গল্প গজুমামা জিন্দাবাদ জয়তী রায় বর্ষা ২০২০

জয়তী রায়ের আগের গল্প- চোখ

জয়তী রায়

বড়মামা বলতেন, ‘ভূত বাইরে কোথায়? তোরাই তো একেকটা জ্যান্ত ভূত।’ শুনে বেজায় রাগ হলেও চুপ করে থাকা ছাড়া উপায় ছিল না। নৈহাটির বিজয়নগর কলোনি এখন ঝাঁ-চকচকে। কিন্তু ছোটোবেলায় কলকাতা থেকে প্রত্যেক গরমের ছুটিতে দশ-বারো দিনের জন্য মামাবাড়ি নৈহাটি যেতেই হত। চার-চারটে ছেলেমেয়ে নিয়ে মা নাজেহাল হয়ে শেষের বিচ্ছুদুটোকে মামাবাড়ি পাঠিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতেন। সত্যি বলতে কী, আমরাও বাঁচতাম। সেই সময়ও তো নীল তিমি গেম ছিল না, পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে হবে এমন দিব্যি ছিল না, ছবি আঁকার কম্পিটিশন, রিয়েলিটি শো বলে কোনও বস্তু ছিল না। গরমের ছুটি মানে ছু-উ-টিই…! আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে। শাখে শাখে পাখি ডাকে। কোনও পিছুটান নেই। আগডুম বাগডুম টেনশন নেই। মামা-দিদি-মা-মাসিদের প্রশ্রয়ে পাড়ার বিরাট বাহিনি নিয়ে বাঁদরামি করতাম মনের সুখে। আহা! কী ছোটোবেলা ছিল রে ভাই নৈহাটিতে। সোনা দিয়ে বাঁধানো। শুধু রাতেরবেলাটুকু ছেড়ে।

ছমছমে রাত—ধীরে ধীরে, গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আমবাগান, বাঁশগাছের ঝাড়, নির্জন উঠোনের একপাশে সাদা ফুলের চাদর জড়ানো কামিনীগাছকে পার হয়ে সিমেন্ট বাঁধানো, হ্যারিকেন জ্বালানো বারান্দায় এসে থমকে দাঁড়াত। বারান্দায় চওড়া চৌকিতে অফিস ফেরত বড়মামা, মামাতো দাদা তপন-স্বপন, মাসি ফুটু, আমি আর আমার ভাই দীপু—সব মিলে মুড়ি, তেলেভাজা চলছে। তেলেভাজা মানে মটর, আলু-পেঁয়াজ ভাজা দিয়ে মাখা মুড়ি। এমন সব সুখের মুহূর্তে উঠোনের ওলটানো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে তপনদাদা বলত, ‘মুনিয়া দ্যাখ, ওই যে। এসেছে। সে এসেছে।’

মা গো! ঝপ করে মাসির কোলে চিপটে গেলেও এক চোখ চলে যেত উঠোনের কোনায় কামিনিগাছটার দিকে। সত্যি সে দাঁড়িয়ে আছে! ঝুপসি অন্ধকারে। চুপ করে একলা। কারণ, মামা বলেছিলেন, ‘সে এলেই সাদা ফুলে ভরা কামিনিগাছকে আর দেখা যাবে না। মনে হবে একটুকরো অন্ধকার দুঃখী মুখে দাঁড়িয়ে আছে।’

এই ‘সে’ ছিল আমাদের মামাবাড়ির বিখ্যাত ভূত গজেন মুন্সী। বড়োমামা দুঃখ করে বলতেন, ‘আরে, গজু যদি মানুষ থাকত, তবে কি বুড়ো বয়েসে আমাকে বাজারহাট করতে হয়?’

‘মামা, গজু বুঝি বাজার করত?’

‘গজু বলবে না, মুনিয়া। উনি তোমার গুরুজন। বলো গজুমামা। রেগে গেলে গজা সাংঘাতিক, হ্যাঁ!’ বলে মামা চোখ মটকে উঠোনের কোনায় ইঙ্গিত করতেন।

খুব রাগ হলেও বলতাম, ‘তা উনি কি তোমার বন্ধু ছিলেন?’

