শতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য
শতবর্ষে হেমন্ত
শর্মিষ্ঠা ভট্টাচার্য
সাংবাদিক। সঙ্গীত বিশারদ – ভীষ্মদেব মেমোরিয়াল ট্রাস্ট।
কতই বা বয়স তখন। সবেমাত্র ক্লাস এইট। রেডিওতে ছায়াছবির গান শোনার একটা আকর্ষণ মনে মনে বাসা বাঁধছিল একটু একটু করে। এদিকে উঠতি বয়সের কন্যাটি রেডিওতে ভেসে আসা কোনও ফিল্মি গান শুনে উচ্ছন্নে যাবে আশঙ্কায় বাবার রক্তচক্ষু সবসময় পাহারা দিত। মাঝে মাঝে দাদাদের সঙ্গে গিরিশচন্দ্র, সুভাষচন্দ্র, বাড়ি থেকে পালিয়ে, কাগজের বাঘ, থ্রি মাস্কেটিয়ার্স টাইপ সিনেমা দেখতে যাওয়ার অনুমতি মিললেও রোম্যান্টিক সিনেমা দেখতে যাবার অনুমতি পাব, এমন আশা ছিল না। মনে আছে, মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হবার পর প্রথম উত্তম-সুচিত্রা জুটির সিনেমা দেখার অনুমতি মিলেছিল। অথচ চোখের সামনে প্রিয় বন্ধুদের বাবারা যখন নিজের হাতে তাঁদের মেয়েদের জন্য সিনেমার টিকিট কেটে এনে দেখতে যেতে বলতেন, লজ্জায় অপমানে রাতে লুকিয়ে বালিশ ভেজানো ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। মনটা তখন উড়ুউড়ু, বয়সটা সবেমাত্র টিন-এজের দ্বারপ্রান্তে করাঘাত করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। বসন্তের দখিনা বাতাস মনে নেশা ধরায়। বাবাকে লুকিয়ে একটু ফাঁক পেলেই রেডিওতে ছায়াছবির গানের আসর খুলে বসতাম। কী অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ তখন! হেমন্ত মুখার্জী, শ্যামল মিত্র, মান্না দে, সন্ধ্যা মুখার্জী, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, আরতি মুখার্জী—একটার পর একটা গান যেন ভেতরটাকে নাড়িয়ে দিত। আর মনে মনে কল্পনা করতাম, যদি এই শিল্পীদের কোনও অনুষ্ঠান সামনে বসে শুনতে পেতাম!
স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথেই গুনগুন গাইতাম, ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন’ কিংবা ‘কতদিন পরে এলে একটু বোসো’। হেমন্ত মুখার্জী তখন হার্ট-থ্রব। খবরের কাগজ বা কোনও ম্যাগাজিনে ওঁর ছবি দেখলেই কেটে নিয়ে লুকিয়ে রাখতাম শরৎচন্দ্রের কোনও এক উপন্যাসের পাতার ভাঁজে, যেসব উপন্যাস তখনও প্রকাশ্যে পড়ার অনুমতি ছিল না। সাদা ধুতি, হাতা গোটানো বাংলা হাওয়াই শার্ট পরা দীর্ঘদেহী সুপুরুষ সুদর্শন এই চেহারাটিকে মনে মনে হিরো বানিয়ে ফেলেছিলাম। শয়নে স্বপনে তাঁরই চিন্তা। সুযোগ পেলেই মায়ের অনুমতি নিয়ে বাবার চোখ রাঙানিকে লুকিয়ে রেডিওর বোতাম ঘুরিয়ে তাঁর গলা শুনতাম। চুম্বকের মতো টানত আমায়। এরপর মাধ্যমিক পরীক্ষার পর যখন প্রথম বন্ধুদের সঙ্গে হলে গিয়ে সিনেমা দেখার অনুমতি পেলাম, অভিভাবকহীন সেই মুহূর্তগুলো ছিল বল্গাহীন। মনের সবটুকু আবেগ উজাড় করে হাঁ করে উপভোগ করতাম উত্তমকুমারের লিপে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের জাদু। একটার পর একটা হিট ছবি ও তার গান, ‘এই রাত তোমার আমার’, ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’, ‘জীবনপুরের পথিক রে ভাই’, ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি’—এরকম কত গানের কথাই আজ মনে পড়ছে। বাঙালির মহানায়ক উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়—সবার ছবিতেই তখন হেমন্ত জাদু। আর শুধু চলচ্চিত্রই বা বলি কেন, স্বর্ণযুগের গানে তখন হেমন্ত-সলিল জুটি বাঙালির মনে আসন পেতে বসেছে। ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূর কুটিরের শত শত স্বপ্ন তার জীবনের মধুমাসের কুসুম ছিঁড়ে গাঁথা মালা শিশির ভেজা কাহিনি’, কিংবা ‘রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে’, ‘গ্রামের মেঠো পথে পালকি চলে হুনহুনা’—রূপকথা মনে হত যেন।
