খেলার পাতা এভারেস্ট এরিক শিপটন অনুবাদ বাসব চট্টোপাধ্যায় বর্ষা ২০১৬

এই লেখার সবকটা পর্ব একত্রে এই লিংকে

আমাদের ভাগ্য এতই সুপ্রসন্ন যে নর্থকল পর্যন্ত পৌঁছতে পুরো অভিযানে কোন দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়নি। জুন মাসের শুরুতে নর্থকল থেকে অনায়াসে শৃঙ্গ আরোহণের একাধিক পদক্ষেপ নেবার মত আরোহণের প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জাম ও রসদ ছিল আমাদের সাথে। আরোহণের অনুকূল আবহাওয়ায় অভিযাত্রীরা সকলেই সুস্থ। তবু অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল উত্তর গাত্রের শীর্ষ থেকে পদতল পর্যন্ত আচ্ছাদিত পুরু তুষারগালিচা। কেবল দূর থেকে দৃশ্যমান বরফের আস্তরণের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত কৃষ্ণবর্ণ সংকীর্ণ পাথুরে পথ প্রত্যক্ষ করে আমরা তখন আশাবাদী।

Tilman, Lloyd, Smith এবং আমি ১৫জন শেরপাকে সঙ্গে নিয়ে উত্তর-পূর্ব চূড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে ২৫,৭০০ ফুট উচ্চতায় পঞ্চম শিবির স্থাপন করলাম। Lloyd-এর অক্সিজেন ব্যবহারের প্রয়োজন হল। ১৯২৪ থেকে এ পর্যন্ত একাধিক অভিযানের মধ্যে এই প্রথম আধুনিক অক্সিজেন কন্টেনারের ব্যবহার শুরু হল। ১৯৩৩-এ অভিযাত্রীদের এই অভিযানের থেকেও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। কিন্তু উদ্যমের কোথাও ঘাটতি দেখা যায়নি। Smith এবং আমি পঞ্চম শিবিরে আটজন শেরপাকে নিয়ে থাকলাম। Tilman এবং Lloyd বাকি শেরপাদের নিয়ে নর্থকলে ফিরে গেলেন। পঞ্চম শিবিরে আমরা দু’রাত্রি কাটিয়ে ঝোড়ো হাওয়াকে উপেক্ষা করে তৃতীয় দিন ভোরবেলা শৃঙ্গের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

পঞ্চম শিবির থেকে আরোহণের সময় দ্রুত আবহাওয়ার অবনতি হতে থাকল। চারিদিকে তখন নরম বরফের আচ্ছাদন। কোমর ডুবে যাওয়া তুষার অতিক্রম করে এগিয়ে চললাম লক্ষ্যের দিকে। সামনে মাত্র পনেরো ফিটের কালো পাথুরে দেওয়াল আরোহণও অসম্ভব হয়ে উঠল। দীর্ঘ আরোহণের প্রয়াস ব্যর্থ হল। Smyth আরোহণের বিকল্প পথ আবিষ্কার করলেন। এই পথ অনুসরণ করে এগিয়ে চলা মালবাহকদের কাছেও কষ্টকর হয়ে উঠল। তখন বিকেল সাড়ে চারটে। আমরা ইয়েলো ব্যান্ডের নীচে পৌঁছলাম। উত্তর-পূর্ব চূড়ার খুব নিকটেই সেই স্থান। আমরা আর অগ্রসর হব না মনস্থির করলাম। কারণ অন্ধকার হবার পূর্বেই শেরপাদের পঞ্চম শিবিরে ফিরতে হবে। নীচে নামার সময় দুজন শেরপা অসুস্থ হয়ে পড়ল। বাকি দুজন শেরপা শিবির স্থাপন করল। শেরপাদের মধ্যে অধিকতর উচ্চে হিমালয়ে শিবির স্থাপনের প্রবণতার অন্যতম কারণ শৃঙ্গ আরোহণের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেওয়া। মাঝেমাঝেই শেরপারা জিজ্ঞাসার ছলে আমাদের আরো উচ্চে পৌঁছে দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করত। কিন্তু তীব্র ক্লান্তি তাদের এমনভাবে গ্রাস করেছিল যে, এই পরিস্থিতিতে তাদের ইয়েলো ব্যান্ডের নীচে তাঁবু স্থাপন করার মত শারীরিক সক্ষমতাও ছিল না।

২৭,২০০ ফুট উচ্চে পুনরায় শিবির স্থাপন করা হল। ১৯৩৩ সালে স্থাপিত ষষ্ঠ শিবিরের তুলনায় এই শিবির অনেক আরামদায়ক। সে রাতে অভিযাত্রীদের ঘুমের কোন ব্যাঘাত ঘটেনি। পাঁচ বছর আগে এই উচ্চতায় পৌঁছে গলা-ব্যথা এবং শারীরিক অবনতির কবলে পড়েছিলাম। সে তুলনায় এবার আমরা খুব সুস্থ। তৎসত্ত্বেও এই অধিক উচ্চতায় নিজেদের অর্ধজীবিত এবং অসহায় মনে হচ্ছিল।

