ঔপন্যাসিকা ভয়াল দেবতার মন্দিরে কর্ণ শীল শীত ২০১৯

কর্ণ শীল

এক

নিত্য দু’পা এগোয়, থমকে দাঁড়িয়ে কী যেন দেখে, আবার দু’পা এগোয়। ভয় পাওয়া তার অনেক দেখেছি আমি, নির্বুদ্ধিতার পরিচয়ও। কিন্তু এমন নিশ্চুপ মনমরা ভয় আমি কোনোদিন দেখিনি তার মধ্যে। আর সত্যি কথা বলতে কী জায়গাটায় এসে অবধি আমারও মনের মধ্যে কেমন যেন একটা দুঃসহ বোঝা, কেমন একটা দম আটকানো অনুভূতি হচ্ছে। সে অবস্থা ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়। গাছপালা ঘেরা উপত্যকার কোনও কোণ থেকে বা সামনের বিরাট বৌদ্ধমন্দিরের জানালা থেকে কোনও বিদেহী আমাদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে এ অনুভূতি হত না। আমার যেন মনে হচ্ছে সমস্ত পাহাড়, শৃঙ্গ, বন, উপত্যকা জুড়ে এক অমানুষিক উপস্থিতি ধীরে ধীরে আমাদের পেয়ে বসছে গ্রাস করছে।

নিত্য বলে উঠল, “পটাশ, মন্দিরে কেউ নেই রে? কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছি না।”

আমি বললাম, “আছে নিশ্চয়ই, নইলে চারদিক এমন ঝকঝকে পরিষ্কার হত না।”

নিত্য আর আমি গুটি গুটি পায়ে সামান্য খাড়াই পথে গুম্ফার দিকে এগিয়ে চললাম। শন শন করে একটা শীতল হাওয়া বইছে। গুম্ফার চূড়া দূর থেকেই দেখা গিয়েছিল। ঢালের নিচটায় পৌঁছনোর পর সেটি সম্পূর্ণ ঢেকে গিয়েছিল। ওপরে উঠতে উঠতে আবার সেটির চূড়া ও বাকি অংশ দৃশ্যমান হতে লাগল। আবছা অন্ধকার নামছে পাহাড় জুড়ে। গুম্ফার বাইরে কোনও আলো নেই। কিন্তু রঙচঙে জানালা ও খোলা দরজার দিকে তাকালে বোঝা যায় ভেতরে আলো জ্বলছে। দিনের শেষ আলো গুম্ফার সোনালি চূড়া থেকে রঙটুকু শুষে নিয়ে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হচ্ছে।

মঠ প্রাঙ্গণে বাইরে বনভূমির পাইন গাছের নিচগুলো ঠাণ্ডা হয়ে এল। বরফের মতো ঠাণ্ডা। পাথুরে মাটিতে আমাদের পায়ের শব্দ উঠছে আর সেই শব্দ মাঝে মাঝে ঢেকে দিচ্ছে কনকনে হাওয়া আর ক্ষণিকের তুষারপাত। একটা ফাঁকা মালভূমির মতো পাথুরে সমতলে গুম্ফাটা দাঁড়িয়ে আছে তার বিশাল আকৃতি নিয়ে। আশ্চর্য ব্যাপার হল, চারদিকে এত গাছপালা থাকা সত্ত্বেও গুম্ফা প্রাঙ্গণে একটাও গাছ নেই। অনুচ্চ প্রাচীর। খুব একটা যে সুরক্ষিত এ গুম্ফা নয়, তা এই হেলাফেলা করে তৈরি প্রাচীর দেখেই বোঝা যায়।

প্রাচীরের মাঝে মাঝে ভাঙা অথবা তৈরিই হয়নি। গুম্ফায় শুনেছি দুষ্প্রাপ্য পুঁথি, দামী অলঙ্কার বসানো অস্ত্রশস্ত্র, পাত্র, গয়না ইত্যাদি থাকে। আর এদিকে খামফা দস্যুদের যেমন অত্যাচার, যখন তখন আক্রমণ করতেই পারে তারা। নিত্যকে সেকথা বলাতে খুব একটা উচ্চবাচ্য করল না সে। শুধু বিড়বিড় করে বলল, “তেমন বোধহয় হয় না।”

আমরা এখন গুম্ফার প্রধান দরজার একদম সামনে। এখন বোধহয় বন্দনার সময় নয়। তাই চারদিক থমথমে। শুধু কড়া তিব্বতী ধূপের গন্ধ জানান দিল আমরা পৌঁছে গেছি। সারি মোমবাতি আর প্রদীপ জ্বলছে। লোডশেডিং চলছে হয়তো বা এদিকটায় হয়তো ইলেকট্রিসিটিই নেই।

লাল হলুদ পোশাক পরা একজন খুব বুড়োমতো মানুষ এগিয়ে এসেছেন। ছোটো ছোটো হাসি হাসি চোখ। নমস্কারের মুদ্রায় হাতদুটো উঠে এল। আমরাও প্রতিনমস্কার করলাম। বিশুদ্ধ ইংরেজিতে বললেন, “ট্যুরিস্ট?”

নিত্য একগাল হেসে বলল, “পার্শিয়ালি।”

বৃদ্ধও হেসে বললেন, “আর কী চাইতে পারেন ভিক্ষুদের কাছে?”

“কেন, আলো?”

বৃদ্ধের মুখটা শুকিয়ে গেল। একটু ঝুঁকেও পড়লেন যেন। হাতদুটো ঝুলে পড়ল। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে বললেন, “আসুন ভদ্র, নিজেরাই তবে খুঁজে নিন আলো বা অন্ধকার। সামায়ে মন্দিরে আপনাদের স্বাগতম।”

এই প্রায়ান্ধকার গুম্ফা, হিমালয়ের নিশ্চুপ রহস্যময় রাতে আমাদের আগমন, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর দ্বিধা, এর মধ্যে আমাকে পড়তে হত না নিত্য দীর্ঘ পনেরো বছর পর ইউরোপ থেকে ফিরে না এলে। বড়ো জ্যাঠামশাই মারা গেছেন বছর দুয়েক আগে। নিত্যকে আমরা সে খবর দিতেও পারিনি, এতটাই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল আমাদের সঙ্গে। নিত্যের একগাল দাড়ি, শীর্ণ মুখ, জ্বলজ্বলে চোখ দেখে প্রথমে আমরা চিনতেই পারিনি। শেষে ছোটো খুড়ির থাপ্পড় খেয়ে নিত্য হেসে ফেলতেই তাকে আমরা চিনে ফেললুম। ছোটো খুড়ি প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বললেন, “বাড়িতে বাপ-মা-খুড়োরা রয়েছেন, মনে থাকে না? আমার কথা ভাবতে হবে না, বাপ-মায়ের কথাও কি মনে পড়ে না?”

নিত্য ছোটো খুড়ির পা জড়িয়ে ধরল। “মাফ করে দাও ছোটো মা, আর যাব না তোমাদের ছেড়ে।”

জোর করে পা ছাড়িয়ে ছোটো খুড়ি ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। বুঝলাম, হেঁশেলে গেলেন নিত্যর পছন্দের রান্নাগুলির তদারক করতে।

আমাকে দেখে নিত্য খুব হাসতে চেষ্টা করল খানিকক্ষণ, তারপর ধপ করে সোফার ওপর বসে পড়ে ফুঁপিয়ে উঠল, “পটাশ! আমার বাবা…”

বাবা পাশেই চুপচাপ বসে ছিলেন। উঠে এসে নিত্যর কাঁধে হাত রেখে বললেন, “দাদাকে আর ফেরাতে পারবি না। যে ক’টা দিন এখানে আছিস বৌদিকে একটু কাছে কাছে রাখিস বাবা, একটু দেখে রাখিস। জানিস তো, স্বামী যাওয়ার পর মেয়েদের সবচেয়ে বড়ো অবলম্বন হল সন্তান।”

নিত্য ঝট করে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কী করে বুঝলে কাকা, আমি থাকতে আসিনি?”

বাবা মৃদু হাসলেন। “আমরা তোদের বাপ-কাকা রে নিত্য। সব বুঝি। ওই দাড়ি, অপরিষ্কার জামাকাপড়, ঝোলার মধ্যে পাকানো ম্যাপ, সব বোঝা যায়। আর বাড়ির প্রতি টান থাকলে তুই এত বছরে একবার হলেও খবর নিতি বা দিতি। এখানেও বোধহয় কোনও মতলব নিয়েই এসেছিস, তাই না?”

নিত্য মাথা নিচু করে রইল। বাবা ঝোলা থেকে ম্যাপটা হাতে নিয়ে ভুরু কুঁচকে রইলেন। কিছুক্ষণ মন দিয়ে দেখার পর একটা গভীর শ্বাস নিয়ে বললেন, “তুই ইউরোপে করতি কী বল তো?” তারপরই কী মনে করে বললেন, “আচ্ছা, আগে ফ্রেশ হয়ে নে। ওই বুনো ঝোপঝাড় কেটে আয়। দুর্গন্ধ ছাড়ছে ওখান থেকে।”

বাবার দিকে কিছুক্ষণ ছদ্ম রাগ করে তাকিয়ে থেকে নিত্য সোফা থেকে উঠল। তারপর আমার পেটে একটা রাম চিমটি কেটে, ‘মা, ও ছোটো মা-আ-আ’ বলে ডাকতে ডাকতে ভিতর ঘরে চলে গেল। আমিও বাজারের দিকে রওনা দিলুম। পথের উত্তরে শালবনের উপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে নীলপাহাড়ি, আর আমার মন বলছে, এবার যেন ওই পাহাড়ের অন্দরে অনেক উচ্চতায় আমাকে যেতে হবে। সে কি নিত্য এসেছে বলেই?

সন্ধ্যাবেলায় বাবার ঘরটায় বসা হল। পশ্চিমের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে রায়দিঘির চকচকে জল। চায়ের ট্রে নিয়ে মোক্ষদা আর ছোটো খুড়ি এসেছিল কিছুক্ষণ আগে। মোক্ষদা চলে গেছে। এখন শুধু আমরা চারজন বসে আছি। বাবার তামাকের সুবাস ছড়িয়ে পড়ছে ঘরময়। সেই ছোটবেলার গল্প বলার আসর। একটাই শুধু ফারাক, আজ নিত্য কথক আর আমরা শ্রোতা।

ছোটো খুড়ির দিকে তাকিয়ে নিত্য বলল, “তুমি সত্যি বুড়ি হয়ে গেছ ছোটো মা। পটাশের বিয়ে-টিয়ে দাও একটা। আর কতদিন তুমি সব করবে বলো তো?”

