ঢেউ খেলানো পাতার উপর একের পর এক সরে যায় প্রতিটা দৃশ্য! যেন নিপুণ হাতে কেউ সাজিয়ে রেখেছে নাটকের অঙ্কের মতো। দেখবার চেষ্টা করেছে ও। বোঝবার চেষ্টা করেছে। পারেনি। শুধু মনে হয়েছে, তিনি আছেন। খুব কাছেই আছেন। অথচ রাতে শোওয়ার আগে পর্যন্ত একটুও ভাবেনি তাঁকে। ছোটো থেকেই মা-বাবাকে হারিয়ে একা থাকতে থাকতে অভ্যাস তো অনেক আগেই হয়েছে। ধোঁয়া ধোঁয়া অংশগুলো নানা আকৃতি পেতে পেতে ক্রমশ স্থির হয়েছিল। আর তাতেই ফুটে উঠেছিল পঁচিশ বছরের অতিপ্রিয় কাছের মানুষটি। কিছু কি বলতে চাইছিলেন ওকে? যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছিল মাথার শিরা-উপশিরা। সৌরীশও কথা বলতে চাইছিল। কিন্তু পারছিল কই? একদলা তেতো দলা পাকিয়ে গেছিল বুক জুড়ে, স্বরনালী জুড়ে। অজান্তেই কি ওর এক হাত হাওয়ায় কিছু খুঁজছিল? ছুঁতে চাইছিল তাঁকে? ধূসর মলাটে ঘেরা ছবিতে তিনি কি অস্ফুটে কিছু বলে গেলেন? কী বললেন? কেন? এমনকি তাঁকে হারিয়েও সেসময় এমনটা হয়নি। তিনি চলে যাওয়ার পর প্রায় পাঁচ বছর ছিল ওখানেই। সম্পূর্ণ একা। বসবাস করে, তার অনুভব জড়িয়ে কতবার নিজের অজান্তেই তাঁর গন্ধ পেতে চেয়েছে। একবারের জন্যও তিনি আসেননি। তাহলে? শরীরটাও একেবারেই সুস্থ ছিল না কাল। দোকান থেকে আনা ছোলা-বটোরার কিছুমাত্র দাঁতে কাটতে পারেনি। গভীর রাতে জ্বর এসেছিল কাঁপুনি দিয়ে। তারপরই…

(২)

নীল চাদরে ঢাকা আকাশটায় হলুদ-সোনালি রং ছড়িয়ে পড়ছিল একটু একটু করে। ছিমছাম শহরটা মনে হয় ওর নিজেরই মতো। নিঃসঙ্গ, একা। হঠাৎ কেন জানে না ভিজে উঠছিল চোখের কোল। একটানা বটল-ব্রাশ গাছে বসে চেরা গলায় ডেকে চলেছে ধূসর-বাদামি গায়ের ইন্ডিয়ান হর্নবিল। ও কি কাঁদছে? দূরে, আরও বেশ কিছুটা দূরে সারসার অনেকটা হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুর মতো তিনকোনা মাথার পাহাড়গুলো আগলে রেখেছে ঢালু বাঁকের শহরটাকে। সৌরীশ বাঁহাতের আঙুল দিয়ে মাথার চুলগুলোকে কিছুটা পিছনের দিকে ঠেলে দিতে আচমকাই একটা গন্ধ আঁকড়ে ধরে চারপাশটা। চাপ চাপ মিষ্টি গন্ধে ভরে ওঠে গোটা ছাদ। কোথায়? কোথায় যেন আগেও পেয়েছে গন্ধটা! খুব চেনা, খুব পরিচিত। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না। কোথা থেকে আসছে গন্ধটা? কেউ কি এসেছে? ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের চারদিকে তাকাতে গিয়েই চোখ আটকে যায় ছাদের কোণে। সমস্ত শরীরের মধ্যে রি রি করে। অস্ফুটে আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে সৌরীশ। পিছিয়ে আসে হাত চারেক। তবুও ওর চোখের সামনে থেকে একচুলও নড়ে না প্রাণীটা। দেওয়াল বেয়ে লোমশ কালো গাটা ঘষটে বুকে হেঁটে এগিয়ে আসতে থাকে ওর দিকে। ক্রমশ দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় সৌরীশের। কিছুতেই কোনওভাবেই চোখ চেয়ে থাকতে পারে না। বিকৃত মুখে জড়োসড়ো হয়ে কুঁকড়ে গুটিয়ে ফেলে শরীরটাকে। আর তখনই জোরালো মিষ্টি উগ্র গন্ধটা জড়িয়ে জাপটে ধরে সৌরীশের নাকমুখ। দম বন্ধ হয়ে আসে ওর। সঙ্গে সঙ্গে গুরু মস্তিষ্কে সজাগ হয়ে ওঠে একটাই স্মৃতি। এই গন্ধের উৎস তার পরিচিত, পরিচিত সেই কোন বাল্যকাল থেকেই। হিলহিলে এক নিঃশ্বাস সৌরীশকে মনে করিয়ে দেয় কারুর অজানা অস্তিত্ব। ছাদের সিমেন্টে আটকে থাকা পায়ের পাতাকে একচুলও নড়াতে পারে না। ঘিনঘিনে প্রাণীটা ওর শরীর বেয়ে উঠতে শুরু করেছে। পা, কোমর, বুক—তারপর আরও উপরে। আঁকড়ে আঁকড়ে, ঘষটে ঘষটে, বুকে হেঁটে হেঁটে। প্রয়োজনের এতটুকু অক্সিজেন অবশিষ্ট নেই আর। নিকষ কালো অন্ধকার নেমে আসে দেখতে দেখতে। চোখ বন্ধ হয়ে যায়। তারপর আর কিছুই মনে নেই ওর।

অদ্ভুত অভিজ্ঞতা

পাঁচটা মাস হয়েছে সবে। এখন চোখ-কান বুজে কাজ করার, টিকে থাকার লড়াই। তবে লড়াইটা যে খুব একটা সহজ হবে না তা বেশ জানত সৌরীশ রায়। ভবানীপুরের জগুবাজার সংলগ্ন কোনও এক রায়বাড়ির একমাত্র বংশধর। পরিবারের দাপট, অস্তিত্ব একবারে মাটির সঙ্গে মিশলেও রক্তে যেন এখনও কিছুটা আভিজাত্যের ছোঁয়া রয়েই গেছে। ছোট্টবেলায় সেই কোন তিনবছর বয়সে মাকে হারানোর পর বাবা এককালীন সম্পত্তি আর বড়বাজারের কাপড়ের দোকান সামলেছেন বটে, কিন্তু ছেলেকে করে রেখেছিলেন চোখের মণি। শেষমেশ ধাক্কাটা কালবৈশাখী ঝড়ের মতো আছড়ে পরেছিল সৌরীশের মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রথমদিনেই। হারিয়েছিল বাবা সৌরাংশু রায়কেও। বিপর্যস্ত দিনগুলোতে বাধা হয়ে উঠছিল নানান পারিবারিক, অর্থনৈতিক অবস্থা। কিন্তু সময় কি থেমে থাকে? অপরিসীম মানসিক যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন ঠাম্মুম। প্রতিদিনের সূর্যকে নতুন করে চিনতে শিখিয়েছেন তিনি। সৌরীশকে বুঝিয়েছেন এখনও কতটা পথ বাকি!

“কী রে, এখনও ঘুমাসনি? জ্বর কমেনি?” বাঙালি বন্ধু মলিনের প্রশ্নে পিছন ফিরে তাকায় সৌরীশ।

“না না, এখন অনেকটাই ভালো আছি। সেই…”

“সেই কী? নতুন জায়গা তাই বোর লাগছে?”

“সেরকম কিছুই নয়।”

“আরে, প্রথম প্রথম আমারও এমনই লেগেছিল। ক’দিন এখানে কাটা। তারপর দেখবি কলকাতাতেই ফিরতে ইচ্ছে করবে না! আমি তো প্রথমে দু’বছর পর কলকাতা গিয়েছিলাম। অবশ্য মা থাকতে না পেরে মাঝে মাঝে ছেলেকে সঙ্গ দিতে আসে।” হাসি হাসি মুখ করে কথাগুলো বলে যায় মলিন।

“তা বেশ তো! কাকিমা এলে এবার ওঁর হাতে জমিয়ে ফুলকো লুচি খাওয়া যাবে। কী বলিস?”

“একদম। তোকে খাইয়ে মজা পাবে বৈকি মা। তবে এই লুচি জিনিসটা আমার মতো হতচ্ছাড়া বাঙালির অপছন্দ। তাই মা বেজায় চটে যায়।”

“বলিস কী! আমার তো মুখে ছাতা পড়ে গেল এই ক’মাসেই। কী যা-তা খাবারদাবার এখানে!”

“হুম। উত্তরের এদিকটায় তেমন সুখাদ্য পাওয়া যায় না। তবে ঘণ্টাঘরের ঐদিকটায় একটা ভালো বিরিয়ানি দোকানের সন্ধান পেয়েছে রোহিত সেদিন বলছিল।”

“বিরিয়ানি? দেরাদুনে?”

“হুম, একবার যেতে হবে। কতদিন আর রুটি, পুরি, সবজি খাওয়া যায়? আর ভাত হলে কারি চাউল। এক তরকারি দিয়ে মানুষ যে কীভাবে ভাত খায় আমার তো মাথায় ঢোকে না। তাও তরকারি নয়, ডাল। স্রেফ বিউলির ডাল।”

“তুই তো অনেকদিন আগে এসেছিস এখানে। তখন থেকেই কি জায়গাটা এমন ফাঁকা ফাঁকা চুপচাপ?” আচমকা কথার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে ওঠে সৌরীশ।

“কেন, তোর ভয় করছে বুঝি?” হো হো করে হেসে ওঠে মলিন।

“কেন, তোর করে না?”

“এখন তো তাও আমাদের আইটি পার্কে কিছু কিছু অফিস জমি কিনে বিল্ডিং বানাচ্ছে। আমি যখন এসেছিলাম তখন আমাদের অফিস আর সরকারি ওই দপ্তরটা। যেখানে আধার কার্ড, আরও কী কী হয়, ওটা ছাড়া ধূ ধূ মাঠ! থুড়ি জঙ্গল। তার উপর আবার আমাদের নাইট শিফট হত। মানে রুমে ফিরতে হত রাত বারোটার অনেক পরে। তারপর…”

“তারপর, তারপর?” অসম্ভব কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করে সৌরীশ।

“তারপর আর কী? তেরাগাঁও-এর যা তেরা কাহানি শুনেছি! তা কি সহজে ভোলা যায়? আপাতত আমার চোখে নিদ্রাদেবী জাঁকিয়ে বসছে। বন্ধু, শুভরাত্রি!” কথা থামিয়ে টানটান পা মেলে চাদরে মুখ ঢেকে শুয়ে পড়ল মলিন।

কিন্তু সৌরীশের ঘুম কি এত সহজে আসবে? বার তিনেক চোখ রগড়ে জানালার ওপারে অন্ধকারের দিকে তাকাল। এমন পরিবেশে নিজের ছায়াকেও ভয়, ভীতি লাগে। তেমনটা তো স্বাভাবিক! কিন্তু কেন জানে না সেদিনের সেই স্বপ্নটা কিছুতেই মুছে ফেলতে পারছে না মন থেকে। দুর্বল শরীর, জ্বর সেরে এখন সৌরীশ রীতিমতো সুস্থ। তাও কেন? আরও একটা জিনিস অদ্ভুতভাবে খেয়াল করেছে ও। অদ্ভুতভাবে ওই অস্পষ্ট অবয়বটা দেখার কিছুটা সময় যেতে না যেতেই শরীরটা বেশ ঝরঝরে হালকা হয়ে গেছিল। রাতের একশো দুই ডিগ্রি জ্বর সকালে একেবারেই উবে গেছিল! শরীরে কোনোরকম অসুস্থতা বোধ হয়নি আর। সবকিছু এতই গোলমেলে লাগছিল সৌরীশের। মনে হচ্ছিল সমস্তটাই এই শহরের রহস্য! রহস্য ওই চোখ যাওয়া সীমারেখার বিপরীতে ঠিক যেখানে তপোবনের গভীর জঙ্গল শুরু হয়েছে সেখানের। রহস্য এই আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু পথের ইশারার। রহস্য এই পাথুরে মাটিতে চাপা থাকা চুপকথার! দিন কি রাত, পাহাড় ঘেরা দেরাদুন যেন কোনও এক বোবা অজানাকে আড়াল করে চলেছে। অস্বাভাবিক রকমের নিস্তব্ধতা হাঁফ ধরিয়ে দিয়েছে সামান্য কয়েক মাসেই। একবুক নিঃশ্বাস বন্দী করে এসবই একমনে ভেবে যাচ্ছিল সৌরীশ। খোলা রাতের জানালার মধ্যে দিয়ে থেমে থেমে পাতলা হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছিল ওর কপাল। এপ্রিলের শেষ। এ শহরে ঠাণ্ডার রেশ বছরের বেশিরভাগ থাকলেও, সূর্যের দাপটও নেহাত কম নয়। সকাল পেরিয়ে দুপুর হতে না হতে তেজি রোদ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় সবুজের ঘর। দিনের গরম ভাব সইতে সইতে দেবদারু, ওক, পাইনের গাছগুলো রাতের অন্ধকারে অনেকটা মৃত দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। খানিক ঘুরে বেড়ানো পাতলা সেই হাওয়া ঝিরঝির শব্দে পাতাদের গোপন কথা শুনে যাচ্ছে হয়তো।

আবার অস্বস্তি লাগছে সৌরীশের। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করে একটা ভয় কয়েদ হচ্ছে। বুড়ো আঙুলের মাথায় নখের আকারের চাঁদটা মায়াবী সরলরেখা টেনে রেখেছে মানব, অমানবের সীমারেখায়। আচমকাই খুব সরু সুরে কীসের যেন কান্না রাতের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে সৌরীশের কানে এসে পৌঁছল। কান্না? হ্যাঁ, কান্নাই তো! শব্দটা ঠিক কোথা থেকে আসছে ঠাওর করতে পারল না। চারপাশটা এতই ফাঁকা আর গাছগাছালিতে ভরা তাতে নির্দিষ্ট জায়গা, শব্দের উৎস নির্ণয় করা বেশ কঠিন। ও আরও কিছুটা সজাগ হয়ে বোঝবার চেষ্টা করল। কান্নাটা বড়ো অদ্ভুত লাগল। শব্দটা কোনও প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ কিংবা মহিলার বলে মনে হল না। তাহলে হয়তো রাতে কোনও দুঃস্বপ্ন দেখে কোনও শিশু কেঁদে উঠেছে। হতেও তো পারে।

খামোখা বিচলিত হয়ে পড়ছে সৌরীশ। একবার ফিরে গিয়ে বিছানার উপর বসে সে। কিন্তু কিছুতেই নিজের এই বিচলিত হওয়াকে আটকাতে পারে না। খানিকক্ষণ সব চুপচাপ। কোনও দিক থেকে কোনও শব্দই কানে আসছে না। শুধু গুপ গুপ করে ছাদের কার্নিশে নিশাচর পেঁচার ডানার ঝটপট শুনতে পাচ্ছে। কিছুটা হেলে বালিশে মাথা দিতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তেই মনে হল আর্ত চিৎকার করে অসম্ভব যন্ত্রণায় কেঁদে উঠল কোনও সদ্যোজাত শিশু। ঠিকই তো। এরকম থেমে থেমে কঁকিয়ে দম নিয়ে কান্না তো সদ্য জন্মানো শিশুদেরই হয়। তাহলে কোনও শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ল? এই সমস্ত পাহাড়ি এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা, আর বিদ্যুৎ যে তথৈবচ তা বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। ব্যাপারটা তো দেখা দরকার। এত রাতে কেউ অসুস্থ হলে হাসপাতালে নিয়ে যাবে কীভাবে? মলিনকে কি একবার ডাকবে? যদি ওরা দু’জনে কোনওভাবে কোনও পরিবারের কাজে আসতে পারে, তাইই বা কম কী?

নাহ্‌, আর বসে থাকা যায় না। উঠে দাঁড়ায় সৌরীশ। কান্নাটা এখনও হয়ে চলেছে। আরেকটা বিষয় ভীষণভাবে খটকা লাগছে ওর। কী এমন হয়েছে যার জন্য শিশুটির মা বা বাবা কেউ ভোলাতে পারছে না? নিজে একটু বেরিয়ে দেখতেই তো পারে! জানালার কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও শব্দটার ঠিক হদিশ না পেয়ে দরজা খুলে সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা নেমে যায় সৌরীশ। এ-বাড়ির একতলাতেও ওদেরই মতো আরও চারজন ছেলে থাকে। সিদ্ধার্থ ল কলেজে পড়ে। ওরা শুনতে পেয়েছে কান্নাটা?

সিঁড়ির লাইটটা জ্বালিয়ে কয়েক ধাপ নামতেই কী যেন মনে হতে থমকে দাঁড়ায় সৌরীশ। সন্দেহে চোখদুটো ছোটো হয়ে ওঠে ওর। ওদের ভাড়া বাড়ির একবারে পিছনের দিকটায়। সরাসরি চোখ গিয়ে আটকায় পেয়ারা গাছের গুঁড়ির কাছাকাছি। ঠিক ওখানেই একটা টালির চালের ঘর। চোখদুটো কুঁচকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করে। একটুও ভুল হচ্ছে না। হ্যাঁ, কান্নার শব্দটা ওখান থেকেই আসছে। কিন্তু এ কী? ওটা কী? অদ্ভুত একটা নীল আলো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে ওই টালির ঘরের কোনও অংশ থেকে। কীসের আলো ওটা? টিউব বা ইলেক্ট্রিকের আলো ওভাবে অত জোরে কীভাবে আসবে? কোনওভাবেই সম্ভব নয়! আলো, আলোর সঙ্গে জোরালো নীলের তীব্রতা যেন উত্তরোত্তর বাড়ছে একটু একটু করে। সৌরীশের চোখের সামনেটা একটু যেন কেঁপে উঠল। শুধু চোখের সামনে নয়, পায়ের তলাটাও কেঁপে উঠছে। কাঁপছে সমস্ত শরীরটা। একটানা সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে রয়েছে ও। দেখছে, দেখেই চলেছে। আলোর তীব্রতার সঙ্গে সঙ্গে কেউ যেন জোর করে কোনও অদৃশ্য শক্তির মতো দেখতে বাধ্য করছে ওকে। গভীর গাছের মধ্যে দিয়ে তীব্র আলোটা ঘুরপাক খাচ্ছে। বড়ো হচ্ছে। তীব্রতা বাড়ছে কান্নারও। কোনাচে হয়ে আছড়ে পড়া সেই জ্বালাময় আলোয় কিছু ছায়া দৃশ্যমান হচ্ছে। দুলে দুলে, কেঁপে কেঁপে। বিরাট এক মুখ-গহ্বরের ভিতর থেকে ভেসে আসছে সেই মানবশিশুর কান্না। রাতের কান্নারা!