সূর্য ওঠার আগেই রাত থাকতে আমরা রওনা হলাম। নতুন উদ্যমে ইয়েলো ব্যান্ডের নীচের তুষার সাম্রাজ্যে অতিক্রম করতে করতে পুনরায় এগিয়ে চলার শুরু। দ্রুত আমাদের সমস্ত মানবিক অনুভূতি যখন শেষসীমায় তখনই আমরা কোনরকমে শিবিরে ফিরলাম। অপেক্ষা করতে থাকলাম যতক্ষণ না সূর্যের উত্তাপ বৃদ্ধি পায়। সাথে সাথে উত্তর-পূর্ব গাত্র দিয়ে চূড়ায় পৌঁছনোর পরিকল্পনা শুরু হল। সোজাসুজি আরোহণ অসম্ভব হওয়ায় ডানদিক ধরে আড়াআড়িভাবে আরোহণ শুরু করলাম। অভিযাত্রীদের মধ্যে তখন সম্পূর্ণ হতাশাজনক পরিস্থিতি। এমন কোন নিরাপদ স্থান দেখা যাচ্ছিল না, যেখানে বরফের আস্তরণ নেই। ঘন্টাখানেক অতিবাহিত হল, কিন্তু একটি আরোহণের দড়ির দৈর্ঘ্যের অর্ধেক অংশ আমরা অতিক্রম করতে পারিনি।  অভিযান চলতে লাগল ধীরগতিতে। প্রয়োজন হয়ে পড়ল বরফ কেটে রাস্তা তৈরি করবার। নীচের শিবির থেকে ষষ্ঠ শিবিরে অভিযাত্রীদের নিয়ে আসার পরিকল্পনা হল। হাতে হাত লাগিয়ে বরফ কেটে সকলে পথ তৈরি করতে থাকল, যাতে অনায়াসে সপ্তাহান্তে শৃঙ্গের চূড়ায় পৌঁছনো যায়। কিন্তু এহেন অবস্থায় ইয়েলো ব্যান্ডের উপরের পাথুরে পথে ন্যুনতম গতিবিধিও বিপজ্জনক। অভিযান স্থগিত রাখার প্ররোচনা সত্ত্বেও আমাদের জ্ঞানবুদ্ধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সুরক্ষার পূর্ণ বন্দোবস্ত করে আরোহণ শুরু করেছিলাম। যদিও কৃষ্ণবর্ণ পাথুরে খাড়াই দেওয়াল আরোহণ করে ব্ল্যাক ব্যান্ড চূডায় পৌঁছনোর ঝুঁকি প্রায় আত্মহননের নামান্তর। আমরা নিশ্চিত ছিলাম এভারেস্টের নর্থ ফেসের উপরিভাগ বর্ষার সময়ে তুষার চাদরের আস্তরণে আরোহণের অনুপযোগী হয়ে উঠবে। কিন্তু আমরা যেখানে ছিলাম, সেখান থেকে উত্তর-পূর্ব ধার বরাবর শৃঙ্গ ভয়ংকর, আকর্ষণীয় ও সুন্দর।

পঞ্চম শিবিরে ফেরার সময় পথে Tilman এবং Lloyd-এর মুখোমুখি হলাম। তারা তখন দ্বিতীয়বার পদক্ষেপের তোড়জোড় করতে ব্যস্ত। ওঁদের পথ নির্বাচন আমাদের আবিষ্কৃত পথকেই অনুমোদন করেছিল। কিন্তু ইয়েলো ব্যান্ডের বিপজ্জনক পথ সম্বন্ধে তাঁদের কোন ধারনাই ছিল না। Lloyd নর্থ কল থেকে ষষ্ঠ শিবিরে পৌঁছনো পর্যন্ত পুরো পথই অক্সিজেন ব্যবহার করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি শারীরিকভাবে বেশ সুস্থ ছিলেন। কিন্তু Tilman খুব অনায়াসেই এই পথ এগোলেও শেষপর্যন্ত পুরোপুরি দক্ষতার নিদর্শন রাখতে পারেননি।

বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাওয়ায় সে বছরের মত এভারেস্ট অভিযান স্থগিত রাখতে হয়। দ্রুত রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটতে থাকে। পাশ্চাত্যের অভিযাত্রীদের তিব্বতের দিক দিয়ে এভারেস্ট অভিযানের অনুমতি পাওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে।    

খেলার পাতা বিভাগের সমস্ত লেখা একত্রে