ছোটো খুড়ি ছদ্মরাগের ভঙ্গিতে বলল, “নিজের বে করার নাম নেই, ছোটো ভাইয়ের চিন্তায় ওর ঘুম আসছে না। চল্লিশ বছর তো হল বয়স, এরপর বউ নয় নাতনি জুটবে এই বলে দিলুম।”

নিত্য একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। আমি বুঝলাম ব্যাপারটা। যাকে প্রকৃতি একবার টেনেছে, তার সংসার বাঁধা আর দা বাঁধা একই ব্যাপার। বাবা বললেন, “তুই যখন গেলি দেশ থেকে, জানতুম লন্ডনে আছিস। সেখান থেকে ওই যে দুটো চিঠি দিলি, ব্যস, আর কোনও খবর নেই। বলি, ছিলি কোথায় একটু শুনি।”

নিত্য চুপ করে রইল কিছু সময়। হয়তো ঘটনাগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে নিচ্ছিল। আরেক প্রস্থ চা এল। চায়ের কাপে দুটো ছোটো ছোটো চুমুক দিয়ে নিত্য শুরু করল, “ছোটো মা, তুমি পিকাডলি সার্কাসের প্রিমিয়ার ইন বলে যে জায়গাটা, গিয়েছিলে?”

ছোটো খুড়ি একটু ভেবে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ রে গেছি। তবে ওটি নামেই ইন, আসলে এই বিশাল একটা প্রাসাদ। আর খাবারদাবারের যা দাম, হাত দেওয়া যায় না। তোর কাকার সঙ্গে একদিন না দু’দিন বোধহয় গেসলুম। আর যাইনি বাবা।”

“ঠিক বলেছ। কিন্তু আমি যখন ওখানে যাই, বাইরেটায়, মানে রাস্তার ওপরে বেশ কয়েকটা এশিয়ান খাবারের রেস্তোরাঁ খুলেছে। পরোটা, মোমো থেকে শুরু করে ভাত, পোস্ত, ইলিশ-টিলিশও বেশ মিলত। তা আমি ওইখানেই মাঝে মাঝে লাঞ্চ কি রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে নিতুম। তা একদিন বসে আছি খাবারের অর্ডার দিয়ে। আলুর পরোটা আর চিকেন কষা। এমন সময় একটা আধবয়সী লোক, গায়ে হলুদ জোব্বা আর লাল একটা চাদর কাঁধের ওপর ভাঁজ করে ফেলা, আমার উলটোদিকের চেয়ারে বসল। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওয়েটারকে ডাকল। দেখলাম মোমো আর চিকেন স্যুপ অর্ডার করল। অতটা খেয়াল নেই আর। আমার অর্ডার এসে গিয়েছিল। খিদেও পেয়েছিল খুব। একমনে মাথা নিচু করে খাচ্ছি। কেমন একটা অস্বাভাবিক লাগায় মুখ তুললাম। অর্ডার তখনও আসেনি ওদিকে, শুধু একটা পাউন্ড আর কয়েকটা শিলিং চাপা দেওয়া আছে। আর তার পাশেই রাখা আছে একটা লাল চামড়ায় বাঁধানো ডায়েরি গোছের কিছু একটা।”

ছোটো খুড়ি আশ্চর্য হয়ে বলে উঠল, “আর লোকটা?”

“তবে আর বলছি কী? লোকটা পুরো উধাও। লন্ডন এসব ব্যাপারে খুব কড়া। কোনও অজ্ঞাতপরিচয় জিনিস তোমার কাছে পেলে যে ওরা কী করে, সে তো আর তোমার অজানা নয়। ছোটোখাটো সাইজের জিনিসটা। ভয়েই হোক বা কৌতূহলেই হোক, ডায়েরি বা ওই জিনিসটা আমি ওভারকোটের পকেটে পুরে নিলাম। ওয়েটার অর্ডার নিয়ে এসে থ। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে না পেয়ে আমার দিকে তাকাল। আমার গলা শুকিয়ে এল। তবে জানোই তো ব্রিটিশ ভদ্রতা। পাউন্ডগুলো গুটিয়ে নিয়ে চলে গেল। আমিও অর্ধেক খাওয়া ফেলে রেখে পুরো বিল মিটিয়ে কেটে পড়লুম। কিংস ক্রসের কাছেই আমার ঘর। বড়ো রাস্তা যেদিক থেকে প্রিমিয়ার ইন ছুঁয়ে কিংস ক্রসের দিকে এসেছে, তার ডানদিকে একটা পাথুরে সরু রাস্তা ধরে পাঁচটা বাড়ির পরেই আমার ঘর। স্যাঁতস্যাঁতে ঠাণ্ডা রাস্তা থেকে ভাপ উঠছে। তবে পথটা খাড়াই বলে জলকাদা কোনোটাই নেই। দু’পাশের বাড়ির ব্যালকনিতে টিউলিপ, ড্যাফোডিল। রোজমেরিও লাগানো আছে টবে। কেউ বোধহয় দুয়েকটা পাতা ছিঁড়েছে একটু আগে, তাই ভুরভুর করে গন্ধ ছাড়ছে। মূল রাস্তা কাছে হলেও পনেরো-কুড়ি ইঞ্চি পাথুরে দেওয়াল দেওয়া বাড়ি ভেদ করে সে শব্দ এখানে পৌঁছয় না।

“হঠাৎ মনে হল আমার পেছনে কেউ আসছে। খুব সন্তর্পণে সে আসছে। আর শব্দহীন জনহীন রাস্তা বলেই তার পদশব্দ শুনতে পেয়েছি। নইলে মৃদু ঠক ঠক শব্দ আমার কানে আসত না। আমি চোখের আড় দিয়ে তাকে দেখার চেষ্টা করলাম ঘাড় না ঘুরিয়েই। হালকা কুয়াশা। তার মধ্যে দিয়ে গাঢ় লাল আর হলুদ রঙটাই চোখে এল। আমার মাথায় তো তখনও রেস্তোরাঁর ব্যাপারটা ঘুরছে। তাই ওই লাল হলুদ রঙ চোখে পড়তেই ওই অদ্ভুত লোকটার কথা মনে এল। লোকটার কোনও বদ মতলব নেই তো? সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত ধন্দ। ডায়েরি ফেলে পালিয়ে যাওয়া, তারপর নির্জন গলিতে আমার পিছু নেওয়া, নাহ্‌, যাই হোক, ঠিক করে নিলাম লোকটাকে ধরতে হবে। মনস্থির করে যেই পিছু ফিরেছি, লোকটা একটু ম্লান এসে হাত তুলল আমার দিকেই। এ তো ভারি বিপদ! কথা বা মোলাকাতের ইচ্ছে থাকলে তো রেস্তোরাঁয় বলতেই পারত বা এখানেও সরাসরি ডেকে নিতে পারত। চুপিসারে পিছু নেওয়ার মানেটা কী?

“আমিও হাত তুললাম। লোকটা খুব সাবধানে পিছনে দেখে নিয়ে দ্রুত আমার কাছে চলে এল। তারপর ফিসফিস করে ইংরেজিতে বলল, ‘এমন কোনও জায়গায় চলুন, যেখানে আপনি আর আমি ছাড়া কেউ নেই।’

“আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, ‘আপনি কে বলুন তো? মান না মান, ম্যায় তেরা মেহমান!’

“দেখুন, আপনি হলেন নিত্যশরণ রায়। কেমব্রিজে আপনার রিসার্চের বিষয় ‘পোস্ট অতীশা বুদ্ধিজম ইন ইউরোপ’। আপনি ভারতীয় ইত্যাদি। আরও জানি, তবে আপাতত এইটুকুই জানা থাক আপনার। আমাকে সার্চ করে দেখতে পারেন কোনও অস্ত্র আছে কি না। আর আপনার রিসার্চ এমন কিছু এগোয়নি যে সেগুলো চুরি যাবে আমার হাতে। বরং আমাকে কিছু সময় দিলে আপনারই লাভ হবে।’

“তাহলে ওখানে কিছু বললেন না কেন?’

“লোকটা সঙ্গে সঙ্গে ভয়ার্ত চোখে চারদিক দেখে নিল। একটু ঢোঁক গিলে নিল। ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘গ্যালপোর শিষ্যরা সব জায়গায় আছে। জানতে পারলে আমাকে…’

“গ্যালপো! হিমালয়ের ভয়ানক দেবতা গ্যালপো?’

“শুধু এটুকু বললে হবে না। আরও অনেক ব্যাপার আছে। আপনি দয়া করে কোনও সুরক্ষিত স্থানে নিয়ে চলুন।’

“একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললুম, ‘বাকিংহাম কি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে যখন নিয়ে যেতে পারছি না আপনাকে, আমার ঘরেই চলুন। দেখি কী উপকার আমার বা আপনার হয়।’

দুই

আগন্তুকের নাম নেমায়েভ। পোশাক-আশাকে বৌদ্ধ হলেও আমরা বাঙালিরা বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বলতে যা বুঝি ইনি তা নন। মুণ্ডিত মাথা হলেও নীল চোখ, টিকলো নাক আর টকটকে ফরসা রঙ বলে দিচ্ছে ইনি জাতে চিনা, তিব্বতী বা সিকিমিজ নন। আমি তাঁকে কফি দিয়ে বললাম, “আপনি ইটালিয়ান না অস্ট্রিয়ান?”

নেমায়েভ মুচকি হেসে বললেন, “রাশিয়ানটাই বা বাদ দিলেন কেন? আপনারা তো ইউরোপিয়ান বৌদ্ধ বলতে ইতালি, অস্ট্রিয়া আর রাশিয়া ছাড়া কিছু বোঝেনই না। ওদিকে আপনাদের অতীশ বৌদ্ধধর্মের যে শাখাটি গড়ে তোলেন তার কত অগ্রসর আমরা ক্যালমিনিয়ানরা ঘটিয়েছি, তার খোঁজও রাখেন না। হায় অতীশ!”

“আপনি ক্যালমিনিয়ান? সেটি তো বোধহয় রাশিয়ান টেরিটরিতে।”

“ওভাবে বলা যাবে না এককথায়। প্রাচীনকাল থেকে গ্রীক, মোঙ্গল, অটোমান, রাশিয়ান, জার্মানদের অধীনস্থ হয়েছি আমরা। একই জাতির লোক রাষ্ট্রশক্তির ক্রীড়নক হয়ে একে অপরের বুকে ছুরি বসাতে বাধ্য হয়েছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। কমতে কমতে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে আমাদের সংখ্যা, তবুও আমরা নিঃশেষিত হইনি একমাত্র তথাগতের দয়াতে।”

“হ্যাঁ, এ একদম সত্য কথা। তথাগতের শান্তির বাণী যার মনে একবার ঢুকেছে সে মরণোত্তর অমর হয়েছে।”

আমাকে চমকে দিয়ে ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল নেমায়েভ। “শান্তির বাণী! আপনি ভুল বুঝেছেন নিত্যশরণ। তথাগতের শান্তির বাণী নয়, তাঁর তেজ আর বোধি থেকে উৎপন্ন শক্তিই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। জ্ঞানই সবচেয়ে বড়ো শক্তি, তা জানেন তো? এই যে প্রচণ্ড শক্তিশালী পরমাণু বিস্ফোরণ, অস্বাভাবিক শক্তিশালী মারণাস্ত্র, এগুলিও কি জ্ঞান থেকে উদ্ভূত নয়?”

