একেকজনের পুষ্যি হরেক কালো গাই, হনুমান আর মহারানি প্যান্সি দীপালি দেবনাথ

কালো গাই, হনুমান আর মহারানি প্যান্সি

দীপালি দেবনাথ

আমার মামার বাড়িতে উঠোনের একপাশে স্নানঘরের পাশে একটা কালো গরু বাঁধা থাকত আর চোখ বুঁজে তারিয়ে তারিয়ে জাবর কাটত। কালো গাইয়ের (গরুর) দুধ নাকি খুব উপকারী, কারণটা আমার জানা নেই। কাছাকাছি বাছুরটাও বাঁধা থাকত বোধহয়, আমার মনে নেই। মাঝে মাঝে ‘গ্যালো –গ্যালো’ রব উঠত। তখন আমরা ছুটে গিয়ে দেখতাম পুরোন কালের স্নানঘরের প্রত্যেক ঘুলঘুলির মধ্যে জিভ দিয়ে একটা থেকে গায়ে মাখার সাবান বের করে খেয়ে ফেলল, বোধহয় পরে আরাম করে জাবর কাটবে বলে। হয়তো পেট পরিষ্কারের কথাটাও ভেবেছিল, যদিও সে-যুগে টিভি বিজ্ঞাপন ছিল অজানা ।

আমার বোন কেয়া তখন খুবই ছোট্ট, আমার দাদা, সেও ছোট, শখ করে মামার বাড়ির ছাদে তাকে নিয়ে গেছে। এমন সময়ে একটা গোদা হনুমান লাফ মেরে সেখানে হাজির। দাদা ভয় পেয়ে বোনকে সেখানেই রেখে হাঁউমাউ করে পালিয়ে নীচে নেমে এল। বোন কিছু না বুঝে হতভম্ব আর হনুমান ততোধিক হতভম্ব।

আমি নীচে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, হনুমানটা আলসের ওপরে দু’হাত রেখে ‘এটা কীরকম হল’ভাবটা মুখের ওপর মাখিয়ে বসে রয়েছে ।

হনুমান নমস্য, তেনাদের মতিগতি বোঝা দায়! কানপুরে গানের ক্লাসে গান শিখছি। দোতলায় আমাদের ক্লাস চলছে। আমরা গাইছি, ‘সঙ্গ সখা অঙ্গদ সুগ্রীব ঔর হনুমান।’

যেই হনুমানের নামগান করেছি অমনি একটা হনুমান লাফ দিয়ে জানলার ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে। ভাবখানা -শুধু কথায় কী হবে, কলা-মিষ্টি কিছু দাও।

নবরসের একটি অন্যতম রস, রসবোধে রসিক। রসিক মহাজন না থাকলে গান কে শুনবে!

আবার কানপুরে, রসিক হনুমান আর বাঁদরের সহাবস্থান। বড়রাস্তা যেখানে তার দু’ধারে গাছ-পালা কম। হনুমান ও বাঁদরের মত মান্যগণ্য সম্প্রদায়ের মাটিতে পা পড়া ভালো দেখায় না। সেইজন্যে বিশিষ্ট এক বাঁদর মহাশয় ঠিকই করেছিলেন চালক চালিত সাইকেলে সওয়ার হবেন। তারপর গন্তব্য স্থানে টুক করে লাফ দেবেন। এটা তাঁর নিয়মিত ব্যাপার ছিল। সৌভাগ্যবশত আমি রেহাই পেয়েছিলাম। আমি মেয়ে বলে বোধহয়। শুধু আমি কেন, তাচ্ছিল্যবশত সব মেয়েদেরই রেহাই দিয়েছিল সে তার সাইকেলি আবদার থেকে।

কানপুরে মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টে আমাদের বাড়ির পেছন দিকেই গঙ্গা। ছুটির দিনে গঙ্গার চরে বন্ধুদের নিয়ে ঘুরছি। এমন সময়ে একজন স্নান সেরে উঠে আমাদের ডেকে দেখালেন। গাছে ওনার গামছা আয়না ইত্যাদি রাখা ছিল। এক হনুমান মহাশয় সেই আয়নায় বিভোর হয়ে নিজের মুখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, ভেংচি কেটে নানান ভাবে দেখছে।

