অমর মিত্রের অন্যান্য গল্পঃ তেঁতুলে শ্রীমধুসূদন, দলমা মশায়, চম্পকলাল, পিসি সরকারের ম্যাজিক, ভূত ও মানুষ, সাত রঙের পাখি
গর্জন সিং সাতফুট হয়ে যায় যায়। আরো লম্বা হবে শোনা যায়। তাকে মাপার জন্য কোনো ইঞ্চিকাঠই যথেষ্ঠ নয়। দরজির ঘরে যে ফিতে তাতেও হবে না। এর পর একটা কঞ্চির গায়ে দাগ দিয়ে রাখতে হবে গজ ফুট ইঞ্চি আর বিরিঞ্চি দিয়ে। গর্জন বলে, হামার দাদাজি চার গজ দো’ফুট তিন ইঞ্চি সাত বিরিঞ্চি লাম্বা ছিল, হামাদের হাইট কমে যাচ্ছে, হামার দাদাজির বাবাজি পুরা চার গজ তিন ফুট দশ ইঞ্চি বারো বিরিঞ্চি লাম্বা ছিল, এক বিরিঞ্চি বেশি হবে তো কম না।
বিরিঞ্চি কেয়া হায় ? লাখন সিং বুদ্ধুর মতো জিজ্ঞেস করে। বুদ্ধু তো বটেই, বিরিঞ্চি নেহি সমঝতা তো হাইটের কথা কী শুনবে ? ইঞ্চির পর বিরিঞ্চি। তা শুনে লাখন সিং আরো তর্ক জোড়ে, আরে বিরিঞ্চি তো সিপাই আছে, বিরিঞ্চি সিং, ই থানায় বিশ বছর আছে, বিরিঞ্চি বলে, জব তক বিরিঞ্চি জিন্দা রহেগা, তব তক বিরঞ্চি ইঁহাই রহেগা।
তো কী হলো, গর্জন সিং হেসেই উড়িয়ে দেয়, কত লম্বা আছে ?
সাড়ে চার ফুট।
আরে ওতো আমার দাদাজির পায়ের পাতার সাইজ হবে, বিরিঞ্চিকে ডাকা করো, বলো, ইঞ্চি সিং-এর ভাগ্না গজ সিং– গর্জন সিং ওকে দেখতে চায়।
তোমার মামা ইঞ্চি সিং ?
হাঁ রে হাঁ, তার মামা সের সিং, তার মামা ছটাক সিং, আমার আর এক মামা ফুটানি সিং, এক চাচা যোজন সিং, বিরিঞ্চিকে আমি দেখতে চাই লাখন ভাই।
হুম। লাখন সিং চুপ করে থাকে। বিরিঞ্চির কী দাপট এই হাঁস পাহাড়িতে। তার লাঠিকে কে না ভয় করে। চোরের বদলে সাধুর গায়ে পড়ে যখন তখন। যখন লাঠি ঘোরায় বিরিঞ্চি, তখন তার মাথার ঠিক থাকে না। বিরিঞ্চি লাঠির খোঁচা না দিয়ে কথা বলে না, কী রে লাখন, করচিস কী, কলা মুলো তো আর দিসনে।
দেব হুজুর, কলার কাঁদি দিয়ে আসব।
আরে কবে দিবি রে, কবে দিবি কলার কাঁদি মুলোর ঝুড়ি। বিরিঞ্চি সিং বলে।
গরমে মুলো আর ক্ষেতে নেই হুজুর। লাখন সিং বলে।
ক্ষেতে নেই বলে কি খেতে নেই ? বিরিঞ্চি মিহি মিহি গলায় গর্জন করে।
কীরে লাখন ভাই চুপ করে গেলি যে ? গর্জন সিং লাখন সিং-এর পিঠে হাত দেয়।
এই লম্বু ডাকাত এসেছে নাকি পশ্চিমের ওই পাহাড় গগন বুরু থেকে। গগন বুরুকে গগন পাহাড়ও বলে হাঁসপাহাড়ির লোক। তো গগন বুরুর ধারে মাটিয়া গ্রামে ঘর গর্জন সিং-এর। গ্রামের সবাই ডাকাত। ওটা ডাকাতিয়া গ্রাম। ঐ গ্রামে পুলিশ ঢুকত না ভয়ে। সারাদিন হারে রে রে রে…ডাক দিয়ে ডাকাতরা হাডুডু খেলত। গর্জন সিং বলে, সে ডেলি গগন বুরুতে ঊঠত আর লাফ দিয়ে নামত।
কেন উঠতে আর কেনই বা লাফ দিতে ?
হামার খুশ।
কিঁউ, খুস কিঁঊ ?