হঠাৎ একবার একটা সুযোগ এসে গেল। সে সময় আমরা থাকতাম পাইকপাড়ার শ্রীনাথ মুখার্জী লেনের ভাড়াবাড়িতে। ঐ বাড়ির একতলায় থাকতেন ডলিবৌদি তাঁর পরিবার নিয়ে। পেশায় হাসপাতালের সেবিকা। কিন্তু তাঁর প্রাণের আনন্দ, মনের খোরাক ছিল ভারতনাট্যম নৃত্য শৈলী। খুব ভালো নাচ করতেন। যদিও আমি নাচ কোনোদিন শিখিনি, তবুও ডলিবৌদির তত্ত্বাবধানে পাড়ার রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীতে নাচ করার সুযোগ পেলেই ধন্য হতাম। ঐ বয়সে সব ছোটোরাই যেমন ভালোভাবে না শিখেও সংস্কৃতির সব বিভাগেই নাম দেয় তেমন আর কী। কবিতা, নাচ, গান, নাটক—সবেতেই নিজেদের শিল্পী সত্ত্বার এক চরম প্রকাশ খুঁজে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার পরিচিত দাদা-বৌদি, কাকু-কাকিমা, মাসিমা-মেসোমশাইয়ের আদরের হয়ে ওঠার একটা সুযোগ পাওয়ার অছিলা। সেই অছিলায় ডলিবৌদির ঘরে নাচের রিহার্সালে যখন বৌদির হাতের তেলেভাজা, নাড়ু, মোয়া, কেকের প্লেটটা সামনে আসত, সে যে কী অসীম আনন্দ হত তা আজ এই বয়সে আর উপলব্ধি করতে পারি না, স্মরণ করতে পারি মাত্র। তো সেই ডলিবৌদি একবার নিজে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন রবীন্দ্র সদন প্রেক্ষাগৃহে। সেখানেই প্রথম খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। সেই প্রথম সামনে বসে তাঁর গানে মুগ্ধ হওয়ার সুযোগ। মধুঝরা সে কণ্ঠের সেদিনের সেই গানগুলো আজও চোখ বুজলে শুনতে পাই।
এরপর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনেরও রং বদল হতে থাকল। দৈনন্দিন জীবন ও জীবিকার তাগিদে আজ হয়তো ঐ আগের মতো নেশার ঘোর নেই, তবুও আজও সেই দিনটার কথা স্পষ্ট মনের কোণে রয়ে গিয়েছে। সাংবাদিকতার খাতিরে আজ যখন বহু শিল্পীসঙ্গ করার সৌভাগ্য ঘটে, তখনও যেন ঐ মুহূর্তগুলোর কথা মনে পড়ে। প্রথম দেখা হবার পর পায়ের ধুলো মাথায় নেবার সঙ্গে-সঙ্গেই ঐ ছোট্ট মেয়েটার মাথায় হাত রেখে তার নাম জিজ্ঞাসা করেছিলেন। সেই উত্তেজনা যেন আজও যেকোনও শিল্পীসকাশেই মনে পড়ে যায়।
১৯২০ সালের ১৬ই জুন তাঁর জন্ম। তাঁর জন্ম শতবর্ষে তাঁর স্মৃতিচারণের সুযোগ পেয়ে আমি ধন্য। পুণ্যসলিলা গঙ্গার তীরবর্তী শহর বারানসিতে তাঁর মামাবাড়ির ঘর উজ্জ্বল করে জন্মেছিলেন একদিন। বাবা কালিদাস মুখোপাধ্যায়, মা কিরণবালা দেবী। হেমন্তকুমার মুখোপাধ্যায় ছিল তাঁর পিতৃদত্ত নাম। তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা তারাজ্যোতি ছিলেন ছোটো গল্পের লেখক, কনিষ্ঠ ভ্রাতা অমল মুখোপাধ্যায় ছিলেন একজন সঙ্গীত শিল্পী ও সঙ্গীত রচয়িতা। বিশু চক্রবর্তী পরিচালিত ১৯৫৯ সালের ছবি ‘অবাক পৃথিবী’র সুর স্রষ্টা ছিলেন অমল মুখোপাধ্যায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় বাংলা গান ‘জীবনের অনেকটা পথ একলাই চলে এসেছি’—এটির সুরকারও ছিলেন অমল মুখোপাধ্যায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একমাত্র বোন ছিলেন নীলিমা দেবী।
