মিঙ্কি, ফোন, অ্যালোফোন, ইংরিজি, অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল
মণিমেখলা মাইতি
নবনীতা দেব সেনের ‘বনলতার পুষ্যি’ গল্পটা পড়ার পর মনে হয়েছিল আহা আমারও একটা পুষ্যি থাকলে কী ভালো হত। লোকে বলত- মণিমেখলার পুষ্যি। সে আর ইহজন্মে হল না। নিজেই কেমন পুষ্যি হয়ে এ-জীবন কাটিয়ে দিলুম। আসলে পুষ্যি জিনিসটা আমাদের বাড়িতে একটু অচল। পুষ্যিকে সচল রাখার জন্য যে সমস্ত কার্যাবলির দরকার ছিল তা সম্পাদন করার মতো লোকের কিঞ্চিৎ অভাব ছিল আমার বাড়িতে। আমার দিদামণি (মায়ের কাকিমা) একবার খুব করে বায়না করেছিল, আমার মাতৃদেবীকে মামাবাড়িতে সদ্য জন্মানো একখানা নধর বাছুরছানা উপহার দেবেই। আমি ছোটো। মনশ্চক্ষে দেখেছিলুম সাদা বাছুরটি আমাদের বাগানে ম্যাজনাতে খড় আর জাউ খাচ্ছে। আমরা গলায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। গলায় একটা ছোট্ট ঘন্টা। গামলা গামলা দুধ উনুনে জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। বাবার হাতে রাবড়ির বাটি। বাগানের একদিকে খড়ের ঢিবি; যদিও সে খড় কোথা থেকে আসে স্বয়ং ব্রহ্মাই জানেন কারণ এক টুকরো জমিজমা নেই আমাদের। কলেজে যাওয়ার আগে পিতৃদেব দুটো খড় দিয়ে, সাইকেল নিয়ে ক্লাস নিতে যাচ্ছেন। ঘাটের কাছে গোবর ডাঁই করা। নারকেল গাছে ঘুঁটে মারা। হায় সেসব কল্পনাই থেকে গেল। আমার কর্মরতা মাতৃদেবী বলে বসল, “কাকীমা, ও আমার দ্বারা হবে না। আমার হাতে পড়লে তোমার ও বাছুর না খেতে পেয়েই মরে যাবে। ও আমায় দিও না।”
হয়ে গেল; সেই থেকেই বোধহয় আমার দুগ্ধ আর দুগ্ধজাত দ্রব্য ঠিক পেটে সয় না। ছোটোবেলায় দু’খানা ঘুঘু ভাড়াবাড়ির বারান্দার সামনে হলুদ-সবুজ পাতাওয়ালা পাতাবাহারের গাছে বাসা করেছিল। আমি ওদের দেখতাম আর বারান্দায় মাদুর বিছোনো খাটে পা দোলাতে দোলাতে দুধে রুটি ডুবিয়ে খেতাম। দুধ চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ত ছড়ার বইতে। বাচ্চা পাখিদুটোর মা কীসব কিচমিচ করে বলত তাদের সঙ্গে। আমার মা তখন ডিউটিতে। ওই ঘুঘুটিকেই পুষ্যি ভাবতুম যদিও তাদের চেহারা আমার দেখে ওঠা হয়নি কোনোদিন।
তবে সত্যি করে আমার আর ভাইয়ের একটা পুষ্যি এল এক সকালে। রথের মেলা চলছে। বাবা সকাল সকাল একটা খাঁচায় নিয়ে এল মিঙ্কিকে। মিষ্টি লাল রঙের ঠোঁট। আমরা ছোলা, জল দেই। সকাল হলে বাড়ির বাইরে বের করে দেই। আস্তাকুঁড়ের চারিদিকে ঘোরা বিড়ালিনী তাকে আড়চোখে দেখে। আমরা কথা শেখানোর চেষ্টা করি মিঙ্কিকে। দিনকয়েক চলল এমন। তারপর একদিন বাবা আমি ভাই মিলে খাঁচার গেট খুলে উড়িয়ে দিলাম তাকে। খাঁচার পাখি একছুটে নয়ানজুলির পাশে কলাগাছের ঝাড়ে বসে বনের পাখি হয়ে গেল। মুক্তি দিয়েছিলাম মিঙ্কিকে। আমাদের কী আনন্দ! খাঁচাটা কেউ বগলদাবা করে ফেলল।
একবার একটা বঙ্গজ কুকুর চারটে বাচ্চার জন্ম দিল আমাদের বাড়ির বাইরের রান্নাঘরে একটা পরিত্যক্ত ঝুড়ির মধ্যে। আমার মা ধবধবে সাদা বাচ্চাটার নাম রেখেছিল ‘ফোন’। তখন বাড়িতে বাড়িতে সবে ল্যান্ডফোনের কানেকশান হয়েছে। কিড়িং কিড়িং শব্দে চারিদিক সচকিত হয়ে উঠত যখন তখন। ফোন সারাদিন কোথায় না কোথায় কী করে বেড়াত। ঠিক সন্ধে হলে ফিরে আসত আমাদের রান্নাঘরে। পাহারাটাহারা বোধহয় বিশেষ দিত না কারণ দুটো পাকা আম ফোনের তত্ত্বাবধানে চুরি হয়ে গেল। ওসব সাধারণ কাজ ফোনের পোষাতো না। ফোনের কাজ ছিল বাড়ি বাড়ি ঘুরে গোয়েন্দাগিরি করা। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা লিঙ্গুইস্টিকস পড়ার অত্যুৎসাহে হাসাহাসি করে বলত যে ফোনের বাচ্চা হলে নাম রাখবি ‘অ্যালোফোন’। অ্যালোফোন হওয়ার পর ফোনও বাড়ির ল্যান্ডফোনের মত কোথায় হারিয়ে গেল যেন।
ইতিহাসের যেমন পুনরাবৃত্তি হয়, পুষ্যির পুনরাবৃত্তি হল। যখন মিষ্টিন অর্থাৎ আমার আত্মজ মাতৃজঠরে, দুটো ঘুঘু এসে বাসা বাঁধল ফ্ল্যাটবাড়ির এক চিলতে বারান্দার একখানা রঙের কৌটোয়। মিষ্টিন মাতৃজঠরে বাড়তে থাকে আর ঘুঘুর বাসায় বৃদ্ধি পেতে থাকে খড়কুটোর সংখ্যা। যত্ন করে তাদের চারিদিকে জাল ঘিরে দিল আত্মজর বাবা বিল্লির উৎপাত থেকে বাঁচাতে। লোকে বলল এ-বাবা, বাড়িতে ঘুঘুকে বাসা করতে দিও না। পাত্তা দিইনি আমরা। তারা ডিম পাড়ল, বাচ্চা ফুটল। আমার কোলে এল মিষ্টিন। ঘুঘু দুটোও বাসার চিহ্ন ছেড়ে একদিন চলে গেল বনের পাখি হয়ে।
কয়েকবছর পর হঠাৎ করে দেখি বারান্দার বাইরে পেয়ারা গাছের তলায় কে যেন মাটি খুঁড়েছে। ভাবলুম কেউ গুপ্তধনের সন্ধানে আছে। তক্কে তক্কে আছি। ও বাবা আবার এক বঙ্গজ নেড়ি। অন্তঃসত্ত্বা। কয়েকদিন পরেই কুঁইকুঁই। চারটে নধর কুকুরছানা, গাবদা গোবদা। মিষ্টিন ওদের নাম দিল – ইংরেজি, অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল। ও বাবা, তার মা তাদের খেতে দিতেই পারে না ঠিকমতো। তারা রোগা হয়ে যায়। আসরে অবতীর্ণ হল বাড়ির কর্তা। তো বাড়িতে যা যা রান্না হয় সব বরাদ্দ হয় ইংরেজি, অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোলের মায়ের জন্য। একটু বড়ো হতে দেখি তারাও পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলল একদিন। শুধু কৃতজ্ঞতা বশত ইংরেজি, অঙ্ক, ইতিহাস ও ভূগোল সবাইকে তাড়া করলেও আমাদের কিছু না বলে দিব্যি কথা শুনত।
তা এসব তো ঠিক পোষ্য হল না। আত্মজ বায়না ধরল তার পোষ্য চাই। হায়, সেই দিদার আর মাতৃদেবীর কথোপকথনটাই মনে পড়ে গেল। কী মুশকিল রে বাবা। মাতৃদেবীর মত কন্যাটিরও পোষ্যপ্রীতি কম। এদিকে ছেলে নাছোড়বান্দা। তাই এক আষাঢ়ের সকালে বাড়িতে চলে এল বদ্রি আর ককাটেইল। খাঁচা চলে এল আমাজন থেকে। তারা খায় দায়, শিস দেয়। রাতে বসার ঘরে ছেড়ে দিলে সারা ঘরময় ওড়াউড়ি করে, পালক ফেলে। তাদের পিতৃদেব আর দাদা এসবে উৎসাহ দেয় আর বিমাতা খালি খালি উঁকি মেরে দেখে। এর আবার ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। একটা চুরি হল। আর একটা এল। একটা মারা গেল, আর একটা এল। সে জোড়া থেকে জন্ম নিল তিনখানা ককাটেইল। হায় তাদের মাও তাদের খাওয়াতে পারে না। খালি কুঁই কুঁই করে। আবার আসরে নামল তাদের পিতৃদেব তথা বাড়ির কর্তা। বাজার থেকে চলে এল ড্রপার আর সেরেল্যাক। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকত তারা। অফিস থেকে ফিরলেই একবাটি সেরেল্যাক গোলা হত আর তারা গলা বাড়িয়ে বাড়িয়ে ড্রপারে দুধ খেত। বড় হতে তাদের লেজ ধরে টানলেও খ্যাঁক করত না, বিমাতার কাছেও চলে আসত। কিন্তু শ্রাবণের এক বিকেলে আমাদের অনুপস্থিতির সুযোগে কে যেন তাদের খাঁচা খুলে নিয়ে চলে গেল। বদ্রিদুটো আবারও সাক্ষী থেকে গেল।
জীবন থেমে থাকে না। বদ্রি দুটোর সঙ্গে এখনো দুটো ককাটেইল আছে। খায় দায়, কিচির মিচির করে আর রাতের বেলা কিছুক্ষণের জন্য ছাড়া পেলে আমাদের পেতলের ঝুলন্ত প্রদীপদানটির ওপর দুটো বসে নিভৃতে কী কথা যেন বলে। যথারীতি আমি উঁকি মেরে দেখি। বাড়ির কেউ টের পায় না যে আমারও মায়া মমতা আছে ওদের জন্য। সেরেল্যাকের প্যাকেটটা রাখা আছে যথাস্থানে।