সুমন মিশ্রের আগের গল্পঃ জুলি মিঠু বিশুয়া ,গুলতির চোর ধরা , তিস্তার অষ্টমী
আমি ছেলেধরা নই
সুমন মিশ্র
এক
পড়ার ঘরে বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে বসে ছিলেন দেবায়ন মজুমদার। বাড়িতে থাকলে বেশিরভাগ সময়টা তাঁর এই ঘরেই কাটে। পুরনো দিনের বেশ বড়সড় ঘর, বেশ কিছু পুরনো আমলের আসবাবপত্রে সাজানো। ঘরের তিনটে দেওয়াল জুড়ে আছে শুধুই বইয়ের আলমারি। তাতে সাজানো সারি সারি আইনের বই। অন্য বিষয়ের বইও আছে, তবে তা সংখ্যায় কম। অবশিষ্ট দেওয়ালটি জুড়ে রয়েছে দুটো সেকেলে বড়ো জানালা। আর সেই জানালা গড়িয়ে সকালের হালকা রোদ্দুর এসে পড়ছে তাঁর পড়ার টেবিলে। তাঁর মুখ গম্ভীর, কপালে ভাঁজ, চোখ নিবিষ্ট হয়ে আছে বইয়ের পাতায়। কোনও একটা বিশেষ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা চলছে। চোখের চশমাটা নামতে নামতে নাকের ডগার দিকে চলে এসেছিল। সেটাকে আবার আঙুল দিয়ে ঠেলে যথাস্থানে ফেরত পাঠালেন।
দেবায়ন মজুমদার নামটার সঙ্গে আজকাল কলকাতার অনেকেই বেশ পরিচিত। পরপর বেশ কয়েকটা হাই-প্রোফাইল কেস জিতে এখন তিনি রীতিমতো তারকা। খ্যাতি আর সম্মান যেমন বেড়েছে, সেই সঙ্গে চড়চড় করে বেড়েছে তাঁর সাম্মানিক। অবস্থা এমনই যে ছোটোখাটো ক্লায়েন্ট হলে আপাতত দরজা থেকেই তাদের বিদায় করে দেন। নতুন গাড়ি হয়েছে, রাজারহাটে নতুন ফ্ল্যাট কেনারও কথা চলছে। এই সময়ে ছোটোখাটো ক্লায়েন্টের পিছনে সময় নষ্ট করা মানেই বোকামি। এখন ঘড়িতে সকাল আটটা বাজে, ঠিক ঘণ্টা দুই পরে একজন মক্কেলের আসার কথা। তাই হয়তো নিজের হোম-ওয়ার্কটুকু সেরে রাখছেন।
খ্যাতি থাকলে তার বিড়ম্বনাও থাকবেই। দেবায়নবাবু শেষ যে কেসটা জিতলেন, সেটা চলাকালীন বেশ কয়েকবার হুমকি দিয়ে ফোন এসেছিল তাঁর কাছে। কেসটা তাঁকে ছাড়তে হবে, নইলে বিপদ। নিজের বিপদের তোয়াক্কা তিনি কোনও কালেই করতেন না, তাই এইসবে ভয় পাওয়ার প্রশ্নই নেই। কিন্তু তারা যখন দেবায়নবাবুর ছয় বছরের ছেলে পাপানকে অপহরণের ভয় দেখাল তখন তিনি আর কোনও ঝুঁকি নেননি। স্থানীয় থানার ওসির সঙ্গে দেবায়নবাবুর যথেষ্ট পরিচিতি ছিল। তাঁকে বলেই বাড়ির বাইরে সাময়িক পুলিশ পাহারার ব্যাবস্থা হয়েছিল কিছুদিনের জন্য। এখন অবশ্য পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ায় সেই পাহারা উঠে গেছে। কিন্তু দেবায়নবাবুর মনের মধ্যে সারাক্ষণ একটা ভয় গেঁথে রয়েছে। যদি সত্যি তারা আক্রোশের বশে পাপানকে…
