শতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য
সুরসাগর
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের শতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানালেন সঙ্গীতবিশেষজ্ঞ ও সঙ্গীতজ্ঞ ভ্রাতৃদ্বয়
বাসব চট্টোপাধ্যায় ও রাঘব চট্টোপাধ্যায়। উঠে এল এক আশ্চর্য সঙ্গীতময় জীবনের ইতিবৃত্ত।
~রাঘব চট্টোপাধ্যায়ের কলমে~
একদিনেতে হইনি আমি
~বাসব চট্টোপাধ্যায়~
বাংলা, হিন্দি মিলিয়ে পাঁচহাজারের ওপর গান রেকর্ড করেছেন গায়ক, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। প্রযোজনাও করেছেন অনেক কালজয়ী ছবি। তাঁর সহকারী সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন কল্যাণজী আনন্দজী, লক্ষ্মীকান্ত প্যারেলাল-এর মত বিশ্বখ্যাত সুরকার। তাঁর সঙ্গীতে সঙ্গ দিয়েছেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, নচিকেতা ঘোষ, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, অনল চট্টোপাধ্যায়, রতু মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, সুধীন দাশগুপ্ত, সলিল চৌধুরী ও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত অনেক গীতিকার-সুরকাররা। মধ্যগগনে থাকাকালীন তাঁদের সৃষ্ট কিছু পরিচিত ও কম শ্রুত গানের উল্লেখ করেছি এই নিবন্ধের শেষে। এ যেন অমৃতের সুবিশাল পাত্র থেকে এক গণ্ডুষ সুর তুলে নেওয়া। এই রচনা একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বড় হওয়া এক গায়কের উত্থান-কাহিনি। ধারাবাহিক জীবনযাত্রার বর্ণনা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমরা টুকরো টুকরো ঘটনা ও সুরের কোলাজে শিল্পীর সাঙ্গীতিক জীবনকে উপলব্ধী করবার চেষ্টা করেছি মাত্র। সুরের আকাশে দুবাহু প্রসারিত করেও জীবনের অন্তিম লগ্নেও শিকড় বিচ্ছিন্ন হননি এই ক্ষণজন্মা শিল্পী।
এই কিংবদন্তি শিল্পীর জন্মশতবর্ষে আশা করি নতুন প্রজন্মকে এই লেখাটি সমৃদ্ধ করবে। প্রত্নতাত্ত্বিক মন নিয়ে যে কোন জনপ্রিয় শিল্পীর জনপ্রিয়তার বাইরে তাঁদের সুর সৃষ্টির কলাকৌশলকে খুঁজে দেখতে সাহায্য করবে। কারণ জনপ্রিয়তার চাপে বহু কালোত্তীর্ণ সুরসৃষ্টি কালের গহ্বরে লুপ্ত হয়ে গেছে। সাংগীতিক পরিবারে বড় হতে হতে তীব্র সঙ্গীত প্রীতির কারণেই বিষয়টি অনুভব করে এই লেখাটির অবতারণা।
সবশেষে পাঠক-শ্রোতাদের সুবিধার্থে আমার পছন্দের একসঙ্গে তিরিশটি গানের ইউটিউব লিঙ্ক দিলাম। কিশোর কুমারের গাওয়া একটি গান বাদে সব কটি হেমন্ত কুমার মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ নিঃসৃত।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯২০ সালে কাশীতে তাঁর মামার বাড়িতে। ছোটো থেকে দারিদ্রের মধ্যে বড় হওয়া। বাবা করতেন সামান্য কেরাণীর চাকরি। কষ্টের মধ্যেও বাবা কালিদাস মুখোপাধ্যায় পুত্রকে সে সময়ের অভিজাত বিদ্যালয় ভবাণীপুর মিত্র ইনস্টিটিউসনে হাফ ফি তে পড়বার ব্যাবস্থা করে দেন। ছোটো থেকেই মেধাবি ছিলেন হেমন্ত। সঙ্গে ছিল সঙ্গীতের প্রতি তীব্র আকর্ষণ।
