অমর মিত্রের অন্যান্য গল্পঃ তেঁতুলে শ্রীমধুসূদন, দলমা মশায়, চম্পকলাল, পিসি সরকারের ম্যাজিক, ভূত ও মানুষ, সাত রঙের পাখি, গগন বুরুর কঞ্চি ডাকাত
প্রজাপতি
অ্যাকারবেজ ছোট্ট মেয়ে। তার বাবা ব্যবসার কাজে নূর সুলতান* শহরে গিয়েছিলেন। ফেরার সময় বাস স্টপে যখন অপেক্ষা করছিলেন, প্রবল বৃষ্টি এল। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর গায়ে বাড়ি ফিরলেন।
ইস, তোমার খুব ঠান্ডা লেগে গেল…! অ্যাকাবেজের মা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন।
হুঁ, ক’দিন গরম স্যুপ এবং লেবু দেওয়া গরম চা পেলেই সেরে যাবে। বাবা বললেন।
তাহলে আমাকে কাজ থেকে ২-৩ দিনের ছুটি নিয়ে নিতে হয় তোমাকে দেখার জন্য। মা বললেন।
না, তার দরকার নেই, তোমার কাজ তুমি কর। এখন অ্যাকারবেজের ছুটি চলছে, তুমি কাজে যাওয়ার আগে যদি স্যুপ তৈরি করে দিয়ে যাও, আমার মেয়ে লেবু চা তৈরি করে দিতে পারবে।
কিন্তু সে ছোট্ট, ভয় হয় আগুনে পুড়ে না যায়।
আমার মেয়ে তার মায়ের মতোই চটপটে। হেসে বললেন অ্যাকারবেজের বাবা যদিও তখনো তাঁর অসুস্থতা যায়নি।
পরের দিন অ্যাকারবেজের মা তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে স্যুপ তৈরি করে কাজে গেলেন। কয়েক ঘন্টা বাদে খুব ভালো ঘুমের পর যখন বাবা গরম স্যুপে চুমুক দিচ্ছিলেন, ক্লাস ফোরের অ্যাকারবেজ বাবার জন্য চা তৈরি করল। যখন চা ভিজিয়ে দিয়েছিল গরম জলে, বেরিয়ে গিয়ে লেবু নিয়ে এল কাছের দোকান থেকে। বাবার কাছে লেবু চা পৌঁছে গেল।
আমার ভালো মেয়েকে ধন্যবাদ, আমি ঘামছি, জ্বর ছাড়ছে, এখন অনেক ভালো মনে হচ্ছে গরম স্যুপ এবং চা পান করে।
সেই দিন সন্ধ্যায় মা ফিরে পুডিং তৈরি করলেন। পুডিং তৈরির সব কিছু প্রস্তুত ছিল। অ্যাকারবেজই তা করে রেখেছিল। পরের সকালে অ্যাকারবেজ সসপ্যানে জল ফুটিয়ে নিল। বাবা তখন উঠে পড়েছেন। তিনি গরম জলে পুডিঙের উপাদান দিয়ে রান্না করলেন। তার ভিতরে হলুদ ফুলের সব্জি এবং কাঁচা পিঁয়াজ ছড়িয়ে দিয়ে গ্যাস স্টোভ বন্ধ করলেন। আজ বাবা স্যুপের ভিতরে গোল মরিচের গুঁড়ো মিশিয়ে দিলেন, আগের দিনের চেয়ে তাঁর ঘাম বেশি হলো। জ্বর চলে যাচ্ছে। সুতরাং মেয়ে দেখল বাবা তাঁর নিজের পথ্য নিজেই তৈরি করছেন। সে বাবাকে লেবু চা তৈরি করে দিল। জ্যাম এনে দিল। এইসব করতে করতে বাবা ২-৩ দিনের ভিতর সুস্থ হয়ে গেলেন।
