অমরবাবুর অজানা ভয়
মৃগাঙ্ক মজুমদার
অমরবাবু রোজ ঘুরতে যান। একা একা। না, ঠিক একা-একাও নয়, সঙ্গে থাকে ওঁর তিরিশ বছরের পুরনো ভেস্পা স্কুটার। কালচে নীল রঙের স্কুটারটা চাকরি জীবনের শুরুতে কিনেছিলেন। সেই স্কুটারেই একের পর এক প্রেম করেছেন, তারপরে দুম করে একদিন বিয়েও করে ফেললন। স্কুটারের ভূমিকা পরিবর্তন হল। প্রেমের সওয়ারি নিয়ে ঘুরে বেড়াবার বদলে মাসকাবারি বাজার বইতে লাগল সে। মাঝে মাঝে বউকে নিয়ে টুকটাক এদিক সেদিক ঘু্রতে যেতেন। এমনি দিনে আপিস থেকে রোজ ফিরে এসে হালকা করে কাপড় দিয়ে স্কুটারটাকে মুছে তারপর ঘরে গিন্নির সঙ্গে কফি খেতে খেতে আড্ডা। অমরবাবু চা অতটা পছন্দ করেন না। তাই বেছে বেছে কফি আনিয়ে রাখেন নীলগিরি থেকে, আরাকু থেকে, এমনকি ব্রাজিল থেকেও গ্যাঁটের কড়ি খরচা করে কফি আনিয়ে রাখতেন আর রাখেন। চা অবশ্যই থাকত ওঁর বাড়িতে, তবে সেটা খালি অতিথিদের জন্য। একপ্রস্থ ফার্স্ট ফ্লাশ আর একপ্রস্থ সেকেন্ড ফ্লাশ চা এনে রাখতেন সবসময়। আজকাল অবশ্য টিনের কৌটোতে রাখা আছে সেইসব চা। সঙ্গে বউয়ের তৈরি ফুলুরি, লঙ্কার চপ, আলুর চপ, ফ্রেঞ্চ টোস্ট, মুড়ি গরম করে ভেজে তার সঙ্গে চানাচুর আর পাঁপড় হালকা করে লঙ্কা কুচি দিয়ে মেখে এক লোভনীয় খাবার—ইত্যাদি নানান রকম ‘টা’ নিয়ে জমিয়ে গল্প করতেন বউয়ের সঙ্গে।
সপ্তাহে ছুটির দিন পেলে ছুটির দিন, আর ছুটির দিনে সময় না পেলে অন্য যেকোনও একটা দিন বরাদ্দ থাকত স্কুটার পরিষ্কারের পিছনে। সেদিন সবকিছু একটা একটা করে পরীক্ষা করে দেখতেন অমরবাবু। গিয়ার আর ক্লাচের তার, হেড লাইট, টেল লাইট, ব্রেক শু, তারপর সিট কভার ঝেড়ে পুঁছে ঘরে ঢুকতেন। আর স্কুটারটা সদ্য স্নান করে চকচকে শরীর নিয়ে আহ্লাদে ঘাড় বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত।
এরপরে ছেলেমেয়ে হওয়ার পরও বহুদিন সেই স্কুটারে চড়ে ঘুরেছেন সপরিবারে অমরবাবু। তারপরে ছেলে বড়ো হয়ে সেই স্কুটারে হাত দিতে চাইল। দোনোমনা করেও হাতে দিলেন। প্রথম কয়েক বছর ঠিক ছিল, তারপর ছেলে স্কুটারের অযত্ন করছে দেখে ছেলেকে আর দিলেন না চালাতে।
ছেলেমেয়েরা বিয়ে করে চলে গিয়েছে দেশের নানান শহরে। ছেলে আর ছেলের বউয়ের ব্যস্ত জীবন আর মেয়েরও তাই। তাতে অবশ্য কোনও অভিযোগ নেই তাঁর। গার্হস্থ্য, এরপরে তো বাকি বাণপ্রস্থ আর সন্ন্যাস। ভারতীয় জীবন দর্শনেই তো বলে। এটা মোটেই পশ্চিমের আমদানি নয়। পশ্চিম বরং বয়োজ্যেষ্ঠ্যদের আলাদা ব্যবস্থা রাখছে আজকাল। আলাদা করে