তখন ক্লাস টেনে পড়েন। ম্যাট্রিক দিতে তিনমাস বাকি। ক্লাস রুমে গান গাইবার অপরাধে রাস্টিকেট হতে হতে সে যাত্রা রক্ষা পেলেন। কিন্তু ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হলেন।
১৯৩৫ সালে হেমন্ত যখন ক্লাস নাইনে পড়েন, তখন বাল্যবন্ধু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে প্রথম আকাশবাণীতে অডিশান দিয়ে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। প্রথম দিন অডিশানে গেয়েছিলেন সন্তোষ সেনগুপ্তের গাওয়া গান—
‘আজও পড়ে গো মনে’
তিনমাস পরে চিঠিতে লাইভ ব্রডকাস্টের সু্যোগ এল। ছুটলেন সুভাষের বাড়ি। সেই সময় কমল দাশগুপ্তের সুরে একটি রেকর্ড বেরিয়েছিল। গানটির প্রথম লাইনটি ‘তোমার হাসিতে জাগে’।
সুভাষকে বললেন এই সুরে একটি নতুন কথা বসিয়ে দিতে। সুভাষের বসানো কথায় প্রথম গানটির দুটি লাইন হল—
আমার গানেতে এলে নবরূপে চিরন্তনী
বাণীময় নিলীমায় শুনি তব চরণধ্বনি।
দ্বিতীয় গানটি গাইলেন ভাটিয়ালি সুরে। সসম্মানে আকাশবাণীতে গান গাইলেন। তখন তিনি তাঁর আইডল পঙ্কজ মল্লিকের গায়কিকে অনুকরণ করতেন। ফলে শ্রোতাদের কাছে তাঁর নাম হয়ে গেল ‘জুনিয়ার পঙ্কজ’। এদিকে চুটিয়ে যে গান গাইবেন তার উপায় নেই। কারণ বাড়িতে তো হারমোনিয়ামের অভাব। সে অভাব পুরণ করতে নিয়মিত বন্ধু শ্যামের বাড়ি গিয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাওয়ার অভ্যাস করতে থাকলেন।
পাশাপাশি চলতে থাকলো তাঁর সাহিত্যচর্চা। পাশে কবিবন্ধু সুভাষ ছাড়াও পেলেন রমাকান্ত মৈত্রকে। অন্যদিকে সুধাংশু সেনগুপ্ত,সন্তোষ ঘোষ, সুধীররঞ্জন মুখোপাধ্যায় ও নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়দের সান্নিধ্যে সাহিত্যচর্চার একটি বড় দল তৈরি হয়ে গেল। নিয়মিত গল্প লিখতে থাকলেন। কয়েকটি সাহিত্যপত্রিকায় গল্প ছাপা হল। ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম গল্প ‘একটি ঘটনা’।
অন্যদিকে সুভাষ একদিন বন্ধু হেমন্তকে বললেন, সাহিত্য নিয়ে অনেক মাতামাতি হয়েছে। গানটা তো গাইতে হবে। রেডিওতে গান গাওয়া হয়েছে। সুতরাং চলো এবার রেকর্ডের জন্য চেষ্টা করতে হবে।
বিভিন্ন রেকর্ড কোম্পানির দরজায় দরজায় ঘোরা শুরু হল।এইচ এম ভি থেকে শুরু করে মেগাফোন। কেউ রেকর্ড করতে রাজি হল না। বিফল হয়ে বসে থাকলেন না। ম্যাট্রিক পাস করে যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার সময় নিয়মিত কলেজ ফাংসানে গান গাইতে থাকলেন। একদিন পিতা আলাপ করে দিলেন তাঁর সহকর্মী শান্তি বসুর সংগে। তিনি কলম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানিতে চেলো বাজাতেন। পিতৃবন্ধু শান্তি বসুর সহায়তায় আলাপ হল শৈলেশ দত্তগুপ্তের সঙ্গে। শৈলেশ দত্তগুপ্ত সেকালে কলম্বিয়া ও এইচ এম ভির নামি সুরকার। শৈলেশ বাবুর সঙ্গে আলাপের পর তিনি হেমন্তকে একটি গান গাইতে বললেন। হেমন্ত গাইলেন সন্তোষ সেনগুপ্তের আর একটি গান।
‘যদিও দূরে থাকো তবু সে ভুলি নাকো’
অর্ধেক শুনেই গান বন্ধ করতে বললেন। সেইদিনই একটি নতুন গান তুলে দিলেন। পরের দিন আসতে বললেন আর একটি গান তুলে দেবার জন্য। জানিয়ে দিলেন দশদিনের মধ্যেই কলম্বিয়া কোম্পানিতে রেকর্ড করবেন তাঁর গান।
১৯৩৭ সালে প্রথম রেকর্ড করলেন। প্রকাশিত হল দুটি গান। দুটিগানেরই সুরকার শৈলেশ দত্তগুপ্ত। গীতিকার নরেশ্বর ভট্টাচার্য।
১। জানিতে যদি গো তুমি।
২। বল গো বল মোরে।
সুরকার শৈলেশ দত্তগুপ্তের তালিমে আধুনিক গান গাওয়ার পথ প্রসস্ত হল। নিয়মিত যাদবপুর থেকে ভবানিপুর আসতেন শিক্ষক শৈলেশ বাবুর বাড়ি। ভবানিপুর থেকে শৈলেশ দত্তগুপ্ত যখন বাড়ি বদল করে টালিগঞ্জ চলে গেলেন,ট্রামে করে আসতেন হেমন্ত। সেই ট্রাম ভাড়াও দিয়ে দিতেন শৈলেশ দত্তগুপ্ত । জানতেন তাঁর পিতার আর্থিক অনটনের কথা।
দুমাস পরে ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বেরোলো হেমন্তের দ্বিতীয় রেকর্ড।
‘তোমারে চাহিয়া প্রিয় বুঝিনু বিফল চাওয়া’
প্রথম রেকর্ড থেকে পেয়েছিলেন কুড়ি টাকা।
আর দ্বিতীয় রেকর্ড করে পেলেন কুড়ি টাকা। মোট চল্লিশ টাকা দিলেন বাবাকে। বাবা জার্মান রিডের হারমোনিয়াম কিনে দিলেন। আর তাঁকে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান অনুশীলনের জন্য অন্যের বাড়ি যেতে হবে না। শৈলেশ বাবু পরামর্শ দিলেন এবার রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার। তাঁর কাছে হেমন্তের শেখা প্রথম রবীন্দ্রনাথের গান—
‘ আমার মল্লিকা বনে
যখন প্রথম ধরেছে কলি।
নতুন আধুনিক গানের রেকর্ড বেরোনোর আনন্দে হেমন্ত তখন মশগুল। রেকর্ডটি কাগজে মুড়ে পরিচিতদের বাড়ি বাড়ি ঘুরতেন।
কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলতেন—ও কিছু না।
তাঁরা জিজ্ঞেস করতেন— কী এমন জিনিস? বলোই না!
তিনি বলতেন— একটা রেকর্ড।
আগ্রহে সবাই তাঁর রেকর্ড শুনতে চাইতেন। এই ছেলেমানুষী করেই চলতে থাকল তাঁর দিন।
অন্যদিকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের জলসা হচ্ছে চারিদিকে। তাঁরও মার্গ সঙ্গীত শিক্ষার ঝোঁক বেড়েছে। শুরু করলেন পাঁচুগোপাল বসুর কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রাথমিক তালিম।
এরমধ্যে শৈলেশ দত্তগুপ্ত একদিন আকাশবাণীতে ফিচার গাওয়াতে নিয়ে গেলেন। দক্ষিণা পেলেন পাঁচ টাকা।
১৯৩৮ সালের শেষাশেষি দেড় বছর ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার পর বাবাকে জানালেন,তিনি আর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বেন না। পুরোপুরি সঙ্গীতকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করবেন। স্বাভাবিকভাবেই যে কোনো অভিভাবকের মত হেমন্তের এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হলেন পিতা। কিন্তু মহাকাল যে কাজের জন্য তাঁকে নির্দিষ্ট করেছেন তাঁকে ঠেকায় কার সাধ্য।