আমার গায়ে কাঁটা দিল। মৃদু স্বরে বললাম, “কেমন করে, শুনি?”

হাত বাড়িয়ে আমার ওভারকোটের পকেট থেকে লাল চামড়ায় বাঁধানো জিনিসটা বার করল সে। সেটি হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে নেমায়েভ কপালে ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি।”

পরপর তিনবার একই কথা বলে সেটি খুলল নেমায়েভ।

কয়েকটি পৃষ্ঠা উলটিয়ে গেল সে। দুর্বোধ্য লিপিতে কিছু লেখা। তবুও আমার খুব চেনা মনে হল হরফটা। ছাঁদটা খুব চেনা, তবুও ধরতে পারছি না। সাত-আটটি পৃষ্ঠার পর নতুন অধ্যায় শুরু। পৃষ্ঠার ওপরে হাতে আঁকা একটি সাদা কালো গুম্ফার ছবি। সেটি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে নিয়ে নেমায়েভ আমার দিকে তাকাল। তারপর গভীর দৃষ্টি দিয়ে কিছুক্ষণ আমাকে মেপে নিয়ে বলল, “কদম কী, নিত্যশরণ?”

এটা আমার জানা ছিল। বললাম, “বৌদ্ধধর্মের একটি শাখা। অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের নির্দেশে তাঁর প্রধান শিষ্য এর প্রতিষ্ঠা করেন একাদশ শতাব্দীতে।”

“বাহ্‌। আর ‘গেলুগ’ সম্বন্ধে কিছু বলুন।”

জানতুম না। চুপ করে রইলুম। নেমায়েভ বলল, “অতীশের সৃষ্ট কদম মতকে ঢেলে নতুন করে সাজান জে-জোংপা চতুর্দশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। জে-জোংপার শিষ্য ছিলেন তিন গোত্রের। শাক্য, কাগ্যু এবং নিংমা। তা জোংপা কী করলেন, কদম শিক্ষার মানসিক তপস্যা কাগ্যু শাখার মার্গদর্শন তপস্যার সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন শাক্য তান্ত্রিক আচার বিচার। অতীশের মৈত্রেয় চিন্তা বা তুষিত স্বর্গের আদর্শে মিশে গেল নতুন কদম পথের তান্ত্রিক আচার বিচার। সৃষ্টি হল অসংখ্য দেবদেবী এবং ভয়ানক সব অপদেবতার।”

“সে তো জানিই এবং তাদের প্রত্যেকটি সঙ্গে হিন্দু দশ মহাবিদ্যা ও অন্যান্য দেবতা অপদেবতার মিল আছে।”

“না-আ-আ-আ, নেই!” ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করে ওঠে নেমায়েভ, “সব দেবদেবীর মিল নেই। এ ডায়রি কী ভাষায় লেখা আপনি জানেন, নিত্যশরণ?”

আমি আগেও সেটা লক্ষ করেছি, এ হরফগুলো আমার খুব পরিচিত মনে হলেও ধরা দিচ্ছে না। আমি দু’দিকে মাথা নাড়লাম। নেমায়েভ একটু হেসে একটি কাচের টুকরো বার করল জোব্বার পকেট থেকে। মেয়েদের প্রসাধনী বাক্সে থাকা ছোটো আয়নার মতো দেখতে সেটি। কাচটি ডায়েরির একটি পাতার ওপরে রাখতেই তাতে হরফগুলোর প্রতিফলন দেখা দিল। আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

এ তো সংস্কৃত!

মৃদু গলায় নেমায়েভ বলল, “হ্যাঁ নিত্যশরণ, এ দেবনাগরী হরফ। মূল পুঁথিটি সংস্কৃত ভাষাতেই লেখা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই জার্মান এবং রাশিয়ানদের কাছ থেকে সরিয়ে রাখার জন্য এ পুঁথি মিররোগ্রাফে লিখে আমার বাবা মূল পুঁথিটি লুকিয়ে ফেলেন অত্যন্ত গুপ্ত এক স্থানে। তবুও শেষরক্ষা হয় না। আমাদের ক্যালমিনিয় গুম্ফা থেকেই কোনও অত্যুৎসাহী পর্যটক বা গুপ্তচরের হাত ধরে পুঁথির বিশেষ কয়েকটি পাতা পাচার হয়ে যায় বাইরে। হাতে নকল করেই হোক বা ছবি তুলে, তা জানা যায়নি।”

“ছবি তুলে? ওই সময় ক্যামেরা ছিল?”

“ক্যামেরা থাকবে না? সে তো চিনে হান যুগেও ছিল খ্রিস্টপূর্ব তিন শতকে। আর বর্তমান যে ক্যামেরা দেখি তার প্রাথমিক ধাপের শুরু হয়ে গিয়েছিল ১৮৯০ সাল নাগাদ। আশ্চর্য কিছু নয়। আর বিপদটা হল সেখানেই। মহাযুদ্ধে যে মারণ যজ্ঞ দেখা যায়, তা সবটাই মানুষের করা বলে মনে হয় না।”

“তবে?”

“এর পিছনে দানবীয় শক্তির হাত আছে নিশ্চয়ই। নইলে মানুষের ইচ্ছে থাকলেও এত বিশাল মারণযজ্ঞ অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়।”

“দানবীয় শক্তি? তার সঙ্গে ওই পুঁথির সম্পর্ক কী?”

“এই পুঁথিতে কী আছে আপনি জানেন, নিত্যশরণ? এতে আছে এক মহা ভয়ানক শক্তির জাগরণের উপায়। মনে করি বিশ্বের কোনও পুরাণে উপকথায় তার তুল্য নৃশংস ভয়ানক আর কিছু নেই। হিন্দু পুরাণের অল্প কিছু রাক্ষসের সঙ্গে এর কিছুটা মিল পাওয়া গেলেও এর তুলনায় তারা কিছুই নয়।”

“এত ভয়ানক কী করে হওয়া সম্ভব?”

“প্রচণ্ড শক্তি ও দায়িত্বের অধিকারী কোনও ধর্মপাল যদি ঘৃণা এবং রাগ নিয়ে মারা যান তবে এই ভয়ানক অপদেবতার সৃষ্টি হয় এবং তেমনটাই হয়েছিল শাং-ডেনের ক্ষেত্রেও। ১৯৩০ সালের আগে পর্যন্ত নাগাদ জে-জোংপার শিক্ষা অনুযায়ী গেলুকদের রক্ষক দেবতারা ছিলেন দোর্জে-পেহার, দোর্জে-নাচুং, দোর্জে পালদেন লামো, দোর্জে-মহাকাল, দোর্জে-বৈশ্রবণ এবং দোর্জে কালপুর। ১৯৩০ সাল নাগাদ এই মতের প্রচণ্ড বিরোধিতা করেন গুরু পাবোং-কা এবং রাইমি আন্দোলনের মাধ্যমে জে-জোংপা নিযুক্ত সকল রক্ষাকর্তাকে নস্যাৎ করে দোর্জে-শাংডেনের আত্মাকেই গেলুক স্তূপ তথা মতাবলম্বীদের প্রধান রক্ষাকর্তা নিযুক্ত করেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন পাবোং-কার পেছনেও সাম্রাজ্যবাদী উন্মাদ জার্মানটির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদত ছিল।”

“সে কি! কীরকম?”

“দোর্জে-শাংডেনের প্রকৃতিও ওই উন্মাদটির মতোই কিনা। সে শুধুমাত্র রক্ষাকর্তাই নয়। গেলুক মতাবলম্বী বাকি সব ধর্ম এমনকি বৌদ্ধধর্মের অন্য শাখাগুলিও তার ঘৃণার আওতায় পড়ত। মিল পাচ্ছেন না?”

“হ্যাঁ, পাচ্ছি। কিন্তু এই পুঁথির সঙ্গে দোর্জে-শাংডেনের সম্পর্ক এখনও বুঝতে পারছি না।”

“এ পুঁথির আসলটি পাবোং-কার নিজে হাতে লেখা। শাংডেনকে জাগিয়ে তোলা এবং তাকে নিরস্ত করার সব রীতি লেখা ছিল এতে।”

“লেখার সময় তাড়াহুড়োই হোক বা ভয়েই হোক, বাবা জাগরণের অংশটিই শুধু নকল করতে পেরেছিলেন, নিরস্ত করার উপায়টি আর পারেননি। সেটি রয়ে গেছে মূল পুঁথির মধ্যেই। মরার আগে তার হদিশ বাবা বলতে না পারলেও বলে গিয়েছিলেন কোনও বৌদ্ধ প্রধান গুরুর হাতে তৈরি বজ্রকীলক যে মন্দির প্রোথিত আছে, সেখানেই আছে এ পুঁথি। আপনাকে তা খুঁজে বার করতেই হবে, নিত্যশরণ।”

“আমাকে!”

“হ্যাঁ, আপনাকেই। দেখছেন না চতুর্দিকে শাংডেন কেমন জেগে উঠছেন বিভিন্ন রূপ নিয়ে! উপসাগর যুদ্ধ, লন্ডন ব্লাস্ট, নিউ ইয়র্কে বিমান হামলা, অক্ষরধামে হামলা… এসব ওরই কাজ। সময়মতো ওই পুঁথি খুঁজে বার না করতে পারলে বিশ্বযুদ্ধ আবার শুরু হতে দেরি নেই।”

“কিন্তু আমি কী করে খুঁজে পাব সেই গুম্ফা?”

“পাবেন নিত্যশরণ, পাবেন। আপনার দাদুর সঙ্গে আমার বাবার সেই গুম্ফাতেই দেখা হয়েছিল। বাবাই আমাকে বলেছিলেন একমাত্র তারিণীচরণ রায়ের বংশধরের হাতেই ক্ষমতা আছে এ মহাবিপদ থেকে বিশ্বকে বাঁচানোর। তবে নিত্যশরণ, তবে!”

“তবে কী?”

“এ শক্তিকে থামানোর প্রক্রিয়াটি বড়ো কঠিন। বড়ো অল্প সময়ের কাজ, কিন্তু কঠিন। বিফল হলেই মৃত্যু অনিবার্য। আর সে মৃত্যুর আসার আগে এমন ভয়ানক দৃশ্য আপনাকে দেখে যেতে হবে, আপনার মৃত আত্মাও লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকবে।”

“শাংডেনের কোনও ছবি আছে কি?”

“না! ওর ছবি আঁকা নিষিদ্ধ, ওর মূর্তি তৈরি নিষিদ্ধ। শুধুমাত্র পদ্মসম্ভব ও অতীশের ছোঁয়া যেখানে আছে, সেখানে শাংডেনের মূর্তি বা ছবি আঁকা আছে। সেখানে শাংডেনের শক্তি নিষ্ক্রিয়। কিন্তু…”

“আরও কিন্তু আছে?”

“হ্যাঁ। আছে। শেষবারের মতো ঘুম পাড়ানোর আগে আধা সুপ্ত অবস্থা থেকে জাগিয়ে তুলতে হয় ওই ভয়াল ভয়ংকরকে। তখন তাকে শুধুমাত্র তন্ত্রশক্তির জোরে চিরনিদ্রায় শুইয়ে দিতে হয়। কোনও প্রাচীন গুরুর প্রভাব তার ওপর খাটে না, সে পদ্মসম্ভবই হন বা অতীশা। আপনি পারবেন নিত্যশরণ। আপনাদের পরিবারের ওপর এখন মহান মনীষীর আশীর্বাদ রয়েছে।”

“তা এই গুম্ফাটি কোথায়?”

ডায়েরির ভেতরে সাঁটা একটি ভাঁজ করা ম্যাপ খুলে আমার সামনে রাখল নেমায়েভ। ভারত, চিন, নেপাল, সিকিম, ভুটান, তিব্বত নিয়ে বড়ো করে হাতে আঁকা ম্যাপটা। মধ্যপ্রদেশের নিচ থেকে ভারতের বাকি অংশ বাদ দেওয়া। তিব্বতের ওপর একটি লাল ফুটকি। আর পাশে ছোটো করে দেওয়া আছে একটি বৌদ্ধস্তূপের ছবি।

আরে! এ তো আমার চেনা। নেমায়েভকে বললাম, “এ তো বিহারের ওদন্তপুরী মহাবিহারের ছবি। তিব্বতে দেখাচ্ছে কেন একে?”

নেমায়েভ মাথা নেড়ে বলল, “না, এটি তিব্বতেই। ২৯°১৯’৩১.৮০ উত্তর অক্ষাংশ, এবং ৯১°৩০’১৩.৩২ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। সামিয়ে গুম্ফা।”

আরেকটা কথা আমার মনে খটকা জাগাল। “আমাদের পরিবারে মহান মনীষীর আশীর্বাদ আছে জানি। তুমি জানলে কী করে?”

মৃদু হেসে নেমায়েভ বলল, “আমার এক তুতোভাই তাঁর নাতজামাই হয়। সে ভারতেই থাকে শেষ বয়স পর্যন্ত। দাদা ছবি আঁকতেন, আর বৌদি ইন্ডিয়ার প্রথম মহিলা মুভি অ্যাকট্রেস।”

আমার চোখ কপালে উঠে গেল। মুহূর্তের জন্য হলেও আমার মন থেকে আগামী ভয়ংকরের কথা মন থেকে মুছে গেল। বুকটা ফুলে উঠল। বলে দিলাম বুক ঠুকে, “যাবই, আমি যাবই।”

“সাবাশ, এই না হলে টেগারকার্টারের বন্ধুর নাতি!”

তিন

বাবা ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন। আমি টিপয় থেকে গ্লাস তুলে দু’ঢোঁক জল খেলাম। ছোটো খুড়ি তখনও চুপ। নিত্য আশ্চর্য হয়ে বলল, “কাকা, তুমি হাসছ!”

বাবা অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললেন, “তোকে একজন গালগল্প শুনিয়ে গেল আর তুইও নেচে উঠলি? তুইও পটাশের মতো সেই গাধাটিই রয়ে গেলি দেখছি। টেগারকার্টার আবার কে রে?”

নিত্য গম্ভীর হয়ে বলল, “কাকা, আমিও প্রথমে তাই ভেবে ডায়েরিটা টেবিলের ওপর অরক্ষিতে ফেলে রেখেছিলাম দু’দিন। তারপর কাগজে আর টিভিতে নেমায়েভের খুন হওয়ার খবর দেখলাম। লন্ডনের এক গলিতে তার দেহ পড়ে ছিল। মাথাটা ছিঁড়ে পড়ে আছে কয়েক হাত দূরে। আর দেহে এক ফোঁটাও রক্ত নেই। কোনও অমানুষিক শক্তির কাজ।”

আমার সারা দেহে কাঁটা দিয়ে উঠল। ছোটো খুড়ি দু’বার কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে উঠল, “দুগ্গা দুগ্গা, মা গো!”

বাড়িতে প্রবল আপত্তি উঠল। বাবা-কাকা-মা মেজমা কেউ রাজি নয়। ছোটো খুড়ির কথাই শেষ কথা সবাই জানে। কারণ, আমরা তাঁরই ছেলে। তিনিই জন্ম থেকে আমাদের বড়ো করা, পড়াশোনা, ঘোড়ায় চড়া, সহবত শিখিয়েছেন। আমাদের মানুষ করার জন্যই তাঁর নিজের ছেলেমেয়েও কোনোদিনও হয়নি। তাঁর আদেশই যে শেষ আদেশ বাড়ির সবাই জানত। জানতাম আমরাও। তাই তিব্বত যাওয়ার আশা যে ক্ষীণ, তা নিশ্চিত।

কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে বললেন, “শীতের পোশাক নিয়ে যেও দু’ভাই। জ্বর গায়ে বাড়ি ফিরলে কিন্তু রায়দীঘিতে চুবিয়ে আনব আর খাওয়াদাওয়া…”

ছোটো খুড়ি মুখে আঁচল দিয়ে চলে গেলেন ঘরের দিকে। বাকিরা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। নিজের ছেলেদের মাই যখন বিদায় জানিয়ে গেল, অন্যরা কীই বা করতে পারে?

রাতে জামাকাপড় গোছাতে গোছাতে নিত্যকে জিজ্ঞাসা করলাম, “সবই বুঝলাম। কিন্তু এই টেগারকার্টারটি কে রে নিত্য?”

নিত্য আমার মাথায় টকাস করে একটা গাঁট্টা মেরে বলল, “ওরে উল্লুক, টেগারকার্টার হলেন দাদামশায়ের বন্ধু, আমাদের ঠাকুরকর্তা।”

আমার মাথাটা আবার ভোঁ ভোঁ হয়ে গেল।

লাসা থেকে প্রায় চার ঘণ্টা লেগে গেল দ্রানাং গ্রামে পৌঁছতে। সাড়ে তিন হাজার মিটারেরও বেশি উচ্চতা। সামিয়ে গুম্ফার গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হেপো-রি শৃঙ্গ। কনকনে ঠাণ্ডা মন্দির চত্বরে গাছের সংখ্যা খুবই কম। চারদিকের শৃঙ্গগুলিও ন্যাড়া-ন্যাড়াই মনে হল। ঠিক যেন মুণ্ডিতমস্তক লামারা বসে আছেন আর বাতাসের সুরে স্তোত্র পাঠ করছেন। বিরাট বিরাট কংক্রিট আর পাথরের বোল্ডার দিয়ে মন্দিরের পাঁচিল তৈরি। তাও কিছু কিছু জায়গায় প্রাচীর ভাঙা বা ফাঁকা।

মূল তোরণ পার হয়ে আমরা লামার পিছন পিছন ঢুকে গেলাম গুম্ফার মধ্যে। দু’দিকে টানা বারান্দা আর নক্সা করা থাম। গায়ে গায়ে কুঠুরিতে জ্বলছে দীপশিখা। হাওয়া বইছে সোঁ সোঁ করে।

শ্রমণ ঘুরে দাঁড়ালেন। করমর্দনের ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে বললেন, “আমি চের-পা। গুম্ফার একজন সামান্য ভিক্ষু। আপনারা প্রধান লামার সঙ্গে স্কার্ফ আদানপ্রদান করে বিশ্রাম নেবেন।”

আবৃত অংশটি পার হলে আবার ফাঁকা জায়গা। আকাশে তারা ফুটে উঠেছে। সোঁ সোঁ করে এলোমেলো হাওয়া মুখে ঝাপটা দিচ্ছে। আর হাওয়া মাঝে মাঝে পড়ে এলে শোনা যাচ্ছে নদীর জলের প্রচণ্ড স্রোতের শব্দ।

মূল মন্দিরের প্রার্থনা বিরতি চলছে। সারি সারি লাল পোশাক পরা বিভিন্ন বয়সের লামা বসে আছেন পাশাপাশি। আর তাঁদের একপাশে গাঢ় নীল পোশাকে যিনি বসে আছেন, তিনিই বোধহয় প্রধান লামা। আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে চের-পা ধীর পদক্ষেপে প্রধান লামার কানে কিছু বললেন। স্মিতহাস্যে তিনি মাথা নেড়ে আমাদের কাছে ডাকলেন।

প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পাথুরে মেঝে। মোজা থাকা সত্ত্বেও পা বেয়ে শীতের ছোবল আছড়ে পড়ছে স্নায়ু বেয়ে ব্রহ্মতালুতে। লামা আমাদের বসতে বললেন। তারপর খাঁটি ইংরেজি উচ্চারণে বললেন, “শেষ ট্যুরিস্টটি ফিরে গেছে ঘণ্টা দুয়েক আগে। আপনারা কি পথ ভুলেছেন পথিক?”

নিত্য সময় নষ্ট না করে রুকস্যাক থেকে লাল চামড়ায় বাঁধানো পুঁথিটা লামার হাতে দিল। স্কার্ফ বিনিময়ই একজন লামার সঙ্গে আদানপ্রদানের প্রধান নিয়ম। এমন বিজাতীয় ব্যবহারে তিন চমকে গেলেও ব্যাপারটির গুরুত্ব কিছুটা আঁচ করতে পেরে সেটি খুললেন। প্রথম পৃষ্ঠাটি দেখেই চমকে উঠলেন তিনি। তারপর অস্ফূট স্বরে বললেন, “স্বর্ণাভ!”

নিত্য হাতজোড় করে বলল, “এই পুঁথিটি আমি পেয়েছি নেমায়েভ নামে এক ক্যালমিনিয়ান ভদ্রলোকের কাছে। এর সঙ্গে অনেক ঘটনা জড়িয়েও আছে। আর তা জানাতেই আপনার কাছে আসা।”

লামা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আপনারা যাকে নেমায়েভ বলে জানেন, তার প্রকৃত নাম নীলাভ, আর এই পুঁথি তার পিতা স্বর্ণাভর লেখা। তিনি আপনাদের মতোই খাঁটি ভারতীয় ছিলেন।”

আমি আর নিত্য দু’জনেই চমকে উঠলাম। নিত্য বলল, “ভারতীয়! কিন্তু কটা চুল, নীল চোখ, ওই টকটকে রঙ?”