দেখভাল করার জন্য একটা আলাদা বিভাগই আছে। প্রতি সপ্তাহে তারা খোঁজ নেয়, সাহায্য করে, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে আর্থিকভাবেও। সেসব অমরবাবু জানেন। তা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথাও নেই বিশেষ। তিনি নিজের জমানো টাকা আর পেনশন নিয়ে দিব্যি আছেন। মাথা এখনও টনটনে। বাকিদের মতো তিনি প্রযুক্তি দেখলে পিছিয়ে যান না। বরং স্মার্ট ফোন, অ্যাপ আর ট্যাব নিয়ে দিব্যি আছেন। এমনি কোথাও গেলে নিজের গাড়ি ড্রাইভ করেন একা-একাই।
কিন্তু এতবছর পরেও তিনি তাঁর প্রথম কেনা স্কুটারটাকে ফেলে দেননি বা বেচে দেননি। রোজ রাতে তাঁর এই গেটেড কমিউনিটির সবাই প্রায় ঘুমিয়ে পড়লে তিনি স্কুটারে কিক মেরে চালু করে এক চক্কর চালিয়ে আসেন। তার মতন স্কুটারটাও একেবারে টিপটপ কন্ডিশনে। প্রতিদিন বেরোনোর সময় দেখেন সিকিউরিটি তার ওই ছোট্ট ঘরটাতে বসে আছে চেয়ারে। দেয়ালে প্রায় পনেরো কি ষোলোটা সিসি টিভি, প্রত্যেকটা টিভির স্ক্রিন আবার চার ভাগে ভাগ করা, আলাদা আলাদা ক্যামেরার ফিড আসে সেখানে। এই কম্পাউন্ডটা বেশ বড়ো। ছ’টা টাওয়ার আছে দশতলা করে। প্রত্যেকটা তলায় তিনটে করে অ্যাপার্টমেন্ট, আর এর সঙ্গেই আছে দুটো ভিলা জোন, যেখানে পরপর গোটা কুড়ি ভিলা আছে। প্রচুর গাছ পোঁতা আছে, বড়ো ছোটো গাছ। রেন ওয়াটার হার্ভেস্টিং হয়, অনেক জল রিসাইকেল হয়। সন্ধের দিকে ভিলার দিকটা বেশ নির্জন। এইদিকে অবশ্য তিন-চারজন সিকিউরিটি গার্ড আছে, সঙ্গে দু-তিনটে ওয়াচ টাওয়ারও। তবুও একটু ছমছম করে গা। দিনের বেলা প্রচুর পাখি আর প্রজাপতি, ফড়িং, গিরগিটি, শুঁয়োপোকা, মানে ইকো-সিস্টেমের নিচের দিকের প্রায় অনেক কিছুই আছে, আর ওপরের দিকে একমাত্র মানুষ ছাড়া আর কেউই নেই এখানে।
এইরকমই একটা ভিলাতে অমরবাবু থাকেন। নিজের হাতে বাগান করেন। গাছ পোঁতেন। তাতে ড্রিপ ইরিগেশন চালু করেছেন নিজেই। গরমকালে এসি থাকলেও চালান না, কারণ গাছেরা ঘিরে থাকায় হাওয়া আর ঠাণ্ডা দুইই হয়। কিন্তু কম্পাউন্ডের বাইরে বেরোলেই একদম অন্যরকম দৃশ্য। কয়েক কিলোমিটার চলার পরই দেখা যাবে খালি গ্রানাইটের জঙ্গল রাস্তার দু’পাশ জুড়ে। জঙ্গলই মনে হয় অমরবাবুর। একেকটা পাথর গাছের মতো। কখনও ঝোপের মতো, কখনও ইয়াব্বড়ো ঝুপসি একটা ডালপালা ছড়ানো গাছ, একটা বড়ো পাথরের ওপর একের পর এক সাজানো। কীভাবে যে এইরকম আকার নিল, কেউই বলতে পারবে না। কিন্তু তাতে অমরবাবুর কিছুই যায় আসে না। তিনি নিজের মতন করে রোজ রাতে স্কুটারটা নিয়ে বেরোন। একটা লম্বা পাক মেরে ঘুরে আসেন। আবার স্কুটারটাকে গ্যারেজে তাঁর গাড়িটার পাশে এক কোনাতে রেখে গ্যারেজ লক করে ঘরে ঢুকে নিজের লাইব্রেরিতে চলে যান।
কিন্তু আজ স্কুটারটা বের করার সময় দেখলেন রাতের আকাশটা কীরকম গম্ভীর। পূর্ণিমা কাছেই, তাও চাঁদের দেখাটি নেই আকাশে। বর্ষা পেরিয়ে শরৎকাল ঢুকবে এইরকম একটা সময়ে। সকালের দিকে তেড়ে বৃষ্টি হয়েছে। বেরোবার সময় দেখলেন সিকিউরিটি গার্ড সিসি টিভি স্ক্রিনগুলোর দিকে তাকিয়ে। স্কুটারের আওয়াজে হালকা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। ওরা জানে, এই সময় অমরবাবু বেরোন।
তোরণটা পেরোলেই হালকা অন্ধকার নেমে আসে। রাস্তার আলো জ্বলে ঠিকই, কিন্তু বাকিটা প্রায় অন্ধকার। অমরবাবুর এ রাস্তা চেনা। দুয়েকটা খুচরো দোকান আছে, আর দেড় কিলোমিটার গেলে একটা শপিং মল আর কৃত্রিম ওয়াটার পার্ক আছে। তবে এই সময়ে সেখানও কেউই থাকে না। শপিং মলটা ছাড়িয়ে আরও কিছুটা গেলে হাইওয়ে, আর হাইওয়ের ওপারে বাড়িঘর আর বসতি অনেক বেশি।
এসবই চেনা আর জানা অমরবাবুর। কিন্তু আজ গেট পেরোনোর পরই দেখলেন পরপর দুটো ল্যাম্প পোস্টে আলো জ্বলছে না। হতেই পারে, মনে মনে ভাবলেন অমরবাবু। প্রথমটা পেরিয়ে দ্বিতীয়টার কাছে এগোচ্ছেন, এমন সময় খেয়াল করলেন, পরেরটাও নিভে গেল। অমরবাবু অত মাথা ঘামালেন না। খালি ভাবলেন, একবার কথা বলে নিতে হবে ইলেকট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে।
একটা ছোট্ট ঝাঁকুনি খেল স্কুটারটা এর মাঝে। অমরবাবু আবার রাস্তার দিকে মন দিলেন। যত এগোচ্ছেন, ততই একটা একটা করে লাইট পোস্টের আলোগুলো নিভতে থাকছে। হঠাৎ খেয়াল করলেন অমরবাবু যে কীরকম একটা খসখসানি আওয়াজ হচ্ছে রাস্তার দু’পাশ থেকে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, গ্রানাইটের পাথরগুলো গাছের মতো দুলছে। মাথাটা একটু ঝাঁকিয়ে নিলেন অমরবাবু। এরকম হঠাৎ কেন হচ্ছে? বয়সের কারণে কি? এবারে ছেলেদের কাছে চলেই যাবেন। বউ বারবারই বলে, ছেলেও অনেকবার বলেছে গিয়ে ওখানেই থাকতে। এবারে চলেই যাবেন।
স্কুটারের স্পিডটা একটু বাড়ালেন অমরবাবু। পাথরগুলো একটু বেশিই নড়ছে। কিন্তু হাওয়া তো সেরকম নেই। আকাশ জুড়ে মেঘটাও কাটছে না।
খসখসানির শব্দ তীব্র হচ্ছে এবারে। জোর বাড়ছে। শোঁ শোঁ হাওয়ার আওয়াজের মতো কানে আসছে, কিন্তু কই, হাওয়া তো নেই! কাছে কি কোনও আবার প্রজেক্ট হচ্ছে? এর আগে তো চোখে পড়েনি, কানেও আসেনি!