মামাবাড়িতে জন্ম নিলেও পরে তিনি পরিবারের সঙ্গে কলকাতায় আসেন এবং পুঁথিগত শিক্ষার জন্য ভবানীপুরের মিত্র ইন্সটিটিউশনে ভর্তি হন। ছোটো থেকেই রক্তে ছিল সংস্কৃতির স্রোত। উপরি পাওনা হয়েছিল বন্ধুত্বের অমৃতযোগ সুভাষ মুখোপাধ্যায়, যিনি পরবর্তীকালে বাঙালির মননের কবি হয়ে উঠেছিলেন, তাঁকে হেমন্ত বিদ্যালয়ে বন্ধু হিসাবে পেলেন। প্রাণের বন্ধু সুভাষ, হেমন্তর সাঙ্গীতিক জীবনে নানাভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। একসময় সন্তোষকুমার ঘোষকেও হেমন্ত বন্ধু হিসাবে পান। এই ত্রয়ী সঙ্গমে একটা বিষয় ছিল লক্ষ করার মতো। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সে সময় ছোটো গল্প লিখতেন। দেশ পত্রিকাতে একবার তাঁর একটা ছোটো গল্প ছাপাও হয়েছিল। সন্তোষকুমার ঘোষ লিখতেন কবিতা আর সুভাষ মুখোপাধ্যায় গাইতেন গান। আজ বিষয়টা ভাবতে অবাক লাগলেও প্রথম জীবনে হেমন্ত লেখক হবারই স্বপ্ন দেখতেন, সঙ্গীতশিল্পী নয়। যদিও স্কুলে থাকার সময় থেকেই হেমন্ত বেশ ভালো গানও গাইতেন। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেবার দু’বছর আগে ১৯৩৫ সালে নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় বন্ধু সুভাষের অনুরোধে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে অডিশন দিয়ে হেমন্ত পাশ করেন এবং তাঁর প্রথম রেডিও রেকর্ডের সে গান ছিল বন্ধু সুভাষেরই লেখা। কমল দাশগুপ্তের ‘তোমার হাসিতে জাগে’ এই গানটির সুরে সুভাষকে হেমন্ত একটি গান লিখে দিতে বলেন এবং সেটাই তিনি রেডিওতে প্রথম রেকর্ড করেন। গানটি ছিল ‘আমার গানেতে এলে নবরূপে চিরন্তনী’। এরপর ১৯৩৬-এ আবার অডিশন দিয়ে রেডিওতে পাশ করেন এবং তাঁর গান রেকর্ড করা হয়।
সে-সময় ছাত্রজীবনে গান গাওয়া ছিল খুব অপরাধের বিষয়। তাই বহুকষ্টে বাবাকে রাজি করিয়ে তিনি রেডিওতে গান গাইতে যেতে পেরেছিলেন। ১৯৩৭ সালে ম্যাট্রিক পাশ করে যাদবপুরের বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটে (যা এখন যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ) ভর্তি হলেন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বেন বলে। কিন্তু রক্তের মধ্যে তখন সুরের কিঙ্কিণী দোলা দিচ্ছে যে! পড়া হল না। মাত্র দেড় বছর পড়ার পরই বাবার নিষেধ সত্ত্বেও ছেড়ে দিলেন কলেজ। শুরু হল এক অন্য জীবন। সম্পূর্ণ সঙ্গীতমনস্ক হয়ে উঠে সঙ্গীতকে তখন জীবিকা করার কথা ভাবতে শুরু করলেন। গানের রেকর্ড করার জন্য স্টুডিওর দরজায় দরজায় ঘুরতে শুরু করলেন, কোথাও সুযোগ পেলেন না। টাইপ, শর্ট হ্যান্ড শিখে যাতে একটা চাকরির সুযোগ পাওয়া যায় তার চেষ্টা শুরু করলেন। এমন সময় হঠাৎই একটা সুযোগ পেয়ে গেলেন গান রেকর্ড করার। গ্রামোফোন কোম্পানি অফ ইন্ডিয়া থেকে ডাক পেলেন। ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে কলম্বিয়া লেবেলে তাঁর প্রথম নন-ফিল্মি ডিস্কের গানের রেকর্ড প্রকাশিত হল। নরেশ্বর ভট্টাচার্যের কথায়, শৈলেশ দত্তগুপ্তের সুরে দুটি গান—রেকর্ডের এক পিঠে ‘জানিতে যদি গো তুমি’ এবং অন্য পিঠে ‘বলো গো বলো মোরে’ তৎকালীন সুরের ধারায় বাংলা আধুনিক গান, যা আজ আর শোনা যায় না। এরপর আর তেমনভাবে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৮৪ সাল অবধি ঐ গ্রামোফোন কোম্পানিই প্রতিবছর তাঁর ডিস্কের আধুনিক বাংলা গানের রেকর্ড বের করেছে।
১৯৪০-এ ‘নিমাই সন্ন্যাস’ ছায়াছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রথম নেপথ্য গায়ক হিসাবে যোগদান করেন। ছবিটির সুরকার ছিলেন হরিপ্রসন্ন দাস মহাশয়। ১৯৪৪ সালে নিজের সুরে বাংলা আধুনিক গান গাইলেন ‘কথা কয়ো নাকো শুধু শোনো’ এবং ‘আমার বিরহ আকাশে প্রিয়া’। ১৯৫৮ সালে ‘নীল আকাশের নীচে’ মৃণাল সেন পরিচালিত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রযোজনা ও সুর সৃষ্টিতে সাড়া জাগানো একটি চলচ্চিত্র। ‘ও নদী রে’ এই ছবির গানটির কথা সবাই জানেন। এই গানটি তিনি ‘সিদ্ধার্থ’ নামক একটা ইংরাজি ছবিতেও গেয়েছেন। ১৯৪৪ সালে ‘প্রিয় বান্ধবী’ ছবিতে প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত গান হেমন্তবাবু। গানটি ছিল ‘পথের শেষ কোথায়’। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে, ১৯৪৪ সাল থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া শুরু করেন এমনকি লতা মঙ্গেশকরকেও প্রথম বাংলা গান হিসাবে
রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার কথাও হেমন্ত মুখার্জীই বলেন। ‘মধু গন্ধে ভরা’ গানটি লতাজির প্রথম গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত। দেবব্রত বিশ্বাসের মতো একজন বিরাট শিল্পী একবার বলেছিলেন যে, রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করে তোলার অনেকখানি কৃতিত্বই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের। কিন্তু অবাক করার মতো কথা হল যে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রসঙ্গীত কোনোদিনই কারও কাছে শেখেননি। তাঁর গানের পথপ্রদর্শক হিসাবে যিনি প্রথম থেকেই ওঁর সঙ্গে থেকেছেন, সেই শৈলেশ দত্তগুপ্ত মহাশয় প্রথম ওঁকে জানালেন যে রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি পাওয়া যায়। তখন এখনকার মতো সব গানের স্বরবিতান বই পাওয়া যেত না। বিভিন্ন পত্রিকা বা কাগজে স্বরলিপি বের হত রবীন্দ্রগানের। সেই স্বরলিপি দেখে কীভাবে গাইতে হয় সেটা শৈলেশবাবুর কাছে শিখে নিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর সঙ্গীত জীবন শুরু করার প্রায় দশ বছর পর ১৯৪৪ সালে গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানি থেকে তাঁর নন-ফিল্মি রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড করার সুযোগ পান। নিজে স্বরলিপি থেকে গান তুলে একটার পর একটা গান গেয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তবে পঙ্কজকুমার মল্লিকের গানের আদর্শ তাঁকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত গান ‘কেন পান্থ এ চঞ্চলতা’, ‘আমার আর হবে না দেরি’। গানগুলি অনাদি ঘোষ দস্তিদারের তত্ত্বাবধানে গেয়েছিলেন।
কলকাতা দূরদর্শনে সুবীর ঘোষ মহাশয়কে দেওয়া একটা সাক্ষাৎকারে শুনেছিলাম হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত জীবনের প্রথম জলসায় গান করার অভিজ্ঞতার কথা। তখন তিনি উঠতি গায়ক। ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলের একটি অনুষ্ঠানে গান গাইবার ডাক পেয়েছেন। জীবনের প্রথম জলসায় গাইবেন। কিন্তু অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার পরেও যখন মঞ্চে ওঠার জন্য ডাক পেলেন না, হঠাৎ ঘোষণা শুনলেন, ‘পঙ্কজকুমার মল্লিক আমাদের মধ্যে এসে গিয়েছেন। আমরা তাঁকে গাইবার জন্য মঞ্চে আহ্বান করছি।’
হতাশ হয়ে হেমন্তবাবু উদ্যোক্তাদের একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, “দূর মশাই! পঙ্কজ মল্লিককে ছেড়ে আপনার গান কে শুনবে?”