সেই থেকে বাবা তাঁর ছোট্ট মেয়েটিকে ‘আমার শাদা প্রজাপতি’ বলে ডাকতে লাগলেন। অ্যাকারবেজ প্রজাপতির মতোই এ ঘর ওঘর করত সেই সময় যাতে তার বাবা দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন।
( * কাযাখস্তান দেশের রাজধানী )
২
ছোট্ট কর্তা মশায়
শ্রীযুক্ত দৌলেত এবং শ্রীমতী রিস্তি আমাদের প্রতিবেশী। ওঁরা আমাদের দাচা*-র ডানদিকে বাস করতেন। দুজনেই বছর ৪-৫ অবসর নিয়েছেন। দুজনেই ভালো বাগান করতে পারেন। দুজনেই আনন্দময়, আনন্দময়ী। সেই কারণে তাঁদের নাতি-পুতিরা মাঝে মাঝে তাঁদের দেখতে আসে। হ্যাঁ, বড় হয়ে ওঠা নাতি-নাতনিরা তাঁদের ঠাকুরদা ঠাকুরমাকে কিছু সাহায্য করে। বসন্তের আরম্ভ এবং হেমন্তের শীতে বৃদ্ধ বৃদ্ধার পক্ষে জমিতে কাজ করা সহজ নয়। বাগানে মাটি কোপান, বাগান পরিষ্কার করা, জমিতে নিড়েন দেওয়া, ঘাস এবং লতাগুল্ম থেকে জমি পরিষ্কার করা এবং গাছে জল দেওয়া–কত কাজ! সুতরাং শ্রীযুক্ত দৌলেত এবং শ্রীযুক্তার প্রাপ্তবয়স্ক নাতি-নাতনিরা ঐ সময় তাঁদের সঙ্গে থেকে তাঁদের বাগানের কাজে সাহায্য করত যখন যেমন প্রয়োজন হত। কিন্তু এমন নাতি-নাতনিরাও ছিল যারা কিছুই করত না। বিশেষত, ইয়েরখান, যার বয়স পাঁচ বছর, সে যেন কর্তার মতো চলাফেরা করত। প্রতিবার যখন সে তার বাবা-মার সঙ্গে আসত দাদু-ঠাকুমাকে দেখতে, সে বাগানে পা দিয়েই খাওয়ার বায়না জুড়ত।
–দাদু, ফুটি পেকে গেছে তো ?
–নিশ্চয়, তুমি দেখ না পেকে গেছে কি না।
–দাদু আমি তরমুজ খেতে এসেছি।
–এ তো দারুণ ব্যাপার বাবা, এখনই আমি বড় তরমুজ কেটে দেব তোমাকে।
–ঠাম্মা, আমি চেরির শরবত খেতে চাই।
–এস বাবা, খাও তুমি চেরির শরবত, গতকালই আমি তৈরি করেছি তুমি আজ আসবে বলে।
–ঠাম্মা স্ট্রবেরির আচারের কী হলো ?
–তাও তৈরি আছে সোনা, কিন্তু ওটা রুটির সঙ্গে খেও, না হলে তোমার দাঁত কষে যাবে।
সুতরাং এই ভাবে শ্রীযুক্ত দৌলেত এবং শ্রীযুক্তা রিস্তি সব কাজই করেন যা তাঁর নাতি-নাতনিরা আদেশ করেন। যখন আমি সেই বাচ্চাটিকে দেখি, মনে হয় এই কর্তা মশায় বড় হয়ে কি তার দাদু-ঠাম্মার কথা মনে রাখবে, যেমন তাঁরা তার কথা সব সময় মনে রাখেন।
(* গ্রামের বাড়ি)
[ কাযাখস্তানের এই গল্পদুটিতে ঐ দেশের সরল জীবন আমাকে ছুঁয়ে গেছে। মনে পড়ে যাচ্ছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সেই সব গল্প যা শৈশব করেছিল মধুর। তাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই অনুবাদ। আমাদের শিশু সাহিত্যের রূপ বদলে গেছে। এত হিংসা-প্রতিহিংসা! সেখানে এইসব গল্প অন্য মাত্রার মনে হয়।-অনুবাদক]