শীতের সময়ে বাড়ির পেছন দিকে দড়ির খাটিয়া পেতে ঠাকুমা বড়ি শুকোতে দিতেন। বাঁদর এসে গঙ্গার ধারের পাঁচিলে বসে চারদিকে নজর রাখত আর ছানা বাঁদরকে পাঠিয়ে দিত বড়ি চুরির জন্য। কেউ এসে পড়লে ইশারায় ডাক দিয়ে পালিয়ে যেত।
আমাদের আ্যলসেশিয়ান কুকুর প্যান্সির তখন ২/৩ মাস বয়স। বাড়িতে দুটো তেঁতুল গাছ
ছিল। বাঁদর ও হনুমান কুলগাছ থেকে আধপাকা তেঁতুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে প্যান্সির মুখে ফেলে ওকে ক্ষেপিয়ে তুলত। ও রেগে যেত ঠিকই কিন্তু তেঁতুলের এবং আচারের স্বাদের উপাদেয়তা জেনে গিয়েছিল। তেঁতুল গাছদুটোতে ওরা সারাদিন রাজত্ব করে ফিরে যাবার পর সন্ধেবেলায়
টিয়াপাখিরা বাড়ি ফিরে দুটো গাছের থেকে পরস্পরের খবর আদানপ্রদান করত।
এমনই একদিন, গরমের দিন,সন্ধেবেলায় মা একতাল আটা নিয়ে রুটি করছেন, হঠাৎ খেয়াল হল এতক্ষণ রুটি করছেন সেগুলো গেল কোথায়?

দেখা গেল, ছাদের দরজা খোলা ছিল, তার এ’পাশটা রান্নাঘর। অতএব ছাদে বসে কপিকূলের মুখপাত্র যিনি তিনি হাত বাড়িয়ে একটা করে রুটি নিচ্ছেন আর সর্ব কপিকূলে বিতরণ করছেন মায়ের লঙ্গর খানার পাত্র খালি করে দিয়ে।

গঙ্গা পারে উন্নাও পেরিয়ে লখনউ। লখনউ-এর অনেক কিছুই বিখ্যাত। মানুষজন,
সংস্কৃতি, কৃষ্টি, স্থাপত্যবিদ্যার উৎকৃষ্ট নিদর্শন ভুলভুলাইয়া, বেগমমহল। তেমনি এলাকাগুলির মধ্যে ‘বান্দরিয়া বাগ’ ইত্যাদি। সবাই নিজেদের মধ্যে স্বমহিমায় বিরাজমান। সেইরকম পবনপুত্ররাও মহানন্দে স্বমহিমায় রয়েছেন।

আমার বাবার একজন সহকর্মী লখনউতে পোস্টেড ছিলেন। আমরা মাঝে মাঝে কিছুদিন কাটিয়ে আসতাম তাঁর কাছে। তাঁদের ছেলেমেয়েরা আর আমরা খুব হৈচৈ করতাম। মাসীমা খুব আমুদে ছিলেন। একদিন ভোরবেলায় ওঁদের এক ছেলে সুভাষ যখন বারান্দায় ঘুমোচ্ছিল তখন একজন রামভক্ত বোধহয় ভুল করে প্রভু রাম ভেবে সুভাষকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবার জন্যে তার হাত দুটো ধরে টানছে। এদিকে মাসীমা হাসছেন আর সুভাষের পা দুটো ধরে টানছেন। সুভাষের তখন চ্যাংদোলায় অবস্থান মানে position টা সেই রকম। শেষকালে সুভাষের দাদা এসে পা দুটো ধরাতে রামভক্ত বোধহয় শুধু পেন্নাম ঠুকে চলে গেল।

তাছাড়া প্রায়ই তাঁরা রান্নাঘরে এসে হালুয়া অর্থাৎ মোহনভোগ খেয়ে ছড়িয়ে যেতেন। বেশি গরম তাঁরা পছন্দ করতেন না।

আগেই আমাদের আলসেশিয়ান কুকুর প্যান্সির কথা বলেছি। ওর একুশ দিন বয়সে ওকে আনা হয়েছিল এলাহাবাদ থেকে। ওর মা এক সম্ভ্রান্ত এবং গোঁড়া পরিবারের কুকুর ছিল। সে আবার পায়ের মোজা খেতে খুব ভালবাসত। অবশ্য তাতে কখনো কখনো বদহজমও হত।