প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এটা ১৯৩৭ সালে তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হবার পরবর্তী সময়ের ঘটনা। সেদিন অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছিলেন, কিন্তু সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন পঙ্কজবাবুর গান সামনে বসে প্রথমবার শোনার স্মৃতি। তিনি পঙ্কজ মল্লিকের গানের রীতি ও ধারাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। তাই সেদিনের অপমানকে তিনি কিছুটা লাভ বলেই মনে করেছিলেন সেদিন।
১৯৪৫ সালে অর্ধেন্দু মুখার্জীর ছবি ‘পূর্বরাগ’ এবং সমসাময়িক কালের আরেকটি ছবি ‘অভিযাত্রী’তে সুরকার হিসাবে কাজ করেন। ‘প্রিয়তমা’ ছবিতে ‘স্মরণের এই বালুকাবেলায়’ অসাধারণ জনপ্রিয় হয়। এরপর একটার পর একটা হিট ছায়াছবির হিট গান ‘শাপমোচন’, ‘সপ্তপদী’, ‘শেষ পর্যন্ত’, ‘হারানো সুর’, ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, ‘লুকোচুরি’, ‘স্বরলিপি’, ‘কুহক’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘পরিণীতা’, ‘দুই ভাই’-এর মতো সব ছবি। ‘নকল সোনা’ ছায়াছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর নিজের নামাঙ্কিত এক গায়কের ভূমিকাতে অভিনয়ও করেছিলেন। তাঁর কণ্ঠে একটি বিশেষ গান ছিল ‘একদিনেতেই হইনি আমি তোমাদেরই হেমন্ত’। গানটির সিকোয়েন্স দেখলে তাঁর জীবনের প্রথম জলসায় গান না গেয়ে অপমানিত হওয়ার কথা মনে পড়ে যায়।
১৯৪৭ সাল ভারত ইতিহাসের গৌরবময় একটি বছর। বাংলা গানের স্বর্ণযুগেরও এক গৌরবময় বছর। সলিল চৌধুরী ও হেমন্ত মুখার্জী একসঙ্গে IPTA-তে কাজ করছেন তখন। সলিল চৌধুরী তখনও তেমন জনপ্রিয় নন। তিনি তাঁর কয়েকটা গান শোনাতে এলেন বন্ধু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ইন্দ্র রায় রোডের বাড়িতে। প্রগতিমূলক কিছু সাম্যের গান শুনিয়ে ফিরে যাবার সময় হঠাৎ তাঁর অসমাপ্ত একটি গানের কয়েক কলি শোনালেন হেমন্তকে। শুনেই হেমন্ত লাফিয়ে উঠলেন, এ গানটিই তাঁর চাই। তৈরি হল ইতিহাস—‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ’। এরপর হেমন্ত-সলিল জুটির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে তুলে পরপর সৃষ্টি হয়েছে ‘রানার’, ‘পালকির গান’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘দে দোল দোল দোল’—এরকম আরও বহু গান।
এবার আসি বাংলার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে মুম্বাইয়ের (তৎকালীন বোম্বাই) হেমন্ত্ কুমার হয়ে ওঠার কাহিনিতে। প্রসিদ্ধ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী উস্তাদ আমির খাঁ সাহেব হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। একবার কথা প্রসঙ্গে আমির খাঁ সাহেবকে তাঁর গান ভালো লাগার কারণ জিজ্ঞাসা করে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, “আমি তো কোনোদিন কালোয়াতি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখিনি। একজন উচ্চমানের ধ্রুপদী শিল্পী হয়ে আমার গান আপনার ভালো লাগে কীভাবে?” এই প্রসঙ্গে তিনি দুঃখ সহকারে আরও বললেন যে, “আমি একবার ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের এক শিষ্য ফণীভূষণ গাঙ্গুলি মহাশয়ের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রাতিষ্ঠানিক তালিম নেবার জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুদিন শেখার পরেই তিনি মারা যাওয়ায় আমার শেখা বন্ধ হয়ে যায়। পরে আর যাঁদের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শেখার ইচ্ছে নিয়ে যাই, কেউই আমায় শেখাতে চাননি। তাঁদের সবারই নির্দেশ ছিল, আমি তখন যে ধরনের গান গাই সেই গান ছাড়তে হবে। কিন্তু খাদ্য যোগায় যে গান, তাকে ছাড়া তখন আমার সম্ভব ছিল না। তাই আমার আর ধ্রুপদী শিক্ষালাভ করা সম্ভব হয়নি।”
সব শুনে আমির খাঁ সাহেব হেমন্তকে বলেছিলেন যে, “শাস্ত্রীয় গানই কি শুধু গান? গান তো যে সুর লাগাতে জানে, তাল, ছন্দ বোঝে, সেই গায়। যার সুর-তাল নেই, যে তার গান গেয়ে ভালো লাগাতে পারে না, সে আবার কী গাইবে? দুঃখ কোরো না, এগিয়ে যাও।”
আমির খাঁ সাহেবের এই কথায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সেদিন মনের জোর খুঁজে পেয়েছিলেন। এরপর ১৯৪০ সালে গ্রামোফোন কোম্পানির কলম্বিয়া লেবেলে কমল দাশগুপ্তের সুর এবং ফৈয়াজ হাসমির কথায় তিনি দুটি হিন্দি গান রেকর্ড করেন, যার একটি হল ‘কিতনা দুখ ভুলায়া তুমনে প্যায়ারে’ আর অন্যটি হল ‘ও প্রীত নিভানেওয়ালি’। হিন্দি ছায়াছবিতেও হেমন্ত্ কুমার নাম নিয়ে যথেষ্ট খ্যাতিলাভ করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রথম গান ১৯৪৪ সালে ‘ইরাদা’ ছবিতে শোনা যায় পণ্ডিত অমরনাথের সঙ্গীত পরিচালনায়। এরপর ‘আনারকলি’, ‘অনুপমা’, ‘বিস সাল বাদ’, ‘নাগিন’ ছাড়াও শচীন দেববর্মণের সুরে গাওয়া বহু গান আজও ইতিহাস হয়ে রয়ে গিয়েছে। ১৯৫১ সালে পরিচালক হেমেন গুপ্ত মহাশয়ের প্রথম হিন্দি ছবি ‘আনন্দমঠ’-এ সুর সংযোজনার জন্য হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মুম্বাই যান। ১৯৫২-তে ঐ ছবি রিলিজ হয় এবং ফিল্মিস্তান স্টুডিওতে গাওয়া লতা মঙ্গেশকরের ‘বন্দেমাতরম’ গানটি বেশ জনপ্রিয় হয়। ফিল্মিস্তান মুভির ব্যানারে ‘শর্ত’ ছবিতেও হেমন্ত্ কুমার সুর সংযোজনার কাজ করেন। শচীন দেববর্মণের সুরে ‘জাল’ ছবির ‘ইয়ে রাত ইয়ে চান্দনি ফির কাহাঁ’ গানটি আজও জনপ্রিয়। ‘হাউস নম্বর ফরটি ফোর’, ‘সোলভা সাল’, ‘ফানটুস’, ‘বাত কি রাত কি’ ছবির গানগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৯৫৫ সালে ‘নাগিন’ ছবির অসম্ভব জনপ্রিয়তার জেরে শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসাবে হেমন্ত ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পান। ঐ বছরই ‘শাপমোচন’ ছবি মুক্তি পায়। একদিকে বাংলা, অন্যদিকে মুম্বাই—একসঙ্গে তুমুল জনপ্রিয়তার পুষ্প বর্ষিত হয় তাঁর ওপর। বাংলায় তো উত্তম-হেমন্ত জুটি এত জনপ্রিয় হয় যে আজও দর্শক-শ্রোতা ঐসব ছায়াছবি দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন।
তাঁর সমসাময়িক যেসব সঙ্গীত পরিচালকের সুরে কাজ করেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তাঁরা হলেন নচিকেতা ঘোষ, রবিন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। সলিল চৌধুরীর কথা তো জানাই আছে। তাঁর সমসাময়িক যেসব সঙ্গীতশিল্পী তখন কাজ করেছেন বাংলার সঙ্গীত জগতে, তাঁদের মধ্যে জগন্ময় মিত্র, রবিন মজুমদার, সত্য চৌধুরী, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সুধীরলাল চক্রবর্তী, বেচু দত্তের নাম করা যায়। মুম্বাইতে সে সময় তালাত মামুদ অত্যন্ত জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন।
১৯৪৫ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বেলা মুখোপাধ্যায়কে বিবাহ করেন। বেলাও একজন সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। পঙ্কজ মল্লিকের সুরে ‘কাশীনাথ’ ছবিতে ১৯৪৩ সালে বেলা নেপথ্য সঙ্গীত শিল্পী হিসাবে কাজ করেন। কিন্তু বিবাহের পর বেলা তাঁর সঙ্গীত জীবনে ইতি টানেন। পুত্র জয়ন্ত (যাঁর স্ত্রী সত্তর দশকের বাংলার প্রখ্যাত অভিনেত্রী মৌসুমী চ্যাটার্জী) এবং কন্যা রানু মুখার্জীকে নিয়ে ছিল হেমন্ত-বেলার সুখের সংসার। ষাটের দশকের শেষদিকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছবি প্রযোজনার দিকে ঝোঁকেন। হেমন্ত-বেলা প্রোডাকশনের প্রথম ছবি ছিল মৃণাল সেনের পরিচালনায় বিখ্যাত চলচ্ছিত্র ‘নীল আকাশের নীচে’। চলচ্চিত্রটি রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক লাভ করে যা ভারত সরকার প্রদত্ত চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠতম সম্মান। পরে হেমন্ত-বেলা প্রোডাকশন ‘গীতাঞ্জলি’ নাম নিয়ে বেশ কিছু হিন্দি ছবি প্রযোজনা করে যেগুলির সুর স্রষ্টা ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সেই ছবিগুলোর মধ্যে ‘বিস সাল বাদ’ ছাড়াও ছিল ‘কোহরা’, ‘বিবি অউর মকান’, ‘রাহগির’ এবং ‘খামোশি’। এর মধ্যে অবশ্য ‘বিস সাল বাদ’ এবং ‘খামোশি’ই বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল। কলকাতায় ফিরে একেবারে অন্য ঢঙে লোকসঙ্গীত ও লঘু সঙ্গীতের সুরে ‘পলাতক’ ছবিতে সুর করেন। সে সময় ‘বাঘিনী’, ‘বালিকা বধূ’, ‘মণিহার’, ‘অদ্বিতীয়া’ ছবিগুলোও ধ্রুপদী ও লঘু সঙ্গীতের মিশ্রণের স্বাদ এনে দেয়।
ষাটের দশকে রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য ‘বাল্মীকি প্রতিভা’, ‘শ্যামা’, ‘শাপমোচন’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘চণ্ডালিকা’তে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুচিত্রা মিত্রর সঙ্গে গান গেয়ে বাণিজ্যিকভাবেও অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন শিল্পী হয়ে ওঠেন। ইতিপূর্বেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের বহু রেকর্ড প্রকাশিত হয়ে গেছে এবং বাঙালির ঘরে ঘরে এইসব রেকর্ডের গান তখন শোনা যায়। সে সময়কার রবীন্দ্রসঙ্গীতের আকাশে যেসব নক্ষত্র শোভা বিকিরণ করছিলেন, দেবব্রত বিশ্বাস ছাড়াও তাঁদের মধ্যে ছিলেন চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, সাগর সেন, সুমিত্রা সেন, ঋতু গুহ প্রমুখ।
সত্তরের দশকে যেসব ছায়াছবিতে তাঁর গান সাড়া জাগিয়েছিল তার মধ্যে ১৯৭১-এ ‘স্ত্রী’, ১৯৭৪-এ ‘সোনার খাঁচা’, ১৯৭৫-এ ‘ফুলেশ্বরী’। ১৯৮০-তে ‘দাদার কীর্তি’তে গাওয়া ‘চরণ ধরিতে দিও গো আমারে’ আজও মনে এক আবেশ এনে দেয়। নন-ফিল্মি বেশ কিছু বাংলা গানও সত্তরের দশকে শ্রোতার মন ছুঁয়েছিল। তার মধ্যে ‘যদি জানতে চাও তুমি’, ‘একগোছা রজনীগন্ধা’, ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’, ‘সেদিন তোমায় দেখেছিলাম ভোরবেলা’—এই গানগুলির উল্লেখ করা যায়।
দেশের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশেও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যথেষ্ট সুনামের সঙ্গে গান করেছেন। ১৯৭১-এ ‘অনিন্দিতা’ ছবির পরিচালনা করার পর ঐ বছরই কনরাড রুক্স-এর ‘সিদ্ধার্থ’ ছবিতে গান করার জন্য হলিউড পাড়ি দেন। ঐ ছবিতে তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি হলিউডি ছবিতে গান করেন। তাঁর ‘নীল আকাশের নীচে’ ছবির বিখ্যাত ‘ও নদী রে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’ গানটি তিনি ঐ ইংরাজি ছবি ‘সিদ্ধার্থ’-এ গান। আমেরিকা সরকার তাঁকে বাল্টিমোর, মেরিল্যান্ড প্রদেশের নাগরিকতা প্রদান করে সম্মান জানায়। তিনিই প্রথম ভারতীয় গায়ক যিনি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকতা পান।
১৯৮০ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হবার পর তাঁর গান গাইবার ক্ষমতা কমে আসে। শ্বাসগ্রহণের ক্ষমতা কমে আসায় চেষ্টা করেও আর আগের মতো দক্ষতায় গান গাইতে পারতেন না তখন। ১৯৮৪ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে তাঁর সঙ্গীত জীবনের বর্ণময় পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করার জন্য সম্মাননা জানায়। ঐ বছরেই গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে তাঁর শেষ নন-ফিল্মি গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। এই সময় অল ইন্ডিয়া রেডিও, দূরদর্শন থেকে তাঁর অনেকগুলি লাইভ অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছে, তাঁর সাক্ষাৎকারও প্রচারিত হয়েছে।