গান থেকে রোজগারের জন্য গানের টিউশন শুরু করলেন। কারণ তিনি জানতেন শিল্পের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয় , প্রতিপদে কন্টকাকীর্ণ।
এর মধ্যে আবার কলম্বিয়া কোম্পানিতে গণ্ডগোলের জন্য রেকর্ড বন্ধ হয়ে গেল। রেকর্ড বন্ধ হলে কি হবে, কণ্ঠ তো তাঁর। চুটিয়ে গান গাইতে থাকলেন বিভিন্ন জলসায়।
এই প্রসঙ্গে হেমন্তের প্রথম অনুষ্ঠানে গাইতে যাবার অভিজ্ঞতা বেশ চমকপ্রদ।ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে একটি জলসায় গাইবার সুযোগ এল এক বাল্যবন্ধুর উদ্দ্যোগে। সন্ধে ছটায় অনুষ্ঠান। কিন্তু প্রথম মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশনের সুযোগ পাওয়ার উত্তেজনায় অনেক আগেই পৌঁছে গেলেন বন্ধুকে নিয়ে। মঞ্চের পাশে অপেক্ষা করতে থাকলেন। ধনঞ্জয় এলেন। জগন্ময় মিত্র গাইলেন। সবাই গাইছেন আর এক এক করে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁর সুযোগ আর হয় না।যখন রাত ৯টা বাজে অধৈর্য হয়ে কর্মকর্তাদের একজনকে বললেন—’দাদা এইবার আমাকে গাইতে বসালে ভালো হয়।’
কর্মকর্তাটি আশ্বাস দিয়ে বললেন,যে শিল্পী গাইছেন তাঁর গাওয়া শেষ হলেই হেমন্তের স্টেজ।
আস্বস্ত হয়ে আবার অপেক্ষা । হঠাৎ হট্টগোলের শব্দ শুনতে পেলেন। দৌড়ে কিসের শব্দ দেখতে গিয়ে এক কর্মকর্তাকে আবার বল্লেন—দাদা এবার আমাকে স্টেজে বসিয়ে দিন। নইলে আর গাওয়া হবে না। সেই ভদ্রলোক তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জানালেন—দূর মশাই! আপনার গান এখন কে শুনবে? দেখছেন পঙ্কজ মল্লিক এসে গেছেন। বরং ওঁর গান শুনে বাড়ি যান।
জীবনে প্রথম মঞ্চে গাইবার ডাক পেয়েও না গাইতে পেরে তাঁর আইডল পঙ্কজ মল্লিকের গান শুনে চলে গেলেন ভবিষ্যতের কিংবদন্তী শিল্পী। প্রত্যেক শিল্পী,প্রত্যেক সফল ব্যক্তিরই একটি প্রথম থাকে। সেই প্রসঙ্গে ‘নকল সোনা’ছবিতে তাঁর গাওয়া একটি গান মনে পড়ে—
‘একদিনেতে হইনি আমি তোমাদের হেমন্ত’
গীতিকার: গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ।। সুরকার: নচিকেতা ঘোষ
কয়েকমাস এভাবেই কাটতে কাটতেই আবার ডাক পড়ল কলম্বিয়া থেকে। নতুন রেকর্ড করবার প্রস্তাব। যদিও কলম্বিয়ার নাম পালটে হয়েছে ওডিয়ন। ১৯৪৪ সালে ‘ওডিয়ন’ ছাপে নতুন গানটি রেকর্ড হল প্রণব রায়ের কথায় এবং শৈলেশ দত্তগুপ্তের সুরে—
‘পরদেশী কোথা যাও থামো গো হেথা’
কিছুদিনের মধ্যে আর একটি সুযোগ এল। নিউথিয়েটার্স তখন সারা দেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে শাসন করছে। বম্বে এবং মাদ্রাজের ছবিও ওই স্টুডিও থেকে লালিত পালিত হয়ে মুক্তি পাচ্ছে। সেই নিউথিয়েটার্সে কোরাস গানের সুযোগ পেলেন হেমন্ত। ধনঞ্জয়,জগন্ময় মিত্ররা তখন প্রথিতযশা। হেমন্তকে কোরাস গাইবার সুযোগ করে দিলেন রাইচাঁদ বড়াল ও পঙ্কজ মল্লিক। শিল্পী হিসাবে বি এন সরকারের নিউথিয়েটার্সে স্বীকৃতি পাওয়া সে সময় সৌভাগ্যের ব্যাপার।