অদ্ভুতের সন্ধানে

এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন এর আগে কোনওদিন হয়নি সৌরীশ। মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছে, চাকরিটা নিয়ে কি ভুল করে ফেলল ও? তবে তার সঙ্গে এটাও মনে হচ্ছে, একবার যদি মাল্টিমিডিয়ার কাজটায় হাত পাকিয়ে নিতে পারে তাহলে কলকাতার বাড়িতে তো ফিরে যাওয়াই যায়। ওখানেই নাহয় অফিস খুঁজে নেওয়া যাবে! এখানে আসার পর থেকে একটার পর একটা ঘটনা। ঠাম্মুমের বলা ঈশপের গল্প, ঠাকুমার ঝুলি, আরব্য রজনী, পুরাণের গল্পের চরিত্রেরা কি ঘুরপাক খাচ্ছে ওর মাথায়? আর তাতেই কি এসব দেখছে? মলিন সেদিন বলছিল এই তেরাগাঁও এলাকাটায় কীসব হয়েছিল, আর আজও সবাই সেসব মেনে চলে! সেসব শুনেই কি মাথার মধ্যে অদ্ভুতুড়ে সব তাল পাকাচ্ছে? নিজের অনুভূতি চট করে প্রাণ খুলে সবাইকে সবটা বলার সাহসও পাচ্ছে না। তবে সৌরীশ ঠিক করে, যে করে হোক, মনের সন্দেহটা কাটিয়ে উঠতেই হবে।

দেরাদুনে সন্ধে নামতে নামতে ঘড়ির কাঁটা সাতটা ছাড়িয়ে যায়। অফিস ছুটি হয় ছ’টা নাগাদ। কম করে এক-দেড় ঘন্টা হাতে পাওয়াই যায়। ঘুরে দেখতে হবে চারপাশটা। ওদের অফিস-সংলগ্ন জায়গাটাকে আইটি পার্ক বলে জানলেও, বেশ কয়েক বছর আগে সবাই এর পরিচয় জানত তেরাগাঁও বলেই। এই তেরাগাঁও থেকে সহস্রধারা বেশ কাছে। তবে পাথুরে ঝরনার থেকে জঙ্গল বেশি টানে ওকে। ছোটোবেলায় বাবার সঙ্গে সুন্দরবনে গিয়েছিল ভুটভুটি চেপে, মনে আছে। বিলি কেটে কেটে জল চিরে এগিয়ে যেতে যেতে সুন্দরীর সৌন্দর্যে শিহরণ জাগে এখনও। তাই আবারও জঙ্গল দেখার ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখা যায় না একেবারেই। তবে সবথেকে আগে জানতে হবে, কী আছে ওই ঝুপড়ি ঘরটায়। সকালবেলা অনেকবার ছাদ থেকে দেখে বোঝার চেষ্টা করেছে। ইটের পর ইট গেঁথে কোনোরকমে দাঁড় করানো হয়েছে টালির চাল। টিনের দরজায় বাঁকানো লোহার আঁকশি লাগনো। এতবার চোখ গেছে, অথচ একবারের জন্যও কোনও মানুষকে ঢুকতে বা বেরোতে দেখেনি সৌরীশ। কোনও জামাকাপড়ও বাইরে শুকোতে দেওয়া নেই যাতে করে বোঝা যেতে পারে ওখানে কোনও শিশু বা তার পরিবার থাকতে পারে। দু’পাশের গাছগুলো নুইয়ে টালির চালের উপর পড়ে জায়গাটাকে আরও পরিত্যক্ত করে তুলেছে।

মলিনকে বলতে ও কিছুক্ষণ থম মেরে গিয়ে অন্য কথায় চলে গিয়েছিল। সৌরীশ বুঝতে পেরেছিল, ও এড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন? বাড়িটার ঠিক পিছনেই অনন্ত গহিন তপোবন। আর বন-জঙ্গলের কোনও সীমারেখা টানা সম্ভব নয়, সবাই তা জানে। কোথায় যে এর শেষ আর কোথায় যে শুরু তা কেউ জানে না। অনেকে বলে, এই তপোবন নাকি ঋষিকেশের রাজাজী ন্যাশনাল পার্ক ছাড়িয়ে আরও বহুদূর এগিয়েছে। অসংরক্ষিত এ জঙ্গলে বুনো হাতি থেকে ‘তেন্দুয়া’ (লেপার্ড, স্থানীয় নাম তেন্দুয়া) এমনকি আরও নানা হিংস্র জন্তু আছে। সুতরাং, বাড়ি থেকে কেউ যদি বেরোতে চায় তাহলে সোজাসুজি লোকালয়ের মধ্যেই আসতে হবে। নাহলে… কিন্তু এভাবে কোনও মানুষ থাকতে পারে? বাড়ির লোক জায়গাটাকে এভাবে অপরিচ্ছন্ন রেখেছে কেন? বিচিত্র প্রশ্নগুলো কিলবিল করতে থাকে মাথার মধ্যে।

আইটি পার্ক ছাড়িয়ে সোজা বাড়ির পথে না গিয়ে দীনদয়াল নৌটিয়াল গোয়ালার বাড়ির সামনে দিয়ে যে পথটা জঙ্গলে মিশেছে সে পথে পা বাড়ায় সৌরীশ। পিঠের ব্যাগটাকে কাঁধের দু’পাশে দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে পাইনের ঠিকানায় ঢুকে পড়ে। ঘাড় উঁচু করে দেখে জঙ্গলের সবুজ। এখানে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ লোকালয়ের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে। বোঁ বোঁ আওয়াজ করে কিছু একটা যেন দূর থেকে ভেসে আসছে কানে। কাছাকাছি কোনও মৌচাক আছে নাকি? সৌরীশ ভেবে রেখেছে, খুব বেশি দূর না গেলেও জঙ্গলের ভিতর সোজা ঢুকে যে পথটা ওর বাড়ির পিছন দিকটায় ঠিক ওই বাড়িটার কাছে পৌঁছয় সেখানে গিয়ে উঠবে। আজ তাপমাত্রা প্রায় চল্লিশ ডিগ্রির কাছাকাছি ছিল। অফিসের এসি থেকে বেরিয়ে আর গরমের সঙ্গে সঙ্গে খাড়াই পথে চলতে চলতে হাঁফ ধরে যাচ্ছে ওর। এদিকটায় লোকজনের যাতায়াত হয়তো আছে, তাই সামান্য হলেও পাতায় পায়ের চাপের দাগ আর দুয়েকটা চিপসের প্যাকেটের অংশ বিশেষ চোখে পড়ছে। বোঁ বোঁ শব্দটা সৌরীশের চলার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়েই চলেছে। মনে হচ্ছে, পাশাপাশি হাঁটছে আওয়াজটা! মাথাটা উপরের দিকে তুলতেই কতগুলো বেশ বড়ো আকারের মাছিকে ঘুরতে দেখল ওর মাথা ঘিরে। আর ঠিক সেখান থেকেই একনাগাড়ে আওয়াজটা হয়ে চলেছে। সাংঘাতিক! কামড়াবে নাকি! এগুলো তো মৌমাছি নয়! তবে ভীষণ ক্ষিপ্রতায় এদের পাখনার আওয়াজ অনেকটা মৌমাছির গুনগুনের মতো শোনাচ্ছিল। কত কী যে আছে পাতার আড়ালে! বিজ্ঞানও হয়তো জানে না।

আরও কিছুটা ঢুকতেই একটু একটু করে ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করল সৌরীশের। গায়ে গায়ে লেগে থাকা পাতার আড়াল মরা রোদের আলোটুকুও ঢেকে দিচ্ছে। একটু পরেই কালো অন্ধকারে ঢেকে যাবে পথ। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে এগোতেই পথের বাঁক নজরে পড়ল ওর। ওটা পেরোলেই নিশ্চয়ই বাড়িটা। ঝিম ধরা ঠাণ্ডাতেও বুকের বাঁদিকটা অস্বাভাবিক রকমের গরম ঠেকছে সৌরীশের। পায়ের নিচে পিষে ফেলা পাতাদের খসখস শব্দটা থেকেই বোঝা যাচ্ছে সৌরীশ কতটা দ্রুততায় এগিয়ে চলেছে।

এদিকটা যেন আরও নিঝুম। আরও নিস্তব্ধ। একটা পাখির ডাকও শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না। এই সময়টা তো ওদের ঘরে ফেরারই সময়। কীসের ভয়ে সবাই যেন ভীত, আতঙ্কিত। হাত দশেক দূর থেকেই ভাঙা ইটের শেওলা ধরা দেওয়ালটা নজরে পড়ল ওর। এই তো ঠিক পথেই এসেছে। দেখতেই হবে বাড়িটায় ঠিক কী হয়। কারা থাকে? কেউ যদি ওকে দেখেও ফেলে, বলবে টুরিস্ট তাই ঘুরতে বেরিয়েছে। নিশ্চয়ই তখন বিশ্বাস করবে।

উত্তেজনায় পায়ের শব্দ আরও দ্বিগুণ হয়ে গেছিল যেন ওর! কিন্তু ভাঙা বাড়িটার কাছে যেতেই কেমন যেন গন্ধ এসে ঠেকল নাকে। গাছ বা পচা পাতার গন্ধ? নাহ্‌, সেরকম শেওলা ধরা গন্ধ তো নয়! তবে কি কোনও ফুলের… আর সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের মতো চমক খেলে গেল মাথায়। তাই তো! এটা তো সেই গন্ধ! যেটা সেদিন ছাদে… এমনকি রাতেও ঘুমের মধ্যে পেয়েছিল! তাহলে কি দিনের আলো কমে এলেই কোনও ফুলের মিষ্টি গন্ধ হাওয়ায় ভেসে উড়ে বেড়ায়? কিন্তু তাই যদি হবে, তাহলে… গন্ধটা তো বাড়িটার ভিতর থেকেই আসছে বলে মনে হচ্ছে। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সৌরীশ। বাড়ির টিনের দরজা ছাড়া আর একটাও জানালা নেই। আলোটা কি দরজা থেকে বেরোচ্ছিল? আরেকবার কি ঘুরে দেখবে বাড়িটা? মোবাইলের স্ক্রিনটা টিপে দেখল, ছ’টা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। ঝাপসা আলোর রেখা কমে গেছে। মনস্থির করেই নিয়েছে। দরজাটা ঠেলে নাহয় একবার দেখবে। উগ্র গন্ধটা আরও প্রকট হয়ে উঠছে।

এগিয়ে যাচ্ছে সৌরীশ দরজার দিকে। কেমন যেন ঘোর লেগে যায় গন্ধটা শরীরে প্রবেশ করলে। আর তারপরই সম্মোহিতের মতো হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। ঝোপঝাড় মাড়িয়ে বেমালুম এসে দাঁড়ায় টিনের দরজার মুখোমুখি। দরজায় টোকা দেবে কি দেবে না ভেবে না দেখেই আলতো চাপ দেয় টিনের উপর। কিন্তু না। দরজাটা খুলতে পারে না সৌরীশ। ভিতর থেকে বন্ধ। তাহলে ভিতরে নিশ্চয়ই কেউ আছে। সে ভিতর থেকে দরজাটাকে বন্ধ করে রেখেছে। কী করবে এবার? নাম ধরে ডাকবে? কী বলে ডাকবে? সাতপাঁচ ভেবে ডানহাতের আঙুল দিয়ে টোকা মারল ও। বার তিনেক। কেউ তো সাড়া দিচ্ছে না! কোনও মুমূর্ষু মানুষ নেই তো ঘরের মধ্যে!

আরেকটা জিনিস লক্ষ করল সৌরীশ। তিনবার দরজায় টোকা দেওয়ার পর একফালি অন্ধকার খানিক দেখা গেল। অর্থাৎ দরজা একটু হলেও ফাঁক হয়েছে। মাথা ঘুরিয়ে পিছনের দিকে আরেকবার দেখে নিয়ে সৌরীশ চোখ রাখল ঘরের ভিতরের অন্ধকারে। খুব সামান্য দেখতে পাচ্ছে। হালকা একটা আলো জ্বলছে। সেদিনের মতোই লাগছে আলোর রংটা নীলচে। তবে অতটা জোরালো নয়। কিন্তু কোনও মানুষকে তো দেখতে পাচ্ছে না! চোখ বুজে একবার ভালো করে দেখার চেষ্টা করতেই আলো বরাবর দেওয়ালের কিছুটা চোখে পড়ল। আর তাতেই অবশ হয়ে উঠল শরীরের সচেতন, সজাগ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। কী করে সম্ভব? ঠিক এমনি একটা ফ্রেম তো ওদেরই ঘরে দেখেছে! সেই লাল-সাদা ফ্রক পরা মেয়ে হাতিকে স্নান করাচ্ছে হাতি-মা। সাদা কাপড়ের উপর নিখুঁত সুতোর অপূর্ব কাজ! এটা এখানে এল কী করে? কী হচ্ছে এসব? গলার স্বর জড়িয়ে আসছিল ওর। কিন্তু ঘরের ভিতরের ব্যক্তিটিকে না ডেকে আর কোনও উপায় তো খুঁজে পাচ্ছে না। গন্ধটা যেন মেখে রয়েছে শেওলা ধরা ইটের ফাঁকফোকরে। ডাকবে বলে ঠিক আরেকবার আঘাত করতে যেতেই…

“ক্যায়া হুয়া বাবুজি? আপ…”

আচমকা প্রশ্নে চমকে ওঠে সৌরীশ। একেবারে গা ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়েছে একজন বছর পঞ্চাশের লোক। পোশাক দেখলে পাহাড়ি স্থানীয় মানুষ বলেই বোধ হচ্ছে। কিন্তু এমনভাবে বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে লোকটা, থতমত খেয়ে গেছিল ও। আমতা আমতা করে বুজে আসা গলায় কোনোমতে জোর এনে বলে, “ইয়ে ঘর কিসকে…”

কথাটা শেষ হতে না হতেই লোকটা রুক্ষ গলায় বলে ওঠে, “আপকো দেখকে তো পতা চলতা হ্যায় আপ শহর সে আয়ে। অন্ধেরে মে ইধর রহনা ঠিক নহি হ্যায়।”

লোকটা তার মানে তার এই কৌতূহল পছন্দ করছে না। কিন্তু ওই ফ্রেমটা যে ওর বাড়িরই! ওটা কীভাবে… কিন্তু লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলতে গিয়েও মুখের ভিতরের লালা পর্যন্ত শুকিয়ে এল। কী ভীষণরকমের লাল, আর ক্রুর! এমন মনে হচ্ছে, যেন ওর গোপন কোনও কথা জেনে ফেলেছে সৌরীশ। এখন লোকটার সঙ্গে কথা বা তর্ক করা ঠিক উচিত হবে না বলে মনে করল ও। বাড়ি ফিরে ছুটির দিন দেখে আবার একবার… শুধু একবার কেন! যতক্ষণ না গোটা বিষয়টা জলের মতো স্বচ্ছ হচ্ছে, ওকে আসতেই হবে।

বাড়িটার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে পিছিয়ে এসে দাঁড়াল সৌরীশ। আকাশটা এক ঝাঁপি কালি ঢেলে দিয়েছে ইতিমধ্যেই। মোবাইলের টর্চ অপশনটায় আলো জ্বালালেও নিখাদ অন্ধকারে তা আর কতটুকুই বা! তবুও এর মধ্যেই তেমনি অস্বস্তিকরভাবে জেগে রয়েছে লোকটার চাউনি। তেমনই কঠোরভাবে দেখে চলেছে সৌরীশকে। কী রে বাবা! তাহলে কি এটা লোকটারই বাড়ি? কিন্তু পনেরো-কুড়ি মিনিটমতো সময় এখানে থাকল, কোনও মানুষ তো বেরিয়ে এল না ঘর থেকে! সে কি ওদের গলার আওয়াজ পায়নি? বড্ড গোলমেলে। তবে ধন্দটা নির্মূল হয় না কোনোভাবেই। উলটো পথে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগায় সৌরীশ। আশ্চর্য! সেই কোথায় কলকাতা, আর কোথায় উত্তরাখণ্ডের দেরাদুন! ঠাম্মুমের সেলাই করা ফ্রেমটা এখানে এল কীভাবে? কী করে সম্ভব? ও কি পাগল হয়ে গেল? চোখের ভুল নয়, স্পষ্ট দেখেছে! একেবারেই এক! ঠাম্মুম, ওর বাবা-মা চলে যাবার পর সারাদিন সেলাই নিয়েই থাকতেন। ও বুঝত, এগুলো শুধু ওদের ভুলে থাকার জন্যই নয়! সেসময় ওর ভরণপোষণের জন্য দরকারও হয়েছিল। সৌরীশের বাবা সৌরাংশুবাবু অকালে চলে যাওয়ার পর বড়বাজারের দোকানও ডুবে যায় কর্মচারীদের গরমিলে। ধারের বোঝা পাহাড় প্রমাণ হওয়ায় এক পরিচিত মাড়োয়ারি ভদ্রলোকের কাছে বিক্রি করে দিতে হয় দোকান। আর তারপরই একটু একটু করে শুরু হয় ঠাম্মুমের লড়াই। দিনরাত ঘাড় গুঁজে হরেকরকমের উল কাঁটা, কখনও সূচের কাজ, কখনও আবার পা মেশিনে এমব্রয়ডারিও করে ফেলতে পারত মানুষটা। এপাড়া ওপাড়া থেকে কাজের অর্ডার নিয়ে কিছু উৎসাহী ছাত্রীও হয়েছিল তাঁর। সৌরীশের বেশ মনে আছে, ওদের মধ্যেই একটি দিদি খুব ভালোবাসত ওদের। ঠাম্মুমের হাতের কাজগুলো যত্ন করে রেখে দিতে বলত। একদিন ওই দিদিটাই ঠিক এরকমই একটা কাজ বাঁধিয়ে দিয়েছিল ঠাম্মুমের জন্য। বেশ মনে আছে, ঠাম্মুম সেদিন খুব খুশি হয়েছিল। ঠিক ঠাম্মুমের সেলাই মেশিনের সামনে দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখতেন। এমনকি দেরাদুন আসবার সময়ও সৌরীশ যখন ঠাম্মুমের ঘরে ঢুকেছিল, স্মৃতিভরা আসবাবের সঙ্গে সঙ্গে চোখ পড়ে গেছিল সেই ফ্রেমটাতেও। কিন্তু… আচ্ছা, একই নকশা তো অনেকেই করতে পারে! সৌরীশ দেখত, ঠাম্মুম যখন নিজে সেলাই করতেন বা কাউকে কিছু শেখাতেন, খোপ কাটা কাটা রঙিন একধরনের মজার বই খুলে বসতেন। কীসব হিসাব করে গুনে সেইসব দাগ মেনেই একেকটা নকশা রূপ পেত। এরকমই কোনও বই থেকে কি এই বাড়িটার কেউ সেলাই করেছে? এই ভাঙাচোরা বাড়িতে কে থাকে তাহলে? নাকি ঠাম্মুম! ইস, কী যে সব ভাবছে! আর ওই মিষ্টি উগ্র গন্ধটা? ওটাও তো কোল ঘেঁষে ঘুমানোর সময় কতবার পেয়েছে! ঠিকই তো! এই ফুলেল গন্ধটা নাকে আসার সঙ্গে সঙ্গে দু’চোখ জড়িয়ে আসত ঘুমে। কতবার জিজ্ঞেস করেছে। আদুরে গলায় ঠাম্মুম শুধু বলত, “ফুলেরা এসেছে আদরের ‘সৌ’কে ঘুম পাড়াতে।”

 মাতাল করা গন্ধটা কোনোদিন যেত না ওঁর গা থেকে। এমনকি সেদিন সকালেও যায়নি যখন ঠাম্মুম ওকে ছেড়ে চলে যান। প্রশ্নগুলোর উত্তর যে কোনোভাবেই খুঁজে পাচ্ছে না সৌরীশ! কী করবে, কাকে বলবে ও? পা জড়িয়ে আসছে, পথ যেন কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। কোনোরকমে ঘরে পৌঁছে মানি ব্যাগ খুলে ঠাম্মুমের হাসিমুখের ছবিটার উপর হাত বোলাতে থাকে ও।

অস্বস্তি আর ভয়াল রাতের কথা

দেরাদুনে সৌরীশের এগারো মাস বারো দিন হল। কিন্তু মনটা বড়োই ছটফট করছে। কী যে সব হচ্ছে ঘটনাগুলো! হাতড়াতে হাতড়াতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। আর ঠিক তখনই আসেন তিনি, সেই স্বপ্নমাখা অস্পষ্ট একটা ছবি! ঝাপসা অবয়বে ওকে যেন শান্ত হতে বলেন। চলার পথে নিশ্চিন্ত থাকতে বলেন কি? যেমনটা তিনি বলে গেছেন বরাবর অভিভাবকের মতো! ঘুমের মধ্যে দেখা অস্তিত্বকে যদি নিছক স্বপ্ন বলে মেনেও নেয়, বাকি ঘটনাগুলো? কী রহস্য লুকিয়ে আছে ওখানে?

