বনপ্রিয়া, কাক্কেশ্বর, গুগুলছানা আরো অনেক
অপর্ণা গাঙ্গুলী
ছোটোবেলায় কিন্ডারগার্টেনে মিস ইমানুয়েল আমাদের একটা খুব বড়ো টিয়াপাখির ছবিতে মোম রং করতে বলতেন, আর সেই ছবিতে সবজে আর লাল রং ভরতে গিয়ে আমার কেবলই মনে হত, আহা কী চমৎকার,আমার কেন অমন এক পাখি হয় না। তা দিলেন বাবা এনে অমন এক পাখি। তার নাম রাখা হলো বনপ্রিয়া।
বনপ্রিয়া? পাখির নাম ? কিন্তু কী করব,আমি যে তখন রূপকথার গপ্পো পড়ে পড়ে নাম দিতে শিখেছি। বনপ্রিয়া সুন্দর। মস্ত বড়ো খাঁচায় একা একাই থাকে, দানাপানি খায় আর শিস দিয়ে কথা বলে।
ওর মুখের বুলি, “এই কী হচ্ছেটা কী?”
বনপ্রিয়া আমাদের সামনের বাগানের সূর্যমুখী ফুলগাছে বসা ঝাঁক ঝাঁক টিয়া আসতে দেখে। ওরা দুলে দুলে সূর্যমুখীর বীজ খায়। আমার কেমন মনে হয়,বনপ্রিয়া ভারী কষ্ট পাচ্ছে। আর তখন একটা আস্ত সূর্যমুখী ফুল ওর কাছে এনে দিলে ও খুব আনন্দ করে খায়। তবু খাঁচার কাছে গেলেই বলে, “এই কী হচ্ছেটা কী?”
এর মধ্যেই মাঝে মাঝে বর্মনকাকুর পোষা কুকুর টিপসি এসে পড়ে। বাবার আর আমার খুব কুকুর পোষার শখ কিন্তু মায়ের আর বোনের জন্যে পোষা যায় না। ওদের বড়ো ভয়। যাই হোক,টিপসি আমাদের সঙ্গে অনেকক্ষণ এসে আড্ডা দেয় সামনের বারান্দায়। বিস্কুট খেতে আসে ও। কাজলপরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন অনেক কিছু বলতে চায়। কখনো চোখ দিয়ে বলে, “আর একটা বিস্কুট দাও না খাই”,কখনো বলে, “আজ দুষ্টু করেছি বলে মার দিয়েছে জানো?” আবার আমি যখন কোম্পানির বাগান পেরিয়ে শেয়ালের বাচ্চা দেখতে যাই,তখন টিপসি আমার পেছন পেছন যায়,পাছে কোনো বিপদে পড়ি। চাঁদনি রাতে শেয়ালনি তার বাচ্চাদের নিয়ে জোছনা পোহায়। টিপসি দূরে দাঁড়িয়ে দেখে, আর আমি ওদের কাছে গিয়ে একটু দেখেই চলে আসি।
এই তো সেদিন কী হল তবে বলি শোনো। ওমা! ভোরবেলায় চোখ খুলেই দেখি, দুই পোষ্য টিকটিকি,প্যাঁকাটি আর মনোহর ধুন্ধুমার ঝগড়া লাগিয়েছে। উপলক্ষ্য পেলমেটের উপর আমার রাখা গুটিকতক নকুলদানা। আমি কিনা ওদের ভাষা বুঝতে পারি,তাই শুনলাম,প্যাঁকাটি মনোহরকে বলছে,তুই কোন সাহসে দুটো নকুলদানা বেশি খেলি? জানিস,মা আমাদের রোজ সমান সমান ভাগ করে দেয়। এখন আমার সারাদিন খিদে পাবে। মনোহর খুব মাথা ঝাঁকিয়ে,লেজ নাড়িয়ে বলছে,বেশ করেছি, ওই তো প্যাঁকাটির মত শরীর, তোর্ বেশি নকুলদানা খেতে হবে নাlসুগার বাড়বে। আমি দেখলাম, ঘোর বিপদ। তখন আমি সুযোগ বুঝে দু’জনের থালাতে দুটো করে আরও নকুলদানা দিলাম। পষ্ট শুনলাম, প্যাঁকাটি বলছে, মানুষটা আমাদের ভাষাও বোঝে। থ্যাঙ্কইউ মাদার। আর মনোহর দু’পা জোড় করে গড় করতে গিয়ে –ধপ!
***
বেশ কিছুদিন হলো কাক্কেশ্বরের পাত্তা নেই। না, হ য ব র ল এর সেই বায়সবংশীয় দাঁড়িকুলীন নয়, এ হল যাকে বলে পোষা এক পাতিকাক। রান্নাঘরের জানালায় এসে বসে,রোজ সকাল সকাল। রান্নাঘরে ঢুকলেই গলা ফুলিয়ে যতটা পারে মিঠে এক স্বর বের করে আমাকে তোয়াজ করতেই থাকে যতক্ষণ না তাকে এক টুকরো পাউরুটি বা বিস্কুট দেব। তা সেদিন কী একটা কাজে যাচ্ছি,বাড়ির কাছের রাস্তায়, ও মা, অমনি দেখি কি একটা কাঁধে এসে বসল। হঠাৎ কাঁধের উপর খচমচ। কাক্কেশ্বর! কোথায় ছিলি রে বাছা আমার? কাক্কেশ্বর আমাকে প্রদক্ষিণ করে দু’বার উড়ে নিয়ে নোংরা ফেলা ঠেলাগাড়ির উপর বসল। আর রাস্তায় কাগজকুড়ানি মেয়েটি বলল, “অমা কাগে ছুঁয়েছে, তোমার ভারী অসুখ করবে দেখো অখন।” হোক গে। খুব খুশি হয়ে বাড়ি ফিরলাম। জানি,দুপুরে ভাত খেতে কাক্কেশ্বর আসবেই।
প্রিয় বন্ধুর তালিকায় এবার টফি,টাইফুন আর ইমো। টফি যেদিন বাড়িতে এল,একটা শেল্টার থেকে মানেওকে রীতিমতো উদ্ধার করে আনা হয়েছিল,তখন ওর অবস্থা ছিল বেজায় খারাপ। গলায় একটা নারকেল দড়ি দিয়ে খুব অযত্নে রাখা ছিল টফি। আমার ছেলে ওকে সেই যে গলা জড়িয়ে ধরল ঘরে না এনে ছাড়লই না। সে যাক তখন ছেলের ঠাম্মা টফিকে দেখে বলেছিলেন, “মে গো, এ কি কুকুর না ছাগলছানা!”
যা ইহোক,সেই টফি যত্নআত্তির জোরে কিছুটা কুকুরের মতন হল বৈকি। আর তার কয়েক মাস পরেই টাইফুন জুটে গেল ওর সঙ্গে। টাইফুন বেশ কেঁদো চেহারার একটি কালো কুচকুচে ল্যাব্রাডোর ছানা। সে অতি উচ্চ বংশের একসম্ভ্রান্ত বাচ্চা আর তার আদব কায়দা টফি সুলভ কিছু নয়। টফি বেশি চেঁচালেই সে বেজায় হাঁক পেড়ে তাকে বকে দেয়। বলে, “এই অসভ্য ছেলে, চোপ! আর একবার যদি চেঁচিয়েছিস,জানিস না আমাদের মা একজন ভদ্রমহিলা?”
আমি হাসি। টফি কুঁইকুঁই করে, “তা কী করব আমার যে চিল্লানো পাচ্ছে। আমি যে চিল্লানোসোরাস! মা বলেছেন।”
ইমোর ভারী দেমাক,ওর গায়ের রঙের জন্য। চকলেট রঙের ল্যাব্রাডোর কুকুর কম দেখা যায় বলেই। সে গলায় বাহারি হার পড়তে ভালোবাসে। আর আমি কোথাও থেকে বাড়ি ফিরলেই ইনিয়ে বিনিয়ে এই মর্মে চেঁচায়,তার চেঁচানির ধরণ শুনেই বোঝা যায়, “ওরে কেউ দরজাটা খুলে দে রে, ওই আমার মা এসেছে বাড়িতে রে, এতক্ষণ পর খেটেখুটে ফিরেছে রে, ওরে তোদের কি একটুও মায়া দয়া নেই রে!”
তাএ হেন ইমো আমার বাজারের ব্যাগ বয়ে বাড়ি নিয়ে আসে মুখে ধরে, তাই বলি, এমন বন্ধু ক’জনের থাকে গো ?
মনে পড়ে,ঠাম্মির বাড়িতে প্রতিদিন দুই দল খেতে আসত। বিকেলে বকবকম পায়রা আর রাতের বেলায় ভাম। পায়রাদের এখনো খাওয়াই নিয়ম করে। একটি পায়রা, গুলাবিলাল তার নাম,সে আমার হাত থেকে গম খায়, আর ডাকলেই কোত্থেকে উড়ে আসে। আমি তাকে সুখদুঃখের অনেক কথাই বলি। ভামেরা আসত রাতে,ঠাম্মির বাড়ির ভাঁড়ার ঘরের পেছনের দিকটায়। ঝুপঝুপ নামত ওরা আর পূর্ণিমার আলোয় ওদের দাঁত নখ ঝিকিয়ে উঠত দেখতাম। চুপটি করে জানালার খড়খড়ি টেনে ঠাম্মি আমাকে ভাম দেখাত। ওদের জন্যে ঠাম্মি কলাটা মুলোটা ফেলে রেখে দিত ছাদে। ওরা দু’চার জন টেনে নিয়ে যেত সঙ্গে। আমার এ-বাড়িতে ভাম এসেছিল কয়েকবার। মজা-কলা রেখেছিলাম জানলার পাড়ে, খায়নি। শুধু ধানি গন্ধ ছড়িয়ে গিয়েছিল সারা বাড়িতে আর ঠিক সেই সময়ে ঠাম্মিকে আর ঠাম্মির সেই ভাঁড়ার ঘরটিকে বড়ো বেশি মনে পড়েছিল আমার।
আর গুগলছানার গল্পগাছা বলে বলেও শেষ করা যায় না তাই শেষপাতে সেইসব মধুর গপ্পো একটুকুই বলি তোমাদের। গুগল যে দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো সার্চ ইঞ্জিন সে কে না জানে! আমাদের এই কুট্টি গুগুলও কিন্তু টক করে জিনিসপত্র খুঁজে এনে দিতে পারে। গুগল-এর ওই দুটো বড়ো ‘ও’-এর আকারে ওর গোল্লাপানা দুটি চোখ, তাই ওর নাম গুগল। ডাক্তারখানায় ওর নাম বলা হয়েছিল গুগল গাঙ্গুলী। অনুপ্রাসের ব্যবহারে যিনি খাতা লিখছিলেন তিনি একটু হেসে তাকালেন আমার কোলের দিকে। গুগল সাগ্রহে ওর সামনে হাতটি বাড়িয়ে দিল। এসব কেতা জানে ও। গেরেম্ভারি ভাব,মুখে সারা পৃথিবীর চিন্তা নিয়ে ছোট্ট বেঁটে খাটো গুর্খা দারোয়ানের ভঙ্গিতে বসে থাকে দরজার পাশে সারা বিশ্বের মিষ্টিতম ওই পাগ কুকুরটি। নাক চ্যাপ্টা চোখ গোলগোল ভীষণ গেরেম্ভারি চেহারা নিয়ে ও সকলের হাসির কারণ হয়ে ওঠে। হাসলে ও খুশিই হয়ে বটে,ঘাড় বেঁকিয়ে দেখে নেয় ঠিক ওর কায়দা কানুনে আমরা হাসলাম কিনা। এমন ভাব করে,যেন এই বাড়িটি ওরই, ও দয়া করে আমাদের একটু থাকতে দিয়েছে। এখন ওর শব্দকোষে অনেক বাংলা ইংরিজি শব্দ। প্রিয় গান – শিং নেই / তবু নাম তার সিংহ।
ওই দেখো,এতসব গল্প করতে করতে পোষা খরগোশ চরকি আর ফুলঝুরির কথা বলাই হলো না তোমাদের। সেসব না হয় অন্য কোনোদিন বলা যাবে। যাহোক, আশেপাশের দু’পেয়েদের ভিড়ে, চারপেয়েদের এই বন্ধুত্বপূর্ণ উপস্থিতি আমাকে ভালো থাকতে উৎসাহ জোগায়। প্রতিদিন যখন ভোরের আলো ফোটে, গুগুল বলে গুড মর্নিং, পায়রারা বলে সুপ্রভাত, কাক্কেশ্বর বলে দিনটা ভালো কাটুক আর মনোহর নমস্কার করতে গিয়েই ধপাস হয়!