একটি একটি করে সাফল্যের দরজা আস্তে আস্তে খুলে যেতে থাকলেও প্রথাগত গানের ব্যাকরণ শেখার আক্ষেপ নিয়েই চলছিল তাঁর দিন। সে সুযোগও এসে গেলো প্রখ্যাত ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁর শিষ্য ফণীভূষণ ব্যানার্জীর সান্নিধ্য পেয়ে। বছর দুয়েক মার্গ সঙ্গীতের তালিমও নিয়েছিলেন তাঁর কাছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য– গুরুর অকাল প্রয়াণে সেই শিক্ষাতেও বাধা পড়ল।
হাল না ছেড়ে অন্য ওস্তাদের কাছেও পুনরায় গেছিলেন। কিন্তু হেমন্তকে গান শেখানোর শর্ত হিসেবে তাঁরা আদেশ করেন আধুনিক গান বন্ধ করবার। সে নির্দেশ মান্য করা সম্ভব হয়নি তাঁর। কারণ আধুনিক গান গাওয়া তখন তাঁর একমাত্র আয়ের উৎস। হিন্দুস্তানি মার্গ সঙ্গীত শিখতে না পারার সেই আক্ষেপ একসময় ব্যক্ত করেছেন ওস্তাদ আমির খাঁর কাছে। খাঁ সাহেব তাঁকে বলেন— যে ব্যক্তি নিখুঁত সুর, তাল, লয় বজায় রেখে শ্রোতার হৃদয় জয় করতে পারেন,তিনি প্রকৃত শিল্পী। তাঁকে কালোয়াতি গাইতে হবে এমন কনো বাধ্যবাধকতা নেই। একজন প্রকৃত সঙ্গীত শিল্পীর আশি শতাংশ শিক্ষাই হয় কানে শুনে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও আকাশবাণীর মাধ্যমে তাঁর দ্রোণাচার্যদের (পঙ্কজ মল্লিক,কে সি দে,শচিন দেব বর্মণ) গান শুনেই শিল্পী হিসেবে নিজেকে স্বয়ংসম্পুর্ণ করতে থাকেন। আর ছিল তাঁর ঈশ্বর প্রদত্ত কণ্ঠস্বর।
সেই অতুলনীয় ব্যারিটোন কণ্ঠে খুলে গেল অন্য একটি জগৎ। শুরু হল নিয়মিত রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা। সুরকার শৈলেশ দত্তগুপ্তের সুপারিশে প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশিত হল।
সাল ১৯৪৪। অনাদী দস্তিদারের ট্রেনিং ও পঙ্কজ মল্লিকের অনুপ্রেরণায় মুক্তি পেল দুটি রেকর্ড।
১) কেন পান্থ এ চঞ্চলতা
২) আমার আর হবে না দেরি
সঙ্গে সঙ্গে ‘প্রিয় বান্ধবী’ ছবিতে রবীন্দ্রনাথের গানের প্লেব্যাকের সুযোগ এল। গাইলেন—
‘পথের শেষ কোথায় কী আছে শেষে’
যদিও তিনি রবীন্দ্রসংগীতের প্রথম প্লেব্যাক করেন ১৯৪২ সালে ‘অপরাধ’ ছবিতে
‘ওই যে ঝড়ের মেঘে’ গানটি গেয়ে। তখন তাঁর কাছে যেন প্যান্ডোরার বাক্স খুলে গেছে। অকাতরে গেয়ে চলেছেন রবীন্দ্রগানের ভাণ্ডার থেকে এক এক করে গান।
অন্যদিকে রেডিও স্টেশনে যাতায়াতের সুবাদে নিয়মিত আকাশবাণীর ফিচারে গান গাইছেন। বাণীকুমারের পরামর্শে শুধু কণ্ঠ প্রয়োগই নয়,সুর দিতেও থাকলেন। হয়ে উঠলেন ফিচারের সঙ্গীত পরিচালক।
একটু একটু করে পরিচিত হয়ে উঠছেন গানের জগতে। ১৯৪৩ সালে এই প্রথম নিজের সুরারোপিত গান রেকর্ড করলেন। গীতিকার অমিয় বাগচী।
১)’কথা কোয়ো নাকো শুধু শোনো’
২)’আমার বিরহে আকাশে প্রিয়’
প্রথম গানটি শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরতে থাকল।
হেমন্তের কণ্ঠ তখন শ্রোতাদের মুখে মুখে পৌঁছে গেছে বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক কমল দাশগুপ্তের কাছে। তিনি হেমন্তকে দিয়ে প্রথম হিন্দী গান রেকর্ড করালেন ১৯৪০ সালে। গ্রামাফোন কম্পানির তখন একচেটিয়া সুরকার তিনি।
নিউ থিয়েটার্সে প্লেব্যাক আর্টিস্ট হিসেবে প্রখ্যাত শিল্পীরা হলেন তখন সুপ্রভা সরকার, উৎপলা সেন।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়েরও প্রথম প্লেব্যাকের সুযোগ এল। গাইলেন ইস্ট ইণ্ডিয়া ফিল্ম কোম্পানীর ‘নিমাই সন্ন্যাস’ ছবিতে ১৯৪১ সালে। সুর দিলেন হরিপ্রসন্ন দাস। তাঁর সঙ্গে পরবর্তী কালে সহকারী সঙ্গীত পরিচালকের কাজ শুরু করলেন।
‘কাঁহা কানু কহি ‘
কথাঃ অজয় ভট্টাচার্য
এরপর গাইলেন ‘রাজকুমারে নির্বাসন’ ছবিতে, ‘জাগো প্রথম প্রণয়। ‘ কথা অজয় ভট্টাচার্য/ সুরঃ শচীন দেব বর্মণ
এই সময় থেকে নিজের স্টাইল সম্পর্কে সচেতন হলেন। পঙ্কজ মল্লিককে অনুকরণ করে এতদিন এগিয়েছেন। এবার নিজস্বতা তৈরির দিকে মননিবেশ করলেন।
১৯৪৪ সালের প্লেব্যাক শুনলেই বোঝা যায়। সম্পূর্ণ নিজস্ব স্টাইল। গাইলেন—
‘মাটির ঘর’ ছবিতে। ‘যত চেয়ে দেখি বারে বারে’। কথাঃ শৈলেন রায়, সুরঃ শচীন দেব বর্মণ
১৯৪৩ সালে ‘প্রিয় বান্ধবী’ ছবিতে রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরতে থাকল তাঁর নাম। সেই সময় ‘প্রিয় বান্ধবী’ সিনেমা পরিচালক সৌমেন মুখোপাধ্যায়ের (সুচিত্রা মিত্রের দাদা) তাঁকে মনোনিত করেছিলেন। তাঁর মাধ্যমেই সঙ্গীত পরিচালক রবিন চট্টোপাধ্যায় ‘সাত নম্বর বাড়ি’ ছবিতে গান গাইবার জন্য ডাকলেন হেমন্তকে। সে সময় প্রথম দুই তিনদিন শুধু শিল্পীর সঙ্গে রিহার্সাল হত। তারপর অর্কেস্ট্রার সঙ্গে গায়কের রিহার্সাল হত। মোট সাত-আটদিন ধরে চলত একটি গান রেকর্ডিং।
সে বছর ১৯৪৬-এই ‘সাত নম্বর বাড়ি’ ছবি মুক্তি পেল। ছবি হিট। হেমন্তের গাওয়া দুটি গান বিপুল জনপ্রিয় হল সে সময়। দুটি গানেরই গীতিকার প্রণব রায়, সুরকার রবিন চট্টোপাধ্যায়।
১। ফেলে আসা দিনগুলি মোর
২। তোমারে ভুলিয়া আপনারে
এই গানদুটি রেকর্ডিং হয়েছিল সবচেয়ে দ্রুত। নিয়ম ভেঙে রবিন চট্টোপাধ্যায় রিহার্সালের তিনঘন্টা পরেই যন্ত্রশিল্পীদের ডেকে সেদিনই রেকর্ড করেন। আশ্চর্য দুটি গানই হিট হয় এবং এই ঘটনা স্টুডিও পাড়ায় মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৪৪ সালে হেমন্ত বম্বে গেছেন। আলাপ হল প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে। তখন প্রমথেশের ‘শেষ উত্তর’ ছবির হিন্দী ভার্সন ‘জবাব’ মুক্তি পেয়েছে। সারা দেশে তাঁর নাম। হেমন্তকে বড়ুয়া সাহেব বাংলায় ফিরে দেখা করতে বললেন। একটা ছবিতে দুজন মিলেই সুর করবার প্রস্তাব দিলেন।
১৯৪৭ সালে হেমন্তর কাজ শুরু হল সলিল চৌধুরীর সঙ্গে। আই পি টি-এর সঙ্গে যুক্ত থাকায় হেমন্তের সঙ্গে আলাপ ছিল তাঁর। একদিন সলিল এলেন হেমন্তের বাড়ি। শোনালেন তাঁর সৃষ্ট বিভিন্ন সুর। সলিল চৌধুরী যেধরণের গান করছিলেন সেগুলির অধিকাংশই কয়্যার। ফলে একক গান হিসেবে হেমন্তের সুরগুলি পছন্দ হচ্ছিল না।
সলিলকে সে কথা বলায় বিফল হয়ে চলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েও ফিরে এলেন সলিল। শোনালেন একক হিসেবে গাওয়ার একটি গান।
১। কোন এক গাঁয়ের বধূ
পছন্দ হয়ে গেল হেমন্তর। গানটি প্রধানত ছিল দীর্ঘ কাহিনিসংগীত। ফলত একটি গানই দুপিঠে রেকর্ড হল। এরপর আর থেমে থাকেননি হেমন্ত-সলিল। একের পর এক সুরকার সলিল চৌধুরীর সৃষ্ট গান গেয়ে চললেন হেমন্ত।
‘রানার’,
‘পালকির গান’,
‘অবাক পৃথিবী’
গ্রামোফোন কোম্পানীতে তখন হু হু করে বাড়ছে এই উদীয়মান শিল্পীর গানের চাহিদা। ‘গাঁয়ের বধূ’ রেকর্ড বিক্রি হল।
এর মাঝে ঐ বছরই হেমন্ত সুরারোপিত একটি হালকা চালের গান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।
‘কথা ছিল তোমার মালা করবে আমায় দান’
অন্যদিকে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সলিল চৌধুরীর নাম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল।
১৯৪৫ সালের আরেকটি মোড় ঘুরল হেমন্তের জীবনে। পরিচালক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় ডেকে পাঠালেন তাঁর ছবির সঙ্গীত পরিচালনার জন্য। এতদিন সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন এবার পুরোপুরি প্রধান সঙ্গীত পরিচালক। সুর দিলেন ‘পূর্বরাগ’ ছবিতে। তারপর সুর দিলেন হেমেন গুপ্ত পরিচালিত ‘অভিযাত্রী’ ছবিতে। খুলে গেল নতুন আরেকটি পথ। সুর দিলেন পর পর কিছু ছবিতে।
‘ভুলি নাই’
‘সন্দীপন পাঠশালা’
অদ্বিতীয়া
প্রভৃতি ছবিতে। সঙ্গে চলতে থাকল প্লেব্যাকের কাজ।
ভি. শান্তারাম তখন বম্বের বিখ্যাত পরিচালক। তিনিও চাইলেন ‘শিবশক্তি’ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব নিন হেমন্ত। হেমন্ত রাজী হলেন কিন্তু কোন অনিবার্য কারণে সে ছবি মুক্তি পায়নি। দু-তিনমাস থেকে বম্বে থেকে ফিরে এলেন হেমন্ত।
বাংলায় ফিরে সুর দিলেন হেমেন গুপ্তের ‘৪২’ ছবিতে। সে ছবির সুরও জনপ্রিয় হল। এরপর হেমেন গুপ্ত ‘আনন্দমঠ’ ছবি পরিচালনার জন্য বম্বে গেলেন। হেমন্তকে প্রস্তাব দিলেন সুর করবার। প্রথম হিন্দি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার প্রস্তাব নিয়ে ১৯৫১ সালের মার্চে বম্বে গেলেন হেমন্ত।
শশধর মুখার্জীর ফিল্মিস্তানে মাস মাইনের চাকরি পেলেন সঙ্গীত পরিচালনার। শশধর মুখার্জি তাঁকে ‘ভাড়া খাটা মিউজিক ডিরেক্টর’ থেকে একেবারে বাধা মিউজিক ডাইরেক্টরের চাকরি দিলেন। মন দিয়ে কাজ শুরু করলেন হেমন্ত। ফিল্মিস্তানের সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরের সম্পর্ক ভালো ছিল না। কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রস্তাব লতা মঙ্গেশকর ফেলতে পারলেন না। ১৯৫২ সালে ‘আনন্দমঠ’ ছবিতে লতাকে দিয়ে প্লেব্যাক গাওয়ালেন হেমন্ত। ‘আনন্দমঠ’-এর যে ‘বন্দেমাতরম’ গানটি সারা ভারতবর্ষে জনপ্রিয় তার পিছনে ছিল দীর্ঘ পরিশ্রম। পরিচালক হেমেন গুপ্ত এই গানটি রেকর্ডিং-এর সময় কুড়িবার গাইয়েছিলেন লতাকে দিয়ে। লতার একুশতম পরিবেশনই আমরা এখন শুনতে পাই।
ভাবলে আশ্চর্য লাগে কতটা অধ্যবসায় থাকলে এমন একজন শিল্পী হওয়া যায়। কিন্তু ‘আনন্দমঠ’ ছবিটি ফ্লপ করল।
এরপর পরের পাতায়–>