যাই হোক প্যান্সি ট্রেনে চেপে বাস্কেটের পাল্কির সংগে ট্রেনের দুলুনি উপভোগ করতে করতে এসে পৌঁছল। মায়ের কোলে শালের তলায় লুকানো ছিল। কিন্তু আমার কাকু মার হাতে দুধের বোতল দেখে বুঝে গেল যে মহারানির আগমন হয়েছে। বাড়ির সবার আদরে তিনি বেশ দাপুটে মহারানি হয়ে রাজ করতে শুরু করলেন।এরা gradations টাও বেশ ভাল বোঝে। যেমন সর্বোচ্চ পদে বাড়ির কর্তা এবং সেই অনুসারে তার আনুগত্য চোলত, আবার পুরুষতান্ত্রিক ও বটে। বাপি দাদা ও কাকু। বাপিকে মান্য করত, দাদাকে ভয় পেত আর কাকুর আদর পেয়ে পেয়ে মাথায় চড়েছিল একেবারে যথার্থ।

একটু কান কামড়ে দাও তো মা বললেই কাকুর কাঁধে লাফিয়ে উঠে কানটা মোলায়েম ভাবে কামড়ে দিত। মাকে শ্রদ্ধা-ভক্তি করত, বিশেষ কাছে ঘেঁসত না কিন্তু লক্ষ রাখত। মা কোনো বাচ্চা কোলে নিলে ও কান্নাকাটি শুরু করে দিত। একেবারে her majesty, তিনিই একমাত্র কোলের candidate। ঠাকুমার সঙ্গে সখ্যভাব। আমাদের সঙ্গে যেমন তেমন আর আমাদের সর্বকনিষ্ঠা বোনকে সে শাসনে রাখত।

বাপির অফিসে যাওয়া সে মেনে নিয়েছিল। অফিস থেকে ফেরার পরে প্রথমে বাপিকে তার সঙ্গে খেলতে হবে। বল খেলা বা গাছের সরু ডাল মুখে নিয়ে খেলা। তবে সব চেয়ে পছন্দের খেলা, মায়ের একটা পুরনো হিল উঁচু জুতো নিয়ে খেলা। সেটাকে খেলা ছাড়া অন্য সময়ে ঝোপেঝাড়ে লুকিয়ে রাখত। খেলা অন্তে বাপি বাড়ির ভেতরে যেতেন।
অফিস ছাড়া অন্য সময়ে বাপির একা বেরোনো ওর একেবারে পছন্দ ছিল না।
সকাল বেলায় সবাই ব্যস্ত অফিস স্কুল কলেজ ইত্যাদি যাবার জন্য, মা-ও ব্যস্ত। অতএব দেখা যাবে প্যান্সিও ব্যাস্ত হয়ে এ-ঘর ও-ঘর করছে। সবার মুখে তখন ‘মোজা মোজা’ রব। মোজাগুলোর সব “ঠাঁই পরিবর্তন” হয়ে গিয়েছে ।

ঠাকুমার খুব বিছানা বাতিক ছিল। ধোপদুরস্ত সাদা ধবধবে চাদর টান টান নিভাঁজ করে পাতা। আমাদের কারো permission ছিল না বিছানায় বসা। একদিন হঠাৎ দেখা গেল এক জোড়া বুট বিছানার শোভাবর্ধন করছে। প্যান্সি খাটের নীচে বসে আছে রেজাল্ট আউটের জন্য। কিন্তু ঐ যে বলেছিলাম ‘সখ্যভাব!’ কাজেই ঠাকুমা কিছুই বললেন না।
ঠাকুমা আহ্ণিক মানে পূজো করতে বসলে ও ঠাকুমাকে না ছুঁয়ে একটু দূরে বসত। পুজো হয়ে গেলে সবার আগে প্রসাদ খাবে প্যান্সি, তারপরে বাকিরা।

ঠাকুমা দুপুরের খাওয়া ও রাতের খাওয়া নিজের ঘরে বসেই খেতেন। প্যান্সি ও যথারীতি একটু দূরে বসে যেত। দুপুরে খাওয়ার পর ছোট চামচের এক চামচ ভাত আর রাতে এক টুকরো পরোটা ও শেষে ঘটি থেকে একটু জল গড়িয়ে দিতেন। ওই খাওয়াটা ওর কাছে নেশার মতো ছিল। মা ঠাকুমা পুজো দিতে মন্দিরে গিয়ে ফিরে এলে প্রসাদের প্রথম candidate প্যান্সি, আমরা বাকিরা বাড়তি। ও  নাকি অবোলা জীব, সেটাই কারণ।

সেই সময় গ্যাস চুল্লির আবির্ভাব হয়নি। কয়লার আগুনে রান্না হত। মা রান্না শেষে জ্বলন্ত কয়লাগুলো এক গামলা জলে একটা একটা করে চুবিয়ে দিতেন। শীতল জলের পরশে জ্বলন্ত অঙ্গার মুহূর্তে ফোঁস করে উঠত। একদিন প্যান্সি রান্নাঘরের দরজায় শুয়ে ঘুমুচ্ছিল। হঠাৎ আগুনের ফোঁসফোঁসানি শুনে প্যান্সি ‘কী সব্বোনাশ হয়ে গেল’ মার্কা চেঁচিয়ে অর্থাৎ ওর ভাষায় কেঁউ কেঁউ করতে করতে বাপির কাছে ছুটে গিয়ে প্যান্ট ধরে কাকুতি মিনতি করে ‘অকুস্থলে’ নিয়ে এল।
বাপিকে দেখলে তার যত লম্ফ ঝম্প, লেজ নাড়ার ঘটা, তারপরে gradation অনুসারে ও পরিচিতির হাসি দিত মানে লেজ নাড়ত।

যদিও আমি ওকে নাওয়াতাম, খেতে দিতাম কিন্তু তাও, হয়তো তখন ঘুমচোখে  ভুল করে নাড়বার জন্যে লেজ তুলেছে পর মুহুর্তে ভুল ভাঙতেই লেজ নামিয়ে রাখত।
বাসন মাজার জন্যে যে মেয়েটি আসত তাকে দেখলেই বকাবকি শুরু করলে সে তার দেড় বছরের ছেলেকে সামনে এগিয়ে দিত। শিশুদের প্রতি প্যান্সির বাৎসল্য রস অর্থাৎ স্নেহভাব ছিল।

আমার সর্বকনিষ্ঠা ভগিনী তার বইয়ের আলমারিতে বইয়ের পেছনে তেঁতুল লুকিয়ে রেখে স্কুলে গিয়েছে। সেই ফাঁকে মহারানি বই সরিয়ে সব তেঁতুল খেয়ে ফেলেছে। বোন স্কুল থেকে ফিরে প্রথমে ভ্যাঁ—তারপরে তেনার সঙ্গে ঝগড়া করতেই উল্টে বোনই বকুনি খেল।

লঙ্কা ছাড়া অন্যান্য আচারও পছন্দের মধ্যে পড়ত অথচ মাংসহীন দিনগুলিতে তিনি নিরম্বু উপোস দিতেন। কচি মটরশুঁটি ও তার খোসা তাঁর প্রিয় মুখশুদ্ধির অন্যতম একটা ছিল।
মিলিটারি চাকরি, পাঁচ বছর থাকার পর বাপি বদলি হয়ে গেলেন বম্বে, অধুনা মুম্বই। মা গেলেন বাপির সঙ্গে। আমরা কানপুরেই থাকলাম।

প্যান্সি সারাদিন বাপিদের আসার অপেক্ষায় গেটে বসে থাকত। সন্ধে বেলায় অনেক কষ্টে তাকে বাড়ির ভেতরে আনা হত। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। ঠাকুমা আগের দিনের বিধবা, মাছ মাংস ছুঁতেন না, ফ্রিজেও ওসব ঢুকত না। সেই ঠাকুমাও মাংস হাতে নিয়ে ওকে খাওয়ার জন্য সাধাসাধি করতেন।

প্রায় একমাস না খেয়ে থেকে যখন প্যান্সি হাড়সার তখন ডাক্তারের পরামর্শে বাপিকে তার (telegram) করা হল। বাপি, মা-কে দেখে তার কী কান্না আর বকুনি! পরে জল খেল, খাওয়া-দাওয়া করল আর ঘুমোল।

কতটা তার ভালবাসা তার প্রমাণ পরেও দিয়েছে। তখন আমরা দেরাদুনে। ডিসেম্বরের ঠান্ডা, তখন ওর বাচ্চা হল। পরের দিন ওকে নিয়ে আসা হল খাবার ঘরে। সে সময়ে ও খুব দুর্বল, ঠক ঠক করে কাঁপছে। বাপি অফিস থেকে ফিরলে প্যান্সি কাঁপতে কাঁপতে মুখে একটা করে বাচ্চা নিয়ে এসে বাপির পায়ের ওপরে রাখল, ভাবটা “তোমার পায়ে এদের সঁপে দিলাম প্রভু।”

তারপরে বাচ্চা অবতারদের অনেক গল্প তৈরি হতে শুরু করল বাড়িতে। আরো অনেক পোষ্য সদস্যদের অর্থাৎ কুকুর বেড়াল পাখি ইত্যাদির ঝুলিভরা গল্প আছে। সে-সব ফের পরে বলব। আপাতত এখানেই থামছি ।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s