দিন চারেক আগের কথা। মুদিখানার দোকান থেকে ম্যাগির প্যাকেট কিনতে গিয়ে দেখে রীতিমতো ব্যস্ততা দোকানির। জনা দশেক লোক সাইকেল ভ্যানে আটা, ডাল, চাল তুলছে। কোনও বিয়েবাড়ি নাকি! আগ্রহবশত জিজ্ঞেস করে ফেলেছিল ব্যাপারখানা কী! আধা বয়সী এক ভদ্রলোক অনেক চিন্তাভাবনার পর বলেছিলেন, “দেবী মা কি ভেট।”

আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও পারেনি সৌরীশ। কারণ, অচেনা একটা লোককে কথাগুলো বলায় খুব সহজভাব ফুটে ওঠেনি আধা বয়সী লোকটার মধ্যে। আগে শুনেছিল, পাহাড়ি মানুষেরা খুব উদার আর প্রাণখোলা হয়। কিন্তু এখানে এসে তেমনটা চোখে পড়েনি একেবারেই। তপোবনের মধ্যে দেখা হওয়া লোকটার চোখ তো এখনও মনে পড়ে সৌরীশের। কী ক্রুর, কী কঠিন! আর এখন এই লোকটা।

কাছাকাছি অনেকগুলো শিবদুর্গার মন্দির আছে। সেখানে অনেক সময় ভোগ রান্না হয়। খাওয়ানো হয় অনেকগুলো গ্রাম মিলিয়ে। এখানে থাকতে থাকতেই শুনেছে। কিন্তু তাতে তো আরও লোক ডাকা হয়! এভাবে এড়িয়ে যাওয়ার কী আছে বুঝল না। সৌরীশ আর কথা না বাড়িয়ে সরে গেছিল সেখান থেকে। বাড়ি ফিরে একেক করে মনে মনে খুঁটিয়ে ভেবে দেখছিল সবটা। মলিন বলছিল, তেরাগাঁওয়ের ইতিহাস বড়োই দুর্ভাগ্যের। চম্বাতে বাড়ি সুনীলের। ওই শুনিয়েছিল এখানকার মুখ ফিরে ঘোরাফেরা করা কিছু গল্প। সেসময় জনপদ, বাড়িঘর গড়েই ওঠেনি। বাঘ-শেয়াল পথ চলতে কখনও চোখে পড়ে যেত দিনের বেলাতেও। তবে জঙ্গল আগাছা পরিষ্কার করে কিছু মানুষের যেটুকু জমি ছিল, তাতেই এক-আধখানা ঘর করে থাকত কিছু গাড়োয়াল। দেরাদুনের সহস্রধারা সংলগ্ন পাশাপাশি তেরোটা গ্রামের মানুষের মধ্যে সদ্ভাব থাকায় একটি পঞ্চায়েতই গড়ে ওঠে। আর তেরোটা গ্রামকে একত্রে নাম দেওয়া হয় ‘তেরাগাঁও’। মাটি ফলনশীল। তাই টুকটাক চাষ করে চলে যেত মানুষগুলোর। তাছাড়া দেশি গরু তো ছিলই। সেটা অবশ্য ঠিক। সৌরীশের এখনও চোখে পড়েছে। বেশিরভাগ বাড়িতে এখনও গরু প্রতিপালন হয়। বেশ কয়েকবছর এভাবেই চলছিল। এখন যেখানে রাজপুর রোড, শপিং মল তৈরি হচ্ছে, ওদিকটাও নাকি তেরাগাঁওয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু আচমকাই কীসের অভিশাপে তেরাগাঁও শ্মশান হয়ে যায়। পরিবারগুলো কোনও অজানা কারণেই হারিয়ে ফেলছিল তাদের সদস্যদের। একেক মৃত্যু ডেকে আনছিল ভয়, আতঙ্ক। ঘর থেকে মানুষ পর্যন্ত বেরোনো বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ঠিক কীভাবে হয়েছিল তা বলতে চায় না কেউই। এমনকি সুনীলও এটুকুই বলেছিল। সেই অশুভের নাম করলেই নাকি কোনও না কোনওভাবে সে এসে উপস্থিত হয়। আজব কাণ্ড! তবে এখনও অনেকে বলেন, তেরো সংখ্যাটাই হয়তো সব খারাপের মূল। তাই বাড়ির ঠিকানায় আজও এরা এক আর তিন সংখ্যাদুটো পাশাপাশি রাখে না। রাখেনি বাড়ির ঠিকানায় তেরাগাঁওয়ের নামটাও। প্রতিটা বাড়ির মালিকের নাম দিয়ে তলায় সহস্রধারা রোড লেখা থাকে। ওভাবেই নাকি ওদের দলিল-দস্তাবেজও তৈরি হয়। সেরকম কোনও অসুবিধা হয় না। এতেই মানুষগুলো ভালো আছে। সত্যিই কি ভালো আছে?

গুম ধরা আকাশটায় একটুও নীল দেখা যাচ্ছে না। টিম লিডার না আসায় তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসেছে ও। মলিন রামানিয়া রেস্টুরেন্টে আড্ডায় মেতেছে। ছেলেটা খুব বকবক করে। তবে রুম পার্টনার আর অচেনা জায়গায় বাঙালি বন্ধু হিসাবে বেশ ভালো। ভেসে ভেসে শিরশিরে হাওয়ায় ভর করে এগিয়ে আসছে কালো মেঘের দল। বৃষ্টি নামবে? অল্প অল্প সোঁ সোঁ শব্দটা নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে পাতায় পাতায়। হেলেদুলে ভয়ে ভয়ে নিজেদের সতর্ক করে দিচ্ছে সবুজ গাছের পাতারাও। একটা ঘুঘু না পায়রা ধপ শব্দ করে ওর ঘরের ঘুলঘুলিতে এসে বসল গুটিসুটি মেরে। পাখিটার চঞ্চল মাথা আর ঠোঁটের এদিক ওদিক ঘোরানো দেখে মনে হচ্ছে, ও ভয় পেয়েছে। ঠকঠক করে ঠোঁট দিয়ে কাচে দু-চারবার ঠোক্করও দিল। ভিতরে ঢুকতে চাইছে কি? আর দেখতে দেখতেই অসম্ভব জোরে একটা হাওয়া শনশন শব্দ তুলে জানালা-দরজার উপর সপাটে আঘাত করতে শুরু করল। যেন দু’হাত বিস্তৃত করে কোনো জাদুকর তার কালো ফুঁয়ে তছনছ করে দিতে চাইছে মানুষের অস্তিত্বকে। দূরের কোনও গরু হয়তো ভীষণ আর্তনাদে হাম্বা স্বরে ডাক ছাড়ল। জানালা-দরজা ভালো করে বন্ধ করে দিলেও মনে হচ্ছে, এক্ষুনি যেন তা ভেঙে পড়বে। এ কি সত্যি ঝড়ের শব্দ? নাকি দরজার ওপারে নিশ্চিত কেউ আছে! মলিন আসেনি তো? শব্দটা এতই প্রবল, দু’হাতে কান চেপে ধরে দরজার কাছে এগিয়ে যায় সৌরীশ। দরজাটা অল্প ফাঁক করতেই সূচের মতো গায়ে এসে বেঁধে বৃষ্টির তীক্ষ্ণ ফোঁটা। একটা, দুটো, তিনটে—আরও অনেকগুলো। একের পর এক। কিছুতেই দরজার পাল্লাটা শক্ত হাতে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। ঝড়ের দাপট কিছুতেই কমছে না। বরং উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। সামান্য জায়গা পেয়ে দখল করে নিতে চাইছে সমগ্রটা। ফাঁক হওয়া দরজা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়েছে ঝড়, ঝড়ের সঙ্গে প্রাণহীন সবুজ গাছের পাতা। কুচকুচে কালো আকাশটা অন্ধকার করে দিয়েছে একহাত দূরও। কই, কেউ তো নেই! ঘরের সুইচ বোর্ডে হাত দিয়েও কোনও লাভ হল না। বিদ্যুৎ নেই। দিনের মধ্যে কতবার যায়! আর ঝড়বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। দরজাটাকে গায়ের জোরে ঠেলে বন্ধ করতে গিয়ে যথেষ্ট বলপ্রয়োগ করতে হল। টেবিলের উপর থেকে হাত ঘষে ঘষে দেশলাই আর ছোটো মোমবাতিটা জ্বালাল সৌরীশ। উন্মাদ হাওয়ার রেশ ঘরে ঢুকে যাওয়ায় মোমবাতির শিখাটা মিনিট তিনেক দপদপ করার পর স্থির হয়। ছোট্ট একটা আলোর বৃত্ত গোল হয়ে ঘিরে থাকে সৌরীশকে। দেওয়ালে নিজের ছায়াকেও অচেনা ঠেকছে। ঝড়ের তাণ্ডব ক্রমাগত আঘাত করে চলেছে চার দেওয়ালের মাঝে প্রবেশের জন্য। কালো পাতার মতো চারদিকটায় তাকাতে রীতিমতো ভয় লাগছে ওর। হাত-পায়ের আঙুলগুলো সিঁটিয়ে গেছে শিরশিরে আবহাওয়ায়। আজ আর কিছুতেই জানালার কাছে যাবে না ও। দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল, আসুক অন্তত একটা প্রাণের অস্তিত্ব আসুক এ ঘরে। এক মুহূর্ত থাকতে পারছে না প্রাণহীন এই কালো গুহায়। হাওয়ার শনশন সোঁ সোঁ শব্দগুলো জানোয়ারের মতো গর্জে চলেছে ঘরের দেওয়ালের ওপারে। ঠাস করে ঝোলানো ক্যালেন্ডারটা পরে গেল খসে। আর ঠিক তখনই সৌরীশের মনে হল, প্রচণ্ড চিৎকার করে কেউ ডাকছে ওর নাম ধরে। মলিন এসেছে নিশ্চয়ই। শরীরের সমস্ত সাহস জড়ো করে একহাতে মোমের আলো নিয়ে দরজার গোড়ায় যেতেই অদ্ভুত বিচিত্র এক দৃশ্য ঝাপসা হয়ে ঘিরে ধরল ওকে। ঘাড় ঘোরাতেই এক থলি বরফ-কুচি শরীরের সমস্ত রক্তপ্রবাহকে স্থগিত করে দিল। মাথার পিছনে ফনফনিয়ে উঠল অসংখ্য সুতোর মতো অজস্র জাল। আর সেই সুতোর আকারের জাল ধরে এগিয়ে আসছে ঠিক সেদিনের মতোই আটপেয়ে একটা প্রাণী! বহুদূর থেকে যেন ভেসে আসছে একটাই শব্দ—সৌরীশ, সৌরীশ, সৌরীশ!

কয়েক কোটি বছর আগে

(১)

মিত্র অনেকক্ষণ ধরে দেখছিল মেয়েটি পাহাড়ের পায়ের কাছে বসে কী যেন একমনে বানিয়ে চলেছিল। মেয়েটির একঢাল এলো চুল পিঠ বেয়ে নেমে গেছে কোমর অবধি। উচ্চতা ও শারীরিক গড়ন দেখে মনে হয় মিত্রর বয়সীই হবে। তাই বন্ধুত্ব করার ইচ্ছেটাও আরও কয়েক ধাপ বেড়ে যায়। দূর থেকে দেখতে দেখতে এতটা কাছে এসে গেছে, তাও মেয়েটা একবারের জন্যও মুখ তুলে তাকায়নি। আসলে ও খুব মন দিয়ে কিছু একটা করছে তা বুঝতে পেরেছে মিত্র। মিত্র প্রতিদিন আকাশে আলো ছড়িয়ে পড়ার আগে আসে। সারাদিনে নিজের প্রয়োজনীয় কাজ সেরে, ঘাম ঝরিয়ে তারপর সন্ধের সময় বাড়ি ফেরে। মেয়েটিকেও দেখে। কিন্তু কোনও কথা বলার আগেই মেয়েটা চোখের পলকে হারিয়ে যায়। ঠিক ম্যাজিকের মতো। খুব আশ্চর্য লাগে ওর। তাই ভেবেছে, আজ ওর সঙ্গে কথা বলবেই। নাম জিজ্ঞেস করবে। কী করে মেয়েটা? উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখবার চেষ্টা করতে করতে হঠাৎ করে চোখে পড়ে, মেয়েটির হাতের আড়ালে একটি হলুদ রঙের পুতুল। পুতুলটি সম্ভবত একটি মেয়ে। ঠিক বুঝতে পারছে না। আন্দাজ করছে খানিক। আরও অনেক কিছু নিশ্চয়ই আছে ওর কাছে। মিত্র আর নিজের কৌতূহলকে চেপে রাখতে পারল না। পিছন থেকে সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা করেই ফেলল, “তুমি কে? তোমার নাম কী?”

একবার নয়, দু-দু’বার প্রশ্নটা করার পরও যখন মেয়েটা কোনোরকম উত্তর করল না। তখন মিত্রর মনে ছোট্ট একটা সন্দেহ হল, মেয়েটা কি শুনতে পায় না? নাকি ওকে অগ্রাহ্য করছে? ভারি বদ মেয়ে তো! অসম্ভব রাগ হল মেয়েটির উপর। কী বেয়াদপ মেয়ে রে বাবা! এই মেয়েকে শাস্তি দিতেই হবে। মিত্রর কোনও বন্ধু আজ পর্যন্ত ওকে অগ্রাহ্য করার সাহস পায় না। আর এই মেয়েটি? রাগটা এতই হয়েছিল, আর কথা না বলে সরাসরি হাত বাড়িয়ে এক ধাক্কা দেয় মিত্র। মেয়েটি আচমকা ধাক্কা খেয়ে হাতের বানানো পুতুলটি নিয়ে মাটি, ধুলোবালির মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাতের মুঠো খুলে মেয়েটি তার বানানো পুতুলটিকে দেখে। সেটিও কেমন যেন ঘাড় কাত হয়ে হেলে গেছে। নরম যে জিনিসটা দিয়ে পুতুলটি বানানো হচ্ছিল সেটি খানিকটা গলে পড়ে যাচ্ছে পায়ের কাছে, নিচে। মেয়েটি অবাক হয়ে মিত্রর দিকে তাকিয়ে ছিল। কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে অনেকগুলো জলের কণা জমা হয়ে এল মেয়েটির চোখের কোলে। মিত্র বুঝতে পারল, মেয়েটি কাঁদছে। মিত্র কান্না সহ্য করতে পারে না। আকাশ থেকে ঝরে পড়া মেঘেদের কান্নাও ওকে কষ্ট দেয়। চোখে জল দেখলেই ওর মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি মেয়েটির কাছে হাঁটু মুড়ে বসে পুতুলটার কাত হয়ে যাওয়া অংশটাকে সোজা করতে চায়। অদ্ভুতভাবে লক্ষ করে, মেয়েটি কষ্ট পেলেও পুতুলটি ওর হাত থেকে নিয়ে নেওয়ার সময় কোনোরকম বাধা দেয়নি মিত্রকে। সারা আঙুল সাদাটে হলুদ হয়ে যাচ্ছিল মিত্রর। তবুও মিত্র চেষ্টা করে যাচ্ছিল। বারবার মুখ তুলে তাকাচ্ছিল মেয়েটার দিকে। খুশির ঝিলিক অল্প অল্প করে ফুটে উঠছিল মেয়েটার মুখে। ও কি খুশি হচ্ছে? মিত্রর মনটাও খুশির তুফানে ভরে উঠছিল। ছোট্ট পুতুলের নড়বড়ে মাথাটা আলতো হাতে সোজা করে মেয়েটির হাতে তুলে দিয়েছিল মিত্র। চারদিকে প্রকৃতি ফিকে হতে শুরু করেছিল। সবুজ গন্ধ জানিয়ে দিচ্ছিল, মিত্রর এবার যাওয়ার সময় এসেছে। আর তিলমাত্র দেরি করে যাবে না। মেয়েটি তখনও কৃতজ্ঞতায় ভরা চাউনি নিয়ে অপলক তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। মিত্রর আজ কাজে যেতে ইচ্ছে করছিল না। তবুও ওকে যে যেতেই হবে। উঠে দাঁড়িয়ে ও ফিরে যাচ্ছিল গন্তব্যে। আর ঠিক তখনই মিত্রর হাতে হাত রেখে ডানহাতে হলদেটে পুতুলটা দিয়ে মিষ্টি হেসে তাকিয়েছিল মেয়েটি। মিত্র অনুভব করছিল, ভারি হয়ে আসা গুমোট হাওয়া কেটে গিয়ে পাতলা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে ওর চারপাশে। আর তারই মাঝে শ্যামবর্ণা একটি মেয়ে সরু সরু সুতোর অজস্র রকমারি কাজ করা মাদুরে করে ভেসে যাচ্ছে দূরে, বহুদূরে।

(২)

হাতে ধরা পুতুলটির দিকে তাকিয়ে থাকে মিত্র। এতক্ষণ লক্ষ করেনি বটে, কিন্তু মেয়েটি কী অদ্ভুত সুন্দর বানিয়েছে পুতুলটি। কী জীবন্ত! যেন এক্ষুনি কথা বলে উঠবে। চোখ, মুখ, নাক সবটাই একেবারে অজানা, অথচ এক নতুনের মতো। কী করে পারল এমন জীবন্ত বানাতে? আর কী দিয়েই বা বানাল এমন? এমন উজ্জ্বল রং হলই বা কী করে পুতুলটার? ভাবতে ভাবতে মিত্র রোজের মতো নিজের জায়গায় গিয়ে স্থির হয়। দেখে, যতদূর চোখ যায় হালকা কমলা আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে আকাশটা। আর আকাশ জুড়ে জমা হচ্ছে পেঁজা তুলোর ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘ। খানিকটা উপরে সাত রঙের রামধনু গোল হয়ে মাথা নিচু করে আগলে রেখেছে পৃথিবীটাকে। মিত্র কি ওর নতুন বন্ধুকে খুশি করতে পারল? হাসি ফোটাতে পারল প্রিয় বন্ধুর মুখে?

একটা, দুটো করে অনেকগুলো পুতুল জমা হয়েছে মিত্রর কাছে। আর প্রতিদিনই এভাবেই মিষ্টি বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে মেয়েটির সঙ্গে। কী করে জানে না, এখন কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই বুঝতে পারে মেয়েটি। হাসিমুখে ওর দিকে তাকায়। নিজের হাতে বানানো পুতুলগুলো দিয়ে ইশারায় বুঝতে চায় ঠিক কেমন হয়েছে। এতদিনে মিত্র এটাও বুঝতে পেরেছে, ও হয়তো ঠিক কথা বলতে পারে না! তাই এমন চুপ করে থাকে। দিন শুরুর প্রতিটা মুহূর্ত বড়ো ভালো লাগে ওর। মনে হয়, আবার কখন দেখা হবে মেয়েটির সঙ্গে?

