শাশ্বত করের আগের উপন্যাস পানডুবরা
সোনার কন্যে সুলুং টুং
শাশ্বত কর
সুলুং টুং দো
এই সবকিছুর শুরু সেই দিন, যেদিন কিনা ইশকুলের সব্বাইকে লুকিয়ে তেরাই, উরুম আর আমি তেতলার ছাতের উত্তর কোণের সেই ঘরটায় ঢুকে পড়েছিলাম। উরুমটা তো ভিতুর ভিতু রাম-ভিতু! খালি উঠব না, যাব না এইসব করছিল! বলছিল, “বাবা রে! যদি ধোপধারি-স্যার দেখে ফেলে! যদি পিংরোকে বলে দেয়!”
ধোপধারি-স্যার এখন আমাদের ক্লাস টিচার আর পিংরো হল উরুমের বাবা। কী ভাবছ, তা আমি বেশ জানি! কী আর বলব বলো, উরুমটা তো এমনিই হাঁদা। নইলে বাবাকে নাম ধরে কেউ ডাকে! উরুমের দাদু অবশ্য বলেন, পিংরোকাকু বাড়ির ছোটো ছেলে বলে সবাই তাঁর নাম ধরেই ডাকে, আর সেই দেখাদেখি উরুমও ডাকে। ভাবো তো, কী বুদ্ধির কলসি! আর তাছাড়াও, পিংরোকাকু মোটেই ভয় পাওয়ার মতো কেউ নন। ছোট্টখাট্টো মানুষ। মসুর ডালের বড়ির মতো লাল পুঁচকু নাক। চোঙা টুপিখানা মাথায় দিয়ে রোজ সকালে খেবরুর পথ ধরে খামার বাড়ি যান। আমি দেখি তো। মাঝে মাঝে দেবদারুগাছের মোটা গুঁড়িটা ধরে ঘুরপাক খেতে খেতে চিৎকার করে ডাকি, ‘পিইইংরোওও কাআআকুউউউ…!’
পাহাড়ের ওপারের জঙ্গল থেকে কে যেন অমনি আমার ভেংচি কাটে। অবিকল আমার মতো করে বলে! পিংরোকাকু সেই শুনে ঘাড় দুলিয়ে হাত নেড়ে হাসতে হাসতে চলে যান।
তারপর আবার ধরো কোনও কোনও বিকেলবেলায়, সূর্য যখন লোপলাডিহার মাঠের উই কোণের পাইনবনের পিছনদিকে চলে যায়, পিংরোকাকু বাড়ি ফেরেন। হাতছানি দিয়ে তখন কাকু উরুমকে ডাকেন। উরুমকে একা ডাকলেই হল? আমিও চলি উরুমের পাশে পাশে তুড়ুরুং তুড়ুরুং করে লাফাতে লাফাতে। কাকু আমায় দেখেই বলেন, “কই রানিমা, ফুল হাতটা দেখি তো!”
যেই না হাত পাতা, অমনি হাতে একটা পিচ নয়তো এতগুলো বনকুল! কাজেই বলো, পিংরোকাকুকে ভয় পাওয়ার মতো কিছু আছে?
তবে হ্যাঁ, ধোপধারি-স্যারকে ভয় পাওয়ার কিন্তু অনেক কারণ আছে। উরে বাবা! যেমন দিম্মার আচারের বোয়ামের তলার মতো মোটা কাচের চশমা, তেমনি মোটা নাকের নীচে চিমড়ে পানা তিড়তিড়ে গোঁফ। স্যার যখন রেগে যান, মোটা মোটা গালগুলো লাল হয়ে যায় আর গোঁফের কোনা দুটো তিড়তিড় করে নড়ে। ছোটো চোখগুলো তখন আরও ছোটো ছোটো হয়ে যায়। ঠোঁটদুটো যেন নীচের দিকে ঝুলে পড়ে। অমনি করে চুপ করে তাকিয়ে থাকেন তো থাকেনই। তারপর হঠাৎ করে টেবিল হাঁকড়ে ‘হাঁইই’ করে চেঁচিয়ে ওঠেন যখন, কতজন তো কেঁদেই ফেলে! আর যারা কাঁদে না, তাদেরও বুকের ভিতর ধমধম করে, কনকনে ভয়ের হাওয়া থরথরিয়ে কাঁপিয়ে দেয়।
ইশকুলের প্রথমদিনেই ধোপধারি-স্যার প্রেয়ার লাইনে বলে দিয়েছিলেন, ইশকুলের আদবকায়দা সব মানতেই হবে, নইলে বিকেলবেলাতেও ছু্টি মিলবে না। আর সেই নিয়মকানুনের মধ্যেই একটা হল ছাতে যাওয়ায় মানা। এবারেও ক্লাস টিচার হয়ে ঘরে এসেই ধোপধারি-স্যার হাতের লিকলিকে বেতটা টেবিলে চাপড়ে সবার উপর দৃষ্টি চড়িয়ে বলেছিলেন, “তেতলার ছাতে যাওয়া কিন্তু এক্কেবারে নিষেধ!”
কিন্তু কী করি, যে কাজখানায় যত বারণ সেটা তত বেশি করতে মন চায় আমার। কাজেই টিফিনবেলায় সবাই যখন কৌটো খুলে খায়, হুড়মুড় করে নীচের মাঠে দৌড়োদৌড়ি করে খেলে, আমি পা টিপে টিপে উঠে যাই তেতলায়। ছাতে ঢোকার লোহার গেটটা তো রোজ বন্ধই থাকে, তাতে কী! পাল্লাটার একদিক ঠেললে যেটুকু ফাঁক হয়, সেখান দিয়ে অনায়াসে গলে যাওয়া যায়। এভাবেই ছাতে আসি আমি। আসব নাই বা কেন বলো তো? ছাত থেকে কতদূর পর্যন্ত দেখা যায়! কেমন সুন্দর দেখায় পাহাড়ের কোলে আমাদের ছোট্ট গ্রামখানাকে! লোপলাডিহার মাঠটাকে দেখলে মনে হয় যেন দেবী সিংডিহা শুয়ে আছেন। দেবদারুর বন যেন তাঁর মাথার মুকুট। ক্ষেতগুলোর কোনোটা কমলা, কোনোটা সবুজ, আবার কোনোটা হলুদ। আর কত্ত যে পাখি ছাতের আলসে জুড়ে বসে, সে তোমায় আর কী বলব! যেই না দৌড়ে যাবে, অমনি উড়তে উড়তে ওই দূরে সিংলির চুড়োর কাছে জমে থাকা আকাশখানায় মিশে যাবে।
যেদিকটায় সিংলির চুড়ো, সেদিকেই ছাতের মাঝখানে একখানা ঘর। দরজা বন্ধ। দরজার উপরে লেখা, ‘নো অ্যাডমিশন’। কী আছে ওই ঘরের ভিতরে? দরজার নিচ দিয়ে, জানলার পাল্লা খানিক ঠেলে দেখার চেষ্টা করি, কিন্তু এত অন্ধকার যে কিছুই দেখতে পাই না।
একদিন হয়েছে কী, অমনি করেই নিচু হয়ে দরজাটার তল দিয়ে দেখার চেষ্টা করছি, এমন সময় কাঁধে কার হাত! ওরে বাবা, ধোপধারি-স্যার নাকি? ভয়ে তো আমি আর তাকাতে পারি না। শেষমেশ বন্ধ চোখের ফাঁক দিয়েই খানিক তাকালাম। ওফ্! যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। ধোপধারি-স্যার নন, টুংলুদাদু আমার কাঁধে হাত রেখেছিল। এই গোটা ইশকুল বাড়িটা টুংলুদাদু দেখেশুনে পাহারা দিয়ে রাখে। আমাদের খুব ভালোও বাসে। আমার দাদুর কাছেও প্রায়ই যায় টুংলুদাদু। চা খায়, মুড়ি আর পাঁপড় ভাজা খায়, কত গল্প করে।
টুংলুদাদু বলল, “দিদি, উপরে এসেছ কেন? সারজি দেখলে তো রাগ করবে! পালাও, পালাও! আর এসো না কখনও।”
আমি কি পালানোর মেয়ে? টুংলুদাদুর আঙুল ধরে বললাম, “স্যার জিজ্ঞেস করলে বলব, তোমার সঙ্গে এসেছি, তা হলেই স্যার আর আমায় বকবে না।”
“কী সাংঘাতিক তুমি, দিদি!” টুংলুদাদু হাউমাউ করে উঠল, “এই বুড়োমানুষটার চাকরি চলে যাবে যে!”
“কেন? চাকরি যাবে কেন? তোমার নাতনিকে তুমি ছাতে আনতে পারো না? এ আবার কেমন চাকরি?”
টুংলুদাদুর নাতনি মিয়া আমারই বন্ধু। কিন্তু ওরা এখন এখানে থাকে না। শহরে বাবার সঙ্গে থাকে। মিয়া চলে যাবার পর থেকে টুংলুদাদু আমাকে আরও বেশি ভালোবাসে। পরবের সময় যদি মিয়া আসতে না পারে, তো আমাকেই মিঠাই খাওয়ায় টুংলুদাদু।
আমার এই কথা শুনে টুংলুদাদু ঝুঁটি দুটো নেড়ে দিয়ে বলল, “খুব কথা শিখেছ তো দিদি!”
আমি কিছু বলি না। কেবল দাদুর আঙুলখানা আরও জোরে চেপে ধরি।
টুংলুদাদু বলে, “ছাতে আসতে যে সব্বার মানা দিদি। কেন জানো তো?”
মাথা নেড়ে বললাম, “কই, জানি না তো!”
“তুমি ভুজুঙ্গা, সাবরিও এদের কারও কথা শোনোনি?”
অবাক হয়ে বললাম, “কই, না তো!”
“সে কি! সবাই জানে, আর তুমি জানো না?”
মাথা নাড়লাম। টুংলুদাদু হাতের খুরপিটার দিকে খানিক চেয়ে হাঁটতে হাঁটতে ছাতের অন্যদিকটায় গেল। সেখানে টিউলিপের বাগান। কেমন সুন্দর ফুল ধরে ডাঁটিগুলো সটান দাঁড়িয়ে। আর কী উজ্জ্বল রঙ! মাটি উসকে দিতে দিতে বলল, “ভুজুঙ্গা হল এক ভয়ানক দত্যি। কত লম্বা জানো? উই যে দূরে পাহাড়টা দেখছ, উই পাহাড়টাকে পুরো দু’বার বেড় দিতে পারে এমন লম্বা! আর ইয়া মোটা! জ্বলজ্বলে লাল লাল চোখ। চেরা জিভ যখন মুখের বাইরে হিলহিলায়, কেউ দেখলেই বুকের রক্ত শুকিয়ে পাথর!”
“বাবা! ভুজুঙ্গা কি তাহলে সাপ?”
“সাপ না দিদি, ও হল ড্রাগন।”
“ড্রাগন? তার মানে তো ও মুখ থেকে আগুন ছাড়ে।”
“ছাড়েই তো! রেগে গেলেই ওর নাকমুখ থেকে আগুন বেরোয়। গাছপালা পুড়ে যায়। ঝোরা, নদী, বাঁওড়, দহ—সব শুকিয়ে যায়।”
“তা তো হওয়ারই কথা দাদু। ড্রাগন তো এমনই হবে। কিন্তু ও কি দুষ্টু? সবার ক্ষতি করে?”
“না রে দিদি। দুষ্টু নয়। ভালো মানুষদের ও কিছু করে না। আসলে ও আর ওর তিন ছেলে উই পাহাড়িখানা পাহারা দেয়।”
“কেন? সেখানে কী আছে?”
“সেখানে তো কিছু নেই দাদু। আছে তার পরের পাহাড়িতে।”
“ওর পরেও পাহাড় আছে?”
“আছেই তো। এই পাহাড়ের পরে আছে কলমডিলার পাহাড়। তারও পরে আছে ফুলটুংলির স্বপ্ন পাহাড়। সেখানে থাকেন সাবরিও। এইসব পাহাড়-জঙ্গল-ঝরনা-নদীর দেবতা সাবরিও। ঠিক রাজাও নন। রক্ষাকর্তা।” বলেই টুংলুদাদু খুরপি ধরা হাতের কবজিটা কপালে ঠেকিয়ে তিনবার মাথা নোয়াল। মানে হল দাদু প্রণাম করল। কাউকে শ্রদ্ধা জানাতে হলে আমরা এভাবেই জানাই।
বললাম, “দাদু, সে না হয় হল। কিন্তু তার জন্যে ছাতে আসা মানা কেন?”
“ওমা! সেটাই বলিনি বুঝি? দেখো তো কেমন বাহাত্তুরে ধরেছে আমায় দিদি! সাবরিওর কথা বললাম না দিদি, এই ঘরটা যে তেনার, তিনি যে এখানেই থাকতেন। এই গোটা ইশকুল যে তাঁরই বাড়ি। অবশ্য তোমারও বাড়ি বটে।”
টুংলুদাদু শেষকথাটা বলে কেমন একটা চোখে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমি সে ব্যাপারটায় মন না দিয়ে বললাম, “সাবরিও তার মানে এই গ্রামেরই মানুষ, কেমন কিনা টুংলুদাদু?”
“সে তো বটেই দিদি। তবে সে বহুকাল আগের কথা।”
“তোমার ছোটোবেলার কথা?”
“না রে দিদি, তারও অনেক আগের। তবে কিনা এই ইশকুল তৈরি আমার ছোটোবেলায়। দিদি রে, তুমি বরং তোমার দাদুর কাছে জিজ্ঞেস কোরো, উনি আমার থেকে আরও ভালো জানেন।”
“কেন, তুমি জানো না?”
“আমি জানলেও দিদি, কতটুকু আর জানি! তোমার দাদু জানেন সব। কত বড়ো বংশ তোমাদের! সেখানেই তো…”
টুংলুদাদুর কথাটা শেষ করতে না দিয়েই জিজ্ঞেস করলাম, “তাহলে সাবরিওর এই ঘরের জন্যেই কাউকে ছাতে আসতে দাও না তোমরা?”
“তাইই তো! সাবরিওর পুরো বাড়িটাই তো আমরা নিয়ে নিয়েছি। কেবল তাঁর নিজের ঘরখানা নাহয় তাঁরই থাক। তিনি তাঁর যখন ইচ্ছে নাহয় এই ঘরখানাতেই এসে থাকুন।”
“তিনি আসেন?”
“আসেনই তো।”
“কখন?”
টুংলুদাদু মাথা-টাথা ঝাঁকিয়ে বলে উঠল, “না না, আর আমি কিছু বলব না। সেসব তোমার শোনার নয়। তুমি দিদি এখন সোজা নেমে তোমার ক্লাশে চলে যাও।”
টুংলুদাদুও বলল, আর আমিও চলে গেলাম, সে আবার হয় নাকি! ঘ্যান ঘ্যান করতে শুরু করলাম, “ও দাদু, বলো না, ও দাদু, বলো না!”
বাবাও বলে আমার ঘ্যান ঘ্যান বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না, আর টুংলুদাদু! কাজেই শেষমেশ বলেই দিল।
বছরে যেদিন প্রথম বরফ পড়ে, সেদিন থেকে পরপর সাতদিন সাবরিও উড়ো বরফের ঝুরো ডানায় ভেসে ভেসে এই ঘরে ঢোকে। ওই দিনগুলোয় টুংলুদাদু ঘর পরিষ্কার করতে এলে দেখতে পায় ঘরের আসবাবে শুকনো ঘাস, ফুলের মতো ঝুরো ঝুরো তুষার জমে আছে। অথচ জানালা-দরজা সব বন্ধ। ঘরের ছাতেও কোথাও ফুটো নেই।
টুংলুদাদুর কাছ থেকে কথাগুলো শুনে নীচে চলে এলাম। ততক্ষণে টিফিন শেষ হবার ফার্স্ট ওয়ার্নিং বেলও পড়ে গেছে। তেরাই আর উরুমকে সব বললাম। ওদেরকে তো বলতেই হত। প্রাণের বন্ধু বলে কথা!
তেরাই তো আমাদের বাড়িতেই থাকে। ও আমার পিসতুতো বোন। তেরাই আসলে ওর ডাকনাম। ভালো নাম রাঞ্ঝিয়া।
এই, আমার নামটা জানো তো? কী বলছ, জানো না? জানবেই বা কেমন করে? আমি তো বলিইনি। আর বলবই বা কেন, বলো? তুমি তো জানতেও চাওনি! কী বললে, সুযোগই পাওনি জানতে চাওয়ার? সে হতে পারে বাপু। সবাই তো বলে আমি নাকি খুব বেশি কথা বলি। এমনকি একা-একাও কথা বলি। বাবা এজন্য আমায় কী বলে জানো? বলে তুলুং ঝোরা। জলের মতো কথা নাকি কেবল ঝরেই চলে, ঝরেই চলে! আর দাদু আমায় বলে ভুট্টার খই। ফটফট ফটাস আওয়াজ নাকি কেবল হয়েই চলেছে মুখ থেকে।
যাক গে। জিজ্ঞেস করলে যখন, তখন বলেই দিই নামটা। আমার নাম হল সুলুং। সুলুং টুং দো। কেউ বলে সুলু, কেউ বলে সু, কেউ ডাকে সুলুং, আর দাদু ডাকে সুলুং টুং। ওই ডাকটাই আমার সবচেয়ে প্রিয়।
রেনোলাবিলার আলো
ওই যে ঢালু ঝুরঝুরিয়া রাস্তাটা, ওই বরাবর চোখটা সোজা উত্তরে সরাও। কী হল! থুত্থুড়ে দেবদারুগাছটা দেখতে পাচ্ছ কি না? দাদু বলে, ওটা নাকি সবথেকে পুরনো গাছ। ওর গোড়ার কাছ থেকে শুঁড়িপথটা নামছে দেখছ? কী বলছ, দেখতে পাচ্ছ না? তা পাবেই বা কী করে! মোটা গুঁড়িটায় পথখানা ঢাকা পড়েছে যে! ওই গলতাটা ধরেই যদি এট্টুখানি এগোও, দেখতে পাবে চোঙা টুপি পরে উবু হয়ে বসে একজন একমনে ঝুড়ি বুনছে। যদি তার গায়ের রঙ আমার মতন, তবে নিশ্চিন্তি সে আমার দাদু। আর যদি তা হয় জমা মেঘের মতন, তবে সে আমার বাবা। ওদের পিছনেই যে ছোট্টো মিষ্টি দোতলা কাঠের বাড়িটা, ওটাতেই তো আমরা থাকি। অনেক পুরনো বাড়ি কিন্তু, জানো! বাড়ি ঘিরে যত মোটা মোটা গাছ দেখতে পাও, তাদের সব্বার বয়স কিন্তু এই বাড়ির চেয়ে কম। আমাদের বাড়িতে একটা নিয়ম আছে। নতুন কেউ জন্মালেই তার যখন একবছর বয়স হবে, তাকে দিয়ে একখানা গাছ পোঁতানো হবে। বড়দাদু, দাদু, ঠাম্মার গাছগুলো যদি দেখো, গোড়াগুলো ইয়া মোটা মোটা। ঠাম্মারটায় তো আবার শ্যাওলার চাদর। ঠাম্মার আবার খুব ফুলেরও শখ ছিল। গোলাপের ঝাড় ছিল, রাসনা ছিল, বল লিলি, স্পাইডার লিলি, কলাবতী, মাধবীলতা, চন্দ্রমল্লিকা, তারা গাঁদা, গাইলার্ডিয়া, স্যালভিয়া, গোলাপ—কতসব ফুলের ঝাড়! এখনও আমাদের বাড়ির আনাচেকানাচে তুমি গাইলার্ডিয়া আর স্যালভিয়ার ঝোপ দেখতে পাবে। কেউ পোঁতে না। বর্ষার জল পেলেই একাই ফনফনিয়ে ওঠে। স্যালভিয়ার ঝোপে যখন ফুল আসে, লাল টকটকে সেই ফুলের ডাঁটার আশেপাশে সারাদিন প্রজাপতি ওড়ে, কুচকুচে কালো মোটা মোটা ভোমরা ভনভনায়, মৌমাছিরা গুনগুন করে। আমাদের এখানের মৌমাছির সাইজ জানো? এক-একটা আমার এই বুড়ো আঙুলের মতো!
আমাদের অনেক ভেড়াও আছে। রাবিংলা ভেড়াগুলোকে চড়ায়। ওর বাবাকে আমি টুনাইজেঠু বলি। টুনাইজেঠু ভেড়ার লোম বেড়ে গেলে ছেঁটে দেয়। সেই লোম তারপর একদিন এসে নিয়ে যায় জোহারকাকু। সেই দিয়ে কারখানায় কোট বানানো হয়, টুপি বানানো হয়। দাদু তো সেই টুপিই পরে।
ওই যাহ্! ভুলেই গেছি। আজ তো দাদুর দেওয়া দুল পরবার দিন! ওই যে গো, সেই ঝুমকো দুলটা গত বুধবার দিল না! আরে ওইদিন যে আমার জন্মদিন ছিল! দাদু তাই তো সক্কালবেলা আদর করে হাতে দুল দুটো দিয়েই বললেন, “এ তোমার ঠাম্মার রাখা দুল গো দিদি! আজ যে তুমি দশ বছরের হলে। তাই তো তোমায় দিলাম।”
দাদুর আক্কেলখানা দেখো! আরে, দুল আমি পরব কেমন করে! বলি, আমার কি কানে ফুটো আছে? মা যে কান বিঁধতেই দেয়নি ব্যথা লাগবে বলে।
তো দাদু সেকথা শুনে বলে কি, “তাই তো! তাইলে চলো দিদি, আগে আজ্জুর কাছ থেকে তোমার কান বিঁধিয়ে আসি।”
যেই না বলা, অমনি হাউমাউ করে মায়ের সে কী কান্না! তারপর বাবা কত বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করল মাকে, আর আমিও চললাম দাদুর সঙ্গে আজ্জুকাকার দাবাখানায়।
আজ্জুকাকা ভেড়ার বাচ্চার গল্প করতে করতে কখন যে টকাস টকাস করে কান বিঁধল, বুঝতেই পারলাম না। কান বিঁধে সেখানে ওষুধ মাখা সুতোর রিং পরিয়ে দিল কাকু। আজ সেই সুতো খুলে দুল পরার দিন। কী মজা!
তেরাইকে সেই কথাটা বলতে বলতে তুড়ুড়ুং তুড়ুড়ুং করে লাফাতে লাফাতে ইশকুল থেকে ফিরছি। হঠাৎ দেখি কী, লোপলাডিহার মাঠের শেষে উই যে ধোঁয়া ধোঁয়া আরামডিলা পাহাড়, তার মাথার উপর দিয়ে মুকুটের মতন রামধনু উঠেছে। তেরাইকে দেখালাম, উরুমকে দেখালাম। কী আশ্চর্য! ওরা কেউই দেখতে পেল না! কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি! রামধনুটার রংগুলো ক্রমশ যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। সব রং মিলেমিশে কেমন যেন কেবল কমলা রংটা ফুটে উঠছে। আর সে কী জেল্লা!
“দেখ উরুম! তেরাই দেখ! ওই কমলা ধনুক থেকে কে একজন যেন ভেসে উঠছে! দেখ, ভালো করে দেখ কেমন আশমানি জোব্বা, মুকুটে টকটকে লাল পাথর!”
উফ্! কী জ্বলজ্বল করছে পাথরটা! আর তাকাতে পারছি না। চোখ সরাতেও পারছি না। উফ্! উফ্! আমার চোখ ঝলসে যাচ্ছে।
চোখটা বন্ধ হয়ে আসছে আসছে এমন সময় সে রঙের ঝাঁঝ কমে গেল। কিন্তু এ কী! সেই আশমানি জোব্বা পরা লোকটার চোখে যেন জল! কী দুঃখ ওর?
“উরুম রে! আমার কেন মনে হচ্ছে বল তো, ও আমার খুব চেনা? কেন মনে হচ্ছে ওর ওই চোখের জল আমি ছাড়া আর কেউ মুছে দেওয়ার নেই? কে ও? অমন করে ডাকছে কেন আমায়? দেখ দেখ তেরাই, কেমন করে দু’হাত ছড়িয়ে আমায় ডাকছে! ওর চোখ থেকে যে জল ঝরেই চলেছে! ওর কাছে আমায় যেতেই হবে রে উরুম। আমি চললাম, আমি চললাম…”
দৌড়োলাম সেই আলোর ধনুকের দিকে। আমার তখন দিগ্বিদিক জ্ঞান নেই। দু’পা দৌড়তে না দৌড়তেই মুখ থুবড়ে পড়লাম মাটিতে। গড়িয়ে যেতে যেতে কীভাবে যেন সামলে ফের দৌড়তে গেলাম। কে যেন আমায় ধরে রেখেছে। শক্ত করে ধরে রেখেছে। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না। ওদিকে ধনুকের রং আবার উজ্জ্বল হতে শুরু করেছে! আর পারছি না, আর তাকাতে পারছি না! রং বাড়তে বাড়তে একসময় দপ করে নিভে গেল আর অমনি আমার চোখেও নেমে এল ঘুটঘুটে এক অন্ধকার চাদর।
চোখটা খুলতেই যেই মায়ের মুখটা দেখলাম, অমনি জড়িয়ে ধরলাম মাকে। সে তখন এক হুলুস্থুলু কাণ্ড। এ কাঁদে, ও বকে, সে জানতে চায় কী হয়েছিল… ভাগ্যিস দাদু ছিল! সব্বাইকে বকে বলল, “ওকে বিশ্রাম করতে দাও। আমি বলছি।”
দাদু তারপর বললে, “সুলুং যে আলোটা দেখেছিল, তা আমারও চোখে পড়েছিল। অবাক হয়ে সেই আলোটা দেখতে-দেখতেই কেন জানি না সুলুংয়ের মুখটা চোখে ভেসে উঠল। আর তক্ষুনি কে যেন আমার মনের ভিতর থেকে বলে উঠল, ‘বুড়ো সামরু, বসে না থেকে দৌড়োও! তাড়াতাড়ি নাতনির কাছে যাও। সে যে রেনোলাবোলার আলো দেখে বিপদের মুখে দৌড়োচ্ছে!’
“শুনেই পড়িমড়ি করে দৌড়ে এসেই দেখি সুলুং আমার উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়োতে দৌড়োতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে। উঠে ফের দৌড়োতে যাচ্ছে। তক্ষুনি তার হাতটা চেপে ধরলাম। কিন্তু ধরলে কী হবে, এই আমি, এই বুড়ো সামরু বলছি, সুলুংয়ের গায়ে তখন সে কী জোর! কিন্তু জোর হলেই বা পারবে কেন? আমিও যে সামরু বুড়ো! আজও তো এই পাহাড়-গাঁয়ের পালোয়ানেরা আমার কথায় কপালে হাত ঠেকায়। তবুও এই আমাকেও গায়ের সব জোর দিয়ে আটকাতে হয়েছে আমার সুলুংকে। তারপর যখন জ্ঞান হারাল, কোলে করে মাকে এনে তুললাম বাড়িতে। তারপর এই সাত ঘণ্টা পরে চোখ মেলল আমার সুলুং। কাজেই ওকে আর এখন কেউ বিরক্ত কোরো না। আরাম করতে দাও।”
“কিন্তু সামরু, তুমি তো জানো, রেনোলাবোলার আলো দেখার মানে। তুমি তো জানো এরপর কী করতে হয়।” ভিড় থেকে বলল বুড়ো হিংরো।
দাদু বলল, “জানি। কিন্তু তার আগে তো মেয়েটাকে সুস্থ হতে দাও।”
মা হঠাৎ আমার জামাটা খামচে ধরে কেঁদে উঠল। “না, না! আমি আমার সোনাকে কোত্থাও যেতে দেব না!”
আমি আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করি, “কোথায় যেতে দেবে না মা?”
মা কিছুই বলে না। খালি কাঁদে আর কাঁদে। শেষটায় আমি দাদুকে ডাকলাম।
দাদু বলল, “কীগো দিদি?”
“মা কোথায় যেতে দেবে না বলছে দাদু?”
দাদু বলে, “সে অনেক কথা গো দিদি। এখন তুমি আরাম করো, আমি পরে বলব তোমায়।”
“না না দাদু, দেখো, আমি ভালো আছি। বলো আমায়।”
মাথার চোঙা টুপিটা খানিক টেনে কান দুটো ঢেকে নিয়ে দাদু বলল, “বেশ। তবে শোনো।
“সে অনেকদিনের কথা। এই উপত্যকায় তখন না ছিল কোনও পাহাড়, না ছিল কোনও নদী। ছিল এক সবজে গালচে মোড়া মাঠ, মাঠভরা রঙবেরঙের ফুল। বলতে পারো বসন্ত যেন ঘাঁটি গেড়ে বসে সেই দিগন্ত জোড়া মাঠে। এমন সুন্দর দুনিয়ায় কোত্থেকে উড়ে উড়ে আসত পাখির ঝাঁক। কত্ত রকম! কেবল পাখিই বা কেন, এই স্বর্গ দেখতে কত মানুষ আসত দেশবিদেশ থেকে! এই উপত্যকার মানুষদের মনও জানো দিদি, এখানকার ফুলের মতন সুন্দর! বিদেশ থেকে উড়ে আসা পাখিদের যেমন আশ্রয় দিত দেবদারু-পাইনের ডাল, তেমনি বিদেশ থেকে আসা মানুষদের আশ্রয় দিত এখানকার সব লোক। সব্বার বাড়িতে একটা দুটো ঘর ফাঁকা থাকতই অতিথিদের জন্যে। অতিথিরা থাকতেন বাড়ির একজন হয়ে।”
এটুকু বলে নিয়ে দাদু থামলেন। হাত দুটো মাথার উপর তুলে নিয়ে আড়মোড়া ভাঙলেন। তারপর একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে বললেন, “কিন্তু দিদি রে! সব গাছে যেমনি এক ফুল ফোটে না, তেমনি সব মানুষের মনও একরকম হয় না। এমন সুন্দর দেশেও একদিন মেঘ ঘনাল। আকাশের মেঘ নয় সে, সে হল মনের মেঘ। সে মেঘ এমন ঘন, যে মন এক্কেবারে অন্ধকার। সেই অন্ধকারের কালো মন নিয়ে একদল মানুষ এল সেবার। তারা মানুষ অবশ্য নাও হতে পারে, হতে পারে মানুষের বেশে কোনও জীব। সেই জীব এসে উঠল সাবরিওর বাড়ি।”
সাবরিও! এই নামটা তো আজই শুনলাম টুংলুদাদুর কাছে। আমাকে নড়েচড়ে বসতে দেখেই দাদু বলে উঠল, “বুঝেছি দিদি, টুংলু এসেছিল, সব বলে গেছে। তুমি বরং শান্ত হয়ে বাকি গল্পটা শোনো।”
এর মধ্যেই কখন যেন উঠে গিয়ে মা চা করে এনেছে। চায়ের ধোঁয়ায় মুখটা খানিক ডুবিয়ে নিল দাদু। এটা অবশ্য আমারও অভ্যাস। গরম বাষ্পে মুখ ডুবিয়ে বের করে আনলে যে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ছোঁয়া লাগে না হাওয়ার, সেইটা আমার খুব প্রিয়।
যাই হোক, ধোঁয়া থেকে মুখ তুলে মগে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে ভেজা ভেজা গলায় দাদু ফের বলতে শুরু করল, “সেই লোকজন তো উঠল এসে সাবরিওর ঘরে। আর ঠিক তার দু’দিন পর থেকেই কেমন করে জানি ভালো মানুষেরা হারিয়ে যেতে থাকল বরমডিলা থেকে। কোথায় যে হারিয়ে যায়, কোনও খোঁজ মেলে না! যে বরমডিলায় শোনা যেত পাখির গান, সেখানে তখন কেবল হারিয়ে যাওয়া মানুষদের শোকে কান্না। শুধু কি তাই? ধীরে ধীরে শুকিয়ে গেল গাছের ফুল, খেতেই পচল ক্ষেতের ফসল, মেঘ নেই তবুও ধাঁই ধাঁই বাজ পড়ল। শান্তির বরমডিলায় অশান্তির মেঘ নেমে এল।
“কিন্তু সাবরিও তো যে সে মানুষ নয়। তারও কি ক্ষমতা কম! এই পাহাড়দেশের সব পাখি, সব প্রজাপতি, সব ভেড়া, সব হরিণ তার অনুচর। সবচেয়ে বড়ো অনুচর হল লাংমোর দল।”
“লাংমো? সে আবার কী?”
“লাংমো হল দিদি এই অ্যাত্তটুকুন মানুষ। বড়োজোর তোমার হাঁটুর মতন উঁচু। কিন্তু ছোট্টো বলে তাদের যেন কম ভেবো না! তারা জাদু জানে। বর্ষার আগে তারা সারসের পিঠে চেপে মেঘে মেঘে জল ভরে, শীতের সময় তারাই তো গাছের পাতা ঝরায়, বসন্তের শুরুতে পাতায় পাতায় রঙের তুলি বোলায়, কুঁড়ি আঁকে, পাঁপড়িতে রং ছড়ায়। এত কাজ করে অথচ কেউ তাদের কোনোদিন দেখতে পায় না। পায় কেবল সাবরিও। সাবরিও যে তাদের বন্ধু!”
“বাবা!”
“হ্যাঁ, দিদি! এই এত্তসব বন্ধুদের কাছ থেকে সবকিছুই জেনে গেছিল সাবরিও। তাই সব্বাইকে নিয়ে তৈরিও হয়েছিল। কেবল অপেক্ষা ছিল, ওই না-মানুষদের হাতেনাতে ধরবার। তাও হল।
“সে এক শুক্লা চতুর্দশীর রাত। ফুটফুটে জোছনায় পুরো বরমডিলা মায়ায় ভরে আছে। চাঁদ আকাশ-পথে চলতে চলতে খানিক ক্লান্ত হয়ে মেঘের গুহায় খানিক জিরিয়ে নেবে বলে ঢুকেছে, এমন সময় হঠাৎ হুউউউউ করে কীসের যেন রক্ত জল করা চিৎকার! মেঘের ভিতর থেকে তারপর বিদ্যুতের মতো ঝলকে নেমে এল যেন কী এক জিনিস। ভয়ে চাঁদ লুকোল আরও গহিন মেঘে। অন্ধকার লোপলাডিহার মাঠে সেই জান্তব চিৎকারের সঙ্গে-সঙ্গেই ভেসে উঠল পাঁচ পা আর দুই মাথাওয়ালা ভীষণ এক প্রাণী! সঙ্গে তার ভয়ানক সব কুকুর! ভয়ংকর শব্দ করে তারা ছুটে চলল বরমডিলার বাড়িঘরের দিকে। আর তক্ষুনি রুখে দাঁড়াল সাবরিও আর তাঁর অনুচরের দল। সে কী ধুন্ধুমার! এই সাবরিও জেতে তো এই জেতে সেই পাঁচ-পেয়ে দত্যি! কিন্তু সমস্যা হল লাংমোর দলের। সেই ছোট্ট সুন্দর মানুষের দল যতই জাদু জানুক, রাক্ষুসে কুকুর দলের সঙ্গে কিছুতেই আর পেরে ওঠে না। শেষমেশ বজ্রের মতো আওয়াজে সাবরিও ডেকে আনল ভুজুঙ্গাকে। ভুজুঙ্গার সে কী রূপ! টপাটপ খেয়ে ফেলল বুনো কুকুরদের সব্বাইকে। কিন্তু সেই পাঁচ-পেয়ের সঙ্গে সেও পেরে ওঠে না। ভুজুঙ্গার আগুনে শ্বাস সেই পাঁচ-পেয়ে মুহূর্তে নিভিয়ে দেয়। ভুজুঙ্গার যে পেষণে পাহাড়ও গুঁড়িয়ে যায়, তাতেও তার কিচ্ছু হয় না। কাজেই সাবরিওকে সেই চরম পথটাই বেছে নিতে হল।”
“কী পথ?”
“বরমডিলা ছেড়ে চলে যাওয়া।”
“সাবরিও কেন গ্রাম ছেড়ে যাবে? সে চলে গেলে তো মুশকিল আরও বাড়বে!”
“না, দিদি! সাবরিও তো আর অমনি অমনি যাবে না! সে যাবে কালান্তক ঝড়ের রূপে। সেই ঝড়ে উড়িয়ে নেবে শত্রুকে। শর্ত একটাই, ঝড় হয়ে গেলে আর সাবরিও মানুষ হয়ে সবার চোখের সামনে ফিরতে পারবে না বরমডিলায়।”
“সাবরিও তাই করল?”
“তাই করল দিদি! উড়িয়ে নিয়ে গেল সেই পাঁচ-পেয়ে দু’মুখো দত্যিকে। সেই ঝড়ের অভিঘাতে কেঁপে উঠল মাটি। আর মাটির কাঁপনে মাথা তুলে জেগে উঠল তিনটে পাহাড়—এই গোটা উপত্যকার রক্ষক সেই তিন পাহাড়। আরামডিলা, কলমডিলা আর শেষেরটা হল ফুলটুংলির স্বপ্ন পাহাড়। আরামডিলার সিংলির চুড়ো বাকি দুই পাহাড়কে ঢেকে রাখে বলে তাদের দেখা যায় না। আরামডিলায় থাকে ভুজুঙ্গা। কলমডিলায় থাকে লাংমোরা।”
“আর ফুলটুংলির স্বপ্ন পাহাড়ে থাকে সাবরিও আর তার তিন ছেলে, তাই না দাদা?”
“সবাই তাই বলে বটে। কিন্তু সাবরিওর ছেলে হবে কোত্থেকে? তাঁর তো বিয়েই হয়নি!”
“আসলে ওই পাহাড় তিনটেই ওর তিন ছেলে, কেমন কিনা দাদু?”
“একদম আমার মনের কথা বললে দিদি।”
“সেই তখন থেকে সাবরিও ওখানে থাকে? এতদিন কেউ বেঁচে থাকে?”
“থাকবে না কেন দিদি? সাবরিও যে এই প্রকৃতি মায়ের ছেলে। এই উপত্যকার দেবতা। যদ্দিন এই উপত্যকা আছে, তদ্দিন তো সে থাকবেই। তারপরেও হয়তো থাকবে।” এই না বলে দাদুও টুংলুদাদুর মতো করে প্রণাম করল।
আমি বললাম, “সে তো হল। কিন্তু মা যে কোথায় যেতে দেবে না বলছিল!”
“বলি দিদি, বলি! সাবরিও তো চলে গেল। তারপর থেকে এই উপত্যকার নেতা নির্বাচন শুরু হল। সেই নেতাও নির্বাচন হল দৈব উপায়ে। যে নেতা হবে, তাকে সাবরিওই কোনও না কোনোভাবে বুঝিয়ে দেয়, আর সবাইও বুঝতে পারে সেই নির্দেশ। যে নির্দেশ পেল তাকে তখন স্বপ্ন পাহাড়ে গিয়ে সাবরিওর আশীর্বাদ নিয়ে আসতে হয়। এই আমাদের রীতি।”
এটুকু বলে দাদু একটু থামল। তারপর হাতের পানীয়তে একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে আমার দিকে চেয়ে বলল, “সেই রীতি মেনেই এতদিন আমাদের নেতা নির্বাচন হয়েছে। শেষ নেতা হয়েছিলেন আমার দাদা পিয়াংটুং।”
“আমি দেখেছি তাঁকে?”
“তুমি কী করে দেখবে দিদি! দাদা যখন বাড়ি ছাড়েন তখন তো আমিই ছোটো!”
“কত ছোটো? আমার মতো?”
“না। ওই উরুমের দিদির মতো।”
উরুমের দিদির নাম হল ইমলি। ইমলিদিদি আমাদের থেকে তিন ক্লাশ উঁচুতে পড়ে। দাদুর চোখ লক্ষ করে তাকিয়ে দেখি ইমলিদিদি ঘরের দোরের কাছে দাঁড়িয়ে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মিষ্টি করে হাসল। আমিও হাত নেড়ে ইশারা করলাম। তারপর দাদুর দিকে চেয়ে বললাম, “সেই দাদুও তো তবে গিয়েছিলেন। তবে তো সে ভয়ের জায়গা নয়। মা তাহলে কাঁদছে কেন?”
দাদু একটু থেমে বলল, “তোমায় আর কী বলি দিদি! পিয়াংটুং গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু আর যে ফিরে আসেননি! তাঁর ভাই বলে আমিই এতদিন নেতার দায়টুকু সামলে এসেছি।”
এটুকু বলতেই দেখলাম মা ফের দুই হাতে মুখ ঢাকল।
এইবার আমিও বুঝতে পারলাম মা কেন কাঁদছে। আর সত্যি বলতে কী, মাকে অমন করে কাঁদতে দেখে আমারও মনে বেজায় দুঃখ হল। গলার কাছে জমে থাকা দুঃখটাকে যেই না ভ্যা করে বের করে দিতে যাচ্ছি, অমনি কানের ভিতর ফিসফিস করে কে একটা কথা বলেদিল, আর কী আশ্চর্য, আমিও সেই কথাগুলো একেবারে পাক্কা দিদিমণির মতো থেমে থেমে বলতে থাকলাম।
“মা আমার, তুমি চিন্তা কোরো না। রেনোলাবোলার জ্যোতিতে যখন ডাক এসেছে, যেতে যে আমায় হবেই। তবে মা, আমি যাবও, আবার খুব শিগগির ফিরেও আসব। আর একা তো যাব না! দাদু আমার সঙ্গে যাবে। উরুম আর তেরাই আমার সঙ্গে যাবে। কিচ্ছু ভয় নেই।”
কথাগুলো বলে ফেলেই আমি চমকে উঠেছি! এই গলার স্বর, এই বলার ধরন তো আদৌ আমার নয়! তাকিয়ে দেখি ঘরের আর সবারই একই দশা। মা তবুও কী একটা বলতে গেল, দাদু তার আগেই বলে উঠল, “না দিদি, সবকিছুর সময় আছে। তুমি এখন খুবই ছোটো। সেখানে যাওয়া তোমার তাই সাজে না। আর তাছাড়া সেখানে একা যেতে হয়, কাউকে নিয়ে নয়।”
অবাক হবার তখনও অনেক কিছুই বাকি ছিল। কারণ, দাদুর কথা শেষ হতে না হতেই সেই ফিসফিসানি স্বর আমায় দিয়ে ফের কথা কইয়ে নিল, “না দাদু! সাবরিওর ডাক যার কাছে আসে, সে চাইলে সঙ্গে নিতে পারে। সিলিওংমায় তেত্রিশ নম্বরে লেখা আছে। খুলে দেখো।”
কথাটার পরেই ফের সবাই হাঁ! হাঁ তো হবারই কথা। যে মেয়েটা এইমাত্র শুনল সাবরিওর কথা, তার মুখে কিনা সিলিওংমার কথা!