হে হে করে হাসে গর্জন সিং, তারপর বলে, পেরাক্তিস করতাম এই ভাবে।
পেরাক্তিস কী ?
বুরু থেকে লাফ দিয়া।
তুমি কি সত্যি বলছ গর্জন ভাই ?
হাঁ রে হাঁ।
পেরাক্তিসে কী হয় ?
আনন্দ হয়, মনের খুশ হয়।
লাখন সিং অবাক হয়ে পশ্চিমের আকাশে তাকায়। কী আশ্চর্য ব্যাপার! ওই যে দূর বহুদূরে আকাশের গায়ে চুড়ো ছুঁইয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়, ওর নাম যে গগন বুরু তা কে জানত, আর ওই বুরু থেকে লাফ দেয় যে গর্জন সিং, তাই বা জানত কে? এত লম্বা ডাকাত সে আর দ্যাখেনি। কিন্তু বড় রোগা। লিকলিকে কঞ্চির মতো। আর ওই ফিনফিনে দেহ নিয়ে সে যেমন হাঁটে, তেমনি করে হাঁটতে আর কেউ পারে না। কিন্তু সেই সময় আচমকা তার মনে হয়, হাঁটতে হাঁটতে গর্জন সিং না বাতাসে মিশে যায় আরো রোগা হতে হতে। এত রোগা ডাকাত ভূ-ভারতে আর নেই। সে নাকি গগন বুরু থেকে ভাসতে ভাসতে নেমে আসত নীচে। গগন সিং বলে, দরকারে সে উড়তেও পারে, উড়বার জন্যি তার দেহ এমন রোগা, না হলে সে পাহাড়ের মতো মস্ত হয়ে যেত।
পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির লাখন সিং বলে, তুমি যে উড়ে উড়ে নামতে, তুমার ডানা কই?
গর্জন সিং বলে, ডানা, পাখোয়া, হামার পাখোয়া, তখন চলে আসে, হামার বডি থেকে বেরিয়ে আসে, তো তুই এত ছোটামোটা কেন ? এইটুকু বডি নিয়ে তুই কী করে ডাকাত হলি, আমার দেশে, মানে গগন বুরুর দেশে, তোকে তো চোরি করতেও দিত না, চোরাই মাল বিচাকিনা করতিস, তার বেশি নয়।
এ হেন কথা শুনে মুখ চুন লাখন সিং ভাবে বলবে, তার দাদাজির দাদাজি পুরা এগার ফুট এগার ইঞ্চি ছিল, তাদের হাইট কমতে কমতে পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি হয়ে গেছে। এই হাঁসপাহাড়ির হাওয়ায় কী যেন আছে, মানুষ বাঁটকুল হয়ে যায়।
কথাটি মনের ভিতর চালাচালি করেও লাখন সিং বলতে পারে না। কথা শুনে এইসা খিক খিক হাসি দেবে গর্জন সিং যে পেটের পিলে মাথায় উঠে যাবে। গর্জন সিং তার গগন বুরুর দেশ থেকে কেন হাঁসপাহাড়িতে এসেছে কেউ জানে না, কিন্তু এখন হাঁসপাহাড়ি তার আবাস। হাঁসপাহাড়ির নামি ডাকাত লাখন সিং-এর ঘরে উঠেছে, বলেছে, তুম সিং, হাম সিং, এক সাথ রহেনা পড়েগা।
এই যে এখন চাঁদ উঠছে হাঁসপাহাড়ির ঝকঝকে আকাশে। তারা ফুটেছে অনেক। গর্জন সিং সে আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলে, চান্দা ভি মেরা মামা হায়।
লাখন বলে, আর সূরয ?
-ও ভি মামা হায়, বড় মামু।
-পোলিশ ?
গর্জন সিং বলে, পোলিশ গগন বুরু পার হতে পারত না, আমরা সব পেরাক্তিস করে আশমানে চান্দা মামুর কাছে ঘুরে বেড়াতাম।
এই সব কথার ভিতরে দূর থেকে খনখনে গলায় ডাক আসে, আরে ও লাখন, লাখন ডাকাতিয়া, কোথায় গেলি রে ?
-এইরে মামু এসে গেল। লাখন বলে ওঠে।
-মামু ! কৌন মামু ? গর্জন সিং জিজ্ঞেস করে।
-বিরিঞ্চি মামু।
-তুমহার বিরিঞ্চি মামু হ্যায়, হামার তো ইঞ্চি মামু থা, বিশ বিরিঞ্চি সমান এক ইঞ্চি, এই হিসাব।
-সিপাই মামু?
-মতলব?