তবে সেদিন বড়ো অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। হাওয়ার দাপট যেন সেদিন বেশিই ছিল। মাথা দুলিয়ে লম্বা গাছেরা মচমচ শব্দে হেলছিল এদিক ওদিক। কাছের কোনও জায়গা থেকে শুনতে পাচ্ছিল জলের ছলাৎ-ছল শব্দ। কী যেন আশঙ্কায় সোজা উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছিল মেয়েটি। ভীত, সন্ত্রস্ত চোখে তাকিয়ে দেখছিল চোখের চারপাশটা। আর তারপরই হাতেগড়া পুতুলগুলো বুকের মধ্যে লুকিয়ে পলক ফেলার আগেই হারিয়ে গেছিল কোন অজানার দেশে। বড়ো অদ্ভুত লেগেছিল মিত্রের। ঝড়, বৃষ্টি, বিদ্যুৎ, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে মানিয়ে নেবার, লড়াই করার ক্ষমতা তো ওদের প্রত্যেকেরই আছে! তাহলে হঠাৎ মেয়েটি ভয় পাবে কেন? মেয়েটি কি তবে ওদের মতো নয়? অন্য কেউ? অন্য কোথাও ওর বাড়ি?

মিত্রর মনটা স্থির থাকতে পারে না। হাতের তেলোতে ফুঁ দিয়ে ধুলো উড়িয়ে দিয়েছিল কিছুটা। ফুরফুরে হাওয়ায় মন ভালো হয়ে উঠছিল একটু একটু করে। আসলে সেই যে ভয় পেয়ে মেয়েটা কোথায় যেন চলে গেল, তারপর আর দুটো দিন তার আর দেখাই নেই। ও কি আর ফিরবে না? মিত্র রোজ অপেক্ষা করেছে। বালি, মাটি ঘেঁটে ঘেঁটে কত কী বানিয়েছে! সেসব আকার পেয়েছে কখনও গুহা, কখনও গাছের কোটর, আবার কখনও আবার অন্যকিছু। ভেবেছিল, দু’জনে খেলবে এভাবেই। আর ওদের তৈরি খেলাঘরে পুতুলের সংসার গড়ে উঠবে একটু একটু করে। মিত্রর অপেক্ষা বেড়েই চলেছিল, আরও আরও বেশি। কেটেছিল অনেকগুলো দিন। যখন সব আশা ছেড়ে মিত্র ওর পশ্চিমের বাড়িতে বিশ্রাম নিতে যাচ্ছিল ঠিক তখনই একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল মেয়েটি। এর আগে কখনও কোনোদিন এ সময়টাতে আসেনি ও। খুব অবাক হয়েছিল মিত্র। মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলেছিল মেয়েটি। লুকিয়ে বের করে এনেছিল আরও বেশ কিছু পুতুল। আর তারপরই হাতের ইশারায় অঙ্গভঙ্গি করে মিত্রকে বলেছিল, ওদের রক্ষা করার কথা। ওদের পাশে থাকার কথা। শয়তান আজও এসেছে; আজও মেয়েটির কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল ওদের। তাই এতদিন ও লুকিয়েছিল। ওদের নিয়ে। সেই অতলে! যেখানে কেউ কোনোদিন খোঁজ পাবে না। কিন্তু কতদিন? একদিন তো ওকে ফিরে আসতেই হবে। ওদের গড়ে তুলতেই হবে বসবাসের উপযোগী সমাজ, সংসার। আর তাই ও মিত্রর সাহায্য চায়। মেয়েটির হাতের ইশারায় কথাগুলো শুনতে শুনতে মিত্রর আশ্চর্য লাগলেও কথা দিয়েছিল মেয়েটিকে, সে ওদের রক্ষা করবেই। পাশে থাকবে ওর। প্রিয় বন্ধু হয়ে। আর তারপরই ওরা দু’জনে হাতে হাত মিলিয়ে বন্ধুত্বের রঙিন শপথে আবদ্ধ হয়েছিল।

পরের প্রভাতে একরাশ রঙিন আলোর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছিল ঝলমলে দিন। মেয়েটি আর মিত্র দু’জনে দু’জনের মনের কথা ভাগাভাগি করে নিতে নিতে প্রাণ দিত ওদের। কথা বলা শেখাত। শেখাত কীভাবে লড়াই করে বেঁচে থাকার রসদ আহরণ করা যায়। কীভাবে শিখতে হয় একে অন্যের বিপদে এগিয়ে আসতে। আরও কত কিছু। একটু একটু করে ওদের পাঠিয়ে দিয়েছিল পৃথিবীর চারটি কোণে। জল, স্থল, রুক্ষ জমি কিংবা বরফের চরম শীতল পরিবেশ ধীরে ধীরে হয়ে উঠতে থাকল উপযোগী। ঠিক তাদেরই উপযোগী। কিন্তু এত কিছুর পরেও কোনোদিন কথা বলতে শোনেনি মিত্র মেয়েটিকে। শ্যামবর্ণ হাতের নিপুণ মুন্সিয়ানায় যখন তারা পূর্ণতা পেত তখন মনে হত, এ কাজ যেন মেয়েটির কাছে অতি নগণ্য। ওর ক্ষমতা হয়তো আরও, আরও অনেক। এতদিনেও পরিচয় জিজ্ঞেস করতে পারেনি মিত্র। মনে হত, জিজ্ঞেস করলেই যদি হারিয়ে যায় মেয়েটি! আর ফিরে না আসে! তবে? তার থেকে এই ভালো। অপেক্ষা। অপেক্ষাই করা যাক। একদিন হয়তো ঠিক পাবে বন্ধুর পরিচয়।

(৩)

অপেক্ষার মুহূর্তটা যে এত ভীষণ আকারে আসবে তা কিছুতেই টের পায়নি মিত্র। পুতুল গড়ার খেলা শুরু হতে সেদিন সামান্য দেরি হয়েছিল। আসলে মেঘলা দিনে মিত্রর মনটা বেজায় খারাপ থাকে। তাই অন্যদিনের মতো অতটা সাহায্য করতে পারেনি মেয়েটিকে। কিন্তু সেদিন প্রথম থেকেই খেলার মাঝে মাঝেই অদ্ভুতভাবে ঘুরে ঘুরে চারদিক দেখে আসছিল মেয়েটি। মিত্র বুঝতে পারেনি। জিজ্ঞেস করতে মেয়েটা আগের মতোই কোনও কিছুর উত্তর দেয়নি। বেশ কিছুক্ষণ পর মিত্র বুঝতে পেরেছিল মেয়েটির আশঙ্কার প্রকৃত কারণ।

দিনের বেলাতেও আকাশ ছেয়ে গেছিল কুচকুচে কালো পাতার জঙ্গলে। শ্বাপদের মতো দিগন্তবিস্তৃত আকাশগঙ্গায় হিলহিলে দাঁতের নিশান এঁকে যাচ্ছিল কেউ। আর চোখের পলকে ঠিক উপরদিকে তাকিয়ে আচমকাই অসম্ভব এক জেদি চিৎকার করে উঠেছিল মেয়েটি, ওর শরীরটা নিয়েই। ভীষণ সে চিৎকার! প্রবল সে চিৎকার! আর মুহূর্তে বায়ুমণ্ডলের পরত ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছিল আরেকটি দানব। প্রবল উন্মাদের মতো এগিয়ে আসছিল মেয়েটির দিকে। মিত্র চোখ মেলে দেখছিল ওর সামনে বসে থাকা শান্ত শরীরটা হঠাৎ, আকাশছোঁয়া একটা কালো লোমশ শরীরে পরিণত হয়েছে। শরীরের সমস্ত রোমকূপ পুরু, গাঢ়। কিন্তু তার মাঝেও জেগে রয়েছে তার কুতকুতে পুঁতির মতো দুটো লাল চোখ। আঁকড়ে আঁকড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গোটা শরীরটা ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র স্থল জুড়ে। মুখগহ্বরের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে লালা। অজস্র লালার রস। ছড়িয়ে পরছে তার বিষ। বিষময় নিঃশ্বাস। তৈরি হচ্ছে একটার পর একটা সুতো। অনেকগুলো সুতো জুড়ে তৈরি হচ্ছে জাল। কোনায় কোনায় নিমেষে ছেয়ে গেছে কারুকাজ। একটুও শূন্যতা নেই কোথাও! চোখের সামনে ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, ষড়ভুজের আকারে বিচিত্র মায়ারেখার অঙ্কন দেখছে মিত্র। সম্পূর্ণ বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে। দেখছে, নারকীয় জালের মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। তীব্র আক্রোশে ফুলে উঠছে তার শরীরটা। জাল ছাড়িয়ে রোমশ শরীর আকাশের দিকে একবার, একবার মাটির দিকে আছড়ে আছড়ে আস্ফালন করছে। মনে হচ্ছে, আর কিছুতেই সহ্য করবে না সে দানবের অস্তিত্ব। তৎক্ষণাৎ দুই অসুরসম শরীর আছড়ে পড়ল একে অপরের উপরে। কেঁপে উঠল যেন পাতালপুরীও!

ভয়ের নাম কী?

(১)

ডাক্তারের কথা শুনে সৌরীশের মনে হচ্ছিল, ও কী সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেল? নাহলে এভাবে এখানে এসে যে ডাক্তার দেখাতে হবে, তা কোনোদিন ভাবেনি।

“আচ্ছা, আমাকে কি যেতেই হবে?”

সৌরীশের কথা শুনে হো হো করে হেসে ওঠে মলিন। বেশ কয়েক সেকেন্ড হাসার পর বলে, “তাহলে কি তোর জায়গায় আমার নামটা লিখে আসব? কাম অন ব্রো! একটু গল্পগুজব করে আসবি আর কী!”

পিঠ চাপড়ে কথাগুলো বলে বেরিয়ে গেল মলিন। মনে মনে সৌরীশ ভাবল, না গেলেই তো হয়! মলিন ডাক্তারের চেম্বারে নাম লিখিয়েছে মানে এমন তো নয় মাথার দিব্যি দিয়ে ফেলেছে সেও, যে যেতে হবেই। ওই কোনও একটা অজুহাত দেখিয়ে দিলেই হবে। তার চেয়ে বরং আজকের দিনটা একটু ঘুরে বেড়িয়ে আসা যাক। মানসিক ধকলটা সত্যি ওকে নিজেকেই কাটিয়ে উঠতে হবে। ডাক্তারে এর কীই বা করবে? ছোটোবেলায় মনে পড়ে, ডাক্তার আর ওষুধ নিয়ে যা ভয়ভীতি ছিল ওর! শিলনোড়া দিয়ে ভেঙে খেতে হত ট্যাবলেট। কিছুতেই গিলতে পারত না। সে এক অসম্ভব বিরক্তিকর পরিস্থিতি। আজও কি সেই ভীতিটা কেটেছে? হয়তো না। নাই তো! নাহলে এভাবে ছোটোবেলার ভয়টাও থেকে যেতে পারে? ভয়টাও আসলে একটা অভ্যাসের মতো। ভয় পেতে পেতে শরীরের স্বাভাবিকতাও অনেক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে। হারিয়ে যায়। এইসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির সামনের পাথুরে মাটিটা খড়মড় করে মাড়িয়ে বড়ো রাস্তায় উঠতে যাবে, ঠিক সেই সময়ই আচমকা বেজে উঠল মোবাইলটা। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে হাতে নিয়ে দেখে একটা অচেনা নাম্বার। সবুজ বোতাম টিপে কানে ধরতেই কথা বলে ওঠেন এক মধ্যবয়সী লোক। অন্তত গলা শুনে তেমনটাই মনে হচ্ছে। ঠিক পাঁচ মিনিট কান-মাথা ঝালাপালা করার পর লোকটা ফোন রাখল। আজব তো! ডঃ রাজীব থাপা। পেশেন্ট ডাক্তারকে ফোন করে শুনেছে, কিন্তু ঘুরিয়ে ডাক্তার যে পেশেন্টকে ডাকবে, সাধ্যসাধনা করবে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না শহরের লোক। লোকটার কি পেশেন্ট হয় না? কে জানে বাবা! তবে মলিন যে বলল, এলাকায় বেশ নামডাক আছে ডাক্তারের! বিদঘুটে ডাক্তারের বিদঘুটে আচরণে যাওয়ার ইচ্ছেটা আরও কয়েক দাগ কমে গেল ওর। কিন্তু মলিন যদি কিছু ভাবে? আসলে কলকাতা থেকে এত দূরে এসে এমন একজন বাঙালি বন্ধু পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার! আর কেই বা আছে ওর? সাতপাঁচ অনেক ভেবে রাজপুর রোডের যে রাস্তাটা পুলিশ চৌকির পাশ দিয়ে গেছে, সেদিকে পা বাড়ায় সৌরীশ।

(২)

“অ্যারাকনোফোবিয়া। আপনার বন্ধুর কাছ থেকে শুনেই একটা আন্দাজ পেয়েছিলাম। একশো জনের মধ্যে নয় কিংবা দশজনের এমনটা হয়ে থাকে। খুব রেয়ার বুঝতেই পারছেন। আচ্ছা, আপনার পরিবারের কেউ কি এমন রোগের শিকার ছিলেন? মানে এমনটা ভাবতেন?” খুব তাড়াতাড়ি কথাগুলো বলে ডাক্তার ভদ্রলোক আবার ঝুঁকে নিজের প্রেসক্রিপশনের উপর পেন দিয়ে কীসব লিখতে শুরু করলেন।

সৌরীশ কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। মা-বাবাকে সেভাবে চিনে ওঠার আগেই তো সব শেষ হয়ে গেছে। সবকিছু। আর ঠাম্মুম? নাহ! কস্মিনকালে ঠাম্মুম কোনও কিছুকে ভয় পেত এমনটা জানাই নেই ওর। বরং ও ভয় পেলেই একেবারে মুশকিল আসানের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে একহাতে সব রক্ষা করত। ঠিক সেসময়ই তাঁকে লেডি সুপারউইম্যান মনে হত।

“মনে পড়ছে কিছু?” সৌরীশ মিনিট কয়েক চুপ করে থাকার পর নাকের উপরের দিকে চশমা ঠেলে তুলে সন্দেহ দৃষ্টিতে ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন।

“না।” বলে ছোট্ট করে মাথা হেলাল সৌরীশ দু’দিকে।

“হুম। এর জন্য মস্তিষ্কের নিউরাল সার্কিট দায়ী। কারণ অ্যামিগডালা যা সাধারণত ভীতির অনুভূতি পাঠায়, তার সঙ্গে মস্তিষ্কের এমন একটা কর্টেক্স যুক্ত, যেটা দৃষ্টিশক্তির উপর প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। আর এই দুটি মিলিয়ে পর্যবেক্ষণ নীতিকে প্রভাবিত করে। এই অনুসন্ধানী মূলক গবেষণাটি অ্যারাকনোফোবিয়ায় আক্রান্ত পেশেন্টের সেরে ওঠার পক্ষে খুব যুক্তিযুক্ত হয়ে উঠবে পরবর্তীতে।”

কী সাংঘাতিক ডাক্তার রে বাবা! শুধু জ্ঞান দিয়ে যায়। মলিন কোথা থেকে যে একে জোগাড় করেছে! এখন কোনোরকমে পালাতে পারলে বাঁচে। সৌরীশ উশখুশ করতে থাকে। দেখে, এখনও ডাক্তারটা পাতা ভর্তি করে কীসব লিখে চলেছে। প্রেসক্রিপশনে ইতিহাস লিখছে। আর রোগের কার্যকারণ ব্যাখ্যা করে চলেছে। উফ!

“খুব গরম লাগছে তোমার?” সৌরীশের অস্থিরতা হয়তো চোখে পড়েছে ডাক্তারের। তাই জিজ্ঞাসা করছেন। নিজেকে সংযত করে একবার মোবাইলের ঘড়ির দিকে তাকায় সৌরীশ। যাতে মুখে না বললেও অন্তত হাভেভাবে বুঝতে পারেন ডাক্তার থাপা।

আবারও দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে ডাক্তারবাবু নিজের খেয়ালে বলতে শুরু করেন, “তুমি হয়তো খুব দুশ্চিন্তা করো, তাই না? দুশ্চিন্তা বা ভয় থেকেই এরকম হয়ে থাকে তোমার বয়সী ছেলেমেয়েদের। চিকিৎসাশাস্ত্রে একে ‘অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার’ বলে। তুমি কি বাড়ি থেকে খুব কম বের হও? প্রথম ঠিক কবে থেকে তুমি এমন দেখতে শুরু করো? বা আমি বলতে চাইছি, ভয় পাও।”

সৌরীশ চুপ করে থাকে। আসলে ডাক্তারের প্রথম প্রশ্নটা যে একেবারে বেঠিক তা কিন্তু নয়। ঘুরতে ভালো লাগলেও তেমন একটা সর্ষে নেই ওর পায়ের নিচে। মানে এখানে এসে অনেকেই শনিবারে করে উইকএন্ডে পুরো দেরাদুন, মুসৌরি এমনকি ধনৌল্টি পর্যন্ত ঘুরে আসে। কিন্তু সেরকম যাওয়ার তাগিদ অনুভব করে না ও। তবুও বাড়ির কাছের জঙ্গলটা অদ্ভুতভাবে টেনেছিল ওকে। ডাক্তারের কাছে এতটা বলবে না ও। যদিও জানে ডাক্তারের কাছে কোনও কিছু লুকোতে নেই। তবুও খোলসা করে এসব বলবে না। আর দ্বিতীয় প্রশ্নটা তো? তা প্রায় অনেকদিন আগের ঘটনা। তখন ক্লাস সিক্স কি সেভেনে পড়ে ও। স্কুলের বাথরুম খুব একটা পরিষ্কার থাকত না। সেখানেই চোখে পড়েছিল একটা আটপেয়ে প্রাণী। হ্যাঁ, মাকড়সা! দম আটকে এসেছিল মুহূর্তে। মনে হয়েছিল, প্রাণীটা এই বুঝি আঁকড়ে আঁকড়ে শরীর বেয়ে উঠে আসছে উপরে। ঘিনঘিনে শরীরের মুখ দিয়ে লালা বের করে এক মুহূর্তে যেন ওকে আটকে ফেলবে ওর জালে। চোখের পাতা বুজে এসেছিল। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি ও।

“দেখেছিলাম সেই স্কুলে পড়ার সময়…” থেমে থেমে দম নিয়ে নিয়ে কথাগুলো বলতে বলতে মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে ভেসে উঠছিল সবটা। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছিল কপালে। চেম্বারের হালকা নীল রঙের দেওয়াল হঠাৎ করেই মনে হচ্ছিল কালো।

(৩)

“কী রে, গেলি শেষমেশ? আমি তো ভেবেছিলাম তুই যাবিই না। যেভাবে ডাক্তারের নাম আর কথা শুনে মুখ বেঁকিয়েছিলি! তা কেমন লাগল?”

“খুব বেশি বকেন। বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেছেন রীতিমতো। আমাকে এত কিছু বোঝবার কী আছে?”

হাসি হাসি মুখ করে মলিন বলে উঠল, “ওটা অনেকের নেচার থাকে!”