“সে ওর মায়ের জন্য। মারিয়া রোয়েরিখ।” তারপর একটু থেমে বললেন, “আপনারা অতিথিশালায় যান, বিশ্রাম নিন। আপনাদের সাথেই নৈশাহার করব আমি আর বিশদ আলোচনাও হবে এই নিয়ে।”

তারপর তিনি দুর্বোধ্য ভাষায় চের-পাকে কিছু নির্দেশ দিলেন।

আমরা স্কার্ফ বিনিময় করে চললাম বিশ্রামাগারের দিকে। আবছা অন্ধকার অলিন্দ দিয়ে আমরা চললাম মন্দিরের অন্য একটা প্রান্তে। নীল কাচের একটি লন্ঠন নিয়ে সামনে চলেছেন চের-পা। দেয়ালে দেয়ালে অদ্ভুতদর্শন দেবতাদের মূর্তি। হাজার হাতের অবলোকিতেশ্বর। সপ্তস্বর্গের মাথায় বসে থাকা রিনপোচে বা পদ্মসম্ভব। নানা বর্ণের নিশান ঝুলছে ছাদ থেকে। রঙবেরঙের নক্সা করা সুদৃশ্য ঝাড় ঝুলে আছে। নরম আলো ছড়িয়ে পড়ছে সেগুলি থেকে। ঠাণ্ডা, ধূপের গন্ধ, মোলায়েম আলো আর সামনে চলমান নীলাভ লন্ঠন হাতে চের-পা, সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে এক অন্য জগতে পৌঁছে গেছি আমরা। মোহময় এক জাদুলোকের দিকে আমরা এগিয়ে চলেছি আধো আধো স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে।

অন্ধকার আলোর কয়েকটি গলিঘুঁজি পার হয়ে আমরা একটা নক্সা করা বর্ণময় দরজার সামনে উপস্থিত হলাম। দরজাটি খুলে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে চের-পা বললেন, “আসুন ভেতরে। সামথিং ভেরি সারপ্রাইজিং অ্যাওয়েইটস ইউ।”

আমরা অভিবাদন জানিয়ে ঘরে ঢুকলাম। চওড়া চওড়া সোফা। দেওয়ালে দুর্দান্ত সব ছবি। কাচের শার্সির ওপারে অন্ধকার। পশ্চিমের দেওয়ালে চোখ পড়তেই আমার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইল। আমি তাড়াতাড়ি নিত্যকে ডাকলাম।

একটা গ্রুপ ফটো। চারজন মানুষ। সামিয়ে গুম্ফার প্রধান লামার অল্প বয়সের ছবি। তাঁর ডানপাশে একজন মানুষ, যার চোখ আর চিবুক দেখলে বলে দিতে হয় না ইনিই স্বর্ণাভ। লামার বাঁপাশে লম্বা খয়েরি আলখাল্লা আর পাকা দাড়িওয়ালা দেবদর্শন মানুষটি তো বিশ্বের সবারই চেনা। আর তাঁর ডানদিকে যিনি পাকানো গোঁফ নিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দৃপ্ত ভঙ্গীতে, তিনি আর কেউ নন, আমাদের দাদামশায় তারিণীচরণ রায়।

নিত্য ধপ করে একটা সোফায় বসে পড়ল।

চায়ের নীল পেয়ালাগুলো ভারি সুন্দর। পলকাটা নীল কাচের গায়ে সাদা ড্রাগন। ড্রাগনের চোখগুলো ভারি মিঠে আর শান্ত। কাচের শার্সি দেওয়া জানালায় নাক ঠেকিয়ে দাঁড়ালে চতুর্দশীর চাঁদের আলোতে ভেসে যাওয়া ইয়ারলুং নদী দেখা যায়। উপত্যকায় সে যেন জ্যোৎস্নার আঁজলা ছেটাতে ছেটাতে ছুটে যাচ্ছে। নিঃশব্দ ছবি। কাচ পার হয়ে জলের শব্দ এপাশে আসে না। পাহাড়ে রাত্রি আর সন্ধ্যার মধ্যে এক মজাদার লুকোচুরি খেলা চলে। কখন যে সন্ধ্যার খেলাঘরটুকু রাত্রি দখল করে নেয় বোঝা যায় না। সন্ধ্যা হিমচাঁপার গায়ে নিঃশব্দে শিশিরের কান্না হয়ে ঝরে যায়।

ঘড়ি বলছে এখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে নিশুতি রাত। প্রদীপ আর মোমবাতির আলোয় গুম্ফার ঘরগুলোকে মনে হচ্ছে মায়ানগরীর কোনও গোপন প্রকোষ্ঠ।

আটটা বাজতে প্রধান লামা আমাদের ঘরে এলেন। সঙ্গে অল্পবয়সী একটি ছেলে। সে বেশ বলশালী ও পেশীবহুল। আমরা উঠে দাঁড়াতেই প্রৌঢ় বললেন, “আমি এখন অতিথির কাছে এসেছি। এখন আমি আপনাদের মতোই সাধারণ মানুষ। আমাকে আপনারা গেলেগ বলেই ডাকবেন বা ভারতীয় রীতিতে গেলেগ আঙ্কল। হা হা হা…”

প্রৌঢ়ের সহৃদয় হাসিতে আমরা বেশ স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করছিলাম। নিচু কাঠের চৌকো টেবিলের ওপরটা গাঢ় নীল ও হলুদ রঙের নকশা কাটা রেশমি আবরণ দিয়ে ঢাকা। দু’জন মানুষ বেশ কয়েক রকমের বাটিতে খাবার দিয়ে গেল। গেলেগ যুবকটিকে বললেন, “নোরবু, তুমি ডিনার সেরে নাও। একঘণ্টা পরে এসে আমাকে ডেকে দেবে।”

ঝরঝরে নুডলস, গরম ধোঁয়া ওঠা সেদ্ধ সবজি, আর শুকনো করে রান্না টকঝাল স্কোয়াশের তরকারি। পথশ্রান্তিতে খিদেটা জব্বর পেয়েছিল। খাওয়াটা একটু বেশিই হয়ে গেল। ভাঁজ করে রাখা পশমিনা তোয়ালেতে মুখ মুছে গেলেগ বললেন, “আপনারা যে সমস্যার কথা বলতে এসেছিলেন, এবার আমি শুনব। তবে পুঁথিটি আবার পড়ে যা বুঝলাম, এ তো নতুন কিছু নয়। দোর্জে-শাংডেন তো অনাদিকাল থেকেই ঘটিয়ে আসছেন ধ্বংসলীলা। আপনারা বরং নেমায়েভের ঘটনাটি বলুন।”

নিত্য এক নিঃশ্বাসে বলে যেতে লাগল ঘটনাগুলো। আমি আগেও শুনেছি যদিও, তবুও শিহরন জাগল। বিশেষ করে নেমায়েভের হত্যার ঘটনাটি শুনে আবার প্রথমদিনের মতোই গায়ে কাঁটা দিল। তিব্বতের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিঃশব্দ মন্দিরের এ ঘরটা যেন হঠাৎ আরও বেশি ঠাণ্ডা হয়ে উঠল। আমার মনে হল মন্দিরের প্রাচীরে ছায়া ফেলে কোনও অতিকায় ছায়ামূর্তি ঘুরে বেড়াচ্ছে বিশাল বিশাল পা ফেলে। তার করাল থাবা বার বার গ্রাস করতে চাইছে জীবিত প্রাণগুলিকে। কিন্তু অদৃশ্য কিছুতে বাধা পেয়ে সে ফিরে ফিরে যাচ্ছে। গর্জন করে উঠছে হাওয়ার শব্দের মতো, নদীর গর্জনের মতো। পাথর গড়িয়ে পড়ছে সে শব্দে আর অনেক ওপরে ফাটল ধরছে বরফে।

নিত্য বিবরণ শেষ করে গেলেগকে বলল, “বিশ্বে এত গুম্ফা থাকতে নেমায়েভ বা আপনার মতে নীলাভ, তার বাবা কেন এই সামিয়ে গুম্ফাতেই সেই পুঁথি লুকিয়ে রাখতে গেলেন? যেকোনও সুরক্ষিত আর্মি বা সরকারের হেফাজতে রাখলেই মনে হয় সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত থাকত মনে হয়।”

গেলেগ একাগ্র চিত্রে ঘটনাটি শুনছিলেন। নিত্যের প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন না তিনি। ধ্যানমগ্নের মতো বসে রইলেন চোখ বুজে। আমরাও চুপ করে রইলাম। এ অবস্থায় কথা বলাও উচিত নয়। ন’টা নাগাদ নোরবু এসে গেলেগকে ডাকল। চোখ খুলে গেলেগ তাকে বললেন, “চীরপুঁথিটি নিয়ে এসো।”

নোরবু অভিবাদন করে চলে গেল। গেলেগ আমাদের দিকে কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলা শুরু করলেন, “একদম প্রথমেই বলি সৈন্য বা সরকারি কোনও সংস্থায় এই পুঁথি রাখা সবচেয়ে বিপজ্জনক কেন। তান্ত্রিক মতে যেকোনও দেবদেবী অপদেবতা ইত্যাদিকে ডেকে না আনলে তাঁরা আসেন না। ‘তন’ বা দেহের প্রকাশ বা মুক্তিই হল তন্ত্র। কোনও রাষ্ট্রশক্তির হাতে এ পুঁথি পড়লেই এর ভুল বিনিয়োগ হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা। কারণ, লোভী তন্ত্রজ্ঞানী মানুষ সবসময়ই রাজশক্তির কাছে মজুত থাকে। তাই স্বর্ণাভ এবং তারিণীচরণ এই পুঁথি সামিয়ে গুম্ফাতে গচ্ছিত রাখেন ১৯৩৪ সালে। দ্বিতীয় কথাটি হল, সামিয়ে গুম্ফাকে কিন্তু যে সে ধর্মস্থান ভাববেন না। এটি তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মমতের প্রথম দেবালয় এবং স্বয়ং গুরু পদ্মসম্ভব এটি সুরক্ষিত করেছিলেন তন্ত্র মতে।”

আমি আশ্চর্য হলাম। “কীরকম?”