সিলিওংমা কী বলো তো? সিলিওংমা হল আমাদের জন্যে সাবরিওর নির্দেশনামা। সেখানে আমাদের সমস্ত করণীয়, নিয়মকানুন লেখা আছে। পরে দাদার কাছে শুনেছিলাম, সেখানে নাকি ঠারেঠোরে আমার মতো একটা মেয়ের কথাও বলা আছে।
সে যাই হোক, আমার মুখ থেকে ওই কথা শোনার পরেই তো সব্বাই চুপ। হঠাৎ বাজারের গয়না দোকানের লিম্বোদাদু, ‘হো সাবরিও! হো হো, হো সাবরিও!’ বলে দুই হাত একবার উপরে তুলে আর পরক্ষণেই একেবারে মাথাসুদ্ধু ঝুঁকিয়ে প্রণাম করতে শুরু করল। ওমা! দেখাদেখি একে একে সব্বাই ওইরকমভাবে পরপর প্রণাম করতে লাগল। কেবল দাদু চুপ করে হাতের চেটোয় থুতনিটা রগড়াতে থাকল আর মা ফের দুই হাতে ঢেকে নিল চোখ।
যাত্রা শুরু
এত সুন্দর নদীটা, যে অনায়াসে তুমি ছবির মতো বলতেই পারো। জল বয়ে যাওয়ার বিরাম নেই। কুল কুল কুল কুল করে শব্দ হয়েই চলে, হয়েই চলে। আর তার জল তো যেন কাচ। নীচের পাথর, রঙ্গিলা নুড়ি সব দেখতে পাওয়া যায়।
নদীর দুই ধারে বন। অবশ্য ঠিক করে বললে একেবারে ধারে নয়। মানে হলটা কী, এই যে নদীটা, মানে যেখানটা দিয়ে জলধারা বইছে, সেই ধারাটার দুই পাড়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে পাথর আর পাথর। সাদা আর রুপোলি গোল গোল ডিম ডিম খরবুজা অথবা তরমুজ কিংবা রাগবি বলের মতো পাথর। তার খাঁজে খাঁজে কোথাও মাছের কঙ্কাল। কোথাও কোথাও আবার নদী বেজায় সরু, সেখানে আর পাড়ে পাথর নেই। বাঁকে বাঁকে মোটা মোটা গাছের শিকড় জলের তলে ডুবে ডুবে। গাছের ডালগুলো ঝুঁকে ঝুঁকে এ-ওর হাত ধরে আছে।
তেরাই বলল, ও নাকি বইতে পড়েছে, পাহাড়ি ভালুকের দল এইসব নদী থেকে পাঞ্জা ডুবিয়ে মাছ তুলে আনে। সেই মাছের খানিকটা তারা খায় আর বাকিটা ফেলে রাখে এই পাথরে। পাখিরা কখনও খায়, কখনও বা এমনিই পচে মিশে যায়। কে জানে বাবা, এখানেও তেমন ভাল্লুক আছে কি না! আর থাকলে থাকবে। ভাল্লুক, উল্লুক, বাঁদর, হরিণ সব্বাই তো এখানে সাবরিওর অনুচর। আর আমরা হলাম সাবরিওর খাস অতিথি। কাজেই আমাদের ভয় নেই।
সেই পাথুরে বিছানা পেরিয়েই বন। ইয়াব্বড় বড়ো গাছ। তাদের কারও কারও ডাল থেকে আবার অর্কিড ঝুলছে। তাদের ফুলের যে নীল, বেগুনি, গোলাপি, হলদে—কত্ত কী সুন্দর রং, সে আর তোমায় কী বলি! তবে কিনা গাছগুলোর মাথা একে অন্যের সঙ্গে মিলে আকাশটাকে যেন প্রায় ছেয়েই ফেলেছে। ফলে ভাপা পিঠের মতো গোল গোল হয়ে রোদ্দুর এসে পড়ছে মাটিতে। এখন তো সূর্যের তেজ অমনিই কম। বেলা যে ঢলে এসেছে।
আমরা সেই নদীতে মুখ ধুয়ে যেই না পাড়ের দিকে উঠেছি অমনি হুড়মুড় করে জল খেতে এল হরিণের দল। এই যে আমরা চার-চারটে মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছি, তাদের একটুও পাত্তা দিল না! আর কত যে রকম তাদের! কারও শিং আছে কি না বোঝাই দায়, আবার কারও বা মাদারগাছের ডালের মতো বাঁকা শাখাওয়ালা শিং। কারও বাদামি গা, তো কারও বা পাকা খড়ের মতো হলদে গায়ে শিমুল তুলোর মতো সাদা ছোপ। বাচ্চাগুলোর ফূর্তি তো সবচে’ বেশি। তুলুং তুলুং টুড়ুং টুড়ুং করে লাফিয়েই যাচ্ছে। বড়োরা ততক্ষণে নদীর জলে মুখ ডুবিয়েছে।
আমরা পাড়ে উঠে এসে একটু ভিতরের দিকে ছায়া জমা একটা পাইনগাছের নীচে বসেছি। হঠাৎ দেখলাম, হরিণগুলো জল খাওয়া থামিয়ে কান খাড়া করে কী যেন শুনছে। মুহূর্তে কেন যেন সাড়া পড়ে গেল দলটার মধ্যে। ছুটে ছুটে পালাতে লাগল সবাই।
ঠিক তখনই কী ভীষণ শব্দে কেঁপে উঠল গোটা বন। পরপর দু’বার। মাথার উপরে গাছের ডাল থেকে উড়ে গেল পাখির ঝাঁক। কেবল জলের ধারে রইল পড়ে ছোট্ট ফুলের মতো হরিণ শিশু। বেলাশেষের রঙে রাঙা নদীর জল আরও অনেক রেঙে উঠল!
আমার চোখ থেকে টপ টপ করে জল পড়ছে তখন। তেরাই আর উরুমও কাঁদছে। দাদু আমাদের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে আস্তে আস্তে বলছে, “ভাগ্যিস দিদি! সবাই তোমরা উঠে এসেছিলে এই আড়ালটায়! নইলে…”
দাদুর কথাটা আর শেষ হল না। দেখি কী, মাথায় টুপি আর পায়ে হান্টিং বুট পরে হাতে বন্দুক উঁচিয়ে আমাদের ঠিক উলটোদিকের জঙ্গল থেকে নেমে আসছে একদল মানুষ। কেউ পাহাড়ের নয়। দেখলেই কেমন ভালো নয় বলে মনে হয়। তাদের পিঠে রুকস্যাক আর সঙ্গে বেশ কিছু কুলি। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়টা হল, যে লোকটা দৌড়ে এসে হরিণটাকে কাঁধে তুলে নিয়ে বিশ্রীভাবে হাসল, সে কিন্তু এই পাহাড়ের লোক। বেজায় পাজি বলে গোটা পাহাড়ে তার বদনাম। কুতকুতে চোখ আর হলদে খ্যাড়খেড়ে দাঁতের সেই খারাপ লোকটার নাম হল টুগ্গা।
এই লোকগুলোর কথা বলেছিল আমায় তেরাই। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার প্রায় দেড় দিন তখন কেটেছে। প্রায় অনেক পথ পেরিয়ে এসেছি। কী বলেছিল আর কখনই বা বলেছিল সেই কথাগুলো, একটু পরে না হয় বলব, কেমন? বরং তার আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ার কথাটা আগে বলে নিই।
যত সহজে এই বেরিয়ে আসার কথাটা বললাম, ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও ততটা সহজ ছিল না। মা তো রাজিই হচ্ছিল না। কারও কথা শোনে না। দুই হাতে কান চেপে থাকে আর জোরে জোরে মাথা নাড়ে। আমি কত বলি, “মা, আমায় তো যেতেই হবে, সে যে আমায় ডাকছে!” একটুও শোনে না। বলি, “দেখো দাদু যাচ্ছে, উরুম যাচ্ছে, তেরাইও যাচ্ছে আমার সঙ্গে। কই পিংরোকাকু তো একটুও কাঁদছে না! শোনো না!” কিচ্ছুতে মানে না। কেবল আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদে। মায়ের চোখে জল দেখে আমারও খুব কান্না পায়। তবুও কাঁদি না। মার দু’গালে চুমো করি, গাল থেকে জলের ধারা মুছে দিই।
শেষমেশ দাদু যখন বোঝাল, মা রাজি হল। দাদুকে যে খুব মান্যি করে মা।
আর যেই না মা রাজি হল, অমনি ভিড় উপচে পড়ল আমাদের বাড়িতে। আমার জন্যে চোঙা টুপি আর ফুল-লতাপাতা আঁকা জলপাই রঙের বিশেষ পোশাক এল। উরুম, তেরাই আর দাদুও নতুন সাজে সাজল। দল বেঁধে এল মন্দির থেকে পুরোহিতের দল। তারা সুর করে মন্ত্র আওড়াল আর ধম ধম ঢং ঢং করে ঘণ্টা পিটল। লম্বা পিলসুজে জ্বলল এই বড়ো ঘিয়ের প্রদীপ। রীতি শেষে বুড়ো পুরোহিত আমার গলায় বেঁধে দিলেন লাল রঙের এক রেশমি স্কার্ফ। দাদু বললেন, “প্রণাম করো দিদি। এই স্কার্ফ সাবরিওর আশীর্বাদ। নতুন নেতার জন্যে সাবরিওর নিশান।”
এরপর যখন আমরা রওনা হলাম, তখন কিন্তু মা আর কাঁদেনি। বরং গাল-মাথা সাপটে আদর করে বলেছে, “এসো মা আমার, সব কাজ সেরে মঙ্গলমতো ফিরে এসো।” আর দিয়েছে এক পুঁটুলি ভর্তি মুড়কি মোয়া আর ভেড়ার দুধের ক্ষীর। আমারই বরং মাকে ছেড়ে আসতে তখন খুব কষ্ট। তবুও বুঝতে না দিয়ে দুটো চুমো করেই নেমে পড়লাম রাস্তায়।
লোপলাডিহার মাঠে নেমে এলাম আমরা চারজন। আমার আর পিছনে চাওয়া মানা। তেরাই, উরুমের তো আর মানা নেই, তাই ওদের কাছ থেকেই শুনতে লাগলাম কেমন করে সব্বাই সামনে ঝুঁকে ঝুঁকে প্রার্থনা করছে আমাদের জন্যে আর মা আমার কেমন করে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেবদারুগাছটায়।
ট্রি-হাউসে
যে ফুলের ক্ষেতটা ইশকুলের ছাত থেকে এক্কেবারে ছবির মতো দেখায়, হাঁটতে হাঁটতে সেইখানে তখন আমরা। কিন্তু কী আশ্চর্যের কথা বলব ভাই, যেখানে এসে পড়েছি সে কিন্তু ফুলের ক্ষেত ঠিক নয়, বরং ফুলের অরণ্য বলা যায়। চারধারে শুধু বড়ো বড়ো গাছ। রঙিন। কেবল রঙিন বললে অবশ্য ছবিটা ভাবা মুশকিল। ব্যাপারটা কী জানো, সেই গাছগুলো ছিল আগাপাশতলা রঙিন। মানে কাণ্ডেরও যেই রং, পাতারও সেই, আবার মাথা ছেয়ে থাকা ফুলেরও সেই। কারও রং পাহাড়ি জবার মতো টকটকে, তো কারও আবার পাকা সোনার মতো উজ্জ্বল। কোথাও হলুদ, তো তার পাশেই ঘন আশমানি। সে জন্যেই তো দূর থেকে অমন দেখাত।
দাদু কী বললে জানো? বলল, “এ হল পরিচড়ার মাঠ। পুন্যিমার রাতে এ মাঠেই নেমে আসেন পরিদের রানি। তাঁকে ঘিরে আর সব পরিরা হাত ধরে ধরে ঘুরে ঘুরে নাচে গায়।”
দাদুকে জিজ্ঞেস করলাম, “পুরো পথটাই কি তুমি চেনো?”
দাদু বললেন, “এ পথে তো আমাদের আসা এমনিতে হয় না দিদি, তবে কী আর বলি, ছেলেবেলা থেকেই আমি ছিলাম বেজায় ডানপিটে আর ডাকাবুকো। বেশ কয়েকবার আমি ওই আরামডিলার আগ অবধি গেছি।”
“ও বাবা! কই, একথা আগে কখনও বলোনি তো!”
আমার কথা শুনে উরুম বলল, “ভালোই তো হল রে! ভুল পথে যাবার আর কথাই রইল না।”
তেরাই বলল, “আরামডিলা আর কতদূর, দাদু?”
দাদু একটু থমকে চারপাশটা দেখে নিয়ে বলল, “তা ধরো না কেন, দিনে দশ ঘণ্টা যদি হাঁটি, তো আরও প্রায় দেড় দিন।”
তেরাই বলল, “ও বাবা! কতদূর গো!”
উরুম বিজ্ঞের মতো বলে উঠল, “ঘাবড়াচ্ছিস কেন তেরাই? আমরা তো সবাই একসঙ্গেই আছি। দেখতে দেখতে ঠিক পৌঁছে যাব।”
দাদু উরুমের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “তা ঠিকই বললে উরুমদাদা। দেখতে দেখতেই পার হওয়া যাবে বটে। কতরকমের যে অদ্ভুত জিনিস, সেসব দেখতে দেখতে তোমার চোখ এক্কেবারে কৎবেলের মতো গোল্লা গোল্লা হয়ে যাবে।”
ইস! কী কথাটাই বলল দাদু! নামটা শুনেই জিভে জল চলে এল। তেরাইদের বাড়িতে একটা কৎবেলের গাছ আছে। ছোট্ট ছোট্ট সেই বেলগুলো দিয়ে ঝাল ঝাল করে মেখে পাথুরে পাঁচিলে পা দুলিয়ে দুলিয়ে চাটতে যে কী সুখ! উল্লুস!
উরুমটা যেন কী! আমি বলে স্বাদের আরামটা মন থেকে জিভে পাবার চেষ্টা করছি, আর ও কিনা পড়ে আছে কী কী অদ্ভুত দেখবে সেই নিয়ে! তেরাইটাও তো সেইরকম। উরুম ঘ্যানাচ্ছে ঘ্যানাক, তোরও তাতে যোগ দেওয়ার কী?
দু’জনের ঘ্যানরিতে শেষপর্যন্ত দাদু বলে উঠলে, “শুনে নিলে তো আশ্চর্য হওয়ার মজাটাই নষ্ট রে! বরং নিজেরাই দেখবি।”
“না না, কিচ্ছু নষ্ট হবে না। তুমি বলো, তুমি বলো।” উরুম আর তেরাই একসঙ্গে ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকল।
দাদু আর কী করে, শেষমেশ বলল, “বেশ বেশ। বলছি শোন। এই ধরো না কেন আর খানিক বাদেই তোমরা গিয়ে পড়বে অদ্ভুতুড়ে গাছেদের দেশে। পাকানো দড়ির মতো তাদের গা উই আকাশে উঠে গেছে। আর তাদের পাতা সব ইয়া ইয়া লম্বা আর লিকলিকে। যেন বুড়ো কোনও দাদামশাইয়ের আঙুল। আর সেইসব আঙুলগুলো সব আকাশের দিকে ওঁচানো। তারপর ধরো…”
এরকম গল্প করতে করতে খেয়ালও করিনি কখন যেন ঢুকে পড়েছি এক বনে। ঘন বন। অচেনা সব গাছ। মাটিতে সেইসব গাছের গোল গোল সব পাতা পড়ে আছে। ঠিক যেন দাদুর ভাত খাবার থালা। সেইসব পাতার তল থেকে জুলজুল করে চেয়ে আছে কত যে কাঠবিড়ালি, সে আর কী বলি! আমাদের শব্দ পেতেই তারা কিচকিচ করে ডেকে উঠল, পালাল না কিন্তু। বরং যেন হেলতে দুলতে হেলতে দুলতে কাণ্ড বেয়ে, ঝুরি বেয়ে উঠে পড়ল উপরে। আরও আশ্চর্য কী জানো? যে কাঠবিড়ালিটা আর সবার থেকে গাবলুগুবলু, সেইটা করল কী, আমার চোখের সামনে একটা ঝুরি ধরে দুলতে দুলতে কিচকিচ করে কী যেন বলতে থাকল আর আঙুল উঁচিয়ে ইশারা করতে থাকল। সেদিকটায় তাকিয়েই দেখি, আরে! এই তো সেই গাছ! এই তো সেই লিকলিকে আঙুলের মতো পাতা! চেঁচিয়ে বললাম, “দাদু দাদু! দেখো দেখো!”
আমার চিৎকার শুনে ওরা ফিরল যেই অমনি তেরাই আর উরুম একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, “ঠিক বলেছিস সু! ঠিক বলেছিস। ওই দেখ কেমন আঙুলের মতন পাকানো পাকানো পাতা! আর ওই দেখ কেমন লাল নীল সব বল ঝুলছে!”
দাদু বলল, “ওগুলো বল নয় রে, দাদারা। ও তো ফল। একটা মজা দেখবি?”
এই না বলে যেই না দাদু সেই ফল পাড়তে হাত বাড়াল, ওমা! অমনি সেই লাল নীল বলের মতো ফলের ঝাঁকা তুড়ুং করে লাফিয়ে উঠে গেল নাগালের বাইরে। দাদু যত লাফিয়ে লাফিয়ে ধরতে যায়, তত লাফিয়ে লাফিয়ে ফলগুলোও উঁচুতে ওঠে।
দাদু চেষ্টা করল, উরুম চেষ্টা করল, তেরাই চেষ্টা করল—কেউ পারল না। কিন্তু আমি যেই না হাত বাড়ালাম, অমনি সেই ফল নিজে থেকে নেমে এল আমার হাতের তেলোয়। কী নরম! কী তুলতুলে সেই ফল!
দাদু বলল, “দেখলে দিদি? এখান থেকে সব্বাই কেবল তোমারই কথা শুনবে।”
বলতে না বলতেই হল কী, কোত্থেকে এই টুকুটুকু সবুজ পাখি, ন্যাজে তাদের কাঠির মতো কী জানি দোলে, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এল। মাটি থেকে কাঠি তুলে, গাছ থেকে সোনালি লতা তুলে ঠোঁটে নিয়ে ভারি ব্যস্তসমস্তভাবে বড়ো একটা ডালে কী জানি কী করতে থাকল। এত পাখি, এত পাখি, কিচ্ছুটি ভালোভাবে দেখা যায় না। কেবল তাদের ডানার ফড় ফড় ফড় ফড় আওয়াজ। কী আর করা, রইলাম বসে আমরা সেই গাছের তলায়।
জানি কী ভাবছ। তারা তাদের কাজ করছে করুক, আমরা কেন নিজেদের পথে এগোলাম না, তাই না? সে চেষ্টা কি আর আমরা করিনি ভেবেছ? কিন্তু যেই না আমাদের মধ্যে কেউ এক পা এগোতে যায়, অমনিই সেই পাখির ঝাঁক আমাদের ঘিরে উড়তে থাকে। এক পাও এগোতে দেয় না। তো কী আর করা। দাদু বলল, চলো, এখানে একটু বরং বসেই নেওয়া যাক। তাই না আমরা বসলাম। বুঝেছ তো?
তো সেইখানে বসে গল্প করতে করতে তা প্রায় ঘণ্টা খানেক বা তারও বেশি তো কাটল, তারপর হঠাৎই সেই পাখির ঝাঁক ফুস করে গেল উড়ে। আর আমরা তো সব দেখেশুনে হাঁ! গাছের সেই ডালটায় কেমন করে তৈরি হয়ে গেছে চোখ জুড়োনো এক ট্রি-হাউস! সোনালি তার দরজা, আর জানালায় সবুজ লতার ঝালর। গায়ে রঙবেরঙের কত না ফুল!
দাদু বলল, “বুঝলে দাদারা, সাবরিও তাঁর নির্দেশ পাঠিয়ে দিল। আজ এখানেই আমাদের রাতটা কাটাতে হবে।”
শুনেই তো মন একেবারে হই হই করে নেচে উঠল। এমন ট্রি-হাউসে রাত কাটানো, এ যে স্বপ্নেরও বাইরে!
দাদু কাঁধের ঝোলা থেকে ইয়া মোটা কাছি নামাল। সেই কাছি দিয়ে ঝটপট বানিয়ে ফেলল এক দড়ির মই। মই তো বনল, কিন্তু সে মই বাঁধবে কে? সেই ডালটা তো অনেকটাই উঁচুতে আর গাছটাও তো পুরো মসৃণ। কিন্তু বললে বিশ্বাস করবে না, আমার সেই শীতকাতুরে দাদু মইটা কাঁধে ঝুলিয়ে আমার দিকে ফিক করে হেসেই ঠিক একটা শিম্পাঞ্জির মতো তুড়তুড় করে চড়ে গেল অত উঁচু ডালে। তারপর আর কী, সেই দড়ির মই বেয়ে দুলতে দুলতে হাসতে হাসতে আমরা তিনজনও উঠে পড়লাম।
আর কী বলি! সূর্যও যেন আমাদের জন্যে অপেক্ষায় ছিল। কারণ, যেমনি আমরা ঢুকলাম সেই ট্রি-হাউসে, অমনি টুক করে ডুবে গেল বড়ো বড়ো গাছগুলোর ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া সবুজ মাথার পিছনে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে ছেয়ে গেল চারপাশ।
যদি ভাবো সেই অন্ধকারে আমরা চারজন বুঝি বেজায় জব্দ হলাম, বলতেই হবে খুব ভুল ভাবছ। কারণ, অন্ধকার হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই আমাদের চারপাশটা ভরে গেছিল অদ্ভুত মিষ্টি সবুজ আলোয়। লাখো লাখো জোনাকির আলো। কত যে জোনাকি সেই ট্রি-হাউসের ছাতে আর কোনায় কোনায় জমে রয়েছে! সেই শীতল আলোয় দেখলাম ঘরের ভিতর একটা ছোট্ট টেবিলের উপর অনেক ফল। পাহাড়ি পথে পথে এতটা হেঁটে খিদেও পেয়েছিল খুব, কাজেই সবাই মিলে ঝটপট সেই ফলগুলো খেয়ে নিলাম।
ভিতরে বসে সবাই গল্প করছিলাম। ভিতরে ওই মিষ্টি ঠাণ্ডা আলো আর বাইরে জমাট বাঁধা অন্ধকারে একটানা ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। এরই মাঝে বার দুয়েক একটা আলোছায়া যেন ঘরের দেয়ালে খেলে গেল। দাদু সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেল জানালার দিকে। পিছন পিছন আমিও গেলাম। দূরে জঙ্গলের মধ্যেই কোথাও আগুন জ্বলছে বলে মনে হল। দাদুকেও কেমন যেন চিন্তিত মনে হল। বলল, “আমরা ছাড়াও আরও কেউ এসেছে। কারা তারা? কেনই বা এল? আর কারও তো আসার কথা নয়!”
তেরাই টক করে বলে উঠল, “হতে পারে টুগ্গার বাড়িতে যাদের দেখেছিলাম তারাই!”
আমরা কিছু বলবার আগে দাদুই তেরাইকে জিজ্ঞেস করল, “কাদের দেখেছিলে, দাদা?”
তেরাই বলল, “দেখেছিলাম কয়েকজন ভিনদেশিকে। ওরা সবাই চাপা গলায় কীসব যেন আলোচনা করছিল—তার মধ্যে কলমডিলা, আরামডিলা শব্দগুলো আমি চিনতে পেরেছি। এই ত্তো সেদিন গো, যেদিন সু রেনোলাবোলার আলো দেখলো! তোমরা সবাই ওকে নিয়ে চলে গেলে যখন, আমিও গেছিলাম। কিন্তু অনেকটা যাওয়ার পর খেয়াল হল কী আমার স্কার্ফটা নেই। মনে পড়ল ওটা তো মাঠেই আছে। তাই ফিরে এলাম। এসেই দেখি মাঠের কাছে দাঁড়িয়ে টুগ্গা গুণ্ডা গুণ্ডা কিছু লোককে আঙুল দিয়ে পাহাড়ের দিকে দেখাচ্ছে আর আরামডিলা, কলমডিলার কথা বলছে। আর বলছে কী যেন, ব্যানানা না কী একটার কথা। আর লোকগুলো দূরবীন দিয়ে দেখছে আর ঘন ঘন মাথা নেড়ে কীসব বলছে। ওদের একজন, মাথায় একটা খুলি আঁকা গোল টুপি, আবার একটা বড়ো নীল কাগজ খুলে তাতে কী দেখছিল।”
তেরাইয়ের কথা শুনে দাদু বেশ খানিকক্ষণ গুম হয়ে রইল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “টুগ্গাটা খারাপ হয়েছে শুনেছিলাম, কিন্তু এতটাও খারাপ হয়েছে বুঝিনি।”
বললাম, “কী হয়েছে দাদু?”
দাদু আমার দিকে চেয়ে বলল, “হয়েছে কী দিদি, ওই যে পাহাড় দেখছ, ওর পিছনে কলমডিলা। তার একটা চুড়োকে আমরা বলি কলার পাহাড়। ব্যানানা পিক। আমরা, এই পাহাড়ের সব মানুষ সেই স্থানকে অতি পবিত্র বলে মানি। এ পর্যন্ত যত নেতা আমাদের, তাদের সবার সমাধি ওইখানে বলেই আমরা মানি। সেখানে আছে আশ্চর্য সব কলার গাছ! বাজারে যেসব কলা মেলে তার থেকে এই কলা আকারে যেমন বড়ো, তেমন মিষ্টি। আর তেমনই তার ওষধি গুণ। সব রোগজ্বালা সারে ওই কলা খেলে। তবে দিদি, কেবল এই কলার জন্যেই যে ওই চুড়োর নাম ছড়িয়ে পড়েছে, তা কিন্তু নয়। শোনা যায়, সেখানে নাকি নুড়িপাথরের মতো রত্ন ছড়িয়ে। সেই মণিমানিকের লোভেই বহু বিদেশি আমাদের পাহাড়ে আসত। পাহাড়ের লোকেরা কেউ কেউ তাদের অভিযানে সাহায্য করতও। কিন্তু নিজেদের মধ্যে মারামারি, কাটাকাটি করে ক্রমশ আমাদের এই পাহাড় বিষিয়ে তুলছিল। তাই অনেক কষ্ট করে আমরা সেইসব অভিযান বন্ধ করিয়েছি। কিন্তু লোভি টুগ্গা পাহাড়ের সেই নিয়ম ভেঙে বিদেশিদের নিয়ে চলেছে সেই পুণ্যস্থানে। তবে চিন্তা নেই রে দাদা, লক্ষণ যা দেখছি তাতে এই বুড়ো সামরু নিশ্চিত, এই লোভীদের সাজার ব্যবস্থা খোদ সাবরিওই করবে।”
সবকথা শুনে আমরা শুতে গেলাম। আর অমনি কিছু জোনাকি উড়ে গিয়ে ঘরের আলোও অনেকটাই কমে গেল।
খুবরু আর মুনরো
ভোর তো সবসময়ই সুন্দর। কিন্তু এমন সুন্দর ভোর তো আমি আগে কখনও দেখিনি। ট্রি-হাউসে সেই রাত্রি ভোর হয়েছিল পাখিদের ডাকে। কমলা ঠোঁটের এক এত্তটুকুন পাখি এসে আমার কানের কাছে টেই-টেই-টুট্টুট… টুটিটু-টুইটুটু এরকম আরও কত কী বলে বলে চোখ মেলাল। চেয়ে দেখি ঘর ভরে গেছে সোনা সোনা আলোয়।
“ওই পাখি, আমি জেগেছি। এবার চুপ কর।” বলার পর তবে সে থামল। সে থামল ঠিকই, কিন্তু বাইরে যে কোরাস চলছে তাকে থামাবে কে? ওরে ব্বাবা! সে যে কত্ত কিসিমের ডাক!
তেরাই আর উরুম অবশ্য তখনও ঘুমের দেশে। দাদু নেই। দাদুর বরাবরের সকালে বেড়ানোর অভ্যেস। নিশ্চয়ই বেরিয়েছে।
দড়ির মই বেয়ে নেমে এলাম। আশেপাশের মাটি তখনও ভেজা ভেজা। রাতভর শিশির পড়েছে কিনা! ঝোপঝাড়ের পাতায় ডগায় সেই শিশির। এপাশ ওপাশ চাওয়াচাওয়ি করতে-করতেই দেখি দাঁতন হাতে দাদু আসছে। আমায় দেখেই দাদু বলল, “ঘুম ভাঙল দিদি?”
চোখ কচলাতে কচলাতে বললাম, “কোথায় গেছিলে?”
“এইত্তো সামনে। যাবে?”
ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললাম।
“তবে চলো।”
খানিক এগিয়েই দেখি পথটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে। দাদু সাবধান করল। বলল আস্তে আস্তে পা চেপে চেপে দাদুর পিছন পিছন আসতে। সেভাবেই অনেকটা এগোলাম। রাস্তাটা এবার ডানদিকে বেঁকেছে। রাস্তা অবশ্য ঠিক নয়, তবে চলা যায় এমন পথ। সে পথে চলতে শুরু করেই দাদু হঠাৎ করে সুড়সুড়িয়ে নেমে গেল বামদিকের ঢালুতে।
দাদু চেঁচিয়ে ডাকল, “নেমে এসো দিদি। এখানটা দিয়ে নামা যাবে। উঁচু উঁচু পাথরগুলোয় চেপে চেপে চলে এসো।”
পাথরগুলো ঠিক চু-কিতকিত খেলার স্টাইলে সাজানো। এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে আস্তে আস্তে নেমে এলাম। যেখানে এলাম, সে এক অদ্ভুত সুন্দর সরোবর! উপর থেকে দেখাই যায়নি। এত শান্ত সেই সরোবর যে গাছের ছায়া, আকাশের ছায়া কিছুই নড়ে না। আর তার বুকে কী সুন্দর ফুল ফুটে আছে! ফুল আছে তার পাড়েও। মানে আমরা যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছি ঠিক সেইখানটা বরাবর। এমন রঙিন ফুলের দেশে রঙিন রঙিন সব প্রজাপতি দুই পাখা মেলে উড়ছে। কী তাদের বাহার! সে বাহার বলার ক্ষমতা ভাই আমার নেই।
সরোবরের পাড়ে আমরা যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে খানিক দূরেই লম্বা লম্বা ঘাসের ঝোপ। দাদুর থেকেও উঁচু উঁচু ঘাস। ঘাসের পাতার মধ্যিখানে সাদা রঙের শিরা। সেখানে লম্বা লম্বা সাদা সাদা, তারপর হালকা গোলাপি রঙের ঘাস ফুল ফুটে আছে। মাঝে মাঝে হাওয়া দিচ্ছে, সেই তালে তালে ঘাসের দল মাথা নাড়াচ্ছে, আর ফুলের রেণু উড়ে উড়ে যাচ্ছে সরোবরের দিকে। দাদু বলল এই ঘাস শুকিয়ে গেলে তা দিয়ে নাকি ঝুড়ি বানানো যায়, বেড়াও বানানো যায়।
ঝোপটার কাছে যেতেই মনে হল ঝোপটা একটু একটু নড়ছে। দাদু আমাকে দাঁড় করিয়ে দেখতে ঢুকল। খানিক বাদেই বেরিয়ে এল আবার। হাতে একটা খরগোশ। তার লাল ছোট্ট ছোট্ট চোখ, তুলোর মতো নরম গা। কিন্তু এ কী! সেই নরম গায়ে কীসের আঘাত?
খরগোশটার পায়ের কাছে একটা লম্বা ক্ষত। দাদু বলল গুলি ছুঁয়ে গেলে অমনি হয়।
“এমন সুন্দর জীবটাকে কে গুলি মারল দাদু?”
দাদু খানিক চুপ থাকল। তারপর যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব করে বলল, “চিন্তা কোরো না দিদি, আমি ওকে ঠিক করে দেব।” বলেই খরগোশটাকে আমার হাতে দিয়ে নিজে সেই ঘাস-ঝোপের নীচে গজানো কীসব লতাপাতা নিয়ে থেঁতো করে রুমাল দিয়ে পুলটিশ বেঁধে দিল। খরগোশটা তখন আমার দিকে জুলজুল করে চেয়ে আছে। বললাম, “ভয় নেই রে! তোর নাম দিলাম খুবরু। ভালো হয়ে যাবি রে খুবরু! যদ্দিন ভালো না হোস আমাদের সঙ্গে থাকবি। আমি তোকে কচি ঘাস খেতে দেব, ফল খেতে দেব… তবে গাজর দিতে পারব না। গাজর এখানে কোথায় পাব! কী, থাকবি তো খুবরু আমার কাছে?”
“থাকবেএএ… থাকবেএএ… নিচ্চই থাকবে!”
ওমা! এ আবার কে কথা বলে! এমন বাঁশিতে ফুরর ফুরর স্বর আবার কার?
“আমি বলি গো, আমি!”
ওমা! চেয়ে দেখি সে এক ময়না পাখি। গাছের ডাল থেকে অমনি বলে চলেছে। বললাম, “ওই! নেমে আয় আমার কাছে।”
অমনি উড়ে এসে বসে পড়ল আমার কাঁধে। বলল, “মালকিন! মালকিন!”
বললাম, “ও, আমি তোর মালকিন? বেশ, তোর নাম দিলাম তবে মুনরো।”
“মুনরো মুনরো! মালকিনের মুনরো! মালকিনের মুনরো!” বলেই চলল, বলেই চলল।
দাদু হাসতে হাসতে বলল, “দিদি, চলো তবে যাই।”
আমি বলার আগেই মুনরো বলে উঠল, “বেশ বেশ, চলো যাই, চলো যাই!”
খাওয়াদাওয়া সেরে আমরা ট্রি-হাউস থেকে নেমে এলাম। এখনও যে অনেক পথ আমাদের বাকি। দল বেঁধে তাই হাঁটতে শুরু করলাম আরামডিলার দিকে। হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে এলাম ধপধপির মাঠ, সেখানে উঁচুনিচু পথে হাঁটতে গেলেই ধপ ধপ করে এমনি আওয়াজ হয় যেন মনে হয় এক্ষুনি সব ভেঙেচুরে ঢুকে যাব মাটির ভিতরে। তারপর পেরিয়ে এলাম কাঁটা ঝোপের বন। আমাদের তো হাত-পা জামা কাঁটায় কাঁটায় ছিঁড়ে একশা। ভাগ্যিস মুনরো সঙ্গে ছিল, সেই তো উড়ে উড়ে সঠিক পথে আমাদের বলে বলে নিয়ে এল! তারপর পেরোলাম দলদলের বিল। সেখানে পাতা পচে পচে এমন দলদল তৈরি হয়েছে যে, কেউ যদি একবার সেখানে পড়ে তো আর রক্ষা পাওয়ার উপায় নেই। যত ছটফট করবে, তত ঢুকে যাবে পাঁকের ভিতরে। এখানে আমাদের বাঁচাল কে জানো? খুবরু। সেই দলদলের বিলে হাঁটার জন্যে পাথরও ছিল একটু দূরে দূরে। কিন্তু তার রং ঠিক সেই দলদলের মতোই। খুবরু আগে আগে তুড়তুড়িয়ে চলল, আর ওর পথেই একে একে দড়ি দিয়ে একে অন্যকে বেঁধে নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পার হলাম আমরা। উফ্! সে এক ভয়ের পথ বটে!
এই পথ পেরোতে-পেরোতেই ভরদুপুর। খিদেয় প্রাণ যায়।
আমাদের দশা দেখে দাদু বলল, “বেশ, তবে এখানেই একটু এবার বিশ্রাম নেয়া যাক।”
যেখানে পা টানটান করে বসলাম, সেখানে পরপর অনেক শিশুগাছ। বড়োটার নীচে বসেছি আমরা। দাদু পাথর জড়ো করে উনুন বানাল, শুকনো পাতা-নাতা জড়ো করে উনুনে দিল। তারপর একটা চওড়া কাঠে আরেকটা লম্বা শক্ত কাঠি খুব জোরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আগুনের ফুলকি জ্বেলে সেই আগুন নিয়ে নিল নারকোলের ছোবড়ায়। তারপর ফুঁ দিতে দিতে আগুন জ্বালিয়ে নামিয়ে দিল পাথরের উনুনে। তার উপর তো হাঁড়ি চাপানোই ছিল। আস্তে আস্তে গবগবে ভাতের গন্ধে চারদিক ভরে উঠল আর অমনি খিদেটাও যেন উঠল বেড়ে।
মুনরো ফড়ফড় করে উড়তে উড়তে বলে কিনা, “কই হে মালকিন! এসো তো দেখি আমার সঙ্গে!” বলেই ফুড়ুৎ।
কী আর করা, দৌড়োলাম ওর পিছে। পায়ের শব্দে বেশ বুঝলাম আমার পিছে পিছে তেরাইও আসছে।
উড়তে উড়তে মুনরো আমাদের যেখানে নিয়ে গেল, সেখানে কত যে জংলি লতা! তারই মাঝে অনেক অনেক তেলাকুচো আর ধুঁধুল ফলে আছে। আর আছে টোম্বা টোম্বা জংলি মটরশুঁটি। কোঁচড় ভরে মটরশুঁটি নিয়ে এলাম ফিরে। ওমা, এসে দেখি সেখানে উরুম নেই! গেল কোথায় একা একা?
এদিক ওদিক চাইতেই দেখি, ওই তো ওই ঝোপটা থেকে হামাগুঁড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসছে! হাতে কী? ওমা, এত গাজর উরুম পেল কোথায়? কথাটা মনে আসতে না আসতেই দেখি পিছন পিছন গাজর চিবুতে চিবুতে তুড়ুক তুড়ুক লাফাতে লাফাতে আসছে খুবরু। তেরাইয়ের ডাক শুনে তাকিয়ে দেখি দাদুও এর মধ্যে কোত্থেকে জুটিয়ে ফেলেছে ইয়াব্বড় এক মেটে আলু। তারপর আর কী? সে তো বুঝতেই পারো।
ধাঁই-ধপর করে নদীতে চান-টান সেরে আসার পর গোল গোল জলজ লিলির পাতায় যেই না পড়ল গরম গরম ফ্যানা ভাত, পোড়া মেটে আলু, গাজর আর মটরশুঁটি সেদ্ধ আর বাড়ি থেকে আনা ঘি, অমনি হাপুস-হুপুস। ওফ্! তোফা স্বাদ তার।
খাওয়ার পর হাত-পা ছড়িয়ে গাছের নীচেই খানিকক্ষণ টানটান হয়ে বিশ্রাম। তারপর আবার যখন পথচলা শুরু করব, দাদু অমনি বলে উঠল, “দাঁড়াও সোনারা! পথটা আর একবার ঠাওর করে নিই।”
উরুম আর তেরাই হাউমাউ করে উঠল, “সে কি গো! পথ হারালে নাকি?”
“না রে দাদা, না।” দাদু ফিক করে হেসে নিয়ে বলল, “আসলে বয়স তো হয়েছে! যদি ভুল হয়, তাই একেবারে নিশ্চিন্ত হওয়া।” বলেই মুনরোকে বলল, “ও ময়না মেয়ে মুনরো সোনা, দেখো তো দেখি আরামডিলা কি চোখে পড়ে?”
বলার অপেক্ষা কেবল, ফুড়ফুড়িয়ে উপরে উঠেই টুরটুরিয়ে ঘুরতে লাগল মুনরো। তারপর উপরে নীচে গোল করে একবার ঘুরেই সুড়ড়ড় করে নেমে এসে বসল দাদুর কাঁধে। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলল, “হ্যাঁ গো মালকিনের দাদু! দেখা তো যায়, তবে বোঝা তো যায় না।”
উরুম মুখটা তোম্বা করে বলল, “সে আবার কেমন কথা!”
মুনরো সেকথায় কোনও উত্তর দিল না। বরং মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কুড়ড় কুড়ড় করে আওয়াজ করল। ভাবটা যেন, ঘটে বুদ্ধি থাকলে নিজেই বোঝো।
দাদু বলল, “তার মানে পাহাড়টা এখনও ধোঁয়া ধোঁয়া, কেমন কিনা?”
উত্তরে মুনরো ফুড়ুত করে উড়ে বাম কাঁধ থেকে ডান কাঁধে গিয়ে বসল।
দাদু বলল, “তার মানে এখনও প্রায় দশ ঘণ্টার পথ। বেশ, চলো সাথীরা, যদ্দুর যাওয়া যায় আজ।”
দড়িদড়া, ছালা-বস্তা, থালা-পাতিল সব গুছিয়ে ফের শুরু হল পথ চলা। হাঁটতে হাঁটতে বন হালকা হয়ে এল, পায়ের তলার মাটিও যেন খানিক নরম হল। দূরে কোথায় যেন নদীর কলকল কলকল শব্দ শোনা গেল। আরও খানিক যাওয়ার পর সেই নদীটাকে দেখা গেল। পাতলা নদী। তবে বেশ স্রোত আছে বোঝা যায়।
দাদু বলল, “এই নদী পার করে আমাদের পথ।”
সেই শুনে কী জানি কেন, হাতের শুকনো ডালটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে উরুম দিল নদীর দিকে ছুট। ছুটতে ছুটতে নদীর চরে হঠাৎ করে থমকে দাঁড়িয়েই চিৎকার করে আমাদের ডাকতে থাকল। কী ব্যাপার! দৌড়ে গিয়ে ব্যাপারখানা দেখে তো আমাদের আক্কেল গুড়ুম! নদীর চরার ভেজা বালিতে ছোটো ছোটো গর্ত আর অনেক অনেক পায়ের ছাপ।
তার মানে টুগ্গা আর তার ভিনদেশি সঙ্গীসাথী নিশ্চয়ই এখানে ছিল। কাজেই আমাদের এবার একটু সাবধানে চলতে হবে। অবশ্য আমরাও তো কম নই। কাজেই ভয় পেয়ে থেমে থাকার মানেই হয় না। এই ভেবে ফের চলা শুরু হল। কেবল উরুম দেখলাম ভয়ে বেশ জুবুথুবু।
সেই দেখে তেরাই ওকে কনুই দিয়ে এক ঠেলা মেরে বলল, “অ্যাই বুদ্ধু! ভয় পেলে হবে? তুই না বীরপুরুষ!”
তেরাই বলল, আমি বললাম, দাদুও সাহস দিল। কিন্তু উরুমের মুখ তবুও ঝুলেই রইল। মুনরো তখন ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে বসল উরুমের হাতে। আর বসেই সুর করে গাইতে লাগল—
‘ভয় ভয় ভয়! কে পেয়েছে ভয়?
এমন করে ভয় পাওয়া তো সহজ কথা নয়!
টুরুং পুড়ুং টুংরো! এর চে’ সাহসী মুনরো!
টুরুং পুড়ুং টুংরো! ঢের সাহসী মুনরো!
সহজ কথায় ভয় পেয়ে যায় কেমন ছেলে উরুম?
বীর উরুমের কান্ডি দেখে আক্কেল ভাই গুড়ুম!
টুরুং পুড়ুং টুংরো! এর চে’ সাহসী মুনরো!
টুরুং পুড়ুং টুংরো! ঢের সাহসী মুনরো!’