শপিং মলের কাছ থেকে ঘুরে বাড়ির দিকে যান প্রতিদিন। আজ শপিং মলের আলোটাও দেখা যাচ্ছে না। রাস্তা জুড়ে খালি স্কুটারের হেড লাইটের আলো। আগে-পিছে কতটা কিছুই দেখা যাচ্ছে না সেভাবে। কতদূর এসেছেন তাও বুঝতে পারা যাচ্ছে না। এর মধ্যেই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি নামল।
স্কুটার ঘোরাতে যাবেন, হেড লাইটের আলোয় দেখেন একটা পুকুর সামনে আর তার মধ্যে কে একজন চিত-সাঁতার দিচ্ছে। অমরবাবুর বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। এখানে কবে থেকে আবার পুকুর হল? ওয়াটার পার্কের মধ্যে ঢুকে পড়লেন নাকি ভুল করে? স্কুটারটা পুরো ঘুরিয়ে নিলেন। তারপর আবার মোচড় দিলেন অ্যাক্সিলারেটরে। পিছনে স্কুটারের শব্দ ছাপিয়ে জলের আওয়াজ আর তার মধ্যে কে যেন ছপ ছপ করে দৌড়াচ্ছে।
ঘাড় ঘোরাতে সাহস পাচ্ছিলেন না অমরবাবু। এতবছর এখানে থেকে এটা কী করে হতে পারে? এই সময়ে মোবাইল বার করে কাউকে ফোন করাটাও অসম্ভব। গাড়ি হলে ভাবা যেত। অমরবাবু সামনে দেখে চালাতে গিয়ে দেখলেন যে ওঁর হাত আর পা প্রায় ফ্রিজ করে যাচ্ছে। হঠাৎই পাশের পাথরগুলো ঝুঁকে ঝুঁকে রাস্তা আটকাতে চাইছে।
এরই মধ্যে স্কুটারের টেল ল্যাম্প আর সাইডের দুটো ইন্ডিকেটর জ্বলে উঠল, আচমকাই স্কুটারের গতি বেড়ে গেল। অমরবাবু দেখছেন, স্কুটারের স্পিডোমিটারের কাঁটা প্রায় একশোর কাছাকাছি। পাথরগুলো আটকে দিতে চাইছে পথ। পিছনেও ছপাৎ ছপাৎ শব্দের জোর আর গতি দুই বেড়েছে।
দেড় কিলোমিটার শেষ হতে কতক্ষণ লাগে? অমরবাবুর মনে এক অজানা ভয় ভর করল এবার। তাহলে কি তেনারা আছেন? নাকি এটা অন্য কিছুর সংকেত? তিনি কি কিছু করেছিলেন? কারো ক্ষতি?
জলের শব্দ বাড়ছে। পাথরের খসখসানি প্রায় কানের কাছে ঝড়ের মতো লাগছে। না তাকিয়েও অমরবাবু বুঝতে পারছেন, একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। অমরবাবু চোখ বুঝে ফেললেন।
চোখ খোলার পর দেখলেন, তিনি নিজের ভিলার সামনে শুয়ে, তাকে দু’জন সিকিউরিটি গার্ড পাহারা দিচ্ছে। আস্তে আস্তে উঠে স্কুটারের কাছে গেলেন তিনি। স্কুটারের পেট্রলের রিডিং দেখাচ্ছে শূন্য। দু’দিন আগেই রিজার্ভে চলে গিয়েছিল মানে প্রায় শেষ। ভুলে গিয়েছিলেন ভরতে তেল, এই প্রথমবারের মতো। তেল শেষ কখন হয়েছিল? কীভাবে এলেন এখানে তিনি? তেল শেষ হলে স্কুটার এতদূর এল কী করে?
সিসি টিভি ফুটেজে তাঁর বেরোনো দেখাচ্ছে, ঢোকার কোনও রেকর্ডিং নেই। খালি সিকিউরিটি গার্ড এত রাতে বাইরে পড়ে থাকতে দেখে মেন রুমে খবর দিয়েছে। ডাক্তার দেখতে আসছে কিছুক্ষণের মধ্যেই।
স্কুটারটার দিকে তাকালেন অমরবাবু। ঘাড় কাত করে যেন তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। আবার অজানা ভয়টা তাঁকে পেয়ে বসল।
জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে