দেবব্রত দাশের আগের গল্প ডাওহিলের হিমেল সন্ধ্যায়
নিজের চেনা শহর, ভালো লাগার ভালো থাকার শহর কলকাতা ছেড়ে মুম্বইতে গিয়ে থাকতে হবে অরিজিতের সঙ্গে তার কোম্পানির দেওয়া ওরলির অ্যাপার্টমেন্টে, ভাবতেই কান্না পেয়ে গেল সদ্য বিয়ে হওয়া হেমছায়ার। ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা হতবাক হয়ে বলল, “তুই কী বোকা মেয়ে রে হেম! আমরা তো তোকে হিংসে করতে শুরু করে দিয়েছি এরমধ্যেই। ক’জনের ভাগ্যে এমন ঘর-বর আর এমন চ্যাম্পিয়ন শহর জোটে বল তো!”
“সে তোরা মুখে বলছিস, তোদেরকে তো আর চেনা জায়গা, চেনা পরিবেশ ছেড়ে পাড়ি দিতে হচ্ছে না আরব সাগরের তীরে বারোশো মাইল দূরের এক কংক্রিটের জঙ্গলে! সত্যি সত্যি গিয়ে দিনের পর দিন থাকতে হলে বুঝতিস, কত ধানে কত চাল!”
অরিজিৎ ইঞ্জিনিয়ার। কম্পিউটার নিয়ে কাজ। দিনে এগারো-বারো ঘণ্টা অফিসে কাটিয়ে বিপুল দায়দায়িত্ব সামলে সপ্তাহের পাঁচ-পাঁচটা দিনই রাত করে ফেরে ওরলির অ্যাপার্টমেন্টে। খুব কঠিন যাপন। কাজের মাসির রান্না করে রেখে যাওয়া খাবার ফ্রিজ থেকে বের করে মাইক্রোওয়েভ ওভেনে গরম করে তবে ডিনার সারতে হয় প্রায় মাঝরাত্তিরে। এতসব কথা শুনেছে হেমছায়া শ্রীরামপুরে তার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে শাশুড়ি-মায়ের মুখ থেকে। তিনি বলেছেন, “আমি নিশ্চিন্ত হলাম বউমা, আমার ছেলের কষ্টের দিন এবার শেষ।”
এই প্রত্যাশার চাপও এখন এসে পড়েছে হেমছায়ার উপর। অষ্টমঙ্গলায় শ্রীরামপুর থেকে কলকাতায় বাপের বাড়ি ফিরে আসার সময় জোড় খুলতে সঙ্গে এসেছিল অরিজিৎ, তারপর দু’দিন কাটিয়ে কলকাতা থেকে সোজা মুম্বইয়ে চলে গিয়েছে সে এবং তারও পরে পার হয়ে গিয়েছে পনেরোদিন। অরিজিৎ হেমছায়ার মেইল আই.ডি-তে কলকাতা-মুম্বই ফ্লাইটের টিকিট কেটে পাঠিয়ে দিয়েছে। একাই রওনা হতে হবে তাকে ওই নির্দিষ্ট ফ্লাইট ধরে। এই প্রথম কলকাতার বাইরের কোনও শহরে যাচ্ছে হেমছায়া একা, তাই ভরসা জুগিয়ে অরিজিৎ জানিয়েছে, সে সঠিক সময়েই উপস্থিত থাকবে ছত্রপতি শিবাজী বিমানবন্দরের ডোমেস্টিক লাউঞ্জে।
আসলে বাবার ইচ্ছেয় সায় দিতে বাধ্য হয়েছে হেমছায়া। তার একেবারেই ইচ্ছে ছিল না সারাটা জীবন কলকাতা ছেড়ে বাইরে কাটানোর। কিন্তু কী আর করা যাবে। চাকরি থেকে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বাবাকে উদ্বেগ- উৎকণ্ঠার হাত থেকে রেহাই দেওয়া ছাড়া অন্য কোনও অপশন তো ছিল না হেমছায়ার কাছে।
মানিয়ে চলার নামই হল জীবন। হা-হুতাশ বন্ধ করে নির্দিষ্ট ফ্লাইট ধরে হেমছায়া তাই পৌঁছে গেল ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানীতে, তারপর স্বল্প পরিচিত জীবনসঙ্গীর অফিস-বাহনে চড়ে ওরলির অ্যাপার্টমেন্টে।
আরব সাগরের তীরে বহুতল প্রাসাদের দশম তলায় সমুদ্রমুখী অ্যাপার্টমেন্ট মুহূর্তে হেমছায়াকে নিয়ে গেল ছোটবেলায় ঠাকুমার মুখে শোনা রূপকথার স্বপ্নলোকে। দূরে ‘মাহিমবে’র উপরে তৈরি বান্দ্রা-ওরলি সংযোগকারী সমুদ্র-সেতুর দিকে চেয়ে মনে মনে ডানা মেলে পরির মতো ভেসে বেড়াতে লাগল সে দিনভর। অখণ্ড অবসরের দ্বিপ্রহর কেমন স্বচ্ছন্দে গড়িয়ে গড়িয়ে ঢলে পড়ে ক্লান্ত বিকেলে এবং আরও পরে পশ্চিম দিগন্ত রাঙিয়ে ডিমের কুসুমের মতো সূর্যটা যখন টুপ করে ডুব দেয় আরব সাগরের জলে, তখন ডেক চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে হেমছায়া অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করে অরিজিতের। যদিও তার ফিরতে ফিরতে গোধূলির শেষ রোশনাইটুকুও মিলিয়ে যায় পুরোপুরি প্রায় প্রতিদিনই। মে মাসের দীর্ঘ দিন শেষে আঁধার ঘন হয়ে ঘড়ির কাঁটা যখন ন’টার ঘর ছুঁতে যায়, তখন।
কী করবে অরিজিৎ! কী করার আছে? প্রাইভেট কোম্পানির কাজের রথের চাকায় যে সে বাঁধা আর পাঁচটা তরুণ-তরুণীর মতো। এই বিশ্বায়নের যুগে এরকম হওয়াটাই দস্তুর। হ্যাঁ, শনি-রবির দুটো দিনের মধ্যে একটা দিন ফোন বন্ধ রেখে সে যে পুরো সঙ্গ দেয় তাকে, হেমছায়ার কাছে এটাই পরম প্রাপ্তি।
দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল দু-দুটো সপ্তাহ। রান্নার হাত তেমন ভালো না হলেও কাজ চালানোর মতো রান্না—নিরামিষ এবং আমিষ, দু’রকমই সে রাঁধতে পারে। তার ওপর ভরসা রাখলেও কাজের মাসিকে অরিজিৎ ছাড়িয়ে দেয়নি, সাহায্যকারী হিসেবে বহাল রেখেছে। আর একথাও বলেছে, “তোমাকে আমি বিয়ে করে এনেছি আমার জীবনসঙ্গিনী হিসেবে হেম, হাতা-খুন্তি নাড়তে নয়।”
জবাবে হেমছায়া বলেছে, “বা রে! বাড়ির বউরা বুঝি রান্নাবান্না করে না, ফুলপরি সেজে বসে থাকে শো-পিস হয়ে!”
“না, তা নয়। করে, রান্না করে। তুমিও করবে মাঝেমধ্যে একটা দুটো পদ।” অরিজিৎ স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছে তার মনোভাব, “মাসি যেমন কাজ করছে করবে, ব্যস।”
হেমছায়া মনে মনে খুশি হলেও বলেছে, “সে আমি বুঝে নেব’খন। তুমি বাইরেটা সামলাও, আমি দেখব ঘর-গেরস্থালি। মাসি কী করবে, কতটুকু করবে, সেসব ভাবনা আমার। মাথা ভারী কোরো না তো তুমি!”
‘তিলোত্তমা’-র জন্যে মনকেমন করে খুব। তেইশ বসন্ত কেটেছে যে শহরে, তাকে ভুলবে কেমন করে হেমছায়া? ভোরের ট্রামের শব্দে যখন ঘুম ভাঙত, তখনও উঠি উঠি করে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বিছানা আঁকড়ে পড়ে থাকত সে আরও কিছু সময়। তারপর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখত নিচে। শহরটাও তখন তার মতোই আলস্য কাটিয়ে জেগে উঠত একটু একটু করে। অজান্তেই তাই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার বুকের গভীর থেকে।
তা সত্ত্বেও মুম্বই সামান্য হলেও যখন একটু জায়গা করে নিতে পেরেছে হেমছায়ার মনে, তখন হঠাৎই একদিন শেষমুহূর্তে জানান দিয়ে দিল্লি থেকে এসে হাজির অরিজিতের এক বন্ধু আর বন্ধু-পত্নী। তারা মুম্বই হয়ে যাবে গোয়া ভ্রমণে। একটা রাত্তির ওদের ওরলির অ্যাপার্টমেন্টে কাটিয়ে পরেরদিন রাতের ভলভো বাসে রওনা হবে গোয়ার উদ্দেশ্যে। অরিজিতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে কথা। আগেভাগেই সে বলে দিল, “দেখো হেম, মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার, যত্ন-আত্তির যেন কোনওরকম ত্রুটি না হয়।”
বন্ধু-পত্নী অঞ্জলি বেশ মিশুকে মহিলা। বিয়ের পর হানিমুনে গিয়েছিল সিমলা-মানালি গতবছরের মার্চ মাসের গোড়ার দিকে আর এবছর যাচ্ছে গোয়ায়। আফসোস করে বলল, “দেরি করে ফেললাম আমরা, গোয়ায় এখন বেশ গরম পড়ে গেছে। আসলে কী জানো হেমছায়া, আমার হাজব্যান্ড, মানে তোমার সুবর্ণদা কিছুতেই ছুটি ম্যানেজ করতে পারছিল না। তোমরা কোথায় যাবে ঠিক করেছ কিছু?” অঞ্জলির কণ্ঠস্বরে আন্তরিকতার ছোঁয়া, “দিস ইজ হাই টাইম ফর ইউ। দেরি করলে হানিমুনের মধু আর মিষ্টি থাকে না কিন্তু!”
“অরিজিতেরও তো একই সমস্যা অঞ্জলি। ছুটি সমস্যা।” জবাবে বলল হেমছায়া, “বলল তো চেষ্টা করছে।”
সুবর্ণ আর অঞ্জলির সঙ্গে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প-আড্ডা চলল ওদের সে রাত্তিরে। নবদম্পতির রুটিন মাফিক জীবনে একটু বৈচিত্র্য, মন্দ লাগল না হেমছায়ার।
দিনভর রান্নার ফাঁকে ফাঁকে সঙ্গ দিল সে অঞ্জলি-সুবর্ণকে। অন্যান্য দিনের চেয়ে কিছু আগে অফিস থেকে ফিরল অরিজিৎ। ওদেরকে সি-অফ করার জন্যে হেমছায়াকে সঙ্গে নিয়ে বেরোল। স্মার্টফোনে জি.পি.এস চালু করে ক্যাব-ট্যাক্সি আনিয়ে রওনা হল চারজন একসাথে। রাতের মুম্বইয়ের ঝাঁ চকচকে রাস্তায় হেমছায়া এই প্রথমবার। ঘরে বসে থেকে থেকে একঘেয়েমির শিকার হয়ে পড়েছিল, বাইরের খোলা হাওয়ায় ভালো লাগে তার। মুখে না বললেও চোখমুখ বলে দেয় ভিতরের উচ্ছ্বাস।
ভলভো বাস ছাড়তে ছাড়তে দশটা বেজে গেল। এবার ফেরার পালা। কিন্তু কী যে খেয়াল হল অরিজিতের, ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে তুলে সে বলল, “চলো হেম, আমরা অন্য বাহনে ফিরি।”
“মানে! কোন বাহনের কথা বলছ?”
“বাসে। নতুন শহরের বাস-ভ্রমণ আশা করি ভালোই উপভোগ করবে তুমি।”
অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরোনোর আগে অরিজিৎ বলেছিল, “যদিও এ শহরের তেমন কোনও দুর্নাম নেই, তবুও সাবধান থাকা সবসময়েই ভালো। আর সেজন্যেই আমি তোমাকে বলছি, যতসব সোনার গয়নাগাটি পরে আছ, সেগুলো খুলে রেখে বেরোও।”
হেমছায়া মনে মনে নতুন মানুষটার বিচক্ষণতায় খুশি হওয়ার সাথে সাথে আশ্বস্তও হয়েছিল। বন্ধুরা ভুল কিছু বলেনি তাহলে। স্বামী-ভাগ্য তার খুবইভালো।
বাস-স্ট্যান্ডে দাঁড়াতে হল না বেশিক্ষণ। ওরা ওরলির বাস পেয়ে গেল মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই। হেমছায়া সামনের দিকে বসার সিট পেল। তার সিটের কাছেই ওপরের রড ধরে দাঁড়াল অরিজিৎ।
ফাঁকা রাস্তায় দ্রুতগতিতে চলতে থাকে মুম্বইয়ের ‘বেস্ট বাস’। দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল কয়েকটা স্টপেজ। তারপর পেছনের দিকে খালি সিট পেয়ে অরিজিৎ যেই এগিয়ে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতে গেল, হেমছায়া জিজ্ঞেস করল, “আমরা কোথায় নামব যেন? আমি তো এ শহরের কিছুই চিনি না, তুমি…”
“একদম টেনশন কোরো না হেম, আমি তো কয়েকটা রো পেছনেই থাকছি! এই যে বাস ছাড়ল, এরপর তিন নম্বর স্টপেজে নামব আমরা, বুঝলে?”
পরের স্টপেজ এল অনেক পরে। আশ্চর্য শহর বটে মুম্বই! দুটো স্টপেজের মাঝে যে এত দূরত্ব, তা কলকাতার মেয়ে হেমছায়ার কাছে একেবারে অভিনব অভিজ্ঞতা। কলকাতায় হলে এই দূরত্বে বাস অন্তত চারবার থামত। একটু পরেই উসখুস করতে করতে উঠে দাঁড়ায় হেমছায়া। তার আশঙ্কা, তিন নম্বর স্টপ না পার হয়ে যায়। অরিজিৎ হয়তো নামবে পেছনের গেট দিয়ে। নামার সময় জানান দিলেও যদি বাসের শব্দে শুনতে না পায় সে!
দু’নম্বর স্টপ পেরিয়ে বাস ছুটছে দ্রুতগতিতে। তারপর হঠাৎ ব্রেক করে দাঁড়াতেই সামনের গেট দিয়ে চটপট বাস থেকে নেমে পড়ল সে এবং বাসও ছেড়ে দিল প্রায় সাথে সাথে। পেছন ফিরে তাকাতেই ছ্যাঁত করে ওঠে হেমছায়ার বুক। কী আশ্চর্য! অরিজিৎ নেই! সে কি তবে নামেনি বাস থেকে? এবার কীহবে? পার্স নেই তার কাছে। অরিজিৎই নিতে বারণ করেছিল বেরোনোর সময়। বলেছিল, “আরে, আমি তো আছি! তুমি চলো একদম ঝাড়া হাত-পা। তোমার হাজব্যান্ডের ওপর কি একটুও ভরসা রাখতে পারছ না হেম!”
একথার পর আর কী করবে সে? পরম নিশ্চিন্তে একেবারে খালি হাতে বেরিয়ে পড়েছিল। মোবাইল ফোনটা পর্যন্ত সঙ্গে নেয়নি! রাতের মুম্বইয়ের অচেনা রাস্তায় এখন সে একেবারে একা। চারপাশে জনস্রোত। বিভিন্ন এজ-গ্রুপের ছেলেমেয়েরা ছুটছে। ছুটছে এমনভাবে, যেন দম দেওয়া পুতুল সব কিংবা এ যুগের রোবট! কী করবে সে? কীভাবে ফিরবে ওরলির অ্যাপার্টমেন্টে? উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে হেমছায়ার। ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ। যেকোনও পথচারীকেই হেমছায়া দেখতে থাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে। কাকে বিশ্বাস করে সাহায্য চাইবে? বিপুল এ বিশ্বের যেকোনও প্রান্তে দিনের আলোতেই বলে নারী নিরাপত্তাহীন, তা রাত্তিরে, এমন পরিস্থিতিতে… শুনেছিল বটে, এ শহর ঘুমোয় না। রাত যত বাড়ে, রাস্তায় লোক-চলাচলও পাল্লা দিয়ে বাড়ে। অবশ্য রাস্তা সুনসান কিংবা জনাকীর্ণ, দুয়ের মধ্যে কোনও ফারাকই নেই তার কাছে। চলমান জনস্রোত তার বিপন্নতাকে একটুও কমাতে পারেনি, পারেনি ভরসা যোগাতে।
অকূল সমুদ্রে দিশাহারা নাবিকের মতো কূলের সন্ধানে যখন সে মরিয়া, তখন হঠাৎ করেই অন্য এক সম্ভাবনার চিন্তা মাথায় বিদ্যুৎ-ঝিলিকের মতো ঝিলিক দিয়ে ওঠে হেমছায়ার। অবশ হয়ে আসে তার সমস্ত শরীর, চলার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলে সে। তাহলে এইজন্যেই কি অরিজিৎ পরিকল্পনা-মাফিক সব সোনার গয়নাগাটি খুলে বেরোতে বলেছিল তাকে সাবধানতার অজুহাত দিয়ে! আর সেও সরল বিশ্বাসে পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে! ক’দিনের পরিচয় তার মানুষটার সাথে? বাইরে থেকে যাকে এত কেয়ারিং হাজব্যান্ড মনে হচ্ছে তার, সে কি আসলে অন্যরকম? মন্দ কোনও উদ্দেশ্যে তাকে বিয়ে করে মুম্বই শহরে নিয়ে এসেছে এবং সচরাচর যেমন শোনা যায়, তেমনই কোনও আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্রের সাথে জড়িত?
উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে হেমছায়ার শরীর। সে বসে পড়ে ফুটপাতের ওপর। পাশ দিয়ে যেতে যেতে এক পথচারী কিছু একটা বলতে গিয়েও শেষমেশ কী ভেবে নির্বাক থেকে চলে গেল।
বাবাও তাহলে পাত্রের খোঁজখবর ঠিকমতো না নিয়েই বসিয়ে দিয়েছিল তাকে বিয়ের পিঁড়িতে! ভালো মানুষের মুখোশ আঁটা অরিজিৎ হয়তো শুধু তাকেই নয়, প্রতারিত করে চলেছে একের পর এক… আর কিছু ভাবতে পারে না হেমছায়া।
যখন সব আশা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটতে শুরু করেছে সে, ঠিক তখনই…
কী দেখছে হেমছায়া! ঠিক দেখছে তো? দেবদূতের মতো সামনের দিক থেকে ছুটতে ছুটতে আসছে যে মানুষটা, সে তো অরিজিৎ! অরিজিৎই!
“কী ব্যাপার! তুমি আগেই নেমে পড়লে কেন হেম? আমি যে তোমাকে বললাম…” হাঁপাতে থাকে অরিজিৎ। দম নিয়ে কথার খেই ধরে, “আগেই নেমে পড়লে কেন?”
“কী বলছ তুমি?”
“ভুল তো কিছু বলিনি হেম!” অবাক হয়ে চেয়ে থাকে সে হেমছায়ার বিপন্ন-বিধ্বস্ত মুখের দিকে।
“না, আমি তো… তুমি যেমন বলেছিলে তিন নম্বর স্টপেজেই নামলাম! তুমি নামলে না কেন অরিজিৎ, বলো তো?”
অরিজিতের ঠোঁটের কোণে কষ্টের হাসির রেখা ফুটে ওঠে, “কী যে বলো না তুমি হেম, আশ্চর্য! যে জায়গায় তুমি নামলে, সেটা তো কোনও স্টপেজই নয়, ট্র্যাফিক সিগন্যাল পয়েন্ট! আমি তোমাকে নামতে দেখে নামতে গিয়েও নামতে পারিনি কেন জানো? কারণ, তার আগেই সবুজ হয়ে গিয়েছিল সিগন্যাল! আরে, তুমি বাস থেকে নামার আগে পেছন ফিরে আমার দিকে চাইবে তো একবার, নাকি! প্রায় এক কিলোমিটার পথ ছুটতে ছুটতে আসছি…”
হেমছায়া তার একটু আগের ভাবনাগুলোর কথা ভেবে মরমে মরে যেতে থাকে, অরিজিতের কোনও কথাই আর তার কানে ঢোকে না।
অলঙ্করণঃ সায়ন মজুমদার
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস
বেশ লাগল
LikeLike