এই গান একেবারে ম্যাজিকের মতো কাজ দিল। “কে বলেছে আমি ভিতু! এই দেখ আমি সবার আগে চলেছি।” এই না বলে সত্যি সত্যি সেই শুকনো ডালখানাকে তরোয়ালের মতো ঘোরাতে ঘোরাতে সব্বার আগে আগে চলল উরুম। সেই না দেখে আমাদের পেল বেদম হাসি। পাছে দুঃখ পায়, তাই ঠোঁট কামড়ে চিমটি কেটে অনেক কষ্টে আমরা হাসি চাপলাম।
দাদু ডাকল, “উরুম! ভাই, অমনি করে আগে আগে যেও না! আমায় আগে চলতে দাও, বিপদ হতে পারে।”
উরুম তবুও কোনও কথাই শুনল না। শুনবে কেন? তাকে তখন সাহসে পেয়েছে। কাজেই সে চলল আগে আগে আর আমরা চললাম পাছে পাছে।
তবে সে আর কতক্ষণ! নদী পার হতে গিয়েই উরুমের সব জারিজুরি খতম।
হয়েছিলটা কী, নদী পার হবার সময় উরুমের পায়ের তলায় পড়েছিল কী যেন এক মাছ। তার গা তো যেন বরফ! আর সেই ঠাণ্ডা নরম কিলবিলে জিনিস পায়ের তলে পড়তেই ভয়ের ঠেলায় হুড়মুড়িয়ে উরুম পড়ল জলে। সেই মাছেরও বিপদ অবিশ্যি কম কিছু হল না। পালাতে গিয়ে সেও ঢুকে পড়েছে উরুমের জোব্বার ভিতর, আর বেরোতে পারে না। ওদিকে উরুম তো সাপ সাপ করে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। আমরাও দেখতে পাচ্ছি, উরুমের জল ঝরঝরে ভিজে ন্যাতা-পাতা জোব্বার ভিতরে কী যেন খলবল খলবল করছে।
উরুমের ওই দশা দেখে আমি দৌড়লাম ওর দিকে। চেঁচিয়ে বললাম, “উরুম, ভয় পাস না। আমি আসছি।”
দাদু তো আমার মতো জলদি ছুটতে পারে না। তাই চেঁচিয়ে আমায় বলল, “দিদি! ওকে দাঁড় করিয়ে জোব্বাটা আলগা করে দাও।”
সেই কাজ করতেই থপাস করে জলে পড়ল ট্যাপা-টোপা লাল রঙের এক গাল-ফুলো মাছ। কী জানি কী নাম!
উরুমকে উপরে এনে ওর জামা খুলে দেওয়া হল। এ বাবা! ওর গা কেমন লাল লাল চাকা চাকা হয়ে ফুলে গেছে! আর সেগুলো নাকি বেদম চুলকোচ্ছে। মুখ কুঁচকে উরুম সারা গা খাবলে খাবলে চুলকোতে লাগল।
দাদু বলল, “ওর’ম করে এক জায়গার বিষ সাত জায়গায় ছড়িও না ভাই। ওই মাছের গা থেকে কিছু লেগে অমন হয়েছে। বরং নদীতে ভালো করে চান করে নাও। দেখবে কালকের মধ্যে ঠিক ভালো হয়ে যাবে।”
তেরাই ফুট কাটল, “আর ভালো হলেই সেরে যাবে।”
উরুম একটা কথাও বলল না। বেশ আক্কেল সেলামি হয়েছে তার। দাদুর কথা শুনে খানিক থামলেও সে মাঝেমাঝেই ঘষঘষ করে গা চুলকোচ্ছে। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে উরুমের মুখ ফুলে টোপা কুল হয়ে গেল।
ফুলো উরুম আর তুলো তেরাই
নদী পার হয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম আরেকটা বনে। এখানে সব খাটো খাটো গাছ ঝোপ করে আছে। আর তাদের গায়ে মাথায় লাল হলদে সবজে বাদামি সব লতার দল একেবারে লেপটে আছে। তাদের ঠেলে চলাই দায়। চলতে গেলেই পায়ে জড়ায়।
দাদু দুই হাতে লতার জট ছাড়িয়ে এগোয়। কিন্তু যেই দাদু পেরিয়ে যায়, অমনি আবার সেই ফাঁক বুজে যায়। আমরাও দাদুর মতো দুই হাতে লতা সরিয়ে যেতে চাই, কিন্তু আমাদের হাত তো আর অত বড়ো নয়! কাজেই অতটা করে ঝোপ সরাতে পারি না। জামা আটকে যায় লতায়। পা ছড়ে যায় শুকনো ডালে। সামান্য চলতেও বেশ সমস্যা হচ্ছিল আমাদের। তার মধ্যে আবার উরুমটার অমন ফুলো দশা।
ওর দিকে দেখতে দেখতে একসময় আমি বলে ফেললাম, “ইস! এই লতার বনে যদি পরিষ্কার একটা পথ থাকত তবে কত না ভালো হত।”
ওমা! যেই না বলা, অমনি স্যাট-স্যাট-সট-সট সেই লতার ঝোপের গিঁট গেল খুলে। দুই ধারে সরে যেতে যেতে তারা খানিকক্ষণের মধ্যে তৈরি করে দিল এক সুন্দর চলার পথ।
তেরাই ফ্যাক করে হেসে বলল, “হ্যাঁ রে সু, এই কথাটা তো তুই আগে বললেও পারতি!”
“সেই তো! আমিই কি ছাই জানি?”
“জানিসই তো! উরুম তুম্বো মুখে বলল, “দাদু তোকে বলেছিল না এখানকার সবকিছু তোর কথা শুনবে?”
“তোর যদি মনে ছিল তো তুই কেন মনে করিয়ে দিলি না রে ব্যাটা উরুম?” আমিও চেঁচিয়ে উঠে বললাম।
তেরাই বিজ্ঞের মতো মুখ করে বলল, “উঁহু! কথায় কথা বাড়ে। কাজেই আর ঝগড়া নয়, চলো এবার শান্তিমতো আমরা আগে বাড়ি।”
মুনরেও খোনা গলায় চেঁচিয়ে উঠল, “ঠিকই তো! ঠিকই তো!”
কাজেই কথা আর না বাড়িয়ে রওনা হলাম সেই পথে।
সেখানে আরও একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। সেই যে লতার ঝোপ, যা কিনা সরে গেছিল দুই ধারে, সেখানে কোথাও কোথাও ঝুলছিল বনকুলের মতো কী যেন এক ফল। কী যে লোভনীয় তার রং সে আর কী বলি! খয়েরি লাল টুসটুসে। আমারও যে বড়োই লোভ হচ্ছিল, সেকথা স্বীকার করতে কোনও বাধা নেই। কিন্তু অচেনা ফল, যদি কিছু হয়! কাজেই সে লোভ আমি সামলে নিলাম। তেরাই পারল না। টপাটপ সে কয়েকখানা চালান করে দিল মুখের ভিতর।
তারপর যা হল, সেকথা শুনলে তোমাদের বিশ্বাস নাও হতে পারে। তেরাই যেই না সেই ফল চিবিয়ে ঢোঁক গিলেছে, অমনি তার পায়ের পাতা মাটি ছেড়েছে। চোখের সামনে গ্যাস বেলুনের মতো তরতর করে উপরে উঠতে শুরু করল তেরাই! হাউমাউ করে চিৎকার জুড়লাম আমি আর উরুম। তেরাইও ভয়ে তখন কান্না জুড়েছে। উড়তে উড়তে তেরাই হঠাৎ আটকা পড়েছে অনেকটা উপরে লতাপাতার ঝোপের ছাতে। অমনি দাদু বুদ্ধি করে একগাছা রশি ছুড়ে দিয়েছে তার দিকে। তারপর সবাই মিলে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে তাকে টেনে নামানো। নামালেই বা কী হল! যেই না তার ঘাড় ছেড়ে দেওয়া হয়, অমনি তুড়ুং করে জমি ছাড়ে। বার কয়েক এমনি দেখার পর উরুমের বুদ্ধিতে সব বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হল তেরাইয়ের কাঁধে, তবে তার পা ঠেকল মাটিতে।
দাদু বলল, “হল তো শিক্ষা? আর যেন কেউ অজানা কিছু খেয়ে-টেয়ে বোসো না।”
কী মনে হতে আমি সেই ফল বেশ কিছু তুলে রেখে দিলাম পকেটে। কী দারুণ কাজটাই যে দিয়েছিল সেই ফল, সে তোমাদের সময়মতো ঠিক বলব।
যাই হোক, ফুলো উরুম আর তুলো তেরাইকে নিয়ে আমরা পেরিয়ে এলাম সেই অদ্ভুত জিয়ন্ত লতার দেশ। যেই আমরা বেরিয়ে এলাম, অমনি মুহূর্তের মধ্যে এর দু’ধার থেকে লতা এসে ছেয়ে ফেলল সেই পথ। যেমন করে ঢিল ডুবে যাবার পর কুচো পানার দল এসে জলের মধ্যের ফাঁকা জায়গাটাকে বুজিয়ে দেয়, ঠিক তেমন করে।
হঠাৎ করে হাতে টান পড়ায় তাকিয়ে দেখি, উরুম আর তেরাই সামনের দিকে দেখাচ্ছে। সামনে তখন আমাদের অদ্ভুত সুন্দর স্বপ্নের দেশ। চোখের সামনে সবুজ চাদর গায়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের প্রাণের পাহাড় আরামডিলা। তার ধোঁয়া ধোঁয়া ভাবটা আর নেই। হাঁ করে তাকিয়ে দেখতে দেখতে মনে হল, এ আমার কত চেনা! যেন কত খেলে বেড়িয়েছি এর আনাচেকানাচে পাথরে পাথরে! কত যেন চান করেছি ওর বুক বেয়ে বয়ে চলা ঝোরার ধারায়! কত যেন কথা কয়েছি সবুজ বুকে ভেসে থাকা প্রজাপতি, মৌমাছি আর পাখিদের সঙ্গে। এই তো আমার দেশ! এই তো আমার কত জনমের বাড়ি! ওই তো ওই সবুজ বুকে ভেসে চলেছে কী যেন এক সাদা ঘোড়া! ও কি পক্ষীরাজ? ইউনিকর্ন? ও যে আমার অনেক চেনা! কিন্তু ও মিলিয়ে যাচ্ছে কেন?
“দাদু দাদু! পক্ষীরাজ মিলিয়ে যাচ্ছে কেন? ওর এত দুঃখ দুঃখ মুখ কেন? ও কি কিছু বলতে চায়? তবে আসছে না কেন? দাদু! দাদু!”
দাদু আমার পিঠে হাত রেখে বলল, “সোনাদিদি, তুমি এমন অনেক কিছুই দেখতে পাবে এখানে, আমরা তো পারব না। এ পাহাড় যে তোমার, দিদি! আমরা কেবল তোমার সাথী।”
“সত্যি তোমরা কিছু দেখতে পাওনি? কেউ না?”
উরুম, তেরাই, মুনরো, খুবরু সব্বাই মাথা নাড়ল।
দাদু আবার আমার পিঠে হাত রেখে বলল, “সোনাদিদি! আরামডিলা চোখের সামনে হলেও এখান থেকে এখনও না হোক ঘণ্টা দুয়ের পথ। এদিকে দেখো, সুয্যিও কেমন ঢলে পড়েছে। কাজেই আমি বলি কী, আজকের মতো এখানেই বরং ডেরা বাঁধি।”
কিন্তু আমার যেন আর তর সইছিল না। বললাম, “দাদু, পা চালিয়ে চললে ঠিক আমরা সন্ধের আগে পৌঁছে যাব। চলো না যাই!”
কী যেন ভেবে দাদু বলল, “বেশ! তাই চলো তবে।”
সেইদিনই আমরা সবাই বুঝেছিলাম, দাদুই ঠিক ছিল। রাতটা যদি সেদিন ওখানেই কাটাতাম, তাহলে এমন ভয়ানক বিপদে হয়তো আমাদের পড়তে হত না।
আলোর মেয়ে, আলোক যান!
আরামডিলার দিকে এগোতেই আমরা সেঁধোলাম লম্বা লম্বা বুড়ো পাইনগাছে ঘেরা জঙ্গলে।
দাদু বলল, “এই শুরু হলো। এই অঞ্চলটায় সারাবছরই না শীত না গরম। অজস্র পাইন, দেবদ্রুম, ফার, ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি, আরও কত নাম না জানা বৃক্ষরাজিতে ঢাকা থাকে বলেই আরামডিলা এমন সবুজ। আর এমন চিরবসন্ত বলেই গাছেদের গায়ে ঝুলে পড়া অর্কিডগুলো এমন চমকদার ফুলে ভরা।”
পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে শেষ সূর্যের যতটুকু আলো চুঁইয়ে গলে ভিতরে আসছে, তাতে তখনও পথ চলা যায়। পা চালিয়ে চললাম আমরা। চলতে-চলতেই বুঝলাম পাথুরে জমিতে এসে পড়েছি আমরা। আশেপাশে একটু দূরে তাকালে পাহাড়ের পাথরে লম্বা লম্বা ফাটল চোখে পড়ে। কখনও এমনও মনে হল, আমরা বোধহয় উঠছি সমতল থেকে।
উরুম একসময় একদিকে আঙুল তুলে ইশারা করল। দেখি কী, একটা এই বড়ো গোল পাথর ঢালু পাথরের উপর দাঁড়িয়ে আছে। অথচ গড়িয়ে পড়ছে না!
আরও কত যে অবাক করা জিনিস সেই পাহাড়ে সে আর কত বলব! এই শুকনো পাথর, তো এই পাথরের ফাটল থেকে জল নামছে ছলছল করে। এই পরিষ্কার রোদ, তো এই কোত্থেকে মেঘ উড়ে এসে ছায়া ফেলছে। কোথাও বড়ো পাথর তো কোথাও পায়ের তলায় এক্কেবারে গোল গোল নুড়ি। ঠিক যেন লিম্বোকাকুর দোকানের লজেন্স।
আমাদের মনের অবস্থা তখন ভাবো! উত্তেজনায় টগবগ করছি আমরা সবাই। যতই আশ্চর্য হই প্রকৃতির শোভা দেখে, চলার বেগ ক্রমেই বাড়ছে। মনে কোনও কথা আর ভাসছে না। কেবল ওই সামনের আবছায়ার চাদরে ক্রমশ আরামডিলার ডাক শুনতে পাচ্ছি। দুই হাত বাড়িয়ে সে যেন আমাদের ডাকছে, ‘কই গো আমার ছানাপোনারা, এসো! এসো! কবে থেকে কোল পেতে বসে রয়েছি আমি তোমাদের জন্যে! তোমরা তো আমার সব সোনা সোনা ছেলেমেয়ে! তোমাদের কাছে পাওয়ার জন্যে আমার কতকালের অপেক্ষা। এসো! দেখো কেমন করে ঝোরার জল তোমাদের পা ধুয়ে দেয়, পাইন-ফার-ইউক্যালিপটাস কেমন শাখা দুলিয়ে তোমাদের বাতাস করে, পাখির দল তোমাদের কেমন গান শোনায়, হায়না-নেকড়ে-নেউলের দল কেমন করে তোমাদের রক্ষা করে! এসেই তো দেখো!’
সেই অমোঘ ডাকের টানে প্রায় দৌড়ে চলেছি আমরা সবাই। এমন সময় তীব্র কর্কশ স্বরে মুনরো চিৎকার করে উঠল, “সাবধান! পালাও! পালাও!”
স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে এমন আকস্মিক চিৎকারে হতবুদ্ধি হয়ে আমরা সবাই দৌড়োলাম। পাথুরে জমিতে উপর পানে দৌড়োনো কষ্ট। তবুও হাঁসফাঁস করতে করতে আমরা দৌড়োচ্ছি। হঠাৎ পিছনে ধড়মড় করে আওয়াজ শুনে পিছন ফিরে দেখি দাদু পা হড়কে পড়ে গেছে!
সারা পাহাড়ে পালোয়ানরা আমার দাদুর নাম জানে। সেই দাদু এমনি এমনি পা হড়কে পড়ে যাওয়ার মানুষ তো নয়! দাদুকে তুলে দেব বলে এগোতে যেতেই কারণটা বুঝতে পারলাম। দাদুকে ঘিরে ধরেছে বন্দুকধারী পাঁচ-ছ’জনের একটা দল। একজন গিয়ে কুড়িয়ে নিচ্ছে একটা ছোটো লাঠি। চলতে গিয়ে আচমকা ওই লাঠির ঘায়েই পড়ে গেছে দাদু।
আমি এগোতে যেতেই দাদু আমাদের পাহাড়িয়া ভাষায় চেঁচিয়ে উঠল, “সিংমোরো সুলুং! সিংমোরো সুলুং!” যার মানে ‘সুলুং তুমি থেমো না! সুলুং তুমি থেমো না! এগিয়ে যাও! এগিয়ে যাও!’
কী করি এখন? উরুম আর তেরাইও খানিক এগিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে এদিকে দেখছে। ওদিকে দাদুকে ঘিরে থাকা লোকগুলোর একজন দাদুকে পিছমোড়া করে বাঁধছে। আমাকে কিছু করতেই হবে, দাদুকে বাঁচাতেই হবে। সেই জন্য দাদুর দিকে দৌড়োতে যাচ্ছি, অমনি দাদু পাহাড়িয়া ভাষায় ফের চেঁচিয়ে উঠল, “ওমোরো সিরাবুরু নিয়া, ওমোরো লিয়াপ্পি সুলুং, সিংমোরো সিংমোরো!” ‘ও আমার পাহাড় দেশের নেতা সুলুং, ও আমার ভালোবাসার নাতনি সুলুং, তুমি থেমো না! এগিয়ে যাও! এগিয়ে যাও!’
আর ঠিক তক্ষুনি মূর্তিমান যমদূতের মতন এসে পড়ল টুগ্গা! বিদেশিরা না হয় নাই বুঝুক, সে তো পাহাড়ের ছেলে, কাজেই দাদুর চিৎকারের অর্থ বুঝে সে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে ঠিক দেখে ফেলল আমায়। আর যেই না দেখা, অমনি ধরবে বলে দিল আমার দিকে দৌড়। আর অপেক্ষা না করে আমরাও পড়িমড়ি করে দৌড়োলাম সামনের দিকে।
কিন্তু টুগ্গা তো গাগরা বাঘের মতো জোয়ান। ক্রমশ তার পায়ের আওয়াজ আমাদের কাছে চলে আসছে। আর হয়তো কয়েকটা মুহূর্ত। তারপরেই হয়তো ধরে ফেলবে আমাদের। দাদুর স্বপ্ন, পাহাড়বাসীর স্বপ্ন সবকিছুর কী হবে তখন! আর সাবরিওর ডাক! সেও কি মিথ্যে হয়ে যাবে?
সাবরিওর কথা মাথায় আসতেই বুদ্ধিটা টক করে খেলে গেল মাথায়। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে আদেশের গলায় বললাম, “ও আমার পাইন ভায়েরা! রক্ষা করো তোমাদের নেতাকে। শুয়ে পড়ে আটকে দাও দুষ্টু টুগ্গার গতি।”
যেই না বলা, অমনি ধাঁই-ধাঁই ধপড়-ধপড় মড়মড় করে পাইনের দল শুয়ে পড়ল মাটিতে। টুগ্গার সাধ্যি কী সেই উঁচু দেয়াল পেরিয়ে আমাদের ধরে?
পাইন ভাইদের ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা দৌড়োলাম সামনের দিকে। তখনও লাল সূর্য আটকে আছে পাইনগাছের উই মাথায়।
দৌড়োতে দৌড়োতে একসময় হঠাৎ করেই বেরিয়ে পড়লাম পাইনের ঘন বন ছেড়ে। কেমন যেন অলিখিত সীমানা! যেন এরপরে আর পাইন হবার মানা আছে।
এই মুহূর্তে আমরা যেখানটায় দাঁড়িয়ে সেখানে আমাদের পায়ের নীচে কেবল ন্যাড়া ন্যাড়া পাথর। আর সামনে খানিক দূরে ঘন পাইনবনের রেখা। এখন কালো হয়ে আছে সেই গাঢ় সবুজ বন।
এখানে কিন্তু থামিনি আমরা। আরও অনেকটা উঠে যখন প্রথম চাট্টানটা পেলাম, তখন থামলাম। বলা ভালো থামতে বাধ্য হলাম। কারণ, তখন আর কারও পাই চলছে না আমাদের। হাপরের মতো ওঠানামা করছে বুক। আর গলার কাছে দলা পাকিয়ে আছে কান্না। কান্না জমে আছে দাদুর জন্য।
“দাদুকে কেন ধরল ওরা? দাদু কীই বা ক্ষতি করেছে ওদের?”
উরুম হাতের তেলো দিয়ে আমার গাল থেকে কান্না মুছে দিয়ে বলল, “দাদু যে টুগ্গার শয়তানি জেনে গেছে রে সু! দাদুকে যদি না ধরে, পাহাড়ের আর সবাইও তাহলে টুগ্গার এই গদ্দারির কথা জেনে যাবে না? ঠিক এই জন্যই ওরা দাদুকে ধরেছে রে সু। তবে চিন্তা করিস না, আমরা সবাই মিলে ঠিক দাদুকে ফিরিয়ে আনব।”
উরুমের কথা শুনে তেরাইও কাছে এসে বসল। সেই নিভন্ত সূর্যের আলোয় অমন অপরিচিত পাহাড়ে আমরা তিন বন্ধু হাতে হাত ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলাম। অমনি মুনরো ধমকে উঠল, “ছি! ছি! ছি! তোমরা না পাহাড়ের নেতার রক্ষী! আর সু, তুমি না পাহাড়ের নেতা? নেহাত এখন আলো কমেছে, নইলে এক্ষুনি উড়ে গিয়ে জেনে আসতুম দাদুর কথা।”
মুনরোর ধমকে ম্যাজিকের মতো কাজ হল। আবেগ সামলে গলা খাঁকরে কান্নাটা ঝেড়ে ফেলে বললাম, “দেখ, আগে রাতটা যাতে নিরাপদে কাটে তার ব্যবস্থাটা করতে হবে আমাদের। এমন কোনও একটা জায়গা খুব শিগগির খুঁজতে হবে যেখানে মাথার উপর একটা পাথরের ছাত থাকে।”
কথাটা শোনামাত্রই খুবরু তুড়ুক তুড়ুক করে লাফাতে লাফাতে হারিয়ে গেল চাট্টানের ওপারে।
“অ্যাই খুবরু! অ্যাই খুবরু!”
কোনও ডাকই শুনল না।
তেরাই বলল, “ভাবিস না সু, খুবরু নিশ্চই জায়গা খুঁজতে গেছে। এখন বরং ভাব, দাদুকে কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায়।”
উরুমের সেই ফোলাগুলো অনেক কমে গেছে। সে এবার বিজ্ঞের মতো বলল, “আমার কাছে একটা প্ল্যান আছে।”
মুনরো ফুট কাটল, “হয়ে গেল।”
উরুম হাত উঁচিয়ে তেড়ে গেল মুনরোর দিকে। পাজি মুনরো তখন ফুড়ুৎ করে উড়ে এসে বসল আমার কাঁধে।
হাত উঁচিয়ে বলালাম, “উরুম, এখন নিজেদের মধ্যে লড়াই করবার সময় নয়। কী প্ল্যান আছে তোর সেটাই আগে বল।”
উরুম তখন বেশ একজন এলেমদারের মতো পায়ের উপর পা তুলে বসল গিয়ে একটা গোল পাথরের উপরে। গলা ভারী করে বলল, “শোন তবে। আমি ভাবছি কী, আজ যখন ওরা দাদুকে ধরল, তার মানে খুব নিশ্চিন্তে আর আনন্দে আছে। তার উপর পাইনের গাছ শুইয়ে তুই রাস্তাও দিয়েছিস আটকে, কাজেই আজ রাত ওরা ওখানেই থাকবে। আমার ধারণা নিশ্চিন্ত হয়ে বেশ জমিয়ে রাত্তিরে ভাত, শুয়োরের মাংসের সুরুয়া, পাঁপড় ভাজা খাবে।”
উরুমকে থামিয়ে তেরাই বলে উঠল, “দেখছিস সু পেটুকটার অবস্থা! এমন সময়েও খাবার কথাই ভাবছে!”
উরুম হাঁ হাঁ করে বলে উঠল, “আরে না রে বাবা! আমি বলতে চাইছিলাম যে ওরা জমিয়ে খানাপিনা সেরে যখন ঘুম দেবে তখনই আমরা ওদের আক্রমণ করে হারিয়ে দেব আর দাদুকে ফেরত নিয়ে আসব।”
“ওহ্! এলেন রে বড়ো বীরপুরুষ! সব যেন একেবারে টোপা কুল। টপাটপ মুখে পুরলেই হল। আমি তোকে আগেই বলেছিলাম সু,” তেরাই তড়বড় করে বলে উঠল, “এ ব্যাটার যেমন মোটা গা, তেমন মোটা বুদ্ধি। অতগুলো লোকের সঙ্গে খালি হাতে আমরা এই তিনটে বাচ্চা লড়াই করতে গেলে না ঠিক দু’মিনিটের মধ্যে ধরা পড়ে যাব। যেটুকুও আশা আছে, সেটুকুও মুহূর্তে ভোগের বাড়ি যাবে।”
উরুম গাল ফুলিয়ে বলল, “তবে তুইই একটা বুদ্ধি বাতলা না দেখি!”
তেরাই অমনি ওকে ভেঙচিয়ে বলে উঠল, “বলবই তো! তোর থেকে অনেক ভালো প্ল্যান বলব দেখিস হাঁদা।”
উরুম কিছু বলতে যাচ্ছিল। ওকে থামিয়ে বিজ্ঞের মতো বলে উঠলাম, “তুমি তোমার কথাখানা বলো। সেটা কতটা ভালো সে আমি বুঝব।”
তেরাই মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল, “সবসময় যদি অমনি করে কথা কও বাপু, তাহলে আমি কিছুই বলব না।”
বললাম, “বেশ, আর বলব না। প্ল্যানটা তো বল!”
তেরাই ফের আমাদের দিকে ঘুরে বলল, “আমার প্ল্যানটাও খানিক উরুমের মতোই…”
ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে উরুম চেঁচাতে লাগল, “ওই দেখ, আমার আইডিয়া চুরি করছে! আমার আইডিয়া চুরি করছে! চোর! চোর!”
“খুব সাবধান উরুম! মেরে মুখ ভেঙে দেব! কী চুরি করেছি আমি?” তেরাই ঝাঁঝিয়ে উঠল।
“কী আবার? আমার প্ল্যান! আমাকে আবার হাঁদা বলা! হাঁদা তো তুই! হাঁদাও, চোরও!”
“তবে রে!” বলে যেই তেরাই তেড়ে গেল উরুমের দিকে অমনি আমি বলে উঠলাম, “তেরাই তোর যদি কোনও বুদ্ধি দেওয়ার থাকে তো বল। দাদু একা ওখানে আটকা পড়ে আছে। এই সময় তোদের এই ঝগড়া আর আমার ভাল্লাগছে না।”
তেরাই অমনি ঝগড়া-টগড়া থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেমে থেমে বলল, “ভালো আমাদেরও লাগছে না রে সু। তাই তো…”
এটুকু বলেই গলা বুজে এল তেরাইয়ের। আমারও খুব কষ্ট হচ্ছিল। তেরাইয়ের কাছে গিয়ে ওর হাতটা চেপে ধরলাম। ও মাথাটা একটু ঝাঁকিয়ে বলল, “সু! উরুম! আমি ভেবেছি কী, উরুমের কথামতোই আমরা আস্তে আস্তে নেমে ওদের তাঁবুর কাছে যাব। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখব ওদের গতিবিধি। আরেকটা কথা, এই পাহাড়ে আমি ঘুমপাড়ানি লতার গাছ দেখেছি। ওদের খাবারদাবারে যদি সেই পাতার রস মিলিয়ে দিতে পারি না, তাহলেই ব্যস! কেল্লা ফতে! ভোঁসভোঁস করে সব ঘুমোবে। দাদুকে ওদের ওখান থেকে নিয়ে আসা তখন আর কোনও ব্যাপারই হবে না।”
উরুম হাততালি দিয়ে বলল, “দারুণ প্ল্যান তেরাই! তাহলে চল, সবার আগে সেই লতার রস বানাই।”
তেরাই বলল, “চল।”
ঠিক তক্ষুনি খুবরু লাফাতে লাফাতে এসে উঠল আমার কোলে। দেখে মনে হল বেজায় ভয় পেয়েছে।
তেরাই বলল, “নিশ্চয়ই। উপরে শিয়াল-টিয়াল অথবা হায়নার তাড়া খেয়েছে খুবরু!”
আমি ওর নরম সাদা লোমে হাত বুলিয়ে বললাম, “কী হয়েছে খুবরু? কিছু দেখেছিস?”
খুবরু ওর খুদে খুদে লাল চোখগুলো আরও ছোটো করে আরও ঢুকে গেল আমার কোলের ভিতরে।
উরুম আর তেরাই ঘুমপাড়ানি লতা নিয়ে ফিরে এল। পাথরে থেঁতো করে আমরা তার রস করলাম। তারপর অন্ধকার ঘনিয়ে এলে আস্তে আস্তে নামতে লাগলাম।
অন্ধকারে কোথায় পথ ঠিক করে মালুম হয় না। হোঁচট খেতে খেতে পাছড়ে যায়। হুমড়ি খেয়ে পড়ি পাথরে। ফের উঠে দাঁড়াই আমরা। এইভাবে যেতে যেতে একটা সময় আমরা এসে পড়লাম একটা গভীর খাদের সামনে। তার নিচ দেখা যায় না। উরুম একটা পাথর ফেলল নীচে। কিন্তু তার মাটিতে পড়ার কোনও শব্দই পেলাম না। সব্বাই বেশ বুঝতে পারলাম যে রাস্তা ভুল হয়েছে আমাদের। এই জায়গায় এসে মনটা একেবারে হু হু করে উঠল। কীভাবে বাঁচাব দাদুকে? ফিরে যাব কি আগের জায়গায়? কিন্তু যদি আবারও পথ হারাই? রাত বাড়ছে। যদি হিংস্র প্রাণীদের সামনে পড়তে হয়! তাহলে করবটা কী? কীভাবে পৌঁছোব ওদের শিবিরে যেখানে বাঁধা আছে আমার দাদু? সঠিক রাস্তার কথা কে আমাদের বলে দেবে!
হঠাৎ করে একটা কথা মাথায় এল। দাদু যে বলেছিল, এই পাহাড়ের সবকিছু এখন আমার বন্ধু, সবাই আমার কথা শুনবে! মনে হওয়ামাত্রই চিৎকার করে বলে উঠলাম, “ও আমার পাহাড়-কোলের বন্ধুরা! যদি সত্যি বন্ধু হও, পথ দেখাও। আমায় নিয়ে চলো আমার দাদুর কাছে।”
ওমা, যেই না বলা, অমনি জোনাকির মতো ছোট্ট ছোট্ট আলোর ঝাঁক অন্ধকারের বুক চিরে নাচতে লাগল অদ্ভুত ছন্দে! তারপর সব আলোর বিন্দু মিলেমিশে হয়ে গেল আমারই মতো ছোট্ট একটা মেয়ে। ঝরনার জলের মতো কণ্ঠে সেই মেয়ে বলল, “কই গো বন্ধু, এসো আমার সঙ্গে।”
আমরা সেই আলো-মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে চললাম। এবার সেই লতায় পাতায় ঠাসা পাহাড়িয়া পথ কত সহজ হয়ে গেল। লতাপাতারা সবাই দুইপাশে সরে সরে গেল। কেউ বা উঁচুতে উঠিয়ে নিল তার ডাল। হাঁটতে হাঁটতে আমরা এসে উঠলাম একটা চাতালে।
আলো-মেয়ের জন্য গোটা চাতালটায় নরম একটা আলো। আমার কাঁধ থেকে মুনরো এবার উড়ে গিয়ে বসল আলো-মেয়ের কাঁধে। কেমন সুন্দর মিষ্টি আভা ফুটল মুনরোর পালকে! গলা দুলিয়ে দুলিয়ে গান ধরল মুনরো—
‘ছোট্ট সোনা সুলুং
কেমন করে আদর করি
কেমনে গাই গুণ!
এইটুকু এক মেয়ে
তিনটে পাহাড় কতই আশায়
সু-র দিকে তাকিয়ে।
সু-এর মনে কতই মায়া
মায়াভরা মন যেন তার
পাইনবনের ছায়া।
ভয় কোরো না সু
সবাই আছি তোমার সাথেই
সব্বাই বন্ধু!
সুলুং, দুঃখ কোরো না!
এক্ষুনি যাব দাদুর কাছে
বুঝতেও পারবে না!
কই গেলে হে আলোর মেয়ে! সুয্যিসোনা আন!
এবার আনো তোমার জাদুভরা
সেই যে আলোকযান।’
গান শেষ হতে না হতেই আলো-মেয়ের আঙুলের ইশারায় কোত্থেকে এসে উঠল একটা আলোর বুদবুদ। আমাদের সব্বাইকে টপ করে গিলে নিল নিজের ভিতর। তারপর ভাসতে ভাসতে নামতে লাগলাম নীচের দিকে। সে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা।
লড়াই দিল জয়ের স্বাদ
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আমরা এসে পড়লাম ঠিক সেইখানে, যেখান থেকে দাদুকে ছেড়ে আমরা পাহাড় চড়তে শুরু করেছিলাম।
আলো-মেয়েকে খুব করে ধন্যবাদ জানালাম। সে-মেয়ে হেসে বলল, “সোনার মেয়ে সুলুং, মনে হলেই আবার ডেকো। আমরা সবাই তো বন্ধু হলাম। কেমন কিনা?”
আলো-মেয়ে মিলিয়ে যেতেই মুনরো ফড়ফড় করে উড়ে এসে বসল আমার কাঁধে।
এইবার পরিকল্পনামতোই ধীরে ধীরে আমরা ঢুকে পড়লাম বনের ভিতরে।
খানিক এগোতেই দেখি ওদের শিবিরের আলো দেখা যাচ্ছে। এইখানে আমরা থমকে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে শেষবারের মতো আলোচনা সেরে নিলাম। উরুমের হাত থেকে তেরাই নিয়ে নিল সেই লতা থেকে তৈরি ঘুমের তরল। তারপর পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল শিবিরের রান্নাঘরের দিকে।
এইবার আমাদের দুটো কাজ। এক, রান্নাঘরের দিকে যাতে কেউ না আসে সেজন্য ওদের অন্যদিকে ব্যস্ত রাখা, আর দুই, যদি বা কেউ এসেই পড়ে তবে তেরাইকে আগেভাগে সতর্ক করে দেওয়া আর সাহায্য করা। প্রথম কাজটার জন্য মুনরো আর খুবরুর সাহায্য দরকার। আমি দু’জনকেই কোলে তুলে নিয়ে আমার মতো করে বুঝিয়ে বললাম গোটা ব্যাপারটা। কতটা কী বুঝল জানি না, কিন্তু ঘাড় কাত করে খুবরু দিল কোল থেকে এক লাফ আর মুনরোও গেল উড়ে।
আমি আর উরুম গেলাম দু’দিকে। উরুম গেলতে তেরাইয়ের সঙ্গে আর আমি পিছু নিলাম খুবরু-মুনরোর। মুনরো উড়তে উড়তে বসল গিয়ে যেখানে টুগ্গারা সবাই আছে। সেখানেই দাদুকেও দেখলাম। একটা মোটা গাছের গুঁড়িতে কষে বেঁধে রেখেছে দাদুকে। কী নিষ্ঠুর! একবার দাদুকে ছাড়াই, তারপর তোমাদের দেখাচ্ছি মজা।
মুনরোকে ইশারা করতেই সে গিয়ে দাদুর মাথার উপরের ডালে গিয়ে শিস দিয়ে গান ধরলে—
‘পাহাড় দেশের বীর বাহাদুর
সুলুং যার নাতনি,
আজ খেও না খাবার কোনও
সুরুয়া হোক বা চাটনি।
আমরা সু-এর সাঙ্গপাঙ্গ
সবাই মিলে একজোট,
দুষ্টু টুগ্গা হবেই নাকাল
যতই পাকাক সাত ঘোঁট!
ঘুম নগরীর আজব খাবার
মুদবেই চোখ নির্ভুল,
ঘুমের বুড়ি আসন পেতে
গাঁথবে মালা ঘুম ফুল।
ঠিক তখুনি তাঁবুর পিছে
পাইন-গুঁড়ির একটু নীচে
থাকবে সু-এর দলবল।
আপনি এলেই বীর বাহাদুর
এখান থেকে অনেকটা দূর,
যেখানটাতে আরামডিলার
ঝর্ণা ঝরে খলবল।
ভাবছ নাকি কাটবে বাঁধন কী দিয়ে!
বলছি শোনো, ভেবো না অমন
আসছে খুবরু কাটতে বাঁধন
ছুরির মতন কচ-কচাকচ দাঁত নিয়ে।’
মুনরোর কথা শুনে দাদু হেসে তাকাল ওর দিকে। তারপর ওকে বলল—
“মিষ্টি পাখি মুনরো
একটা কথা শোন তো
তিন নম্বর তাঁবুর ভিতর আছেন ব্যাটা সর্দার।
অনেক অস্ত্র অনেক যন্ত্র
ওদের কাছে অনেক মন্ত্র
সুলুং যেন সামলে চলে
যাই ঘটে যাক মন না টলে
বলিস ওকে দাদু বলে সামলে চললে নেই মার।”
সেই কথা শুনে মুনরো উড়ে এল আমার কাঁধে। আমি ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতেই শুনলাম একটা লোক টুগ্গাকে বলছে, “বুড়োটা কী বিড়বিড় করছে রে?”
টুগ্গা দাদুর কাছে এগিয়ে গিয়ে দাদুকে একটা ঠোনা দিয়ে বলছে, “কী বলছ বীর বাহাদুর?”
দাদু দাঁতে দাঁত ঘষে বলছে, “বিশ্বাসঘাতক! বেইমান!”
টুগ্গা বিচ্ছিরিভাবে হেসে উঠে বলছে, “বলো বলো। আর কতক্ষণই বা বলবে। কাল সকাল হতেই তো আমরা চলে যাব। আর তুমি পড়ে থাকবে একা এই জঙ্গলে হায়নার দলের খাবার হয়ে। চাও তো বুড়ো অনুরোধ করো। সর্দার তোমাকে একটা বুলেটে খতম করে দিতেও পারে। তাহলে অন্তত হায়নার দাঁতের কষ্টটা আর তোমার মালুম হবে না।”
“বেইমান! তোদের থেকে হায়নার দল অনেক ভালো।”
দাদুর দাঁতে দাঁত ঘষার আওয়াজ এতটা দূর থেকেও শোনা যাচ্ছে। টুগ্গার উপর ভয়ানক রাগ হচ্ছে। মনে হচ্ছে গিয়ে খুব কড়া কোনও শাস্তি দিই ওকে। কিন্তু প্ল্যান মাফিক কাজ করতে হবে। তাই রাগ সামলে খুবরুকে টেনে নিলাম কোলে। ওকে ওর কাজটা বুঝিয়ে দিলাম ছেড়ে। অন্ধকারে মিশে লাফাতে লাফাতে খুবরু গিয়ে হাজির হয়ে গেল দাদুর পিছনে। কুচু কুচু দাঁত দিয়ে কাটতে শুরু করল দড়ি।
এবার একটু ওদিকে যাই। তেরাই আর উরুম কী করছে দেখাটা দরকার।
সেখানে গিয়ে আর তো উরুমকে দেখি না! এদিক ওদিক দেখতে দেখতে দেখি কী একটা গাছের নীচে উরুমের জুতো দুটো ছড়িয়ে পড়ে আছে। মনটা হু হু করে উঠল। উরুম তাহলে ধরা পড়ে গেল! আর তেরাই! তার কী হবে?
কিচ্ছু মাথায় আসছে না। ধপ করে বসে পড়েছি গাছটার নীচে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে জলে। এমন সময় মাথার উপর গাছে কেমন ঘসঘস খসখস শব্দ। চমকে লাফিয়ে সরে যেতেই কী যেন একটা থ্যাপাৎ করে পড়ল গাছ থেকে। আর পড়েই হাসতে শুরু করল। সে কী হাসি!
কিন্তু এ-হাসি তো আমার চেনা। ব্যাটা উরুম! তেড়ে গেলাম যেই, অমনি উরুম হাসির বেগ কমিয়ে বলল, “আরে অমনি করে ভয় পেলি কেন সু? তুই না আমাদের নেতা?”
“নেতা না হাতি! তোর জন্য, তেরাইয়ের জন্য বুঝি চিন্তা হয় না আমার!”
“চিন্তা করতে গিয়ে ভয় পেলি কেন?”
“না, ভয় পাবে না! তুমি অমন বীর হনুমানের মতন লম্ফ দেবে, আর তাতে সু ভয় পাবে না! যেমন মোটা শরীর তার তেমন মোটা বুদ্ধি। হাঁদা কোথাকার!” বলতে বলতে তেরাই সামনের ঝোপ থেকে উঠে এল।
তেরাইকে দেখে খুব আনন্দ হল। বললাম, “যাক বাবা! তুইও ফিরে এলি। কাজ কমপ্লিট তো?”
“পুরোভাবে কমপ্লিট। এমন মিশিয়েছি না, খাবার পরই ব্যাটারা টের পাবে। কাল সকাল দশটার আগে আর কারও ঘুম থেকে উঠতে হবে না।”
“তাহলে চল যাই। দাদু যে জায়গাটায় আছে, সেখানে গিয়ে আমরা লুকিয়ে অপেক্ষা করি।”
“তাই চল।”
আমরা গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম সেখানে। খানিক বাদে খুবরুও চলে এল। বুঝলাম দাদুর হাতের বাঁধনও এখন কাটা। এবার শুধু অপেক্ষার পালা।
রাতের মতো রাত বাড়ে। খাওয়াদাওয়া তো করে না টুগ্গারা! মশার কামড়ে একেবারে নাজেহাল দশা। শেষমেশ বলেই ফেললাম মশাদের, “দেখো বাপু মশার দল! এখন অত কামড়িও না আমাদের। বড়ো একটা কাজ বাকি। তারপর না হয়…”
কথাটা শেষ হল কি হল না, হঠাৎ তাঁবুগুলো থেকে পৈশাচিক চিৎকার ভেসে এল। তারপর ধর ধর আওয়াজ! ছোটাছুটি, দৌড়াদৌড়ি হুলুস্থুলু কারবার! শেষ অবধি আওয়াজ কমে এলে শুনতে পেলাম কারা যেন ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে। হঠাৎ করে দাদুর গলার আওয়াজ পেলাম। দাদু কঠোর গলায় টুগ্গাকে সাবধান করছে, “সাবধান টুগ্গা! এই পাহাড়ের ছেলে হয়ে তুই এমন কাজ করিস না। লাংমোরা এই পাহাড়ের রক্ষক। ওদের বাইরের মানুষদের সামনে আনিস না।”
উত্তরে টুগ্গার হাসি ভেসে এল। খানিকটা উঁচু হয়ে দেখি, দাদুর সামনেটাতেই দাঁড়িয়ে আছে টুগ্গা আর তার শয়তান সঙ্গীরা। আর ওদের সামনে পিছমোড়া করে বাঁধা হয়ে পড়ে রয়েছে কতগুলো বাচ্চা ছেলে। একজন ভিনদেশি হাতের লাঠিটা দিয়ে ওদের খুঁচিয়ে তুলল। অমনি ওদের দেখতে পেলাম আর দেখতে পেয়েই চমকে গেলাম।
যাদের বাচ্চা ভাবছিলাম তারা বাচ্চা নয়! বরং ছোটো ছোটো মানুষ। আমাদের থেকেও ছোটো। খুব বেশি হলে হাঁটুর উচ্চতার সব মানুষ। ছ’জন।
উরুম-তেরাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। আমি বললাম, “এরা হল লাংমো। এই পাহাড়ের রক্ষক।”
তেরাই বলল, “তুই চিনলি কেমন করে?”