-আরে বিরিঞ্চি সিপাই, থানার সিপাই মশায়, পাহারায় বেরিয়েছে।
-সিপাইকে তুমি মামা বলো। গর্জন সিং অবাক।
-সবাই বলে। লাখন সিং বলে।
-সব ডাকু ?
-না পাবলিক বলে। লাখন সিং বলে।
-পাবলিক আর ডাকু এক হলো, ডাকু কেন পোলিশকে মামু বলবে ?
লাখন সিং জিজ্ঞেস করে, তোমাদের গগনবুরুর দেশে কী বলে ?
-ভাগ্না, পোলিশ হলো ভাগ্না, আর ডাকু হলো ভাগ্নার মামু।
শুনতে শুনতে লাখন সিং আবার ডাক শোনে বিরিঞ্চি সিং-এর, আই লাখন, লক্ষণ ডাকু, ছিচকে ডাকু, গেলি কই ?
-হুজুর বিরিঞ্চি মামু, আমার ঘরে মেহমান। চিৎকার করে জবাব দেয় লাখন।
লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে বিরিঞ্চি সিং তার সাড়ে চার ফুট দেহ নিয়ে চলে এসেছে লাখন সিং-এর ঘরের উঠনে, কোন মেহমান, ঘর কাঁহা ?
সাড়ে ছ’ফুট গর্জন সিং ঝপ করে দাঁড়িয়ে পড়ে, হামি আছি, গগন বুরুর গর্জন সিং, হামি ইঞ্চি সিং-এর ভাগ্না গর্জন সিং, তুম কোন হও ভাগ্না ?
বিরিঞ্চি লোকটা আসলে বিরিঞ্চি গড়াই। গড়াই পদবীতে তেমন জোশ হয় না, তাই সে বিরিঞ্চি সিং হয়ে গেছে কোর্টে গিয়ে বিচারক হুজুরের কাছে প্রার্থনা করে। সে তার জোশ রাখতে পারে। তার হাতে লাঠি চলে যেমন, গুড়ুম পিস্তলও চলে তেমন। তার কথায় কত রকম মারপ্যাঁচ, ডাকু আর চোর সবাই ঘুমায় রাতভর। সে সিড়িঙ্গে তালগাছের মতো লোকটিকে দেখে অবাক বটে, কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করে না। তার হাঁটুতে লাঠির খোঁচা মেরে বলল, কোথা থেকে এলিরে কঞ্চি কুমার?
গর্জন সিং ঘাড় নুয়ে বলে, হামি গর্জন সিং আছি, গগন বুরু হামার মুলুক, তুম কৌন হো ভাগ্না ?
হে হে হে, গর্জন সিং না তর্জন সিং, কী রোগা আদমি রে বাপ, গগন বুরুর কঞ্চি সিং, এই লাখন এ কে, থানায় আসতে বল, ধোলাই হবে।
মতলব? গর্জন সিং বলে।
সাতটা ডাকাতি, কয়লা চুরি আর গাছ কাটার আসামী ধরতে হবে, এ মাসে এই কোটা আমার, ডাকাতি না হলেও সাত ডাকাতির আসামী ধরতে হবে, এই তো পেয়ে গেছি, কঞ্চি সিংকে কেস দিয়ে চালান করি আগে, তারপর জামিনে ছাড়িয়ে আনব, এই কঞ্চি থানায় আয়।
-কঞ্চি না, গজ্জন, হাঁ ভাগ্না, হামি যদি না যাই ?
-লাখনকে ভরে দিব। বিরিঞ্চি সিপাই বলে।
-লাখন যদি না যায় ?
-বিরিঞ্চি লাঠি ঘোরায়, সে হিম্মত আছে ?
-কেয়া হিম্মত ?
-বিরিঞ্চির কথা শুনবে না, সে হিম্মত ?
হা হা করে হাসে গর্জন সিং, বলে, হিম্মত সিং তো হামার খুড়ো হচ্ছে, গগন বুরুতে আছে, বহুত কামচোর আছে, সব সময় শুয়ে থাকে আর দিনমানে স্বপন দ্যাখে।
বিরিঞ্চি বলে, এই কঞ্চি সিং, বস উঠানে, আমার ঘাড় ব্যথা হয়ে যাচ্ছে তোর দিকে তাকাতে তাকাতে, শুয়ে থাক তোর খুড়োর মতো করে, বাপরে কী উঁচা আর কী রোগা!