চওড়া কাঠের চৌকি। সেখানে তোষকের উপর সাদা চাদর। সাদা ওয়াড়ের মাথার বালিশ, পাশবালিশ। পানের ডিবে। ঝালর লাগানো হাতপাখা। সেখানে আধশোয়া বড়মামা। গোলগাল, হাসিখুশি। ভালো মানুষ। গজুমামার কথা উঠলে উদাস গলায় বলেন, ‘ঘটনা অন্য। অনেকদিন আগের কথা। আমার বাবা মানে তোর দাদু দেখেছিলেন ছেলেটা নাকি ইস্টিশনে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তখন তার বয়স হবে পাঁচ। নাম বলল, গজেন মুন্সী। আর কিছু বলতে পারল না। বাবার কেমন মায়া হল। সঙ্গে করে নিয়ে এলেন। থেকে গেল বাড়িতে। আমিও তখন  বছর দশেকের।  তবে মাথা মোটা হাঁদা ছিল একটা। লেখাপড়া কিস্যু হল না। ওই যেমন তেমন করে বড়ো হতে লাগল।’

কথাটা শুনে উঠোনের কোণ যেন একটু নড়ে উঠল। ভাই ভয়ে ভয়ে বলল, ‘গজুমামা রেগে গেলেন বোধহয়।’

‘আরে ধুর!’ মামা মাছি তাড়ালেন। ‘গজু রাগবে কেন? ব্যাটা আমার ছায়া হয়ে আরামেই থাকত। খেয়ে খেয়ে অ্যাইসা ভুঁড়ি, বুঝলি দীপু? তবে, গজা থাকলে আমার এই বুড়ো বয়েসে আর বাজারহাট, তোর মামির ডাক্তার—এসব করতে হত না।’ বলতে বলতে মামা কেমন উদাস হয়ে গেলেন।

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ‘এই যে তুমি বললে, গজামামা আছে! তবে আর কী? তোমার দুঃখ হলে তাকে ডেকো।’

কথা শুনে সব হৈ হৈ করে আমাকে এই মারে তো সেই মারে। ভূতকে অমন করে ডাকে নাকি? ভূতের কি মানুষের মতো কাজ করবার ক্ষমতা আছে নাকি? ডাকলেই কি ভূত আসবে? সে কেবল রাতে আসবে। এইসব বলতে বলতে ঘুমানোর সময় হয়ে গেল, উঠোনে একলা গজামামাকে ফেলে আমি আর ভাই দিদিমার কোল ঘেঁষে শুয়ে পড়লাম।

মামার বাড়ির দিঘির পাড়ে আমাদের দুপুরের আড্ডা হত। সে এক বিশাল দিঘি। জলের রং গেরুয়া। মামাতো ভাইবোনেরা হাসতে হাসতে জলে ঝাঁপায়, ভেজা গায়ে উঠে আসে, আমরা কলকাতার বেকুব বাচ্চা চেয়ে চেয়ে দেখি। বাচ্চাগুলোর সঙ্গে সঙ্গে কলকল করে খেলত জল, খেলত আকাশ, নির্জন দুপুর পর্যন্ত ছুটে এসে খেলায় যোগ দিচ্ছে, এমন মনে হত। অদ্ভুত অলৌকিক সেইসব সময়। ভাই বলল, ‘একবার চুপিচুপি নামব আমরা।’

শুনে শিউরে ওঠার বয়স না হলেও আমি কড়া করে ভাইকে বারণ করলাম, ‘খবরদার ভাই! ডুবে মরে যাবি কিন্তু।’

ভাই আমার কথা খুব শোনে। দিদি অন্তপ্রাণ। তাই বিশ্বাস ছিল, ও নামবে না দিঘিতে।

রাতের আসরে মামা আবার শুরু করলেন গজুমামার গল্প। আজ উঠোনের কোনা থেকে কামিনী ফুলের তীব্র মিষ্টি সুবাস ভেসে আসছে। বৈশাখী ঝড় হয়েছে একপ্রস্থ। ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধের সঙ্গে কামিনী ফুল, আর চা-চিঁড়ে ভাজা মিলেমিশে একাকার। দিদিমার কাছে ঘেঁষটে বসে শুনছি গজামামার মাছ ধরার গল্প।

কোন খালে কোন বিলে কীভাবে মাছ ধরা পড়বে, গজু সব খবর রাখত। পাড়ায় পাড়ায় মাছ ধরার কম্পিটিশনে বড়মামা আর তাঁর বন্ধুরা ফার্স্ট হবেই। বড়মামা ইস্কুল থেকে না আসা পর্যন্ত ঠায় বসে থাকত রাস্তার ধারে আমগাছের নিচে। দাদু মারা যাওয়ার পরে মামার বাড়ির ভার অনেকখানি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল সে। লেখাপড়া না জানলে কী হবে, এমন বুদ্ধি ছিল যে হিসেবে মাছি গলার উপায় ছিল না।

“কিন্তু থাকল কই?” মামা হাহাকার করে উঠলেন, “তোরা দেখিসনি তাকে। যখন চিরতরে চলে গেল, বয়স মোটে আঠারো। আমার বিয়ে হয়েছে। তপন হবে হবে। সরল সোজা নাদুসনুদুস ছেলে। খাকির হাফ-প্যান্ট। আর একটা গেঞ্জি পরে ঘুরে বেড়াত। তোর মামির ন্যাওটা ছিল। সব তো ছিল। হঠাৎ দেখি, নেই।” মামা ব্যাকুল গলায় বলে উঠলেন।

উঠোনের চুপ করে থাকা ছায়াটা আবার নড়ে উঠল।

আমি আবার বেকুবের মতো বলে বসলাম, “একবার তুমি  বলো সে কোথাও যায়নি, আবার বলো সে চলে গেছে—কী যে বলো না!”

মামা যেন শুনতেই পেলেন না আমার কথা। চিঁড়ে ভাজার বাটি হাতে উদাস স্বরে বলতেই থাকলেন, “কত বলেছি, গজা রে, এত খাস না, এত লোভ করিস না! তো সেকথা ব্যাটা কানেই নিত না। এই যে চিঁড়ে ভাজা দেখেছিস, বজ্জাতটা একা পাঁচ বাটি খেয়ে নিত। কলির ভীম। হুঁ।” বলে রাগের চোটে মামা নিজের গোঁফ ঝাড়লেন, মাথা নাড়লেন। সেই সঙ্গে কামিনীগাছ আবার সাদা ফুলে আলো হয়ে গেল।

সেই দেখে নিঃশ্বাস ফেলে মামি বললেন, “অমন করে খাওয়ার খোঁটা দিতে আছে কাউকে? দুঃখ পেয়ে চলে গেল গজু ঠাকুরপো। জানিস মুনিয়া, তোর মামা তো বিয়ে করেই খালাস। আমার সব খেয়াল রাখত গজু ঠাকুরপো। তপন যখন পেটে, কচি কতবেল মাখা, তেঁতুল মাখা সব এনে দুপুরবেলা লুকিয়ে দিত। একমুখ হাসি নিয়ে আমার পায়ে আলতা পরাত। বারণ করলেও শুনত না।” মামি আঁচল চাপা দিলেন চোখে।

মামা লাফিয়ে উঠলেন, “গজু আলতা পরাত তোমার পায়ে? তাও দুপুরবেলা? বলোনি তো কোনোদিন! তাই বলি, ব্যাটা দুকুরবেলা যেত কোথায়। জিজ্ঞেস করলেই পেট দেখাত। ভাবতাম পাইখানায় যায়। তা না, তোমার পায়ে আলতা! উফ্‌!”

নির্জন দুপুরে অন্তঃসত্ত্বা তরুণী বউয়ের পা কোলে নিয়ে গজুমামার আলতা পরানো দৃশ্য বোধ করি পৃথিবীর সুন্দরতম দৃশ্য। দেখলাম কামিনীগাছ আবার অন্ধকারে দুলে দুলে উঠছে। ভাই বলল, “গজুমামা হাসছে।”

মামা মুখ ভেংচে বলে উঠলেন, “তা তো হাসবেই। পাজির পা ঝাড়া। যদি হাতে পেতাম একবার।”

ভাই বলল, “তুমি হাতে পাবে না জেনেই গজুমামা হাসছে।”

শুনে আমরা সকলে হো হো করে হেসে উঠলাম। কামিনীগাছটাও জোরে জোরে দুলতে থাকল। কেবল মামাই কেমন গম্ভীর হয়ে গেলেন।

পরেরদিন গোছগাছ করছি। কলকাতা ফিরে যাব বিকেলের ট্রেনে। ভাই বলল, “গজুমামাও তো আমাদের মামা, দিদিভাই। ওঁকে প্রণাম করতে হলে তো সেই রাত্তির। তখন তো বাড়ি। তবে?”