দেবায়নবাবু হুমকি টেলিফোনের কথা তাঁর স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন। তবে বিস্তারিতভাবে নয়। বিশেষত পাপানকে নিয়ে হুমকির ব্যাপারটা সম্পূর্ণ গোপন করেছিলেন। কী দরকার জানানোর? মায়ের মন, সারাক্ষণ সাতপাঁচ ভেবে দুশ্চিন্তা করে যাবে। এর ফলে নিজের মনে জমে ওঠা ভয়ের কথাটাও সরাসরি তিনি তাঁর স্ত্রীকে জানাতে পারেননি। বলেছেন যে সংবাদপত্রে আজকাল ছেলেধরার খবর খুব দেখা যাচ্ছে। সাবধান, অচেনা কেউ পাপানের সঙ্গে কথা বলছে বা বাড়ির আশেপাশে ঘুরছে দেখলেই যেন সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।
দুই
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন দেবায়নবাবু। আপাতত যেটুকু ঝালিয়ে নেওয়ার দরকার ছিল তা দেখা হয়ে গেছে। এখন কিছুক্ষণ মাথাটাকে বিশ্রাম দিতে হবে। তিনি গিয়ে দাঁড়ালেন জানালার ধারে।
উত্তর কলকাতার অভিজাত বংশের সন্তান তিনি। সিঁথির মোড়ে, বিটি রোড থেকে পাঁচ মিনিট পায়ে হাঁটা দূরত্বে তাঁর তিন পুরুষের বাড়ি। সামনে গাড়ি বারান্দা। তার পাশ দিয়ে মোরাম বিছানো পথ চলে গেছে মূল ফটক অবধি। সেই পথের দু-পাশে শৌখিন বাগান, তাতে বাহারি ফুল গাছের পাশাপাশি আছে বেশ কিছু আম-বেল-কাঁঠালগাছ। এমন সাজানো বাড়ি এ তল্লাটে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া ভার। মূল ফটকে একজন দারোয়ানও আছে, নাম রণেন। বছর দুই হল কাজ করছে।
দেবায়নবাবুর বাড়ির ঠিক মুখোমুখি রয়েছে একটা পোড়ো বাড়ি। দুই বাড়ির মাঝে ব্যবধান শুধু একটা রাস্তার। রাস্তাটা যদিও মোটামুটি চওড়া, তাই রক্ষে। নইলে মক্কেলদের যাতায়াতে বেশ অসুবিধা হত। কোন এককালে এই পোড়ো বাড়িটা এক নামকরা ব্যবসায়ীর শখের বাগানবাড়ি ছিল, এখন কালের গ্রাসে জীর্ণ বিবর্ণ। ইটের পাঁজর জড়িয়ে তাকে ঘিরে ধরেছে বুনো লতা আর বট-অশ্বত্থের জঙ্গল। জানালা-দরজা কবেই লোপাট হয়েছে। আপাতত পুরসভার লাগানো ‘বিপদজনক বাড়ি’ লেখা বোর্ড বুকে আগলে সে শেষের দিন গুনছে।
জানালায় এসে দাঁড়াতেই একটা জিনিস চোখে পড়ল দেবায়নবাবুর। একটা বছর পনেরোর ছেলে বাগানের বেলগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে। পরনে ময়লা ছেঁড়া একটা গেঞ্জি, মাথায় উসকোখুসকো চুল আর গায়ের রং রোদে পোড়া তামাটে। ছেলেটা পাপানের সঙ্গে গল্প করছে! দারোয়ান রণেনও একটু দূরে বসে ওদের কথা শুনছে আর ফিক ফিক করে হাসছে।
কে এই ছেলেটা! আগে তো দেখিনি! পাপানের সঙ্গেই বা এত কী গল্প? দেবায়নবাবুর মাথা সহজে গরম হয় না, কিন্তু আজ হল। আর তা হল রণেনের কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণের কথা ভেবে। পইপই করে বলে দেওয়া হয়েছে যেন অচেনা কেউ বাড়িতে না ঢোকে সেদিকে লক্ষ রাখতে, আর সেখানে পাপানের সঙ্গে এই অচেনা ছেলেটা ভাব জমিয়ে ফেলেছে!
“রণেন… এই র-ণে-ন!” দেবায়নবাবুর গলায় রাগ স্পষ্ট।
রণেন ছুটে এসেছে ডাক শুনে। “বাবু কিছু বলছেন?” রণেন কাঁচুমাচু মুখে বলল।
“ছেলেটা কে? ভিতরে এল কী করে?” দেবায়নবাবুর গলায় উষ্মা বাড়ছে।
রণেন প্রথমে কয়েক মুহূর্ত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল, যেন বুঝতেই পারছে না কার কথা বলা হচ্ছে। তারপর বেলগাছের দিকে তাকিয়েই একগাল হেসে বলল, “ওহ্, ওই ছেলেটা? ও তো মিতে। ঘোষপাড়ার পাশে যে বস্তি আছে সেখানেই ওর মাকে নিয়ে থাকে। বড়ো ভালো ছেলে, বাবু। ওর বাপটা তো ছোটো বেলাতেই মারা গেছিল, তাই ও বড়ো অভাবে মানুষ হয়েছে। ওর মা লোকের বাড়ি কাজ করে, আর ও লোকের ফাইফরমাশ খাটে।”
“বাড়ির ভিতরে ঢুকল কী করে? বলেছিলাম তো অচেনা কেউ যেন বাড়িতে না ঢোকে। বলেছিলাম কি না?”
রণেন অধোবদন হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
“নিজের সামান্য দায়িত্বটুকু সামলাতে না পারলে কাজ ছেড়ে দাও।”
“ও একটু বেলপাতা আর ক’টা বেল নিয়েই চলে যাবে, বাবু। সামনে শিবরাত্রি আসছে তো, ওটা বেচে দুটো পয়সা রোজগার হবে। গরিব ছেলে বাবু, অভাবে মানুষ।”
“আর পাপানের সঙ্গে পরিচয় হল কী করে? দেখে তো মনে হচ্ছে আগেই দু’জনের বন্ধুত্ব হয়েছে। আগে খবর দাওনি কেন?”
“আজ্ঞে, মিতে কিন্তু পাপানবাবুকে খুব ভালোবাসে। পাপানবাবুও তার মিতেদাকে পেলে অস্থির। দু’জনের কত গল্প যে হয়। মিতে চলে গেলেই পাপানবাবু মনমরা হয়ে বসে পড়েন।” বলেই রণেন আবার ফিক করে হেসে ফেলল।
এই হাসিটা দেখলেই দেবায়নবাবুর মাথা আরও গরম হয়ে যাচ্ছে। অপদার্থ একটা লোককে কাজে রেখেছেন।
“এখন আমার বাড়িতে কে ঢুকবে, না ঢুকবে, তার সিদ্ধান্ত কি তুমি নেবে? পরের মাসে মাইনে বন্ধ করে দিলে তারপর আমার কথাগুলো মাথায় ঢুকবে?” জ্বলে উঠলেন দেবায়নবাবু।
“আজ্ঞে আমি তো জানিয়েছিলাম গিন্নিমাকে। তিনিও তো কথা বলেছেন মিতের সঙ্গে…”
নমিতা জানে! অবাকই হলেন দেবায়নবাবু। তাঁর স্ত্রী নমিতা যে সহজ সরল মানুষ, সবাইকে তাড়াতাড়ি বিশ্বাস করে ফেলে, সেকথা তিনি জানেন কিন্তু একজন মা তার ছেলের নিরাপত্তার ব্যাপারে এত খামখেয়ালি আচরণ কী করে দেখাতে পারে! রণেনের সামনে এই নিয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, তাই শুধু বললেন, “দু’জনকে চোখে চোখে রেখো, বাড়ির বাইরে যেন পাপান বেরিয়ে না যায়।”
রণেন চলে যেতেই দেবায়নবাবু দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে একতলায় নেমে এলেন। নমিতা এখন হয়তো রান্নাঘরেই আছে, সকালের জলখাবার বানানোর গন্ধে বাড়ি ম-ম করছে। এখনই ব্যাপারটা নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। বিশেষত আগামী কয়েক মাস তিনি কোনও ঝুঁকি নিতে চান না।
দেবায়নবাবুকে দেখে নমিতা হাসলেন। “ও মা, তুমি আবার নিচে নেমে এলে কেন! আমি তো তোমার জলখাবার উপরে পাঠাতেই যাচ্ছিলাম।”
“ওসব পরে হবে, একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করার ছিল।” দেবায়নবাবু গলার স্বর ভারী করে বললেন।
“আমার সঙ্গে আবার এই সাতসকালে কী আলোচনা করবে?” নমিতার গলায় ঈষৎ বিস্ময়ের ছোঁয়া। স্বাভাবিক, যে লোকটা বাড়িতে থাকলে সারাক্ষণ বইয়ে মাথা গুঁজে থাকে, আর শুধুমাত্র চায়ের দরকার হলে স্ত্রীকে স্মরণ করে সে কিনা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার জন্য নিচে নেমে এসেছে!
“মিতেকে চেনো?”
হঠাৎ প্রশ্নে মানুষ হকচকিয়ে যায়, নমিতাও কয়েক মুহূর্ত চুপ করে তারপর হেসে বললেন, “কে? আমাদের মিতে? তা চিনব না কেন? ওই তো ঘোষপাড়ার পাশের বস্তিতে থাকে। সে এসেছে নাকি আজ?”
“হুম, পাপানের সঙ্গে খেলছে।”
“হ্যাঁ, পাপানের সঙ্গে ওর খুব বন্ধুত্ব। রণেনের কাছে কিছু পুরনো জামাকাপড় দিয়ে রেখেছিলাম মিতেকে দেওয়ার জন্য। যাই, গিয়ে দেখি ওগুলো দিল নাকি। গরিব ছেলে, দুটো পুরনো জামাকাপড় পেলেও উপকার হবে।”
“দাঁড়াও, আগে আমার কথাটা শেষ করি। আমি তোমাকে বলেছিলাম তো যে আজকাল এই তল্লাটে ছেলেধরা খুব বেড়ে গেছে, পাপানকে অচেনা কারও সঙ্গে মিশতে দিও না। আর কীভাবে বোঝালে তুমি বুঝবে?”
“কীসব বলছ! মিতে ছেলেটার সঙ্গে আমি কথা বলেছি। খুব ভালো ছেলে, কী সুন্দর কথা বলে। আমাকে তো প্রথমদিনই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।”
“আর তুমিও অমনি গলে গেলে। আরে, এরা এমনই হয়। মুখে সবসময় মিষ্টি কথা। তুমি কি জোর দিয়ে বলতে পার যে ও কোনও গ্যাংয়ের ইনফর্মার নয়? হয়তো এভাবেই একটু একটু করে খবর পাঠাচ্ছে, তারপর একদিন সুযোগ বুঝে…”
“কী উলটোপালটা বলছ! মানুষ দেখে চেনা যায়। ছেলেটার চোখদুটো দেখো একবার। অমন সরল যার চাউনি, সে অন্য কারও ক্ষতি করতে পারে না।”
“আমিও অনেক মানুষ দেখেছি। আমিও সব বুঝতে পারি…”
“ভুল বোঝো।”
“ভুল বুঝি? তাহলে শোনো, শেষবার হুমকি ফোনটা আমার জন্য আসেনি, এসেছিল পাপানকে অপহরণ করার ভয় দেখিয়ে। তোমাকে বলতে চাইনি, কিন্তু তুমি তো আবার ঘুরিয়ে বললে কিছুই বোঝো না!” এটুকু বলেই কোনোমতে নিজেকে সামলালেন দেবায়ন মজুমদার। এই কথাগুলো তিনি নমিতাকে একেবারেই বলতে চাননি। কিন্তু তর্কের মধ্যেই মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। তিনি বুঝতে পারলেন না এই অবস্থায় কী করা উচিত, তাই তাড়াতাড়ি সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন। শুধু বেরনোর আগে আড়চোখে দেখলেন নমিতা ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে।
তিন
সেইদিনের ঘটনার পর মাস খানেক কেটে গেছে।
দেবায়ন বাবু লক্ষ করেছেন তাঁর স্ত্রী নমিতা পাপানের ব্যাপারে আগের থেকে অনেক বেশি সাবধানী হয়েছে। যদিও তাঁদের বাড়িতে মিতের আসাযাওয়া এখনও বন্ধ হয়নি। ছেলেটার উপর নমিতার যে কী মায়া পড়েছে কে জানে!
আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। কখনও জোরে, কখনও ঝিরঝিরে। এখন যেমন চারপাশ ঝাপসা হয়ে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। দেবায়নবাবুর হন্ডা সিটি ছুটে চলেছে ই.এম বাইপাসের উপর দিয়ে। একজন বড়ো ক্লায়েন্ট লাঞ্চ পার্টিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। গন্তব্য জে.ডব্লিউ ম্যারিয়ট। হঠাৎ তাঁর হাতে সাইলেন্ট মোডে থাকা ফোনটার স্ক্রিনে আলো জ্বলে উঠল। নমিতা ফোন করছে। ফোন ধরতেই অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল নমিতার উদ্ভ্রান্ত কণ্ঠস্বর, “তুমি এখন কোথায়?”
“আমি এই চিংড়িঘাটা ক্রস করলাম। কেন, কী হয়েছে? তোমার গলাই বা অমন শোনাচ্ছে কেন?”
“তুমি এখনই ফিরে এস।” কান্নায় নমিতার গলা বুজে আসছে, “পাপানকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
নমিতার মুখ থেকে দেবায়নবাবু যেটুকু জানতে পারলেন তা কিছুটা এইরকম—
সকাল থেকেই বৃষ্টির কারণে পাপান বাইরে বাগানে বেরোতে পারেনি, বারান্দায় বসে খেলছিল। দেবায়নবাবু বাড়ি থেকে বের হন সকাল সোয়া এগারোটা। ঠিক তার পরপর, সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ মিতে আসে। সে নাকি বৃষ্টির জন্য আজ কোথাও কাজের ঠিক সুবিধা করতে পারছিল না, তাই চলে আসে পাপানের সঙ্গে দেখা করতে। রণেন তখন গাড়ি বারান্দায় একটা চেয়ার নিয়ে বসে ছিল। প্রথমে কিছুক্ষণ রণেনের সঙ্গে খোশগল্প করে, তারপর বারান্দায় পাপানের সঙ্গে গল্প করতে বসে মিতে। নমিতা দুপুর বারোটার সময়ও দেখেছে দু’জন বারান্দায় আছে। তারপর বৃষ্টি একটু ধরতেই রণেনকে দোকান থেকে কিছু জিনিস আনতে পাঠিয়ে রান্নাঘরে গিয়েছিল। রণেন ফিরে এসে ডাক দিতেই বারান্দায় গিয়ে দেখে মিতে বা পাপান কেউই সেখানে নেই। সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাপানকে পাওয়া যায়নি। বাগানেও নেই, বাড়ির বাইরে রাস্তাতেও দেখা হয়েছে। পাপান কোথাও নেই। ইতিমধ্যে আবার মুষলধারে বৃষ্টি নামায় রণেন বাড়ি ফিরে এসেছে।
“তোমায় বলেছিলাম মিতে ছেলেটা সুবিধের নয়!” রাগ দেখাতে গিয়েও গলার স্বর তাঁকে তরল করতেই হল। ফোনের ওপ্রান্তে তখন এক মায়ের হা-হুতাশ বাইরের বৃষ্টিকে ছাপিয়ে কানে বাজছে, “তুমি যে করেই হোক আমার পাপানকে ফিরিয়ে আনো।”
স্ত্রীর ফোনটা রেখেই দেবায়নবাবু প্রথমে ফোন করলেন লোকাল থানার ওসিকে। পুরো ব্যাপারটা শুনেই তিনি তৎক্ষণাৎ লোক পাঠানোর আশ্বাস দিলেন। দ্বিতীয় ফোনটা করলেন পাড়ার ক্লাবের বখাটে ছেলেগুলোর উঠতি লিডার রাজাকে। ফি পুজোয় কাঁড়ি কাঁড়ি চাঁদা যে তিনি দেন তার কিছু প্রতিদান তো থাকবে। রাজাকে ঠিক যেটুকু বলার সেটুকুই তিনি বললেন। পাপানকে পাওয়া যাচ্ছে না, আর তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস মিতে ভুলিয়ে ভালিয়ে তাকে নিয়ে গেছে, ব্যাটা ছেলেধরার দলের সঙ্গে যুক্ত। রাজা জানে এমন পয়সাওয়ালা মানুষের কাজে লাগলে আরও ডোনেশন পাওয়া যাবে। মিতেকে এলাকার অনেকেই দেখেছে, রাজাও দেখেছে। চিনতে অসুবিধা হবে না। সে তার দলবল নিয়ে তখনই খুঁজতে বেরোবে কথা দিল।
দেবায়নবাবুর গাড়ি তখন বাড়ির দিকে দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে। রাগে তাঁর সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে। একটা বস্তির ছেলে কিনা দেবায়ন মজুমদারকে বোকা বানিয়ে যাবে? একবার হাতে পেলে… রাগের মাথায় হাতের ফোনটা ছুড়ে ফেললেন গাড়ির সিটে।
বাড়ি পৌঁছতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল। কিন্তু ফিরে যে দৃশ্যটা দেখলেন তার জন্য আদৌ তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। গেট দিয়ে গাড়ি ঢুকতেই চোখে পড়ল বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকজন পুলিশ। থানার ওসি স্বয়ং এসেছেন। তিনি নমিতার সঙ্গে কথা বলছেন।
রণেন গেট খুলেছিল। আগে পাপানকে খুঁজে পাই, তারপর এর ব্যাবস্থা করব, মনে মনে ভাবলেন দেবায়ন মজুমদার। কিন্তু ওটা কী, নমিতার পিছনে পাপান না? হ্যাঁ, পাপানই তো নমিতার পিছনে দাঁড়িয়ে উঁকি মারছে। মনে মনে পুলিশের তৎপরতার প্রশংসা করলেন তিনি।
গাড়ি থেকে নামতেই ওসি নিজে এগিয়ে এলেন দেবায়নবাবুর দিকে। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “মিঃ মজুমদার, আপনার থেকে আমি আর একটু দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করেছিলাম। পুলিশে খবর দেওয়ার আগে ভালোভাবে আপনাদের খুঁজে দেখা উচিত। ছেলেকে চোখের সামনে দেখছেন না মানেই সে কিডন্যাপ হয়েছে তা তো নয়। দেখুন আপনার ছেলে নিজেই হারিয়ে গিয়েছিল, নিজেই আবার ফিরে এসেছে।”
দেবায়নবাবু কী বলবেন বুঝতে না পেরে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন।
নমিতাও এগিয়ে এসেছে। “তুমি ফোন রাখার কিছু পরেই দেখি পাপান গেট খুলে চুপিচুপি ঢুকছে, গা-হাত-পায়ে কাদা মাখা। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, মিতে চলে যাওয়ার পর সে উলটোদিকের পোড়ো বাড়িতে গিয়েছিল, ওখানে কী আছে দেখবে বলে। ছোটোদের মাথায় কখন যে কীসের ভূত চাপে! তার পরপরই প্রচণ্ড বৃষ্টি নামায় পাপান সেখানেই আটকে গিয়েছিল। আমি তো খবরটা জানাব বলে তারপর থেকে কতবার তোমায় ফোন করলাম, প্রতিবারই বেজে গেল।”
সেটা অবশ্য অস্বাভাবিক নয়। ফোনটা এখনও গাড়ির সিটেই পড়ে আছে। সাইলেন্ট মোডে থাকায় কখন যে ওটা বেজে গেছে খেয়ালই করেননি। ছেলের চিন্তা, নিজের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হওয়া উচিত, এইসব নিয়ে তিনি এতটাই চিন্তিত ছিলেন যে ফোনের কথা তাঁর মাথাতেই ছিল না।
দেবায়নবাবু এখনও কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। হঠাৎ তাঁর মাথায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। “মিতে! মিতের কী হল?”
“মিতের আবার কী হবে? সে তো আগেই চলে গিয়েছিল।” নমিতার গলায় প্রশ্ন।
নমিতার কথার উত্তর না দিয়েই ওসির দিকে তাকিয়ে দেবায়নবাবু বললেন, “অফিসার, আমাদের এখুনি বেরোতে হবে। একটা সর্বনাশ হওয়ার আগেই সেটাকে আটকাতে হবে। পাড়ার ছেলেরা মিতেকে খুঁজতে গেছে। ওরা কিন্তু জানে মিতেই পাপানকে…”
পুলিশ নিয়ে অবশ্য বেশি দূর যেতে হয়নি। ন-পাড়ার পাশে যে বড়ো পুকুরটা আছে, তার উত্তরদিকে বুড়ো বটতলায় একটা জটলা দেখা গেল। কাছে আসতেই বোঝা গেল ওটা রাজার দলবল। পুলিশ দেখে ভিড়টা চারদিকে ছিটকে পালাল আর সেই সঙ্গে দেখা গেল বাঁশের সঙ্গে বাঁধা একটা ছেলে, সারা গায়ে কাদা মাখা, মাথাটা নুইয়ে বুকের কাছে নেমে এসেছে।
মিতে!
রাজার দলবল মিতেকে প্রচণ্ড মেরেছে। বেচারা মরে যায়নি তো! দেবায়নবাবু গাড়ি থেকে নেমে ছুটে গেলেন।
“মিতে, এই মিতে!”
কোনও উত্তর নেই। ইস, কী মার মেরেছে! কপাল ফেটে রক্ত ঝরছে, চোখের নিচে কালশিটে, ঠোঁট ফেটেও রক্ত গড়াচ্ছে।
অনেক ডাকাডাকির পর অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ শোনা গেল। মিতে বলছে, “আ-মি ছেলেধরা নই। আমি ছেলে-ধরা নই।”
চার
সন্ধে নেমেছে অনেক আগেই। দেবায়নবাবু তাঁর পড়ার ঘরের জানালার পাশে বসে আছেন। আকাশ এখনও মেঘলা, পরিবেশ গুমোট, বিষণ্ণ। নিচের ঘরে নমিতা কেঁদেই চলেছে। কাছে গেলেই বলছে, “আমরা যে বড়ো পাপ করে ফেললাম, ভীষণ পাপ! মিতেটা বাঁচবে তো?”
পাপানও বিকেলে জেদ করেছিল মিতেদাকে দেখতে যাবে। দেবায়নবাবু কাউকে সঙ্গে নেননি। একাই গিয়েছিলেন হসপিটালে। ডাক্তার বলেছে বেঁচে যাবে, কিন্তু সুস্থ হতে বেশ সময় লাগবে। তিনি রণেনকে পাঠিয়েছিলেন মিতের মায়ের কাছে কিছু আর্থিক সাহায্য দিয়ে। কিন্তু মিতের মা তা ছুঁয়েও দেখেনি। শুধু হাতজোড় করে বলেছে ওই টাকা নিয়ে যেন রণেন চলে যায়। কোনোরকম দয়া তারা চায় না।
দেবায়নবাবু আজ উপলব্ধি করেছেন, একজন মানুষকে দোষী বা নির্দোষ প্রমাণ করার আইনি প্যাঁচ-পয়জারে তিনি দক্ষ হতে পারেন কিন্তু মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আসল মানুষটাকে চেনার ক্ষমতা এখনও তাঁর হয়নি। অথচ সেই ক্ষমতাটা রয়েছে সারাক্ষণ হেঁসেল সামলানো নমিতার, মাধ্যমিক পাশ রণেনের, আর ছোট্ট পাপানের।
তিনি শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আকাশের দিকে। মেঘ কি কাটবে? আকাশের এবং তাঁর মনের ভিতরের। বাইরের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাপিয়ে তখনও তাঁর কানে বাজছে মিতের করুণ স্বর, ‘আ-মি ছেলেধরা ন-ই।’
ছবিঃ সায়ন মজুমদার