গল্প আমি এসেছি সৌভিক হালদার শীত ২০১৯

সৌভিক হালদার

অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিল রণজিৎ। এইসময় হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠায় কিছুটা বিরক্ত হয়েই ল্যাপটপের পাশে রাখা ফোনটা তুলে নিল সে। দেখল দেবলীনা ফোনে করছে। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল তার। আজ তো পরির জন্মদিন! চকিত দৃষ্টিতে একবার ঘড়ির দিকে তাকাল সে, প্রায় রাত আটটা বাজে। আজ তো সন্ধে সাতটার মধ্যে বাড়ি ফেরার কথা ছিল তার। না, আজ তার আর রক্ষে নেই। তড়িঘড়ি করে ব্যাগ গোছাতে গোছাতেই কলটা রিসিভ করল সে, আর কিছু বলে ওঠার আগেই দেবলীনার গলা যেন ফোনের ভিতরে বজ্রপাত করল, “তুমি কীরকম বেআক্কেলে মানুষ হে? আজও তোমার কাছে কাজই সব হল? আজ যদি ওভার-টাইম না করতে কী এমন ক্ষতি হত তোমার?”

এতগুলো প্রশ্ন একসাথে শুনে বোধহয় রণজিৎ কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেছিল। এবার হয়তো নিজের দোষটা চাপা দেওয়ার জন্যই কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সে। কিন্তু দেবলীনা আবার চেঁচিয়ে উঠল, “আজ তোমার কোনও অজুহাত শুনব না আমি। মেয়েটা তোমার অপেক্ষায় সেই সন্ধ্যা থেকে বসে আছে। আমার কথা না হয় নাই ভাবলে, কিন্তু তোমার মেয়ের কথা কি একটুও ভাববে না?”

রণজিৎ এবার অত্যন্ত ধীর গলায় বলল, “প্লিজ, তুমি একটু শান্ত হও, আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি পৌঁছচ্ছি।”

এবার রণজিতের এর স্বরে অনুশোচনার আভাস পেয়ে বোধহয় দেবলীনা কিছুটা নরম স্বরে বলল, “তুমি আর দেরি কোরো না। তুমি তো জানো, তুমি না এলে পরি কেক কাটবে না।”

“ঠিক আছে, তুমি আর চিন্তা কোরো না, আমি এখুনি অফিস থেকে বেরোচ্ছি। বাই, টেক কেয়ার।”

“আচ্ছা, তুমি সাবধানে এসো।”

ফোনটা কেটে রণজিৎ তাড়াতাড়ি পার্কিং এরিয়ার দিকে দৌড়াল। লাল রঙের এই ফোর্ড গাড়িটা নতুন কিনেছে সে। লক খুলে সে গাড়িতে উঠতে যাবে হঠাৎ এমন সময় একফোঁটা জল এসে পড়ল তার গালের উপর। মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকাল রণজিৎ। সেখানে আলোকবিন্দুর কোনও চিহ্নমাত্র নেই, একটি ঘন অন্ধকারের চাঁদোয়া যেন আকাশকে দিগন্ত পর্যন্ত মুড়ে রেখেছে। এবার তার মনে হল, আজ আগে বাড়ি চলে যাওয়াই বোধহয় ভালো ছিল। গাড়িটা স্টার্ট দিতেই হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল তার। পরির জন্য গিফট কোনও কেনা হয়নি। কিন্তু আকাশের এইরকম অবস্থা সত্ত্বেও কি এখন কোনও দোকান খোলা থাকবে? আর না ভেবে রণজিৎ এবার বাড়ির দিকে রওনা দিল। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে সে বুঝতে পারল তার আশঙ্কায় ঠিক, বেশ জোরালো বৃষ্টির পূর্বাভাস পেয়ে সব দোকানপাট আজ তাড়াতাড়িই বন্ধ হয়ে গেছে।