“দাদুর কাছে শুনেছি। দাদু বলেছে, এই তিন পাহাড়েই নানা কাজে ঘুরে বেড়ালেও আরামডিলাতেই নাকি লাংমোদের বাস। রাত্রি হলেই রং-তুলি হাতে গাছের পাতায় ওরা রং দেয়, ঘাসের ডগায় ফুল আঁকে, পাথরের খাঁজে আটকে পড়া পাখির বাচ্চাকে তুলে নিয়ে বাসায় পৌঁছে দেয়। পাহাড়ের বুকে ফুল ফোটানো থেকে ঋতুর বদল সবকিছুই করে এই লাংমোরা।”
“কিন্তু ওরা এত ছোটো কেন?”
“দাদু বলেছে, ওরা সাধারণ মানুষের মতো নয়। ওরা স্বর্গের মানুষ। সাবরিওর আপনার জন। অনেক জাদু ওদের জানা।”
“তাহলে টুগ্গারা ওদের ধরল কেমন করে?”
“ধরল, নাকি কারা এসেছে এই পাহাড়ে, সেই কথাটা ভালোমতো জানতে ওরা নিজেরাই ধরা দিল—সেকথাটাও ভালোমতো জানা দরকার।” তেরাই বলল।
আমরা এসব বলাবলি করছি। মনে খুব ইচ্ছা দাদুর সঙ্গে লাংমোদেরও উদ্ধার করব। আশায় রয়েছি খাবার খাওয়ার পর ওদের ঘুমিয়ে পড়ার। কিন্তু ওরা খেতে যাচ্ছে না কেন এখনও?
এর মধ্যেই একজন দেখলাম কী একটা পাত্র ভরে কী যেন একটা দাদুর সামনে নিয়ে গেল। দাদু মাথা নাড়িয়ে আপত্তি করছে। প্রবল আপত্তি। সেই লোক শেষ অবধি দাদুর গায়ে ছুড়ে দিল পাত্রের খাবার। গরম সুরুয়ার ধোঁয়া আমরা এতটা দূর থেকে দেখতে পেলাম, কিন্তু সেই গরম তরল গায়ে পড়লেও দাদু এতটুকু চিৎকার করল না। হাত তো আসলে খোলা এখন দাদুর, তবুও হাত দিয়ে সুরুয়াটা মোছার চেষ্টাও করল না।
“কী সহ্যশক্তি রে দাদুর!” উরুম বলে উঠল।
এই দৃশ্য দেখে রাগে তখন আমার চোয়াল শক্ত। ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে গিয়ে শাস্তি দিই। তবুও বললাম, “এত নিষ্ঠুর মানুষ হতে পারে! দেখতে তো পাচ্ছে দাদুর বয়স হয়েছে! বয়স্ক মানুষদের সঙ্গে এমন আচরণ মানুষ করে?”
তেরাই হাতের উলটো পিঠটায় চোখ ডলতে ডলতে বলল, “ওরা কি আর মানুষ রে সু! ওরা মানুষ নয়।”
সত্যিই মানুষ নয়। নইলে গায়ে গরম সুরুয়া ছিটিয়ে কেউ অমন দাঁত বের করে হাসে?
খানিকক্ষণ হেসে সেই লোক চলে গেল। আর তার যাবার পরপরই খাওয়াদাওয়া শুরু হল। আর আমরা একে অন্যের মুখের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করে রইলাম।
খনিক বাদেই দেখলাম, সুরুয়ার পাত্র হাতে করেই ভোঁসভোঁসিয়ে ঘুমোচ্ছে সব। ধীরে ধীরে তখনই আমরা নেমে গেলাম দাদুর কাছে।
দাদু আমাদের জড়িয়ে ধরে আদর করল। বলল, “আমার বীর বাহাদুর নাতিনাতনিরা সব! তোরা থাকতে এদের সাধ্যি কী ক্ষতি করে?” বলেই আমাদের দিক থেকে মুখ তুলে চাইল লাংমোদের দিকে।
সবাই মিলে গিয়ে আমরা ছাড়িয়ে নিলাম লাংমোদের।
খুব খুশি আমরা। উরুম তো সবচেয়ে খুশি। লাংমোদের ছুঁয়ে দেখে, আর খিলখিলিয়ে হাসে। লাংমোরাও সেই দেখে হাসে। আর কী মিষ্টি ওদের হাসির আওয়াজ! যেন ঝরনা বয়ে যাচ্ছে পাথরের উপর দিয়ে।
খুশির মাঝেই তেরাই বলে উঠল, “সবই তো হল। কিন্তু আমাদেরও যে খুব খিদে পেয়েছে। কী খাব আমরা?”
সেই না শুনে লাংমোর দল এ-ওর মুখের দিকে চেয়ে দেখে আর কী যেন বলাবলি করে। তারপর দাদুর দিকে ফিরে পরিষ্কার আমাদের ভাষায় বলল, “মহান নেতা সাবরিওর দূত আমরা। আপনাদের জন্যই আমাদের এখানে আসা। আপনারা চিন্তা করবেন না। আমাদের সঙ্গে আসুন। আমাদের বাসায় আপনাদের ভোজের আয়োজন করা হয়েছে।”
ভোজের কথা শোনামাত্রই আমারও পেটের ভিতর খিদেটা তড়বড় করে উঠল। উরুমের তো আর তর সয় না। বলল, “সু, আলো-মেয়েকে আরেকটা বার ডাক না!”
সত্যি তো! ওকে ডাকলেই তো হয়। আমি চোখ বন্ধ করে ডাকলাম আলো-মেয়েকে। অমনি দেখি অন্ধকার পাইন-ডালে জ্বলে উঠল সেই মিষ্টি নীল আলো। ধীরে ধীরে নেমে এল আলো-মেয়ে। বলল, “কই, চলো!”
আলো বুদবুদের ভিতর ঢুকতে যাব, এমন সময় দেখি, আমাদের সোজাসুজি তাঁবুটার পর্দাটা নড়ছে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে লাল চামড়ার ভয়ানক রাগী এক মানুষ। চোখ দেখে মনে হয় ঘুম থেকে উঠল। বেরিয়ে এসেই আমাদের দেখে থমকে দাঁড়িয়েই একছুটে ফের ঢুকে গেল তাঁবুর মধ্যে। আর আলো-মেয়েও আলোর বুদবুদে ঘিরে ফেলল আমাদের সব্বাইকে। তারপর উঠতে লাগল উপরে। খানিক বাদেই সেই লোক হাতে বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে এদিক সেদিক দেখতে দেখতে ছুটে বেড়াতে লাগল। উপরের দিকে চেয়ে যেই দেখতে পেল আমাদের, অমনি বন্দুক তাক করল আমাদের দিকে। আলো-মেয়েও অমনি নিভিয়ে নিল আলো। আর সাঁ করে সরে গেল বাঁদিকে। আমাদের ডানদিক দিয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটে গেল বুলেট।
দাদু বিড়বিড় করে বলল, “এটাই সর্দার! এটাই সর্দার!”
তেরাই বলল, “ইস! এই ব্যাটাই সুরুয়া খেল না!”
উরুম বলল, “ব্যাটা গণ্ডার!”
আমি কিছু না বলে দেখতে লাগলাম কেমন ছোটো হয়ে আসছে নীচের সবকিছু। সেই লাল চামড়ার সর্দার এখন লাংমোদের থেকেও ছোটো। হাতে জল নিয়ে ছিটিয়ে ছিটিয়ে ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করছে স্যাঙাতদের।
ছোটো হতে হতে একসময় মিলিয়ে গেল ওরা, আর আমরা এগিয়ে চললাম লাংমোদের বাসার দিকে।
লাংমো কন্যে কচি-কলা
ঘুটঘুটে অন্ধকারের দেশ পেরিয়ে আলোর বুদবুদ যেখানে এসে থামল সেখানে গোটা উপত্যকা জুড়ে নরম নীল আলো। অন্ধকারে মাথা ডুবিয়ে দেওয়া গাছগুলোর কোমর পর্যন্ত সেই নীল আলো ছড়িয়ে। লম্বা লম্বা গাছেদের মাঝে সেই নীল আলো-আঁধারি এক অদ্ভুত রহস্যময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
একটা উঁচু পাথরের উপর আমাদের নামিয়েই আলো-মেয়ে বিদায় নিল। দাদু তাকে ঝুঁকে কৃতজ্ঞতা জানাতেই সেও মাথা নুইয়ে প্রতি-সম্মান জানাল, তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়েই দপ করে গেল নিভে।
যে লাংমোদের উদ্ধার করলাম আমরা, তাদের একজন হঠাৎ কোমর থেকে শিঙার মতো কী একটা বার করে দিল ফুঁকে। সেই তীক্ষ্ণ আওয়াজের রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই আরও অনেক অনেক শিঙার রব উঠল আশপাশ থেকে।
দাদু বলল, “বুঝলে দিদি, লাংমোদের মধ্যে খবর চালান হচ্ছে। এক্ষুনি ওরা সবাই মিলে এল বলে তোমায় দেখতে।”
দাদুর কথা শেষ হল কি হল না, পিলপিলিয়ে শয়ে শয়ে লাংমো জড়ো হল পাথরের নীচে। হাঁটু মুড়ে বসল সবাই। একে তো লাংমোরা ছোটো সাইজের, তার মধ্যে অমন হাঁটু মুড়ে বসায় এই আলো-আঁধারিতে ওদেরকেও একটা একটা ছোটো পাথর বলে মনে হচ্ছে। হাঁটু মুড়ে বসে দুই হাত উঁচু করে এবার তারা সমস্বরে বলতে শুরু করল, “হো সাবরিও! হো সাবরিও! এন্না সাবরিও! এন্না সাবরিও সুলুং টুং ওরিওসা! সুলুং টুং ওরিওসা!”
দাদু উরুমকে বলল, “কী রে উরুম, এর মানে বুঝলি?”
উরুম মাথা নাড়ল।
দাদু বলল, “এর মানে হল, হে মহান সাবরিও! হে মহান সাবরিও! আমাদের রক্ষাকর্তা সাবরিও! আমাদের রক্ষাকর্তা সাবরিওর উত্তরসূরি সুলুং টুং! সাবরিওর উত্তরসূরি সুলুং টুং!”
আমি তখন হাত তুলে ওদের থামতে বললাম। তখন একজন নেতা গোছের লাংমো এগিয়ে এসে অভিবাদন জানিয়ে বলল, “আসুন মহান সুলুং টুং! আসুন মহান সুলুং টুংয়ের অভিভাবক আর সহচরের দল। লাংমোদের পাহাড় আপনাদের স্বাগত জানাতে চায়।”
আমরাও প্রত্যুত্তরে শ্রদ্ধা জানিয়ে রওনা হলাম ওদের সঙ্গে।
কী সুন্দর যে লাংমোদের গ্রাম! যেন বড়ো কোনও শিল্পীর হাতে আঁকা ছবি। অথবা ঠিক যেন কোনও জাদুকরের মায়ায় সেজে ওঠা নগরী।
ছোট্ট ছোট্ট পাথুরে বাড়ি। নানা রঙের পাথরের তৈরি দেওয়াল। ছাত থেকে কল্কার মতো সব লতা নেমে এসেছে। সেইসব লতায় কত্ত রকমের ফুল! তাদের মিষ্টি গন্ধে বাতাস একেবারে মেতে রয়েছে। সব বাড়িরই ছাতে চিমনি। চিমনির উপরের ঢাকাগুলো সব ঠিক এক সঙ্গে করে উঠে যাচ্ছে, আবার নেমে আসছে। যখনই ঢাকা উঠছে, অমনি ভলভলিয়ে রঙিন ধোঁয়া বার হয়ে আসছে। সব রঙিন ধোঁয়া একসঙ্গে মিশে গিয়ে তৈরি করছে এক ধোঁয়ার চোঙ। আর সেই চোঙ আমাদের একটু আগে পর্যন্ত বয়ে এসে ফের ভেঙে যাচ্ছে নানান শাখায়। সেই শাখা ধোঁয়ারা বয়ে যাচ্ছে যে যে দিক খুশি। কিন্তু যেই না লুরেম গাছের ডগে ধাক্কা খাচ্ছে, অমনি সে হয়ে যাচ্ছে এক ফুল!
সেই নেতা গোছের লাংমো আমাদের হাঁ হয়ে যাওয়া মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “এ হল লুরেম গাছের ফুল ফোটবার কাল। লাংমোরা ঘরে ঘরে সুগন্ধি রান্না করছে। আর দেখুন সেই বাষ্পেরা মিলে কেমন লুরেমের ফুল হয়ে জমে যাচ্ছে।”
লুরেম ফুল আমার খুব প্রিয়। বললাম, “আচ্ছা! আমার শোবার ঘরের জানালায় যে লুরেমের ডালখানা লেপটে থাকে সেখানেও কি তোমরাই ফুল ফোটাও?”
“নিশ্চয়ই। আমাদেরই কোনও না কোনও দল যায় ফুল ফোটাতে।”
“শুধু লুরেম নাকি গো!” খুব মিষ্টি একটা গলা পেয়ে চেয়ে দেখি চিনির চেয়েও মিষ্টি এইটুকু এক লাংমো মেয়ে দু’বিনুনি করা পুঁচকি মাথাখানা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলছে, “অরলি, সিউম, টুরাং, নিলুই—সব ফুলই তো আমরাই ফোটাই!”
তেরাই সেই মেয়ের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে মুখখানা তার কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, “তাই নাকি গো মিষ্টি মেয়ে, তুমিও যাও?”
“এমা! আমি যাব কেন? আমরা সব মেয়েরা তো ঘরে ঘরে সুগন্ধি রাঁধি। নাবরু ঝোরার জলে তুবরো ঘাসের ডগায় জমা শিশির, আর মেঘ নয়তো জ্যোৎস্নার গুঁড়ো মিশিয়ে আমরা রং বানাই। কস্তূরী থেকে বানাই সুগন্ধ। সেই দিয়েই তো তৈরি হয় ফুল! জানো না?”
“না গো! আমরা এসব কিছুই জানি না।” উরুম লাংমো মেয়ের সুরেই বলল।
সেকথা শুনেই, নাকি উরুমের বলার ধরন দেখে কে জানে, সে মেয়ে উঠল খিলখিলিয়ে হেসে। তার সেই হাসির শব্দে ঝাঁক বেঁধে উড়ে এল সব প্রজাপতি। সে কী নাচ তাদের!
তখন সেই দলপতি লাংমো গলা খাঁকরে বলে উঠল, “বেশ বেশ! অনেক তো কথা হল। বাকি কথা না হয় খাওয়াদাওয়ার পরেই হোক।”
বেশ বেরসিক তো! দিব্যি জমেছিল, এমন সময় দিলে একেবারে ডাল ঢেলে! মনে হচ্ছিল বলি, ‘আমরা এখন খাব না।’ কিন্তু কী মনে হতে তেরাই আর উরুমের দিকে চেয়ে দেখি, ও বাবা! একেবারে কোমর বেঁধে তৈরি!
“বাব্বা! এত খিদে পেয়ে গেছে তোদের?”
“পাবে না বল?” উরুম বলল, “একে তো রাত হয়েছে, তার উপর ভাব আজ কত ছোটাছুটি! আর সবথেকে বেশি সেই…”
“সেই কী?”
“টুগ্গাদের ডেরার সেই সুরুয়ার গন্ধ, উফ!”
সত্যি। উরুমটার মতো পেটুক আর বোধহয় হয় না। নইলে শত্রু শিবিরে কেউ সুরুয়ার গন্ধের লোভে পড়ে?
তবে তাই হোক। সবার হয়ে দাদু বললেন, “বেশ, চলুন তবে।”
দলপতি লাংমো বলল, “চলুন, চলুন। আপনারা লাংমোদের অতিথি। মন ভরে খাওয়াব আজ আপনাদের।”
“সে নাহয় হবে।” দাদু বলল, “তার আগে শ্রদ্ধেয় দলপতি, আপনার নামটা যদি জানা যেত…”
সেই শুনে দলপতি আর সব লাংমোর সঙ্গে মুখ চাওয়াচাওয়ি জুড়লে। সেই দেখে বললাম, “কী গো! নাম বলতে তোমরা সব এমনি কেন করছ?”
দলপতি বলল, “না মহান সুলুং, আমরা লাংমোরা নিজেদের নাম বাইরের সমাজে বলি না।”
“শুধু নামই বা কেন?” সেই লাংমো মেয়ে টরটরিয়ে বলে উঠল, “বলতে গেলে খুব কম বাইরের মানুষ আমাদের এই গ্রাম দেখতে পায়। তোমরা আবার সেই অল্প মানুষদের মধ্যে প্রথম, যারা কিনা লাংমোদের বন্ধু হলে।”
“বন্ধু বলছ অথচ নাম বলতে পারছ না! এ আবার কেমন কথা?” আমি বললাম।
আমার কথায় সব লাংমোরা এ-ওর দিকে তাকিয়ে কীসব গুজগুজ ফুসফুস করল। তারপর দলপতি সেই লাংমো মেয়েকে দেখিয়ে বলল, “বেশ, তবে ওর নামটাই আগে শুনুন।”
সেই মিষ্টি লাংমো মেয়ে তার মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “শোনো বাপু, নাম শুনে-টুনে পরে কিছু বলতে এসো না যেন! অত কথার উত্তর আমি দিতে পারব না এই কিন্তু আমি আগেই বলে দিলাম, হ্যাঁ।”
আমরাও তাতে ঘাড় কাত করলাম।
তখন সেই লাংমো মেয়ে তার রিনিরিনি স্বরে বলল, “আমার নাম বিরিঞ্চি বিনোদিনী তিরিক্ষি তাম্বুলে কুসি আম কচি-কলা।”
“যাহ্, কলা!” ফস করে উরুম বলে উঠল, “এটা নাম!”
অমনি সেই কচি-কলা, লাংমো মেয়ে মুখ ফুলিয়ে ফেললে। আমি উরুমকে বকে দিয়ে বললাম, “কত সুন্দর নামটা, আর তুই ভালো বলতে পারলি না?”
এই না বলে আমি সেই লাংমো মেয়ে কচি-কলাকে আদর করব বলে হাত রাখলাম তার মাথায়। আরে! কী আশ্চর্য! আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী করে ওর মাথা ছুঁতে পেলাম!
ওমা! কচি-কলা তো শূন্যে ভাসছে! দলপতি লাংমো বলল, লাংমো মেয়েদের অভিমান হলেই নাকি তারা এমন ভেসে যায়। যতক্ষণ না অভিমান গলে ভাসতেই থাকে, ভাসতেই থাকে। আর তখন যদি হাওয়া দেয়, তাহলে যে কতদূর চলে যায় তার আর ইয়ত্তা নেই।
সেই শুনেই তো আমি কচি-কলার পুচকু মিষ্টি হাত দুটো ধরে নিয়ে বললাম, “তুমি কিচ্ছুটি যেন মনে কোরো না মিষ্টি বন্ধু কচি-কলা। যেমন মিঠা তোমার নাম, তেমনই মিঠা তোমার গলা। উরুমটা তো হাঁদা গঙ্গারাম। সেজন্যেই তো এমন বলে ফেলেছে। আর বলবে না।”
কেবল এইটুকুতেই কচি-কলার দুঃখ গলে হাসি। সুড়ুত করে নেমে এসেছে মাটিতে। আনন্দে নেচে উঠে বলছে, “কী মজা! কী মজা! মহান সুলুং টুং আমার বন্ধু! দেখো দেখো, সবাই দেখো সুলুং টুং কেমন ভালোবাসে কচি-কলাকে।”
আমাদের সবারই খুব ভালো লাগছিল কচি-কলার এই খুশি হওয়া দেখে। তখনই দলপতি লাংমো ফের তাড়া দিল আর আমরা সবাই চললাম খাওয়ার জায়গার দিকে।
যেতে যেতে কী মনে হতে দলপতি লাংমোর কাছে জানতে চাইলাম, “আচ্ছা দলপতি, দাদু যে বলেছিল তোমাদের বাস কলমডিলায়! তবে কি আমরা এখন কলমডিলায়?”
দলপতি একটু থেমে বলল, “না, মহান সুলুং টুং। আমরা এখন আরামডিলাতেই। আমরা লাংমোরা কাজের দরকারমতো ছোটো ছোটো বসতি তৈরি করে রাখি। যেবার যাদের ভাগে সেই কাজ পড়ে, তারা গিয়ে সেই গাঁয়ে থাকে। এবার যেমন আমরা এসেছি এই আরামডিলার চুড়োর গাঁয়ে।”
আরও নানান কথা বলতে বলতে আমরা এগোলাম। সবকথা তো আর বলতে পারব না, দলপতি তা না বলতেই আমাদের অনুরোধ করেছে। কাজেই সেসব বাদ রেখে এসো এবার তোমাদের বলি সেই রাতের ভোজের কথা।
বাপ রে বাপ! আয়োজন দেখে চোখ তো একেবারে কপালে উঠবার জোগাড়! শালগম থেকে সুরুয়া, রুটি থেকে পায়েস, বাদামের বড়া থেকে কমলার ক্ষীর—কী নেই সেখানে? আর কতরকম যে ফলের ঝুড়ি, কত কিসিমের যে জুস—সে আর কী বলি! উরুমের দিকে চাইলাম। উরুমের চোখে তখন খুশি একেবারে ঝকঝক করছে।
ভয়ংকর ভুজুঙ্গা!
যে ভোর আমরা সেই লাংমোভূমে দেখলাম, তাকে স্বর্গীয় বললেও যেন কম বলা হয়। রাতে লাংমো গাঁয়ের সৌন্দর্যটা ততটা ঠাওর হয়নি। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই পাখিরা সব গেয়ে উঠল। ভোরে এমন ডাক শুনলে মনে হয় না যে আর একটু আলিস্যি করি? আমিও তেমনই করছিলাম। কিন্তু উপায় আছে কি তার? মুনরোটা কানের কাছে ‘বাইরে চলো, বাইরে চলো’ বলে ডাক জুড়ল। কাঁহাতক আর সহ্যি হয়! উঠেই পড়লাম।
ও বাবা! উরুম, তেরাই সব্বাই ঘুমে কাদা। আমি যখন উঠেছি, তখন ওরাই বা আয়েশ করবে কেন? ঠেলে ঠেলে তুললাম ওদেরও। তারপর সবাই মিলে বেরোলাম। বেরিয়েই দেখি দাদু দাঁড়িয়ে আছে, আর তার মাথার উপর উড়তে উড়তে ঘুরতে ঘুরতে সেই পাজি মুনরো বলে চলেছে, “বাব্বা! ঘুম তবে ভাঙল! কখন থেকে ডেকে ডেকে আমি তো একেবারে হদ্দ! যাক তবুও উঠেছ।”
উরুম তিরিক্ষি মেজাজে বলে উঠল, “থামবি?”
মুনরো কি থামার পাত্র? উরুমের কথা শুনে সে বরং আরও নানান কথা ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে শুরু করল যাতে কিনা উরুমের বিরক্তি আরও বাড়ে। একসময় আর না পেরে উরুম ‘তবে রে’ বলে যেই না মুনরোর দিকে ধেয়ে গেছে, অমনি দাদু ছোট্ট একটা ধমক দিয়ে বলল, “আহ্, উরুম! চারদিকে একবার চেয়ে দেখো আগে। মুনরোকে বকার বদলে দেখবে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করবে।”
উরুম তো থেমে গিয়ে গজগজ করতে লাগল; কিন্তু আমরা চেয়ে দেখলাম, বটেই তো! এমন সুন্দর সকাল তো আগে কখনও দেখিনি! কাল মালুম হয়নি বটে, কিন্তু আজ দেখলাম আমরা রয়েছি আরামডিলার সবচেয়ে উঁচু সিংলির চুড়োয়। আমাদের সামনে কেবল আকাশ আর আকাশ। কুয়াশায় মুড়ে দেওয়া নীল আকাশ। কুয়াশা নয়, মেঘ। কোথাও জমাট বাঁধা, তো কোথাও ধোঁয়া ধোঁয়া। হাঁ করলেই মেঘ ঢুকে যাচ্ছে মুখের ভিতর। আমাদের নীচে থোকা থোকা মেঘ জমে আছে সব। আর সেই সব মেঘে এখন সূর্যের লাল রং। যেন আগুনের বাগানে সব থোকা থোকা ফুল ঝুলে আছে। সেই বাগানেই বেশ খানিক দূরে মাথা উঁচিয়ে আছে আরেকটা পাহাড়। সিংলির চুড়ো থেকে একটু নিচুই। ঠিক যেন একটা কলম লম্বালম্বি দাঁড়িয়ে আছে। এইই তবে কলমডিলা!
সিংলির চেয়ে খানিক নিচু বলেই চুড়োয় না ওঠা অবধি আমরা দেখতেই পাইনি। এই সক্কালবেলায় সেই কলমডিলার যে কী রূপ সে আর আমি কেমন করে বলি। গাছে গাছে কেবল রঙের মেলা সে পাহাড়ে। অজস্র ঝরনা সেইসব গাছেদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে নেচে নেচে নেমে যাচ্ছে নীচে। এখান থেকেও তাদের মিষ্টি খলখল কলকল শব্দ শোনা যাচ্ছে।
তেরাই হঠাৎ বলল, “সু! এদিকটায় একবার তাকা।”
তেরাইয়ের আঙুল মেনে তাকিয়ে আরেক প্রস্থ অবাক বনলাম। এ বোধহয় লাংমোদের গ্রাম। তাবড় তাবড় শিল্পীরাও সবাই ডাঁহা ফেল করে যাবেন এমন ছবি ক্যানভাসে আঁকতে। এই গ্রাম কাল রাতেও তো দেখেছি। কিন্তু নরম নীল আলোয় তখন তার এক রূপ, আজ সুয্যির নরম ভোরে তার রূপ আরেক। ঘরের গঠন তো কালই বলেছি, আজ বলব ঘরের পৈঠা থেকে ছাত অবধি ছেয়ে থাকা অদ্ভুত লতার কথা। জলের মতো স্বচ্ছ তার ডাঁটা। বাদামের বুকের মতো তার পাতা। লতায় লতায় যে মুকুল তাতে যেন সূর্যের সব রং। আর কী তাদের বাহার! কোনোটি ঘণ্টার মতো, তো কোনোটি যেন ডানা মেলা প্রজাপতি।
কুয়াশার মেঘ ছিঁড়ে যেখানেই সূর্যের আলো এসে পড়ছে, সেখানেই স্বচ্ছ ডগা জমে যেন কুঁড়ি হয়ে পরক্ষণেই মেলে দিচ্ছে পাপড়ি। হলুদ রেণু মাখা মৌমাছিরা ডান্সিং ফ্রক পরা ছোট্ট রাজকুমারীর মতো ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে, গুনগুনিয়ে গেয়ে গেয়ে যেন অভিবাদন জানাচ্ছে সেই সুন্দরী ফুলকুমারীকে। আর ফুলের কাছাকাছি পাতারা সব সঙের বাঁশির মতো একবার গুটিয়ে যাচ্ছে, আবার পরক্ষণেই ফুররর করে মেলে যাচ্ছে। ভারি মজার!
সত্যি, কত না সুন্দর আমাদের এই পাহাড়দেশ! কতই না সুন্দর আমাদের এই পৃথিবী! এই ফুল, এই পাখি, এই ঘাস, এই পাথর, এই ঝোরা, এই শিশির—সবকিছু সুন্দর। এই সুন্দর পৃথিবীকে কিছুতেই মলিন হতে দেব না, বুক দিয়ে আগলে রাখব সবাই মিলে।
“এই তো আমাদের মহান নেতা সুলুং টুং-এর উপযুক্ত কথা।”
রিনিঝিনি গলাটা তো আমার চেনা। তাকিয়ে দেখি, ঠিক তাই। লাংমো মেয়ে কচি-কলা। বললাম, “আমি কি জোরে কথা কইছিলাম গো?”
কচি-কলা বলল, “না গো, না!”
“তবে তুমি যে বললে?”
“সে আমরা লাংমোরা অমন চাইলেই পারি। কে কখন কী কথা তার মনের ভিতরে ভিতরে বলছে, ইচ্ছে করলেই শুনতে পারি।”
“বাবা! দারুণ ক্ষমতা তো! আমাকে শিখিয়ে দেবে?”
“সময় যখন হবে সে তুমি আপনিই শিখে যাবে। এ আর এমন কী ব্যাপার?”
“তার চেয়ে বলো না ভাই শেখাবে না!”
“কী মুশকিল! এ জিনিস শিখিয়ে দেওয়ার নয় গো সু। শিখে নেওয়ার। যখন সময় আসবে দেখবে তুমি কেমন শিখে গেছ।”
“বেশ।” একটু থেমে নিয়ে বললাম, “তবে এখন আমাকে তোমাদের গ্রামটা ঘুরে দেখাও।”
“নিশ্চয়ই! চলো তবে বেরিয়ে পড়ি। আর দেরি হলে তো তোমরা আবার সময় পাবে না। কলমডিলায় যেতে হবে না তোমাদের?”
এই না বলে সেই মিষ্টি লাংমো মেয়ে কুমারী কচি-কলা ছোট্ট ছোট্ট তুলুং তুলুং লাফ দিতে দিতে এগোল। একটু করে এগোয় আর হাতছানি দিয়ে একবার এপাশ ফিরে ডাকে, আবার ওপাশ ঘুরে ডাকে। আর দু’পাশের লম্বা লম্বা ঘাসবনের আড়াল থেকে পিলপিলিয়ে বেরিয়ে আসে কচি-কলার মতোই আরও সব লাংমো মেয়েরা। দেওদারের, পাইনের ডাল থেকে দড়ি বেয়ে নেমে আসে চোগা চাপকান পরা লাংমো পুরুষ। লম্বা শিঙাড়ার মতো টুপি খুলে তারা আমাদের অভিবাদন জানায়; প্রত্যুত্তরে আমরাও ঝুঁকে তাদের সম্মান দেখাই।
এগোতে এগোতে একসময় আমরা এসে পড়লাম লাংমো গ্রামের এক্কেবারে মধ্যিখানে। ছোট্ট ছোট্ট লাংমোরা সেখানে কত্ত রকমের কাজে ব্যস্ত। কেউ বাদামের খোসা পিষে রং বানাচ্ছে, কেউ আবার চিনেবাদামের খোলায় ছোট্ট শিশি থেকে ঢেলে দিচ্ছে শিশিরের জল, আর সেই খোসাখানা রেখে দিচ্ছে কেউ দুই পাথরের খাঁজে। ঘুরে বেড়ানো মেঘেদের দল ছুটে এসে জমে এত্তটুকু হয়ে যেই না সেঁধোচ্ছে সেই বাদামের খোসায়, অমনি সেখান থেকে বইতে শুরু করছে জলের ধারা। লাংমো মেয়েদের মতোই সেই জল পাথরের উপর দিয়ে নাচতে নাচতে গাইতে গাইতে একসময় যেই উঁচু পাথরের কোল থেকে লাফিয়ে নীচে নামছে, তখনই হয়ে যাচ্ছে এক-একটা ঝোরা।
উরুম তাজ্জব গলায় বলল, “তার মানে এই পাহাড় জুড়ে যত ঝোরা, সব তোমাদের বানানো?”
“না না। ঝোরা তো মেঘেদের বানানো। আমরা তো শুধু ব্যবস্থা করি বয়ে যাওয়ার।”
আমাদের অবাক দশার আরও কত যে বাকি সে আর কীভাবে বলি। বিস্তারে না বলে বরং এটুকুই বলি যে, আমাদের পাহাড় গাঁয়ে যত যা ফুল ফোটে তার সব তৈরি হতে দেখলাম। তেরাই তো বলেই ফেলল, “নিজের চোখে না দেখলে এসব কক্ষনও বিশ্বাসই হত না, বল সু?”
তেরাইয়ের কথা শেষ হতে না হতেই পায়ের নীচের পাথর যেন কেঁপে উঠল। বেশ কয়েকবার। লাংমোভূমে যেন হঠাৎ সাড়া পড়ে গেল। হাতের কাজ সব ফেলে হঠাৎ যেন সবাই এক অজানা কাজের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করল।
“মনে হয় কোনও বিপদের পরিস্থিতি।” দাদু বলল।
লাংমো দলপতিও এসে গেল। চিন্তা মাখা গলায় সে বলল, “মহান নেতা সুলুং টুং, খারাপ মানুষরা আরামডিলায় এসে পড়েছে। সঙ্গে সাংঘাতিক সব অস্ত্রশস্ত্র!”
খানিকক্ষণ চুপ করে ফের বলল, “আমরা যতক্ষণ পারি ওদের আটকাব। কিন্তু আপনাদের আর দেরি করা চলে না। এক্ষুনি রওনা হতে হবে কলমডিলার দিকে।”
“তোমাদের এই অবস্থায় রেখে…”
আমার কথা শেষ হতে না হতেই দাদু বলল, “আমরা এভাবে চলে যাব! সে কখনও হয়?”
“আপনাদের উপযুক্ত কথাই আপনারা বলেছেন।” আমাদের দিকে চেয়ে দলপতি বলল, “কিন্তু এমন অবস্থায় আপনাদের সুরক্ষিতভাবে কলমডিলায় রওনা করিয়ে দেওয়ার নির্দেশই আমাদের দিয়েছেন মহান সাবরিও।”
“কিন্তু তোমরা ওদের সঙ্গে পারবে কেমন করে?” আমার উদ্বেগ আমি চেপে রাখতে পারলাম না। “অস্ত্রশস্ত্রর কথা বাদ রাখলেও তো আকারে ওরা তোমাদের থেকে অনেক বড়ো!”
“লাংমোরা ছোটো হলেও প্রকৃতি তাঁর সমস্ত জাদু লাংমোদের দিয়ে রেখেছেন। কাজেই আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন নেতা সুলুং। তাছাড়া ভুজুঙ্গা তো আছেনই।”
“কোথায় আছে ভুজুঙ্গা? তাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?”
“এই গোটা পাহাড় তাঁর। দেখলেন না পাহাড় কেমন নড়ে উঠল! তার মানে তিনি জেগে উঠলেন।”
দলপতির কথা শেষ হল কি হল না, পাহাড় ফের কাঁপতে শুরু করল থরথর করে। সব লাংমোরা দু’হাতের আঙুল মুখে পুরে শিসের মতো একটানা সুর বাজাতে থাকল। কোত্থেকে উড়ে এল হাজার হাজার পাখি। লাংমোদের পিঠে নিয়ে ফের তারা শুরু করল উড়তে। দলপতি বলল, “আপনারা এবার রওনা হোন নেতা সুলুং টুং।”
কী করা উচিত সে নিয়ে সংশয় হয়তো আমার মুখে প্রকাশ পেয়ে থাকবে, তাই বোধহয় দাদু বলে উঠল, “সুলুং, তুমি এখানে এসেছ মহান সাবরিওর নির্দেশে। কাজেই এখনও তাঁর নির্দেশ মেনেই তোমার চলা উচিত।”
দাদুর কথাতেও মন মানছিল না। হঠাৎ একটা কথা মাথায় এল, দৌড়ে উঁচু পাথরটার উপর উঠে চিৎকার করে বললাম, “হে মহান ভুজুঙ্গা! অনুগ্রহ করে একবার দেখা দাও। তোমার দেখা না পেলে লাংমোদের এই বিপদের মধ্যে রেখে আমি এগোতে পারছি না।”
বলার অপেক্ষা কেবল। আরামডিলায় তুমুল কম্পন শুরু হল। পাথরের উপর দাঁড়িয়ে থাকাই দায় আমার। হামাগুড়ি দিয়ে কোনোরকমে নেমে সেই পাথরটাকেই আঁকড়ে দাঁড়ালাম। দাদু, উরুম, তেরাই সবাই মাটিতে বসে পড়েছে। হঠাৎ যেন সিংলির চুড়োটা ফেটে গেল। পাথর ছিটকে এল চারদিকে। আগুনের লেলিহান শিখা বেরিয়ে এল সিংলির চুড়ো থেকে। ধীরে ধীরে সেই জ্বালামুখ থেকেই প্রকট হলো এক অদ্ভুত দর্শন জীব। ড্রাগনের মতন তার মুখ। মুখের ভিতরে লম্বা দাঁত দুটো ঝকঝক করছে। সিংলির চুড়ো থেকে সে এগিয়ে আসতে থাকল আমাদের দিকে।
গপ্পোকথায় যে মনস্টারদের কথা থাকে, ভুজুঙ্গা অন্তত তাদের বিশটার সমান। ধপধপে সাদা গা! পুরনো বটগাছের কাণ্ডের মতো মোটা আর শক্ত শরীর। মুখটাই তো বোধহয় আমার সমান। এই যে আমাদের সামনে এসে পড়েছে, এখনও তাঁর শরীরের আদ্ধেকটা রয়ে গেছে সিংলির চুড়োর সেই গর্তের ভিতর।
আমি মাথা ঝুঁকিয়ে ভুজুঙ্গাকে শ্রদ্ধা জানালাম। সেও তাই করল। একটু এগিয়ে ওর মাথায় হাত বোলাতেই সে মাথাটা নেড়ে বলে উঠল, “মহান সুলুং টুং! আপনি নিশ্চিন্তে কলমডিলা রওনা হোন।”
ভুজুঙ্গার গলার স্বরে যেন পাহাড় গমগমিয়ে উঠল। কথা শেষ হতে না হতেই ভুজুঙ্গা তার বিরাট লেজটা আকাশে তুলে বিরাট এক ঝাপটা মারল পাহাড়ের কিনারায়। ধস নামার আওয়াজের সঙ্গেই কানে ভেসে এল অনেকগুলো আর্ত চিৎকার।
লাংমো দলপতি উড়তে উড়তে সামনে এসে বলল, “আর দেরি করবেন না নেতা সুলুং, দয়া করে রওনা হোন।”
দাদু আমার হাতটা ধরে বলল, “চলো সু।”
লাংমোদের সবাইকে সেইভাবে আর বিদায় জানানো হল না। কেবল দলপতিকে মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে, আরামডিলার পাথরে কপাল ছুঁইয়ে আর ভুজুঙ্গার মাথায় আরেকবার হাত বুলিয়ে আমরা নেমে চললাম পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে।
নেমে তো চললাম, কিন্তু মন রইল পড়ে লাংমো গ্রামে। কী জানি কী হয়। ভুজুঙ্গার আশ্বাসেও যে মন শান্ত হতে চাইছে না। কেবল থেকে থেকে কু গাইছে।
কলমডিলার পথে
যারা বলে পাহাড়ে চড়ার থেকে নামা ঢের সহজ, আমি বলব তারা সেরকম পাহাড় দেখেইনি। সিংলির চূড়া থেকে এই যে আমরা নামছি, প্রতিমুহূর্তে সতর্ক থাকতে হচ্ছে। একটু অন্যমনস্ক হলেই পায়ের তলা থেকে সুড়সুড় করে সরে যাচ্ছে নুড়ি।
পথটা খুব খাড়া। উপর থেকে যত ঘন বলে বনটাকে মনে হয়, আদতে কিন্তু তেমনটা নয়। বেশ ফাঁকা ফাঁকা। তার উপর নুড়িভরা পথ। কাজেই নামা বেশ শক্ত। নেহাত আমরা সবাই পাহাড়েরই ছেলেমেয়ে, কাজেই নেমে আসছিলাম একভাবে। অবশ্য দাদুর কথায় আমরা সবাই কোমরে দড়ি বেঁধে চলছিলাম।
সবার আগে চলছিল দাদু। তারপর তেরাই আর উরুম, সবশেষে আমি। মাথার উপর উড়ছিল মুনরো আর উরুমের পাশে পাশে লাফিয়ে লাফিয়ে চলছিল খুবরু। আমরা কেউই কোনও কথা বলছিলাম না। লাংমোদের চিন্তায় সবারই মন ভার ছিল।
চুপচাপ নামতে-নামতেই একসময় এক অমানুষিক চিৎকারে পিছন ফিরে তাকাতেই হল। দেখি সিংলির চূড়া ধোঁয়াচ্ছন্ন। সেই ধোঁয়ার মেঘের মধ্যে আবছা দেখা যাচ্ছে ভুজুঙ্গাকে। তুমুল লড়াই হচ্ছে ভুজুঙ্গার সঙ্গে অদ্ভুত দর্শন ভয়ংকর এক জীবের।
সেই ভয়ংকর জীবটার শরীরের নীচের দিকটা সাপের মতো কিন্তু উপরের দিকটা পেশীবহুল এক দৈত্যের! লম্বা লম্বা কান। মাথার মাঝখানে একটা প্রকাণ্ড শিং। হাতে একটা কাঁটাওয়ালা ভয়ংকর মুগুর।
সে যে কী ভয়ানক যুদ্ধ! ভুজুঙ্গা তাকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতে যায় তো বিদ্যুতগতিতে সেই প্রাণী সরে সরে গিয়ে বাঁচিয়ে নেয় নিজেকে। ভয়ংকর আঘাত করে মুগুর দিয়ে। ভুজুঙ্গাও তৎপর। কাজেই মুগুরের আঘাত লাগে সিংলির চূড়ায়। নিমেষে ধুলো হয়ে যায় পাথর।
এরই মাঝে হঠাৎ দেখি উরুম যেন কেমন অস্থির আচরণ করছে। মাঝে-মাঝেই দুই হাতে মাথাটা চেপে ধরছে আর বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। ভালো করে শুনে দেখি, বলছে, “গর্জন, গর্জন!”
তেরাই এমন অবস্থাতেও উরুমকে বকা দিচ্ছে। উরুম তাতে আমল না দিয়ে প্রচণ্ড অস্থিরভাবে বলল, “তোরা কেউ জীবটার ভয়ানক গর্জন শুনতে পাচ্ছিস না?”
সত্যিই চারদিকে প্রচণ্ড ফোঁস ফোঁস শব্দ। আর তার মধ্যেই রক্ত জল করা একটা অমানুষিক গর্জন। আর সেই প্রচণ্ড গর্জনে এমন কিছু হচ্ছে যে প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছে আমাদের। উরুম তো সহ্যই করতে পারছে না। দু’হাতে কান চেপে ধরে আছে। দাদু পোশাকের ফার খানিক ছিঁড়ে গোল্লা করে গুঁজে দিল উরুমের দু’কানে। তাতে খানিকটা যেন স্বস্তি পেল উরুম।
দাদু উত্তেজিত গলায় বলে উঠল, “এইই সেই শত্রু পারতপক্ষে যার নামও উচ্চারণ করতে নেই। ভয়াল, ভয়ংকর! তবুও তার উপায় ছিল না এই পাহাড়দেশে ঢোকার, যতদিন না এই পাহাড়দেশেরই কোনও মানুষ তাকে হাতে ধরে না নিয়ে আসে। কুলাঙ্গার টুগ্গা সেই অন্যায়টাই করল। ক্ষমার অযোগ্য অন্যায় করেছে টু্গ্গা। এই পাহাড় মাটি সোনার দেশ আমাদের। টুগ্গা সেই পাহাড়ের সন্তান হয়েও সেই মায়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এই প্রকৃতি টুগ্গাকে শাস্তি দেবেই। দেবেই।”
দাদুর কথা শুনে টুগ্গার উপর রাগ যতটা না হল, তার চেয়েও বেশি চিন্তা হতে শুরু করল লাংমোদের জন্য। এতক্ষণে তারা নিশ্চয়ই বন্দি! নইলে ভুজুঙ্গা তো যুদ্ধে আসত না!
“দাদু! লাংমোদের বাঁচাতেই হবে। যে করেই হোক। চলো আমরা আবার উপরে যাই। এই পাহাড়দেশের সব গাছ, সব প্রাণী আমার কথা শুনবে। চলো সবাইকে নিয়ে ছাড়িয়ে আনি আমাদের লাংমো বন্ধুদের।”
“লাংমোদের নিজের ইচ্ছা না হলে তাদের ক্ষতি তো দূর, তাদের ধরতে পারে এমন কেউ এখনও জন্মায়নি বন্ধু।”
পরিচিত গলাটা পেয়েই তাকিয়ে দেখি লাংমো মেয়ে কচি-কলা!
“তুমি এখানে কেমন করে?” তেরাই আমার আগেই ওকে জিজ্ঞাসা করল।
“মহান ভুজুঙ্গার আদেশে। তিনি আমাদের পাঠিয়েছেন তোমাদের কাছে।”
“কী বলেছে তোমায় ভুজুঙ্গা?” আমি জানতে চাইলাম।
“বলেছেন, সুলুং যখন সিংলির চূড়ায় ফিরে আসতে চাইবেন তখন যেন আমি তাঁকে মনে করিয়ে দিই পিছনে না ফিরে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কথা। যেন তাঁকে বলি যে সব লাংমোরা সুরক্ষিত। লাংমোরা সবাই এতক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে তাদের পরম বন্ধু সাবরিওর কাছে।”
“কীভাবে?” উরুম জানতে চাইল।
“সব বলব, তবে যেতে যেতে।” এই বলেই সেই লাংমো মেয়ে সামনের দিকে নামার জন্য পা বাড়াল।
ভয়ানক যুদ্ধে রত মহাবীর ভুজুঙ্গার জন্যে আরেকবার প্রার্থনা করে আমরাও এগোলাম ফের কলমডিলার পথে।
লাংমো মেয়ে বলল, “আমাদের দলপতির জানো তো অনেক ক্ষমতা। তিনি সব লাংমোর ইচ্ছেশক্তিদের জড়ো করে সবাইকে নিয়ে মুহূর্তে চলে গেছেন মহান সাবরিওর কাছে। কাজেই তোমরা একদম চিন্তা কোরো না।”
একটা কথা মনে হল। তাই কচি-কলাকে বললাম, “আচ্ছা! তোমাদের কত কত শক্তি, কত কত ক্ষমতা, কই, আমার তো এর এককণাও নেই! তাহলে আমায় তোমরা নেতা বলে মেনে নিচ্ছ কেন?”
কথাটা শুনেই কচি-কলা বলে উঠল, “কারণ, সাবরিও তোমায় নেতা বেছেছেন। রেনোলাবিলার আলো তোমায় খুঁজে নিয়েছে। এদের তো কারও আর ভুল হবার জো নেই! আমরা সবাই জানি যে তুমি মহান শক্তির অধিকারী।”
“কিন্তু আমি তো নিজেই জানি না!”
“সে তুমি নিজেই জেনে যাবে ঠিক সময় এলে।”
কথা হতে-হতেই ফের সেই অমানুষিক গর্জন। পিছন ঘুরে উপরে চেয়ে দেখি, সিংলির চূড়ায় ভুজুঙ্গা তার শরীর দিয়ে পেঁচিয়ে ধরেছে সেই জীবটাকে। পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে অনেক উঁচুতে চলছে দু’জনের মুখোমুখি লড়াই। ভুজুঙ্গার আগুনে ঝলসে যাচ্ছে সেই জীবটার মুখ, আর অমানুষিক গর্জন করে ছটফট করছে সে।
হঠাৎ কারা যেন গোলা বর্ষণ করতে শুরু করল ভুজুঙ্গার দিকে। সামান্য দৃষ্টি সরল ভুজুঙ্গার। কিন্তু তাতেই অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় সেই জীব ভুজুঙ্গার বাঁধন থেকে ছাড়িয়ে নিল তার একটা হাত আর তীব্র চিৎকার করে কাঁটার মুগুর দিয়ে ভয়ানক আঘাত হানল ভুজুঙ্গার মুখে।
এলিয়ে যেতে যেতে ভুজুঙ্গার মাথাটা ধাক্কা খেল সিংলির চূড়ায়। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল পাথর। কিন্তু মুহূর্তেই সামলে নিয়ে ফের তীব্র আক্রমণ করল ভুজুঙ্গা।
ওদিকে ভুজুঙ্গার ধাক্কায় চূড়া থেকে পাথরের চাঁই ধসে এল নীচের দিকে। দাদু চেঁচিয়ে উঠল, “সাবধান! সাবধান!”
পাথর গড়িয়ে নেমে গেল নীচের দিকে। আমরাও বেসামাল হয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকলাম। ভাগ্যিস দড়িতে সবাই বাঁধা। তাই আলাদা হয়েও গেলাম না বটে, কিন্তু গড়িয়ে পড়তে পড়তে বুঝতে পারলাম, হাত-পায়ের চামড়া সব ছিঁড়ে যাচ্ছে। উরুম, তেরাই প্রাণভয়ে আমার নাম ধরে চিৎকার করছে। গড়াতে-গড়াতেই ভাবছি, এখনও কতটা নীচে সমতল। এতটা গড়ানের ফলে আর কি আমাদের হাড়গোড় কিছু বেঁচে থাকবে!
“হে মহান সাবরিও! আমি সুলুং টুং আপনার কাছে প্রার্থনা করছি, আমার জীবনের বদলে আর সব্বাইকে দয়া করে রক্ষা করুন! হে আরামডিলার পাথর! তোমরা সবাই চাইলে আমার উপর দিয়ে বয়ে যাও, কিন্তু আমার সঙ্গীদের সুরক্ষিত করো।”
মুখ দিয়ে কথাগুলো বের হওয়া মাত্রই সেই রুক্ষ পাথর কেমন করে যেন হয়ে গেল নরম স্পঞ্জ। নীচে আছড়ে পড়েও কোনও ব্যথাই লাগল না আমাদের। আর লাংমো মেয়ে এসে যেই তার হাতের ছোট্ট লাঠিটা বুলিয়ে দিল, অমনি যার যার দেহে যা যা ক্ষত সব মিলিয়ে গেল।
কচি-কলা সবার দিকে ফিরে বলল, “দেখলে তোমরা! সাবরিও কেন সুলুং টুংকে নেতা বেছেছেন? নিজের জীবনের বিনিময়েও যিনি সঙ্গীদের সুরক্ষা চান, তিনিই তো মহান নেতা।”
সবাইকে সুরক্ষিত দেখে এত আনন্দ হচ্ছিল যে আমার কান্না পেয়ে গেল। একই সঙ্গে ভুজুঙ্গার কথা ভেবেও কেন যেন চোখে জল আসছিল। সামলানোর জন্য দাদুর দিকে তাকালাম। দাদুর চোখের কোলও যে ভরে আছে! আর পারলাম না। হু হু করে কেঁদে ফেললাম। ছুটে এসে তেরাই আমার মাথাটা চেপে ধরল ওর বুকে।
ভুজুঙ্গা বনাম মুঙ্গো
যেখানে এখন আমরা দাঁড়িয়ে, আমাদের ইশকুলের ভূগোলের তাসি-স্যার থাকলে তাকে নির্ঘাত বলতেন গিরিখাত। আমাদের একপাশে খাড়া আরামডিলা, আর পাশে কলমডিলা।
সিংলির চুড়ো হয়তো এখান থেকেও দেখা যায়। কিন্তু এখন যে দেখা যাচ্ছে না, তার প্রধান কারণ হল মেঘ। ঘন কালো মেঘে আরামডিলার উপরের দিক ঢাকা। মাঝে মাঝে এখনও কেঁপে কেঁপে উঠছে আরামডিলা। ছোটোবড়ো পাথর গড়িয়ে নামছে অনবরত। একটা তো প্রায় উরুমের ডান পায়ের পাশে এসে পড়ল।
দাদু বলল, “সু, আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। চলো আমরা এবার কলমডিলায় উঠি।”
তেরাই এখনও আমার গা ঘেঁষে। ওর হাতটা আমার হাতে এখনও। ওভাবেই হাতের তেলো দিয়ে চোখটা মুছে নিয়ে এগোলাম।
কিন্তু যাদের সঙ্গী মুনরো আর কচি-কলা, তাদের কি আর মনখারাপের জো থাকে? দু’জনের কথায় আর কাণ্ডকারখানায় কলমডিলার রাস্তায় খানিক উঠতে-উঠতেই মন ফের ভালো হয়ে গেল। জ্বালা যা হল সে শুধু বেচারা উরুমের। কচি-কলা আর মুনরো পালা করে ওকে জ্বালাতে থাকল। উরুম তো বেজায় চটে একা একা আগে আগে চলতে শুরু করল। আর অমনি ওর মাথার উপর ঘুরতে ঘুরতে মুনরো গাইতে থাকল—
পেরোলাম আরামডিলা
সুমুখে কলমডিলা
আরও কত এমন টিলা
পার হব যে তার সীমা নাই!
বলো ভাই, বলো ভাই, বলো না ও উরুম ভাই!
লাংমো-ভুঁইয়ের মানুষ
গেল কোথা উড়িয়ে ফানুস!
হাঁই হাঁই হাঁপুস হাঁপুস
হাঁফ ছেড়ে যাও কোথা ভাই?
বলো ভাই, বলো ভাই, বলো না ও উরুম ভাই!
ওরে বাবা! এই যে পাহাড়!
সব কিছু অচেনা তার!
কেউ যদি মটকায় ঘাড়!
তুম্বো উরুম ভাবছ কি তাই?
বলো ভাই, বলো ভাই, বলো না ও উরুম ভাই!
মুনরোর গানের সঙ্গে-সঙ্গেই কচি-কলা ঘুরে ঘুরে উড়ে উড়ে নেচে নেচে বেড়ায় আর যেই না উরুমের নাম শোনে, অমনি তার ছোট্ট ছোট্ট আঙুল দিয়ে উরুমের থুতুনি ধরে নেড়ে দেয়। আর উরুমের তুম্বো মুখ আরও তুম্বো হয়ে যায়। শেষমেশ যখন খুবরুও ওই গানে তুড়ুং তুড়ুং নাচ জুড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল উরুমের কোলে, ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে উরুম চেঁচিয়ে উঠল, “তবে রে!”
অমনি খিলখিল করে হেসে উঠল তেরাই। আমারও খুব হাসি পাচ্ছিল। কিন্তু হাসলাম না।
তবুও দাদু মিছিমিছি আমাকেই বকে দিয়ে বলল, “আহ্! কী হচ্ছে দিদি! কত ভালো ছেলে উরুম, ওকে নিয়ে এত মজা করা!” বলেই এক গাল হেসে উরুমকে ডেকে বলল, “কই, দেখি উরুম, আয় তো দাদা। কে তোর ঘাড় মটকায় আমিও তো দেখি! এমন কলাগাছের মতো মোটা ঘাড়, মটকাবে বললেই হল?”
“দাদু, তুমিও!”
উরুমের কথা শুনে ফের সবাই হেসে উঠল। দাদু বলল, “থাক থাক, অনেক হয়েছে। এবার আর উরুমকে কেউ জ্বালাবে না। চলো আমরা বরং এগোই।” তারপর লাংমো মেয়ে কচি-কলাকে বলল, “ও লাংমো মেয়ে! এবার এই কলমডিলার কথা কিছু বলো না আমাদের, শুনি!”
কচি-কলা হাসি থামিয়ে ভুরু কুঁচকে বলল, “এই কথাটা আগে বললেই তো হত। আমি কখন বলব না বলেছি?”
আমি তাকে বললাম, “সে তো তুমি আমাদের সঙ্গেই আছ, বলবেও। কিন্তু একবার তো বলো, আমরা চলে আসার পর সেখানে কী ঘটেছিল। আমার যে এখনও মন থেকে দুশ্চিন্তা যাচ্ছে না।”
সেই কথায় লাংমো মেয়ে বাম পায়ে আলতো টোকা দিয়ে বেশ খানিকটা উঠে গেল হাওয়ায়। তারপর আলোর মতো হাতার কাপড়ে চোখ মুখটা মুছতে মুছতে নামতে নামতে বলল, “বেশ, তবে সেই কথাই বলছি।”
কচি-কলা তার কথা শুরু করতে-করতেই আমরা আরামডিলার চড়াইয়ের বনপাহাড়িতে ঢুকে পড়লাম। চারদিকে মেঠো ফুলের গন্ধ। লতায় পাতায় আকাশটা প্রায় ঢেকে দিল যেই, লতার ডগায় ডগায় আগায় আগায় টুকুস টুকুস করে হলুদ, গোলাপি, বেগুনি ফুলেরা ফুটতে শুরু করল যেই, লাংমো মেয়ে কচি-কলাও বলতে শুরু করল।
“তোমরা যখন চলে এলে, তার কিছুক্ষণ পরেই তোমাদের মতোই মানুষদের একটা বড়ো দল উঠে এল আরামডিলায়। কী নিষ্ঠুর তাদের চোখ! কী ভয়ানক তাদের হাতের অস্ত্রশস্ত্র! একজন তো আবার এই পাহাড়দেশেরই লোক।”
“টুগ্গা! টুগ্গা!” উরুম চেঁচিয়ে উঠল।
কচি-কলা তার ছোট্ট মাথাটা দু’বার ঝাঁকিয়ে নিয়ে ফের বলতে শুরু করল, “ওদের হাতে অস্ত্র আছে তো কী? আমরাও কম কীসের? তাছাড়া ভুজুঙ্গা তো আছেনই আমাদের সঙ্গে। কাজেই ধুন্ধুমার যুদ্ধ বাধল। কিন্তু ওদের কীসব কায়দা জানা আছে, একরকম চশমা পরে নিল সবাই। ব্যস! আমাদের আর কোনও জাদুই তাদের উপর কোনও কাজ করল না। শেষমেশ ভুজুঙ্গা এসে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ওদের উপর। ওদের কাছে একরকমের অস্ত্র আছে, সেখান থেকে আলো বেরোয়! আর যেখানে লাগে সবকিছু পুড়িয়ে দেয়। কিন্তু মহাবীর ভুজুঙ্গার তাতে কিচ্ছু হয় না। উলটে ভুজুঙ্গার আগুনে তারা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কিন্তু কীরকম এক পোশাক পরে নিল তারা। আর ভুজুঙ্গার আগুনেও কিছু হয় না তখন। প্রচণ্ড রেগে ভুজুঙ্গা গোটা আরামডিলাকে বেড় দিয়ে শুরু করলেন ভয়ংকর তাণ্ডবলীলা! দুশমনদের দল একেবারে ছত্রভঙ্গ তার জেরে। কিন্তু তখনই নেড়া মাথা লাল চামড়া একটা লোক এসে উঠল। কী কুটিল চোখ তার! চারদিক মুহূর্তে দেখে নিল সে, তারপর নিজেকে বড়ো করতে শুরু করল। বিরাট বড়ো হয়েই সে ভুজুঙ্গার মাঝখান থেকে তুলে নিয়ে মাথার উপর বোঁ বোঁ করে ঘোরাতে শুরু করল। ভুজুঙ্গার গোটা দেহ তখন আকাশে ঘুরছে। সে কী শব্দ! ঘোরাতে ঘোরাতে ছুড়ে দিল ভুজুঙ্গাকে আরামডিলার গায়ে। মড়মড় করে ভেঙে গেল সিংলির চুড়ো।”
“হ্যাঁ, আমরাও তো পাথর গড়িয়ে আসতে দেখেছি!” উত্তেজিত গলায় তেরাই বলে উঠল।
কচি-কলা বলতে থাকল, “যে কেউ শেষ হয়ে যাবে এমন আঘাতে। কিন্তু তিনি তো আর কেউ নন, তিনি হলেন ভুজুঙ্গা! মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়লেন দুশমনদের মধ্যে। ভয়ানক আগুনে ছারখার করে দিতে চাইলেন তাদের। কিন্তু আগেই বলেছি যে পোশাক তার পরে ছিল, তাতে ভুজুঙ্গার আগুনে কিচ্ছু হচ্ছিল না। যা হচ্ছিল সে শুধু ভুজুঙ্গার আঘাতে। কিন্তু সেই যে ভয়ানক নেড়া লোক, সে ততক্ষণে নিজের রূপ পালটে হয়ে গেল এক অদ্ভুত জীব! নীচের অংশ তার বিরাট এক মানুষের। কিন্তু উপরের দিকটা বিরাট একটা মুঙ্গো!”
“মুঙ্গো! সে আবার কী?” উরুম বলল।
“মুঙ্গো মানে যাকে তোমরা বলো বেজি, সেই।”
“ও! মঙ্গুজ?” তেরাই বলল।
“মঙ্গুজ না! মুঙ্গো! মুঙ্গো! বুঝেছ?” কচি-কলা বলে উঠল।
কচি-কলা চটলেই তো সব মাটি। কাজেই, “বুঝেছি বুঝেছি। তুমি বলে যাও।” বলে চেঁচিয়ে উঠলাম।
“তারপর সে কী লড়াই!” কচি-কলা বলে চলল, “দলপতির নির্দেশে আমরা সবাই কত কত জাদু করে সেই মুঙ্গোকে বিচলিত করতে চাইলাম, কিন্তু আমাদের কোনও জাদুই খাটে না তার উপর।”
“সে আবার কী? তোমাদের জাদুও খাটছে না!” উরুম বলে উঠল।
কচি-কলা বলে উঠল, “ভাবো তাহলে! আসলে কী, ওই জীবটার মন বোধহয় খুব শক্ত। আর শক্ত মনে তো জাদু কখনোই কোনও কাজ করতে পারে না। যারা খুব জ্ঞানী অথবা যাদের মন খুব শক্ত, তাদের উপর জাদুর প্রভাব নেই।”
“তার মানে ওই মুঙ্গো খুব জ্ঞানী?” তেরাই বলে উঠল।
“জ্ঞানী তো বটেই।” দাদু বলল, “জ্ঞানী, তবে ভালো নয়। অসাধু।”
উরুম বলল, “তাহলে এত নিষ্ঠুর কেন?”
“সেই তো উরুম।” দাদু বলল, “জ্ঞানী তো বটেই। তবে অসম্পূর্ণ তার জ্ঞান। তাই এমন নিষ্ঠুর। আরেকটা কথা কী জানো দাদু, আলো থাকলে কালোও থাকবেই। কালো থাকে বলেই না আলোর গায়ে আলস্যের মরচে ধরে না! কাজেই এমন ভয়ংকর দুশমনরা থাকবেই। চিরকাল। তবে ভয় কীসের? কালোর উপর আলো জিতবেই। ও যা করে করুক। দেখে নিও শেষ অবধি আমরাই জিতব।”
দাদুর কথা শেষ হল কি হল না, উরুম কচিকলাকে বলে উঠল, “তারপর কী হল? তারপর কী হল?”
“তারপর তো সাংঘাতিক লড়াই বেধে গেল! একদিকে ভুজুঙ্গা আর মুঙ্গো, আর দিকে মুঙ্গোর সাঙ্গপাঙ্গ আর আমরা।”
একটু থেমে নিয়ে কচি-কলা ধীরে ধীরে বলল, “একসময় ভুজুঙ্গার গোটা দেহ রক্তে ভাসাভাসি! তবুও কঠিন লড়াই লড়ছেন তিনি। লড়তে-লড়তেই তাঁর ইশারা বুঝে দলপতি আমাদের নিয়ে অদৃশ্য হলেন। জাদুযানে চড়ে লাংমোরা চলে গেল মহান সাবরিওর কাছে, আর দলপতির নির্দেশে আমি এলাম তোমাদের কাছে।”
“আর ভুজুঙ্গা?” চেঁচিয়ে উঠেই হঠাৎ মনে হল, কচি-কলা আসার পরেও যে ভুজুঙ্গাকে সেই অদ্ভুত জীবটার সঙ্গে লড়াই করতে দেখলাম। আর সেই জীবটাকে যেমন দেখলাম তা তো কচি-কলার বর্ণনার সঙ্গে মিলছে না!
কচি-কলাকে সেকথা বলতেই সে বলল, “মহান ভুজুঙ্গা তো অমর! তাঁর যে কতগুলো রূপ, সে আমরা নিজেরাই জানি না। মুঙ্গো নিশ্চয়ই একটা রূপকে ঘায়েল করেছে।”
“সে কি!”
“আমি আসার আগে দেখেছি…” এই প্রথম কচি-কলাকে ফোঁপাতে দেখলাম। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “ভুজুঙ্গার দেহটাকে চার খণ্ড করে ফেলেছে সেই মুঙ্গো। কিন্তু ভুজুঙ্গা তবুও লড়ে যাচ্ছেন বীরবিক্রমে।”
আর কিছু বলতে পারল না কচি-কলা। শুধুই ফোঁপাতে লাগল। চোখ থেকে তার অনবরত বের হতে লাগল ছোটো ছোটো লাল লাল প্রজাপতি। সেই প্রজাপতিরা একসঙ্গে উড়তে উড়তে সবাই মিলে ফুটিয়ে তুলল একটা ছবি। কচি-কলার। দুঃখী কচি-কলা সে-ছবিতে হাউ হাউ করে কাঁদছে।
আমারও খুব কান্না পাচ্ছে। গলা চেপে আসছে কষ্টের দলায়। কিন্তু আমার তো কাঁদা চলবে না। আমি কাঁদলে যে মহান ভুজুঙ্গার আত্মত্যাগ বিফলে যাবে!
তাই জোর এনে প্রায় চিৎকার করেই বললাম, “কান্না নয় আমার বন্ধু লাংমো মেয়ে কচি-কলা! চোখের জল বদলে নাও তেজে। বীর ভুজুঙ্গার কোনও রূপেরই আত্মত্যাগ বিফল হতে দেব না আমরা। চলো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা কলমডিলা পেরিয়ে ফুলটুংলি হয়ে পৌঁছোই মহান সাবরিওর কাছে।”
ম্যাজিকের মতো কাজ হল। লাংমো মেয়ে, তেরাই, উরুম একসঙ্গে বলে উঠল, “তাই হবে নেতা সুলুং টুং! আমরা হারাবই ভুজুঙ্গার হত্যাকারীদের।”
দাদু আমাদের জিনিসপত্র কাঁধে নিয়ে পা বাড়িয়ে বলল, “চলো তবে।”
মুনরো ফড়ফড় করে উড়ে এসে বসল আমার আমার হাতে। খুবরু খপর খপর করে লাফিয়ে লাফিয়ে চলল সবার আগে আগে।
যেতে-যেতেই আমার মনে হল ভুজুঙ্গার যেমন অনেক রূপ, তেমনই ওই দুশমনেরও তাই। নিশ্চয়ই ওরও মুঙ্গো রূপ শেষ হয়েছে। নইলে অমন ভয়ংকর দানবের রূপে তাকে আমরা দেখলাম কী করে? কী যে হয়, কে যে জেতে! মহান ভুজুঙ্গার শক্তির উপর প্রত্যয় থাকলেও কেন জানি তার জন্য দুশ্চিন্তায় আমার মনটা ছেয়ে গেল।
প্রকৃতির ভাষা
কলমডিলায় কদম কয়েক চলেছি হয়তো, রাজ্যের পাখপাখালি আমাদের ঘিরে ঘিরে উড়তে লাগল। গাছের ডালে, লতার উপর বসে বসে লেজ ঝুলিয়ে, গলা ফুলিয়ে কত যে কথা তাদের! এদের দেখে সবচেয়ে বেশি খুশি মুনরো। সরু গলায় শিস দিতে দিতে সেও চলল খোশ মেজাজে। লাংমো মেয়ে কচি-কলাও মুহূর্তে সব দুঃখ হাওয়ায় উড়িয়ে ভেসে পড়ল ওদের দলে। ভাসতে ভাসতে বলল, “কেমন সুন্দর দেখছ আমাদের এই কলমডিলা?”
“আমরাও আমাদের ছোটোবেলা থেকে কলমডিলার সুখ্যাতি শুনে আসছি। কলমডিলা হল আসলে প্রকৃতির স্বর্গরাজ্য।” দাদু আমাদের দিকে চেয়ে বলল।
স্বর্গই বটে। আরামডিলাও আমাদের অজানা ছিল। সেখানেও প্রতিমুহূর্তে আমরা আশ্চর্য হয়েছি। কিন্তু কলমডিলার এই সৌন্দর্যের কাছে সে যেন কিছুই নয়।
আমাদের চারধারে শুধু গাছ আর গাছ। নানান আকারের, নানান কিসিমের। তাদের কারও কাণ্ড দেখা যায় না। স্বর্ণালি লতা অথবা অর্কিডের দল জড়িয়ে রয়েছে সবার কাষ্ঠল কাণ্ড। চোখ জুড়োনো রঙের সেসব লতায় অবাক করা সব ফুলেরা হাওয়ায় মাথা পেতে দুলছে। এত সুন্দর যে সত্যি বলে বিশ্বাস হয় না। মনে হয় যেন কোনও শিল্পীর আঁকা। মহান সেই শিল্পী।
গোটা জঙ্গলটায় এইসব নাম না জানা সুন্দরীদের সুগন্ধে ম ম করছে। আমরা ক’জন তো চোখ বুজে হাত ছড়িয়ে মাথা উঁচু করে কেবল প্রাণভরে সেই গন্ধ নিচ্ছি। আর কী বলি, যতবার নাক হয়ে সেই গন্ধ ভিতরে যাচ্ছে, অমনি যেন মাথার ভিতরটা হালকা হয়ে যাচ্ছে আর খুব আনন্দ হচ্ছে। আমরা খিলখিল করে কেবল হাসছি আর হাসছি।
খুশিতে ডগমগ করতে করতে যেই আমরা সেই বনটা পার হয়ে নীল আকাশের নীচে একটা সমতলে এলাম, অমনি কচি-কলা বলল, “এই বনের নাম কী জানো? এ হল খুশেল বন। এখানে হাওয়ায় হাওয়ায় খুশির পরাগ ভাসে। তোমরা তো এমনিই খুব ভালো, কিন্তু দুষ্টু মানুষরাও যদি এই বনে আসে, তবে তাদেরও মনের সব দুশ্চিন্তা ধুয়ে মুছে যাবে।”
“তার মানে এটাও একটা সুরক্ষা বলয়?”
“ঠিক তাই সু। এই গোটা কলমডিলা জুড়েই এমনি করে সুন্দরের আঁচল বিছিয়ে সুরক্ষার বন্দোবস্ত করা আছে। এই যে যত ফুল, পাখি, লতাপাতা, প্রজাপতি—এরা সবাই মহান সাবরিওর অনুচর। এমনকি আমাদের লাংমোরাও অনেকে রূপ বদলে আছেন এখানে। দেখবে তুমি?”
বলেই কচি-কলা বাম পায়ের বুড়ো আঙুলে আলতো চাপ দিয়ে ভেসে পড়ল আকাশে। দুটো হাত দু’দিকে ছড়িয়ে চিৎ-সাঁতারের মতো বাতাস কাটতে লাগল। তারপর হঠাৎ হাত-পা গুটিয়ে ছোটো হতে হতে হঠাৎ হয়ে গেল ছোট্ট একটা হলুদ প্রজাপতি! উড়তে উড়তে গিয়ে বসল সাদা রঙের একটা মিষ্টি গোলাপের উপর। সাদা গোলাপও যেন আদর করার মতো করে তার পাপড়িগুলো বুজিয়ে নিয়ে বৃন্ত থেকে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল নিজেকে। ছোট্ট সেই গোলাপ তখন ভাসছে। ভাসছে নাকি হাসছে! হাসতে হাসতে বলছে—
“এই যে আমি ছোট্ট গোলাপ
তোমার সাথে করতে আলাপ
এলুম সকাল সকাল।”
আমরা তো হাঁ। উরুম বলল, “আরিব্বাস! গোলাপ ফুল উড়ছে, আবার কথাও বলছে! দারুণ তো!”
সেই শুনে গোলাপ তখন বলে কী—
“একা তো নই, একা তো নই
আমরা সবাই সাথী
দিনে ফুটি, গন্ধে মাতি
রাতে জ্বালাই বাতি।”
“সে আবার কী? ফুল আবার বাতি জ্বালাও কেমন করে?”
উত্তর দেবে কী! তেরাইয়ের কথা শুনে তো সেই গোলাপ হেসে আর বাঁচেই না। তার হয়ে উত্তর দিল হলদে প্রজাপতি মানে আমাদের কচি-কলা। “কলমডিলার এই তো মজা! এই যে যত ফুল দেখছ, রাত্তির হলেই এরা সবাই জ্বলজ্বল করে জ্বলে। যার যেমনি রং, সূর্য থেকে পাওয়া আলো সে তেমনি করে ছড়ায়।”
“ও বাবা! তাই নাকি?” তেরাই বলল।
“তাই না তাই! আছই তো! দেখে নিয়ো!”
আমি সেই গোলাপকে বললাম, “প্রণাম গোলাপ! আমরা তোমাদের দেশে এলাম। এরপরে যাব ফুলটুংলি। তোমাদের সবাইকে আমাদের ভালোবাসা জানাই। খুব ভালো লাগছে তোমাদের দেশে এসে।”
সেই শুনে খুশি হয়ে গোলাপ তার ঠোঁট খুলল।
“আয় শুনে যা! শুনে যা লো বকুল গাঁদা কামিনী বেলি!
পপি, অ্যাস্টার, জিনিয়া, ডালিয়া, গাইলার্ডিয়া কোথায় গেলি?
ওলো এয়েই দেখ না বলছেন কী মহান সুলুং,
শুনলেই মনে নাচবে খুশি তুলুং তুলুং!”
গোলাপের সেই গান তো আর গান নয় যেন সরোবরে ঝরনার জল ঝরার মিঠে বোল। সেই বোলে গলা মেলাল সব ফুলেরা আর পাখিরা। কককক, টিট্টিট, ক্রুইই, ধুত্তুরিইই, উউইই—এমনি নানান শব্দে মশগুল হল চারদিক। যেন এক মেলা বসেছে আমাদের ঘিরে। ফুল, প্রজাপতি, পাখি, মৌমাছি এমনকি পিঁপড়েরাও এসেছে সেই মেলায়। সেই খুশির মেলায় একসময় হলদে প্রজাপতি লাংমো মেয়ে কচি-কলা বলল, “তোমরা সবাই এমন ভাষায় কথা বোলো যাতে সুলুং বুঝতে পারেন, কেমন?”
আমি বলে উঠলাম, “তা কেন? বরং এমনি কেন করো না যাতে তোমাদের সবার ভাষাই আমি বুঝতে পারি!”
কচি-কলা বলল, “তাই তো! সেইটাই তো সবচেয়ে ভালো।” বলেই আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তবে তুমি চোখ মুদে বসো। যতক্ষণ না বলছি চোখ খুলো না যেন।”
আমি একটা ফার গাছের তলায় ছোট্ট একটা গোল পাথরে চেপে বসে চোখ বুজলাম। খানিক বাদেই মনে হল আমার গা বেয়ে উঠে আসছে পিঁপড়ে, কেন্নো আর শামুকেরা। মুখে উড়ে এসে বসছে প্রজাপতি আর মৌমাছি। বেজায় সুড়সুড়ি লাগছে। তবুও হাসছিও না, নড়ছিও না। শুনতে পাচ্ছি উরুম তেরাইকে বলছে, “আরিব্বাস! সু যে পুরো ঢেকে গেল!”
তেরাই বলছে, “চুপ কর হাঁদা। সুর মনঃসংযোগ নষ্ট হবে যে!”
আমার কি আর তখন মনঃসংযোগ নষ্ট করবার জো আছে? সারা গায়ে যেমন তাদের স্পর্শ, নাকে তেমন তাদের নানান গন্ধ, কানে তাদের সড়সড়, ফিসফিস, আর মনের ভিতর যেন কার আওয়াজ—
‘সুলুং, আরও একাগ্র হও। আরও মনেপ্রাণে মিলে যাও এই পাহাড়দেশের সঙ্গে। পাহাড়ের ধুলো, রেণু, কীটপতঙ্গ আর তুমি যে এক, এই কথাটায় গভীর প্রত্যয় আনো। শোনো, কেমন সবাই তোমায় ডাকছে। শোনো, কান পেতে তাদের ডাক শোনো। শোনো।’
আমার চোখ বন্ধ। তবুও ধীরে ধীরে যেন দেখতে পাচ্ছি আমার প্রিয় পাহাড়দেশ। ঝাপসা থেকে ক্রমশ পরিষ্কার হচ্ছে ছবি। হু হু করে স্থান বদলে যাচ্ছে। যেইখানে থামতে চাইছি সেখানেই থেমে যাচ্ছে সেই চলচ্চিত্র। আমি এবার মাকে দেখব একবার। আমার মা। ওই ত্তো! ওই ত্তো দেখতে পাচ্ছি আমার মাকে! মা আমার! টুকরি থেকে সবজি রান্নাঘরের দাওয়ায় নামিয়ে রাখছে মা। ফুলকপি সরিয়ে রাখছে মা। রাঁধবে না? ফুলকপি খেতে যে আমি ভালোবাসি! মা তাই রাঁধবে না? মাকে ডাকতে ইচ্ছে করছে খুব। মা! মা!
মা কি শুনতে পেল? ফিরে তাকাল যে! মা! মা! আবার ফিরে তাকাল মা। রান্নাঘরের দেয়ালে মাথাটা খানিক উঁচু করে হাঁ করে রয়েছে একটা টিকটিকি। তবে কি ওই টিকটিকিটাই আমার ডাক পৌঁছে দিল? টিকটিকি তার মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলল, “ঠিক ঠিক! মহান সুলুং টুং! ঠিক ঠিক।”
আমি কি তবে সবার কথা বুঝতে পারছি? চাইলেই যেখানে খুশি চলে গিয়ে আমার বার্তা পৌঁছে দিতে পারছি?
এত কিছু হচ্ছে আমার সঙ্গে, অথচ মনটা কী শান্ত! একটুও দুঃখ হচ্ছে না, চিন্তা হচ্ছে না। কেবল ভেসে আছি যেন শূন্যে।
ভাবতে-ভাবতেই শুনতে পেলাম, “অভিবাদন মহান সুলুং! আমরা আপনার সঙ্গী।”
দেখি কথাগুলো বলছে ডিম মুখে সার সার পিঁপড়ে। ওদের দেখতে আমার চোখ খুলতে হচ্ছে না। ওরা আমায় বলছে, “এই পাহাড়দেশের নীচেই আমাদের পিমপিমিনগর। আমরা সাতান্ন কোটি সাঁইত্রিশ লক্ষ সাড়ে সাতাশো হাজার পিঁপড়ে সেখানে থাকি। মহান সুলুং, কোনও প্রয়োজনে একবার শুধু স্মরণ করবেন, আমরা সবাই হাজির হয়ে যাব।”
একে একে সব কীটপতঙ্গের সঙ্গে কথা বললাম। কী যে শান্তি সে আমি বলে বোঝাতে পারব না। সবাই বলে গেল তারা আমাদের সঙ্গেই আছে। এই পাহাড়দেশের পরিবেশ কিছুতেই তারা নষ্ট হতে দেবে না।
সব্বাই চলে গেলে কচি-কলার ডাক শুনতে পেলাম, “সুলুং ওঠো! চোখ খোলো এবার।”
ধীরে ধীরে চোখ খুললাম। বাবা! এত সময় পার হয়ে গেছে? যখন বসেছিলাম তখন পুব আকাশে সূর্য, আর এখন তো সুর্য ডুবে রাত হয়ে গেছে! কলমডিলার ফুলেরা সবাই আলোয় আলোয় ভরে তুলেছে বন। মোহময় সেই আলো।
তেরাই এসে বলল, “কিছু খাবি সু? কতক্ষণ একভাবে বসে রইলি, ধৈর্য বটে তোর! তোর বন্ধু বলে আজ আমাদের খুব গর্ব।”
উরুমও এসে বলল, “আমারও।”
খুবরু এল, মুনরো এল। দাদু এসে বললেন, “এবার তবে তোমরা সবাই কিছু খাও।”
অমনি উরুম বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই ভালো। সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। খুব খিদে পেয়েছে।”
সব্বাই মিলে একসঙ্গে খেতে বসলাম। সেই মিহি আলোয় গরম ভাত, বাড়ির ঘি, মেটে আলু সিদ্ধ। দারুণ জমল। হঠাৎ দেখি দাদু দুটো পাত্র আনল। তার একটায় মাছভাজা, আরেকটায় ফুলকপির তরকারি। ঠিক যেমনটা আমার মা বানায়।
আনন্দে জিজ্ঞাসা করলাম, “এতসব তোমরা কোথায় পেলে?”
দাদু বলল, “পেলামই বটে। তুমি যখন চোখ বুজে বসে ছিলে, তখন তোমার সামনে হঠাৎ করে দুটো টুকরিতে এইসব এল। আমি আর তেরাই কেবল রেঁধে ফেললাম।”
অবাক কাণ্ড!
যাই হোক, সমস্ত চিন্তাভাবনা দূরে ফেলে আমরা সবাই মিলে আমাদের প্রিয় খাবারগুলো তখন হাপুস-হুপুস করে খেতে থাকলাম। মাছভাজা খেতে দেখে ফুলেরা তাদের আলোর জোর খানিকটা করে বাড়িয়েও দিল!
অমানুষিক আর্তনাদ!
রাতের নিস্তব্ধতা ভাঙল এক বুকচেরা অমানুষিক চিৎকারে। ও কীসের চিৎকার?
আমরা সবাই নিশ্চিন্তে সেই বনের ভিতর শুকনো ঘাসের বিছানায় ঘুমোচ্ছিলাম। অমন চিৎকারে ধড়মড় করে সবাই উঠে বসেছি। খানিকক্ষণ মন দিয়ে শুনে দাদু বলল, “এ তো কারও কান্না মনে হচ্ছে! কোনও বন্যপ্রাণীর কান্না।”
উরুম গুটিয়ে-সুটিয়ে ছিল। বলল, “কাঁদছে কেন? কোন প্রাণী?”
দাদু বলল, “নিশ্চয়ই ভয়ংকর কিছু ঘটেছে।”
কচি-কলা বলল, “এ বনে কেন কোনও প্রাণী কাঁদবে? এখানে তো সবাই যে যার শান্তিতে থাকে।”
“নিশ্চয়ই সেই শান্তি ভেঙে কেউ কিছু ঘটিয়েছে।” আমি বললাম।
উরুম আর তেরাই বলল, “আমাদেরও তাই মনে হয়। নিশ্চয়ই তেমন কিছু ঘটেছে। আজ আর আমাদের ঘুমোনো ঠিক হবে না। কতটুকুই বা আর রাত বাকি! এটুকু না হয় আমরা জেগেই কাটাই। কী বলিস, সু?”
আমারও তেমনই মত ছিল। কিন্তু সারাদিনের পথচলার ধকলের পর রাতের বিশ্রামটুকুও না হলে যদি দাদুর কোনও সমস্যা হয়, সে ভেবেই দাদুর দিকে তাকালাম। দাদু বলল, “আমায় নিয়ে ভেবো না দিদি। তোমার এই দাদুর গায়ে আজও যেমন জোর, মনেও তেমনি। বরং চলো আমি তোমাদের একটা গল্প শোনাই।”
সেই শুনে সবার আগে কচি-কলা একেবারে গুছিয়ে বসল। উরুম-তেরাইও রেডি। আর দাদুর গল্পের জন্যে আমি তো সবসময়ই আঙুল মুড়ে তৈরি।
দাদু বলল, “এই যে চিৎকার বলো, আর্তনাদ বলো, আর কান্নাই বলো শোনা গেল, সেটা এই মুহূর্তে আমাকে অনেকদিন আগের একটা ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। আমি তখন বছর তিরিশের জোয়ান। বেড়াতে গেছিলাম আমার এক দাদার কাছে। বেশি দূরে নয়, আমাদের এই পাহাড়দেশের পায়ের কাছে যে সমতল, সেখানেই কাজ করত আমার এক জ্ঞাতি দাদা। রেলের কাজ। জঙ্গলের মধ্যখানে একটা গুমটি ঘরে বসে তার কাজ হল লাইন ক্লিয়ার থাকলে সবুজ বাতি, অথবা লাইনে সমস্যা থাকলে লাল বাতি দেখানো। তবে সে-কাজ রাতেরবেলা। দিনেরবেলা সেখানে কাজ করত অন্যজন। আমি যাওয়ার পর তো তার আর আনন্দের সীমা নেই। হবে নাই বা কেন? একা একা থাকে। কথা বলার জ্ঞাতি পেলে তো মন খুশি হবেই। এই গল্প, ওই গল্পে সারাদিন পেরিয়ে যেই মাঠের শেষে সুয্যি ডুবো ডুবো হয়, অমনি গায়ে ইউনিফর্ম চড়িয়ে আমায় বলে-টলে বেরিয়ে যায়। সে তো যায় কাজে, ওদিকে সন্ধে থেকে গোটা রাত ওই অচেনা জায়গায় একা একা থাকতেও আমার আর ভালো লাগে না।
“এমনিভাবে দিন দুয়েক কাটল। তৃতীয় দিনে আমি বললাম, ‘দাদা, তোমার সঙ্গে আমিও চলো যাই।’
“তো সেই শুনে সে বলে, ‘ধুস! ও তো আরও অন্যরকম জায়গা। জঙ্গলের ভিতর নির্জন গুমটি ঘর। সামনে কেবল সরু রেল লাইন, তাছাড়া যেদিকে তাকাবি শুধু জঙ্গল। ঘন অন্ধকারে ঢাকা জঙ্গল। ওখানে তোর যেতে হবে না।’
“তো আমি কি আর সেই কথা শোনার পাত্র! তাছাড়া আমি পাহাড়-মাটির ছেলে। জঙ্গলে আমার ভয় কীসের? বরং অমন নিরালার রাত দেখার সুযোগই বা ক’জন পায়? এইসব ভেবে বললাম, ‘না দাদা, ওতে আমার কোনও অসুবিধেই হবে না। বরং তুমি আমায় তোমার সঙ্গে নাও।’
“সাতপাঁচ কীসব ভেবে দাদা বলল, ‘আচ্ছা, বেশ।’
“যেমন কথা তেমন কাজ। সন্ধে ঘনাবে ঘনাবে দেখেই দাদা আমায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। কয়েকটা পাকদণ্ডী নেমেই সেই রেলের পথে পড়লাম। তারপর প্রায় ঘণ্টা খানেক হেঁটে চলেছি রেললাইন ধরে। দু’পাশের জঙ্গল যে ক্রমশ ঘন হয়েছে তা কিন্তু শুধু নয়, তাদের রংও গাঢ় হতে হতে এখন পুরো অন্ধকার। বলা ভালো, অন্ধকারের গাছ সব যেন ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া মাথা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঝিঁঝিঁর সে কী একটানা ডাক! আর সে ছিল বর্ষা আসবে আসবে এমন একটা সময়, কাজেই ব্যাঙের দলও সেই কোরাসে গলা মিলিয়েছে। সেই নির্জন রেলপথে আমরা দুই ভাই হেঁটে চলেছি আর হেঁটে চলেছি।
“দাদাকে বললাম, ‘একটা টর্চ আনলে ভালো হত না?’
“দাদা বলল, ‘রোজ হেঁটে হেঁটে এ-পথের পাথর-টাথর সব আমার চেনা। টর্চ লাগবে কেন? ও, তোর ভয় করছে বুঝি? বলেছিলাম তো আসিস না! শুনলি না।’
“আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘না না! ভয় করবে কেন? অন্ধকারে রেললাইনে তো পোকামাকড়, সাপখোপ উঠে আসতে পারে, তাই বলছিলাম।’
“দাদা কিছু না বলে একটু হেসে আমায় দু’ধারের জঙ্গলে কী কী গাছ, জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কতদূরে হাই ওয়ে, সেই সব বলতে লাগল। এভাবে যেতে যেতে একসময় দেখি দূরে জঙ্গলের বুকে জোনাকির থেকে খানিক উজ্জ্বল এক আলো দেখা যাচ্ছে।
“দাদা বলল, ‘ওই দেখ, এসে গেছি।’
“সেখানে পৌঁছোতেই দিনেরবেলার কর্মী লন্ঠন আর একটা লাঠি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তার তো এবার ছুটি। সে থাকে এই কাছেই একটা গাঁয়ে। কিন্তু সেই গাঁয়ে যেতে হবে এই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। একখানা লাঠিগাছই তার অস্ত্র।
“সে যাওয়ার আগে আমায় দেখে দাদার দিকে ফিরে বলল, ‘এই বুঝি তোমার সেই ভাই? তা ওকে এই রাতবিরেতে না নিয়ে এলেই তো পারতে! তোমার না হয় ভয়ডর বলে কিছু নেই, ও তো নতুন!’
“দাদা কিছু বলতে গেল, কিন্তু লোকটা সেসব না শুনে আমার দিকে ফিরে বলল, ‘শোনো ভাই, রাতের জঙ্গল আর রেললাইন কিন্তু চরম অজানা। যাই শোনো, যাই ঘটুক, কক্ষনও কিন্তু এই ঘর ছেড়ে যেও না।’
“আমি কী বলব বুঝলাম না। অবশ্য আমার কথা শোনার সময়ও বোধহয় তার ছিল না। কথাখানা বলেই হুড়হুড় করে করে লাইন দিয়ে নেমে গেলে অন্য পারে। খানিকক্ষণ তার হাতের লন্ঠনের আলো নেচে নেচে অন্ধকারকে ছিঁড়ছিল ঠিকই, কিন্তু যতদূরে যেতে লাগল তত তা ক্ষীণ হতে থাকল, আর একসময় অন্ধকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে মিলিয়ে গেল।
“দাদা বলল, ‘আয় ভাই, ভিতরে আয়। গাড়ি আসতে বহু দেরি। আয় খানিক গল্প করি।’
“ভিতরে যেতে মন চাইছিল না। এই জঙ্গল, রেললাইন, এক আকাশ টিমলি ফুলের মতো তারা আর কাটা নখের মতো চাঁদ—এসব তো একসঙ্গে আগে দেখিনি, কাজেই খুব মায়াভরা লাগছিল।
“দাদা বলল, ‘ভিতরে আয়, জানালা তো খোলাই, সব দেখতে পাবি। সুন্দরের ভিতরেও যে অনেক ভয়ংকর থাকে রে ভাই! কাজেই ভিতরে এসে দেখ।’
“ভিতরে এসে বললাম, ‘ভয়ংকর মানে? জঙ্গলের পশুদের কথা বলছ? কী কী আছে এখানে?”
“কী যে নেই কে জানে। কত যে পশুর ডাক শুনেছি, তার আর ইয়ত্তা নেই। তবুও ভগবানের কাছে প্রার্থনা সে যেন আজ না আসে। আমার তো অভ্যেস হয়ে গেছে, কিন্তু তুই তো আজই প্রথম…’ বলেই কেমন চুপ হয়ে গেল দাদা!
“আমি বললাম, ‘কীসের কথা বলছ তুমি?’
“দাদা সে কথার উত্তর দিল না। আমি বারবার জিজ্ঞেস করাতে একসময় বলল, ‘আমাদের এখানে একটা প্রাচীন প্রবাদ আছে জানিস তো? ‘ইন্দার সিতুলুং, নান্নি বে বুলুং’—মানে যাকে চাও না, কখনও তার নামটাও মুখে এনো না।
“বুঝলাম, দাদা এ ব্যাপারে কিছু বলবে না। কাজেই প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দু’ভাই খানিক অন্য গল্পে মন দিলাম। তারপর দাদা রান্না শুরু করল, আমি তাকে সাহায্য করতে থাকলাম। জব্বর রান্নার হাত দাদার। কিছু সময়ের মধ্যেই খিচুড়ি আর ভাজা রেডি।
“খেয়েদেয়ে ফের বসলাম ঘরের ভিতর চৌকিতে। জানালার ওপারে ঘন আঁধার বন। সেখানে কিছুই দেখা যায় না, কেবল জোনাকির ঝাঁক নেচে নেচে ঘোরে। মাঝে দুয়েকবার জ্বলজ্বলে চোখ দেখেছিলাম বটে। তো দাদা বলল, সেগুলো হয়তো কুকুর, নইলে শেয়াল-টেয়াল।
“গাড়ি আসতে তখনও নাকি দু’ঘণ্টা। জঙ্গল দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতেই পারিনি। ঘুম ছিঁড়ে গেল এক অমানুষিক আর্তনাদে! ধড়মড় করে উঠে বসলাম। দাদা বলল, ‘চুপ। শব্দ করিস না। আজ আবার সে এসেছে!’
“আমি বললাম, ‘কে?’
“দাদা ঘরের হ্যারিকেনটা নেভাতে নেভাতে বলল, ‘শুনতে পাচ্ছিস না?’
“তারপর আমার মুখের দিকে ফিরে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘হাতি! মা হাতি!’
“এমন ভয়ংকরভাবে চিৎকার করছে কেন?’
“দাদা সন্তর্পণে একবার গুমটির ছোট্ট জানালাটা দিয়ে বাইরে দেখে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘ওর সন্তানের জন্য। এরকমই এক রাতে পাথর বোঝাই মালগাড়িতে কাটা গেছিল ওর সন্তান। সেদিনও এমনই চিৎকার। গাড়ি চলে যেতেই আমি বেরিয়ে দেখেছিলাম, লাইনের উপর ছিন্ন দেহটাকে শুঁড় দিয়ে তোলার অবিরাম চেষ্টা চালাচ্ছে মা, আর মাঝে মাঝে প্রবল মাথা ঝাঁকিয়ে অমন করে কাঁদছে। তারপর থেকে মাঝে-মাঝেই রাতে সন্তানকে খুঁজতে আসে ওই একই জায়গায়। খোঁজে আর কাঁদে। গাড়ি চলে গেলে প্রচণ্ড চিৎকার করতে করতে তার পিছনে দৌড়োয়। আমি তখন ঘরের আলো নিভিয়ে চুপ করে থাকি।’
“অনেকক্ষণ ধরে সেই অমানুষিক বিলাপ চলল। দাদার বারণ সত্ত্বেও একসময় বাইরে বেরিয়ে দেখলাম সেই তারাভরা আকাশের নীচে অন্ধকারে ঝাপসা হয়ে আসা এক মাকে। সন্তানের যন্ত্রণা যাকে ফিরিয়ে আনছে বারবার। কী যেন খুঁজে চলেছে সে ওই একই জায়গায়। খুঁজছে, আর না পেয়ে মাথাখানা উপরে তুলে শুঁড় উঁচু করে কাঁদছে। মনে হল, তার শুঁড় থেকে গোটা দেহটাই যেন কান্না। খানিক আগের নরম আকাশটাও কেমন বিষণ্ণ। চাপ চাপ অন্ধকারের নিশুতি রাত মায়ের কান্নার কাছে যেন আত্মসমর্পণ করেছে। হঠাৎ যেন চঞ্চল হয়ে উঠল মা। দাদা বলল, ‘গাড়ি আসছে!’
“সত্যিই দূরে গাড়ির আলো দেখা গেল। সামনের রেললাইনে কেমন একটা আওয়াজ তার আসার। এবার দেখলাম সেই মা হাতি একা নয়। তার সঙ্গে বড়ো আরেক হাতি তার শুঁড়ে মায়ের শুঁড় লাগিয়ে যেন নামিয়ে নিতে চাইছে। যেন বাঁচাতে চাইছে আসন্ন বিপদ থেকে। মাও কিছুতেই যাবে না। ছুটে যাবে সেই গাড়ির দিকে। সে এক অদ্ভুত বুকচেরা দৃশ্য!
“শেষ অবধি তারা নেমে গেল, আর দাদাও সবুজ বাতিটা নিয়ে দাঁড়াল। গমগম করে চলে গেল গাড়ি। মনে হল যেন কোনও সর্পিল ঘাতক সদর্পে তার শক্তির আস্ফালন করতে করতে বিদায় নিল।
“গাড়ি যেতে না যেতেই দাদার হ্যাঁচকা টানে এসে পড়লাম গুমটির বারান্দায়। বারান্দার রেলিংয়ের উপর দিয়ে একটু মাথা তুলে দেখলাম, কী প্রচণ্ড চিৎকার করতে করতে মা দৌড়োচ্ছে সেই গাড়ির পিছনে, তার পিছনে আরও হাতির দল! যেন শোকের উন্মত্ততার মিছিল উঠেছে লাইন জুড়ে। থরথর করে কাঁপছে গুমটি। কাঁপছি আমিও। না, প্রাণভয়ে নয়, কেমন যেন খুনি সমাজের একজন বলে কষ্টে কাঁপছে আমার হাত-পা। মনে হচ্ছে আমিও ছুটে চলি ওদের সঙ্গে।
“কিন্তু আমি তো ওদের সমাজের নই! আমাদের সমাজেও তো এমন একসঙ্গে বাঁচে না কেউ।
“কত কথাই মনে এল। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে মায়ের যে আলোভরা রূপ আমার চোখে সেই অন্ধকারের রাতে এসেছিল, আজও তার সবটুকু মনে আছে।”
“দাদু গল্প শেষ করে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। আমাদের সবার চোখে জল। আবার সেই অমানুষিক চিৎকার শুনতে পেলাম। আর তক্ষুনি হাওয়ায় ভেসে পড়ল কচি-কলা। ওকে সাবধান করতে চেঁচিয়ে উঠলাম, “কচি-কলা!”
কিন্তু সেকথা শোনার আগেই জোনাকির মতন একটুকরো আলো হয়ে সে মিলিয়ে গেছে কলমডিলার বাতাসে।
মৃত গাছের বদলে নতুন গাছ
সেই উৎকণ্ঠার রাতে কচি-কলা যখন ফিরে এল, তখন তার অন্য রূপ। সে রূপকে শোকের বলব না ক্রোধের, সে আমার জানা নেই। প্রচণ্ড আবেগে কচি-কলার গা তখন যেন মিশে মিশে যাচ্ছে হাওয়ায়। চোখ থেকে অঝোরে বেরিয়ে আসছে কীটপতঙ্গ।
শান্ত করতে বুকে টেনে নিলাম তাকে। তেরাই মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করল। খানিক বাদে ফোঁপাতে শুরু করল লাংমো মেয়ে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে তার শ্বাস আটকে যায়, মুখ লাল হয়ে ওঠে। অনেক কষ্টে ধীরে ধীরে শান্ত করা গেল তাকে। বাঁশের চোঙা থেকে খানিকটা জল খেয়ে ধাতস্থ হল সে। তারপর বলল, “এই কলমডিলায় যুগ যুগ ধরে বেঁচে আছে এক ভাল্লুক, এক গণ্ডার আর এক বড়ো পাণ্ডা। অনেক বড়ো তাদের পরিবার। ছানাপোনা নিয়ে শান্তিতে মধু খেয়ে, কচি বাঁশ খেয়ে, ঝোরার মাছ খেয়ে তাদের দিন কাটে। কলমডিলার মাঝখানে আছে এক মনোরম সরোবর। সেই সরোবরে সপরিবারে গান গেয়ে সাঁতার কাটে ভালুক; পাণ্ডারা গাছের উপর থেকে বাঁশের ডগার থেকে সেই গানে সুর মেলায়। গণ্ডাররাও ঘাসজমিতে চরতে চরতে কখনও-সখনও গম্ভীর গলায় সেই সুরে তান ধরে। কিন্তু আজ গিয়ে দেখলাম, সেই সরোবর লাল হয়ে আছে রক্তে! বাঁশের বন লণ্ডভণ্ড। গাছের গায়ে রক্তের ছিটে। ঘাসজমিতে উলটে পড়ে রয়েছে তিনটে গণ্ডারের প্রাণহীন দেহ আর তোমাদের টুগ্গা ছুরি দিয়ে কেমন কেটে নিচ্ছে সেই গণ্ডারের উঁচু খড়গ!
“আমার চোখ ফেটে জল আসছে, হঠাৎ সেই চিৎকার। সেইদিকে ভেসে গিয়ে দেখলাম, লোহার খাঁচায় বেঁধে ফেলেছে গণ্ডার আর ভাল্লুকদের। এই কলমডিলার জীবেরা খাঁচার বাঁধন জানে না। খাঁচা ভাঙতে যতবার ঝাঁপিয়ে পড়ছে, খাঁচার দেয়ালে অমনি যেন বিদ্যুতের ঝটকা খেয়ে ছিটকে পড়ছে উলটোদিকে! তখনই অন্যরা সেইরকম চিৎকার করছে। আর তোমাদের টুগ্গার দল সেই দেখে হাসছে।
“ওদের কাছে কিছু যন্ত্র আছে, বিশেষ করে পাণ্ডা মতন লোকটার হাতে, কারণ সে আমার উপস্থিতিও টের পাচ্ছিল। চিৎকার করে সে তার এক সঙ্গীকে কী যেন বলল, আর সে একটা কী লম্বা মতন এনে দিল। সেই লোকটা হাতের যন্ত্রটায় ভালো করে কী যেন দেখে সেই লম্বা নলটা আমার দিকে তাক করে হাতল টানল। কিন্তু আমিও তো কচি-কলা! ততক্ষণে কত উপরে উঠে গেছি! কিন্তু কী ভয়ানক অস্ত্র! লম্বা নলটা থেকে বেরিয়েই সে যত এগোল তত হয়ে যেতে থাকল একটা লোহার জাল। অত উপরে উঠে গেছি আমি, তবুও আর একটু হলেই ধরা পড়ছিলাম। লোকটা সেই যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে কী দেখে, “মিসড ইট! মিসড ইট!” বলে চেঁচিয়েই ফের তাক করল আমার দিকে। আমি আর সুযোগ না দিয়ে পালিয়ে এলাম এখানে। কিন্তু ওই ভাল্লুক, গণ্ডার, পাণ্ডারা সবাই আমার বন্ধু। ওদের জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।”
কষ্ট তো আমাদেরও হচ্ছে। কিন্তু বসে থাকলে তো চলবে না। ওদের বাঁচাতে হবে।
দাদু কচি-কলার কথা শুনে বলল, “ওই পাণ্ডাটার নাম ম্যাক্স। ওর মতো নিষ্ঠুর হয় না। তবে ও মূল পাণ্ডা নয়। সেজন অন্য। তার নিষ্ঠুরতার কথা তোমাদের আমি বলব’খন। ওদের হাতে তো বন্দি ছিলাম আমি, দেখেছি। সেই আসল। সে-ই রূপ বদলে নিতে পারে। দলের সবাই তাকে হিজ হাইনেস বলত। কেবল ম্যাক্সকে দেখতাম এভিল কিং বলে ডাকতে। ওই এভিল কিং আর যাই হোক মানুষ নয়। আমার ধারণা, ওই আরামডিলায় ভুজুঙ্গাকে লড়াইয়ে ব্যস্ত রেখে স্যাঙাতদের যেভাবেই হোক এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে। ওরা নিষ্ঠুর বলেই এভিল কিং ওদের দলে নিয়েছে। ওরা ওদের মতো নিষ্ঠুর কাজ কর্ম চালাচ্ছে। কিন্তু এভিল কিং-এর লক্ষ্য আলাদা।”
“এভিল কিং-এর লক্ষ্য মহান সাবরিও। গোটা পাহাড়দেশের রাজত্ব।” আমি বললাম।
দাদু বলল, “একদমই তাই।”
“কিন্তু আমরা ওদের আটকাবই। তার আগে আমার বন্ধুদেরও আমরা বাঁচাব।” কচি-কলা চেঁচিয়ে উঠল।
“নিশ্চয়ই।” আমি বললাম। “এসো, তাহলে আমরা আমাদের লড়াইয়ের প্ল্যান করি।”
সবাই জড়ো হয়ে বসলাম। হাওয়ারাও যেন ঘন হয়ে এল। সবার প্রথমে দাদু বলল, “তোমরা তো জানো সবাই আমায় ওরা বন্দি বানিয়েছিল। ওদের নিষ্ঠুর রূপ কিছুটা হলেও আমি জানি। কিছু অস্ত্রশস্ত্রের মহড়াও দেখেছি। কাজেই সেইসব আগে বলে নিই। তাতে প্ল্যান করতে সুবিধে হবে।”
এই পর্যন্ত বলেই দাদু থুতনির দাড়িতে খানিকক্ষণ আঙুল চালিয়ে নিয়ে বলল, “ওদের মূল পাণ্ডার কথা তো বলেইছি—এভিল কিং। তার রূপ এক ঝলকের জন্য দেখতে পেয়েছিলাম। টুগ্গা আর ম্যাক্স যখন আমায় অত্যাচার করেও দলে নিতে পারছে না—ও, বলা হয়নি তোমাদের, বন্দি করার পর থেকেই ওরা লোভ দেখিয়ে, জোর করে, ভয় দেখিয়ে, মানে সব রকমভাবেই আমাকে দলে টানতে চাইছিল। এর মূল চক্রান্ত অবশ্য টুগ্গার। সে-ই সবাইকে বলে যে এই বুড়ো পাহাড়ের অলিগলি কেমন চেনে তার কথা। সে যাই হোক, সেই বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি এই পাহাড়-মাই দেবেন। যাই হোক, টুগ্গা আর ম্যাক্স যখন কিছুতেই আমায় দলে টানতে পারল না, তখন মেরে ফেলার জন্য আমার দিকে বন্দুক তাক করল। আমি একটুও তাতে ভয় পাইনি। কেবল পাহাড়-মাকে মনে মনে তোমাদের রক্ষা করতে বলছিলাম। আমার ক্রমাগত আপত্তি দেখে বন্দুক চালিয়েই দেয় ওরা, এমন সময় সেই এভিল কিং-এর আবির্ভাব। উফ্! সে যে কী কদাকার সে আর কী বলি! এই লম্বা, গায়ের মাংসপেশী যেন পাথর কেটে তৈরি, রোদে তামাটে হওয়া রং, কুতকুতে বিশ্রী চোখ, নেড়া মাথার মাঝখান থেকে নাকের মাঝখান অবধি কাটা দাগ মুখটাকে আরও বীভৎস করে তুলেছে। কপালের বাঁদিক ঘেঁষে একটা অংশ ফুলে আছে। পরনে চামড়ার প্যান্ট আর খালি গা। গায়ে অসংখ্য গুটি গুটি কী যেন। সব মিলিয়ে একটা ভয়ংকর উপস্থিতি। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর তার চাওনি আর গলার স্বর। যেন একা নয়, বিভিন্ন স্বরের অনেকগুলো মিলিয়ে একসঙ্গে কথা বলছে।
“তাকে দেখেই টুগ্গা থেকে শুরু করে সবাই অস্ত্র নামিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়াল। সে আমার দিকে কুতকুতে চোখ তুলে কী যেন দেখে বলল, ‘একে মারার দরকার নেই। অন্য কাজে এমনিই লাগবে।’ বলে কেন জানি একটা ক্রুর হাসি হাসতে লাগল আমার দিকে চেয়ে চেয়ে। আমি পাহাড়ের পালোয়ান সামরু। আমিও তার চোখের দিকে তাকাতে পারলাম না। চোখ বুজে নিতে বাধ্য হলাম। কী কুটিল হাসি তখন সেই এভিল কিং-এর!
“এই কথাগুলো তোমাদের বলবার একমাত্র কারণ কী জানো, কেবল তোমাদের প্রত্যেককে প্রতিমুহূর্তে সচেতন থাকতে বলা। মারাত্মক সব অস্ত্রশস্ত্রের কথা তো আগেই বলেছি, তাছাড়া ওদের সঙ্গে ওড়ার যন্ত্র, দৌড়োনোর যন্ত্র, এমনকি ঝড়-বৃষ্টির যন্ত্রও আছে দেখেছি। কাজেই খুব সাবধানমতো এগোনো দরকার।”
দাদুর কথা শেষ হওয়ার পর সবাই খানিক চুপ। তারপর আমি বললাম, “বেশ। সেভাবেই নাহয় আমরা তৈরি হই। ওদের কাছে ভয়ংকর অস্ত্র থাকে তো থাকুক, গোটা প্রকৃতির অস্ত্রভাণ্ডার আমাদের কাছে। তাদের সবাইকে আমরা ওদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করব। ওদের মারণাস্ত্রের বদলে আমাদের থাকবে প্রকৃতি-মায়ের নির্মল অস্ত্র।”
বলেই আমি চোখ বুজে এই গোটা পাহাড়দেশের প্রকৃতির সব্বাইর সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথা সেরে নিলাম। কী কথা হল আর কী প্ল্যান হল তাদের সঙ্গে, সেকথা এক্ষুনি তোমাদের বলছি না, কারণ আসল মজাটা তাহলে নষ্ট হতে পারে।
যাই হোক, সেসব কাজ মেটানোর পরেই বললাম, “শোনো। আমরা প্রত্যেকেই খুব সজাগ থাকব। দলের মধ্যে সব্বার আগে চলবে খুবরু। ও তো খরগোশ! কাজেই বিপদ বুঝে নেবার ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি ওর। খুবরুর পিছনেই উড়বে মুনরো। আমাদের সুরক্ষা তাতে আরও বাড়বে। তারপর চলব আমি, আমার পরে তেরাই, উরুম আর সবশেষে দাদু। কেমন?”
“আর আমি?” কচি-কলা বলল।
আমি বললাম, “তুমি প্রথম থেকেই থেকো আমার পাশে পাশে, তবে একদম অদৃশ্য হয়ে। যদি কোনোভাবে আমরা ধরা পড়েও যাই, তাহলে অন্তত তুমি স্বাধীন থাকবে।”
তাই ঠিক হল। এবার তো এগোনোর পালা। রাত এখনও বাকি। তাতে কী! আমরা এগোলাম। পথে চলতে যাতে অসুবিধা না হয় তাই মনে মনে বললাম কলমডিলার ফুলেদের, ওরা ওদের আলো বাড়িয়ে দিল। যাতে ছোটো থেকে ছোটো শব্দও আমরা শুনতে পাই, ঝিঁঝিঁপোকা সহ আর সব কীটপতঙ্গ, পাখিপশুদের মনে মনে অনুরোধ জানালাম, অমনি সব থেমে গিয়ে অদ্ভুত এক নৈশব্দ ছেয়ে ফেলল গোটা কলমডিলা।
খুবরু তখন কান খাড়া করে কী যেন শুনল। ওর দেখাদেখি আমিও চোখ বুজে শোনার চেষ্টা করে দেখলাম আমাদের বাঁদিকের গভীর জঙ্গল থেকে কাদের কথা শোনা যাচ্ছে। তার মানে ওদিকেই ঘাঁটি গেড়েছে টুগ্গার দল। আমি আমার দলকে বললাম, “টুগ্গারা এখন ঠিক আমাদের বাঁদিকে। কিন্তু আমরা সোজাসুজি সেদিকে যাব না। হয়তো ওরা আমাদের জন্য সেদিকে ব্যবস্থা রাখবে। বরং আগে কোনাকুনি এগিয়ে ওদের পেরিয়ে তারপর বাঁদিকের কোণ বরাবর পিছিয়ে এসে সামনে থেকে দেখব। শক্তির গর্বে হয়তো সামনের দিকটায় তেমন সুরক্ষা রাখবে না ওরা।”
সবাই রাজি হল। মনে মনে ফের একবার সাবরিওকে স্মরণ করে আমরা এগোলাম।
পথে যত এগোচ্ছি, গাছপালার তছনছ অবস্থা দেখে টের পাচ্ছি ওদের তাণ্ডব। মাঝে-মাঝেই উরুম ‘উহ্! আহ্!’ শব্দ করে উঠছে। তেরাই মুখে আঙুল দিয়ে ওকে চুপ করতে বলছে। ওরা কেউ জানে না, যে মশার দল ওদের চারদিকে ভনভন করছে, তারা আসলে আমায় খবর এনে দিচ্ছে। ওদের সঙ্গে কথা বলে আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে কেন এখানে এসেছে এভিল কিং—কী চায় সে।
শুনলে শিউরে উঠবে। এভিল কিং এই পাহাড়দেশের স্বাভাবিক রূপ নষ্ট করে নিজের মতো করতে চায়। সে সব গাছপালা কেটে এই তিনটে পাহাড়েই বানাতে চায় তার সাঙ্গপাঙ্গদের জন্য বিলাসভূমি। পাহাড়ের সবুজ কেটে সে রাস্তা বানাবে, সেই রাস্তায় যাতে গাড়ি উঠে আসতে পারে। আরামডিলার সিংলির চূড়ায় রিসর্ট হবে। কলমডিলার কলমচূড়ায় রিসর্ট, ফুলটুংলিতেও রিসর্ট। প্রকৃতির সবকিছু নষ্ট করে নিজের মতন করে সাজিয়ে নেবে এভিল কিং। কিন্তু তার ফল যে মারাত্মক! এর আগেও পৃথিবীর নানান জায়গায় নানান নামে এই এভিল কিং তার এই সৃষ্টির নামে, সুন্দরের নামে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে। গাছের পর গাছ কেটেছে। পাহাড়ের পর পাহাড় ভেঙে সর্বনাশ করেছে। নদীর পর নদীর মুখ ঘুরিয়ে তাদের মেরে ফেলেছে।
একাগ্র হলেই সারা পৃথিবীর সব জায়গা থেকে প্রকৃতির আসল ছেলেমেয়ে পশুপাখি কীটপতঙ্গদের আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছি আমি। এত ধ্বংস করে আসলে যে গোটা পৃথিবীটার ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে এভিল কিং, টুগ্গাদের মতো লোভী মানুষরা তা বুঝতেও পারছে না। সামান্য লোভে নিজেদের অজান্তে কী ক্ষতিই না করে ফেলছে আমাদের এই সুন্দর গ্রহের। সারা জগতে গরম বাড়ছে, বরফ গলছে।
চোখ বুজে ফেললাম। চোখের সামনে আমার দুলে দুলে ভেসে উঠল সাদা বরফে ঢাকা এক দেশ। কানের কাছে, নাকি মনের ভিতর থেকে কে যেন বলল সে দেশের নাম রাশিয়া, সাইবেরিয়া, কামচাটকা। সার সার হরিণের মৃতদেহ। সার সার চমরি গাই মরে পড়ে আছে। উফ! অন্যদিকে তাকালাম। সার সার তিমি মরে ভেসে আছে সাগরে। উফ! পরপর ভূমিকম্প, সুনামি, ভয়ংকর সব জীবাণু! সার সার মানুষের মৃতদেহ মৃতদেহ আর মৃতদেহ। উফ! মাগো!
“কী হল সুলুং?”
দাদুর কথার উত্তর দেওয়ার মতো ক্ষমতা আমার আর নেই।
আমার চোখ থেকে জল আর বাঁধ মানছে না। কোনোরকমে বললাম, “এভিল কিংকে হারাতেই হবে দাদু। গোটা পৃথিবীর বিপদ।”
তেরাই ছুটে এসে আমার গাল চোখ মুছিয়ে দিল।
তখনও আমার চোখে ভেসে আসছে ছবি—কত কত রূপে পৃথিবীর সব জায়গায় কেমন অবাধে ধ্বংস চালাচ্ছে এভিল কিং। কেউ ওকে চিনতে পারছে না। কেউ বুঝতে পারছে না। আমাদের মা-পৃথিবী ক্রমশ কমজোর হয়ে পড়ছে। নিজের মতো করে আর সে সব ঠিক করে নিতে পারছে না। কী করে পারবে মা? যে গাছপালা তার প্রাণরক্ষার প্রহরী, তাদেরই তো নির্বিচারে কেটে চলেছে এভিল কিং। ভুল হল। কাটছে আসলে মায়ের সবচেয়ে আদরের সন্তান মানুষেরা। মা কাঁদছে, মা রেগে উঠছে, কখনও সাইক্লোন, কখনও সুনামি পাঠিয়ে সতর্ক করছে, শীতের সময় ঝঞ্ঝা, গরমের সময় কুয়াশা পাঠিয়ে সতর্ক করছে, অথচ এভিল কিং-এর মায়া ঠুলি পরে থাকা টুগ্গা, ম্যাক্সের মতো লোভী মানুষেরা তা নজরও করছে না। ওরা বুঝতেই চাইছে না, হরিণ-চমরি গাই-নীল তিমি-বাঘ-শকুনের পর এবার আসতে চলেছে মানুষের পালা। আর পালাবার পথ নেই। মৃত্যু ছাড়া মঞ্জিল নেই আর।
কী করি আমি? কী করলে একটু হলেও উলটো কাজটা করা হয়? কতজনকে বাঁচাব আমি এই এতটুকু মেয়ে? কী ক্ষমতা আমার? ভাবতে ভাবতেই কথাটা মাথায় এল। সব্বাইকে ডেকে বললাম, “চলো, ওরা গাছ কেটে, পশুপাখিদের মারছে, আমরা উলটো কাজটা করি। আমরা গাছ লাগাতে লাগাতে যাই।”
“কিন্তু গাছ আমরা পাব কোথায়?” উরুম বলল।
“কেন? গাছেরাই দেবে!” বলেই আমি ফের চোখ বুজে গাছদের কাছে প্রার্থনা জানালাম। অমনি কচি-কলা কেন যেন তার হাত নাড়াল। দেখি কত ছোটো ছোটো আলোর ব্যাগ ভাসছে চোখের সামনে। ব্যাগ-ভর্তি শুধু বীজ আর বীজ।
হাতে একটি বীজ নিয়ে মাটিতে পুঁতে তাকে বললাম, “তুমি বড়ো হও, ফুল হও, ফল হও, আরও নতুন গাছ হও।”
ওমা! যেন এটুকু বলারই বাকি ছিল। ফুলেরা সবাই আলো দিল বাড়িয়ে, হাওয়া বইল, মুহূর্তে সেই বীজ থেকে এই রাত্তিরেও চারা বেরোল! চারাগাছ বাড়তে বাড়তে দেখতে দেখতে আকাশছোঁয়া বৃক্ষ হল। তারপর তাতে কী সুন্দর যে ফুল হল আর কোত্থেকে দৌড়ে এল ঝাঁক ঝাঁক প্রজাপতি। দেখতে দেখতে ফল হলো। সেই ফল পাখিরা এসে খেয়ে গেল আর ছড়িয়ে দিল বীজ। যেখানেই সেই বীজ পড়ে অমনি নতুন চারা, আরও আরও গাছ। তারাও সবাই তরতরিয়ে বাড়ে।
আনন্দে আমার মন ভরে উঠল। চিৎকার করে উঠলাম, “এভিল কিং! আমরা তৈরি। চালাও তোমার ধ্বংসলীলা। আমরাও আমাদের সবুজ রক্ষা করে যাব। যতক্ষণ বেঁচে থাকব, সবুজের অভিযান আমাদের চলবেই।”
উরুম, তেরাই, দাদু, কচি-কলা সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, “চলবেই!”
আর খুবরু-মুনরো তিড়িং বিড়িং করে নেচে নেচে ভরিয়ে তুলল চারদিক। আর তক্ষুনি আমাদের মাথার উপর থেকে অতর্কিতে নেমে এল এক জাল! মুহূর্তে বন্দি হলাম আমরা সবাই। শুধু লাংমো মেয়ে কচি-কলা ইট্টুখানি এক মাছির মতো নিজেকে ছোটো করে বার হয়ে গেল সেই জাল থেকে। অদৃশ্য হয়ে আমার মনে মনে বলল, “ভয় নেই সু, আমি আছি।”
বিশ্বাসঘাতক
বন্দি হতেই টুগ্গা আর তার দলবল এসে হাজির হল। আমাদের ওই অবস্থায় দেখে টুগ্গার সে কী পৈশাচিক হাসি! চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “ওহ্! ভারি আমার নেতা চলেছেন পাহাড় বাঁচাতে।” দাদুর দিকে ফিরে বলল, “যেমন অথর্ব সামরু, তেমনি তার নাতনি সুলুং। শুধু পাহাড়ের সাধারণ লোকদের ভুজুং ভাজুং বুঝিয়ে নিজেরা ভালো থাকার ফিকির, তাই না?”
দাদু দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “সাহস থাকে তো একবার বাঁধন খুলে দিয়ে সামনে আয়। অথর্ব কি না দেখিয়ে দিচ্ছি তোকে।”
ম্যাক্স নামের লোকটা এসে টুগ্গাকে বলল, “বুড়োটাকে বাদ দে। ওই মেয়েটার কাছে জাদু আছে। ওর কাছ থেকে জাদুগুলো আগে নিয়ে নে। দেখছিস না কেমন মুহূর্তের মধ্যে ফের কেমন জঙ্গল ভরে দিল গাছ দিয়ে!”
টুগ্গা আমার দিকে এগোতেই আমি বললাম, “শোনো টুগ্গা, তোমাদের মতো কোনও যন্ত্র আমার কাছে নেই যে সেটা তুমি নিতে পারবে। আমার যা আছে তার নাম ভালোবাসা। এই পাহাড়দেশ, এই পৃথিবী-মায়ের জন্যে ভালোবাসা। সে যদি তুমি জোর করে কেড়ে নিতে পারো তো নাও। আর যদি ভালোভাবে সেগুলো পেতে চাও, তবে এখনও সময় আছে, ওই দুষ্টুদের দলে না থেকে মনের ময়লা সব ধুয়ে ফেলে নিজের লোকেদের কাছে ফিরে এসো।”
টুগ্গা কিছু বলার আগেই ম্যাক্স বলে উঠল, “মনে যদি থেকে থাকে তো সেখান থেকেই টেনে বার করব।” বলেই দৌড়ে এসে হঠাৎ করে আমার বুকে একটা ধাক্কা দিল। ছিটকে পড়লাম আমি। দাদু চিৎকার করে উঠল। তেরাই ছুটে এসে আমায় তুলে ধরল।
খুবলে গেছে আমার। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে ফের দাঁড়ালাম। শয়তানটা হলদে দাঁত বের করে হাসছে। দাদুকে ভেংচাচ্ছে। তারপর কর্কশ গলায় ‘জাদু জাদু জাদু জাদু’ বলতে বলতে ফের ছুটে আসছে আমায় মারবে বলে।
কিন্তু যেই সে আমার কাছে এসে হাত তুলেছে, অমনি কোত্থেকে যেন একটা লোমশ ভাল্লুক এসে ম্যাক্সকে পেড়ে ফেলেছে। প্রাণভয়ে চিৎকার করছে ম্যাক্স। সঙ্গের লোকেরা হতবুদ্ধি। টুগ্গা হঠাৎ হাতের বন্দুক থেকে পরপর গুলি চালিয়ে দিল ভাল্লুকটার দিকে। চোখের সামনে ছটফট করতে লাগল রক্তাক্ত ভাল্লুকটা। ম্যাক্সকে তার হাত থেকে উদ্ধার করল ওর সঙ্গীরা। ম্যাক্স তখন কাঁপছে। ডানহাতটা তারও রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
মৃত ভাল্লুকটার জন্যে খুব কষ্ট হচ্ছে। চোখ বুজে ওর জন্যে প্রার্থনা করলাম প্রকৃতি-মায়ের কাছে। ওই তো আজ আমার জীবন বাঁচাল। এই প্রকৃতি-মায়ের কত সন্তান কত না রূপে সবসময় বাঁচিয়ে রাখছে আমাদের, আমরা তা বুঝতেও পারি না। তাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে উঠল মন।
ম্যাক্স আহত বলে টুগ্গাই বোধহয় এখন দলপতি। সে সাঙ্গপাঙ্গদের হুকুম দিল, “সব ক’টার হাত বাঁধ। আগে বাচ্চাগুলোর। একজনের দড়ির সঙ্গে আরেকজনকে বাঁধ, যাতে কেউ না পালাতে পারে। সবার শেষে বুড়োটাকে। ওর গায়ে অসুরের শক্তি। ওকে যখন বাঁধবি, মেয়েটার গলায় কুকরিটা ধরে থাকবি।”
টুগ্গার নিষ্ঠুরতা দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমাদের সবাইকে বেঁধে নিয়ে চলল ওদের শিবিরের দিকে। ম্যাক্সকে তো আগেই সেখানে নিয়ে গেছে চিকিৎসা করাবে বলে।
বীজের থলিগুলো ওদের চোখের আড়ালে কচি-কলা সরিয়ে নিয়ে গেছে। আমাদের যখন ওরা নিয়ে চলল, তখনও কচি-কলা চলল আমার পাশে পাশে। প্রয়োজনে মনে মনে কথা কয়ে নিচ্ছিলাম দু’জনে। খুবরুকেও দেখতে পাচ্ছিলাম সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। কচি-কলাকে বললাম, “খুবরু আর মুনরোকেও পারলে অদৃশ্য করে নাও। নইলে টুগ্গারা দেখলে একটুও দয়া করবে না। মেরে খেয়ে ফেলবে ওদের।”
কচি-কলা কথা শুনল। খুবরু আর মুনরো অদৃশ্য হল।
যেতে যেতে দেখলাম এমন সুন্দর বন কেমন সাফ করে ফেলেছে টুগ্গারা! যে গাছ কেটেছে তার চিহ্নমাত্র রাখেনি। ধু ধু মাঠ বানিয়ে ফেলেছে। তার মানে কেমন সব ভয়ানক যন্ত্র ওদের কাছে!
টুগ্গাকে আমাদের পাহাড়িয়া ভাষায় জিজ্ঞাসা করলাম, “কেন করছ এইসব? তুমিও তো এই পাহাড়েরই ছেলে!”
টুগ্গা বলল, “কেন করব না? এই পাহাড় আমাদের কী দিয়েছে? খালি কষ্ট আর কষ্ট। এখানে ওরা রিসর্ট বানাবে। কত ছেলেমেয়ে কাজ পাবে! পাহাড় হয়ে যাবে শহর। সেখানে সব থাকবে আনন্দ করবার জন্য।”
“ভুল ভাবছ তুমি টুগ্গা।” আমি বললাম, “পাহাড় আমাদের দুঃখ দেয়নি, বরং খাবার দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। তুমি লোভে পড়েছ বলে বুঝতেও পারছ না। তাছাড়া তোমার যদি সমতল ভালো লাগে তো সেখানে যাও, শহর চাও তো শহরে যাও! এই গাছ কেটে, পাহাড় ভেঙে শহর করার দরকার কী?”
“না তো কী! আমরা পাহাড়িরা চিরদিন কি অমনিই থেকে যাব নাকি? উন্নত হব না?”
“নিশ্চয়ই হব।” দাদু বলল, “কিন্তু আমাদের মতন করে হব। পাহাড় তো আমাদের মা রে টুগ্গা! মাকে মেরে কখনও সন্তানের ভালো হয় না। তুই বোঝ সেটা একবার!”
খানিকক্ষণ চুপ রইল টুগ্গা। কী জানি কী ভাবল। তারপর চেঁচিয়ে উঠে বলল, “সেসব আমি জানি না। আমায় কিং কাজ দিয়েছে, তার জন্য অনেক টাকা দিয়েছে। আমাকে এই পাহাড় কেটে সাফ করতেই হবে।” বলেই সঙ্গীদের চেঁচিয়ে বলল, “এই! এদের উপর কড়া নজর রাখবি। পালাতে গেলেই আর ছাড়বি না। গুলি মেরে দিবি।”
বলেই ধাঁই ধাঁই করে এগিয়ে গেল আমাদের ছেড়ে।
দাদু বলল, “সুলুং, মায়ের কথা ওরও মনে লাগছে। কিন্তু এমন লোভের জালে ফেঁসেছে যে চাইলেও আর বেরোতে পারছে না।”
“ওর ভাবনা ছেড়ে এবার নিজেদের ভাবনা ধরো তো তোমরা!” উরুম বেশ বিরক্ত গলায় বলে উঠল।
“কথাটা সত্যিই। টুগ্গা টুগ্গার কথা ভাবুক, আমরা আমাদের।” তেরাই বলল।
“কিন্তু,” দাদু বলল, “তোমরা শুনলে তো, বেগড়বাঁই করবার চেষ্টা করলেই গুলি করবার হুকুম জারি হলো? আর এরা যেমন আহাম্মক, বলা যায় না ধাঁ করে হয়তো গুলি চালিয়েই দেবে। তার চেয়ে খানিক বন্দি থেকে দেখাই যাক না কী করতে চাইছে এরা।”
দাদুর কথায় সবাই সম্মতি জানাল। আমি কচি-কলাকে মনে মনে বললাম, খুবরু আর মুনরোকে কাজে লাগিয়ে একবার ওদের প্ল্যানটা কোনোভাবে জানা যায় কি না সেই চেষ্টা করতে। তাতে ও বলল, ওদের সঙ্গে ও নিজেও সেই কাজে যাচ্ছে। ওকে সাবধান থাকার জন্য বলে এদিকটায় মন দিলাম।
আমাদের ওরা একজনের সঙ্গে আরেকজনকে বেঁধেছে। আর দাদুকে বেঁধেছে একটা মোটা খুঁটির সঙ্গে। এমন নানান বিপদ যে আমাদের আসতেই থাকবে সে সম্পর্কে আমরা মোটামুটি সবাই জানতাম বলে কেউই অতটা আর ঘাবড়ায়নি। কেবল খিদের ঠেলায় উরুমের মুখটা শুকিয়ে গেছে।
ওকে খিদে ভোলানোর জন্য বললাম, “উরুম, তিনেত্তো খেলবি?”
তিনেত্তো আমাদের স্কুলের খেলা। স্যার যখন ক্লাসরুমে পড়ায়, তখনও হাত-পা না নাড়িয়ে আমরা সেই খেলাটা খেলি। এখন আমাদের হাত-পা বাঁধা থাকলেও তাই তিনেত্তো খেলতে বাধা নেই।
তিন বন্ধুতে শুরু হয়ে গেল খেলা। খেলার এমন মজা যে কখন সব ভুলিয়ে দিল। গপ্পে হাসিতে ভরে উঠল সেই জায়গা। টুগ্গার সেই পাহারাদারও অনেকক্ষণ ধরে আমাদের খেলা দেখছিল আর মজা পাচ্ছিল। খেলতে খেলতে আড়চোখে দেখে নিয়েছি।
এইটাই তো আমি চাইছিলাম। একটু অন্যমনস্ক করে দেওয়া। খেলাটা যাতে চলতে থাকে ইশারায় তেরাইকে সেই কথাটা বলতেই ও সব বুঝে গেল। খেলা দেখতে দেখতে দেখলাম সেই পাহারাদার হাতের অস্ত্রটা মাটিতে নামিয়ে রাখল। ইস! যদি কচি-কলারা এখন আসত!
“সেই কখনই তো এসে গেছি! তুমি তো খেয়ালই করছ না!” কচি-কলার অভিমানী শব্দ শুনলাম মনে।
আশ্বস্ত হয়ে বললাম, “তাই তো! কিছু যেন মনে কোরো না বন্ধু। বরং বলো না, কী খবর পেলে?”
“ওরা এখান থেকে যাবে ব্যানানা পিক। ব্যানানা পিকের কলাগাছের বিশ্লেষণ করার জন্য ওরা স্যাম্পল নেবে। সঙ্গে-সঙ্গেই পুরো বাগান ধ্বংস করে দেবে। আর ওই কলার চাষ করবে ওরা নিজেদের বাগানে। এরকমই ভয়ানক ভাবনা ওদের।”
কচি-কলার কথা শুনে মনে হল, এর ভিতরে আরও কোনও ব্যাপার আছে নিশ্চয়ই। একটু বিশদে জানতে হবে। কিন্তু কোত্থেকে?
ভাবতে-ভাবতেই মনে হল, একবার মনের ভিতরে যে আওয়াজ নির্দেশ দেয়, তার সঙ্গে যোগাযোগ করবার চেষ্টা করি। সঙ্গে সঙ্গে কচি-কলাও বলে উঠল, “তাই করো সুলুং।”
ইশারায় তেরাইকে খেলা চালু রাখার কথা বলে চোখ বুজলাম। একটু সময় পরেই সেই শব্দ ভেসে উঠল, “আমায় ডাকছ সুলুং? ওরা কেন এরকম করতে চাইছে তা বুঝতে পারছ না বুঝি? না বোঝারই তো কথা। কত আর বড়ো হয়েছ তুমি? আর বড়ো হলেও তো এসব দুষ্টু চিন্তা আর সবার মধ্যে আসে না। আসলে কী ব্যাপার জানো? এই যে এদের দেখছ, এরা সবাই লোভের বশ। যার যেমন দরকার, তার জন্য ঠিক তেমনটাই লোভ ছড়াচ্ছে ওদের পাণ্ডা। সে নিজেও কিন্তু লোভের বশ। সেকথা সে নিজেও বোঝে না। ওর আছে ক্ষমতার লোভ। এই যে আমাদের সুন্দর প্রকৃতি, এই যে অপূর্ব সব দান—এর মধ্যেই তো লুকিয়ে আছে সমস্ত দুঃখ-কষ্ট-রোগ-বালাইয়ের ওষুধ। ও চায় এর সবকিছু কেবলমাত্র ওর একার বশবর্তী হোক। তাহলেই সব মানুষ ওর বশে থাকবে। মনের খুশির কথা ও ভাবে না, ভাবে কেবল অসুখবিসুখের কথা। আমাদের এই পাহাড়দেশে আনাচেকানাচে নানান ওষধি, অদ্ভুত তাদের ক্ষমতা, কতগুলোর কথা তো মানুষ এখনও জানেই না! তোমার দাদুই তো জানেন কত গাছগাছালির গুণাগুণ। এভিল কিং-এর মতলবটা হল, ও এইসব ওষধি গাছ পুরোপুরি নষ্ট করে নিজের মালিকানার জমিতে কেবল ফলাবে, আর তার থেকে ওষুধ বানিয়ে ব্যাবসা করবে। যেমন খুশি তেমন করবে। যা প্রকৃতি-মা এমনি এমনি সন্তানদের দেন, তার সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে ও অর্থের বিনিময়ে দেবে। আর যাতে অন্য কোথাও থেকে কেউ সংগ্রহ করতে না পারে তাই সেই প্রকৃতি ধ্বংস করে সেখানে ইট, কাঠ, পাথরের জঙ্গল তৈরি করবে। ওকে এখানে দেখছ বলে কেবল এখানেই এই ধ্বংস চালাচ্ছে এমনটা ভেবো না। সারা পৃথিবীর নানান জায়গায় নানান নামে, নানান রূপে ও ছড়িয়ে পড়ছে। অন্তত এক জায়গায় ওকে রুখে দেখাতেই হবে। তাহলেই অন্য জায়গার মানুষেরাও সাহস করে ওর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। তোমাদের ওকে হারাতেই হবে সু। যেকোনও উপায়ে। সমস্ত প্রকৃতি তোমার সঙ্গে থাকবে। কিন্তু এই কলমডিলাতেই ওকে হারাতে হবে। ও যদি একবার ফুলটুংলিতে এসে পড়ে তাহলে কিন্তু সব শেষ হয়ে যাবে। আর কোনোভাবেই তখন আর ওকে রোখা যাবে না। ওকে তাই কলমডিলাতেই রুখতে হবে।”
জানতে চাইলাম, “আরামডিলায় তো ভুজুঙ্গা ওকে আটকাচ্ছে। ভুজুঙ্গা কি তাহলে হেরে যাবে?”
“ভুজুঙ্গার ক্ষয় নেই। আরামডিলায় এখনও লড়াই চলছে। তবে একসময় ভুজুঙ্গাকে হার স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু তা বলে ভেবো না ওর সাহায্য আর তুমি পাবে না। বরং দেখবে কাজের সময় ঠিক ওকে পাশে পাবে। আমাকেও পাবে। আমরা কেউ একা হারাতে পারব না ওকে। সবাই মিলে হারাব।”
“আমি তাহলে এখন কী করব?”
“সে তো আমার বলার কথা নয় সুলুং! পরিস্থিতি আমাদের সামনে যেমন রূপে আসবে, তেমনভাবেই তার মোকাবিলা করতে হবে। আর মোকাবিলা করার পথটাও আমাদের নিজেদেরই তৈরি করে নিতে হবে। তুমি তা পারবে বলেই রেনোলাবিলার আলো তোমায় বেছেছে। একদম ঘাবড়িও না, বরং নিজের শক্তি ক্ষমতার যথাযথ ব্যবহার করো, কেমন?”
তারপর আর কোনও শব্দ পাওয়া গেল না। অবশ্য যা বলার তো তিনি বলে গেলেন। চোখ খুলে দেখলাম, তখনও খেলা চলছ পুরোদমে। আর দাদু আমার দিকে তাকিয়ে। দাদুকে চোখের ইশারা করে বললাম, যে এবার কাজ শুরু করতে হবে। দাদুও চোখের ইশারায় সম্মতি জানালেন।
কচি-কলাকে মনে মনে বললাম, “এবার আমাদের বাঁধন খুলে দাও।”
বলতে না বলতেই দেখি বাঁধন হাওয়া! উরুমটা কাণ্ড ঘটাচ্ছিল দু’হাত তুলে চেঁচিয়ে, কিন্তু যেই হাঁ হাঁ করে ইশারা করলাম, অমনি সব বুঝে সামলে নিল।
এবার শুধু অপেক্ষার পালা। কখন আর একটু অন্যমনস্ক হয় লোকটা। খেলা-টেলা বন্ধ করে আমরা ক্লান্ত হয়ে ঝিমোনোর ভান শুরু করলাম। একে একে উরুম, আমি, দাদু, তেরাই সবাই মাথা নুইয়ে নিলাম। যেন কত না ক্লান্তি! মাথা নুইয়ে চোখ বুজে মনের চোখে দেখতে শুরু করলাম।
লোকটা একবার হাতিয়ার হাতে তুলে আমাদের দিকে ফিরে তাকায় আর তারপর নিজে বড়ো বড়ো হাই তোলে। একসময় তো উঠে এসে আমাদের কাছে ঝুঁকে পরীক্ষাও করে গেল। তারপর নিজের জায়গায় ফিরে হাতিয়ার মাটিতে রেখে হাত টানটান করে সে কী হাই আর আড়মোড়া ভাঙা! যেন কতদিন ভালো করে শুয়ে ঘুমোয়নি!
আরেকবার আমাদের দিকে তাকিয়ে হেলান দিল পাইনের কাণ্ডে। খানিক বাদে আরামে তারও চোখ বুজে এল। আরও কিছু সময় অপেক্ষা করলাম। তারপর কচি-কলাকে বললাম, “যাও, ওর হাতিয়ারটা ভ্যানিশ করে দাও।”
কচি-কলাকে কোনও কাজের কথা বলা আর দু’বার চোখের পলক পড়া, ব্যস। এইটুকু সময়ের ব্যবধানেই টাস্ক কমপ্লিট। কী যে গতি ওর কাজের, সে আর কী বলি!
যাই হোক, হাতিয়ার হাপিস হবার পর দাদুকে বললাম ওকে কাবু করে বেঁধে ফেলতে। দাদুর গায়ে তো অমানুষিক জোর। দাদু গুটি গুটি চলে গেলেন পাইনগাছটার পিছনে। এক্কেবারে পাহারাদারটা যে জায়গায় হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছে তার পিছনে। তারপর হঠাৎই কাঁধের গামছাটা দিয়ে পেঁচিয়ে ধরেই পাইনগাছের সাথে বেঁধে ফেলল ওর মুখ। ঘুমের মধ্যেই এই হঠাৎ আক্রমণে সাময়িক ঘাবড়ালেও মুহূর্তেই হাত-পা চালিয়ে মুক্তি পেতে চেষ্টা শুরু করল। কিন্তু দাদুও তো পালোয়ান! সে এক বিরাট ঝটপটি শুরু হল। আমি ভয় পেলাম এই আওয়াজে আবার টুগ্গারা ছুটে না আসে!
চোখ বন্ধ করে তাই প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা করলাম, “হে প্রকৃতি-মা! তোমার লতা-নাতাদের দিয়ে এক্ষুনি বেঁধে ফেলো এই রক্ষীটাকে।”
চোখ খুলে দেখি, রাজ্যের মোটা মোটা লতা এসে কষে বেঁধে ফেলেছে সেই দশাসই মানুষকে পাইনগাছের সঙ্গে।
ব্যস, আমরা মুক্ত। কিন্তু মুক্ত হলেই তো আর হল না! আমাদের মূল কাজ তো ওদের আটকে দেওয়া। সেটা কীভাবে করা যায় সেইটা তো ভাবতে হবে! একটা প্ল্যান মাথায় আসতেই বললাম, “এবার চলো আমাদের দ্বিতীয় কাজটা শুরু করা যাক।”
“দ্বিতীয় কাজ!”
তেরাইয়ের বিস্ময়ভরা প্রশ্নের জবাবে বললাম, “দ্বিতীয় কাজ মানে ওদের হাতিয়ারগুলো সব হাপিস করে দেওয়ার কথা বলছি আমি। ওদের যত জোর ওই হাতিয়ারে। যন্ত্র ছাড়া ওদের আটকাতে আর আমাদের কী লাগবে!”
“একদম ঠিক কথা বলেছ সু।” দাদু বলল।
“বেশ, তাহলে চলো এগোই।” বলে তেরাই এগোনোর উপক্রম করেই আবার ফিরে এল। অবাক গলায় ফিসফিসিয়ে বলল, “এই, সু!”
আমি বললাম, “কী?”
“এই, উরুমকে একবার দেখ।”
এ বাবা! তাকিয়ে দেখি উরুম বাহাদুর মাথা নিচু করে ভোঁসভোঁসিয়ে ঘুমোচ্ছে। সেই যে আমরা ঘুমোনোর ভান করেছিলাম, উনি তাতে সত্যি-সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছেন।
তেরাই এক ঠোনা দিয়ে বলল, “ওই! ওঠ! চল! আমাদের এখন ওদের অস্ত্রশস্ত্র সরিয়ে ফেলবার সময় না?”
চোখ লাল করে ধড়মড় করে উঠে বসল উরুম। তারপর সবাই মিলে পা টিপে টিপে এগোলাম ওদের আস্তানার দিকে। আর কচি-কলা তার হাত ঘুরিয়ে কী যেন এক করল যে পাইনগাছে বাঁধা লোকটার মাথা পড়ল নুয়ে আর আর নাক থেকে ঘড়র ঘড়র করে শব্দ বেরোতে থাকল।
আমরা এবার একে একে এগোলাম ওদের ছাউনিগুলোর দিকে। বাইরে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এই তো মুশকিল! ভিতরে যদি সবাই থাকে, তাহলে তো অন্যভাবে ভাবতে হবে।
কী করা যায়? মুনরোকে বরং ঘরগুলোয় পাঠিয়ে দেখি। যেমন ভাবা তেমন কাজ। মুনরোকে ডেকে কাজের কথাটা বলে নিজেরা একটা বড়ো বেগুনি বেগুনি ফুল ফোটা ঝোপের আড়ালে বসে পরবর্তী পরিকল্পনার জন্য আলোচনা শুরু করলাম।
আমরা তো আমাদের শক্তি ক্ষমতা সম্পর্কে মোটামুটি জানি। কচি-কলার কাছে একবার জানতে চাইলাম ও কী কী পারে। উত্তরে কচি-কলা বলল, “তুমি যা যা বলবে সব পারি, কিন্তু নিজে নিজে তেমন ভাবতেই পারি না! আমরা লাংমোরা কেবল ফুলের মতো ফুটতে পারি, হাওয়ার মতো বইতে পারি, পাখির মতো ভাসতে পারি, কিন্তু তোমাদের মতো বুদ্ধি করে কাজকম্মো পারি না। তোমাদের ওই টুগ্গাদের মতো অমন হাতিয়ার ধরতে পারি না, নিষ্ঠুর হতে পারি না। এই পাহাড়দেশের গাছের মতো, পাথরের মতো, ঝরনার মতো, ধুলোর মতোই আমরা লাংমোরা। কেবল বইতে পারি আনন্দে, আর পারি এই প্রকৃতি-মায়ের সঙ্গে থেকে তার রূপ-রং নিজেদের মতো সাজিয়ে নিতে। তাকে যদি তোমরা জাদু বলো তো হ্যাঁ, আমরা লাংমোরা জাদু জানি। তবে সে কিন্তু কাউকে আঘাত করার জাদু নয়, বরং আঘাত থেকে বাঁচানোর জাদু।”
কচি-কলা এত সুন্দর করে কথাগুলো বলছিল, আর বলার সময় মিষ্টি মেয়েটাকে আরও এত মিষ্টি লাগছিল যে আমরা সবাই হাঁ করে ওকে দেখছিলাম।
ওর কথা শেষ হওয়ার পরে ওকে বললাম, “তুমি আমাদের বড়ো ভরসা গো লাংমো মেয়ে।”
“তুমিও আমাদের বড়ো ভরসা গো পাহাড়ের মেয়ে।” কচি-কলা বললো।
ওর কথার ধরন শুনে উরুম আর তেরাই হেসে উঠল। আর তখনই মুনরো উড়ে এসে আমার কাঁধে বসে বলল, “আমায় কাজে পাঠিয়ে নিজেরা কেবল খোশগপ্প করলে হবে?”
বাবা! পাখি বটে একটা! “বল রে মুনরো! কী খবর নিয়ে এলি বল দেখি।”
মুনরো তার ঘাড় থেকে গলাটা তিনবার গোল গোল করে ঘুরিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করল।
প্রত্যাঘাত
মুনরোর কথা শুনে আমরা যা বুঝলাম, ছাউনিগুলোর প্রতিটাতে আছে আপাতত চারজন করে। তার মানে চারটে ছাউনি মিলিয়ে মোট ষোলো জন। তার মধ্যে তেরো জনই নাকি ঘুমিয়ে কাদা। এতদিনের পরিশ্রমে নাকি ওরা সকলেই নাজেহাল। কেবল পাহাড়ের মানুষ বলে টুগ্গা এখনও তরতাজা। সেই ওদের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে আলোচনা করছে। মুনরো শুনেছে, ওদের এভিল কিং নাকি খবর পাঠিয়েছে যে আজ ঠিক মাঝরাত্রে সে আসবে। তারপর সবাই মিলে যাবে ব্যানানা পিকে। ওরা সবাই জানে যে ব্যানানা পিকের কলা খেলে ওরা নাকি অমর হয়ে যাবে। আর ব্যানানা পিকে নাকি নুড়ির মতো পড়ে রয়েছে অজস্র রত্ন। সেইসব ওরা পাবে আর ধনী হয়ে যাবে।
“কিন্তু ব্যানানা পিকে তো সেসব কিছু নেই। আর ওই কলা খেলে তো অমর হওয়াও যায় না। ও-কলার যে অন্য গুণ! ওই কলা খেলে ফুলটুংলির পথ দেখতে পাওয়া যায়। আর তাছাড়া রোগবালাই যা আছে শরীরে সেইসব যায় সেরে। আর কিছু তো নয়!” কচি-কলা বলে উঠল।
“ফুলটুংলির রাস্তাটাই তো এভিল কিং-এর দরকার। আর বাকি কথাগুলো এদের বলেছে লোভ দেখানোর জন্য। কিন্তু কোনোভাবেই ওদের ওখানে যেতে দেওয়া যাবে না। আর এভিল কিংকে কোনোভাবেই ওই কলা খেতে দেওয়া যাবে না। এই আমাদের শপথ হোক এখন।”
উরুম, তেরাই, কচি-কলা, দাদু , মুনরো খুবরু সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, “তাই হোক মহান সুলুং টুং। আমরা ওদের আটকাবই।”
“তাহলে আর দেরি কেন?” বলেই একবার ফের প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা করলাম, ‘প্রকৃতি-মা আমার! ওদের কত শক্তি। তোমার স্নেহধন্য হওয়া ছাড়া আমার তো আর কোনও ক্ষমতাই নেই। না পারব ওদের মতো নিষ্ঠুর হতে, না পারব কাউকে মারতে। কিন্তু মা, তুমি তো সর্বশক্তিমান। সব ক্ষমতা তোমার। এমন কিছু করো যাতে ওরা সবাই বাইরে বেরিয়ে আসে অথচ আমাদের দেখতে না পায়।’
বলতে না বলতেই এক আজব কুয়াশা এসে ছেঁকে ধরল আমাদের। কিচ্ছু দেখা যায় না। আমার কানে সেই স্বর বাজল। যে কথা উনি আমায় বললেন, আমিও আমার সঙ্গীদের সেই কথাই বললাম, “বসে পড়ো সবাই। হাতে হাতে ধরে চেপে বসো মাটিতে।”
আমরা বসতে না বসতেই কাঁপতে শুরু করল মাটি। সে কী কাঁপন! আমরা একে অন্যের হাত ধরে কোনোরকমে বসে রইলাম। উরুম বেজায় ভয় পেয়ে কেঁদে ফেলে প্রায়। ওকে আশ্বস্ত করে বললাম, “ভয় নেই রে উরুম। প্রকৃতি-মা আমাদের কিচ্ছুটি হতে দেবেন না। নির্ভয়ে থাক।”
ছাউনিগুলোর ভিতরেও সাড়া পড়ে গেছে। ছুটে ছুটে বাইরে বেরিয়ে আসছে সবাই। ওদের ভয়ের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এই কুয়াশার মধ্য থেকে যে ওদের দেখতেও পাচ্ছি না! কী করি? কী মনে হতে কচি-কলাকে বললাম, “ও লাংমো মেয়ে, বাইরে কী হচ্ছে দেখাতে পারো নাকি এখানে?”
অমনি সে খানিক কুয়াশা নিয়ে মুঠো করে দলা পাকিয়ে আটার গুলি থাবড়ে রুটি বানানো মতো থাবড়ে থাবড়ে খানিক চ্যাপটা করল, তারপর হুস করে ঘুরিয়ে ছুড়ে দিল উপরে। গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে সেটা বড়ো হতে হতে খানিক উঠে গেল। তারপর ফের ঘুরতে ঘুরতে বাড়তে বাড়তে নামতে লাগল নীচে। কচি-কলা তার হাত ঘুরিয়ে ইশারা করতেই সেই বড়ো গোল সাদা চাকতি ঠিক আমাদের মাথার খানিক উপরে গেল থেমে। লাংমো মেয়ে এবার বুড়ো আঙুলে চাপ দিয়ে ভেসে পড়ল। আর ভেসে গিয়ে যেই না ছুঁয়ে দিল সেই চাকতি, অমনি তাতে ফুটে উঠল বাইরের ছবি।
বাইরে যে একেবারে হুলুস্থুলু ব্যাপার! সব্বাই বেরিয়ে এসেছে। কেউ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। টাল খেয়ে খেয়ে পড়ে যাচ্ছে মাটিতে। ভয়ে আর্তনাদ করছে। টুগ্গা একটা ফারের কাণ্ড ধরে কোনোমতে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে বিড়বিড় করছে।
দাদু বলল, “দিদি! এই তো সুযোগ। ভয় দেখিয়ে টুগ্গাকে আমাদের দলে আনতে পারো কি না দেখো।”
বললাম, “আমাদের দলে এসে জোটার মতো মন তো টুগ্গার আর নেই দাদু। তবে ওকে ভয় দেখাব যাতে ওর লোভ কেটে যায়, আর মন দিয়ে ওই দলে কাজ করতে না পারে। আর যতক্ষণ এই কাজটা আমি করছি সেটুকু সময়ে তোমরা ছাউনির ভিতর থেকে ওদের হাতিয়ারগুলো এনে এখানে জড়ো করে ফেলো, কেমন?”
বলা তো হল, কিন্তু অমন কাঁপুনিতে ওরাই বা ছাউনিগুলোয় যায় কেমন করে? ফের শরণাপন্ন হলাম প্রকৃতি-মায়ের। কানের ভিতরে এবার সেই আওয়াজ পেলাম, ‘ওদের নির্ভয়ে এগিয়ে যেতে বলো।’
কেবল ভূমিকম্পই তো নয়, সঙ্গে চলতে শুরু করেছিল প্রবল হাওয়া! এমন দুর্যোগ আমি তো এর আগে কখনও দেখিনি। উরুম-তেরাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিলাম কতটা ভয় ওরা পাচ্ছে। এমন দুর্যোগ হলে সবার আগে যাকে মনে হয়, সেই মায়ের জন্য আমার যেমন মন টানছে, ওদেরও তাই। এতদিনের মধ্যে এই প্রথম উরুমকে ‘মা! মা!’ বলে কেঁদে উঠতে দেখলাম। তেরাইয়েরও চোখে জল টলটল করছে। ওদের দু’জনের চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললাম, “তোদের মতো বন্ধু ক’জনের ভাগ্যে জোটে, বল?”
প্রিয় বন্ধু যারা, তাদের কিচ্ছুটি যে বলতে হয় না, সে তো তোমরা জানোই। উরুম-তেরাই তো কেবল আমার বন্ধু নয়, আরও বেশি কিছু, সেও তোমরা এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছ। কাজেই আমাকেও আর কিচ্ছু বলতে হল না ওদের। দাদুকে নিয়ে ওরা এগোল ওই ভয়ংকর দুর্যোগের মধ্যে।
আর বলব কী, যেইখানে ওরা পা রাখে সেই জায়গা থেকে খানিকটা জায়গা জুড়ে বন্ধ হয়ে যায় দুর্যোগ। কুয়াশার গোলকের ভিতর দিয়ে আমি দেখি আর অবাক হই। ধীরে ধীরে এগিয়ে ওরা ঢুকে পড়ল প্রথম ছাউনিটায়, আর আমিও আমার কাজে মন দিলাম।
চোখ বন্ধ করে মনটাকে পৌঁছে দিলাম টুগ্গার কাছে। টুগ্গা তখন পাহাড়ি ভাষায় তারস্বরে চিৎকার করছে। তথৈবচ দশা ওর আর সব সঙ্গীসাথীদের। তারা তো এই পাহাড়দেশের সন্তানও নয়। ভয়ে ভয়ানক দশা তখন তাদের। দেখে হাসিও পেল। এই তো সব বীর পুরুষ!
মনে মনে টুগ্গার কানে কানে বললাম, ‘দেখছ তো টুগ্গা, পাহাড়-মা কেমন রেগে গেছেন?’
লোভী মনই বোধহয় বেশি ভিতু হয়। আমার সেই কথা শুনে টুগ্গা তো এপাশ ওপাশ দেখতে লাগল। একে দুর্যোগে ব্যতিব্যস্ত, তায় আমার কথা! টুগ্গার সে এক নাজেহাল অবস্থা আর কী।
যাই হোক, আমি আমার মতো ওকে বলে চললাম। এই পাহাড়ের অবদানের কথা বললাম, ওর ছোটোবেলার কথা মনে করতে বললাম, ওর বাবা-মায়ের কথা মনে করালাম। যত বলি, তত দেখি টুগ্গা শান্ত হয়ে আসে। তারপর যখন সাবরিওর ত্যাগের কথা বললাম, অমনি যেন ওর সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেল। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল একেবারে।
“ভুল করে ফেলেছি। লোভ করে বড়ো ভুল হয়েছে। আর কখনও করব না।” বলে সে কী কান্না টুগ্গার! কাঁদে আর বলে, “আমাকে প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দিন পাহাড়-মা।”
সেরেছে! টুগ্গা তাহলে আমার স্বরকে পাহাড়-মায়ের স্বর ভেবেছে? তা ভাবুক। বরং তা ভাবলেই আরও জোর হয়। বললাম, ‘বেশ! সুযোগ দিলাম। এখন তবে তুই এই দল ছেড়ে সামরু আর তার নাতনিদের দলে গিয়ে ভিড়ে যা।’
হঠাৎ কেন যেন চুপ হয়ে গেল টুগ্গা। তারপর ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে কী একটা বলতে গেল, কিন্তু সেকথা আর তার বলা হল না। বলবে বলে যেই সে হাঁ করেছে অমনি যেন রাজ্যের কালো কালো কীট বেরোতে শুরু করল মুখের ভিতর থেকে।
সে যে কী ভয়ংকর দৃশ্য! পিলপিল করে কীটের দল বেরিয়ে আসছে টুগ্গার মুখ থেকে। বেরোচ্ছে আর ছেয়ে ফেলছে টুগ্গাকে। যেখান থেকে সরে যাচ্ছে সেখানেই চামড়া ছিঁড়ে দগদগে ঘা ফুটে উঠছে। টুগ্গা আর্তনাদ করছে, “আমায় ক্ষমা করো পাহাড়-মা! আমি ভুল করেছি। আমি ভুল করেছি।”
কিন্তু ওকে কেমন করে বোঝাই এমন খারাপ শাস্তি না পাহাড়-মা দিয়েছেন, না আমি। কে দিল ওকে শাস্তি?
“কে আবার? যে ওকে লোভ দিয়েছে, সেই লোভ কেটে শুধরে যাওয়ার উপক্রম দেখে ওকে এখন শাস্তি দিয়ে ভয় দেখাচ্ছে।” কচি-কলা বলল।
উফ্! কী ভয়ংকর নিষ্ঠুর!
কিন্তু টুগ্গাকে আমার জানাতেই হবে সত্যিটা। আমি ফের মনে মনে ওর কানের কাছে বললাম, ‘টুগ্গা, আমি পাহাড়-মা নই, আমি সুলুং। তোমার এই শাস্তি পাহাড়-মা দিচ্ছেন না। দিচ্ছে তোমার মালিক। যার কথায় লোভে পড়ে তুমি তাকে এই পাহাড়দেশে এনেছ।”
“মহান সুলুং!” জ্বালা যন্ত্রণা সইতে সইতে টুগ্গা বলে উঠল, “আমাকে বাঁচাও! আমাকে বাঁচাও!”
আমি কেমন করে ওকে বাঁচাব?
চোখ বুজে ওর ভালো চাইলাম। অমনি কোত্থেকে যেন লম্বা লম্বা ঠোঁটওলা ল্যাজঝোলা সব পাখির ঝাঁক উড়ে এসে ছেঁকে ধরল টুগ্গাকে। টপাটপ সেই কীটদের খেতে শুরু করে দিল তারা। দেখতে দেখতে মুক্ত হয়ে গেল টুগ্গা। মুক্ত হয়েই নিজের দিকে তাকিয়ে আনন্দে হেসে উঠল। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে দুই হাত উপরে তুলে বলে উঠল, “আপনি কোথায়, মহান সুলুং? আমি এই মুহূর্তে এভিল কিং-এর দল থেকে বেরিয়ে আপনাদের পক্ষ থেকে লড়তে চাই। আমায় দয়া করে দলে নিন।”
“ওকে নিয়ে নাও দলে, সুলুং।”
তাকিয়ে দেখি দাদুরা সবাই ফিরে এসেছে।
উরুম বলল, “সু, ওদের সব অস্ত্রশস্ত্র আমরা ফেলে দিয়েছি ঘূর্ণিতে।”
“ঘূর্ণি!”
“হ্যাঁ রে সু!” তেরাই বলে উঠল, “সব ছাউনি থেকে অস্ত্র নিয়ে একজায়গায় জড়ো করে আমরা ভাবছিলাম এগুলো কেমন করে নষ্ট করবো। ঠিক তক্ষুনি যেন একটা হাওয়ার ঘূর্ণি উড়তে উড়তে এল আমাদের দিকে। আমরা সব অস্ত্র তাতে ফেলে দিলাম।”
“বেশ করেছিস। প্রকৃতি-মাই মনে হয় ওইসব ভয়ানক জিনিসের ব্যবস্থা করলেন।”
“সে তো করলেন। এবার টুগ্গার একটা ব্যবস্থা তো কর। ও যে নইলে মরে যাবে!” উরুম হড়বড় করে বলল।
সত্যিই। সেই যে হাঁটু গেড়ে বসেছে টুগ্গা, আর উঠছে না। ওদিকে ভূমিকম্পের দোলায় দুলেই চলেছে ওর দেহ। আশেপাশে পাইনের ডাল ভেঙে ভেঙে পড়ছে, ভ্রূক্ষেপ নেই। দূর থেকে ওর সঙ্গীসাথীরা ডাকছে, একবারও সেদিকে চাইছে না। কেবল বলে চলেছে আমাদের দলে ওকে নিতে।
কী আর করা! টুগ্গাকে কোনোদিনই আমার ভালো লাগে না। তবুও এমন সময়! বললাম, “বেশ। তুমি তাহলে চলে এসো আমাদের দলে।”
বলে উঠল, “কোথায় আপনারা? আমি তো ঠাহর করতে পারছি না!”
“এই তো তোমার বাঁদিকে যেখানে কুয়াশা জমে আছে, সেখানে ঢুকে পড়ো।”
শোনার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মুছে আমাদের কুয়াশা গোলকের দিকে ছুটে এল টুগ্গা। তারপর ঢুকে পড়েই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, “আমায় বাঁচালেন! আমায় বাঁচালেন! এই টুগ্গা আপনার দাসানুদাস হল।” বলেই উপুড় হয়ে প্রণামের ভঙ্গিতে পড়ল শুয়ে।
চোখের পলক ফেলতে যতটুকু সময় লাগে তার থেকেও কম সময়ে ঝটাক করে লাফিয়ে উঠল টুগ্গা। হাতের ছোটো ছুরির ফলাটা ঝিলিক দিয়ে উঠল। মুখজোড়া ক্রূর হাসি। মুহূর্তেই তেরাইকে টেনে নিয়ে ওর গলায় ছুরিটা ধরল টুগ্গা।
“এত খারাপ তুই টুগ্গা!” দাদু বলে উঠল।
“চুপ করো বুড়ো সামরু!” তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, “এই যে পুঁচকি ছুঁড়ি, এবার আমি যা বলছি ভালোয় ভালোয় করো তো দেখি। নইলে…” বলেই হাতের ছুরিটায় চাপ বাড়াল টুগ্গা। আর তেরাইয়ের নরম চামড়া ছিঁড়ে রক্ত বেরিয়ে এল চুঁইয়ে।
সেই দেখে, “সাবধান টুগ্গা!” বলে দাদু ঝাঁপিয়ে পড়ল টুগ্গার উপরে। দাদুর অমন মূর্তি আমরা কখনও দেখিনি। তেরাই ছিটকে পড়ল। অনেকখানি ছিঁড়ে গেছে। রক্ত পড়ছে। জামার কোলটা ছিঁড়ে পট্টি বাঁধতে গিয়ে দেখি, যাহ্! ক্ষত ভ্যানিশ! লাংমো মেয়ে কচি-কলা কেবল মিটিমিটি হাসছে।
আর ওদিকে তো দাদুর সঙ্গে কিছুতেই পারছে না টুগ্গা। তেরাইয়ের রক্ত দাদুকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে একেবারে। দাদুর হাতে মার খেয়ে নাজেহাল হয়ে গেছে টুগ্গা। কিন্তু হাতের ছুরিটা ফেলেনি। মুহূর্তের অসতর্কতায় দাদুর বুক বরাবর চালিয়ে দিয়েছে টুগ্গা। লম্বা হয়ে চিরে গেছে জামাটা। জামার ভিতরের ফর্সা চামড়া ভেদ করে রক্তের রেখা। খুব কান্না পাচ্ছে আমার।
দাদু তখন আহত বাঘ! হুঙ্কার দিয়ে নিচু হয়েই অদ্ভুত কায়দায় টুগ্গার একটা পা ধরে ফেলেছে। টুগ্গাও তার ছুরি বিঁধিয়ে দিয়েছে দাদুর কাঁধে। ওই অবস্থাতেই পা ধরে ঘোরাতে ঘোরাতে ছুড়ে ফেলে দিল দাদু টুগ্গাকে খাদের দিকে। অনেক নিচ থেকে টুগ্গার আর্তনাদ ভেসে এল কানে।
আমরা দৌড়ে গেলাম দাদুর কাছে। হাঁপাচ্ছে দাদু। কাঁধ থেকে, বুক থেকে রক্ত ঝরছে। তবুও তেরাইয়ের মাথায় হাত দিয়ে বলছে, “লাগেনি তো বেশি দাদুভাই? তোমরা তো আমার বাহাদুর বাচ্চা!”
বলো কার না চোখে জল আসে!
লাংমো মেয়েরও চোখে জল। বাঁধ না মানা জল। দাদুর মাথার কাছে ভেসে ভেসে সে কাঁদছে। আর তার চোখের জলের ছোঁয়ায় দাদুর ক্ষত সেরে যাচ্ছে।
আমি হাত ধরে কৃতজ্ঞতা জানালাম কচি-কলাকে। সে কেবল মিষ্টি করে হাসল। বলল, “সুলুং, আমরা তো সবাই একটা পরিবার হয়ে গেছি, না? তোমার দাদু কি আমার দাদু নয়?”
কী বলি? মনের কথাটাই তো বলেছে কচি-কলা।
যাই হোক, যা চেয়েছিলাম তা তো হল। অস্ত্রশস্ত্র বিদেয় হল, তার চেয়েও বড়ো কথা অনেক বড়ো একটা আপদ বিদেয় হল। উফ্! কী সাংঘাতিক মানুষ টুগ্গা! একবারের জন্যও আমরা কেউ ভাবতেই পারিনি যে ও আসলে আমাদের কাছে পৌঁছে আমাদের ক্ষতি করতে চাইছে! বাপ রে বাপ!
দাদু বলল, “আসলে কী জানো দিদি, যেই মুহূর্তে ওরা খারাপের কাজে, খারাপের কাছে নিজেদের সমর্পণ করেছে তখন থেকেই ওরা আর নিজেরা নেই। ওদের সব রূপে আসলে সেই খারাপ মানুষ এভিল কিং ঘুরে বেড়াচ্ছে। বুঝলে দাদুভাইরা, জগতে ভালোও থাকে, খারাপও থাকে। ঈশ্বরও থাকেন, শয়তানও থাকে। যাঁর কাছে নিজেকে সমর্পণ করবে, তিনিই তোমার মাঝে থাকবেন। পছন্দটা তোমাদের, ভালোর কাছে থাকবে না মন্দের কাছে।”
“আমরা তো সবাই সু-এর সঙ্গে থাকব।” উরুম, তেরাই বলে উঠল।
“আর আমি থাকব সাবরিওর সঙ্গে।” আমি বললাম।
“আর সাবরিও আছেন প্রকৃতি-মায়ের সঙ্গে।” লাংমো মেয়ে কচি-কলা বলে উঠল।
“আর প্রকৃতি-মাই তো ঈশ্বর!” দাদু বলে উঠলেন।
তক্ষুনি আমার মনে হল যে এই দুর্যোগটা এবার থামা দরকার। অবশ্য তার আগে আমাদের ব্যানানা পিকের দিকে রওনা হওয়া দরকার।
সেইমতো আমরা এগোলাম। বেশ খানিকটা এগোনোর পর প্রকৃতি-মাকে অনুরোধ করলাম দুর্যোগ থামিয়ে নিতে। অমনি থেমে গেল সব।
ওমা, কী আশ্চর্য! দুর্যোগ থামতেই দূর থেকে আমরা দেখলাম যেমনকার তেমনই সব আছে। বরং গাছগুলো যেন হাসছে। কেবল টুগ্গার দুষ্টু সাথীরা তখনও ঠকঠক করে কাঁপছে।
“সত্যিই, প্রকৃতি-মায়ের খেলা বোঝা দুষ্কর।” দাদু বললেন। বললেন আর হাত দুটো জড়ো করে প্রণাম করলেন প্রকৃতি-মাকে। তারপর রওনা হলেন সামনে।
আমরাও সবাই মিলে কথা বলতে বলতে এগিয়ে চললাম ব্যানানা পিকের দিকে।
খেল খতম
ব্যানানা পিক কলমডিলার পশ্চিমে। বেশি ঠিক করে বলতে হলে বলতে হয় খানিকটা দক্ষিণ-পশ্চিমে (দাদু অন্তত তাই বলেছিল)। পথ বেশ দুর্গম। অসংখ্য কাঁটা ঝোপে ভরা চড়াই পার হয়ে যেতে হয়। মাঝখানে পড়ে একটা হ্রদ। সেখানে ভর্তি মাছ! যেমন তেমন মাছ নয়, একেবারে মাংসাশী মাছ। জলে হাত-পা পড়লেই হয়ে গেল। কেবল খটখটে হাড়টুকু মাত্র বেঁচে থাকবে।
সেই হ্রদ যদি বা পেরোলে, এবার তোমাকে পার হতে হবে ঘন কুয়াশার দেশ। সেখানে পদে পদে বিপদ। খাড়াই রাস্তা, একে সরু, তায় আবার একধারে গভীর খাদ। গোটা পথটায় এবড়োখেবড়ো পাথর। পদে পদে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা। অথচ এত ঘন কুয়াশা যে এক হাত দূরের জিনিস পরিষ্কার দেখা যায় না। তাহলেই বোঝো কী মুশকিল সেখানে যাওয়া!
অবশ্য সেসব অন্য মানুষদের জন্য। আমরা তো এখানে আমন্ত্রিত। সবচেয়ে বড়ো কথা লাংমো মেয়ে কচি-কলা আমাদের সঙ্গী। কাজেই আমরা তো গেলাম আলোর বুদবুদে চেপে। চারপাশ দেখতে দেখতে মজা সে কখন পৌঁছে গেলাম সেই ব্যানানা পিকে।
ব্যানানা পিক কিন্তু কলমডিলার আর পাঁচটা অংশের মতনই। তফাত মাটিতে পাথরে তেমন কিছুই নেই। যেটুকু তফাত, সে কেবল গাছপালায়। সারা কলমডিলায় যেমন মনভোলানো নানান গাছপালা, এখানে সেসব কিছু নেই। আছে কেবল কলাগাছ। তোমাদের মনে হতেই পারে পাহাড়দেশে এত কলাগাছ হয় কেমন করে? এর উত্তর কীভাবে দিই বলো তো? এটুকু বলতেই পারি তোমায়, এও প্রকৃতি-মা আর সাবরিওর এক রক্ষাকবচ। এই চুড়োয় রয়েছে এই পাহাড়ের প্রধান সব সেনানীদের কবর।
“পূণ্যভূমি এই ব্যানানা পিক। সর্বরোগহর সব কলাগাছে ভর্তি। মূল থেকে ফল, সবকিছুই রোগনাশক।” দাদু কথাগুলো আমাদের বলতে-বলতেই প্রণাম করল মাটিতে।
আমরাও সবাই প্রণাম করলাম। দাদু বলল, “পাহাড়-মায়ের কত বীর সন্তান এখানে শুয়ে আছেন, প্রণাম করো, গায়ে মেখে নাও এই ধুলো।”
প্রণাম সেরে আমরা পিকে উঠলাম। এখান থেকে অনেকটা দূর অবধি দেখতে পাওয়ার কথা, কিন্তু বড়ো বড়ো কলাপাতার জন্য কিছুই দেখা যায় না। কী করি? ওদের গতিবিধিও তো দেখতে হয়! কাজেই মুনরোকে বললাম দেখতে। কিন্তু সেটাই সবচেয়ে বড়ো ভুল হল। যেই না মুনরো ফড়ফড়িয়ে উড়ল নীল আকাশে, অমনি কোত্থেকে এক দশাসই বাজপাখি তাড়া করল ওকে।
চেঁচিয়ে উঠলাম, “মুনরো সাবধান! সাবধান!”
কিন্তু মুনরো তাড়াতাড়িই ধরা পড়ে গেল সেই বাজের কাছে। কচি-কলা ভেসে পড়ল মুনরোকে বাঁচানোর জন্য।
কচি-কলা ভেসে পড়তেই সেই বাজ কীভাবে হয়ে গেল বিরাট এক কালো গোলোক। মুহূর্তে সেখান থেকে ধেয়ে এলো কালো এক জাল। বন্দি হল কচি-কলা। সেই গোলোক এবার নেমে আসতে থাকল নীচের দিকে।
তীব্র এক শব্দে ভরে যাচ্ছিল চারদিক। শব্দ যেন বাইরে নয়, মাথার ভিতরে! উফ, কী যন্ত্রণা! উরুম, তেরাই, দাদু কেউ সহ্য করতে পারছিল না সেই শব্দ। মাথা চেপে ধরে বসে পড়ল সবাই। একসময় লুটিয়ে পড়ল মাটিতে জ্ঞান হারিয়ে।
সেই তীব্র শব্দে চোখ বুজে গেলেও সারা শরীরের অনুভূতিতে স্পষ্ট বুঝছিলাম, কারা যেন নির্বিচারে কলাগাছ কাটতে কাটতে উঠে আসছে আমাদের দিকে। উপর থেকে সেই গোলোকও আসছিল নেমে।
এই চরম অবস্থায় সেই স্বর আমার ভিতর থেকে বলে উঠল, ‘এই তো সময় সুলুং। নিজের উপর বিশ্বাস রেখে লড়ে যাও।’
মুহূর্তে মনে হল এই পাহাড়, প্রকৃতি আর আমি আলাদা কেউ নই। আমরা সবাই মিলেমিশে আসলে একটা এক। আমিই পাহাড়, প্রকৃতি আমিই। এই গাছপালা, নদী, ঝোরা, পাথর, পাহাড়, কীট, মানুষ সব্বাই মিলে আমি। ভাবনা মনে আসার সঙ্গে সঙ্গে এক অদ্ভুত শক্তি এল মনে। মন দৃঢ় হল। আমি ডানহাতটা নাড়ালাম, ডানদিকের ভূমি প্রচণ্ড কম্পনে কেঁপে উঠে ছিটকে ফেলে দিল সব দুষ্টু মানুষদের। বাঁদিকে চেয়ে তর্জনী নাড়ালাম, পাহাড়দেশের যত হাওয়া কলমডিলার মাথা ছুঁয়ে, আরামডিলার গন্ধ নিয়ে হুড়মুড়িয়ে ছুটে এল। তাদের দিকে চেয়ে চোখের পলক ফেললাম। প্রচণ্ড ঝড় হয়ে ছুটে গেল তারা, আর দুরন্ত বেগে উড়িয়ে নিয়ে গেল যত আততায়ীদের।
এক অদ্ভুত প্রশান্তি ছেয়ে রয়েছে আমার ভিতরে। কোনও কিছু নিয়ে উদ্বেগ নেই। এই পাহাড়দেশের সবকিছু যে ছন্দে বয়ে চলেছে, তার সবকিছু এখন আমার জানা।
ওদিকে উপর থেকে সেই কালো গোলক নেমে এল প্রায়। আসুক, ওতে আর আমার কোনও ভয় নেই। কীভাবে ওকে রুখতে হবে সেও এখন আমার জানা। স্থিরভাবে গোলকের দিকে চেয়ে হাত নাড়ালাম। সমস্ত পাহাড়দেশ থেকে উড়ে এল তীক্ষ্ণ সব পাথর। পাথরের আঘাতে চুরচুর হয়ে ভেঙে পড়ল সেই গোলক।
কচি-কলা আর মুনরোর নিথর দেহ নীচে পড়ছিল, সেদিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে চোখের পলক ফেললাম, পালকের মতন ভেসে ভেসে নামল ওরা।
ভাঙা কালো গোলকের যে অংশটা এখনও ভাসছিল, তার ভিতর থেকে ভীষণ কদাকার এক-শিংওয়ালা জীব দু’দিকে হাত ছড়িয়ে নেমে এল। ইয়া লম্বা, সারা গায়ে পাটকিলে রঙের গলা গলা আঁশ, ভুরুর উপর দুটো অস্বাভাবিক ফোলা, ঠোঁটের কষে লম্বা শ্বদাঁত কেটে বসে, অসম্ভব নোংরা বড়ো বড়ো নখ হাতে পায়ে—গল্পে শোনা সমস্ত দৈত্যর থেকেও ভয়ংকর। হাতে কাঁটা কাঁটা একটা ভয়ানক লাঠির মতো কী যেন। ক্রোধে ফুঁসছে। মুখের কষ বেয়ে নামছে কালো লালার স্রোত। দেখেই বোঝা যায় এই সেই দুর্বৃত্ত এভিল কিং।
এমন ভয়ানক একজন, অথচ বিশ্বাস করো, আমার আর কোনও ভয় করছে না। আমার সঙ্গে যারা এসেছিল তারা এখনও অজ্ঞান, আমি একা। তবুও আমার কোনও ভয় করছে না। ভয় কীসের? আমিই প্রকৃতি। দাদু, উরুম, তেরাই, কচি-কলা সবাই আর আলাদা কেউ নয়, সবাই মিলে যেন আমি।
এভিল কিং হাতের সেই কাঁটা দণ্ড দুলিয়ে অজস্র কাঁটা ছুড়ল। কিন্তু ওগুলো তো আলাদা কিছুই নয় আদতে। মাটির জিনিস মাটিতেই মিশুক গিয়ে, এমনটা ভাবতেই গলে পড়ল মাটিতে।
এভিল কিং ছড়ি ঘুরিয়ে তৈরি করল মহা-ঝঞ্ঝা। সেই ঝঞ্ঝাকে আমার মনে হল যেন অজস্র মৌমাছির ঝাঁক। যেমন ভাবা, অমনি সত্যি সত্যি ঝঞ্ঝা হয়ে গেল মৌমাছি আর আঙুল নাড়াতেই তারা উড়ে গেল কলমডিলাময় ফুটে থাকা অজস্র সব ফুলের দিকে।
এভিল কিং প্রচণ্ড রাগে জ্বলজ্বলে চোখে তাকাল আমার দিকে। শুনেছি সেই চাউনিতে যে কেউ হয় আমরণ এভিল কিং-এর বশ হয়ে যায়, নয়তো পুরো অন্ধ। কিন্তু আমার সেসব কিছুই হল না। সেই দেখে আরও ক্রুদ্ধ হয়ে দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে সে ছুটে এল আমার দিকে।
তার সেই ভয়ংকর গজরানোর আওয়াজ আর জান্তব মুখভঙ্গী স্বপ্নে দেখলেও অতি সাহসীর শ্বাসরোধ হয়ে আসবে, কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার এতটাই প্রশান্তি যে, আলাদা করে ভয় পাওয়ার কিছু মনেই এল না। বরং চোখ বুজে মিশে গেলাম এই পাহাড়-ভূমির আলোয়, বাতাসে। প্রচণ্ড গতিতে আমার উপর পড়তে চেয়ে সশব্দে পাথরে আছড়ে পড়ল এভিল কিং।
সে কী ভয়ানক অবস্থা তখন এভিল কিং-এর! প্রচণ্ড রাগে গরগর করছে। আমায় দেখতে না পেয়ে এলোপাথাড়ি ঘোরাচ্ছে হাতের সেই কাঁটা মুগুর। এত জোরে ঘোরাচ্ছে যে কালো কুয়াশার মতো দেখাচ্ছে, আর সে কী আওয়াজ!
কিছুতেই আমার নাগাল না পেয়ে সেই কাঁটা মুগুর নিজের দিকে তাক করল এভিল কিং। মুহূর্তে তার চোখে চলে এল এক অদ্ভুত নীলচে চশমা। সেই চশমা পরে চারপাশে আমায় খুঁজতে থাকল এভিল কিং। কিন্তু তোমার ওই চশমারও যে সাধ্য নেই আমাকে খুঁজে পাবার, মিস্টার এভিল কিং! সে কেবল খুঁজতে পারে অদৃশ্যকে। কিন্তু আমি তো কেবল অদৃশ্য হইনি, মিশে গেছি পাথরে, ফুলে, পাতায়, ঘাসে সবখানে। পারলে খোঁজো দেখি এবার আমায়।
কিন্তু এভিল কিংও তো এভিল কিং! যেমন তেমন কেউ নয়। নিষ্ঠুরতায় তার জুড়ি নেই জগতে। কাজেই এবার শুরু করল সে তার নিধন যজ্ঞ। যেন বুঝে গেছে যে এছাড়া আর আমাকে নাকাল করার কোনও উপায় তার নেই।
নির্বিচারে কাঁটা মুগুরের আঘাতে ধ্বংসলীলা চালাতে শুরু করল এভিল কিং। এক-একটা আঘাতে হুড়মুড় করে সব ভেঙেচুরে পড়ছে। কিন্তু যেই না আমি নিজের মনেই নিজেকে বলছি, ‘সব ঠিক আছে, সব ঠিক আছে,’ অমনি সত্যিই সব আগের মতো হয়ে যাচ্ছে।
এসব দেখে এভিল কিং আর স্থির থাকতে পারল না। প্রচণ্ড হুঙ্কারে চারপাশে খুঁজতে থাকল আমাকে। খুঁজতে-খুঁজতেই তার চোখে পড়ল দাদু, উরুম, কচি-কলা, তেরাইদের। একটা ক্রূর হাসি ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে কাঁটা মুগুরটা তোলার উপক্রম করল সে।
এই নিষ্ঠুরের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে বুঝতে পারলাম। আর দেরি করা সমীচীন হবে না।
কাজেই সমস্ত প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া অংশগুলো জুড়ে ফের নিজের দেহে ফিরে এলাম। আর সরাসরি চাইলাম এভিল কিং-এর চোখে।
এভিল কিং ক্রূর। প্রকৃতি থেকে তৈরি হয়েও, তার থেকে সমস্ত কিছু নিয়েও তাকেই ধ্বংস করতে উদ্যত আর আমি, সুলুং টুং, পাহাড়-কোলের ছোট্ট গ্রামের ছোট্ট এক মেয়ে, অন্ধকারে কিছু নড়লেও যে কিনা মায়ের আঁচলে মুখ লুকোত, সে এই মুহূর্তে নিজেই প্রকৃতি-মায়ের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধ্যি কী এভিল কিং-এর মায়ের সঙ্গে লড়বার?
আমার চোখের দিকে তাকাতেই মুখটা বিকৃত করে চোখ নামিয়ে নিল এভিল কিং। আমার দৃষ্টি ওর সইছে না। সইবে কেমন করে? প্রকৃতির নির্মল আলো যে ওর পক্ষে সওয়া সম্ভব নয়!
কিন্তু যা ভাবছিলাম তা অত সহজে হল কই? ভেবেছিলাম এভিল কিং এবার হার মানবে। কিন্তু না, চাউনি নীচে নামিয়ে মুহূর্তেই হাতের কাঁটা মুগুরটা ছুড়ে দিল আমার দিকে।
কী তার তাপ! ঝলসে যেতে যেতে বুঝতে পারছিলাম যেন দাবানল লেগে গেছে গোটা পাহাড়দেশের জঙ্গলে জঙ্গলে। হঠাৎ কী যেন একটা হল। কী হল?
চেয়ে দেখি এভিল কিং-এর সেই কাঁটা মুগুর দুখণ্ড হয়ে পড়ে আছে। আর আমার আর এভিল কিং-এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে পাথরে পা দাপড়াচ্ছে এক-শিংওয়ালা এক পক্ষীরাজ ইউনিকর্ন। তার পিঠে যিনি সওয়ার, কাউকে বলে দিতে হয় না যে তিনিই মহান সাবরিও।
ঝুঁকে পড়ে অভিবাদন জানালাম মহান সাবরিওকে। তিনিও তাই করলেন। তারপর আমার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে তেরাই, উরুম, কচি-কলা আর দাদুকে নিয়ে মুহূর্তে মিলিয়ে গেলেন কোথায়।
ব্যর্থ এভিল কিং তীব্র ক্ষোভে অমানুষিক চিৎকার করে উঠল। আক্রোশে চাইল আমার দিকে। কিন্তু আমার আর কোনও চিন্তা নেই। নির্ভয়ে ফের তাকালাম তার চোখে। অমনি মুখ বিকৃত করে চাউনি নামিয়ে নিল সে। আমি বুঝে গেছি কেমনভাবে ধ্বংস হবে এভিল কিং।
এভিল কিং নিমেষে কালো ধোঁয়া হয়ে উঠে গেল অনেক উপরে, তারপর তীক্ষ্ণ ফলার মতো নেমে আসতে থাকল আমার দিকে। ফের মিশে যেতে-যেতেই মনে মনে প্রকৃতির সব জলকণাদের এভিল কিংকে ঘিরে দাঁড়াতে বললাম।
সেই তীক্ষ্ণ ফলার মতো এভিল কিং আছড়ে পড়ল পাথরে। বলা ভালো, ঢুকে গেল পাথরের গভীরে। এতটাই তীব্র অভিঘাত!
তারপর পাথরের ফাঁক থেকে, জমির ফাটল থেকে গলগল করে বার হতে থাকল বিষাক্ত কালো ধোঁয়া। শ্বাসরোধী ধোঁয়া।
গলা বুজে আসছে। কাশির দমকে যেন চোখ বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু এমন কেন হবে? আমি তো প্রকৃতি! নিজেকে সারিয়ে ফেলার বিদ্যা তো আমারই হাতে। চোখ বন্ধ করে সমস্ত ভুলে মিশে গেলাম দূরের এক সাগরপাড়ের অরণ্যে। একবুক তাজা বাতাস নিয়ে ছড়িয়ে দিলাম পাহাড়দেশে। উপরে উঠে মিলিয়ে গেল বিষবাষ্প।
না, মিলিয়ে যায়নি। ওই তো সেই ধোঁয়া জমাট বেঁধে ফের এভিল কিং-এর রূপ পেল।
কিন্তু সেই যে ধোঁয়ার ফলা পাথুরে মাটিতে ঢুকেছিল, সে বোধহয় অনেকটাই গভীরে গিয়ে থাকবে। কারণ, এভিল কিং নিজের রূপে আসতে না আসতেই সেখান থেকে ফোয়ারার মতো জল বেরোতে থাকল।
আমিও তো মনে মনে বলেছি সব জলকণাদের এভিল কিংকে ঘিরে ফেলতে। তারা যেই ঘিরে ফেলল, অমনি আমি ফের এভিল কিং-এর সামনে এলাম। এভিল কিং পরের আঘাত আনার আগেই আমি প্রকৃতির নির্মলতা আলোর কণায় মিশিয়ে দিলাম। সমবেত সব জলকণায় প্রতিফলিত হল সেই আলো। বারবার করে বিভিন্ন দিক থেকে ঠিকরে পড়ল এভিল কিং-এর চোখে গায়ে সর্বত্র। পড়তেই থাকল, পড়তেই থাকল।
এভিল কিং-এর শরীরের যেখানেই সেই আলো এসে পড়ে, সেই অংশ ধোঁয়া হয়ে মিশে যায়। আর্ত চিৎকারে ফেটে পড়ল এভিল কিং। অবশিষ্ট শরীর নিয়ে তেড়ে এল আমার দিকে।
তখনই সেই ফোয়ারার মতো নির্গত জলের কণায় কণায় আমি মিশিয়ে দিলাম আমাকে। কণায় কণায় অজস্র সুলুং টুং। অগুনতি সুলুং টুং ঝরে পড়ল এভিল কিং-এর অবশিষ্ট শরীরে। অনায়াসে ঢুকে পড়লাম এভিল কিং-এর অন্ধকার মনের ভিতরটায়।
হাত দুটো ছড়িয়ে বললাম, “আলো হোক, আলো হোক!”
এভিল কিং-এর শরীরময় ছড়িয়ে থাকা অজস্র সুলুং টুং একসঙ্গে বলল, “আলো হোক, আলো হোক!”
জলের কণায়, সূর্যের আলোয় মিশে থাকা লাখো লাখো সুলুং টুং আলোর কণা হয়ে ঢুকে এল ভিতরে। আলো কণা মিলে মিলে অন্ধ মনে ধীরে ধীরে জ্বলে উঠল তীব্র আলো। আলোর অভিষেকে মুছে গেল অন্ধকার।
এমন আলোয় আলোয় এভিল কিং আর বাঁচে কী করে? এত আলোয় সেও যেন কখন আলো বনে গেছে। আদতে সবকিছুই তো আলোয় আলোয় বোনা। এভিল কিং আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা মানুষের অজান্তে দূষণের বিষে ঢেকে ফেলেছিল সব। সবকিছুর পুনর্বিন্যাসে কখন যে সেই প্রথম নির্মল আলোর বুননে ফিরে গেছে আমাদের এভিল কিং, সে নিজে তো নয়ই, আমিও বুঝতে পারি নি।
বুঝলাম যখন, তখন দেখি সেই আলোয় ভরা আকাশে এসে দাঁড়িয়েছেন মহান সাবরিও আর তাঁর ইউনিকর্ন। নতুন ভোরের সোনার আলো তাঁদের চারপাশে। সাবরিও আমায় ডাকছেন।
হাত দুটো উঁচু করে ভেসে পড়েছি বাতাসে। ভাসতে ভাসতে পৌঁছে গেছি সেই ইউনিকর্নের কাছে।
সাবরিও আমায় অভিবাদন জানিয়ে তুলে নিলেন ইউনিকর্নের পিঠে। আর ইউনিকর্ন ভেসে পড়ল কোথায় বলো তো? ঠিক ভেবেছ। সাবরিওর ইউনিকর্ন তুলোর মতো মেঘের উপর দিয়ে চলল সেই ফুলটুংলির স্বপ্ন পাহাড়।
বিদায়!
স্বপ্ন বলে স্বপ্ন! ফুলটুংলি পাহাড় এত সুন্দর যে স্বপ্নেও ভাবা যায় না। কথায় আর বলব কী!
“এত সুন্দরও কোনঅ জায়গা হতে পারে?”
এই প্রশ্নটা কিন্তু আমার নয়, প্রশ্নটা ছিল তেরাইয়ের। আমার যে এই প্রশ্নটা এই মুহূর্তে হতে পারে না, তার কারণ আছে। আসলে ওর থেকে বেশ খানিক সময় বেশি আমি ফুলটুংলির শোভা দেখছি। কাজেই বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটা বলতে পারো আমি অনেকটা আগেই সামলে উঠেছি। দাঁড়াও, একদম প্রথম থেকে বলি।
এভিল কিং শেষ হবার পরে সেই তো আমরা ভেসে পড়লাম ইউনিকর্নে। যে ইউনিকর্ন আমার স্বপ্নের রাজা, তার পিঠে সওয়ার হওয়া! সেই অনুভূতির কথা আর কী বলি তোমাদের। সে যে কী সুন্দর যাত্রা! এই আমি, এই পাহাড়দেশের সুলুং টুং, যে কিনা খানিক আগেও প্রকৃতির সঙ্গে এক হয়েছিলাম, সেও আকাশের শোভা দেখে কথা হারিয়ে ফেলেছি। সূর্যের আলোর যে মেঘে মেঘে এমন রূপ সে তো কখনও ভাবিওনি! মেঘের রাজ্যও যেন আমাদের এই পাহাড়দেশ। উঁচুনিচু ছোটো ছোটো সাদা, ধূসর টিলায় ভরা, কোথাও আবার সাদা মেঘের মাঠ। আবার খাদও আছে অনেক। একটা বড়ো মাঠের পর অনেকটা জায়গা ফাঁকা। যেন পাহাড়ি সরোবর। ছোট্ট মেঘ নৌকার মতো সেখানে ভাসে। আর এদের সবার উপর সূর্যের আলো ঝলমল করে গয়নার মতো।
তুলো মেঘের দেশ পার করে আমাদের ইউনিকর্ন নামতে শুরু করল। নামতে নামতে নীচে তাকিয়ে দেখি, রঙের মেলা! সাবরিও বললেন, “ওই আমাদের ফুলটুংলি। তোমাদের স্বপ্ন পাহাড়।”
উপর থেকে স্বপ্ন পাহাড়কে তালপাতার টোকার মতো দেখাচ্ছে। গোল আর মধ্যিখানটা একটু উঁচু। অবশ্য যত নীচে নামছি সেই উঁচু জায়গাটা ক্রমশ চারপাশ থেকে কত উঁচু বোঝা যাচ্ছে। উঁচু জায়গাটা আসলে ফুলটুংলির চুড়ো। অনেক উঁচু। মাথা থেকে চারদিকে অসংখ্য জলের ধারা নেমেছে। উপর থেকে দেখে সিঁথিপাটি মনে হচ্ছে। গোটা ফুলটুংলি ফুলে ছাওয়া। যত নীচে নামছি রঙের খেলা ততই স্পষ্ট হচ্ছে। এত যে রঙ হয়, জানি না। কত রঙ একদম নতুন! আর ফুলের যে কত্ত রকম গড়ন!
তবে অবাক হবার আসল জিনিস তো নীচে নামার পর। একটা সবুজ ঘাসের গালিচা ঢাকা উপত্যকায় আমাদের নামিয়ে মাথা নিচু করে অভিবাদন জানিয়ে উড়ে গেল ইউনিকর্ন। সাবরিও আমায় ডাকলেন, “চলো সু, ভিতরে যাওয়া যাক।”
“ভিতরে মানে? এ তো খোলা মাঠ!”
“উঁহু, সুলুং টুং,” সাবরিও বললেন, “তোমাকে তো এমন কথা মানায় না। ভালোভাবে দেখো।”
ভালোভাবেই তো দেখছি। কই, কোনও তো ঘরবাড়ি নেই! সেই একইরকম সবুজ উপত্যকা।
কী মনে হতে চোখ বন্ধ করে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে চেয়ে দেখলাম। এবার স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, চোখ জুড়োনো একটা ক্যাসেলের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে। ক্যাসেলের সিঁড়ি ধাপে ধাপে নেমে এসেছে ঠিক আমাদের সামনে। আর সেখানেই মাথা ঝুঁকিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে আমাদের একটা ডালিয়া।
আমি জানি তোমাদের বিশ্বাস হচ্ছে না। অন্য কেউ বললে আমারও বিশ্বাস হত না। কিন্তু নিজের চোখে যা দেখছি কীভাবে অবিশ্বাস করি!
মাথা নুইয়ে আমিও অভিবাদন জানালাম। ডালিয়া বলল, “আসুন মহান সুলুং টুং! আসুন হে সাবরিও!”
সাবরিওর দিকে চাইলাম। সাবরিও বললেন, “এই যে ক্যাসেল দেখছ সু, আলোর ক্যাসেল। সবকিছু আলোয় বানানো।”
“প্রকৃতিতেও তো সবকিছু আলোর তৈরি বলে জানলাম এই ক’দিনে!”
“সে তো বটেই। তবে আলোর কণারা নিজের খেয়ালে নানান ভেলকি দেখাতে সক্ষম। এই ক্যাসেলও সেরকমই একটা ভেলকি ভাবতে পারো। প্রকৃতি যেমন নির্মল, তেমন নির্মল না হতে পারলে এই ক্যাসেল চোখে পড়বে না কারও। তবে আমি চাইলে, অবশ্য এখন তুমি চাইলেও, অন্য যে কাউকে এই ক্যাসেল দেখার দৃষ্টি দিতে পারো। যাক, সবকথা হবে। আগে ভিতরে চলো, একটু বিশ্রাম নেবে।”
“সে নাহয় পরে হবে মহান সাবরিও। আগে আমি আমার বন্ধুদের দেখতে চাই। দাদুকে দেখতে চাই।”
“নিশ্চিন্তে থাকো সুলুং। ওরা সবাই ক্যাসেলের ভিতরে আছে। এখন ঘুমোচ্ছে। ভালো আছে।”
“তাহলে একবার একটু এই ফুলটুংলি ঘুরে আসি?”
“যাবে? বেশ তো! তবে এই ভেলা চড়ে যাও।”
বলতে বলতে দেখি এক সূর্যমুখী ভেলা এসে হাজির। সেই ভেলার সূর্যমুখী ফুলেরা সব জীবন্ত। যেই না আমি চড়লাম, অমনি ভেসে পড়ল আকাশে। শুধু কী আর ভেসে বেড়ানো? হালের ডগার সূর্যমুখী বোধহয় এদের মাতব্বর। আমায় সে প্রতিটা জায়গার বিবরণ দিতে দিতে চলল। ভালোই হল। ওর কল্যাণে আমি প্রায় গোটা ফুলটুংলি দেখে ফেললাম। কত যে ফুল! ফুল আর ফুল। ফুলের পাহাড়। ফুলের পথ। ফুলের বাড়ি। আর সেখানে থাকছেও সব ফুলেরা।
আমায় দেখে হাত নাড়ল তাদের সব্বাই। আমিও হাত নাড়লাম। সেই ফুলের দেশেই আছে লাংমো গ্রাম। সেও দেখলাম ভেসে ভেসে। আরামডিলায় তাদের গ্রামের যে অপরূপ শোভা দেখেছি সেও হার মেনে যায় এখানে তাদের বসতির কাছে। তুলতুলে সব ফুলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে লাংমোরা আমায় দেখে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে। এরা তো সবাই আমার স্বজন। কী যে আনন্দ হচ্ছে ওদের দেখে! ওই তো দলপতি লাংমো! তাকে দেখেই মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করলাম। সেও হাসিমুখে মাথা নোয়াল।
খুব ইচ্ছে করছিল একবার ওদের গাঁয়ে নামার। কিন্তু মাতব্বর সূর্যমুখী আবার খুব কড়া। সে একেবারে রাজি হল না। বলল, “এখন তো বেশি সময় নেই মহান সুলুং। ক্যাসেলে সবাই আপনার অপেক্ষায়। পরে নাহয় আসা যাবে।”
ঠিক কথাই তো। হাত নেড়ে বিদায় জানাতে জানাতে ভেসে গেলাম ফুল ঝরনার দেশে। এবার মনে হচ্ছিল যেন স্বপ্ন দেখছি। এও কি সম্ভব! লাল-হলুদ এক টিলার চুড়োয় এই বড়ো এক গোলাপি ফুলের ভিতর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে নামছে ঝরনার জলধারা। এতটা উপর থেকেও তার সুগন্ধ মালুম হচ্ছে। গন্ধটা এমনই যে মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ছেয়ে যাচ্ছে।
এমন সব নানান আশ্চর্য সৌন্দর্যের উপর দিয়ে ভেসে ভেসে একসময় এসে পৌঁছলাম ক্যাসেলের সিঁড়িতে। সেখানে তখনও দাঁড়িয়ে সাবরিও।
খানিক সংকোচ হল আমার। মাথা নামিয়ে বললাম, “মহান সাবরিও, আপনি ভিতরে যাননি?”
“যাব কী গো! ঢোকার সময় পেলাম কই? এই তো তুমি গেলে সুলুং!” সাবরিও হাসিমুখে বললেন।
মানছি, আমি এসেই বেড়াতে গেছি; মানছি, এখন আমি মহান সাবরিওর অতিথি, তবুও এতটা আদর আপ্যায়ন কি আর মানা যায়? বললাম, “এই গেলাম কোথায়? অনেকক্ষণ তো! আপনার সূর্যমুখী ভেলায় চেপে পুরো ফুলটুংলি ভেসে এলাম যে!”
একটু হেসে সাবরিও বললেন, “আসলে কী জানো সুলুং, এইখানকার আর বাইরের সময়ের তফাত আছে। এখানে সময় অনেক অনেক ধীরে চলে বাইরের তুলনায়।”
“তাই আবার হয় নাকি!”
“হয় বলেই তো আমি এতদিন বেঁচে আছি সু! একই ভাবে।”
আমায় আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সাবরিও বললেন, “আর নয়। এবার ভিতরে গিয়ে আগে বিশ্রাম, তারপর সবার সঙ্গে দেখা করে অন্য সব কাজের কথা, কেমন?”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। তারপর সাবরিওর সঙ্গে ঢুকে পড়লাম ক্যাসেলে।
ক্যাসেল তো আর সাধারণ ক্যাসেল নয়। ভিতরে ঢুকেই বিরাট মাঠের মতো হল, তার বিভিন্ন দিকে সুদৃশ্য সিঁড়ি উঠে গেছে। অসংখ্য ফুলেরা একমনে বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছে। সে যে কতরকম কাজ, সে আমি বলে শেষ করতে পারব না।
আমরা উঠলাম মেইন গেটের সোজাসুজি সিঁড়ি দিয়ে। উঠলাম না, বরং ভাসলাম বলা চলে। উঠেই একটু হেঁটেছি, হঠাৎই কীসে যেন ধাক্কা খেলাম। উফ্! কিচ্ছু তো নেই! তবে ধাক্কা লাগল কীসে?
সাবরিও বললেন, “সুলুং, এখানে কিন্তু দরজা আছে, তুমি হয়তো খেয়াল করলে না। মনে রেখো, এখানে সব জায়গায় তোমাকে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখতে হবে। এর প্রত্যেকটা এক-একটা সুরক্ষা বলয়।”
সাবরিওর কথা শুনে ফের তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই সামনে দরজা! এমন দরজা যে সাধারণ চোখে দেখাও যাবে না। তবে দরজা তো দেখছি, খুলবে কেমন করে?
সাবরিও দেখলাম দরজার বিশেষ এক জায়গায় হাত রাখলেন, অমনি সেই দরজা নিচ থেকে উপরের দিকে উঠে গেল খুলে। আমরা ঢুকে যেতে নিজেই সেই দরজা নেমে এল ফের। সাবরিও বললেন, “এই ক্যাসেলে যত দরজা সব আমার ছোঁয়াতেই খোলে। অবশ্য এখন থেকে যাতে তোমার ছোঁয়াতেও খোলে তার ব্যবস্থাও করে দেব।”
এখানেও ফুলেরা কাজ করে যাচ্ছে নিজেদের মনে। আমায় দেখে সবাই অভিবাদন জানাল। এখন আমি সব দেখতে পাচ্ছি।
এখান থেকে ডানদিকে ঘুরে আরেকটা দরজা পার হয়ে আমরা যেখানে পৌঁছলাম সেখানে ফুলের খাটে ঘুমিয়ে আছে উরুম, তেরাই, কচি-কলা আর দাদু। ওদের দেখে এত আনন্দ হল যে নাচতে ইচ্ছে করছিল। মুহূর্তেই পরিচিত আওয়াজ পেয়ে দেখি মুনরো। এতক্ষণ কোথায় ছিল কে জানে। আমায় দেখেই ফড়ফড় করে উড়ে এসে বসল আমার হাতে। তারপর কত কথা তার! সে আর শেষ হতেই চায় না।
পায়ের কাছে কী একটা সুড়সুড় করছে। ওমা! এ তো খুবরু! ও-ও এখানে! কী যে আনন্দ হচ্ছে আমার!
উরুমদের ডাকতে যেতেই সাবরিও বললেন, “আরও একটু সময় ঘুমোক ওরা। অনেকটা ক্ষতিই তো হয়েছিল, সেটা পূরণ হতে আর একটু সময় লাগবে।” তারপর আমার দিকে ফিরে ফের বললেন, “তাছাড়া তোমারও তো বিশ্রাম দরকার।”
“আমি ঠিক আছি, মহান সাবরিও।”
“বেশ। তাহলে চলো কিছু খেয়ে নেওয়া যাক।”
“ওরা উঠুক, একসঙ্গে খাব সবাই।”
“তোমার উপযুক্ত কথাই বলেছ।” প্রশংসার চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন সাবরিও, “তবে ওদের জাগতে তো একটু দেরি আছে, ততক্ষণ নাহয় তুমি বিশ্রাম করে নাও, আমিও একটু কাজ সেরে আসি।”
সাবরিও চলে গেলেন। ঘর তো এখানে সব স্বচ্ছ। যেকোনও দিক থেকে বাইরে দেখা যায়। কিন্তু বাইরে থেকে দেখা যাবার কোনও জো নেই। যাই হোক, বাইরে দেখতে দেখতে চোখ দুটো লেগে এল। অমনি কোত্থেকে এক ফুলের আরামকেদারা এসে গেল আমার কাছে। আর পারা যায়!
আরামকেদারায় গা এলাতেই পাপড়িগুলো ঝুঁকে এসে মাথায় মুখে নরম পরশ দিল। কী স্নেহের ছোঁয়া! মায়ের মুখটা ভেসে উঠল আমার চোখে। পাছে চোখে জল চলে আসে কাজেই চোখটা বুজিয়ে নিলাম।
তারপর কতক্ষণ কেটে গেছে কে জানে। ঘুম ভাঙল তেরাইয়ের ডাকে। ঘুমটা ভাঙতেই ওকে দেখে হঠাৎ খুব আনন্দ হল। জড়িয়ে ধরলাম তেরাইকে। তারপর দুই বন্ধুতে কত কথা! সব ওকে বললাম। ও তো অবাক! তারপর জানালা দিয়ে চারপাশ দেখে আপন মনে বলে উঠল, “এত সুন্দরও কোনও জায়গা হতে পারে?”
“হতে যে পারে সে তো দেখতেই পারছিস!”
যাক বাবা, উরুমটার ঘুম ভেঙেছে। ওমা! দাদু আর কচি-কলাও তো যে যার বিছানায় উঠে বসে আছে!
“দিদি! তুমি যখন তেরাইকে বলছিলে তখনই আমরা সবাই জেগেছি, কিন্তু তোমাদের আর কিছু বলিনি!” দাদু কাছে এসে বলল।
সত্যি আবার পুরো দল একসঙ্গে হয়ে সে যে কী মজা আমাদের! সবচেয়ে আনন্দ বোধহয় মুনরোর। ঝুটোপুটি করে উড়ে উড়ে সে গান ধরল—
আয়রে সবাই দেখরে চেয়ে
পাহাড়দেশের ছোট্ট মেয়ে
কান্ডিটা কী করেছে!
এই তো ক’জন বন্ধু সাথে
সবার ভালোয় দিনে রাতে
কী লড়াই না লড়েছে!
ওহো! কী লড়াই না লড়েছে!
তাই তো আজকে পাহাড় স্বাধীন
নাচছি সবাই তাধিন তাধিন
করছি সু-এর জয়গান
সুলুং টুং মোদের সোনার মেয়ে
আপন কে আর সু-এর চেয়ে?
গাইছি সু-এর জয়গান
ওহো! গাইছি সু-এর জয়গান!
ওহো! গাইছি সু-এর জয়গান!
উরুম, তেরাইও শেষে ওর সঙ্গে গলা মেলাল। আমার এত লজ্জা করছিল যে চোখ নামিয়ে নিলাম।
গান শেষ হতেই বললাম, “আমি একা তো কিছুই করিনি! তোমরা সবাই ছিলে। তোমরা না থাকলে কিছুই হত না। আর মহান সাবরিওর সাহায্য আর নির্দেশ ছাড়া আমার কী সাধ্য এইসব করার! বরং তোমাদের সবার সহায়তায় আমি অনেক কিছু শিখলাম।”
“আরও অনেক কিছুই শিখবে তোমরা সবাই এইখানে। অনেক যুদ্ধ আরও লড়তে হবে আগামীতে। শুধু এই পাহাড়দেশ নয়, পৃথিবীর নানান জায়গায়। যেখানেই প্রকৃতি-মাকে বিপন্ন করে তুলবে কেউ, সেখানেই। তার জন্য তৈরি হতে হবে তোমাদের এইখানেই।”
সাবরিওর কথাগুলো শেষ হতে না হতেই উরুম হাউমাউ করে উঠল, “সে কি! আমরা বাড়ি যাব না!”
শুধু উরুম কেন? তেরাই, আমি, দাদু সবারই এই প্রশ্ন। বাড়ি যাব না! মা যে অপেক্ষা করে আছে আমাদের!
মহান সাবরিও হেসে বললেন, “সে কি! বাড়ি যেতে আমি বারণ করলাম কোথায়? বাড়ি তো যাবেই তোমরা। কিন্তু দেখাসাক্ষাৎ সেরে আবার এখানে আসতে হবে।”
“আমাদের ইশকুল?” তেরাই বলল।
“সব এখন থেকে এইখানে। কেউ তোমরা সাধারণ ছেলেমেয়ে নও। তোমাদের সবার বিশেষ ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতা আরও বাড়ানোর শিক্ষা তোমরা এখানে পাবে।”
“আপনি শেখাবেন মহান সাবরিও?” আমি জানতে চাইলাম।
“আমি একা নই। আরও অনেক শিক্ষক আছেন যাঁরা তোমাদের শেখাবেন।”
দাদু এতক্ষণ চুপ ছিল। এবার বলল, “কেবল এরাই?”
সাবরিও বললেন, “না। এদের মতো আরও অনেক ছেলেমেয়ে। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ছেলেমেয়েরা এখানে আসে। বিভিন্ন বিষয়ে এরা শিক্ষা পায়। আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীকে সুরক্ষিত রাখার জন্য তৈরি হয় সবাই। সারা পৃথিবীতে প্রকৃতি-মায়ের সৃষ্টি ধ্বংস করার যজ্ঞ চলছে। তাকে বাঁচাতেও তো সেনানী দরকার! সেনাপতি দরকার! তোমরা হবে প্রকৃতি-মায়ের সেনাবাহিনী।”
দাদু আমাদের সবার মাথা নেড়ে দিয়ে ভারী গলায় বললেন, “সত্যিই আমার সোনামানিক তোমরা। তোমাদের জন্য আমার গর্ব হচ্ছে। তোমরা তো আবার এখানে আসবে। আমি বাড়িতে ঝুড়ি বুনতে বুনতে, রডোডেনড্রনের ফুল দেখতে দেখতে, মুনরোর গান শুনতে শুনতে তোমাদের কথা ভাবব। এই দাদুর কথা ভুলো না। সময় পেলেই দেখা করে যেও।“
দাদুর কথা শেষ হল কি হল না, সাবরিও বলে উঠলেন, “সে কী সামরু! আপনিও তো এখানে আসছেন!”
“আমি বৃদ্ধ মানুষ। আমাকে দিয়ে আর কী কাজ হবে আপনাদের।”
“এতদিন ধরে আপনাকে আমরা দেখেছি। কী দায়িত্বপরায়ণ আপনি! কী অপরিসীম শক্তি আপনার বাহুতে! আর রণকৌশল—সেও তো অনবদ্য। তাছাড়া এই পাহাড়দেশের প্রকৃতির সব গাছগাছালি আপনার চেনা, কার কী গুণ সব আপনার জানা। আপনি শিক্ষক হবেন। শেখাবেন এখানে। আপনার শক্তি, লড়াইয়ের কৌশল শেখাবেন ছেলেমেয়েদের। তাছাড়া আপনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণও তো বটে!”
“পরীক্ষা?” আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম।
“নয়তো কী?” সাবরিও হেসে বললেন, “এতগুলো পাহাড় পার হয়ে, শত্রুদের হারিয়ে এখানে এলে তোমরা। এটা পরীক্ষা ছাড়া আর কী? পরীক্ষায় সবাই উত্তীর্ণ তোমরা। এবার আর এখানে আসাযাওয়ার জন্য পাহাড় পেরোতে হবে না। এখানকার গাড়িতেই তোমরা যাতায়াত করবে।”
খুব আনন্দ হচ্ছিল আমাদের। আবার তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতেও খুব ইচ্ছে করছিল। উরুম তো বলেই ফেলল, “তাহলে এবার আমরা বাড়ি যাই?”
সাবরিও বললেন, “বেশ তো। একটু খাওয়াদাওয়া করে তারপর নাহয় যেও!”
উরুমকে পেটুক বলে অনেক ক্ষেপিয়েছি। আজ সেই পেটুকই আমাদের সবার মনের কথা বলে ফেলল, “সে নয় ফিরে এসে খাব। এখন তো শুধু মায়ের হাতে খেতেই ইচ্ছে করছে।”
সাবরিও হেসে উঠলেন। “বেশ। তাই হোক।” বলে আমাদের নিয়ে চললেন ব্যালকনির দিকে।
সেখানে এই বড়ো এক গাড়ি! ভাসছে। আমাদের আর কিছু আশ্চর্য লাগল না। সাবরিওকে প্রণাম জানিয়ে সবাই উঠল গাড়িতে। মুনরো, খুবরু ওঠার পর আমি উঠতে যাব, এমন সময় রিনরিনে গলায় শুনতে পেলাম, “বাহ্! এই নাকি বন্ধু! চলে যাচ্ছে অথচ একবারও মনে হল না!”
তাকিয়ে দেখি লাংমো মেয়ে কচি-কলা। অভিমানে ভেসে উপরে উঠে যাচ্ছে। সত্যিই তো! খুব ভুল হয়ে গেছে। মাথা নুইয়ে বললাম, “ক্ষমা করো বন্ধু। ভুল হয়ে গেছে আমার। তোমার কথা ভুলব কেমন করে? কতবার বাঁচিয়েছ আমাদের! তুমি তো আর আলাদা কেউ নও আমাদের থেকে। কেবল মায়ের কাছে যাবার তাড়ায় ভুল হয়েছে আমাদের। নেমে এসো।”
ব্যস, এইটুকুতেই লাংমো মেয়ে নেমে এসে আমাদের কাছে। তার মিষ্টি হাতটা ধরে বললাম, “তুমিও চলো না আমাদের সঙ্গে! মা তোমাকে দেখলে খুব খুশী হবে।”
গলা ভারী করে চোখ থেকে ধোঁয়া উড়িয়ে কচি-কলা বলল, “আমাদের তো যেতে নেই সবার মাঝখানে। কেমন করে যাব?”
সাবরিও বললেন, “এই কথা! এই নাও, এইবার তুমি যেতে পারবে।” বলেই ডানহাতের অনামিকার আংটিটা ছুঁইয়ে দিলেন ওর মাথায়। অমনি দড়দড় করে বেড়ে উঠে কচি-কলা হয়ে গেল আমাদেরই মতন এক মেয়ে! কী তার রূপ! দেখলে যেকোনও রাজকন্যে লজ্জা পাবে।
হই হই করে এবার কচি-কলাকেও গাড়িতে তুলে নিল তেরাই। আমিও মহান সাবরিওকে প্রণাম করে উঠে পড়লাম। যেই না ওঠা অমনি সেই গাড়িও দিল ছেড়ে।
তারপর?
তারপর আর কী? মেঘের উপর দিয়ে ভেসে চলল আমাদের গাড়ি। আর আমরা সবাই এতদিনের কাণ্ডকারখানার গপ্পো করতে-করতেই ভাবতে থাকলাম কখন আসে কলমডিলা, কখন আসে আরামডিলা, কখন আসে আমাদের সাধের বরমডিলা। কখন আসে আমাদের রেনোলাবিলার মাঠ। কখন আসে আমাদের বাড়ি।
কখন দেখি মা আমার দাঁড়িয়ে আছে আমার অপেক্ষায়।
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস