গল্প একটি অনৈতিহাসিক সার্জিকাল স্ট্রাইক দীপক দাস শরৎ ২০১৯

দীপক দাসের আগের লেখাঃ তোমরাও ভালো থেকোসমুকাকের বাসায় কোকিল ছা, যমধারার জঙ্গলেআবার যমধারার জঙ্গলে, শিয়াল চরা সেই রাত

দীপক দাস

এক

গানটা গাঁক করে কানে বেজেছিল সৃজর। বিকট চিৎকারে কেউ গাইছে, ‘আর কত কাল কান্দাবি রে দয়াল, আর কত কাল…’। তারপরেই দিদিভাইয়ের সরু গলায় চিৎকার, “ভাই ভাই, দেখে যা কাণ্ডখানা!”

দিদির ডাক বা গান—কোনও কিছুকেই পাত্তা দিল না সৃজ। ও দ্রুত হাতের কাজ শেষ করতে চাইছে। না হলে স্যার দয়াপ্রকাশের বাড়ি যেতে দেরি হয়ে যাবে। কিন্তু কাজ আর শেষ করা হল না। দিদি হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে সৃজর কানটা ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে গেল। সঙ্গে তর্জন, “বড়োরা কথা বললে কানে যায় না, নাকি!”

আজ রবিবার। সকলেই বাড়িতে। কান হস্তগত করা সৃজর দিদির রণংদেহি মূর্তি দেখে সকলে হাঁ হাঁ করে উঠলেন। সৃজর জেঠিমা ধমকে উঠলেন, “এই মণি, কী করছিস? কচি কানটা ছিঁড়ে যাবে যে!”

দাদা মানে, জেঠুর ছেলে শুভ বলে, “ছিঁড়ুক না। মণির কান কেটে প্রতিস্থাপন করা হবে। তখন মজাটি টের পাবে।”

জেঠু হাসতে হাসতে বললেন, “ছেলের কান যদি ছেঁড়ে, তোর ছেলেমেয়ে হলে তাদের কান মুলে শিঙাড়ার মতো মুড়ে দেব।”

এত টিপ্পনির চোটে দিদি কানটা ছেড়ে দেয়। আলতো করেই ধরেছিল। কিন্তু সৃজ কানে হাতটাত বুলিয়ে এমন ভাব করছিল যেন কত লাগছে। ওর সহানুভূতি কুড়োনোর কৌশলটা দিদি ধরে ফেলে। ঘুসি পাকিয়ে সৃজর দিকে তেড়ে যায়। সৃজর মা-বাবা এতক্ষণ ছেলেমেয়েদের খুনসুটিতে হাসছিলেন। মণিকে আবার ক্ষেপে যেতে দেখে ওরা বললেন, “কী হয়েছে রে, মা?”

দিদি ফোঁস ফোঁস করে ওঠে, “কখন থেকে ডাকছি একটা আজব জিনিস দেখাব বলে! বাবু গ্যাঁট হয়ে চেয়ারে বসে রয়েছেন!”

সকলেই হইহই করে ওঠেন, “আজব জিনিস! তাই নাকি! আমরাও দেখব। চল, চল।”

শনিবার রাত থেকেই পুরো বাড়িটা খুনসুটির আখড়া হয়ে যায়। সৃজ এবার উচ্চমাধ্যমিক দেবে। ও বাড়িতেই থাকে। বাবা-জেঠু কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন। জেঠতুতো দাদা-দিদি থাকে কলকাতায়। যাদবপুরে গবেষণা করে। কিন্তু ছুটির আগের দিনে সকলেই গ্রামের বাড়িতে ফেরে। সাপ্তাহিক মজলিশ বাদ দিতে চায় না কেউ। মণি বাড়ির একমাত্র মেয়ে। ফলে ওর আদর খুব। ও বুঝতে পারে, বড়োরা বিষয়টা হালকা করার জন্য হামলে পড়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে। তাই ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে, “দেখবে আবার কী? শুনতে পেলে না, তিনু মাতাল চেঁচামেচি না করে, মাকে মারধর না করে আজ গান গাইছে! তাও আবার করুণ গান!”

সৃজর বাবা বলল, “হ্যাঁ, শুনলুম তো। কিন্তু মাতাল-টাতালের কাণ্ড বলে আর পাত্তা দিইনি। কী হয়েছে বল তো।”

”দেখবে চলো কী হয়েছে।” দিদি ঠেলতে ঠেলতে সকলকে ঘরের বাইরে বের করে।

বাইরে বেরিয়ে বাড়ির লোক বিস্মিত। পুকুরের ওপারেই বাড়ি তিনুর। এই সময়ে মদ খেয়ে ফেরে, আর বুড়ি মাকে প্রবলভাবে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে মারে। ঠেলে ফেলে দেয়। পাড়ার লোক একদিন ধরে মেরেছিল ওকে। কিন্তু ওর মাই আবার পরে প্রতিবেশীদের গালাগাল করেছিল। তাই কেউ আর কিছু বলে না। আজ সেই তিনু বাড়ির বাইরের চাতালে মায়ের পা জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে গান গাইছে। তিনুর কীর্তিতে ভিড় জমে গিয়েছে।

সৃজ আস্তে আস্তে দিদির চোখ এড়িয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ে। নিজেই রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে খেয়ে ছুট লাগায় স্যার দয়াপ্রকাশের বাড়ির দিকে। যাওয়ার আগে জেঠিমাকে বলে যায়। আর জেঠিমার পাশে থাকা দিদিকে প্রবলভাবে ভেংচি কাটে।

 দুই

 “কিঞ্চিৎ দেরি করে ফেললি তো রে!” সৃজকে দেখে বললেন বাসুবাবু। সৃজ হাসল।

বাসুবাবু ওদের স্কুলের বাংলার শিক্ষক। ছুটির দিনে অন্যদের মতো উনিও দয়াপ্রকাশের বাড়িতে আড্ডা দিতে আসেন। সে এক জমাট ব্যাপার। সাহিত্য, আবিষ্কার, ইতিহাসের জমজমাট আড্ডা। মূল আড্ডা হয় সন্ধের পরে। কেউ কেউ সকালেও আসেন।

দু’জনে স্যার দয়াপ্রকাশের ঘরে চলে এল। তিনি কী একটা করছিলেন। সৃজকে দেখে বাসুবাবুর মতোই বললেন, “আজ এত দেরি যে!”

সৃজ তিনু মাতালের কীর্তির কথা বলল। বাসুবাবু ‘তাই নাকি’ বলে বিস্ময় প্রকাশ করলেও দয়াপ্রকাশ কোনও আগ্রহ দেখালেন না। বরং পালটা প্রশ্ন করলেন, “পলাশীর প্রান্তরে ক্লাইভের সঙ্গে যুদ্ধে বৃষ্টিতে নবাব সেনার বারুদ ভেজার কাহিনিটা যেন কী?”

দয়াপ্রকাশ ওইরকমই। আপনভোলা। উনি সৃজদের স্যার নন। কখনওই শিক্ষকতা করেননি। বিজ্ঞানচর্চা করেন। বিজ্ঞান বিভাগে সরকারি বড়ো পদে ছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতের মিল না হওয়ায় সেসব ছেড়েছুড়ে দেন। বছর দুয়েক হল সৃজদের গ্রামে বসত করেছেন। নানা মজার আবিষ্কারে মেতে থাকেন উনি। এই তো গতবছর গ্রামে শিয়ালের উৎপাত খুব বেড়েছিল। লোকের হাঁস-মুরগি, শসা, কুমড়ো খেয়ে ক্ষতি করছিল। তারা ক্ষেপে আগুন। ফাঁদ পেতে, বিষ দিয়ে শিয়াল মারবে বলে তৈরি। দয়াপ্রকাশ একধরনের যান্ত্রিক কাকতাড়ুয়া তৈরি করে দেন। কাকতাড়ুয়া শিয়াল ধরে খুব কাতুকুতু দিত। এলাকার মানুষের কাছে দয়াপ্রকাশ খুব প্রিয়।

বাসুবাবু দয়াপ্রকাশের কথার জবাব দিলেন, “ইতিহাস বইয়ে লেখে, সিরাজের হারে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা তো ছিলই, আগের রাতে প্রবল বৃষ্টি হয়ে গোলাবারুদ নাকি ভিজিয়ে দিয়েছিল।”

দয়াপ্রকাশ বললেন, “ওই ভেজার কাহিনিতেও বিশ্বাসঘাতকতা আছে।”

বাসুবাবু থমকে গেলেন। সৃজও অবাক। স্যার আবিষ্কার ছেড়ে ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন নাকি! বাসুবাবু আলতো স্বরে জানতে চাইলেন, “আপনি কি কোনও নতুন গবেষণাপত্রের সন্ধান পেয়েছেন?”

স্যার মুচকি হেসে জবাব দিলেন, “নিজের চোখেই তো দেখলুম।”

দয়াপ্রকাশ কি মজা করছেন? কিছু বলতে না পেরে সৃজ আর বাসুবাবু থম হয়ে বসে থাকেন। স্যার হাসতে হাসতে বলেন, “আরে! এত অবাক হওয়ার কী আছে? সপ্তাহ তিনেক আগেই তো গিয়েছিলুম ১৭৫৭ সালে।”

বাসুবাবু বললেন, “ভালো কথা তো। কিন্তু আপনার নৈর্ব্যক্তিক উত্তরে বিষয়টি খোলসা হচ্ছে না। একটু বড়ো প্রশ্নের মতো করে উত্তর দেবেন?”

সৃজ চুপ করে দুই প্রবীণের কথাবার্তা শুনছিল। স্যার সৃজর দিকে মুচকি হেসে বললেন, “আমি একটা কম মাইলেজের টাইম মেশিন আবিষ্কার করেছি। সেটা চেপেই তো হাজির হয়েছিলুম পলাশীর প্রান্তরে। তখনই দেখতে পেলুম ষড়যন্ত্রটা। আচ্ছা বলুন তো, বাংলার মানুষ মেঘ দেখে বৃষ্টি হবে কি হবে না, সেটা বুঝতে পারবে না? সেনাপতি পদাধিকারীদের কথা না হয় ছেড়েই দিলুম। তাঁদের বড়ো ব্যাপার। সাধারণ সেনারা তো পারবে। পেরেওছিল। বৃষ্টি আসার আগেই গোলাবারুদ ঢাকার ব্যবস্থা করেছিল তারা। কিন্তু মীরজাফরের লোকেরা রাতের অন্ধকারে ঢাকা খুলে দিচ্ছিল। আমি সেইসময়েই গিয়ে পড়ি। কিন্তু আটকাতে পারিনি। বিশ্বাসঘাতকদের একজন আমাকে দেখতে পেয়ে তাড়া করে। কোনওরকমে পালিয়ে এসেছিলুম। কিন্তু লোকটার বন্দুকের গুলিতে মেশিনটা একটু চোট পেয়েছে।”

স্যার নির্লিপ্তভাবে কথা থামান। টাইম মেশিন আবিষ্কার করাটা যেন ছোটোবেলায় নারকেল পাতা দিয়ে হাওয়া কল বানানোর মতো সহজ। শ্রোতারা এত অবাক হয়ে যায় যে তাদের মুখ থেকে কোনও কথা সরে না। সৃজ ভাবে, এসব তো কল্পবিজ্ঞানের গল্পে মেলে। স্যার সেটা সম্ভব করে ফেলেছেন! আর ও সেটা শুনছে!

দয়াপ্রকাশই বিস্ময় আর অবিশ্বাসের বাতাস হালকা করলেন। দু’জনকে নিয়ে গেলেন বাগানের দিকের একটা ঘরে। স্যারের বাগানটা বেশ বড়ো। বাগানের একটা ছোটো ঘরে থাকে স্যারের কুকুর লাইকা। আওয়াজ পেয়ে লাইকা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। তারপর সৃজর পাশে পাশে হাঁটতে শুরু করল। লাইকা খুব শান্ত। ওর কোনও হাঁকডাক নেই।

দয়াপ্রকাশ গুদামঘরের দরজা খুললেন। ডাঁই করে রাখা নানা গবেষণার ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে এগিয়ে গেলেন একটা কোণে। পুরনো চাটাই-কম্বল সরাতে বেরিয়ে এল গোলাকার একটা অবয়ব। সেটা দেখিয়ে উনি বললেন, “এই যে আমার বরাহমিহির।”

এটা টাইম মেশিন! সৃজর মনে হল, দয়াপ্রকাশ আজ মজার মুডে আছেন। উনি যেটাকে টাইম মেশিন বলছেন সেটা অনেকটা বাচ্চাদের চান করানোর প্লাস্টিকের চৌবাচ্চার মতো দেখতে। আকারে অনেকটা বড়ো আর গোলাকারের বদলে ডিম্বাকৃতি, এই যা। গোলাকার বস্তুটার আবার তিনটে ঠ্যাং আছে। এটা উড়বে? সৃজ একপলক বাসুবাবুর দিকে তাকাল। বাসুবাবু মিটিমিটি হাসছেন। মানে উনিও এটাকে দয়াপ্রকাশের মজা হিসাবেই নিয়েছেন। ও দয়াপ্রকাশের মুখেও একচিলতে হাসি দেখতে পেল।

কী যে হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছিল না সৃজ। ওর অস্বস্তি দূর করলেন বাসুবাবু। দয়াপ্রকাশকে বললেন, “প্রকাশবাবু, বরাহমিহির বেশ হয়েছে। কিন্তু আমার আশঙ্কা, এই যানে অতীত বা ভবিষ্যৎ সফরে ঝুঁকি আছে। ধরুন, আপনি যাচ্ছেন গুপ্তযুগে। ইতিহাসে ওই যুগ সুবর্ণ যুগ হিসাবে খ্যাত। আমি আপনার সফরসঙ্গী। যেতে যেতে ধপ করে পড়ে গেলুম মাৎস্যন্যায়ের যুগে। কী হবে তখন!”

“ভয় পাবেন না। আমার টাইম মেশিন অতদূর টানতে পারবে না।”

“আচ্ছা বেশ। অতদূর নাই বা গেল। ধরুন, আপনি স্যার টমাস রোয়ের ভারতে আসা আটকাতে বরাহমিহির ছোটালেন। যাতে ইংরেজরা ভারতে না আসতে পারে। কিন্তু আপনার সঙ্গী টুপ করে গিয়ে পড়ল পলাশীর আমবাগানে। ক্লাইভ সেনার গোলার ঘায়ে উড়ে গেল সে। টাইম-স্পেসের ব্যাপার, মশাই। আপনার বরাহমিহির যা খোলামেলা! একটু এদিক ওদিক হলেই তো…”

“এবার আপনার কথা বুঝতে পেরেছি। আরে, এটা বরাহমিহিরের খোল। নলচেগুলো আলাদা করে রাখা আছে। বিকেলের আড্ডায় আপনাদের পূর্ণাঙ্গ বরাহমিহির দেখাব। এক কাজ করুন না। আজ একটু বরাহমিহির সফর করবেন? আপনার তো এখন স্কুল ছুটি।”

“আমার কোনও আপত্তি নেই। ফিরতে না পারলেও ক্ষতি নেই। ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠিত। গিন্নির দেখভাল করতে পারবে। এমন সুযোগ কি ছাড়া যায়! সৃজ, তোর তো পরীক্ষার দেরি আছে। যাবি নাকি?”

“ও ছোটো ছেলে। ওকে নিয়ে যাব?”

“ছোট তো কী হয়েছে! এমন অভিজ্ঞতা ছোটোবেলাতেই পেয়ে গেলে ও দ্রুত বড়ো হয়ে যাবে।”

 তিন

 দুপুরে খাওয়ার সময়েই জেঠু আর বাবাকে কথাটা বলে দিয়েছিল সৃজ। আজ আর সন্ধের আড্ডা বসবে না স্যারের বাড়ি। দয়াপ্রকাশ ব্যস্ত থাকবেন। আর সেও দুপুর থেকেই স্যারের বাড়ি থাকবে। বাড়ির লোক আর কিছু জানতে চায়নি।

বেরনোর সময়ে সৃজ শুধু চিৎকার বলে দিল, “মা-জেঠিমা, আমি বেরোচ্ছি।”

এবেলাতেও বাসুবাবুকে হারাতে পারল না সৃজ। ওকে দেখেই বাসুবাবু বললেন, “আবার বিলম্ব?”

সৃজ হাসল। দয়াপ্রকাশ দু’জনকে আবার বাগানের দিকে নিয়ে গেলেন। এবার আর গুদামঘর পর্যন্ত পৌঁছতে হল না। ঘরের আগেই খোলা চত্বর। সেখানেই দেখা হয়ে গেল বরাহমিহিরের সঙ্গে। সত্যি-সত্যিই খোলনলচে বদলে ফেলেছে সে। সুন্দর একটা ঘেরাটোপ। আর কতরকম যন্ত্রপাতির সজ্জা সারা শরীরে। জনা ছয়েক লোক ঘেঁষাঘেঁষি করে ধরে যাবে।

স্যার সৃজর দিকে তাকিয়ে বললেন, “কেমন লাগছে আমার বরাহমিহিরকে?”

সৃজ বলল, “অনেকটা ছবিতে দেখা জেপেলিনের মতো লাগছে, স্যার।”

স্যার হাসলেন। তারপর বাসুবাবুর দিকে ফিরে বললেন, “আপনার আর পড়ে যাওয়ার ভয় নেই তো?”

“না, তা নেই। তবে কিনা মাঝপথে জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে কী হবে সেটা ভাবছি।” বাসুবাবু বলেন।

স্যার উত্তর দিলেন, “জ্বালানি নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। কেন নেই তা বোঝাতে গেলে অনেকটা সময় চলে যাবে। তার থেকে আমরা যাত্রার আয়োজন করি। কিন্তু মশাই, মনে হচ্ছে, আপনার মনে অনেক সংশয়। আপনি শুধু উপরোধে ঢেঁকি গিলছেন। আপনি যাত্রা স্থগিত করতে পারেন।”

হাঁ হাঁ করে উঠলেন বাসুবাবু। বললেন, “ক্ষেপেছেন! এই সুযোগ কেউ ছাড়ে? ওবেলায় তো বললুম, গিন্নি এখন ছেলেমেয়ে দরদি।”

স্যার জানালেন, সন্ধের পরে যাত্রা শুরু হবে। দিনের আলো থাকতে যাত্রা শুরু করলে পাড়ার অনেকের চোখে পড়তে পারে। তাতে নানা কৌতূহল, কৈফিয়তের মুখোমুখি হতে হবে। সৃজ জানতে চাইল, লাইকাও তাদের সঙ্গে যাবে কি না। স্যার বললেন, “ওকে নিয়ে যাচ্ছি না। অনেকরকম সমস্যা হতে পারে। ওর জন্য দিন তিনেকের খাবার-জলের ব্যবস্থা করে রেখেছি। ও ঠিক সময়মতো খেয়ে নেবে।”

এর পরের সময়গুলো খুব দ্রুত আর উত্তেজনায় কাটাল সৃজ। ততক্ষণে ঝুঝকো অন্ধকার নেমে এসেছে। হালদার বাড়ির কালীমন্দিরে শাঁখে ফুঁ পড়ল আর নড়ে উঠল বরাহমিহির। দয়াপ্রকাশের বাগানের গাছপালার ফাঁক দিয়ে সাঁই সাঁই করে উড়তে শুরু করে দিল সে। সৃজ ঘুরেফিরে বরাহমিহিরকে দেখতে লাগল। খুব ছিমছাম। টাইম মেশিন মানে ভারিক্কি কিছু হবে ভেবেছিল ও। মেশিনের চারদিকে নানা শিশি-বোতলের সারি। কোনওটার গায়ে লেখা ‘ক্ষান্তক্লান্তি’, কারও লেবেল ‘সহিষ্ণুতাবর্ধক’, কারও নাম, ‘কর্মযোগৌষধি’। সৃজর মনে হচ্ছে, কোনও ওষুধের দোকান হঠাৎ ডানা গজানোয় উড়তে শুরু করেছে। মেশিনটা স্যার চালাচ্ছেন। ওঁর সামনে একটা ঘড়ি রাখা। সেটা বিপরীত দিকে পাঁই পাঁই করে ঘুরছে। দয়াপ্রকাশ জানালেন, এর মানে হল, ওরা সময়ের উলটোদিকে যাচ্ছে। মানে অতীতে।

বাসুবাবুকে কীসব বোঝাচ্ছিলেন দয়াপ্রকাশ। বরাহমিহিরের কলকব্জা-সংক্রান্ত। সৃজর তাতে কান ছিল না। ও তখন ভাবুক হয়ে পড়েছে। এত বড়ো একটা ঘটনার সাক্ষী। বন্ধুদের বললে কি ওরা বিশ্বাস করবে? এই অভিযানের কথা ওদের বলা যাবে কি? সেটা দয়াপ্রকাশের কাছে জেনে নেবে। কিন্তু বলা নাই যাক, এবারের উচ্চমাধ্যমিকের রচনায় ও ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় এটাই লিখবে বলে ঠিক করল। লিখবেই। তাতে স্যারেরা নম্বর দিন বা নাই দিন। সৃজ চোখ বুজে ভাবতে শুরু করল, রচনাটা কোথা থেকে শুরু করা যায়। বাইরে তখন টাইম-স্পেসের দ্রুত পরিবর্তন। ভিতরে বসে সেসব কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

চোখ বুজে প্রথম লাইনটা বাগে এনে ফেলেছিল সৃজ। তখনই একটা ঝাঁকুনি। হাঁ হাঁ করে উঠলেন দয়াপ্রকাশ। কথা থামিয়ে উঠে গেলেন। কীসব খুটখাট করে জানালেন, পলাশীর প্রান্তরে গুলির চোটটা হঠাৎ চাগিয়ে উঠেছে। ব্যথায় কাতর হয়ে পড়েছে বরাহমিহির। শুনে বাসুবাবু আঁক করে উঠলেন। আর বরাহমিহির নামতে শুরু করল।

চার

গাছে ঘেরা একটা সবুজ ময়দানে এসে নেমেছে বরাহমিহির। কোথায় এটা? কোন সময়ে এসে পড়ল তারা? উঁকিঝুঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল সৃজ। দয়াপ্রকাশ বরাহমিহিরের কলকব্জা নিয়ে পড়ে আছেন। আর বাসুবাবু থেকে থেকে একটা কথাই বলে চলেছেন, “বরাহমিহির নরখাদকদের আড্ডায় এসে থামল না তো? ফিরতে না পারি ক্ষতি নেই, কিন্তু পাঁঠা কাটার মতো আমাকে ঝুলিয়ে রোস্ট করবে ভাবলেই গা গুলিয়ে উঠছে।”

সৃজ বুঝতে পারছিল, বাসুবাবু তাঁর ছোটোবেলায় পড়া অ্যাডভেঞ্চার কাহিনির ফেরে পড়ে আছেন এখনও।

সৃজর ভাবনার শেষেই দরজায় টোকা পড়ল। হাউমাউ করে উঠলেন উনি, “ওই যে এসে গিয়েছে নরখাদকেরা!”

দয়াপ্রকাশের এসব কিছুই কানে যাচ্ছে না। উনি সারাইয়ে ব্যস্ত। আবার টোকা পড়ল দরজায়। এবার জোরে জোরে। সৃজ দরজাটা অল্প ফাঁক করল। নিচে লাল পাগড়ি আর হাফ-প্যান্ট পরা একটা লোক লাঠি উঁচিয়ে তর্জন গর্জন করছে, “অভি গাড়ি সে উতরো।”

শুনেই উল্লসিত হয়ে পড়লেন বাসুবাবু। “এ যে রাষ্ট্রভাষা! মানে ভারতেই আছি। আহা!” বলতে বলতে দুদ্দাড় করে দরজার দিকে ছুটে এসে সোজা অবতরণ। একেবারে লাল পাগড়ির সামনে। লাল পাগড়ি খপ করে ওঁর হাতটা চেপে ধরলেন। ঠিক তখনই দয়াপ্রকাশ ‘হুর-রে’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন।

চিৎকারে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল লাল পাগড়ি। কিন্তু দ্রুত সামলে নিয়ে চিৎকার করে উঠল, “ডাকু লোগ হ্যায়! হা-রে-রে বোলতা!” বলেই পিঁ পিঁ করে বাঁশি বাজিয়ে দিল। বাঁশি শুনে আশপাশ থেকে আরও লাল পাগড়ি ছুটে এল। সকলে ‘উতরো উতরো’ করে এমন চিৎকার জুড়ল যে সৃজ আর দয়াপ্রকাশও নেমে আসতে বাধ্য হলেন।

তিনজনকে খপ খপ করে ধরে লাল পাগড়িরা প্রসেশন করে চলল। নিশ্চয়ই থানায় নিয়ে যাচ্ছে। দিনে দুপুরে তিন-তিনটে ডাকাত ধরে ভারি আমোদে আছে ওরা। একজন সৃজকে দেখিয়ে বলল, “ইয়ে বাচ্চা ভি ডাকু হ্যায়।”

সকলে একযোগে সম্মতিসূচক ‘হঁ’ করে উঠল।

এত গণ্ডগোলের মধ্যেও বাসুবাবু কথা থামাননি। ওঁর একটাই কৌতূহল, কোথায় এসে পৌঁছেছেন? হাঁটতে হাঁটতে আগে-পিছের লাল পাগড়িকে ঘ্যান ঘ্যান করে অদ্ভুত রাষ্ট্রভাষায় জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন, “ইয়ে জাগা কি নাম ক্যায়া হ্যায়?”

বারবার জিজ্ঞাসায় এক পাগড়ি ক্ষেপে গিয়ে বলল, “ইতনা উঁচা মনুমেন্ট দিখাই নহি দেতা! কলকাত্তা কা নিশান? কৌনসি দেহাত সে হো?”

ওরা তিনজন পাগড়ির আঙুল অনুসরণ করে দেখতে পেলেন, আখাম্বা দাঁড়ানো স্তম্ভটিকে। সৃজর মুখ থেকে আপনা-আপনি বেরিয়ে এল, “শহিদ মিনার।”

দয়াপ্রকাশ বললেন, “না। অক্টারলনি মনুমেন্ট।”

আর বাসুবাবু চিৎকার করে উঠলেন, “হুর-রে। কলকাতাআআআ… বাঁচ গয়া।”

ওঁর চিৎকার শুনে প্রথম লাল পাগড়ি গর্বের সঙ্গে বলে উঠল, “বোলা থা, ডাকু হ্যায়। ফির হা-রে-রে শোর মচায়া! এই চুপ রহো। নহি তো ডাণ্ডা পড়েগা।”

তাও বাসুবাবু কি চুপ থাকেন? মনুমেন্টের পাশে বিশাল মঞ্চ বাঁধা হচ্ছে। সেদিকে আঙুল দেখিয়ে কী যেন বলার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু দয়াপ্রকাশের আঙুলের এক খোঁচায় ‘ওঁক’ করে উঠে চুপ করে গেলেন।

অনেকটা পথ হাঁটার পরে থানা এল। ইংরেজির পরে পরিষ্কার বাংলায় থানার নাম লেখা। সেটা দেখে বাসুবাবু ফিসফিস করে বললেন, “কী যন্ত্র বানিয়েছেন, প্রকাশবাবু? টাইম-স্পেস না টপকে হুগলি সেতু টপকাল? গাড়িটা রোডে নামিয়ে দিন। দু’পয়সা আয় হবে।”

দয়াপ্রকাশ বললেন, “টপকেছে, টপকেছে। আমরা সন্ধেবেলা যাত্রা করেছিলাম। এখন সকাল ফটফট করছে। এলাকাটি এখনকার মতো লাগছে আপনার?”

দু’জনকে ফিসফিস করতে দেখে প্রথম লাল পাগড়ি চাপা গলায় হুঙ্কার দিল, “কোই ফুসরফুসর নহি।”

ওদের প্রথম ধরেছে বলে একটা অধিকার বোধ জন্মেছে গিয়েছে লাল পাগড়ির। সুযোগ পেলেই বকে দিচ্ছে।

তিনজনকে থানায় একজায়গায় বসিয়ে প্রথম লাল পাগড়ি কোথায় যেন গেল। দু’জন লাল পাগড়ি ওদের পাহারায় রইল। বাকিরা বিদায় নিল। বাসুবাবু টেবিল পড়ে থাকা একটা খবরের কাগজ নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। উনি সময় পেলেই পড়েন। দয়াপ্রকাশ স্বগতোক্তির মতো বলতে লাগলেন, “কোন সময়ে এলাম? কলকাতার রাস্তা, অথচ রাস্তাঘাটে লোক নেই। পুরো এলাকা যেন থমথম করছে।”

সৃজ বলল, “স্যার, আমি দেওয়ালে একটা স্লোগান দেখেছি, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।”

শুনেই বাসুবাবু বললেন, “আমিও দেখেছি। প্রকাশবাবুর যন্ত্রটার কার্যকারিতার সমালোচনায় ঠিকমতো অনুধাবন করতে পারিনি। লড়কে লেঙ্গে… এই রে! আগে এলুম, না পরে এলুম রে বাবা?” তারপরেই কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে কাগজের মাস্ট হেডটা দেখতে লাগলেন। দেখার পরেই উত্তেজিত হয়ে পড়লেন উনি। “সর্বনাশ! ১৪ আগস্ট। একদিন পরেই যে সেই সর্বনেশে দিন, প্রকাশবাবু!”

দয়াপ্রকাশ বললেন, “কাল ১৫ আগস্ট। মানে স্বাধীনতা দিবস। তাহলে সর্বনাশের দিন কেন হবে?”

বাসুবাবু আরও উত্তেজিত হয়ে বললেন, “স্বাধীনতার এখনও একবছর বাকি। একদিন পরেই ডাইরেক্ট অ্যাকশনের দিন। প্রকাশবাবু, ওই ভয়ংকর দিনটা ঠেকাতে পারব আমরা? তাহলে অনেক লোকের প্রাণ বাঁচে। এক কলঙ্কজনক ইতিহাসের ভাগীদার হতে হয় না কলকাতাকে।”

দয়াপ্রকাশ কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। তা দেখে বাসুবাবু বলেন, “এটা আপনার বিষয় নয়, প্রকাশবাবু। আপনি আর সৃজ শুধু আমাকে সাহায্য করুন।” তারপরে কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে উনি, “পবিত্রস্থান না…রে…রে” বলে চিৎকার শুরু করলেন।

থানায় হুলস্থুল পড়ে গেল। অনেক লাল পাগড়ি ছুটে এল। বেরিয়ে এলেন দু-চারটে অফিসারও। ‘চুপ করো’, ‘চুপ রহো’, ‘শোরশরাবা নহি’, নানা ভাষার বৈচিত্রের মধ্যেও ঐক্যের বকুনি ছুটতে শুরু করল।

এক অফিসার জানতে চাইলেন, “কী বলে আপনি চিৎকার করলেন?”

বাসুবাবু দৃঢ় গলায় বললেন, “আপনি ঠিকই শুনেছেন। আপনাদের কাছে যা নির্দেশ এসেছে সেটা পালন করলে কিন্তু ভীষণ বিপদে পড়বেন।”

দয়াপ্রকাশ আর সৃজ হালকা চালের বাসুবাবুকে দেখতে অভ্যস্ত। গুরুগম্ভীর বাসুবাবুকে দেখে ওরাও একটু ঘাবড়ে গেল। অফিসার একটুখানি থমকালেন। তারপর বললেন, “আসুন আমার সঙ্গে।”

থানার বড়বাবুর টেবিলে কলকাতার ম্যাপ বিছানো। পাশে দুটো খবরের কাগজ খোলা। উনি কাগজ দেখে ম্যাপে লাল কালির দাগ দিচ্ছিলেন। মুখ তুলে তাকালেন। অফিসারটি বড়বাবুকে নিচু গলায় কীসব বললেন। বড়বাবু একবার আপাদমস্তক তিনজনকে দেখে নিয়ে বললেন, “থানায় ঝামেলা করছেন কেন?”

বাসুবাবু উত্তরে বললেন, “ঝামেলা তো শুরু গিয়েছে, মহাশয়। এখনই সেটা রুখতে না পারলে আপনার টেবিলের ওই ম্যাপটা লালে লাল হয়ে যাবে। আমাদের একটু পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে হবে। বিপদ সমাসন্ন।”

শুনেই ক্ষেপে উঠলেন বড়বাবু। ধমকাতে শুরু করলেন অফিসারটিকে, “জানেন তো কলকাতা জুড়ে কী চলছে। এখন এইসব পাগল-টাগল ধরে নিয়ে এসে সময় নষ্ট করছেন? লক-আপে ভরে দিন। এদের ছেড়ে রাখলেও বিপদ। একা পাগল হলে না হয় ছেড়ে দেওয়া যেত। জোটবদ্ধ পাগলেরা সাংঘাতিক।”

ধমক খেয়ে অফিসার তিনজনকে লক-আপের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এগিয়ে এলেন। ঠিক তখনই বাসুবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, “ইজ অনারেবল গভর্নর স্যার ফ্রেডরিক বারোজ অ্যানাউন্স ১৬ অগস্ট আ পাবলিক হলিডে?”

অফিসার থমকে গেলেন। বড়বাবু স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন। বিস্ময় কাটিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। সে সুযোগ না দিয়ে বাসুবাবু বললেন, “ইফ দ্য আনসার ইজ ইয়েস দেন মাস্ট কল কংগ্রেস লিডার কিরণশঙ্কর রয়। উনি ওঁর সম্প্রদায়ের লোকজনকে দোকানপাট, ব্যাবসা খোলা রাখার আহ্বান জানাবেন। সমস্যা বাড়বে। প্লিজ, আপনি পুলিশ কমিশনারকে খবর দিন।”

বড়বাবু এতক্ষণ বাসুবাবুর বকুনি শুনছিলেন। পুলিশ কমিশনারকে খবর দেওয়ার কথা বলতেই আবার ক্ষেপে গেলেন। চিৎকার করে, “নিয়ে যাও, নিয়ে যাও” বলতে শুরু করলেন।

 পাঁচ

 “একটা কথা ভাবছি, বুঝলেন বাসুবাবু, রাষ্ট্রদ্রোহিতার ধারা চাপিয়ে আমাদের যদি দ্বীপান্তর দেয়? নিজেদের জন্য চিন্তা নেই। সৃজটাকে নিয়ে এলাম। ও কি নিজের জন্মের আগের সময় থেকে জেল খেটেই জীবনটা শেষ করবে? আন্দামানে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ খুব।”

“চিন্তা করবেন না, প্রকাশবাবু। দ্বীপান্তর দিলেও তার মেয়াদ একবছরের বেশি হবে না।”

“কেন? এত তাড়াতাড়ি মেয়াদ শেষ হবে কেন? আপনার কেউ চেনাজানা আছে বুঝি?”

“আরে না! এই অতীতে কার সঙ্গে চেনা থাকবে? এখন যেসব কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে একটু মুখ চেনা তাঁদের পিতামাতারাও তো এই কালে দুগ্ধপোষ্য বোধহয়। আমি মুক্তির কথা বলছি স্বাধীনতার কথা ভেবে।”

“আরে! মুক্তি মানেই তো স্বাধীনতা।”

“ধুর মশাই! আর একবছরের মধ্যেই দেশ স্বাধীন হবে। আন্দামানের সৈকতে কয়েদিদের সঙ্গে নারকেল দড়ি পাকাতে পাকাতে বা কাঠের কাজ করতে করতে দেশ স্বাধীনের খবর শুনব। ভেবেই তো রোমাঞ্চ হচ্ছে মশাই।”

সৃজ কী একটা বলতে যাচ্ছিল। তখনই গরাদের সামনে সেই অফিসার এসে দাঁড়ালেন। ইশারায় উঠে আসতে বললেন। তিনজনে অফিসারকে অনুসরণ করে থানার বাইরে এসে উপস্থিত। ছেড়ে দিচ্ছে নাকি? তিনজনেই মুখ তাকাতাকি শুরু করল। পরক্ষণেই অফিসারের নির্দেশ, “জীপে উঠুন।”

সৃজ বলল, “স্যার, আন্দামান।”

বাসুবাবু সহাস্যে বললেন, “বোকা ছেলে! থানা থেকে সরাসরি দ্বীপান্তর হয় না। লাশ গুম হয়। ইংরেজরা সভ্য জাত। বিচারের প্রহসনটা না করে রানির কর্মচারীরা কোনও শাস্তি ঘোষণা করবেন না।”

দয়াপ্রকাশ একবার বললেন, “বিচারের প্রহসন? চেনা চেনা ঠেকছে কথাটা।”

বাসুবাবু কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন। অফিসারের তাড়ায় জীপে উঠে পড়লেন। উঠেই দেখতে পেলেন বড়বাবুকে। আগে থেকেই জীপে উঠে বসে আছেন তিনি।

 

প্রশস্ত অলিন্দ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সৃজ বোঝার চেষ্টা করছিল, তাদের কোথায় আনা হয়েছে। জীপটা একটা লালবাড়ির বিশাল চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকেছে এটা ও দেখেছে। বড়বাবু একটা ঘরের সামনে এসে থামলেন। তারপর ঘরে ঢোকার অনুমতি নিলেন। ভিতর থেকে সম্মতি এল। ঘরে ঢোকার আগে নেম-প্লেটটা চোখে পড়ল সৃজর। কমিশনার অফ পুলিশ। ঠিক তখনই বাসুবাবু ফিসফিসিয়ে বললেন, “কাজ হয়েছে বোধহয়।”

ঘরে ধড়াচুড়ো পরা দু’জন বসে। বড়বাবু পরিচয় করিয়ে দিতে শুরু করেছিলেন, “আমাদের পুলিশ…”

তাঁকে থামিয়ে বাসুবাবু বললেন, “পরিচয় জানি। উনি পুলিশ কমিশনার রায়বাবু। আর ইনি ডেপুটি কমিশনার হুদাসাহেব।”

দুই কমিশনারের মুখেই বিস্ময়। রায়বাবু বিস্ময় লুকিয়ে ফেললেন চটপট। ইশারায় বসতে বললেন। তারপর সরাসরি প্রশ্ন করলেন, “কিরণশঙ্কর রায় ১৬ অগস্ট দোকানপাট খোলা রাখার কথা ঘোষণা করবেন, সেটা আপনারা কী করে জানলেন?”

তিনজনে মুখ তাকাতাকি করছিল। এক লহমাই হবে। মুহূর্তেই সপ্রতিভ বাসুবাবু বলে উঠলেন, “আমরা আরও অনেক কিছু জানি।”

“কী জানেন?”

“কলকাতার বুকে কী হতে চলেছে।”

“কী হতে চলেছে?”

“ভয়ানক রক্তপাত। প্রাণহানি।”

থমকে গেলেন কমিশনার। কিন্তু উত্তেজিত হয়ে পড়লেন হুদাসাহেব। রায়বাবুর সম্মতি নিয়ে এবার প্রশ্ন শুরু করলেন ডেপুটি কমিশনার, “কী করে জানলেন?”

“সেটা বললে আপনারা বিশ্বাস করবেন না।”

“বলেই দেখুন না।”

“পরিচয় দেওয়ার আগে আমরা ১৬ অগস্ট পুলিশ প্রশাসনের স্ট্র্যাটেজি নিয়ে বলি। তাহলে হয়তো একটু বিশ্বাস অর্জন হতে পারে। ওইদিন জেলায় জেলায় মিছিল বের করবে শাসক দল মুসলিম লিগ। অক্টারলনি মনুমেন্টের পাশে হবে বিশাল জমায়েত। বক্তৃতা করবেন খাজা নিজামুদ্দিন সাহেব এবং অনারেবল চিফ মিনিস্টার সুরাবর্দি সাহেব। ওই জমায়েতের পরে কলকাতার যা চেহারা হবে তা ঠেকানো আপনাদের সাধ্য হবে না। অবশ্য ঠেকানোর চেষ্টা করা হবে কি না সে বিষয়েই যথেষ্ট সন্দেহ।”

“কী, বলতে চাইছেন কী আপনি? কলকাতা পুলিশের কর্মদক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন? জানেন, কলকাতা পুলিশকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে তুলনা করা হয়!”

“প্রশ্ন আমি তুলছি না। ইতিহাস তুলবে।”

“একটু নিজেকে সামলান। জানেন, কার সঙ্গে কথা বলছেন!”

“ডেপুটি কমিশনার হুদা। যিনি ইতিহাসে কলঙ্কিত হবেন, নরহত্যা ইচ্ছে করে ঠেকাতে না চাওয়া এক অযোগ্য পুলিশকর্তা হিসাবে।”

দু’জনের তুমুল বিতণ্ডার মাঝে দাঁড়িয়ে পড়লেন কমিশনার রায়বাবু। কড়া গলায় বললেন, “আপনারা ঝগড়া থামান। সমস্যার সমাধান খুঁজুন। আর আপনারা নিজেদের পরিচয় দিন।”

বাসুবাবু বলতে শুরু করলেন, “আমরা অনারেবল ব্রিটিশ প্রাইম মিনিস্টার স্যার ক্লিমেন্ট অ্যাটলির প্রতিনিধি।”

শুনেই হো হো করে হেসে উঠলেন হুদাসাহেব। সৃজকে দেখিয়ে বললেন, “এই কিশোর, ইনিও ব্রিটিশ রাজের প্রতিনিধি? আশ্চর্য! গঙ্গাপারের গুলির দোকান থেকে আসছেন নাকি?”

বাসুবাবু হেসে জবাব দিলেন, “আজ্ঞে, ইনিও ব্রিটিশরাজের প্রতিনিধি। ইনি হচ্ছেন পরবর্তী ইংলন্ডেশ্বরীর খাস খানসামার ছেলে। আপনারা তো কাজের ছোটোবড়ো ভাগ করেন। কিন্তু সভ্য সমাজে সেসব হয় না। ইতিহাস ঘেঁটে দেখুন, রাজপরিবারে সহিস, খানসামাদের কীরকম প্রভাব। আমাদের পাঠানো হয়েছে আপনাদের চক্রান্ত ফাঁস করতে। আর একে পাঠানো হয়েছে কলকাতায় রেস্তোরাঁ খোলার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে। সব কলোনিতেই এখন স্বাধীনতার লড়াই চলছে। ব্রিটিশ-সূর্য অস্তমিত হতে পারে ভেবে রাজপরিবার সময় থাকতে থাকতে বিভিন্ন উপনিবেশে বকলমে নানা ব্যাবসা ফেঁদে আয়ের পথ প্রশস্ত করতে চাইছেন।”

কথা বলতে বলতে বাসুবাবু হঠাৎ রায়বাবুর দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন, “কমিশনার সাহেব, মাফ করবেন। পরিচয় দিতে গেলে কথায় কথা বাড়বে। সময় বড়োই কম। আপনি যদি ময়দানে নামা আমাদের বাহনটিকে পরীক্ষা করেন তাহলেই আমাদের দাবি প্রমাণিত হবে। আপনি মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের সাহায্য নিয়ে যাচাই করে দেখুন, এই উড়ানযন্ত্র ভারতীয় সেনাবাহিনীর আছে কি না। আমাদের না হয় ততক্ষণে ফাটকেই পুরে রাখুন। আরেকটা অনুরোধ, আমাদের দাবি যদি সত্য প্রমাণিত হয় তাহলে আর দেরি না করে চিফ মিনিস্টার এবং বিরোধী দলনেতার সঙ্গে আমাদের দেখা করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। ভেরি আর্জেন্ট এবং কনফিডেনশিয়াল।”

 ছয়

 “আপনাদের উদ্দেশ্যটা কী? পুলিশের কাজ না থাকতে পারে, আমাদের আছে। প্রলাপ শোনাতে তিন পাগলকে ধরে এনেছেন?” কমিশনারকে জোর ধমক দেন সুরাবর্দি সাহেব।

রায়বাবু উত্তর দেন, “পাগলের প্রলাপ বলে মনে হচ্ছে না, স্যার। এঁদের খবরের নেটওয়ার্ক সাংঘাতিক। আমরা প্রমাণ পেয়েছি। কিরণবাবু কী ঘোষণা করতে চলেছেন সেটা আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন এঁরা। ওঁদের যন্ত্রটাও অত্যাধুনিক। মিলিটারি সূত্রে পাওয়া খবর, যে প্রযুক্তি এবং উপকরণ ওই উড়ানযন্ত্রে ব্যবহৃত হয়েছে তা এখনও বিশ্বের অজানা।”

কমিশনার থামতেই কিরণবাবু চিৎকার করে উঠলেন, “পুলিশ আর প্রশাসন মিলে যতই নাটক সাজান, ডাইরেক্ট অ্যাকশন আমরা রুখবই।”

“এত রোখ ভালো নয়, কিরণবাবু। রোখারুখির থেকে শান্তির পথ ভালো। খারাপ কিছু ঘটলে আপনারাও দায় এড়াতে পারবেন না।” কথার মাঝে ঢুকে পড়েন বাসুবাবু।

কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিরণবাবু। তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বাসুবাবু উত্তেজিত স্বরে বলতে লাগলেন, “রাজনীতিক-প্রশাসন-পুলিশ ওইদিন কে কোন ভূমিকায় থাকবে তা আমাদের নখদর্পণে। শুধু তাই নয়, সকলে মিলে যে অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি করেছেন তার ফলে বিভিন্ন এলাকায় কী আয়োজন চলছে তার প্রমাণও আমাদের কাছে রয়েছে। সেটা দিলেই বোধহয় অনারেবল চিফ মিনিস্টার এবং আপনার বিশ্বাসযোগ্য হবে। আপনারা গোপাল পাঁঠাকে তুলে আনার ব্যবস্থা করুন। বউবাজারের মলঙ্গা লেনের বাড়িতে না হলে কলেজ স্ট্রিটে ওঁর মাংসের দোকানে পাবেন। আর বিডন স্ট্রিট থেকে তুলে আনুন গুণ্ডা বসন্তকে। আমরা অপেক্ষা করছি।”

হুদাসাহেব উঠে গিয়ে সুরাবর্দির কানে কানে কিছু একটা বলার চেষ্টা করেন। বাসুবাবু সেদিকে তাকিয়ে বলেন, “আমরা যদি দিন চারেকের মধ্যে না ফিরি, তাহলে ইংল্যান্ড থেকে ফোর্ট উইলিয়ামে একটি বার্তা আসবে। বাকিটা আপনারা বুঝে নেবেন।”

বাসুবাবুর আত্মবিশ্বাসে স্তব্ধ হয়ে যায় ঘর। সকলেই সকলের দিকে আড়চোখে তাকাতে থাকেন। সুরাবর্দি সাহেব নিস্তেজ গলায় বলেন, “গোপালকে তুলে আনুন।”

 সাত

বসন্তের চেহারা দেখে তো সৃজ অবাক। মাংসপেশিগুলো গুলি গুলি হয়ে দেহে ফুটে রয়েছে। গোপালবাবুর চেহারাও ভালো। মুখভরা গোঁফ-দাড়ি। সুরাবর্দিসাহেব প্রশ্ন করেন, “গোপালবাবু যে! শ্যামাবাবুর তবিয়ত ভালো তো? গুস্তাকি মাফ গোপালবাবু, এত লাঠি-তলোয়ার নিয়ে করবেনটা কী?”

“আত্মরক্ষা, স্যার। আপনারা যা শুরু করেছেন, জান-মাল বাঁচাতে আমাদেরও তৈরি থাকতে হচ্ছে।”

“কী শুরু করেছি? জরা বাতাইয়ে হুজুর!”

“এখন শোনাশুনির সময় নয়। কাজের সময়।” বাসুবাবু বাধা দেন।

সুরাবর্দিসাহেবও সামলে নেন নিজেকে। বলেন, “বলুন জনাব, কী করণীয়। আপনাদের তো দেখি সবই জানা।”

বাসুবাবু মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করার ইশারা করেন। তারপর বলেন, “এখানে একটা কথাও নয়। দেওয়ালেরও কান আছে। আপনি আর কিরণবাবু আমাদের উড়ানযন্ত্রে চলুন। ওখানে কেউ চরবৃত্তি করতে পারবেন না।”

চিফ মিনিস্টার জানতে চান, “কমিশনারসাহেব আমাদের সঙ্গে যাবেন না?”

বাসুবাবু মাথা নেড়ে ‘না’ বলেন। উনি দুই কমিশনারদের কাজের লম্বা ফিরিস্তি দেন। হুদাসাহেব নিজে গিয়ে নিজামুদ্দিনসাহেবের সঙ্গে কথা বলবেন। উনি যেন এলাকার সব নেতাদের কাছে বার্তা পৌঁছে দেন, ১৬ অগস্ট কোনও প্রসেশন বেরোবে না। জমায়েত স্থগিত রাখা হচ্ছে। আর এই বার্তাটা রেডিওর রাতের নিউজ বুলেটিনেও প্রচার করা হবে। পরদিন সকালে প্রতি ঘণ্টার বুলেটিনে তা প্রচার করা হবে। বার্তা যাতে প্রচার হয় তা দেখবেন হুদাসাহেব। রায়বাবু উত্তেজনাপ্রবণ এলাকায় কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবেন।

কথা শেষ করে দম নেন বাসুবাবু। তারপর আবার বলেন, “১৬ অগস্টের রাতের আগে গোপাল আর বসন্তকে ছাড়া যাবে না কিছুতেই।”

বাসুবাবু থামতেই সুরাবর্দি আর্জি জানালেন, “দলের কর্তাদের সবকিছু জানানো উচিত নয় কি?”

সম্মতি দিলেন বাসুবাবু। বললেন, “নিশ্চয় জানাবেন। আমাদের মিটিংয়ের পরেই সবকিছু জানিয়ে দেবেন। দলের দিল্লির বড়কর্তাদের জানানোর পরেই হুদাসাহেব রেডিওয় ঘোষণা করার ব্যবস্থা করবেন। তার আগে নিজামুদ্দিন সাহেবের মতামতটাও জেনে যাবেন হুদাসাহেব।”

আট

 বরাহমিহিরের দরজা বন্ধ হওয়ার পরে বাসুবাবু দয়াপ্রকাশের দিকে স্থির চোখে তাকালেন। তারপর প্রশ্ন করলেন, “প্রকাশবাবু, আপনার বরাহমিহির তৈরি তো?”

“একদম। চোট আঘাত সামলে নেওয়া গ্যাছে।”

“তাহলে শুরু করা যাক। সৃজ, তুই আমার কাছে বস।”

বাসুবাবু সবে শুরু করেছিলেন, “তাহলে সাহেবরা, বাইরের লোকের কথা শুনে ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই করে হাঁড়ি আলাদা করার চেষ্টা…” অমনি বরাহমিহির উড়তে শুরু করল। সুরাবর্দি আর কিরণবাবু চিৎকার করে উঠলেন। বাসুবাবু সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন, “উত্তেজিত হবেন না সাহেবরা। আপনারা কী করতে চাইছিলেন তার কিছু নথি আপনাদের চাক্ষুষ করিয়ে আনি। সৃজ, তোর মাধ্যমিকের ইতিহাস বইটা হাতের কাছে পাওয়া যাবে তো?”

কাণ্ডকারখানায় অবাক হয়ে গিয়েছিল সৃজ। হঠাৎ প্রশ্নে ভড়কে গিয়েও সামলে নিয়ে ঘাড় নাড়ে। ও ঘাড় নাড়তেই সুরাবর্দি চিৎকার শুরু করেন, “ইংল্যান্ডে নিয়ে যাচ্ছেন নাকি? না না, আমি টাওয়ার অফ লন্ডনের বন্দি থাকতে চাই না।”

তাঁর দেখাদেখি কিরণবাবুরও চিৎকার করতে ইচ্ছে করে।

চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যেই উপস্থিত হন দয়াপ্রকাশ। হাতে দুটো জলের গ্লাস ধরা। সে দুটো এগিয়ে দিয়ে দয়াপ্রকাশ বলেন, “হুজুরেরা উত্তেজিত হবেন না। গলা ভেজান।”

চিৎকার করে গলা শুকিয়ে গিয়েছিল বোধহয়। দুই হুজুরই জল খেয়ে নেন। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ। দু’জনে মাথা নিচু করে বসে থাকেন। হঠাৎই সুরাবর্দিসাহেব গেয়ে ওঠেন, “বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু…”

তাঁকে শেষ করতে দেন না কিরণবাবু। তিনিও গেয়ে ওঠেন, “সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে…”

সৃজ আর বাসুবাবু দয়াপ্রকাশের দিকে তাকান। উনি মিটিমিটি হেসে বলেন, “তিনুবধৌষধি। সকালে তিনুকে হঠাৎ গান গাইতে দেখেছিলি বললি না? ওকেই খাইয়েছিলাম। এই ওষুধটা খেলে মনটা নরম হয়ে যায়।”

ততক্ষণে অতিথি দু’জনে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ করে কাঁদছেন।

 নয়

ভয়ে-ভয়েই ঘরে ঢুকল সৃজ। সামনে পরীক্ষা। ক’দিন পরে ঘরে ঢুকল কে জানে। বকাঝকা শুরু হবে না তো? সঙ্গে বড়ো বড়ো লোকেরা আছেন। বকাঝকার হাত থেকে বাঁচতে সুরাবর্দি আর কিরণবাবুকে ওদের বসার ঘরে বসিয়ে রেখেছে।

দয়াপ্রকাশ আর বাসুবাবুকে নিয়ে বাড়ির লোকের সঙ্গে দেখা করতে গেল সৃজ। ওদের বাড়িতেই অতীতের দুটো লোককে রাখার ব্যবস্থা করা হবে। পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। বাড়ির সবাই টিভির ঘরে বসে। ওকে দেখলেও কেউ কিছু বলল না। সৃজ নিজেই উদ্যোগী হল। মা আর জেঠিমাকে জানাল, বাড়িতে অতিথি এসেছেন। কিন্তু সকলেই কেমন যেন সিঁটিয়ে রইল। কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না।

বাসুবাবু কিছু হয়েছে কি না জানতে চাইলেন। জেঠু বললেন, “কী হয়নি সেটা বলুন, বাসুবাবু। সর্বনাশটা কোথায় হয়েছে, কীভাবে হয়েছে সেটাই তো বুঝে উঠতে পারছি না। টিভিতে নানা পরস্পরবিরোধী খবর। এই দেখাল, পাকিস্তান-বাংলাদেশ সীমান্ত বলে কিছু নেই। বি.এস.এফ জওয়ানেরা সকাল হতে হঠাৎ দেখেন, কোনও কাঁটাতার নেই। সীমান্ত জুড়ে শুধু মানুষ আর মানুষ। তারা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে। চব্বিশ পরগনা, শিয়ালদহের বহু লোকালয় রাতারাতি ফাঁকা। নোয়াখালি, বরিশাল-সহ একাধিক এলাকায় হঠাৎ লোক গিজগিজ করছে। তারপরেই খবর এল, গাঁধী-নেহরু পরিবার জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকতে চান না। খবরের কাগজের ব্যাবসা করতে চান।”

সৃজর দাদা সিনেমার ভক্ত। ও বলল, “পাকিস্তানের পেশোয়ারে কিসসাখোয়ানি নামে একটা বাজার আছে। সেই বাজারে বসে ইউসুফ খান নামে এক বৃদ্ধ দাবি করছেন, বলিউডের বিগত দিনের তারকা সায়রাবানু তাঁর স্ত্রী। বৃদ্ধ পুরো দিলীপকুমারের মতো দেখতে।”

সৃজর বাবা বললেন, “লালকৃষ্ণ আদবাণী সিন্ধুপ্রদেশে চলে যেতে চান। ওটাই তাঁর জন্মভূমি। সিন্ধুকে ভুলতে পারছেন না তিনি।”

বাসুবাবু আর দয়াপ্রকাশ পরস্পরের দিকে তাকালেন। ততক্ষণে সৃজর জেঠু আবার বলতে শুরু করেছেন, “সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হল, রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের প্রতি দোষারোপের খেলা শুরু করেছে। বামেরা বলছে, তারা তো আগেই বলেছিল, ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়। গেরুয়া বাহিনীর দাবি, হিন্দুস্তানই একমাত্র সত্য-শাশ্বত। তারা কম্বোডিয়া-আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ জুড়ে বৃহত্তর হিন্দুস্তান গড়ে তুলবে। এদিকে আঞ্চলিক এবং সেকুলার দলগুলোও সংখ্যালঘু তাস খেলতে শুরু করেছে। তারা সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে আলাদা প্রশাসন গড়ার ডাক দিয়েছে। বেশ কয়েক জায়গায় বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের খবরও এসেছে। তারপরই রেডিও-টিভি-ইন্টারনেট পরিষেবা ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। কোথায় যে কী ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছি না।”

জেঠু থামতেই বাসুবাবু চিৎকার করে উঠলেন, “সৃজ, শিগগির তোর ইতিহাস বইটা নিয়ে আয়।”

সৃজ দৌড়ে গেল আর এল। বাসুবাবু ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ অধ্যায়টা খুলেই চমকে উঠলেন। পুরো অধ্যায়টা সাদা। কোনও ছাপার অক্ষর নেই। উনি সৃজর কাছে জানতে চাইলেন, বইটা আগেই এরকম ছিল কি না। সৃজ ‘না’ বলতেই বাসুবাবু চিৎকার করে উঠলেন, “প্রকাশবাবু, শিগগির চলুন। বরাহমিহির…”

 দশ

 “আমাদের নিয়ে খেলা করছেন নাকি?” বরাহমিহিরে বসে ঘ্যান ঘ্যান করছিলেন সুরাবর্দি আর কিরণবাবু। তাঁদের দাবি, রাত হয়ে গিয়েছে বলে ঠিক ঠাহর করতে পারছেন না। কিন্তু তাঁদের সন্দেহ, ইংল্যান্ড নয়, ওঁদের বাংলারই কোনও গ্রামে এনে ফেলা হয়েছে। ওঁদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে।

বাসুবাবু ম্লান হেসে বললেন, “আর প্রতারণা! মানুষের সঙ্গে যা প্রতারণা আপনারা করেছেন তার দায় মেটাতেই…”

কথা শেষ হল না। বরাহমিহির নামতে শুরু করল। দয়াপ্রকাশ চেঁচিয়ে বললেন, “পুরনো ব্যথা।”

উড়ানযন্ত্রটি নামল একটা আলোকজ্জ্বল স্টেডিয়ামের অন্ধকার কোণে। মাঠে খেলা চলছে। দয়াপ্রকাশ দুটো গোল গোল কাচ চোখের সামনে ধরে বললেন, “ক্রিকেট খেলা হচ্ছে।”

সৃজ কাচদুটো নিয়ে মাঠের দিকে তাকিয়েই চিৎকার করে উঠল, “এ যে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ হচ্ছে! ১৯৯২ ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ওই দেখুন, জাভেদ মিয়াদাদ ব্যাঙের মতো লাফিয়ে কিরণ মোরেকে ভেঙাচ্ছে।”

বাসুবাবু হতাশ গলায় বললেন, “এখন কী হবে!”

সুরাবর্দি আর কিরণবাবু একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠে বললেন, “কী হবে মানে?”

অলঙ্করণঃ শিমুল

জয়ঢাকের গল্পঘর

11 thoughts on “গল্প একটি অনৈতিহাসিক সার্জিকাল স্ট্রাইক দীপক দাস শরৎ ২০১৯

  1. খাসা লেখা। গরম রসগোল্লার মতই লোভনীয়। পাতে পড়লেই শেষ করে ফেলতে হয়।

    Like

  2. গল্পের অলংকরণ শিল্পী শিমূলকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ছবিটি খুব সুন্দর। আমাকে এক গুণী পাঠক জানিয়েছেন।

    Like

  3. আরেকটু চলতে পারত। কেমন করে হঠাৎ শেষ হয়ে গেলো।

    Like

    1. আর চালানোর উপায় ছিল না। ইতিহাসের ওপরে কারও হাত নেই যে। কী ভাবে তা বদলানো যাবে? ভেবে পাইনি। একটা ইঙ্গিত দিয়েছি। এরকম হলে আজকের ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক সমস্যার সমাধান হত।

      Like

  4. আর চালানোর উপায় ছিল না। ইতিহাসের ওপরে কারও হাত নেই যে। কী ভাবে তা বদলানো যাবে? ভেবে পাইনি। একটা ইঙ্গিত দিয়েছি। এরকম হলে আজকের ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক সমস্যার সমাধান হত।

    Like

Leave a Reply to সুদীপ Cancel reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s