“অষ্টম শতকে রাজা ত্রিসঙ দেৎসেন এই গুম্ফা তৈরি করেন। এর মাধ্যমে ভারত, তিব্বত এবং হান সংস্কৃতির মিলন হয়। এই স্তূপ তৈরির সময় ভারতের বৌদ্ধ শ্রমণ শান্তরক্ষিত উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু মন্দির নির্মাণের সময় এক বিরাট বিপত্তি উপস্থিত হয়। একটি নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত মন্দির তৈরি হওয়ার পরই সেটি ভেঙে পড়ে। রাজার নির্দেশে পুনরায় সেটির নির্মাণ শুরু হয়। কিন্তু একই ঘটনা ঘটে এবারও। ওই নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত নির্মাণকার্য হওয়ার পরই মন্দিরটি ভেঙে পড়ে। বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখে শান্তরক্ষিত বুঝতে পারেন এ বিপত্তি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। কারণ ভূমিকম্প হলে বা ভূমিক্ষয় হলে আশেপাশেও তার প্রভাব দেখা যাবে। পার্বত্য অবদেবতা বা স্বর্গবিরোধী শক্তিরাই এ মন্দির নির্মাণে বাধা দিচ্ছে। আশ্চর্য সমাপতনের মতো তখনই সেখানে উপস্থিত হন গুরু রিনপোচে বা পদ্মসম্ভব। এক লহমায় তিনি বুঝে যান, এখানে তন্ত্রপদ্ধতি ছাড়া মন্দির নির্মাণ সম্ভব নয়। তখনই মন্দিরের চতুর্দিকে তিনি লম্বা লম্বা কয়েকটি স্তম্ভ নির্মাণ করেন এবং সেগুলি মুড়ে দেন বিভিন্ন রঙিন কাপড় দিয়ে। এগুলি মন্দিরকে সুরক্ষিত করল চারদিক থেকে। তারপর পদ্মসম্ভব শুরু করলেন বজ্রকীলয় বা বজ্রকীলক নৃত্য।”

আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম, “সে কী নৃত্য?”

“কোনও সদবংশজাত, শুদ্ধ-হৃদয় সাধু বা তাঁর শোনিতোদ্ভুত ছাড়া এ নৃত্য অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়। এর মাধ্যমে চতুর্দিকের অপদেবতা ওই নির্দিষ্ট ব্যক্তির বশীভূত হয় এবং তাঁর নির্দেশে সৎকার্যে ন্যস্ত হয়। পদ্মসম্ভবের এই তান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ছোটোখাটো অপদেবতারা বন্দী হনই, উপরন্তু সব অপদেবতার প্রধান দোর্জে পেহার বা দোর্জে দ্রাকদেন তাঁর বশীভূত হয়। পদ্মসম্ভব তাঁকে নিযুক্ত করেন সামিয়ে গুম্ফার রক্ষাকর্তা হিসেবে এবং পরবর্তীকালে দোর্জে পেহার সমগ্র গেলুক সম্প্রদায় এবং দলাই লামাদের রক্ষাকর্তা হন।”

নিত্য মাথা নেড়ে বলল, “সে সবই ঠিক বুঝলুম। কিন্তু নীলাভের মৃত্যুর কারণ স্পষ্ট হল না। পুঁথি তো তার কাছেই ছিল এতদিন, কিন্তু আমার হাতে সেটি তুলে দেওয়ার পরপরই তার মৃত্যু হল কেন?”

নোরবু এসে দাঁড়াল। তার হাতে লাল কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা একটা চতুষ্কোণ জিনিস। খুব সাবধানে সেটি তার হাত থেকে নিলেন গেলেগ। একটি কাঠের পুঁথিদানের ওপর সেটি রেখে খুব সাবধানে তার মোড়কটি খুললেন। এটিও চামড়ার বাঁধাই, কিন্তু নেমায়েভের পুঁথিটির চেয়ে একটু বেশি মোটা। প্রথম পৃষ্ঠাটি খুলতেই একে ‘চীরপুঁথি’ বলার কারণ বোঝা গেল। প্রতিটি পৃষ্ঠাই হলদে কাপড়ে তৈরি আর তার ওপরে লেখা রয়েছে স্পষ্ট দেবনাগরী হরফে। কালো কালিতে লেখা মুক্তাক্ষর।

একদম শেষের দিকের পৃষ্ঠায় চলে গেলেন গেলেগ। একটি নির্দিষ্ট পৃষ্ঠা খুলে গুরুগম্ভীর সুরে পড়ে গেলেন এবং তার ইংরেজি তর্জমা করে বুঝিয়েও দিলেন যে, এই মহাপবিত্র পুঁথি বা তার মন্ত্রসমূহের স্থানান্তর বা হস্তান্তর ঘটলে স্থানান্তরকারীর ভয়ংকর মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।

আমার একটু খটকা লাগল। আমি গেলেগকে প্রশ্ন করলাম, “এর স্থানান্তর তো অনেকেই করেছে। স্বর্ণাভ নিজে করেছেন, যারা পৃষ্ঠাগুলোর ছবি পাচার করেছে তারাও করেছে, তবে মৃত্যু একা নেমায়েভের হবে কেন?”

গেলেগ হাসলেন। “আপনি সঠিক জানেন ছবি পাচারকারীরা বেঁচে আছেন?”

আমি বোকার মতো মাথা নাড়লাম। গেলেগ আবার বললেন, “স্বর্ণাভ পুঁথি স্থানান্তর দু’বার করেছেন। একবার নিজের ছেলের মাধ্যমে ক্যালমিনিয়ান গেলুক মঠের ভেতরেই, আরেকবার আমার হাতে এবং তাও গেলুক মঠের মধ্যেই এবং সেটি আবার খোদ পদ্মসম্ভবের স্পর্শধন্য মঠ। একমাত্র নেয়ামেভই পুঁথিটির হস্তান্তর করে দেবস্থানের বাইরে এবং নিহত হয় দোর্জে পেহার তথা গেলুক সম্প্রদায়ের বিদ্রোহী দেবতা দোর্জে শাংডেনের হাতে। সে পুঁথির সুরক্ষার অংশটি পড়েনি কারণ, স্বর্ণাভ সেটি মিররোগ্রাফে নকল করার সময় পাননি। হতভাগ্য নীলাভ। উফ্, কী ভয়ানকই সে মৃত্যু হয়েছিল! তথাগত কি পারবেন তার আত্মাকে শান্তি দিতে?”

“আমি দেখেছি নেমায়েভের টুকরো হওয়া দেহ।” নিত্য বলে উঠল, “সে ভয়ংকর মৃত্যু!”

গেলেগ আর্তনাদ করে উঠলেন, “না! না! মৃত্যু নয়। দোর্জে শাংডেনকে সামনে থেকে দেখতে পাওয়া মৃত্যুর চেয়েও দুর্বিষহ। মৃত্যুর পরও অসীম অনন্ত সময় পর্যন্ত মৃতের আত্মা ভয়ে আকুল হয়ে থাকে তাকে দেখলে।”

আমি শিউরে উঠলাম। বিশাল কোনও পায়ের চাপে গুম্ফা সামিয়ে দুলে উঠল কি?

গেলেগ উঠে দাঁড়িয়েছেন। চিন্তিত মুখে বললেন, “তারিণীচরণ আর স্বর্ণাভের স্বপ্ন কি পূর্ণ হবে? স্বর্ণাভের একমাত্র বংশধর মৃত। তারিণীচরণের বংশ কে জানে কোথায়।”

নিত্য গলা খাঁকারি দিয়ে গেলেগের দিকে তাকাল। তিনি চলে যাচ্ছিলেন। নিত্য স্পষ্ট স্বরে বলে উঠল, “গেলেগ, আমরা তারিণীচরণেরই পৌত্র। আর আপনাকে আমরা আঙ্কল নয়, গ্র্যান্ডপা বলে ডাকব।”

এবার গেলেগের চমকে যাওয়ার পালা। কিছুক্ষণ নিত্যের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে তিনি ধপ করে বসে পড়লেন গদি-আঁটা সোফার উপরে।

চার

পুব, উত্তর আর দক্ষিণে কোনও জানালা নেই এই ঘরের। একটিই মাত্র বড়ো কাচের জানালা আর সেটি পশ্চিমে। তাই সকালের রোদে নয়, মঠের গুরুগম্ভীর রামশিঙার শব্দে ঘুম ভাঙল আমার। বৌদ্ধদের প্রার্থনার ব্যাপারটি ভারি সুন্দর। যে যখন খুশি বুদ্ধদেবের ছবি বা মূর্তির সামনে প্রার্থনা করতে পারে। সেটি দিনের যেকোনও সময় হতে পারে। এমনকি যে কেউ লামার অনুপস্থিতিতেও এই স্তবস্তুতি করলে অন্যায় হয় না। এ নিয়ম থেরবাদ ও মহাযান উভয়ক্ষেত্রেই বর্তমান।

আমি হাড় কাঁপানো জলে মুখহাত ধুয়ে বাইরে এলাম। নিত্য সেই যে জামাকাপড় মোজা পরে শুয়ে ছিল, তেমনটিই রইল। শুধু ব্রাশটা করে নিল এই যা। কাল অনেক রাত পর্যন্ত শুয়ে শুয়ে আমাদের ছোটোবেলার কথা ভেবেছি। একেই নতুন জায়গায় আমার ঘুম হয় না, তার ওপর মঠে দরজা বন্ধ করার নিয়ম নেই। আমার কেবল মনে হচ্ছিল বাইরের ছায়া ছায়া অলিন্দে আবছা কুয়াশা নিঃশ্বাস ফেলে এক এক করে প্রদীপগুলো নিভিয়ে দিচ্ছে আর একটা বিশাল থাবা এগিয়ে আসছে আমাদের ছিন্নভিন্ন করে উপত্যকায় ছড়িয়ে দেওয়ার অভিসন্ধি নিয়ে।

নিত্য দেখলাম বেশ আরামেই ভোঁস ভোঁস করে ঘুমিয়ে নিল। কত পালটে গেছে সে। ছোটোবেলার সেই ভিতু ভিতু বোকা বোকা নিত্য সম্পূর্ণ বদলে গেছে। ইউরোপের জলহাওয়ার গুণ মানতেই হবে। চোখমুখ ধুয়ে বাইরে বেরিয়ে আসার পর নিত্যকে তরতাজা লাগছিল। ওদিকে রাত জাগার পর ঠাণ্ডা হাওয়া আর রোদ লেগে আমার চোখ জ্বালা করে উঠল।

সকাল সাতটা। এর মধ্যেই বেশ কয়েকজন ট্যুরিস্ট হাজির হয়েছে। ফটাফট ছবি তুলছে চারদিকের। একজন দণ্ডী কেটে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে করতে প্রদক্ষিণ করছে মন্দির। এতক্ষণে মন্দিরটি ভালো করে দেখার সুযোগ পেলাম।

ওদন্তপুরী বৌদ্ধবিহারের আদলে তৈরি এই মঠ। পরে এই গঠনশৈলী অনুসরণ করে চিন, কোরিয়া এবং ইটালিতেও তৈরি হয়েছে গেলুক সম্প্রদায়ের আরও বৌদ্ধমঠ। ঘুরতে ঘুরতে পশ্চিম প্রাকারে যখন পৌঁছলাম, দক্ষিণদিকের শোর্তেনের পাশ থেকে হাসিমুখে চের-পা এগিয়ে এলেন। অভিবাদন করে সুপ্রভাত জানালেন মানুষটি। আমরাও প্রতি অভিবাদন জানালাম। তিনি উপযাচক হয়ে বললেন, “আসুন, আমি আপনাদের এই আশ্চর্য মন্দির ঘুরিয়ে দেখাই।”

গাঢ় নীল এই আকাশ বোধহয় তিব্বতের নিজস্ব আকাশ। নীল আকাশ তো আমাদের দেশেও দেখতে পাই। কিন্তু এমন চোখ ধাঁধানো নীল এখানেই দেখছি। নিত্যর মুখে শুনেছি ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলির আকাশও নাকি এমন উজ্জ্বল নীল। চের-পা বলে চলেছেন, “বৌদ্ধ মহাবিশ্বের যে কল্পনা আদিগুরুরা করে গেছেন, তার আদলে সামিয়ে মঠ তৈরি হয়েছে। এটি বৌদ্ধ ব্রহ্মাণ্ডের একটি চতুস্তলক গঠন। ভারতবর্ষ থেকে আহৃত অন্যতম তান্ত্রিক প্রথা রমলতত্ত্ব প্রয়োগ করা হয়েছিল মন্দির নির্মাণের সময়।”

নিত্য জিজ্ঞাসা করল, “রমলতত্ত্ব ব্যাপারটা কী?”

চের-পা জানালেন, “মুষ্টিপ্রমাণ মাটি বা অন্যান্য জাগতিক উপাদান থেকে বিরাট কোনও স্থাপত্য নির্মাণই হলো রমলতত্ত্ব। এই মত অনুসারে তিব্বতী বৌদ্ধব্রহ্মাণ্ডের একদম ওপরে অবস্থিত একটি দৈবী প্রাসাদ। প্রাসাদটি নির্মিত হয়ে ‘মেরু’ নামে একটি পর্বতশৃঙ্গের ওপর। সামিয়ের মূল মন্দিরগৃহ হল সেই প্রাসাদ। তাকে ঘিরে রয়েছে বিরাট মহাসমুদ্র অর্থাৎ সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড। মহাসমুদ্রের মধ্যে আবার রয়েছে চারটি মহাদেশ এবং আটটি উপমহাদেশ। মন্দিরের চারকোণে যে চারটি বিশাল পবিত্র শোর্তেন দেখতে পাচ্ছেন সেগুলি ওই মহাদেশের প্রতীক। সমস্ত মন্দির চত্বর ঘেরা আছে একটি প্রাচীর দিয়ে। আর প্রাচীরের গায়ে রয়েছে চারটি প্রবেশদ্বার আর ১০০৮টি ছোটো ছোটো শোর্তেন। এই শোর্তেনগুলি হল ‘চক্রবাল’ নামে বিশাল পর্বতমালার প্রতীক যা মহাব্রহ্মাণ্ডের সীমানা হিসেবে কল্পনা করা হয়।”

আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে  শুনতে  মন্দিরের একেবারের বাইরের দরজার কাছে চলে এসেছি প্রায়। আমাদের সামনে বিরাট উঁচু উঁচু কয়েকটি স্তম্ভ। আর তাদের সম্পূর্ণটাই কালো কাপড়ে মোড়া। গেলেগের বর্ণনা অনুযায়ী এই স্তম্ভগুলোই হলো পদ্মসম্ভবের স্থাপিত সেই বজ্রকীলক। কিন্তু এতে তো রঙবেরঙের মন্ত্র লেখা কাপড় জড়ানো থাকার কথা। কালো কাপড় থাকাটা তো স্বাভাবিক নয়। চের-পাকে সে কথা বলব ভেবে তাঁর দিকে ঘুরতেই দেখি তাঁর মুখ কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে। ঠোঁটদুটো কাঁপছে থরথর করে। আমি বেশ কয়েকবার ডাকার পর তাঁর সম্বিৎ ফিরল। পড়িমরি করে তিনি ছুটলেন মূল মন্দিরের উদ্দেশ্যে। তার পেছনে আমরাও।

ছুটতে ছুটতেই টের পেলাম সমস্ত উপত্যকা একবার কেঁপে উঠল। আর পশ্চিমের আকাশ ও দিগন্ত জুড়ে মেঘ ছেয়ে ফেলল। তার রঙ পোড়ামাটির মতো লালচে কালো। সাধারণ বর্ষার মেঘ নয় এ।

রামশিঙা আর ঝাখরি বেজে উঠল গুরুগম্ভীর সুরে। মন্দিরের ভিতরে একটা ভ্যাপসা গরম। একটা দমবন্ধ করা আঁশটে গন্ধ ধূপের পবিত্র গন্ধকে ছাপিয়ে ছেয়ে যাচ্ছে সর্বত্র।

গেলেগ নিজে বেরিয়ে এসেছেন প্রার্থনা সভা ছেড়ে। চোখের দৃষ্টি পাগলের মতো। মুখের অভিব্যক্তিতে মনে হয়, যেন কোনও মহা ভয়ংকরকে তিনি সামনে থেকে দেখেছেন। নিত্যকে দেখতে পেয়েই তিনি চিৎকার উঠলেন, “তোমার ঘর খোলা রেখেছিলে কেন নির্বোধ?”

নিত্য হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “মঠের দরজা বন্ধ করার নিয়ম নেই বলেই তো জানি!”

“সে সাধারণের জন্য। যার কাছে বিশ্বের সবচেয়ে মারণগ্রন্থটি রয়েছে, তাকে সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। ওহ্, নোরবু, নোরবু, বিশ্বাসঘাতক! এ যাত্রা তথাগত রক্ষা করলে নোরবুকে জংলি ঈগলের উপত্যকায় বেঁধে ফেলে রাখব।”

গেলেগের হতাশার আর্তনাদ আরও আরও করুণ হয়ে উঠল। নিত্য তাঁর কাছে গিয়ে নরম সুরে বলল, “গ্র্যান্ডপা গেলেগ, কী হয়েছে বলুন আমাকে। আমি যতদূর পারি এর সমাধানের চেষ্টা…”

বিদ্রুপের হাসি হেসে উঠলেন গেলেগ। “নির্বোধ বালক! তুমি করবে শাংডেনের মোকাবিলা? দেখছ না বিশ্বাসঘাতক নোরবু তোমার পুঁথি চুরি করে শাংডেনকে জাগিয়ে তোলার মন্ত্র করায়ত্ত করেছে? রাতারাতি কালো কাপড়ে ঢেকে দিয়েছে পবিত্র বজ্রকীলকের সারা দেহ। দেবতাদের আশীর্বাদ দৃষ্টি আর দেখতে পাচ্ছে না এই অভিশপ্ত সামিয়ে মন্দিরকে। এবার এক এক করে সব ধ্বংস হবে, সব।”

আমি আর্তনাদ করে বললাম, “কিন্তু চীরপুঁথিতে তো শাংডেনকে প্রতিহত করার উপায় লেখা আছে। তবে আর ভয় কী?”

গেলেগ উন্মত্ত হয়ে উঠলেন। “বুদ্ধিহীন ছেলে! তুমি কি এ কোনও রান্নার রেসিপি পেয়েছ যে এই দিলাম ওই দিলাম আর আগুনে বসিয়ে দিলাম, আর হয়ে গেল? জানো শাংডেনেয়ের প্রতিরোধ করতে গেলে তন্ত্রমতে দীক্ষা প্রয়োজন? প্রয়োজন প্রকৃত মহাজ্ঞানীর দীক্ষা। কী আছে তোমাদের, দুর্বল মানুষ?”

নিত্য সুগম্ভীর গলায় উচ্চারণ করল, “তন্যতে বিস্তার্যতে জ্ঞানম্ অনেন্, ইতি তন্ত্রম্। অর্থাৎ, তন্ত্র হল সেই শাস্ত্র যার দ্বারা জ্ঞানের বিস্তার করা হয়। তন্ত্রের নিরুক্তি ‘তন’-এর অর্থ বিস্তার করা এবং ‘ত্রৈ’ রক্ষা করা, এই দুই ধাতুর সংযোগে সিদ্ধ হয়। অর্থাৎ, তন্ত্র সামগ্রিকভাবে জ্ঞানের বিস্তার করা ছাড়াও এর ব্যবহারকারীকে ‘ত্রাণ’ বা রক্ষাও করে। এর উল্লেখ স্বয়ং ঋগ্বেদে আছে, এই চীরপুঁথি রচিত হওয়ার অনেক আগে তা রচিত হয়েছে। আর গুরুর কথা বলছেন গ্র্যান্ডপা? বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো গুরুটির আদর্শেই আমরা ছোটো থেকে বড়ো হয়েছি। তাঁর মতেই চলেছি আমরা সম্পূর্ণ পরিবার। মানুষের মধ্যে থেকে মানুষের কল্যাণসাধনের চেষ্টা করেছি আমরা। আপনি বলুন গেলেগ, ঠাকুরকর্তার চেয়ে বড়ো গুরু কে আছেন এ বিশ্বসংসারে। আপনি পথ দেখান, আমরা প্রাণ দিয়ে হলেও এর শেষ দেখে ছাড়ব।”

গেলেগের দেহটি থরথর করে কাঁপতে লাগল। তিনি বসে পড়লেন পাথুরে মেঝের ওপর। কিছুক্ষণ লাগল সামলে নিতে। তারপর জ্বরগ্রস্ত গলায় বলা শুরু করলেন, “গুরু পদ্মসম্ভব যে আটজন ক্রুদ্ধ বোধিসত্ত্ব বা হেরুকের উল্লেখ করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বজ্রকীলয়। আর সামিয়ে মন্দির তৈরির সময় গুরু পদ্মসম্ভব স্বয়ং বজ্রকীলয়কে অধিষ্ঠান করে গেছেন এ মন্দিরের রক্ষাকর্তা হিসেবে। দোর্জে পোহার তাঁর নির্দেশেই এ মঠ সুরক্ষিত। বজ্রকীলয়ের প্রতীক ছিল ওই দীর্ঘ স্তম্ভগুলি আর তাদের দেহে মোড়ানো মন্ত্রপূত বস্ত্রখণ্ড থেকে মহামন্ত্র ছড়িয়ে পড়ত উপত্যকায় এবং অপদেবতাদের হাত থেকে রক্ষা করত মন্দির তথা উপত্যকাবাসীদের। বিশ্বাসঘাতক নোরবু ওই স্তম্ভগুলিকে ঢেকে দেওয়ায় বজ্রকীলয় বস্তুত অন্ধ। তাই শাংডেন অনায়াসে ধ্বংস করতে পারেন এই মঠ আর ওই চীরপুঁথি যাতে শাংডেনকে প্রতিহত করার উপায় বলা আছে।”

চের-পা উদ্ভ্রান্তের মতো প্রশ্ন করলেন, “কিন্তু শাংডেন তো সপ্তদশ শতকের একজন ভ্রান্ত সন্ন্যাসীর আত্মামাত্র! তার মধ্যে এই অপার শক্তি কী করে আসা সম্ভব?”

স্থান-কাল-পাত্র ভুলে চিৎকার করে উঠলেন গেলেগ, “তার মানে তুমি বলতে চাও আদিবুদ্ধ তথাগতও হাজার দুয়েক জন্মানো এক সাধারণ মানুষমাত্র? শাংডেন স্বয়ং মঞ্জুশ্রীর শক্তি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। প্রধান বোধিসত্ত্বের একজন তিনি। সকল পরাবিদ্যা ও পরাজ্ঞানের অধিষ্ঠাতা দেবতা। তাঁর সমকক্ষ অবলোকিতেশ্বর এই মঠের প্রধান পূজ্য দেবতা।”

কান ফাটানো একটা বজ্রপাতের শব্দ হল। নীল সাদা আলো আকাশ চিরে নেমে এল মাটিতে আর প্রাচীরের পাশের শুকনো বার্চগাছটা জ্বলে উঠল দাউদাউ করে। তারই মধ্যে একটা রক্তাপ্লুত চমরী গাইয়ের মাথা হাতে নিয়ে মন্দিরের প্রধান দরজা দিয়ে প্রবেশ করল নোরবু। কী ভয়ানক তার মূর্তি! দেহের পোশাকের অবশিষ্টাংশ আর হাঁটাচলা দেখে বোঝা যাচ্ছে সে নোরবু। বাকি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঙ্গে জীবিত মানুষের শরীরের বিন্দুমাত্র মিল নেই। কপালে আরও একটা লাল টকটকে চোখ দেখা যাচ্ছে। নাক দিয়ে বেরিয়ে আসছে ধোঁয়া ধোঁয়া বাষ্প। ডানহাতে ঝকঝক করছে একটা ভয়ানক তলোয়ার। সেটি রক্তমাখা। লম্বায় আরও বেড়ে উঠেছে নোরবু। পায়ের চাপে বারবার কেঁপে উঠছে মাটি।

সমস্ত আকাশ ছেয়ে এসেছে লালচে কালো মেঘে। বারবার আগুনের চাবুকের মতো আছড়ে পড়ছে বিদ্যুৎশিখা। আমরা একটা বিরাট স্তম্ভের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। গেলেগের ঠোঁট শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। চের-পা সংজ্ঞাহীন। একমাত্রই নিত্যকেই দেখলাম অনেকটা স্বাভাবিক। সে ফিসফিস করে বলল, “গ্র্যান্ডপা গেলেগ, আপনি চীরপুঁথি পাঠ শুরু করুন। আর আমাদের করণীয় বলে দিন।”

গেলেগের চোখদুটো জ্বলে উঠল। তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। আমাদের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “আমি পাঠ শুরু করছি। তোমরা যে করেই হোক ওই তিনটি স্তম্ভের কালো কাপড়ের আবরণ উন্মোচন করো।”

তিনি গুপ্তকক্ষের দিকে চলে গেলেন। প্রচণ্ড ঝড় বইছে বাইরে। তাতে ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি হয়েছে। মন্দির প্রাঙ্গণে ছিটকে পড়ছে অসংখ্য পশুপাখির মৃতদেহ। রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে চতুর্দিকে। ইয়ারলুং নদীর জল ফুঁসতে ফুঁসতে উঠে এসেছে মন্দিরের প্রাকার পর্যন্ত। তার জলের রঙও টকটকে লাল রক্তের মতো।

রক্তের স্রোত ঠেলে আমরা এগিয়ে গেলাম স্তম্ভগুলোর দিকে। প্রাচীরের একটা অংশ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল নোরবুরূপী শাংডেন। বড়ো বড়ো পাথর ছিটকে পড়ল। আমি আর নিত্য প্রাণপণে ছিঁড়ে ফেলতে লাগলাম কালো কাপড়ের আবরণ।

গর্জন করে উঠলো নোরবু। সে আমাদের দেখতে পেয়েছে। গর্জন করে সে এগিয়ে এল আমাদের দিকে। দুটো বড়ো বড়ো শ্বদন্ত বেরিয়ে এসেছে ঠোঁটের দু’পাশ দিয়ে। লাল চুলগুলো বিশাল আকার নিয়ে হাওয়ায় উড়ছে।

আমার মধ্যে একটা ভয়ংকর পাগলামি কাজ করছে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও স্তম্ভ থেকে কালো কাপড় সরিয়েই যাচ্ছি। এ যেন আমি করে আসছি অনাদিকাল থেকে। সৃষ্টির শুরু থেকে এই কালো অন্ধকার উন্মোচনই যেন আমার কাজ। রক্তের স্রোত ঠেলে এগিয়ে আসছে ভয়াল দেবতা। এ মন্দিরে আজ বলি হতে চলেছে অনেক তাজা প্রাণ আর তার মধ্যে আমিও একজন।

নেময়াভের দেহটা আমার মনে পড়ল। অন্তরাত্মা শুকিয়ে আসছে আমার। শ্বাসপ্রশ্বাসে অসম্ভব কষ্ট।

ওই তো! ওই তো নিত্য! পশ্চিমপ্রান্তের স্তম্ভটি থেকে দ্রুত হাতে ছিঁড়ে ফেলছে কালো কাপড়ের আস্তরণ। আর উত্তর প্রান্তের স্তম্ভের কাছে চের-পা। তার ঠিক সামনে শাংডেনরূপী নোরবু। থমকে দাঁড়াল ভয়াল রাক্ষস। লম্বা হাত দিয়ে চেপে ধরল চের-পার গলা। হ্যাঁচকা টানে দু্র্বল বৃদ্ধকে তুলে নিল শূন্যে। আমি ভয়ে চোখ বুজে ফেললাম।

কিন্তু যে মর্মান্তিক মরণ চিৎকার শোনার জন্য কান তৈরি হয়েছিল, তা শুনতে পেলাম না। তার বদলে শুনতে পেলাম এক জান্তব গর্জন।

চোখ খুলে দেখি চের-পা সুস্থ শরীরে একপাশে পড়ে আছেন থৈ থৈ রক্তের মধ্যে। আর তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সম্পূর্ণ কৃষ্ণ আবরণ মুক্ত দৈবী বজ্রকীলয়। শাংডেনের প্রবল টানে চের-পার দেহের সঙ্গে স্তম্ভের কালো কাপড় খুলে এসেছে আর দানব মুহূর্তের জন্য থমকে গেছে।

এমন সময় এক গুরুগম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণ শুনে মন্দিরের দিকে তাকালাম। গেলেগ চীরপুঁথিটি হাতে নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। উচ্চকন্ঠে উচ্চারণ করছেন পবিত্র মন্ত্র।

ওঁ বিশ্বায় নাম গন্ধর্বলোচনি নামি।

লৌসাতিকর্ণাই ত্যস্মি বিশ্বাস স্বাহাঃ।।

একই সঙ্গে একটি পাত্র থেকে মুঠো মুঠো ছাই ছুড়ে দিচ্ছেন দানবের দিকে। তার মূর্তি আরও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে এখন। ক্ষোভ, ব্যর্থতা, ক্রোধে সে এখন পারলে ছিঁড়ে টুকরো করে দেয় সমস্ত পৃথিবীকে। তার হাতের আঘাতে একটুকরো পাথর এসে লাগল আমার মাথায়। মাথা থেকে দরদর করে নেমে এল রক্তের ধারা। নিত্য আমার কাছে ছুটে আসার উপক্রম করতেই গেলেগ প্রাণপণে মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে হাত তুলে তাকে নিরস্ত করলেন।

নদীর জল প্রাচীরের ওপরে ফুঁসে উঠেছে। একটু পরেই ঝাঁপিয়ে পড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সমগ্র মন্দির চত্বর। আমার চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসছে। সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে আমি স্তম্ভের শেষ আবরণটুকুও খুলে নিলাম। নিত্যের কাজও শেষ।

শেষবারের মতো মন্ত্রোচ্চারণ করে একমুঠো ছাই গেলেগ ছুড়ে দিলেন শাংডেনের গায়ে। আর্তনাদ করে উঠল শাংডেন। থরথর করে কেঁপে উঠল চতুর্দিক।

স্তম্ভ তিনটি থেকে তিনটে আলোর রেখা বেরিয়ে এল। তারপর তারা একই সঙ্গে আছড়ে পড়ল দানবের দেহে। এক অদৃশ্য বন্ধনে বেঁধে ফেলল তাকে। যত বেশি দানব সে বাঁধন খুলে ফেলতে চাইল, আরও আরও বেশি বাঁধা পড়তে লাগল তাতে।

মুহূর্তের অপেক্ষা।

মন্দিরের চূড়ায় মেঘ ছিঁড়ে রোদ পড়ল। ঝলমল করে উঠল কালো দিগন্ত। রক্তস্রোত উধাও হয়ে গেল। দূর হল দুর্গন্ধ। বার্চগাছে ঝিকিয়ে উঠল সবুজ পাতার ফলক।

চতুর্দিকে আবার পরম শান্তি। শুধু নোরবু কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ল গেলেগের পায়ে। কঠিন স্বরে লামা তাকে বললেন, “শাংডেনকে প্রতিহত করা যায়। সম্পূর্ণ পরাস্ত করা যায় না। তোমার মতো ক্ষমতালোভী, অসৎ মানুষই শাংডেনের কদর্য রূপকে জাগিয়ে তোলে। কতটা প্রতিকার আজ হল আমি জানি না, তবে এ-মঠে আর তোমার জায়গা নেই নোরবু।”

অশ্রুসিক্ত চোখ মুছতে মুছতে নোরবু বেরিয়ে গেল।

আকাশ আবার নীল। গেলেগ আমাদের জড়িয়ে ধরলেন।

নদীর কুলকুল শব্দ আবার কানে আসছে। বড়ো মধুর সেই জলতরঙ্গের সঙ্গীত। উপত্যকায় অপার নিস্তব্ধ শান্তি ছড়িয়ে পড়ছে। আবার জনজীবন আগের মতোই সুন্দর হয়ে উঠবে।

আর মাটির অনেক গভীরে বা আকাশের অনেক উচ্চতায় উপেক্ষিত ধর্মপাল নিরুদ্ধ ক্ষোভে নিঃশ্বাস ফেলবেন মানুষের পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে। সুযোগ খুঁজবেন মানুষের লোভ আর পাপের মাধ্যমে ফিরে আসতে। কারণ, মানুষের লোভের চেয়ে বড়ো অপশক্তি এ বিশ্বে আর কিচ্ছু নেই।

অলঙ্করণঃ শিমুল

 জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s