এই সব কথা হচ্ছে যখন, লাখন সিং উঠে ‘জল খেতে যাই’ বলে কুটিরের পিছনে গিয়ে আর ফেরে না। লুকিয়ে বসে আছে বুনো ঝোঁপের আড়ালে। বিরিঞ্চি সিপাইয়ের দরকার হলেই তাকে তুলে নিয়ে চালান করে দেয় সদরে। তারপর হালকা কেস দিয়ে জামিনে ছাড়িয়ে আনে। তার মাথায় ১২১টা চুরি ডাকাতি রাহাজানি ছিনতাই খুন জখমের কেস আছে। সব চলছে। তার কাজই এইটা। মাঝে মাঝে চালান হয়ে যাওয়া। সাতদিন পুলিশের গুঁতো খেয়ে জামিনে ফিরে আসা। এর জন্য বিরিঞ্চি সিপাই তাকে মাসে হাজার টাকা করে মাসোহারা দেয় নিজের বেতন থেকে। তার পরিবর্তে বিরিঞ্চির খুব সুনাম পুলিশের দপ্তরে। তাকে হাঁসপাহাড়ি থানা থেকে বদলি করা হয় না। থানার বড়বাবু বদলি হয়ে গেলেও সে থেকে যায় বড়বাবু কাম সিপাই হয়ে। থানার আর সব সিপাই তাকে স্যার বলে। আবার কেউ কেউ হুজুরও বলে। বিরিঞ্চি সিং লাঠি ঘুরিয়েই কতবার যে লাখন সিংকে ধরল। কিন্তু লাখন সিং আজ আর ধরা দেবে না, বিরিঞ্চি আজ এই গগন বুরুর গর্জন সিংকে ধরুক। মাসখানেক শ্রীঘর ঘুরে আসুক গগন বুরুর ডাকাত। এই সময়টায় সে আসল ডাকাতি করে আসবে আশপাশে। তার ভিতরে ডাকু লাখন সিং-এর রোষ জেগে ওঠে। আসলে সে লক্ষ্মণ গুণ। নাম বদলে লাখন সিং। কিন্তু ডাকাত হওয়ার পর থেকে ডাকাতি আর করল কই ? বিরিঞ্চির হাতে পড়ে জীবন দুবির্ষহ হয়ে গেছে। হা রে রে রে করে ডাকাতি করতে পারল কই ? আজ আর থানায় যাবে না সে। গগন বুরুর ডাকাত হাজত খেটে আসুক।
খেয়াল হল বিরিঞ্চির, কাঁহা গিয়ারে লাখন ?
কোনো উত্তর নেই।
গর্জন করে ওঠে বিরিঞ্চি, আরে কাঁহা গিয়া তুম, ওরে ও লাখন, লক্ষ্মণ গুণ, কোথায় গেলি বাঁদর ছেলে, এদিকে আয়।
কোথায় পাবে লাখন সিংকে। সে তখন হাঁটছে বনপথে। সোজা পশ্চিমে গগন বুরুর দিকে। বুরুটা দেখতে পাবে। পাহাড় সে দ্যাখেনি কখনো। আজ সারাদিন ধরে গগন বুরুর ডাকাতের কথা শুনে তার মনে পাখি ডেকেছে। গর্জন সিং-এর মতো উড়ে যেতে চায় সে। হারে রে রে রে করতে করতে সে ছুটছে চাঁদনি রাতে পশ্চিমে। চাঁদ ও চলেছে ওই পথে।
লাখন সিংকে না পেয়ে লাঠি পাকিয়ে লম্বা ডাকাত গর্জন সিংকে সে তাড়া দেয়, এই থানায় চল, হট হট। যেন গরু হাঁটিয়ে নিয়ে যায় বিরিঞ্চি সিপাই।
থানায় কী আছে বিরিঞ্চি ভাগ্না ?
মামু আছে রে মামু আছে কঞ্চি সিং, তোকে ধরেছি এবার আমি নিসপেক্টার হবোই হবো, একটা ডাকাত ধরলে পোমোশনে নিসপেক্টার।
কী আশ্চর্য ! কঞ্চি সিং না না গর্জন সিং, লম্বু ডাকাত ধরা দিল। আসলে সে কোনোদিন মামু ঘরে কিংবা ভাগ্না ঘরে যায়নি। তার খুব লোভ ছিল। শুনেছিল হাঁসপাহাড়ি গেলে মামু ঘর যাওয়া সোজা। গগন বুরুতে যা ভাগ্না ঘর হাঁসপাহাড়িতে তা মামু ঘর। শ্রীঘর। সাড়ে চারফুট বিরিঞ্চির সামনে সাড়ে সাতফুট নয়া ডাকাত গান ধরেছে, মামু ঘর আয়ে, আহা মামু ঘর যায়ে। আর দূরে চাঁদের আলোয় লাখন সিং হার রে রে রে করতে করতে ছুটছে তো ছুটছে, আজ রাতের ভিতর গগন বুরুতে পৌঁছবে সে।
অলঙ্করণঃ রাহুল মজুমদার