“তুই দেখলে তবে বিশ্বাস করবি। এই দ্যাখ।”

প্রেসক্রিপশনটা বাড়িয়ে ধরল সৌরীশ। একটা সাদা কাগজের এ-পিঠ ও-পিঠ ঘেঁষাঘেঁষি করে লেখা অসংখ্য কাগের ঠ্যাং, বগের ঠ্যাং যা উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব। কোনও মেডিসিনের দোকানের পক্ষেও বোঝাটা যন্ত্রণার।

“হুম। সবই তো বুঝলাম। সবটাই মনের ব্যাপার। এর একটা উপায় আমরা কয়েকজন বাতলেছি। চল, ঘুরে আসি কোথাও। শুক্রবার বেরোব, সোমবার ফিরে আসব। শনি-রবি তো ছুটি পাচ্ছি। আলাদা করে ছুটি নিতে হবে না। প্রতিবার কিছু না কিছু বলে কাটিয়ে যাস। এবার আর কাটাতে দিচ্ছি না।”

“অগত্যা।”

“সে তুই যাই বল। তবে বাইক রাইডিং এক্সপেরিয়েন্স মন্দ লাগবে না আশা করি। তিনটে বাইক, ছ’জন। তুই আমার পিছনে বসে যাস। কোনও সমস্যা নেই তো?”

“না, না।”

“আর থাকলেই বা শুনছে কে?” বলে হো হো করে আবার সেই প্রাণখোলা হাসিটা হাসে মলিন। সত্যি ছেলেটা পুরো পাগল। এত আপন, আর এত খোলা মনের মানুষ খুব কম দেখা যায়। কই, ওর স্কুল-কলেজের কেউ তো এতটা নিজের বলে মনে করেনি কোনোদিন! এত দূরে এসে কাউকে নিজের প্রকৃত বন্ধু বলে মনে হচ্ছে ওর।

“তা কোথায় যাবি বলে ভাবছিস?”

“মুসৌরি তো অনেক ঘুরেছি, এবার ঠিক করলাম ধনৌল্টির দিকটায় যাব। তোরও ভালো লাগবে। মুসৌরিতে খুব ভিড় এসময়। কলকাতা থেকে গরমে সব ওদিকটাতেই ঘুরতে আসে। তুলনায় ধনৌল্টিটা একটু ফাঁকা। মনের মতো জঙ্গল পাবি। পাহাড় তো রয়েছেই। মুসৌরি থেকে এই ধর আরও দুই ঘন্টার পথ। আরও চড়াই।”

“তোদের গ্রুপের আর কেউ গেছিল ওখানে কোনোদিন?”

“হুম, সুনীলরা তো প্রায়ই যায়। দেরাদুনের রবার্স কেভটাও ফাটাফাটি। একদিন যাস। হেব্বি লাগবে!”

“তা যাওয়া যায়। আগে ধনৌল্টি ঘুরে তো আসি। তারপর…”

“ঘুরতে থাক, দেখবি দুনিয়ার যত ভয় আছে সব উবে গেছে।”

বারবার এই ভয় আর ভয় কথাটা শুনতে একদম ভালো লাগছে না সৌরীশের। ভয় ও পায় বটে, কিন্তু এই ঘটনাগুলো সবটাই কি মনের ভুল? কী করে হয় তা? জেগে জেগে কেউ ভুল দেখে? আর সেদিন জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে ওই বাড়িটায় যা দেখল তা কি মিথ্যে? কখনওই নয়! আর কোনওভাবেই চিন্তা করবে না ও। ভাববে না কিছুই। মনকে শক্ত করতে হবে। হঠাৎ করে মা-বাবার উপর খুব অভিমান হল সৌরীশের। ওঁরা কী করে স্বার্থপরের মতো ওকে ছেড়ে চলে যেতে পারল? সেই জন্যই তো আজ এতটা পরীক্ষা সহ্য করতে হচ্ছে ওকে। বুকের মধ্যে একটা কষ্ট চিনচিন করে ওঠে। ঠাম্মুমটাও কীভাবে ওকে একলা ফেলে চলে গেল! অথচ একদিন আগেও বুঝতে পারেনি একদিন পরে ঠাম্মুম থাকবে না। একজনও কি নেই যে এসে ওর পাশে এসে দাঁড়াবে? হাত ধরে আশ্বাস দিয়ে বলবে, সে আছে, ছিল, থাকবে!

ধনৌল্টির পথে

(১)

হঠাৎ করে অফিসের কাজ এসে পড়ায় সৌরীশদের যাওয়া কিছুটা পিছিয়ে যায়। মে মাসের শেষ হয়ে গেছিল। গরমের উত্তাপও বেড়েছিল আগের চাইতে আরও অনেকটা। তারপর বাড়ি ফিরলেই লোডশেডিং। অসহ্য হয়ে উঠেছিল চারপাশটা। সৌরীশও অনেকটাই কাজ শিখে গেছিল। তাই রাজ্যের কাজ চাপাচ্ছিল ওর ঘাড়ে সিনিয়ররা। মলিন বলছিল, এই অফিসে তেমন উন্নতি নেই। কলকাতা ফিরে যাবে। মলিন যদি সত্যি ফিরে যায় তাহলে আরও একা হয়ে যাবে বৈকি। মলিনকে বলেছিল, যাওয়ার সিদ্ধান্তটা কি না নিলেই হয় না? মলিন বলেছিল, দেখা যাক কী হয়।

মে মাসের পনেরো তারিখ নাগাদ এক শুক্রবারেই ওরা রওনা দিয়েছিল। পৌঁছে যায় দুপুরের আগেই। ইকো পার্কের কাছাকাছি হোটেল নেওয়া ঠিক হয়। কারণ, এখান থেকেই হর্স রাইডিং বা অন্যান্য লোকাল সাইট সিনগুলো দেখার বিশেষ সুবিধা হবে বলে সুনীল জানায়। তাছাড়া সবার শরীরের অবস্থা বেশ কাহিল ছিল। লাট্টুর মতো ঘুরতে ঘুরতে পাহাড় বেয়ে উঠতে উঠতে অক্সিজেনের অভাব বোধ হচ্ছিল রীতিমতো। ফল? বাইক থামিয়ে মাঝরাস্তায় চার-পাঁচবার বমিও করেছে দুইজন। সৌরীশের তেমন কিছু না হলেও মনে হচ্ছিল, শরীরটা বিশ্রাম চাইছিল। এখান থেকে পঁচিশ কিমি দূরে চম্বায় সুনীলের বাড়ি। তাই ওর ভরসাতেই আসে সবাই। মুসৌরি থেকে আরও চব্বিশ কিমি পেরিয়ে গাড়োয়াল হিমালয় রেঞ্জের অভাবনীয় সৌন্দর্য সত্যি উপভোগ করার মতোই। শরীর হাজার পরিশ্রান্ত থাকলেও একচিলতে সোনালি আলো যখন মেঘের বুক ফুঁড়ে প্রতিফলিত হয়, জড়িয়ে থাকে পাহাড়ের গলা তখন সবকিছুই সুন্দর হয়ে ওঠে। লম্বা ঝালর পর্দাকে দু’হাতে ঠেলে বিশাল কাচের জানালার উলটো পিঠে দাঁড়িয়ে এসবই দেখছিল সৌরীশ। মসলিনের মতো হালকা মেঘগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছিল ‘হোটেল পয়েন্ট ইন’-এর রেলিং দিয়ে। ওই মসলিনের মাঝেই কি কোনও এক জায়গা থেকে অপলক চোখে তাকিয়ে দেখছে ঠাম্মুম! মা, বাবা! সৌরীশ খুব একা। খুব। আর তাই হয়তো অযথা নানারকম ভেবে চলে।

(২)

“কী রে, বেরোবি তো বিকেলে?” মলিন জিজ্ঞেস করে।

“ওরা কোথায়?”

“ওই তো ইকো পার্কের কাছটায় একটু ঘুরে আসতে গেছে। বিপুল, আর প্রমিত নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে বিছানা পেয়েই। বেচারিরা যা বমি করল।”

“ওরা আগে আসেনি?”

“আরে না না, এসেছে। সকালেই বারণ করেছিলাম গাণ্ডেপিণ্ডে না খায় যেন। শুনল? পেট পুরে আলুর পরোটা খাওয়ার এই হাল। শুধু কি তাই? সঙ্গে লস্যি।”

“কিন্তু যাই বলিস, আমারও কিন্তু শরীরটা ভালো নেই। মাথাটা ধরে আছে।”

“বাইকের পিছনে বসলে ওরকম একটু আধটু হয়। তা জায়গাটা কেমন লাগছে বল।”

“অসাধারণ! সত্যি যেন ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে ছেঁড়া কোনও অংশ রে। এতটা সুন্দর!”

“হুম। সুন্দর-অসুন্দর অনেকটাই নির্ভর করে মানুষের উপর। মানুষ চাইলেই সুন্দর। না চাইলেই নয়। আসলে এই জায়গাটায় বাজারের সুবিধা এখনও তেমন হয়নি। আনাজপাতি, চাল-ডাল আনতে হয় অনেকটা দূর থেকে হোটেলে। তাই অতটা ব্যাবসা শুরু করতে পারেনি লোকে। নাহলে মুসৌরির মল রোডের অবস্থা তো কলকাতার ধর্মতলার মতো ভিড় হয়ে গেছে! ও হ্যাঁ, রাতের খাবারটা এখন থেকেই হোটেলে জানিয়ে রাখতে বলেছে। কী খাবি? সেরকম স্পেশাল কোনও ডিশ থাকলে ওরা বাইরে থেকে বাজারটা আনে তো তাই সময় লাগে। বুঝলি? চল বেরোই।”

“দাঁড়া, আমি একটু ফ্রেশ হয়ে নিই। তুই সামনেই থাকিস। আমি আসছি।”

মলিন বেরিয়ে যেতে সৌরীশ ফ্রেশ হতে না হতেই ফোন আসে মলিনের। কাল ভোর চারটেতেই হর্স রাইডিং ফিক্সড করেছে ওরা। গন্তব্য ধনৌল্টির পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কোনও এক সুইসাইড স্পট। আর সবচেয়ে বড়ো সাসপেন্স যেটা তা হল স্বয়ং তেন্ডুয়ার গুহা দেখাবে ঘোড়ার লাগাম হাতে গাইড। ফোনটা কেটে বিছানার উপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ে সৌরীশ। মেজাজটা ফুরফুরে হয়ে গেছিল ওর। চটজলদি তৈরি হয়ে নিয়েই বেরিয়ে পড়েছিল পাহাড়ের পাকদণ্ডী পথে।

সেই ভয়ংকর কালোর মাঝে

একে জঙ্গল, তায় তেন্ডুয়া। রাতে ঘুম প্রায় আসেনি বললেই চলে। কয়েকটা ঘণ্টা কীভাবে কেটেছিল নিজেই জানে না। তারপর মলিনের আঙুলের খোঁচা খেয়ে ঘুম ভেঙেছিল ঠিক সাড়ে তিনটে নাগাদ। বাকি চারজন আরেকটা রুমে বেড পেয়েছিল দু’জন দু’জন করে শোবার জন্য। আর মলিন আর ওর ঘরটা একেবারে বারান্দার শেষপ্রান্তে। তাই সবুজের সারির ধাপটা যেন আরও বেশি করে চোখে পড়ছিল। আরও বেশি করে কাছে টানছিল যেন অপেক্ষার প্রতিটা সেকেন্ড। এ অপেক্ষা নীরবতার। এ অপেক্ষা কু-ডাকের। তেমনটাই মনে হচ্ছিল সৌরীশের। ঘুম একেবারে না এলেও শেষরাতের দিকে সামান্য হলেও চোখ বুজে এসেছিল ওর। আর তাতেই ক্রমাগত চোখের সামনেটা নড়ে নড়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল কেউ কিছু করতে যেন নিষেধ করছে ওকে। গোটা ব্যাপারটা ধোঁয়াশা। একটা মানুষের শরীরের আকার শুধু! অথচ তাকে চেনবার কোনও উপায়ই নেই। আজ ঘুরতে এসে কোনোরকম দুশ্চিন্তা তো মাথায় আসেনি ওর! তবে? মনের মধ্যেটা কেন জানে না খচখচ করছিল সৌরীশের।

যে পথে সৌরীশরা যাবে বলে ঠিক করেছে ধনৌল্টির সেই জঙ্গলঘেরা পথ সরকারিভাবে নিষিদ্ধ। ওর বন্ধুদের জোরাজুরিতে নাকি গাইড অতিরিক্ত টাকায় রাজী হয়েছে। এ অঞ্চলে ব্যাবসা করে জীবিকা নির্বাহ করে তারা। তাই টুরিস্টবাবুদের খুশি করতে নিরুপায় হয়ে এসেছে। পাহাড়ের লোকেরা বেইমান হয় না। বারবার কথাটা বলছিল ঘোড়ার লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বছর কুড়ির ছেলেটা। মনে মনে অল্প হেসে ঘোড়ার পিঠে জুতসইভাবে বসে সৌরীশ। ওঠার আগেই বলে দিয়েছিল পাহাড়ি লোকগুলো। সোজা হয়ে বসে থাকার সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ার জিনে পায়ের স্পর্শ যেন এতটুকু আলগা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আর তা যদি হয়, তাহলে ঘোড়া যে হাতের লাগাম ছেড়ে কোথায় দৌড়বে তার ঠিকানা নেই। তবে তারা এটাও বলেছিল, এমন সম্ভাবনা খুবই কম। তারা পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাবে। ঘোড়া বিপথে যাবে না। ওরা ছ’জন হলেও ঘোড়া নিয়েছে চারটে। বাকি দু’জন কিছুতেই এই অ্যাডভেঞ্চারে নামতে রাজী হয়নি। ওরা নাকি কালপরশু এসে ঘুরে যাবে। সুযোগটা হারাল সত্যি।

বেশ ঠাণ্ডা লাগছিল দুলকি চালে ঘোড়ার পিঠে চলতে চলতে। সামনে যতদূর চোখ যায়, অন্ধকার আর কালো। মাথা ঢাকা টুপিতে চোরা শীতের ধারালো পরশ ঢুকে পড়ছিল ছোটোখাটো ফাঁক দিয়ে। কিন্তু এখন সেসবে মনোযোগী হওয়া যাবে না। একদিকে খাড়াই পাহাড় উঠে গেছে আরও বেশ খানিকটা উপরে সুরকুণ্ডা দেবীর মন্দির ঘিরে। আর বিপরীতে? অতল, অকূল মৃত্যুফাঁদ! পা পিছলে গেলেই কয়েকশো ফুট নিচের খাদ। শিউরে উঠছিল সৌরীশ। খুব জোরে জোরে ওদের কথা বলতে বলেছিল পাহাড়ি লোকগুলো। আসলে যদি কোনও হিংস্র জন্তু থেকেও থাকে, সরে যাবে তাহলে। কিন্তু সত্যি সত্যি কি তাতে কোনও বিপদ আটকানো যায়? যদি পাইনের ডালেই ওত পেতে থাকে কোনও তেন্ডুয়া কিংবা বিষধর সাপ! আর লাফিয়ে এসে… উফ, আচমকাই মুখটা খানিকটা নিচু হয়ে ঠুকে গেছে ঘোড়ার ঘাড়ের কাছে। ঘোড়াটা কি গতি বাড়িয়েছে? এই ঠাণ্ডাতেও ঘাম হচ্ছিল সৌরীশের। ভয় পেয়েছে নাকি ও? নাহ্‌, এভাবে ভয় পেলে চলবে না একেবারেই। সামনে থেকে বিপুল, সুনীল আর মলিন বারবার জিজ্ঞেস করছিল সে ঠিক আছে কি না। যাত্রা যখন শুরু করেছিল তখন ও কিছুটা এগিয়ে থাকলেও যে লোকটা সৌরীশের ঘোড়াটাকে ধরে আছে, সে এতই আস্তে আস্তে মেপে মেপে পা ফেলছে, তাই ওকে খানিকটা পিছিয়ে পড়তে হয়েছে। ভয়-টয় ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে ও, চারদিকে তাকায়। এতটুকু আলো ফোটেনি। নীল চাদরে মোড়া আকাশটায় শুধু কালো আর কালো। চাঁদটা কোথায় যেন ডুবে গেছে। দুয়েকটা সাদা আলো চুমকির মতো জেগে রয়েছে খালি। ওগুলো কি তারা? তাই তো! হোটেল ছাড়িয়ে চলে এসেছে অনেকটাই। ঘড়ি তো আনেনি। শিট! মোবাইলটা যদি আনত! ভুলে গেছে আনতে। আন্দাজে মনে হল পনেরো মিনিটের বেশি তো হলই। চেনা-অচেনা ডাকগুলো ফিরে ফিরে আসছে কানে। ওগুলো পাহাড়ের ডাক। পাহাড়ের ধাপে জেগে ওঠা নিশাচর পাখিদের জেগে থাকার ডাক। দুয়েকটা জোনাকি আলো জ্বেলে ছুটে যাচ্ছে চোখের এপার থেকে ওপার। ওরা কথা বলছে ইশারায়। মচমচ শব্দটা মাঝে মাঝে বাড়ছে, আবার দূরত্ব বেশি হয়ে যাওয়ায় মাঝে মাঝে কমেও আসছে। দূরত্ব সৌরীশের সঙ্গে ওর বন্ধুদের। দূরত্ব এই জঙ্গলে বাস করা সেই সমস্ত সজাগ ইন্দ্রিয়ের যাদের দেখতে আজ ওরা এসেছে। কী বিচিত্র এ পৃথিবী! মানুষের হাত থেকে কারুরই রেহাই নেই হয়তো। সে সমুদ্রের পাতালপুরী হোক কিংবা গভীরে গুহায় লুকিয়ে থাকা কোনও নামহীন অজানাই হোক না কেন! কেন যে এই পরিবেশে এসে মনটা এতটা খারাপ লাগছে, কিছুতেই বুঝতে পারছে না সৌরীশ।

ওদের চলতে হবে আরও মিনিট পাঁচেক। তারপরই নাকি গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। তবে বেশি কাছে যাওয়া তো যাবে না, দূর থেকেই তেনার ডেরা দেখতে হবে। তাতে ক্ষতি নেই। আচমকা পাতার খরখর, মচমচ শব্দ ছাড়িয়ে প্রবল চিৎকার করে উঠল কোনও একটা পশু। আচমকা এই ডাকে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে সৌরীশের বাদামি ঘোড়াটা। বইতে থাকা বাতাস যেন এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেছিল। নিস্তব্ধ নিশ্চুপ সেই নিশাচর রাজত্বে ঠিক একবার নয়, বারবার ডেকে উঠেছিল প্রাণীটা। ততক্ষণে সৌরীশের বাকি বন্ধুরাও ঘোড়া থামিয়ে পিছনের দিকে চলে এসেছিল। ওদের ঘোড়াকেও কিছুতেই আর সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। উপায়! এদিকে যতবারই প্রাণীটা ডেকে উঠছে কেঁপে উঠছে পাহাড়। ফিরে ফিরে ধাক্কা খেয়ে আসা আওয়াজে ততবারই জামার ভিতর থেকে কী এক মাদুলির মতো বার করে কপালে ঠেকাচ্ছিল সৌরীশের ঘোড়াকে নিয়ে আসা গাইড রাঘব। জিজ্ঞেস করতে কোনও উত্তর করছিল না। শুধু ওদের বারবার বলছিল বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য। ব্যাপারটা কী? বুকের ভিতরটায় অজস্র হাতুড়ি পিটছিল সৌরীশের। কোনওমতে নিজেকে গুছিয়ে ওরা সবাই জানতে চেয়েছিল, এটা কী প্রাণী? এরকম ডাক তো আগে কোনোদিন শোনেনি ওরা! ভয়ে ভয়ে কোনওমতে ঢোঁক গিলে বলে উঠেছিল, “গিদ্ধর!”

নামটা প্রথমবার শোনা। স্থানীয় নাম হয়তো। শেয়াল বা ফেউ জাতীয় কোনও কিছুর মতো একেবারেই নয়। অসম্ভব গুরুগম্ভীর, পিশাচময় একটা ডাক। স্থানীয় লোকগুলো বলছিল ‘গিদ্ধর’ ডাকলেই নাকি কোনও না কোনও অশুভ ওদের হয়। তাই বাড়িতে থাকলেই এই ডাক শোনার সঙ্গে সঙ্গে তারা ভগবানের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে। ঘোড়াগুলোও যেতে চাইছে না। তাই ওরা স্পষ্ট কথায় জানিয়ে দিল, ওরা আর কোনওভাবেই তেন্ডুয়ার ডেরার কাছাকাছি নিয়ে যাবে না। সুনীল আর বিপুল অতিরিক্ত টাকার লোভ দেখাতেও তারা কোনওমতেই রাজী তো হলই না, উপরন্তু আমরা যদি যেতে চাই, তাহলে ঘোড়াটাকে যেন ছেড়ে দিই, সে কথাও বলল।

কেউই ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছে না ঠিক কী করবে। জান্তব শব্দটা থেমে গেলেও একটা কড়া নিঃশ্বাস যেন আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিল। তাই সৌরীশের খুব একটা যেতে ইচ্ছে করছিল না। যদি কিছু… বিপুল ঘড়ি দেখে বলল, “ঘড়ির কাঁটা পাঁচটা ছুঁই ছুঁই। একটু পরেই তো আলো ফুটবে! ভয়টা কীসের?”

তবুও রাজী হয়নি লোকগুলো। কোনওভাবেই নয়। অগত্যা সবাইকে নেমে পড়তে হয়েছিল ঘোড়া থেকে। ঘোড়া ফিরে যাচ্ছিল। সঙ্গে লোকগুলোর পায়ের শব্দও কিছুদূর পর্যন্ত মচমচ আওয়াজ তুলে যখন একেবারে মিলিয়ে গেছিল তখন সত্যি সত্যি সাড়হীন হয়ে পড়েছিল সৌরীশের সমস্ত শরীর। বাকিদের অবস্থা ঠিক কীরকম তা বুঝে উঠতে পারছিল না। কারণ, এই অন্ধকারের বুকে আলো বলতে সম্বল ছিল লোকগুলোর হাতে জোরালো টর্চ। যা এখন আর কোনওভাবেই পাওয়া সম্ভব নয়। সুনীল চটপট নিজের মোবাইলের টর্চটা অন করে। বলে এ-রাস্তায় সে অনেকবার এসেছে। তাই শুধুমুধু ভয় পেয়েও কোনও লাভ নেই। ওর পিছন পিছন সবাই এগিয়ে যাচ্ছিল। সৌরীশও। কিন্তু কয়েক পা যেতেই মনে হল, কেউ বা কিছু একটা যেন ওদের সঙ্গেই চলছে! অথচ থমকে দাঁড়ানো যাবে না। বিপদ যে পদে পদে। এখনও একটু আলোও কেন দেখা যাচ্ছে না আকাশে? কেউ যেন গলা টিপে রেখেছে সামান্য আলোর কণাটুকুকেও। কী এক ভয়ংকর পরিস্থিতি!

হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে কী যেন একটা দেখিয়ে পিছন থেকে মলিন বলে উঠল, “ওই তো গুহা!”

আর সঙ্গে-সঙ্গেই সবাই ঝুঁকে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করতে যাবে, সাংঘাতিক একটা ধাক্কায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গড়িয়ে পড়ল সৌরীশ। অসহ্য যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছিল শরীরটা। তলিয়ে যাচ্ছিল কোন অতলে। হালকা হয়ে ভেসে যেতে যেতে শরীরটা আচমকাই বিপরীতদিকে পালকের মতো উপরের দিকে উঠে কোথাও যেন আটকে গেছিল। কোথায়? কোথায় এল ও? ও কি বেঁচে আছে? আর তখনই বিভীষিকার মতো চোখের সামনে জেগে উঠল একটা অসম্ভব অদ্ভুত দৃশ্য। সেই, সেই আটপেয়ে একে একে রোমশ পা দিয়ে আটকে রেখেছে ওকে পাহাড়ের গায়ে খাঁজের মতো একটা অংশে। হিংস্র লালা বেরিয়ে এসে একে একে ছেয়ে ফেলছে সবটা। একটা নয়, আরও আরও অসংখ্য জালের মতো সুতো জুড়ে জুড়ে তৈরি হচ্ছে আরও কিছু। আরও কিছু যেন। আর ঠিক তখনই মিষ্টি গন্ধে ভরে উঠল বাতাস। একচিলতে সরু আলো মেঘ ঠেলে বেরিয়ে আসতে শুরু করল। শরীর বেয়ে জমে ওঠা যন্ত্রণার দানাগুলো টুকরো টুকরো হয়ে বিলীন হয়ে যেতে লাগল সৌরীশের। কী বিষম ভয়, আতঙ্ক অথচ শারীরিক তৃপ্তিতে ভরে গেল বুক। কী হবে ওর পরিণতি?

প্রচণ্ড আক্রোশে সেই শরীরটা একবার দুলে উঠল। আর তারপরই সমস্ত জালটা কেঁপে উঠল। ঝিম অসাড় দেহে সৌরীশ দেখল, প্রচণ্ড এক লাফে সাঁড়াশির মতো পাগুলো এঁকেবেঁকে উঠে যাচ্ছে উপরের দিকে। লাফিয়ে লাফিয়ে ঠিক সেখানে, যেখান থেকে ও ক্ষুদ্র নুড়ির মতো গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল ঠিক সেদিকে। এ কী দেখছে! ওকে এই নরকে রেখে কেন চলে যাচ্ছে প্রাণীটা? তাহলে কি ও ওর আরও শিকারকে জালে আটকাতে এগোচ্ছে! কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না এটা। কোনওভাবেই না। হাত-পায়ে বল আনার চেষ্টা করে সৌরীশ। মাথা তুলতে চায়। পারে না। ওই তো, ওদের চিৎকার শুনতে পাচ্ছে! বিপুল, মলিন, সুনীল! প্রাণীটা কি ওদের ধাওয়া করেছে? আহ্‌! জাল থেকে কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পাড়ছে না। গলা থেকে কোনও আওয়াজ বের হচ্ছে না। মলিন, বিপুল, সুনীল কেউ কি ওকে শুনতে পাচ্ছে? প্রচণ্ড কষ্টে মনে পড়ে যাচ্ছে ঠাম্মুমের কথা। গন্ধটা ধোঁয়ার মতো আকার নিয়ে বুকের উপর চেপে বসছে আরও। আরও খানিকটা চেষ্টা করে মাথা-ঘাড় তুলতে গিয়ে সজোরে কীসে যেন আঘাত পেল সৌরীশ। কোনও শক্ত পাথর কি? মাথার ভিতরের রক্ত চলাচল স্তব্ধ হয়ে গেল মুহূর্তে। শেষবারের মতো চোখ বুজে আসতে আসতে ও দেখল, উপুড় হওয়া আকাশটা নীল উজ্জ্বল আলোয় ছেয়ে গেছে। সেই আলোটার মতোই। আর প্রচণ্ড এক কান্নার আওয়াজে কানের পর্দা ফেটে যাচ্ছে। শব্দটা এক শিশুর কান্নার মতো। ঠিক এক মানবশিশুর ভূমিষ্ঠ লগ্নের কান্নার মতোই!

আদিম যুগের রহস্যরা

ঠিক এভাবেই কেঁপে ওঠে পাতালপুরী বারবার। চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায় ভূমি। ফাটল দেখা যায় যোজনের পর যোজন। যখনই আঘাত হয় তার সৃষ্টির উপর। তার সন্তানের উপর, সন্তানদের উপর। মিত্র এসব বোঝে। পাশে এসে দাঁড়ায় ওর। বারবার। বহুবার। বহুযুগ। বহুকোটি যুগেও তাদের বন্ধুত্বের বাঁধন বিলীন হয়নি। হতে পারে না। সেই যেদিন কোনও এক অমোঘ শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিল সেদিন থেকেই সবটা জেনেছিল। জেনেছিল এই রহস্যময়ী মেয়েটির আসল রূপ। দেবী মাকড়সা। পৃথিবীর মা। জগতের মা। তাঁর প্রথম সৃষ্টিদের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন কী এক অদ্ভুত রীতিতে। বিচিত্র সে দৃশ্য! বিচিত্র সে অনুভব! অবাক হয়ে দেখেছে মিত্র। তারপর বন্ধুত্বের বন্ধনে পরিচিত হয়েছে, সে অপূর্ব এক লীলা! পৃথিবীর মা তাঁর লালারসের ক্রিয়ায় সৃষ্টি করে চলছেন সেই সব মানবরূপী পুতুলদের। প্রাণহীন সেসব পুতুল যেন জীবন্ত গঠন নিয়েই গড়ে উঠত একটু একটু করে। কিন্তু প্রাণ কই? পৃথিবীর বুকে সৃষ্টির এই আদিপর্ব শুরু যে সবে। তখনও গড়ে ওঠেনি প্রাণ। কীট, পশু, পাখি, মানব, জল, স্থল, অন্তরীক্ষের কোনও জীবই তখনও তাদের অস্তিত্ব রাখেনি। তাই মা তাঁর সন্তানদের প্রাণপ্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসে মিত্রর কাছে। সমস্ত কু আড়াল করে, সঞ্চিত পুণ্য যোগ করেই প্রাণ পাবে পুতুলদেহ। দুই বন্ধুর আশীর্বাদ একত্রিত হয়ে পৃথিবীর বুকে প্রাণসঞ্চার হয় প্রথম কীট, পশুপাখি, মানব-মানবীর। বিচ্ছুরিত আলোকের ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে জল, স্থল, অন্তরীক্ষ। পুতুলের দেহ পূর্ণতা পায় অস্থি সমন্বিত মানবদেহে। এ পৃথিবী পৃষ্ঠ যে দেবীর কাছে চরম পরীক্ষার সর্বপ্রথম ধাপ! প্রকৃতি, প্রকৃতির রুক্ষতা, নম্রতা তাঁর সন্তানেরা জানেই না, বোঝেই না। একাকী এ মহাজগতের বুকে তারা বাঁচবে কী করে? গভীর চিন্তায় পড়েন মিত্র ও দেবী মাকড়সা। কেটে যায় বেশ কয়েক বর্ষ। অবশেষে তাঁরা ঠিক করেই ফেলেন পৃথিবীর ঠিক চারপ্রান্ত উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমে পাঠাবেন তাদের। পাঠাবেন প্রথম মানব সন্তানদের। তারাই গড়ে তুলবে তাদের বাসযোগ্য পৃথিবী। তবে একা কোনও এক প্রাণীর পক্ষেই সমাজ, সংসার বিশাল এই পরিমণ্ডল গড়ে তোলা সম্ভব নয়। দেবী মাকড়শাও তো মিত্র, তার অতিপ্রিয় বন্ধুর হাত ধরেছেন। আর তাই প্রতি মানব কিংবা মানবীর সঙ্গে পাঠানো হবে তাদের প্রিয় বন্ধুকেও। কিন্তু সব আলোর আড়ালেই যে কালো লুকিয়ে থাকে! কালোর হাত থেকে নিষ্কৃতি নেই কারুরই। একটু একটু গড়ে ওঠা মানব পাঁচিলে লাগে সেই শয়তানের কুটিল দৃষ্টি। ধ্বংস করে দিতে চায় সে। বিলীন করে দিতে চায় মানবসভ্যতার মূলমন্ত্র। মন্ত্রের বীজ। সে কে? তার প্রকৃত অভিসন্ধি সত্যিই কি তাই? নাকি আরও বৃহৎ! মিত্র জানে না তা। তবে আকাশের প্রতিটা স্তরে দেখেছে তার বিষাক্ত নিঃশ্বাস। ভয়াল চরাচরে ধুলোর মাঝে দেখেছে তার গোপন আস্তানা। আর দেখেছে মায়ের সেই অদ্ভুত পরাক্রমী রূপ। যা প্রতিটি মাই করে থাকেন তাঁর সন্তানদের জন্য। শত্রু হারে, হেরে যেতে বাধ্য হয় প্রকৃত সত্যের কাছে। কিন্তু নির্মূল হয় না। তাই তো বারে বারে ফিরে আসে সে! পৃথিবীর বিভিন্ন কোণে তার কড়া দৃষ্টি হেনে পরাজিত করতে চায় এ গ্রহের রূপ, রস, গন্ধ। ছড়াতে চায় মৃত্যুবীজ! আর সেটাই তার লক্ষ্য। কিন্তু পারবে কি সে তার লক্ষ্যে পৌঁছতে? আগেও পারেনি আর আজও…

ও কে?

(১)

নরম সবুজ ঘাস গোটা বিস্তৃত প্রান্তে ছেয়ে রয়েছে মখমলের মতো। খুব একটা আরাম বোধ হচ্ছে ওর। যতদূর চোখ যায়, জনপ্রাণী চোখে পড়ছে না। জায়গাটাও একেবারেই অচেনা ঠেকছে। তবুও ইচ্ছে হচ্ছে বেশ কিছুটা সময় এখানে থাকতে। চোখের পাতার নিচে ঠাণ্ডাভাব শরীরের সচেতনতা ফিরিয়ে আনছে একটু একটু করে। ও কে? কীই বা ওর পরিচয়? আর কেনই বা এই নিরিবিলি নির্জন পরিবেশে একাকী গৃহহীন প্রাণীর মতো পড়ে রয়েছে? মুহূর্তের মধ্যে ঘূর্ণির মতো একটা শঙ্কা ঘুরপাক খেতে লাগল মনের মধ্যে। তাহলে কি সত্যি ও একা? কেউ নেই ওর? এতদিন কোথায় ছিল ও? কপালের দু’পাশ অল্প অল্প চিনচিন করতে শুরু করে। রক্তস্রোতের গতি বেড়ে যায় অনেকটাই। চোখের সামনে বুনো ফুলে ঢেকে যাওয়া পাকদণ্ডী পথটা কালো কালো অস্পষ্ট হতে থাকে। কেন এমন হচ্ছে? কেন? ও কি অসুস্থ হয়ে পড়েছে? অস্পষ্ট অংশটা কাঁপছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি আঙুল ছোঁয়ালেই কর্পূরের মতো মিলিয়ে যাবে সব। ঠিক তখনই হাত বাড়ায় ও। হাতের তালু উঁচিয়ে ধরে। এগিয়ে আসা দৃশ্যটা একটু টলে উঠল আর তারপর সমস্তটা অপার নীরবতায় স্থির হয়। নীল আসমানি রংটা কোথাও লেগে নেই। তার বদলে জেগে উঠছে নিপাট ধূসর। রঙের মাঝে কুটিল কিছু বিন্দু। নাহ্‌, বিন্দুতে কোনও জ্যোতিষ্কের আভা নেই। রয়েছে সুদূরপ্রসারী এক ষড়যন্ত্রের নীরব ওত! ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু শরীরটা পাথরসম ভারী। স্থান পরিবর্তন করতে সে শরীর অচল। শুধু মুখের কাছে নেমে আসা ধূসর চাদরটা ছাড়া এ-স্থানের সবটাই তার দৃষ্টির অগোচরে। অসংখ্য চিৎকার ভেসে আসছে কানে। অনেকটা দূর। দূর থেকে ভেসে ভেসে আসছে শব্দটা। কেউ কি ডাকছে ওকে? এত মানুষ কোথা থেকে এল? চিৎকার করছে। বিলাপ করছে। খুব খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে কি! অস্পষ্ট অবয়বগুলো নিষেধ করছে কি? শরীরে কোনও বল পাচ্ছে না। পাচ্ছে না মনেও। বুকের ভিতর অসম্ভব জোরে স্পন্দন হচ্ছে।

হঠাৎই মনে হল ঠাণ্ডা জলের এক আঁচল জল ভিজিয়ে দিল ওর মাথা থেকে পা পর্যন্ত। কতগুলো মানুষ ঝুঁকে পড়েছে ওর মুখ, শরীরের উপর। তিলমাত্র জায়গা নেই আর। এতটুকু অক্সিজেন নেই যেন। দম নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। ঠেলে ঠেলে উপরের দিকে ওঠানামা করছে বুকটা। লোকগুলো খুব চঞ্চল হয়ে কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে নিজেদের মধ্যে। আর তারপরই ওর শরীরটা শূন্যে তুলে নিয়ে যেতে শুরু করল জনা পাঁচেক। অথচ ও কিছুই প্রশ্ন করতে পারছে না। জিজ্ঞেস করতে পারছে না।

লোকজনের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ওর শরীরটা আচমকাই এসে পড়ল একটি ফাঁকা দালানের উপর। অজস্র কথা হয়ে চলেছে ওকে ঘিরে। কিন্তু মনে হচ্ছে এ কথা, এ শব্দ ও আগে কোনওদিন কখনও শোনেনি। আশেপাশের লোকগুলোকে সরিয়ে হঠাৎ একজন ওর সামনে এগিয়ে আসে। ওর বুকের উপর কান দিয়ে কী যেন শোনার চেষ্টা করে। বোঝার চেষ্টা করে।

আরেকটা বিষয় দেখে খুব অবাক লাগছে ওর। কয়েকজন ওকে দেখে কেমন সরে সরে যাচ্ছে, যেন অচ্ছুৎ! ওকে ছোঁয়া যায় না? কী হয়েছে ওর? যে লোকটি এতক্ষণ ধরে বুকের উপর ঝুঁকে পড়ে পরীক্ষা করছিল, সে লোকটি বেশ কিছুক্ষণ পরে মাথা তুলে হাত নেড়ে খুব উত্তেজিত হয়ে কীসব বলছিল ভিড় করে থাকা লোকগুলোকে। আর ও দেখছিল, লোকগুলোও একটু একটু সরে যাচ্ছিল ওর থেকে। কালো মাথার ভিড়টা পাতলা হতেই ত্রিকোণভাবে একটা আলো এসে একটু একটু করে ঘিরে ধরল ওর সমস্ত শরীরটাকে। আলোটা অস্বাভাবিকভাবে জ্বালা ধরাচ্ছিল শরীরে। আগের সেই সহজাত ভাব কিছুতেই টের পাচ্ছিল না। টের পাচ্ছিল অসংখ্য সেই কোলাহল, সেই উন্মাদের মতো ভেসে আসা কিছু আর্তনাদ। যারা হয়তো ওকে ডাকছে! ওকেই ডাকছে! জ্বালাধরা শরীরটাও হঠাৎ করে অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে। গলা বুজে আসে চরম ঘৃণ্য তেতো স্বরে। অসম্ভব হিংস্র পশু যেন ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। এভাবে কিছুতেই বাঁচতে পারবে না ও! ওর শরীরে ও নয়, যেন অন্য কেউ লুকিয়ে! আর সে কিছুতেই যেন আলো সহ্য করতে পারে না!

ত্রিকোণ আলোটা এগিয়ে আসছে একটু একটু করে। নীল আলো। একটা উজ্জ্বল নীল আলোর রেখা। কেন এমন করছে ওর শরীর? শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেন এক্ষুনি জ্বালাময় অগ্নি থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসতে চায় পৃথিবীতে। পৃথিবী? এই শব্দটা কোথায় শুনেছে ও? কারা থাকে এখানে? মানব, না দানব? আর কারাই বা এর সৃষ্টিকর্তা? আর এই মানুষগুলোই বা কে, কারা?

(২)

এখানে এসেছে ঠিক কতদিন, কতমাস হল জানে না ও। আসলে দিন, মাস, বছর এসবের হিসেবটা ঠিক কীরকম ও জানে না। কিন্তু মাথার মধ্যে বারবার মনে হয়, একসময় ও এসব সবই জানত। আবছা চাদর দিয়ে যেন চেনা পরিমণ্ডলের সবটুকুই ঢাকা। তা কি কোনওদিন সরে যাবে? কে জানে! সেই সেদিন যখন কালো মাথার ভিড় একটু একটু করে পিছিয়ে যাচ্ছিল, কেবল একটি মানুষই বসেছিল তার পাশে। অনেকটা সময়। মনে আছে, নীল সরে গিয়ে আকাশ কালো হওয়া অবধি চূড়ান্ত এক উদ্বেগ নিয়ে কত কথা বলে যাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করছিল। হাত-ঠোঁটের আকার ইঙ্গিত দেখে তেমনটাই বোধ হচ্ছিল অথচ বাকরহিত হয়ে দেখা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। কারণ, ওর গলা যে অদ্ভুতভাবে আটকে ছিল অসম্ভব জড়তায়।

দিন যেতে থাকল। পরিবর্তন বলতে মানুষটি ওকে সঙ্গে করে রেখেছিল সম্পূর্ণ একটা ভিন্ন জায়গায়। যেখানে চলাচল নেই মানুষের। চলাচল নেই আনন্দ কিংবা খুশির। কাঠের পাল্লা সরালেই শুধু দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়, আর মাথা উঁচু লম্বা গাছের সারিকে দেখতে পায়। উঠে বসার ক্ষমতা কিছুটা হলেও পেয়েছে। ওকে খাবার, জল দিয়ে যাবার সময় মানুষটি দরজা বন্ধ করে চলে যায়। ছোট্ট একটা খট করে শব্দও পায়। জানে, এটা দরজায় কড়া লাগানোর শব্দ। মানুষটি চায় না ও বাইরে বেরোক। কেন? কেন বেরোতে দিতে চায় না? একটু কেউ যদি সাহায্য করে ও ঠিক উঠে দাঁড়াতে পারবে। বোঝাবার চেষ্টা করেছে ও। কিন্তু লোকটা কেমন যেন চুপ করে থাকে মুখের দিকে চেয়ে। খুব সকালে যখন একরাশ ঠাণ্ডা হাওয়া হুমড়ি খেয়ে পড়ে ওই খাড়াই পাহাড়ের উপর, আর সূর্যদেবও তার আঁচল উপচে আলো ছড়িয়ে দেয় বুনো গাছের মাথায় মাথায় তখন মাঝে মাঝে খুব জোরে জোরে মন্দিরের ঘণ্টা বাজতে শোনে। মন্দির? হঠাৎ এই কথাটা মাথায় এল কী করে? ও তো এর আগে এরকম কিছু দেখেছে বলে তো তেমনভাবে খেয়ালই পড়ছে না। অনেকগুলো গুনগুন শব্দও ভেসে ভেসে আসে ওই ঘণ্টার ধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে। সব বুঝতে পারছে, কিন্তু কিছুই যেন বুঝতে পারছে না। টালমাটাল অস্থিরতা কাজ করছে ওর মধ্যে। কী হয়েছিল ওর সঙ্গে? কী দেখে ও? কারাই বা চিৎকার করে! ওকেই কি ডাকে! নাকি অন্যকিছু!

(৩)

ঘরটায় একটা চৌকির মতন পাতা। ওখানেই শুয়ে, কখনও বসে থাকার চেষ্টা করে ও। মাথার কাছে গরাদের মতো লোহার লম্বা লম্বা রড দিয়ে আটকানো একটা ছোটো জানালা। ওটাই ওর সারাদিনের সম্বল। তন্নতন্ন করে খোঁজার চেষ্টা করেছে এমন কিছু, যাতে ওর অতীত মিশে আছে। পায় না, কিছুই খুঁজে পায় না ও। খুঁজে যায়। এমনকি ওর গায়ের পোশাকটাও মনে হয় আশ্রয়দাতাই দিয়েছে। কারণ গায়ের মোটা উলেনের জ্যাকেট, পাজামাটা অনেকটা এখানকার লোকেদেরই মতোই লাগল ওর। রাত নামার আগে লোকটি একটি মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে যায়। দেয় থালাভর্তি গোল রুটি, আর সবুজ রঙের একটা সবজির তরকারি। এগুলো কি আগে খেয়েছিল? এটাকে রুটি বলে জানল কী করে?

সেদিন একটা অবাক কাণ্ড ঘটল। এর আগে কোনওদিন দেখেনি। একটি ছোটো ছেলে একটি জানোয়ারকে ধরে, মানে জানোয়ারের গলায় দড়ি বেঁধে টানতে টানতে ওর জানালার সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। ওর মনে হল, ছেলেটাকে ডাকলে কেমন হয়। ছেলেটি যদি ওকে এখান থেকে বেরোনোর কোনও উপায় খুঁজে দিতে পারে! ছেলেটাকে দেখতে দেখতে বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে গেছিল। ছেলেটিও হাতে একটা হাত খানেক লম্বা লাঠি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নেচে নেচে উঠে গেছিল পাকদণ্ডী পথের ধাপ বরাবর। কিন্তু ও অপেক্ষা করছিল। যদি ছেলেটা ফিরে আসে তাহলে ওকে ডাকতেই হবে। এই মনে করে ও ঠায় অপেক্ষা করেছে জানালার কাছে। একটু একটু মিহি সুর তুলে ঘরে ফিরে গেছে নাম না জানা পাখিগুলো। কিন্তু ছেলেটা ফিরছিল না। মনের ভিতরে কাজ করছিল চূড়ান্ত একটা অস্থিরতা। তাহলে কি কোনও দিন এখান থেকে বেরোতে পারবে না ও? কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছিল। তারপরই শুনেছিল একটা শব্দ আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে ওর জানালার কাছে। মানুষের পায়ের পথ চলার শব্দ। ঘষটে ঘষটে, টেনে টেনে। চৌকি থেকে দ্রুত উঠে জানালার কাছে যেতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে আঘাত পেয়েছিল পায়ে। তাও তীব্র এক উৎকণ্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। খুঁজছিল শব্দের উৎস। তখনই পশ্চিম সূর্যের কমলা আলোয় দেখেছিল ছেলেটি ক্লান্ত, শ্রান্ত শরীরে ফিরে আসছে। ওই তো, ওই তো আসছে ছেলেটি। মুখের ভিতরের লালা শুকিয়ে আসছিল। পড়ন্ত রোদের আলোটাও সহ্য করতে পারছিল না ও। তাও হাত নেড়ে প্রবলভাবে শব্দহীন আকারে ডাকতে শুরু করেছিল ছেলেটিকে। আসছে। ছেলেটি আসছে! ছেলেটি কি গতি বাড়িয়েছে নিজের? ওকে কি দেখতে পেয়েছে? ফিকে আলোয় ছেলেটি দেখতে পেয়েছে। কাছে। অনেকটাই কাছে। ম্লান হয়ে আসছে ছেলেটির মুখমণ্ডল। ও এরকম করছে কেন? ম্লান মুখটায় চোখদুটো রক্তশূন্য হয়ে উঠছে। দু’হাতে মুখ ঢেকে অসম্ভব জোরে চিৎকার করে উঠেছে ও। চিৎকার করছে। ছুটে চলে যাচ্ছে। ওর হাতের ডাক অগ্রাহ্য করে ছুটে চলে যাচ্ছে ছেলেটি। তবে… তবে কি ওকে দেখে চিৎকার করল ছেলেটি? কেন! হাতের দড়ি ছেড়ে দিয়ে দৌড়োতে দেখে জানোয়ারটাও ভয়ে দৌড়োতে শুরু করল ছেলেটার পিছন পিছন। জানালা ধরে থাকা হাতটা আস্তে আস্তে আলগা হয়ে যাচ্ছিল। থপ করে একটা শব্দ। ঠাণ্ডা মেঝেতে বসে পড়েছিল ও। তবে কি ছেলেটা ওকে দেখে ভয় পেল? নিজের মুখে হাত দিল। কিন্তু কোনও কিছুই ঠাওর করতে পারল না। আজ ওকে জানতেই হবে। যে করে হোক। সারাঘর তন্নতন্ন করে খুঁজতে শুরু করল। কোথাও কি একটুও কাঁচের টুকরো নেই, যাতে মুখের সামান্য দেখা যায়! পেল না। কিছুই খুঁজে পেল না। একটি অন্তত উপায় তো করতেই হবে। বিছানায় কিছুক্ষণ বসল ও। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল জলের পাত্রের দিকে তারপর মুখ ঝুঁকিয়ে আরও ঝুঁকে পড়ল পাত্রের কাছাকাছি। আর তখনই বিকেলের মরা আলোয় হাড়হিম হয়ে ভেসে উঠল এক জলছবি। যে ছবিতে বাস করছে এক কদর্য প্রাণী, কদর্য কীটের মুখবয়ব। যার দৃষ্টি ধূর্ত। যার দৃষ্টি অশুভ। সেই বিষময় দৃষ্টি সহ্য করতে পারবে না কোনও মানব-শরীর। সে দৃষ্টির রং গাঢ় নীল।

(৪)

কথা বলার শব্দ তো অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছিল। এখন যেন নিজের দৃষ্টি শক্তির উপরে কোনও আর ভরসা পাচ্ছিল না। সে মানব, না দানব? কে? কোথা থেকে এসেছে? এও কি কখনও সম্ভব! এই বিষদৃষ্টি নিয়ে সে কোথায় যাবে? কে স্থান দেবে তাকে? যিনি তাকে স্থান দিয়েছেন একমাত্র তিনিই হয়তো এর সঠিক উত্তর দিতে পারবেন। উনি রোজই পরীক্ষা করেন ওকে। উৎকট কটু গন্ধের তরল নিয়ে ঢেলে দেন মুখে। ও সেগুলো নিয়ে কোনওরকম প্রতিবাদ করে না। নিজেকে প্রত্যক্ষ করার পর যেন সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে ওর। পাগলের মতো চিৎকার করতে চাইছিল। কিন্তু একটুকরো শব্দও বেরোচ্ছিল না ওর গলা থেকে। নিজের অসহনীয় যন্ত্রণা নির্বোধের মতো অনুভব করা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। লোকটি হয়তো কিছুটা বুঝবে। আকারে ইঙ্গিতে ওকেও বোঝাতে চেয়েছিলেন, সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া অবধি ও বেরোতে পারবে না। তার এ রূপ যে আতঙ্কের। তিনি চেষ্টা করছেন। করে যাবেন। অপেক্ষা করতেই হবে। কিন্তু ও যে আর সহ্য করতে পারছিল না। পরিচয়হীন, বদ্ধ ঘরে থাকতে পারছে না আর ও। ইচ্ছে করছে সবকিছু জানতে। অতীতকে, বর্তমানকে, ভবিষ্যতকেও। চোখ বুজলেই সেই ডাক। সেই অসংখ্য মানুষের ডাক এখনও যে শুনতে পায় ও! বোঝে, ওতেই ওর প্রকৃত অতীত লুকিয়ে। মুক্ত ওকে হতেই হবে। মুক্ত বাতাসেই হয়তো লুকিয়ে ওর অতীত কথা। কে বলতে পারে, এই বিষ হয়তো তাতেই বিলীন হবে! নাহলে যে ওকে সারাজীবন… উফ, আর ভাবতে পারে না ও। বিনিদ্র রাত কেটে যায় আরও একটা। মুক্তির উপায় খোঁজে নীল চোখের বিষমণি।

রক্ষাকর্তার রূপ

মিত্র আসে। আজও আসে মিত্র। আসতে যে তাকে হবেই। শুধু সময়ের ফাঁকিতে সে নিজেকে আড়াল করে। আদপেই তার কাজ নিরন্তর। যেখানে কোনও থামা নেই। শেষ নেই। ছুটে বেড়াতে হয় গ্রহের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। বন্ধুর আহ্বান সে কখনওই উপেক্ষা করতে পারে না। দেবী ডেকেছিলেন তাকে। বলেছিলেন সন্তানের বিপদের কথা। সেই কু-ডাক শুনতে পেয়েছিলেন দেবী আবারও। পেয়েছিলেন কোটি বছর পরে। তাই তো সতর্ক করে দিতে চেয়েছিলেন মানব সমাজকে। তারই সৃষ্টি এক প্রাণীর আর্ত ডাক বুঝিয়ে দিত অপর প্রাণীকুলকে, বিপদ আসন্ন। কেউ সংস্কার কেউবা কুসংস্কারের নিরিখে ভাবত প্রাণীটি হয়তো অপয়া অশুভ। কিন্তু মিত্র জানত, দেবীর বার্তা যে যে অর্থেই গ্রহণ করুক তারা সতর্ক হবেই। পৃথিবী শুরুর সেই অনিবার্য যুদ্ধ উপস্থিত মিত্র জানত। বহু কোটি বছরের ভয়াল রূপ শত্রুর আজও মনে আছে তার। মনে আছে দেবীর ভয়ানক ক্রোধ। আট হাত-পায়ে ভয়ানক ক্রোধ আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরেছিল ধূম্রবর্ণের শত্রুকে। আকার নেই, অবয়ব নেই। অথচ তার বিষাক্ত নিঃশ্বাস বুঝিয়েছিল সে ধ্বংস করতে চায় মানব। মানব তৈরি পৃথিবীকে। পরাজিত তাকে হতেই হয়েছিল। কিন্তু মিত্র জানত সে ফিরে আসবেই। জানত দেবীও। এরপর কেটে গেছে বহু বছর। বহু কোটি বছর। সভ্যতা গড়েছে। গড়েছে নগর। মানব এখন আগের চেয়ে আরও অনেক উদ্ভাবনী। অনেক উন্নত। নিভৃতে দেবী, মিত্র সেসব দেখেন। অবাক হন নিজেদের সৃষ্টিতেই। আজ সেই সৃষ্টিই তাঁদের সৃষ্টির সেই আদিপর্বকে উন্নত চোখে দেখতে চায়। বিজ্ঞান খোঁজে। কেমন করে যেন সারা পৃথিবী নয়, দক্ষিণ আমেরিকার হোপি জনগোষ্ঠী পৃথিবীর এই আদিম কথা মেনে নিয়েছিল। মিত্র আর দেবীর দান স্বীকার করে পুজো করে তাঁদের ঈশ্বর রূপে। তবুও কোনও এক বিশেষ স্থানে দেবীর স্থান সীমাবদ্ধ নয়। সন্তান যে যে প্রান্তে থাকুক, মাকে ছুটে যেতে হয় সেই প্রান্তেই। সন্দেহ বাস্তব-রূপ পেয়েছিল। ভারতের উত্তরাখণ্ডের হিমশীতল সুদূরপ্রান্তে তেরাগাঁওয়ের উপর নেমে আসা করাল মৃত্যু ভয়ে যখন পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি হচ্ছিল শত্রুর বিষাক্ত ছোবল, দেবী এসেছিলেন। তেরো গ্রামের একেকটি পরিবারের মৃত্যুর শূন্যতা তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন প্রাণ দিয়েই। নতুন প্রাণ সৃষ্টিই তো তাঁর জীবনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য। শয়তান কেবল প্রাণ হনন করতে পারে, সৃষ্টি করতে পারে না। সৃষ্টি যে সবচেয়ে কঠিন! সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে শয়তানের পার্থক্য এটাই। তবুও প্রতিটা সৃষ্টি, প্রতিটা প্রাণের মধ্যে সেই সৃষ্টিকর্তা দেব বা দেবী এমন কিছু নিহিত করে রাখেন যার আলো আর অন্ধকার দুই দাগই স্পষ্ট। হিংসা, লোভ, লালসা এসব যখন অন্ধকারের সীমা অতিক্রম করে যায় তখনই আঘাত হানে সেই নিকষ কালো শত্রু। ছোবল দেয় তার বিষাক্ত লেলিহান শিখায়। অন্ধকার আছে, মৃত্যু আছে। আছে প্রতিদিনের শুরুর সেই সৎ বিকিরণ, যাতে পাপের বিনাশ অনিবার্য। মিত্র, দেবী আজও রক্ষা করে চলেছে পৃথিবীটাকে এভাবেই।

মন জুড়ে প্রশান্তি

টেবিলের উপর বসে থাকতে থাকতে ভেসে উঠছিল পুরনো দিনের ঘটনাগুলো। অনেকটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে যদিও। কিন্তু ভুলতে পারেনি। ঘরের কোণ থেকে মাকড়সাটা দেওয়াল আঁকড়ে আঁকড়ে উঠে যাচ্ছিল সিলিং বরাবর। প্রতিদিন ঠিক সন্ধে হলেই কোথা থেকে যেন আসে। নিজস্ব ব্যস্ততায় ঘুরে বেড়ায় দেওয়ালময়। তারপর কোনও এক সময় নিভৃতে বসে বুনে ফেলে নিজের জাল। বড়ো অবাক লাগে ওর। হ্যাঁ, অবাকই লাগে। ভয় লাগে না। মনে হয় না দশ হাত দূরে পালায়। কখনও কি ভাবতে পেরেছে যে ঘৃণ্য প্রাণীটিকে দেখলেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠত! সেই রক্ষা করবে ওকে! তাহলে কি সতর্ক করতেই আসত সে! এসব কি বিশ্বাসযোগ্য? কে বিশ্বাস করবে এসব! কেউ না করুক সৌরীশ তো জানে কী বিপুল ঝড় বয়ে গেছে ওর জীবনের উপর দিয়ে। চোখের সামনে দেখেছে, যা দেখলে বিশ্বাস হয় না, হয় ভয়। জাগে বিস্ময়। কী করে একটি ক্ষুদ্র প্রাণী আকার নিতে পারে দানবসম? কী করে অতলে তলিয়ে যাওয়া সৌরীশের শরীরটাকে নিমেষে এনে আটকে রাখতে পারে এমন কোনও নিরাপদ জায়গায় যেখানে বিপদের কোনও সম্ভাবনা নেই? সে সময় সেই বোধটুকু আসেনি সৌরীশের মনে, মস্তিষ্কে। আচমকা পড়ে যাওয়ায় শরীর জুড়ে পূর্ণ হয়েছিল আসন্ন এক মৃত্যু ভয়। শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের শিথিল ভাব কাটিয়ে উঠতে পারছিল না যেন কিছুতেই। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল প্রতিমুহূর্ত। চোখের সামনে নেমে এসেছিল এক পরত কালো। জ্ঞান ফিরেছিল বেশ কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে। কারা যেন ডাকছিল। চোখ খুলতেই দেখেছিল, পাহাড় বেয়ে নেমে আসছে ক্রেনের দড়ি। সঙ্গে জনা দুয়েক লোক। মাথাটা ঝিম ধরেছিল তখন। বন্ধুদের মধ্যেই কেউ পুলিশে খবর দিয়েছিল। অ্যাম্বুলেন্স-এ উঠতে উঠতে দেখেছিল চারপাশের উদ্বিগ্ন মানুষের ভিড়। কৌতূহলী চোখ নিয়ে সবাই কেমন যেন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু বন্ধুদের কাউকেই চোখে পড়েনি তখনই। স্যালাইন, ইনজেকশনে নার্সিংহোমের দিনগুলোয় শুধু উত্তর খুঁজেছে। কেন? কী করে হল এমন? পুলিশ কয়েকবার এসেছিল জেরার জন্য। বন্ধুদের মুখে চরম বিপদের কথাটা শুনে অসম্ভব মনোকষ্টে কাটিয়েছে রাতের পর রাত। মলিন আজও ফেরেনি। সে রাতে ওর পড়ে যাওয়ার পর ফিরে আসছিল ওরা। তাড়াহুড়োতে বিপুল, সুনীল কিছুটা এগিয়ে গেছিল। আর তখনই শুনেছিল মলিনের ভয়াল চিৎকার। তন্নতন্ন করে চুলচেরা খুঁজেও কোত্থাও পাওয়া যায়নি মলিনকে। সৌরীশ এসবই অফিসারদের বলেছে। তা বিশ্বাস হয়নি অফিসারদের। কিন্তু যা ও বুঝেও বলতে পারেনি সেসব কথা অফিসারদের অজানাই থেকে গেছে। দেরাদুনে ছেড়ে যেতে পারেনি। কী যেন প্রবল আকর্ষণ ওকে আটকে রেখেছে।

বছর চারেক পেরিয়ে গেছে। সৌরীশ অতীতের স্মৃতিকে ভাবে, বারেবারে মন চায় কলকাতা ফিরে যেতে। কিন্তু পারে না। সে রাতের ঘটনার পর মনে হয় এখানে এমন কেউ আছেন যিনি হয়তো… কিন্তু তা কি সম্পূর্ণ সত্য? না, তা নয়। প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য মানুষ কখনও ভুলতে পারে না। মস্তিষ্কের অবচেতন মন তা ভুলতে দেয় না। এসব সম্ভবনার সঙ্গে সঙ্গে প্রচ্ছন্ন এমন কিছু লুকিয়ে আছে, যাকে অস্বীকার করবে কী করে? যতবার সাক্ষাৎ হয়েছিল প্রাণীটির সঙ্গে ততবারই মনে হয়েছে, ঠাম্মুমের গায়ের গন্ধটা কী করে পায় ও? তাতেই সন্দেহ হয়েছিল। আর তপোবনের ঘরে দেখা সেই ফ্রেম! যার সামনে এখনও বসে আছে ও। লাল, নীল সুতোর প্রতিটা কাজ। প্রতিটা বুনন তো একেবারেই ওর ঠাম্মুমের মতো। যাকে ও ছোটো থেকে নিজের মা বলেই মনে করে এসেছে। নিজের ঠাম্মুম, সেই মা আকাশের তারা হয়ে যাওয়ার পর থেকেই। তবে দেরাদুনে সেটি আসবে কীভাবে? কিন্তু প্রকৃত মা হয়তো কোনওদিন তার সন্তানকে ছেড়ে যেতে পারেন না। আর তাই হয়তো যে প্রাণীর ভয়ে আতঙ্কিত সৌরীশ, তার শরীরেই নিজস্ব পরিচয় রেখে গেছেন প্রাণীরূপী জীবনদাত্রী। সে কে? প্রকৃত দেবী, নাকি অন্যকিছু তা জানে না। জানে তার সেই প্রখর দৃপ্ত চোখ, যা ওকে নিরাপদে রেখে হারিয়ে গেছিল সেই গহিন বনে। কোন অজানায়। সৌরীশ নিজের অসহায় শরীরকে বোঝাতে চেয়েছিল সেই দেবীরূপী প্রাণীর ইশারা। যে ইশারায় ছিল হয়তো ওর প্রাণহানির মতো কোনও বিপদের সংকেত। কখনও ভাড়াবাড়ির ছাদে, কখনও ঘরে কিংবা কখনও অস্তিত্বের পরত বুঝিয়েছে সে সেসবই। মিষ্টি গন্ধ, ঠাম্মুমের অস্তিত্ব, তাঁর হাতের বুনন এসবে হয়তো বোঝাতে চেয়েছে সে, তাঁর অস্তিত্ব নিরাপদের। তাঁর অস্তিত্বে ভয় নেই। আশঙ্কা নেই। প্রিয়জনের মতো তাঁকেও বিশ্বাস করা যায় ভয়হীন চোখে। কিন্তু মানুষ সহজাত, সহজ বোঝে না। পরিবর্তে আঁকড়ে ধরে নকল। সৌরীশও তাই করেছিল। নীল আলোর অনুসন্ধানে গিয়ে বিস্মিত হয়েছে চরম। কিন্তু সেই বিস্ময়েই প্রকৃত সত্যের কিরণ পড়েছিল ধনৌল্টির কোনও এক শুভ্র, নির্মল প্রভাতে। জ্ঞান ফিরে দেখেছিল, পাহাড়ের গায়ে গায়ে অজানা শিস গেয়ে উঠছে কোনও দৈব সাহসে। বিপদসংকুল পথের পাকদণ্ডী বাঁক হঠাৎ করেই যেন হয়ে উঠেছিল পবিত্রতার স্বাক্ষর। বাতাস জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল সোনালি দৃপ্ত আলোর প্রথম পদক্ষেপ। সৌরীশ চায় এমন প্রভাত বারবার ফিরে আসুক। যেখানে ভয় নয়, হিংসা নয়, অবিশ্বাস নয়, বিশ্বাস জন্ম নেবে নতুন করে। নতুন করে কেঁদে উঠে কোনও সদ্যোজাত বলতে চাইবে, আগামীর দিন যেন হয়ে উঠুক এমনই নির্ভীক।

অনুশোচনার সকাল

চার দেওয়ালে আর থাকতে পারেনি সে। বেরিয়ে পড়েছিল নিজেকে বিষমুক্ত করতে। ফিরে পেতে সেই সহজ স্বাভাবিক দৃষ্টি, যা মনে করায় কত রামধনুর সকাল। কেন? কেন হিংস্র হিংসা এসে জড়ো হয়েছিল ওর মনে? কেন মনে হত কেউ না কেউ যেন ওর থেকে এগিয়ে না যায়! ভালোর মুখোশের আড়ালে কেন যে দিন দিন বেড়ে উঠছিল অন্যায়ের ঘর তা নিজেও জানে না ও। আর তাতেই জমছিল বিষ, নীল বিষ। চরম শাস্তি পাচ্ছে এখন। কোথাও এতটুকু আশ্রয় পায়নি। সুস্থ মানুষের পক্ষে সত্যিই তো ওকে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সত্যি! সত্যি এ এক অসম্ভব বাস্তব। যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা দুরূহ। অথচ স্পষ্ট ফুটে উঠছিল ওর সামনে সেই অবয়ব। যা নেহাতই আজগুবি গল্পের মতো শুনেছিল দেরাদুনের অলিতে গলিতে। মাকড়সা? তাও পাহাড় প্রমাণ? দেবী? রক্ষা করতে আসেন? পাগলের মতো হাসতে শুরু করে ও। দেবদারুর শক্ত ডাল হাতে নিয়ে আছড়ে ফেলে সামনের বুনো ঝোপ ঝাড়ের মধ্যে। খসখস করে একটা শব্দ করে কী যেন দৌড়ে পালিয়ে যায় গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে। পালিয়ে তো ও যেতে চেয়েছিল! কিন্তু পারল না। পা বাড়ানোর মুহূর্তেই সামনে এসে দৈত্যের মতো দাঁড়িয়েছিল ঠিক ওর পথ আটকে। মুখ দিয়ে নির্গত হচ্ছিল দানবীয় যান্ত্রিক আওয়াজ। প্রথম চোটে বিশ্বাস করতে পারেনি। এ কী চোখের সামনে? শরীরের সব রক্ত যেন জল হয়ে আসছিল। দৌড়ে পালানোর শক্তিটা চিরকালের মতো হারিয়েছিল। কেউ পাশে ছিল না। কাজটা হওয়ার কয়েক মিনিট পর যখন নিশ্চিন্ত হয় ও। নাটক করেছিল বন্ধুদের সঙ্গে। বোঝাতে চেয়েছিল বিপুল, সুনীলকে যে ও কিছুই জানে না। ওরা তখনই আর কেউ দাঁড়ায়নি। পুলিশ ডাকতে এগিয়ে যাচ্ছিল ত্রস্তপায়ে। নিজে আরও কিছুটা নিশ্চিত হতে ও ইচ্ছে করে আস্তে হাঁটছিল। বুঝতে সত্যিই কি ওর পরিকল্পনা ঠিক পথে এগিয়েছে? আর ঠিক তখনই চোখের সামনে যেন আটপেয়ে নরক এসে দাঁড়িয়েছিল। কোনওরকমে হাতড়ে গাছের ডাল নিয়ে আক্রমণ করতে গিয়েছিল। মাথার ঠিক ছিল না কিছুমাত্র। যে করে হোক পালাতে হবেই। কিন্তু কাল নেমে আসছিল আকাশ চিরে। ঠিকরে পড়ছিল একটা নীল জোরালো আলো। প্রবল সেই আলোর তেজে ঝলসে যাচ্ছিল ওর চোখ, মুখ, গোটা শরীরটা। ও যেন নিজেকেই নিজে চিনতে পারছিল না। অদ্ভুত আচরণ করছিল শরীরের শিরা-উপশিরা। শরীর ছাপিয়ে অন্য এক মানব বেরিয়ে আসতে চাইছিল। আর পালাবার পথ ছিল না। চোখ বুজে আস্তে আস্তে দেখেছিল কঠিন পায়ে আঁকড়ে অদ্ভুত আক্রোশে এক রোমশ শরীর যেন বুকের উপর নামছে একটু একটু করে। উফ্‌, ভয়ংকর সে দৃশ্য! ভয়ংকর সময়! কান ফাটানো চিৎকারে খান খান হয়ে যাচ্ছিল জঙ্গলের নীরবতা। চিৎকার বললে ভুল হবে। আর্ত কান্না। ঠিক যেমনটি শুনেছিল সেই গল্পকথার মতো। এ কান্না দানব নয়, মানবেরও নয়। তীব্র আক্রোশে পৃথিবীর সমস্ত স্তব্ধতাকে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছিল এক ভয়ংকর শিশু কান্না। কী অসহনীয় সে চিৎকার, সে কান্না! এ কি বাস্তব, না ভয়ংকর কোনও নারকীয় গল্পের পাতা থেকে উঠে আসা আশ্চর্য জীব! এই গল্পকথার মতো করেই তো একদিন ও নিজের কথায় রং চড়িয়েছিল। ভেবেছিল ওর কথাতেই হয়তো সমস্তটা পালটে যাবে। ভয় পেয়ে সরেও যাবে পথের কাঁটা। হ্যাঁ, কাঁটা নয়তো কী!

এত বছর কলকাতার বাইরে চাকরি করে নিজের যে দক্ষতা অর্জন করেছিল মলিন তা যেন এক নিমেষে নষ্ট করে দিচ্ছিল সৌরীশ। টিম লিডার থেকে ম্যানেজমেন্ট পর্যন্ত সবাইকে নিজের হাতে করে নিতে চেয়েছিল ও। আর তাই তো তেরাগাঁওয়ের গল্পগুলো আরও বানিয়ে বানিয়ে বলেছিল ওকে। মনে হয়েছিল ছেলেটা ভীতু। মা-বাবা নেই। ওর কথায় কাজ দেবে। এমনকি সৌরীশের নির্ভরশীলতার সুযোগ নিয়ে মলিন নিজে দেরাদুন ছেড়ে যাওয়ার কথাও বলেছিল যাতে একা থাকার ভয়ে ও ফিরে যায় কলকাতায়। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। একটা বছরের পরেও সৌরীশ টিকে ছিল অফিসে। এদিকে ইনক্রিমেন্টের সময় এগিয়ে আসছিল। অফিসের ম্যানেজমেন্ট থেকে জানতে পেরেছিল টিমের সব দায়িত্ব দেওয়া হবে সৌরীশকে। যদিও মলিন সিনিয়র থাকবে, তাও সমস্ত খুঁটিনাটি যে সৌরীশের হাতেই, এটুকু বোঝার মতো ক্ষমতা ওর হয়েছিল। আর তাতেই মনের ভিতরটা তীব্র জালায় জ্বলে উঠেছিল। পাহাড় দেখাবার নাম করে ধনৌল্টি আসার সিদ্ধান্তটা ওরই। কেউ জানে না, মনের মধ্যে অসম্ভব হিংসা আর স্বার্থপরতার আগুন জ্বলতে জ্বলতে প্ল্যানটা করে ফেলেছিল মলিন। ঠিক ভোররাতের অন্ধকারে যদি গভীর জঙ্গলের মধ্যে কোনওভাবে সৌরীশকে এনে ফেলা যায় তাহলে চিরদিনের মধ্যে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে পারবে যে করে হোক। সুযোগটাও যেন এসে গেছিল কী করে! কোনও এক পশুর ডাক শুনে পালিয়ে গেছিল স্থানীয় গাইডরা। বাকি দুই বন্ধুকেও আড়াল করে কাজটা করা এমন কিছু কঠিন হয়নি। সৌরীশকে ধাক্কা মেরে খাদে ফেলে দিয়েছিল নির্বিঘ্নেই। কেউ টের পর্যন্ত পায়নি। বিপুলরাও ভেবেছিল দুর্ঘটনা সবটাই। আধঘণ্টা মতন অপেক্ষা করে পুলিশ ডাকার ব্যস্ততায় বন্ধুরা এগিয়ে গেছিল। আর ঠিক তখনই অসম্ভব দৃঢ়তায় হাওয়ার বেগে সামনের এসে দাঁড়িয়েছিল আটপেয়ে কালো মাকড়সা। চোখ বুজে আসার আসে পর্যন্ত শুনেছিল তার সেই কান্না, হুবহু শিশু কান্নার মতো। মনে পড়ে যাচ্ছিল দেরাদুনের আড্ডায় বসে শোনা সেই গল্পটা যেটা সুনীল বলত বারবার। বলত, তেরাগাঁওয়ে যখন মড়ক লাগে হঠাৎ করে কোথা থেকে ঘরে ঘরে অসম্ভব বেড়েছিল মাকড়সা। তাদের আর্তনাদ নাকি হুবহু কোনও সদ্যোজাত মানবসন্তানের মতো। গ্রামবাসী ভাবে, দেবী নিজের বেদনা এভাবেই মানবের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ব্যক্ত করেন। কোনও এক প্রবীণকে স্বপ্ন দিয়েছিলেন দেবী—দেবী মাকড়সা। পৃথিবীর কোনও এক স্বপ্ন শহরে যখনই নেমে আসে কালোর প্রলেপ, তিনি আসেন। হত্যা করেন অশুভদের। পৃথিবী শুরুর পর্বের আদিমের মতো সৃষ্টি করেন নতুন প্রাণের। তেরাগাঁওয়ের প্রতিটা পরিবার থেকে কোনও এক অজানা কারণে সদস্যদের মৃত্যু শুরু হয়েছিল। ঠিক সেই সময়ই নাকি একটি করে শিশু জন্মের সংবাদ আসছিল অন্য কোনও পরিবার থেকে। প্রবীণ পুরোহিত, এমনকি গ্রামের মানুষ ভেবেছিলেন হয়তো এসবই দেবীর কৃপায়। টানা বারো বছর, এক যুগ চলেছিল এই শুভাশুভের দ্বন্দ্ব। তারপর দেবী চলে গিয়েছিলেন। স্বপ্নে বলেছিলেন, আবার আসবেন, যখনই এ গ্রামের সন্তান বিপর্যস্ত হবেন। আজও তারা সেসব মানেন। দেবীর স্বপ্নাদেশে নাকি তাঁর রূপ অনেকটাই মাকড়সার মতো লাগে। সেই বৃদ্ধ আজ বেঁচে নেই। কিন্তু তাঁর বংশধরেরা আজও দেবীর আদেশ মেনে চলেছে। গভীর জঙ্গলে লোকচক্ষুর আড়ালে দেবীর বার্তা আসে সেই পুরোহিতের বংশধরের কাছেই। গিদ্ধরের আর্ত সুরে এ-শহরের মানুষ অবহিত হন বিপদ আসন্ন। দেবীর কৃপায় মানবের শুভকামনার জন্য ভেট চড়ানো হয় দেবীর নির্দেশিত জায়গায়। গল্পকথাগুলো খুব মেকি মনে হয়েছিল। কিন্ত গুজব কথার প্রতিটা সত্যি হয়ে ধরা দিয়েছিল চোখের সামনে। আছেন। তিনি আসেন। খুব অনিবার্যভাবেই আসেন। আসেন নতুন সূর্যের কিরণ হয়ে। প্রথম সূর্যালোকের আলোয়। সেই প্রখর রশ্মি নিদারুণ শাস্তি হয়ে জমাট বেঁধে ওঁরই চোখে। এ পিশাচ চোখের পিশাচ, দৃষ্টি তো কেউ সহ্য করতে পারবে না। মলিন দেখেছে, ওর চোখের সাদা অংশ আর সাদা নেই, জমাট বেঁধেছে ঘোর নীলে। নীল বিষে! এর থেকে নিষ্কৃতি কোনওদিনই পাবে না হয়তো মলিন। মনের সমস্ত ধুলো কি মুছে ফেলতে পারবে? একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে ওঠে গলার মধ্যে। নাহ্‌, কোনও জনপদ নয়, সমগ্র পাহাড় খুঁজে বেড়াবে ও। সৌরীশকে খুঁজে বের করতেই হবে। ওর হাতে শাস্তি পেলে তবেই তো মুক্তি ওর! ওর পিশাচ দৃষ্টি, এ-বিষ যে তবেই ধুয়ে যাবে!

মলিন চাদরে মুড়ে নেয় নিজেকে। ঢেকে নেয় চোখ, চোখের দৃষ্টি। আড়াল করে নিজেকে। এগোতে থাকে ওক-পাইনের জঙ্গল ধরে। অসংখ্য পাতায় পাতা ঘষে বনময় অনুরণন ওঠে। কানে কানে কেউ যেন কিছু বলে। সবার অলক্ষ্যে একটা কালো লোমশ মাকড়সা স্থির হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে কোনও এক বৃহৎ গাছের কোটরে। বিষ, ছড়িয়ে পড়লেই নিমেষে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে সে। কে সে? মলিনের পথ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে একটা তীব্র তেরছা আলো। সে আলোর রং কখনও নীল, সে আলোর রং কখনও কমলা, কখনও হলুদ। সবুজ গন্ধ মেখে সে আলোর ব্যাপ্তির হদিশ কেবল মিত্রর কাছে। যে মিত্র আমাদের গ্রহময় জীবনের প্রকৃত প্রাণধারক। তিনিই মিত্র, তিনিই কিরণ, তিনিই সূর্য। তিনিই সব অন্ধকারের বিনাশ। মিত্রর দেখানো পথেই কি মলিন খুঁজে পাবে তার মিত্রকে? উত্তরটা হয়তো কারুরই জানা নেই।

অলঙ্করণঃ মৈনাক দাশ

 জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

12 thoughts on “উপন্যাস মিত্র ও মিথ রুমেলা দাস শরৎ ২০১৯

  1. খুব সুন্দর হয়েছে। একদম অন্যরকম, এত সুন্দর ফ্লো আছে একটা, টেনে রাখে পাঠককে। নতুন রকমের প্লট সেই সাথে বর্ণনা, খুব ভালো লাগল।

    Like

    1. খুব ভালো লাগল। ঝরঝরে গতিশীল উপন্যাস। প্লট ও অভিনব।

      Like

  2. ভাষা, শব্দ চয়ন প্রশংসনীয় । প্প্রাঞ্জল বর্ণনা । অভিনব প্রচেষ্টা । এক কথায় বলতে গেলে ভালো হয়েছে ।

    Like

Leave a comment