বাড়ি থেকে যখন সে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে তখনই রাস্তার ডানদিকে একটি দোকানের দিকে নজর পড়ল তার। দোকানটা ছোটো হলেও নানারকম খেলনায় ভর্তি। দোকানদার দোকানের শাটার নামানোর মতলব করছে, ঠিক এমন সময় রণজিৎ গাড়ি থেকেই জোরে চেঁচিয়ে লোকটাকে থামতে বলল। রাত্রিবেলা হঠাৎ এত জোরে কাউকে চেঁচাতে শুনে দোকানদার ভয় পেয়ে গেছিল। কিন্তু পিছনে তাকিয়ে ল্যাম্প-পোস্টের আলোয় দোকানের সামনের বড়ো বটগাছটার তলায় দাঁড় করানো একটি গাড়ি থেকে এক স্যুট-বুট পরা বাবুকে তার দিকে হাসি মুখে এগিয়ে আসতে দেখে তার বুঝতে দেরি হল না যে এই অসময়ে বেশ একটা খরিদদার জুটেছে তার।

রণজিৎ আর একটু এগিয়ে আসতেই দোকানদার একগাল হেসে বলল, “কী চাই বলুন বাবু, যা চাইবেন সব পাবেন। খেলনা, পুতুল, বন্দুক সব।”

“না না, অতকিছু লাগবে না, একটা ভালো দেখে পুতুল দিন, তাহলেই হবে।”

দোকানদার তাকে ভালো পুতুল দিল বটে, কিন্তু এই সুযোগে লোকটা যে তাকে লুটে নিল তা বেশ বুঝেছে রণজিৎ। কিন্তু এর বিনিময়ে পরির মুখে হাসি ফুটলে তা হবে তার কাছে অনেক বড়ো পাওনা। সে গাড়িতে উঠে পিছনের সিটে পুতুলটা রেখে দিল। তারপর গাড়িটা স্টার্ট দিতে যাবে ঠিক এমন সময় এক পৈশাচিক আলো যেন গ্রাস করল তাকে, আর তারই সাথে এক কান ফাটানো শব্দে জ্ঞান হারাল সে। যখন তার জ্ঞান ফিরল, তখন বৃষ্টির মুষলধারা যেন তার চারপাশের পৃথিবীকে ভাসিয়ে দেওয়ার গুপ্ত পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দিতে উঠেপড়ে লেগেছে। রণজিৎ মাথার মধ্যে একটা হালকা যন্ত্রণা অনুভব করল। কিন্তু হঠাৎ কী যে হল তার সাথে সেটা সে বুঝে উঠতে পারল না। চারদিকে তাকিয়ে একবার দেখল সে। রাস্তা একেবারে শ্মশান। সেই ল্যাম্প-পোস্টের আলোটাও আর জ্বলছে না, দোকানটাও তো মনে হচ্ছে বন্ধ। প্যান্টের পকেট থেকে এবার ফোনটা বের করল সে। আর সেদিকে তাকিয়েই অবাক হয়ে গেল, প্রায় পৌনে ন’টা বাজে! এদিকে তার স্পষ্ট মনে আছে, সে যখন গাড়িতে ওঠার আগে টাইম দেখেছিল তখন বেজেছিল আটটা কুড়ি। তাহলে কি সে পঁচিশ মিনিট ধরে ওই দোকানের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে? ফোনটার দিকে তাকিয়ে আরেকটা জিনিস চোখে পড়ল তার। ইতিমধ্যে দেবলীনা প্রায় পাঁচ-ছ’বার ফোনে করেছে, এস.এম.এসও করেছে। কিন্তু সেসব আর এখন ভেবে কাজ নেই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এবার বাড়ি ফেরা দরকার। রণজিৎ গাড়িটা স্টার্ট দিল। গাড়ির হেড লাইটের আলো আগুনের ফলার মতো অন্ধকারের বুক চিরে ছড়িয়ে পড়ল বহুদূরে। অনেকক্ষণ পর প্রাণ ফিরে পেয়ে ইঞ্জিনটাও যেন করুণ স্বরে আর্তনাদ করে উঠল।

রণজিৎ যখন বাড়ির সামনে পৌঁছল তখন বৃষ্টি কিছুটা কমেছে। গাড়িটাকে বাড়ির সামনের উঠোনে ঢুকিয়ে দু’বার হর্ন দিল সে। কিন্তু আশ্চর্য! পাঁচ মিনিট হয়ে গেল, তবুও কারও কোনও সাড়াশব্দ নেই কেন? ওরা কি তবে ঘুমিয়ে পড়েছে? কিন্তু এত তাড়াতাড়ি তো ওরা ঘুমোয় না! আর বাইরে এত অন্ধকারই বা কেন?

হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ল তার। ইনভার্টারটা কিছুদিন হল খারাপ হয়ে গেছে। নাহ্‌! কাল সকালে ওটার আগে একটা ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু তার আগে বাড়িতে ঢোকা দরকার। সে ফোন করবে বলে পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখে ফোন অফ হয়ে গেছে। মনে হয় চার্জ শেষ। রণজিৎ আরও দু’বার হর্ন দিল। এরপর আরও দু’বার। না, তাও কোনও সাড়াশব্দ নেই। তাহলে কি ওদের কোনও বিপদ হয়েছে?

আর বসে থেকে কাজ নেই। এবার গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল রণজিৎ। ধীর পদে সদর দরজায় সামনে এসে দাঁড়াল সে। দরজার তলার সামান্য ফাঁক দিয়ে ভিতর থেকে হলুদাভ আলোর দীপ্তি ভেসে আসছে। তাহলে কি ওরা জেগে আছে?

দরজায় কান পাতল সে। ভিতর থেকে পরিষ্কার শুনতে পেল পরীর গলা, “মা, বাবা কোথায়? আমার খুব ঘুম পাচ্ছে মা। বাবা কি আজ আসবে না?”

এবার দেবলীনার গলা শোনা গেল। “তুমি চিন্তা কোরো না সোনা, বাবা এক্ষুনি চলে আসবে। আজ দেখো বাবাকে আমি খুব করে বকে দেব।”

দেবলীনার গলার স্বরে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। তবে কি ওরা দু’জনেই গাড়ির হর্ন শুনতে পায়নি? কিন্তু তা কী করে সম্ভব? যাই হোক, কারেন্ট না থাকলেও কলিং বেল নিশ্চয়ই বাজবে। এই ভেবে সে কলিং বেলটায় চাপ দিল। কিন্তু সেটা বাজল না। আশ্চর্য! এরকম তো হওয়ার কথা নয়। এমন সময় হঠাৎ বাইরের রাস্তায় একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। তার থেকে তিনটে লোক নেমে ,দ্রুতপদে এগিয়ে এল দরজার দিকে। এতক্ষণে রণজিতের চোখ অন্ধকারে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সে বুঝতে পারল, লোকগুলো পুলিশ। রণজিৎ যে দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে সেটা যেন তারা লক্ষই করল না। ওরা কি তাহলে ওকে দেখতে পায়নি? তারপর তাদের মধ্যে একজন কলিং বেলে চাপ দিল। এবার কিন্তু রণজিৎকে চমকে দিয়ে সেটা বেজে উঠল। ভিতর থেকে দেবলীনার গলা শোনা গেল, “ওই দেখো পরি, বাবা চলে এসেছে। একটু দাঁড়াও, আলোটা নিয়ে আসছি।”

এবার দরজার ফাঁক দিয়ে আসা সেই আলোর তীব্রতা যেন কিছুটা বেড়ে গেল। বোঝা গেল, দেবলীনা আলো নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে আসছে। খট শব্দে দরজার ছিটকিনিটা খুলে গেল। রণজিৎ কী একটা বলবে ভাবছিল, কিন্তু দেবলীনার মুখের দিকে তাকিয়ে সে চমকে উঠল। মোমবাতির আলোয় দেবলীনার সুন্দর মুখটা খুবই করুণ দেখাচ্ছে, আর তার থেকেও আশ্চর্য তার কালো দুটো চোখের দৃষ্টি। কারণ, সেই দৃষ্টি রণজিৎকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে তাকিয়ে আছে ওই পুলিশ তিনটের দিকে। দেবলীনা শঙ্কা মিশ্রিত স্বরে বলল, “কী হয়েছে স্যার? আপনারা এত রাতে?”

পুলিশ তিনটের মধ্যে একজন বলে উঠল, “আচ্ছা ম্যাডাম, আপনার স্বামীর নাম কি রণজিৎ চক্রবর্তী?”

“হ্যাঁ, কিন্তু কী হয়েছে স্যার? রণজিৎ তো বাড়ি নেই।”

“সরি ম্যাডাম, আপনাকে অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, আপনার স্বামী আজ রাতে বজ্রাঘাতে মারা গেছেন।”

“না, এ হতে পারে না! আপনারা মিথ্যে বলছেন।” ডুকরে কেঁদে ওঠে দেবলীনা।

“আপনি শান্ত হন ম্যাডাম। একটু আগে আমরা একটা কেস সেরে ফিরছিলাম। তখন একটা দোকানের সামনে লাল রঙের একটা গাড়িকে আধপোড়া অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখি। গাড়ির পিছনের লোগো দেখে আমরা বুঝতে পারি গাড়িটা ফোর্ড কোম্পানির। যে দোকানের সামনে গাড়িটা ছিল সেখানে আরেকটা মৃতদেহ পাওয়া যায়। দোকানটা খোলা ছিল, তাই খুব সম্ভব ওই মৃতদেহটা দোকান মালিকের।”

এবার কিছুক্ষণ থামল সেই পুলিশটা। কী যেন একটা মনে মনে ভাবল সে। এরপর একবার দেবলীনার অশ্রুসিক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করল, “গাড়িটা বৃষ্টির কারণে পুরো পুড়ে যায়নি। গাড়ির রঙও কিছু কিছু জায়গায় বোঝা যাচ্ছিল। একটা সুবিধা ছিল যে নম্বর প্লেটটা বেঁচে গিয়েছিল আর সেটা থেকেই আমরা খবর পাই গাড়িটা আপনার স্বামী রণজিৎ চক্রবর্তীর। গাড়ির ভিতরে ওঁর মৃতদেহ দেখেই আমরা বুঝতে পারি উনি বজ্রাহত। মৃতদেহ আমরা পোস্টমর্টেমে পাঠিয়ে দিয়েছি। সব ঠিকঠাক থাকলে আশা করছি কাল সকালের মধ্যেই আপনার হাতে ওটা তুলে দিতে পারব।”

এতক্ষণ দেবলীনা পাথরের মতো দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ দেখল পরি তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। “মা, বাবা আসেনি?”

দেবলীনা চোখের জল মুছে যতটা সম্ভব স্বাভাবিকভাবে বলল, “বাবা কাল সকালে আসবে সোনা। তুমি এখন ভিতরে যাও।”

সেই পুলিশটা এবার কিছুটা সান্ত্বনা মিশ্রিত স্বরে বলল, “আপনি নিজেকে সামলান ম্যাডাম। আমরা এখন যাই। দেখছেন তো বাইরের আবহাওয়া মোটেই ভালো নয়, আপনি দরজা ভালো করে লক করে দিন।”

এই বলে তারা আবার আগের মতোই দ্রুতপদে গাড়িতে উঠে বেরিয়ে গেল। গাড়িটা দূরে রাস্তায় মিলিয়ে যেতেই রণজিতের সামনের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। এতক্ষণ রণজিৎ হতভম্ব হয়ে সব শুনছিল। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেতেই সে প্রায় পাগলের মতো চেঁচিয়ে উঠল। “পরি ! এই পরি! দেখ সোনা, আমি এসেছি। দেবলীনা! দেবলীনা! কী ইয়ার্কি হচ্ছে এসব? দরজা খোলো, দেখো, আমি এসেছি! আমি এসেছি!”

কিন্তু অন্ধকারের কোনও এক অদৃশ্য দেওয়ালে বাধা পেয়ে সেই আওয়াজ যেন দরজার ওপারের মানুষদুটোর কাছে পৌঁছাতে পারল না। রণজিৎ বুঝতে পারল, এই বৃষ্টিভেজা অবস্থাতেও তার গায়ের লোম উত্তেজনায় খাড়া হয়ে উঠেছে। নিজের অজান্তেই সে তার চারপাশে জমে থাকা অন্ধকারের উদ্দেশ্যে একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিল, ‘তাহলে কি আমি সত্যিই মারা গেছি?’

এতক্ষণে একটা অজানা ভয় যেন ধীরে ধীরে তার সমস্ত মানবসত্ত্বাকে গ্রাস করতে শুরু করেছে। তার বিমর্ষতায় আনন্দ পেয়ে এবার বৃষ্টি যেন আরও ভয়ংকর রূপ নিল, আর দূর দিগন্ত থেকে ছুটে আসা দামাল বাতাস ভাসিয়ে নিয়ে চলল একটা কথা, ‘আমি এসেছি!’ ‘আমি এসেছি!’ ‘আমি এসেছি!’

অলঙ্করণঃ মৌসুমী

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে