মজাদার যত না-মানুষ বন্ধু – বিহুকা, জ্যাক ও হাইজি
নিবেদিতা ঘোষ
১। বিহুকা
“আরে, আরে, চললে কোথায় বিহুকা? তুমি না লক্ষ্মী মেয়ে! ছিঃ এমন দুষ্টুমি করে না।”
কে কার কথা শোনে! বিহুকা আপনমনে চলতে লাগল। একেবারে গহন জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ছে যে! কিছুতেই ওকে থামাতে পারছি না! পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে সুবীর, আর্য, রজার, এইফার, টম, অসোয়াল্ডো কাউকেই তো নজরে পড়ছে না। কী বিপদ!
চুঃ-চুঃ-চুঃ। টমের শিখিয়ে দেওয়া কৌশলে ওর সোনালি গায়ে হাত বুলিয়ে অনেক আদর করলাম। কিন্তু বিহুকার ভাবান্তর নেই। খটখটিয়ে খুরের আওয়াজ তুলে আমাজনের গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়ছে আমার ঘোড়া। যত ভেতরে ঢুকছি, সবুজ অন্ধকার আরো ঘন হয়ে ঘিরে ধরছে। জাগুয়ার কোথায় ওঁত পেতে আছে কে জানে!
একথা মনে হতেই শিরদাঁড়া বেয়ে হিম স্রোত নেমে গেল! বিহুকার লাগাম ধরে সজোরে টান দিলাম। কিন্তু বিহুকার গতি রোধে কার সাধ্যি! শরীর,মনের সব শক্তি জড়ো করে প্রাণপণ ডাক দিলাম,ট—ম, অ-সো-য়া-ল্ডো। খানিক বাদে অসোয়াল্ডোকে জঙ্গলে ঢুকতে দেখে ধড়ে প্রাণ এল। অসোয়াল্ডো ঘোড়াদের মূল সহিস। নিজের ঘোড়া থেকে খানিকটা ঝুঁকে বিহুকার কান ধরে টান দিয়ে বিহুকাকে থামাল। মৃদু ধমক দিল,“ডোন্ট বি নটি বিহুকা। ইউ আর আ গুড গার্ল ডিয়ার।”
ওমা, কেমন বাধ্য মেয়ের মত বিহুকা সেইখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে মাথা নিচু করে ঘাস খেতে লাগল, যতক্ষণ না বাকিরা এসে পড়ে। চলতে চলতে ঘন জঙ্গল পেরিয়ে খোলা মেঠো জমিতে এসে পড়লাম। মানুষ সমান লম্বা বিশাল বিশাল ইঁটরঙা উইঢিবি চারদিকে। এর মধ্যে দিয়ে ঘোড়ারা এগোবে কী করে? আমি ভাবছি বিহুকাকে চালনা করব কী ভাবে।
ওমা, কী আশ্চর্য! এঁকেবেঁকে উইঢিবিদের পাশ কাটিয়ে অদ্ভুত কৌশলে বিহুকা আমায় নিয়ে চলতে লাগল। তখন ও-ই আমার গাইড। বিহুকার পিঠ চাপড়ে আমি বাহবা দিতে দিতে চললাম। ট্যাপির, ক্যাপিবারা, জায়ান্ট অ্যান্টইটার, রিয়া– এমনতর সব অদ্ভুতদর্শন প্রাণী দেখতে দেখতে এগোচ্ছি। ওদিকে আবার মাথার ওপর দিয়ে ক্যাঁ ক্যাঁ করতে করতে পঞ্চভূজ সজ্জায় উড়ে গেল হায়াসিন্থ ম্যাকাও পাখি। পিলে চমকে উঠল। কী কর্কশ ডাক! কচুরিপানার ফুলের মত নীল। পান্তানালের আইকন বার্ড। এ পাখি আবার পান্তানাল ছাড়া আর কোথাও নেই বিশ্বে। কাকে ছেড়ে কাকে দেখি! বিহুকা কিন্তু এখন ভারি লক্ষ্মী। লাগাম ধরে একটু টান দিলেই কেমন আমার কথা শুনছে। দাঁড়িয়ে পড়ছে। প্রাণীটাকে ভালভাবে দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে আমাকে। এমনকি ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে আমায় ছবি তোলার সময়টুকু পর্যন্ত দিচ্ছে! বিহুকার ব্যবহারে আমি অভিভূত!
হঠাৎ দেখি রজারের ঘোড়া আমার বিহুকার প্রায় গা ঘেঁষে ঘেঁষে চলেছে। দু’জনে আবার মাঝে মাঝে মুখে মুখ লাগিয়ে আদর করে নিচ্ছে। বিকেলের এই মন-কেমন আলোয় পরস্পরের প্রতি প্রেম জেগে উঠেছে বোধহয়। এত কাছে কাছে চলেছে দু’জনে, যে রজারের সঙ্গে আমার হাঁটুর ঠোকাঠুকি লেগে যাচ্ছে।
রজার অনেক চেষ্টা করল হ্যাট হ্যাট করে ওর ঘোড়াকে সরিয়ে নিয়ে যেতে। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে অপ্রস্তুত হাসি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখছ তো,আমি কিন্তু ইচ্ছে করে তোমার গা ঘেঁষে চলছি না।”
দু’জনেই হো হো করে হেসে উঠলাম। অসোয়াল্ডো একটু দূর থেকে ডাকছে শুনতে পেলাম,লুক লুক,জায়ান্ট আর্মাডিলো। রজার তার ঘোড়া হাঁকিয়ে চলে গেল। উত্তেজিত হয়ে আমি বিহুকার লাগাম ধরে টানাটানি শুরু করলাম সামনের দিকে এগোবো বলে। কিন্তু ও নট নড়নচড়ন! মাথা নীচু করে ঘাস খেয়েই চলেছে। ওর ভাবগতিক বোঝা ভার।
ঠিক এখনি তোকে ঘাস খাওয়া শুরু করতে হল? বিহুকা, চল, মানিক আমার। এ যে আর্মাডিলো! সত্যজিত-এর গল্পে পড়া। আমার কতদিনের স্বপ্ন! আর্মাডিলো দেখার সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়,বল? আর কি কখনো এখানে আসতে পারব? চল, সোনা আমার, বিহুকা আমার।
আমার কাকুতি-মিনতিতে বিহুকার হৃদয় গলল। ঘাস খাওয়া থামিয়ে জোরকদমে এগোতে লাগল সামনের দিকে। ওহ,বাঁচালি বাবা! সবুজ ঘাসজমি পেরিয়ে খোলা মাঠ। কিছুটা যেতেই দেখি রজার আর এইফার প্রবল বেগে ঘোড়া ছোটাচ্ছে। ওদের ডাচ রক্ত জেগে উঠেছে। তাই দেখে আমার বারো বছরের ছেলে আর্য টমের কাছে বায়না ধরেছে,ঘোড়া ছোটাও। সামনের তিনটে ঘোড়াকে ছুটতে দেখে বিহুকার মত লক্ষ্মী মেয়েরও রক্ত গরম হয়ে উঠল। সে-ও অমনি চার-পা তুলে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটতে শুরু করল। এ কী বিষম বিপদ উপস্থিত হল! আমি প্রাণপণে লাগাম টেনেও ওকে থামাতে পারছি না। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে ছুটন্ত বিহুকা থেকে সজোরে ছিটকে পড়ব।
শক্ত করে ওর পিঠ আঁকড়ে ধরে মনে বল আনার চেষ্টা করতে লাগলাম। রাজকন্যেরাও তো কেমন মাথায় হ্যাট পড়ে টগবগ করে ঘোড়া ছুটিয়ে যায়,ফিল্মে দেখি! কী স্মার্ট লাগে দেখতে! আমার মাথায়ও তো টমবয় হ্যাট। আমাকে নিশ্চয়ই কোনো রাজকন্যের মত দেখতে লাগছে।
নাঃ সব চেষ্টা বৃথা! মনকে কিছুতেই বশে রাখতে পারছি না। মনে হচ্ছে এই উদ্দাম ছোটায় প্রাণটা যে কোনো মুহূর্তে ধড় ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। ছুটতে ছুটতে “পান্তানাল পিউভাল পৌসাদা”লজের সামনে এসে পড়েছি।
বিহুকা গতি কমাচ্ছে– গ্যালপ – ক্যান্টার– ট্রট– ওয়াক। বিহুকা থামল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম!
২। জ্যাক
আর একবার গেছি বোর্নিওর জঙ্গলে। কাকভোরে চোখ খুলেই নৌকায় নেমে পড়েছি। কিনাবাটাঙ্গান নদী বেয়ে পৌঁছব অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদে। জন বলেছেন, হ্রদের চারপাশে উঁচু উঁচু ডুমুর গাছে ওরাং-এর বাসা। বুনো ওরাং উটান। এখানে এসেই তো জানলাম, “ওরাং”কিন্তু “ওটাং”নয়, ওর পদবী “উটান”। মালয় ভাষায় “Orang”মানে মানুষ, আর “Utan”হল জঙ্গল।
ঘন কুয়াশার পর্দা সরিয়ে সরিয়ে এগোচ্ছি আমরা। পাখ-পাখালি হাঁকডাক শুরু করেছে। হর্নবিলের ওড়াউড়ি, নাকঝোলা প্রোবোসিস বাঁদরদের গাছে গাছে দাপাদাপি দেখতে দেখতে ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ কখন গোলগোল হয়ে গেছে! আমাদের ভাগ্য ভাল পাশে পেয়েছি পতঙ্গ বিশেষজ্ঞ জন নায়ার রাজনকে,আমাদের গাইড।
হঠাৎ একটা গাছের ডালে প্রবল আলোড়ন উঠল। ও মা গো,বাইনোকুলার চোখে ঠেকিয়ে দেখি গাছের মগডালে ঝুপসি বাসায় একটা ওরাং ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙছে! আশেপাশের গাছবাড়িতে আরো আরো ওরাং। কিন্তু খুব স্পষ্টভাবে এদের ক্রিয়াকলাপ তো দেখাই যাচ্ছে না!
“তোমরা খুব কাছ থেকে দেখতে চাও?”
“আলবাত!”
“ভয় পাবে না তো?”
বীরদর্পে জনকে বলি,“আদৌ না। দেখি বন্ধুত্ব করা যায় কিনা!” শুনেছি ওরাং-দের সঙ্গে হোমো সেপিয়ানসের ৯৬ শতাংশ জেনেটিক মিল। নিশ্চয়ই আমার ভাষা বুঝবে কিছুটা।
“বেশ, চল তাহলে পোরিং স্যাংচুয়ারিতে যাওয়া যাক। ওখানে জ্যাক আছে। ওর সঙ্গে ভাব পাতিয়ে দেখতে পার।”
স্যাংচুয়ারির ডিরেক্টর সাহেব জন-এর বিশেষ বন্ধু। তাই ভেতরে ঢোকার ছাড়পত্র মিলল। পর্যটকদের এখানে প্রবেশের অনুমতি নেই। জ্যাকের জাতভাই আরো কয়েকজন এখানে থাকে। ওদের জন্য একটা ঘেরা জায়গা করা আছে। সেখানে ওদের খেতে দেওয়া হয়। মর্জি হলে ওরা এই ঘেরা জায়গায় মাঝে মাঝে আসে। কয়েকদিন ধরে নাকি জ্যাকের আনাগোনা বেড়েছে।
ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়েই চলেছে। এখানে ডিসেম্বরে বৃষ্টি পড়ে। পরিযায়ী পাখির দল ভিড় জমায়। কিনাবাটাঙ্গান-এর সরু সরু শাখাগুলো জলে ভরে ওঠে। না হলে তো অক্স-বো লেক পর্যন্ত পৌঁছনোই যেত না! ওরাং-দের আস্তানার কাছে। জন তাই আমাদের ক্রিসমাসের সময় এখানে আসতে বলেছিলেন।
আমরা অপেক্ষা করছি পথ চেয়ে আর কাল গুনে। কখন তার দেখা মেলে! উত্তেজনায় তিরতির করে কাঁপছি। জ্যাকের ব্রেকফাস্টের জন্য ডুমুর, দুরিয়ান, কলা, রামবুতান সব মজুত। দুরিয়ান আর রামবুতান ফল সম্বন্ধে জন-এর কাছ থেকে ফান্ডা নিচ্ছি, দেখি দূরের জঙ্গল থেকে গাছের ডাল চার হাত-পায়ে ধরে ঝুলতে ঝুলতে তিনি হাজির। সোনালি,রোমশ বিশাল প্রাণীটা। ওরে বাবা,দেখেই কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। এর সঙ্গে ভাব জমানোর জন্য সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারব তো? জ্যাক এসে হাঁটু ছাপানো লম্বা হাতের গোটানো আঙুলগুলো খুলে ফলের খোসা ছাড়িয়ে জমিয়ে ব্রেকফাস্ট সারতে লাগল।
আমরা একটু দূর থেকেই ওর হাবভাব লক্ষ করছি। শিম্পাঞ্জির চেয়ে আকারে বড়ো, গরিলাদের তুলনায় ছোটো। খাওয়া শেষ করে দেখি পাশের গাছের ডাল থেকে কলাপাতার সাইজের একটা পাতা ছিঁড়ে এনে ছাতার মতো মাথায় দিয়ে বসল। বৃষ্টি পড়েই চলেছে যে! এ তো মানুষে বুদ্ধি। হবেই তো,মানুষের জাতভাই কিনা! তারপর দেখি তরতর করে আবার গাছে উঠে পড়ল। ছোটো একটা ফাঁপা ডাল নিয়ে গাছের একটা ফোকরে ঢুকিয়ে দিল। মুখটা ছুঁচলো করে ওই ফাঁপা ডালের স্ট্র দিয়ে সুড়ুত সুড়ুত করে পিঁপড়ে,পোকামাকড় টেনে বের করে আয়েস করে খেতে লাগল। মুখশুদ্ধি যেন!
ওমা,আমাদের মাথায় বৃষ্টির মত কি সব কাঠকুটো পড়ছে! জন তাড়াতাড়ি আমাদের টেনে সরিয়ে আনলেন। গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জ্যাকই ওসব ফেলছে আমাদের মাথায়। “হলদে সবুজ ওরাং ওটাং” ইট পাটকেল ছুঁড়ছে মাথায়! আচ্ছা দুষ্টুবুদ্ধি তো! মানুষেরই জাতভাই কিনা! প্রতি পদে তার প্রমাণ দিচ্ছে। আবার আমাদের সরে যেতে দেখে গাছ থেকে নেমে আসছে। ডাল ভেঙে তাক করে ফেলার মাথা পাচ্ছে না যে! রামবিচ্ছু একেবারে! জন বললেন মহিলারা নাকি ওর চক্ষুশূল! এই মরেছে! তাহলে বোধহয় আমার মাথাতেই তাক করছিল।
জন,সুবীর আর আর্য ওর দিকে এগিয়ে গেল,কাছ থেকে ওকে দেখবে বলে। আমার বাপু অতটা সাহস হল না! মহিলা দেখে যদি তেড়ে আসে! দূর থেকে দেখব বলে অন্য একটা জায়গায় উঠে জ্যাককে খুঁজছি,হঠাৎ দেখি থপ থপ করতে করতে সে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। হাঁটার সময় পায়ের আঙুলগুলো মুড়ে একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটছে। ওরে বাবা, এ যে দেখি আমার কাছে এসে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল!
আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া!। স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে আছি,পালিয়ে যাবার শক্তিটুকুও লোপাট। রেগেমেগে যদি কোলের ওপর লাফিয়ে পড়ে তো ওর দেড়শো কিলোর চাপে এখানেই ভবলীলা সাঙ্গ। জটায়ুর মত কানের কাছে “হরিবোল, হরিবোল” নামগান শুনতে পেলাম। হরিবল অবস্থা! সুবীরের মুখ ফ্যাকাশে। জন নীচু গলায় বলতে লাগলেন,“গেট রিল্যাক্সড। ডোন্ট গেট নার্ভাস।”
জ্যাক আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। আলাপ করতে চাইছে নাকি? ঠোঁটদুটো নেড়ে কী সব বিড়বিড় করছে। এদিকে তো বীরাঙ্গনার সব দর্প চূর্ণ! জনকে বড়ো মুখ করে বলেছিলাম,জ্যাকের সঙ্গে আলাপ করব। এখন জ্যাক নিজেই যেচে আমার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছে! ওকে সামনাসামনি দেখে সাহসের বেলুন চুপসে একেবারে নেতিয়ে পড়ল। ওরে বাবা,দাঁত কিড়মিড় করছে নাকি? হাতের গোটানো আঙুলগুলো খুলে একবার মাথা চুলকে নিল। ফোঁস ফোঁস করে দুবার নিঃশ্বাস ফিলল। ভাবখানা যেন,এই তোর সাহসের বহর? চওড়া ঠোঁটদুটো ছড়িয়ে কান এঁটো করা এক হাসি দিল। উপহাস করল নাকি আমায়? দেখে ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল। তারপর মাথায় একবার হাত ঠেকিয়ে আমার পাশ কাটিয়ে ধীরে ধীরে ওই বিশাল শরীরটা টেনে নিয়ে চলতে লাগল। পাশ দিয়ে যাবার সময় হুম হুম করে একটা জান্তব আওয়াজ করল। যেন আমায় বলে গেল,“ঝুম্পা লাগি” … আবার দেখা হবে!
৩। হাইজি
“এবার তোমাদের বলব হাইজি-র গল্প।”
“সে আবার কে?”
“এক মিষ্টি সাদা-কালো জায়ান্ট পান্ডা।”
“সে কী করে তোমার পুষ্যি হল? পান্ডা রাজা-রাজরাদের পুষ্যি হতে পারে,অথবা চিড়িয়াখানায় থাকতে পারে।”
“না, ঠিক পুষ্যি বলা যায় না, তবে সারাটা দিন আমরা তার দেখভাল করেছি। তাতেই তার সঙ্গে আমাদের কিছুটা দহরম মহরম হয়েছে।”
“বটে? তা কোথায় তার দেখভাল করলে? জঙ্গলে? কে তোমাদের অনুমতি দিল?”
“ঠিক ঠিক, খুব সঙ্গত প্রশ্ন। আমরা একবার চিনদেশে গিয়ে বুনো জায়ান্ট পান্ডা দেখার আবদার ধরেছিলাম। চায়না হাইলাইটস ভ্রমণ সংস্থার রবার্ট হুই জানালেন, জঙ্গলে পর্যটকদের নিয়ে যাওয়ার অনুমতি নেই। তবে আমরা চাইলে পান্ডা সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠানে একদিনের জন্য ভলান্টিয়ার হিসেবে যোগ দিতে পারি।”
“কোথায় আছে সেসব?”
“চিনের অনেক প্রদেশেই এমন সংরক্ষণ কেন্দ্র আছে। জায়ান্ট পান্ডা তো খুব বিপন্ন প্রজাতি, তাই চিন সরকার তাদের সংরক্ষণের ওপর খুব জোর দিয়েছে।”
“বুনো পান্ডারা চিনদেশের কোন জঙ্গলে থাকে?”
“সিচুয়ান, শ্যাংসি আর গ্যানস প্রদেশের জঙ্গুলে পাহাড়ে জায়ান্ট পান্ডাদের ঘরবাড়ি। নেকড়ে আর স্নো লেপার্ডের আক্রমণে বেচারা এই অলস প্রাণীগুলো প্রায়ই মারা পড়ে। তাই এদের সংরক্ষণ খুব জরুরি।”
“তা তোমরা কোন সংরক্ষণ কেন্দ্রে ভলান্টিয়ার হলে?”
“আমরা শ্যাংসি প্রদেশের দুজিয়াংগ্যান সংরক্ষণ কেন্দ্রে সারাদিন পান্ডাদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম।”
“কী কী করলে? বল, বল। আর সবুর সয় না যে!”
“বলছি বাপু, বলছি। পান্ডারা তো সকাল ন”টায় জলখাবার খায়, ছাংদু শহর থেকে তাই সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে সাড়ে আটটার মধ্যে কেন্দ্রে পৌঁছে গেছি। সঙ্গে আছে আমাদের গাইড ফ্যাং ফ্যাং। কেন্দ্রের অফিসে জাবদা খাতায় সই করে ভলান্টিয়ারের পোশাক আর দস্তানা পরে নিতে হল। বিশাল কেন্দ্র। বিরাট বিরাট ঘেরা জায়গায় পান্ডারা দুলকি চালে ঘোরাফেরা করে। সেখানে বড়ো বড়ো মাচা তৈরি করা আছে যাতে ওরা ডিগবাজি-টিগবাজি খেতে পারে। আবার ওদের খাঁচাও আছে। নির্দেশক ওয়াং ইং আমাদের তিনজনের হাতে কতগুলো বাঁশ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “তোমরা হাইজির ব্রেকফাস্ট তৈরি করো।”
“বাঁশ-ব্রেকফাস্ট? বেশ মজার তো? বাঁশ নিয়ে তোমরা কী করলে?”
“পান্ডাদের বাঁশ দেওয়া কিন্তু মোটেও সহজ কাজ নয়। কাঁচা, সবুজ বাঁশ মাটিতে আছড়ে আছড়ে ফালাফালা করতে হল। সে বেশ পরিশ্রমের কাজ। সেই টুকরো টুকরো বাঁশ হাইজির ঘেরা জায়গায় রেখে এলাম। শীতের দুপুরে আয়েস করে বসে আখ খাওয়ার মতো করে হাইজি পা ছড়িয়ে বসে ছিঁড়ে ছিঁড়ে বাঁশের নরম অংশ চিবোতে লাগল। ওমা, খেতে খেতে একেবারে আধশোওয়া হয়ে পড়ল। কী মজাদার লাগছে দেখতে!
“হাইজি খেতে থাকুক, ততক্ষণে আমরা ওর খাঁচা ভালো করে জল দিয়ে ধুয়ে লম্বা ন্যাতা দিয়ে শুকনো করে মুছে নিলাম।”
“তারপর?”
“হাইজির কাজ সেরে আমরা পান্ডাদের পাড়া বেড়াতে বেরোলাম। পাশেই কিশোর ঝাও ইয়ানের আস্তানা। খাড়া খাড়া কালো ভেলভেটের মতো কানদুটো। দু’চোখের চারপাশে কালো গোল রিং। কালো ভেলভেটে মোড়া হাত-পা। গলার নীচ থেকে ঘাড়ের ওপর যেন গিঁট দিয়ে বাঁধা কালো মিশমিশে স্কার্ফ। বাকি শরীরটা ধবধবে সাদা উলে মোড়া। ঠিক যেমনটি দেখতে পাও সফট টয়ের দোকানে। এমন মজাদার প্রাণী দেখলে কার না আদর করতে ইচ্ছে করে, বল?”
“বটেই তো। তোমরা বেশ করে চটকান দিয়ে এসেছ তো ওদের?”
“না না, ওদের অত কাছে যেতে দেয় না মোটেও। কেবল ওখানকার কর্মীরা যেতে পারেন। কেন্দ্রের কর্মীদের ওরা চেনে। ওঁদের আদর-যত্নে বুনো পান্ডারা পোষ মেনেছে। কিন্তু হঠাৎ অচেনা লোক ওদের খুব কাছে চলে গেলে ওরা বিরক্ত হতে পারে। ভয় পেয়ে আক্রমণও করতে পারে। তাই ওদের বেশি কাছে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে আমরা নিজে হাতে করে হাইজিকে খাইয়েছি।”
“সারাদিন হাইজিকে বাঁশ দিয়ে গেলে?”
“হেঁ হেঁ হেঁ! কী যে বলো? তা কি করা যায়? পান্ডা কেকও তো খাওয়ালাম ওকে।”
“পান্ডা কেক? তোমরা ওর জন্য কিনে নিয়ে গিয়েছিলে বুঝি?”
“না না, একেবারেই না। বাইরের কোনও জিনিস ওদের খাওয়ানো চলে না। কেন্দ্রে পান্ডাদের ডায়েট মাপা আছে।”
“তবে? তোমরা পান্ডা কেক বানালে?”
“ঠিক। পান্ডাদের রান্নাঘরে পান্ডা কেক বেক করা হয়।”
“কেক তৈরি করতে তো সময় লাগে। তোমরা তাহলে রান্নাঘরেই বেশিক্ষণ সময় কাটালে, বল?”
“তা কেন হতে যাবে? সেদিনের কেক তো তৈরি করাই ছিল। ঠিক ঠিক মাপে আমরা চাল,চিনি, ভুট্টা আর ডিমের মিশ্রণে একটা মন্ড তৈরি করলাম,পরের দিনের জন্য। ইং মন্ডটাকে ছ”টা ভাগ করে বললেন, তোমরা যেমন খুশি আকৃতি দাও। এই শুনে আমরা খুব মজা পেয়ে গেলাম। এক একটা মন্ড দিয়ে কোনওটা পুতুল, কোনওটা কলা,কোনওটা হাতি বানাতে লাগলাম। যেন মাটি দিয়ে জিনিস গড়ছি। একটা দিয়ে আর্য আবার ছানা পান্ডা বানালো। ইং আমাদের কান্ড দেখে হো হো করে হাসছেন। আমি ভাবছি,কাল যখন হাইজি এই কিম্ভুতকিমাকার কেকগুলো খাবে ও কেমন মুখভঙ্গি করবে! ঠিক বুঝতে পারবে,ওই গুণধর লোকগুলোরই হাতের কাজ এগুলো।”
“সত্যিই তো। তারপর কী করলে?”
“ওগুলোকে স্টিম করতে দিয়ে আমরা হাইজিকে কেক খাওয়াতে গেলাম। হাইজি দেখি খাঁচার ভেতর অস্থিরভাবে ঘোরাঘুরি করছে। ওর কেক খাওয়ার সময় হয়ে গেছে যে! কেক খেতে হাইজি বড্ড ভালবাসে। শুকনো বাঁশ চিবিয়ে চিবিয়ে বেচারার মুখে কড়া পড়ে গেছে কিনা! কী সুস্বাদু! কী নরম! মুখে দিলে গলে যায়! আহা-রে কী পুষ্টি!
তাছাড়া এই খাবারটা খাওয়ার পর অনেকক্ষণ পেটটা ভর্তি থাকে। শরীরে যেন বল পায়। রাতে ভাল ঘুম হয়। এই মানুষগুলোকে ও তাই এত ভালবাসে।”
“বাঁশের টুকরোগুলো তো ওর ঘেরা জায়গায় রেখে এসেছিলে, সে তবু একরকম। কেকটা ওকে কেমনভাবে খাওয়ালে? ভয় লাগলো না?”
“লাগবে না? ইং-এর হাতে স্টিলের ট্রে-তে বড়োবড়ো ছ”টা কেক। দেখে হাইজি উৎসুক হয়ে উঠল। একটা কেক হাতে নিয়ে ভয়ে ভয়ে ওর দিকে এগোচ্ছি। হাইজির এত কাছে এর আগে যাইনি। ওর যেন আর তর সয় না। এক হাত বাড়িয়ে আমার হাতটা ধরল। লম্বা লম্বা নোংরা নখ। আমার গা শিরশির করে উঠল! অন্য হাত দিয়ে কেকটা নিয়ে নিল। খেতে খেতে আহ্লাদে হাইজির চোখ বুজে আসছে। চাকুম চুকুম করে খাচ্ছে।”
“রোমহর্ষক ব্যাপার! তারপর?”
“আমার তো বেশ নার্ভাস লাগছে। ইং বললেন,ভয়ের কিছু নেই। সারাদিনে ও তোমাদের চিনে গেছে। ওর খাওয়া শেষ হলে সঙ্গে সঙ্গে আর একটা দাও। এবার হাতে না দিয়ে ওর মুখে ঢুকিয়ে দিও।”
“বলে কী? যদি কামড়ে দেয়?”
“সেই তো বলে কে! এ তো আরও কঠিন কাজ। আমার পেটের ভেতরটা কেমন গুড়গুড় করতে লাগল। ইং-এর স্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে সাহস সঞ্চয় করলাম। আগের কেকটা শেষ হতে না হতে কাঁপতে কাঁপতে হাইজির দিকে এগিয়ে গেলাম। হাইজি চোখ খুলেছে। আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাড়াতাড়ি একটা কেক ওর মুখের কাছে নিয়ে গেলাম। বিরাট হাঁ করে কেকটা মুখে ঢুকিয়ে নিল হাইজি। ওর হাঁ মুখে ছ্যাতলা পড়া ধারালো দাঁত। মুখেরটা খেতে খেতেই আবার হাত বাড়াচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি আরও দু”টো কেক ওর দু”হাতে ধরিয়ে দিলাম। নে বাবা,খা। কিছুক্ষণের জন্য অন্তত নিশ্চিন্ত। চারটে কেক একদমে খেয়ে কিছুটা দম নিল হাইজি। এখন ও অনেকটা শান্ত। অস্থিরতা নেই। পেট খানিকটা ভরে এসেছে নিশ্চয়ই।”
“বাকি কেক দুটো?”
“বাকি দুটোও ভারি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করল হাইজি। তারপর ঠোঁট চেটে কৃতজ্ঞ চোখে চেয়ে রইল আমার দিকে। মায়াময় চোখ দুটি। এখন হাইজিকে অনেকটা দোকানের সফট টয়ের মত দেখতে লাগছে। খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে ওকে। সাহস করে খাঁচার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে শান্ত হাইজির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। আরামে চোখদুটো বুজে এল ওর। এমন তৃপ্তি অনেক দিন পাইনি!”
অদ্ভূত অভিজ্ঞতা, যেন স্বপ্ন।
LikeLike
The write up is so alive that I could see you in Amazon or Borneo or China like a movie . The bonds you created and experienced with unknown and wild animals is a rare experience . Lucky you.
LikeLike
“joydeep22”-র মন্তব্যের বাংলা ভাষান্তরঃ “লেখাটা এত জীবন্ত যে আমি যেন চোখের সামনে তোমাকে আমাজন, বোর্নিও বা চিনদেশে দেখতে পেলাম, ঠিক যেন সিনেমার মত। অজানা কিংবা বন্য প্রাণীদের সঙ্গে তুমি যে সম্পর্ক গড়েছ তা এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। তুমি সৌভাগ্যবান।
LikeLike
কল্পনা না।সত্যি আর জীবন্ত ।তোমার লেখনীতে আরো জীবন্ত । জীবনের মত জীবন্ত ।আরো লেখো।শুভেচ্ছা জানবে।
LikeLike