১৯৮৭ সালে ভারত সরকার প্রদত্ত ‘পদ্মভূষণ’ খেতাবের জন্য তাঁকে মনোনীত করা হলে বিনম্রভাবে তা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। এর আগে সত্তরের দশকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে তাঁর সঙ্গীত জীবনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে লতা মঙ্গেশকর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অনুরাগীদের তরফ থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের হাতে স্মারক উপহার তুলে দেন এক বিরাট সম্মাননা সভার অনুষ্ঠানে। ১৯৮৮ সালে ঐ ভগ্ন কণ্ঠের গানেও ‘লালন ফকির’ ছবিতে তিনি শ্রেষ্ঠ গায়কের সম্মান পান। শুধু আমেরিকা নয়, ১৯৬৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ গিয়ে তিনি বিপুল সম্বর্ধনা পান। ওঁর সাক্ষাৎকার থেকেই জানা যায়, উড়োজাহাজ সে দেশের মাটি ছোঁয়ার আগে থেকেই তাঁর যাত্রাপথের ধারাবিবরণী দেওয়া শুরু হয়। রাজকীয় সম্বর্ধনায় তিনি আপ্লুত হয়ে পড়েন। জামাইকার মানুষ তাঁকে কাছে পেয়ে স্পর্শ করে দেখতে চান। তিনি কারণ জিজ্ঞাসা করায় তাঁদের উত্তর ছিল, ‘আমরা ভারতবর্ষকে স্পর্শ করছি।’ এতটাই সম্মান ও শ্রদ্ধা তিনি পেয়েছিলেন ভারতবর্ষের একজন শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসাবে। এছাড়া ইউরোপ, পূর্ব আফ্রিকা—পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়েও সঙ্গীত পরিবেশন করে তিনি প্রভূত সম্মান পান। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশের ঢাকায় যান মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার গ্রহণের জন্য।
বাংলা ছাড়াও অহমিয়া, মারাঠি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি—বিভিন্ন ভাষায় তিনি গান গেয়েছেন। একসময়ের এক প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায়’। সমাজসেবামূলক কাজেও তাঁকে মুক্ত হস্তে দান করতে দেখা যায়। তাঁর স্বর্গীয় পিতার স্মৃতিতে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বাহারুতে তিনি একটি হোমিওপ্যাথি হাসপাতাল চালু করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই বাহারুতেই তাঁর পিতা ও তাঁর পরিবার দীর্ঘদিন ছিলেন।
কোনোদিন বিরাট সঙ্গীতশিল্পী হবার কথা ভাবেননি বলে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে জীবন শুরু করেছিলেন। কিছুটা লেখক হওয়ার বাসনা মনের কোণে ছিল বলে প্রথম জীবনে লেখালেখি করতেন। যিনি হতে পারতেন দেশি-বিদেশি ডিগ্রিধারী একজন সফল ইঞ্জিনিয়ার, তৈরি করতে পারতেন হয়তো বড়ো কোনও পাওয়ার গ্রিড, তিনি হলেন বাঙালির প্রাণের গায়ক। তিনি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হলে বাঙালির সঙ্গীত তৃষ্ণা এভাবে দু’হাত ভরে ভরিয়ে তোলার জন্য হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে আমরা পেতাম না। ঈশ্বর বিশ্বাসী হেমন্তবাবু বিশ্বাস করতেন, ভাগ্যবিধাতাই তাঁকে ইঞ্জিনিয়ার হওয়া থেকে সরিয়ে এনে এই সঙ্গীত জগতে ফেলেছিলেন। যে সুর দিয়ে তিনি জীবন শুরু করেছিলেন, সেই সুর জীবনের শেষদিন অবধি তাঁকে সঙ্গ দিয়েছে। ফলের আশা না করেই কাজ করে গেছেন। তাই জীবনের অজস্র হতাশা আর ব্যর্থতার মধ্যেও কোনোদিন ভেঙে পড়েননি, আশাহত হননি। ভাগ্যে বিশ্বাসী ছিলেন বলে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে গেছেন। বলতেন, ‘আমার কাজের ফল তো আমার হাতে নেই। যদি থাকত তবে কাজের এত আনন্দ থাকত না।’ বলতেন, ‘আমি যা চেয়েছি তার চেয়েও অনেক গুণ বেশি আমি পেয়েছি শ্রোতাদের কাছ থেকে। ঐ কণ্ঠ আমার নয়, ঈশ্বরের দান। তিনি দিয়েছেন, তিনিই চালাচ্ছেন। যেভাবে চালাচ্ছেন সেভাবেই চলছি। যেখানে গিয়ে থামবে, থামুক।’
হ্যাঁ, এ কণ্ঠ একদিন থেমে গেল। ১৯৮৯ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর বিধাতার দান সেই অমৃত কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেল। দক্ষিণ কলকাতার একটি নার্সিংহোমে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি অমৃতলোকে যাত্রা করলেন। আজ জন্ম শতবর্ষে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি। তিনি বেঁচে আছেন, থাকবেন আমার মতো সঙ্গীতপ্রেমী মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়।