ভাইয়ের অবোধ চোখদুটির তাকিয়ে বললাম, “ধুর বোকা, ভূত আর ভগবান সব দেখতে পায়। দিনেরবেলাতেও সব শোনে। তুই যেকোনও সময়ে প্রণাম করিস।”

কেউ আমাদের কিছু না বললেও এদিক ওদিক থেকে গজামামার শোচনীয় মৃত্যু কীভাবে হল জেনে গেছিলাম। তখন সদ্য তপনদাদার জন্ম হয়েছে। সে বছর শিবরাত্তিরে সবাই ভাঙ খেয়েছিল। গজামামা একটু বেশি। তারপর রাতে কীভাবে ওই দিঘিতে পড়ে যায়। একে ভরপুর নেশা, তারপরে বিশাল ভারী শরীর। পরেরদিন ভেসে উঠল মামা। গলায় শাপলা-কলমির লতা জড়ানো, বীভৎস ফুলে ঢোল শরীর।

মামা মানতেই চান না, যে তাঁর আদরের সখা তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে। তাই বোধ হয় কল্পনা করে সুখ পান যে ওই কামিনীগাছের নিচে রোজ গজামামা এসে দাঁড়ায়।

বাড়ি যাব বিকেলে। সঙ্গে যাবে দুই দাদা। একবুক মনখারাপ নিয়ে ছুটির শেষ দুপুর কাটাতে আমবাগানে গেলাম সকলে। চোখ ছলছল করে বিদায় নিলাম। আবার আসব পরের ছুটিতে। বাড়ি ফিরতেই মামির তাড়া, “মুখে চোখে জল দাও। যা ছিরি হয়েছে মুনিয়া তোমার! মা ভাববে আমি যত্ন করিনি। ভাই কোথায়?”

ভাই কোথায়? ভাই কোথায়? ভাই এই তো ছিল, কোথায় গেল? সকলে হৈ হৈ, দৌড়োদৌড়ি। আমার মাথায় চিড়িক দিল, ভাই দিঘিতে যায়নি তো? ও সাঁতার জানে না। কিন্তু দুরন্ত এক ইচ্ছে ছিল দিঘির জল ছুঁয়ে দেখার। সঙ্গে সঙ্গে সকলে দৌড়ল দিঘির দিকে।

পড়ন্ত বিকেল। বোশেখের মিষ্টি হাওয়া ছেড়েছে। দিঘির জলে ঢেউ দিচ্ছে হাওয়া। শান বাঁধানো ঘাটের ওপরে ভাই। ভেজা গায়ে কলমির লতা, শাপলার লতা জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। বেঁচে আছে। জলের থেকে তুলে কেউ যেন পরম যত্নে শুইয়ে রেখেছে ভাইকে।

ডাক্তার, হাসপাতাল। কলকাতা থেকে মা-বাবা এল। সব হল।

কিছুদিন পরে ভাই সুস্থ হয়ে উঠে কলকাতা যাবার সময় দিনেরবেলাই কামিনীগাছের গোড়ায় ইয়াবড়ো এক পেন্নাম ঠুকল। দেখে মামার মুখে গর্বের হাসি, মামির চোখে আঁচল চাপা।  কেননা, ভাই তার দুর্ঘটনার ঘটনাটা বলেছিল। বাড়ি যাবার আগে সবার চোখ এড়িয়ে শেষবারের মতো দিঘির জলে পা ডোবাতে গিয়ে হড়কে পড়ে যাবার সময় কাতর কণ্ঠে ডেকেছিল, “গজুমামা, বাঁচাও!”

কে না জানে মন দিয়ে ডাকলে ভূত দিনেরবেলাতেও আসে? ডেকে দেখবে নাকি একবার?

ছবিঃ রাহুল মজুমদার

জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস