গল্প এক যে ছিল দত্যি মালিনী মুখার্জি বসন্ত ২০২০

এক যে ছিল দত্যি। দত্যি কি আর? লম্বা বড়সড় চেহারা। গায়ে ভীষণ জোর। মাথায় ঝাঁকড়া বড়ো বড়ো চুল। দাঁতগুলো একটু বড়ো বড়ো। তবে হাসলে ভারি সুন্দর। জামাকাপড়ের ছিরিছাঁদ নেই। নখ কাটে না। গায়ে মাটি মাখা।

তার ছিল এক বাগান। ভারি সাধের বাগান, বুঝলে! (ব্যস! অমনি তোমরা বলছ, ওওও, এই গল্প! এ তো অনেকবার শুনেছি। তাহলে আর কী? সময় নষ্ট কোরো না। বোকাসোকা কেউ যদি থাকো, যে পড়নি বা যার একই গল্প বারবার পড়তে ভালো লাগে, সে পড়বে আশা করি।)

সেই বাগানেই সে থাকত, খেত, শুত। তাই গা-ময় পাতা-কুটো-মাটি এসব লেগেই থাকত।

ভারি যত্নের সে বাগান। বড়ো বড়ো গাছের ছায়ায় ছোটো ছোটো গুল্ম-লতা গলা জড়াজড়ি করে বড়ো হচ্ছে। চারাগাছেদের ছায়া দিচ্ছে মা গাছেরা। পুকুরে মাছেরা শালুক-শাপলার সাথে খেলা করছে। বট-অশ্বত্থর গা জড়িয়ে উঠেছে ঝুমকো লতারা। গাছভরা আতা, সফেদা, জামরুল, কাঁঠাল, লিচু। বাগানভরা উচ্ছে, বেগুন, আলু, কুমড়ো, শাকপাতা। বেড়ার গায়ে জুঁই, মাধবীলতা, নীলমণিলতা, অপরাজিতা। বেড়ার গা ঘেঁষে বেলি, আকন্দ, কুসুন্ডা, পুটুস ফুলের বাহার। বাগানময় কাঞ্চন, শিউলি, কামিনী, পলাশ, বকুল। কারও অনাদর নেই, কারও অযত্ন নেই।

আর আছে সবুজ শুঁয়োপোকা, ঘাসফড়িং, লাল-কালো গুটিপোকা, হলুদ-কালো মৌমাছি, কত্ত কত্ত রঙের প্রজাপতি…

আর বসন্তবৌরি, ফিঙে, বেনেবউ, ঘুঘু, ফটিকজল, টিয়া, কোকিল… সবার কি আর নাম জানি ছাই! শুধু জানি তারা সেই বাগানেই থাকে, খায় দায় গান গায় তাইরে নাইরে না।

রোজ সকালে শুরু হয় মহাযজ্ঞ। দত্যি ইয়া বড়ো বড়ো গামলা ঘাড়ে করে পুকুর থেকে জল তুলে সব গাছে দেয়। এমনকি আগাছাদেরও দেয়। কে জানে বাবা কোন গাছ কার কোন কাজে লাগে। নিড়ানি দিয়ে মাটিও কুপিয়ে দেয়। সার দেয়। শুকনো পাতা কুড়িয়ে এনে বিছিয়ে দেয় মাটির ওপর, যাতে মাটি না শুকিয়ে যায় তাড়াতাড়ি। যেই ফল পেকে টইটম্বুর, নিজের জন্য তুলে নেয় দুয়েকটা। বাকি রেখে দেয় পাখিদের জন্য। কিছু সবজিও তোলে। ফল-সবজির বীজ কিচ্ছুটি ফেলে দেয় না। এনে পুঁতে দেয় বাগানেই। সেখানে আবার গাছ হয়। কোনও গাছ অকালে মরে গেলে তার পাশে বসে হাউ হাউ করে কাঁদে। তারপর সেটা তুলে নিয়ে গর্ত খুঁড়ে মাটির নিচে শুইয়ে দেয়। বলে, ‘আবার আসিস কিন্তু আমার বাগানে।’ তারা আবার ফিরে আসে দত্যির টানে।

ঝড়-বাদলায় গাছেদের সাথে সেও নাচে। নাচ কি আর বলে তাকে? ধাঁই-ধপা-ধপ-ধিনতা করে দাপাদাপি। মাঝে মাঝে গাছেদের গানও শোনায়। গাছেরা নেহাত কানে হাত দিতে পারে না, তাই সহ্য করে নেয়। কিন্তু ভালোবাসার ভাষা বোঝে তারা। তাই তরতর করে বেড়ে ওঠে।

সারাবছর দত্যি বাগানেই শোয়, ছোট্ট একটা কুঁড়ে যদিও আছে তার বাগান ঘেঁষে। শীতের সময় মনের দুঃখে ঘরে শুতে যায়। সারারাত এপাশ ওপাশ করে, এই বুঝি বাঁধাকপির কচি চারাগুলোর ঠাণ্ডায় মরে গেল… এই বুঝি সদ্য লাগানো চন্দ্রমল্লিকারা ঘাড় কাত করে শুয়ে পড়ল। তাই ভোর না হতেই দৌড়ে যায় বাগানে। সব্বাই ঠিকঠাক আছে দেখলে বাগানেই শুয়ে থাকে ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে।

এমনি করেই দিব্যি যাচ্ছিল দিন।

কিন্তু দিব্যি গেলেই তো আর হল না। গল্প থাকতে হবে তো, নাকি!

বসন্তের এক সকালে দত্যি চোখ-টোখ কচলে দেখল আজ একটু দেরিই হয়ে গেছে উঠতে। গামলায় জল ভরে পুবদিকের বাগানে জল দিতে এসে ‘হায় হায় হায়’ বলে চিৎকার করে ধড়াস করে আছড়ে পড়ল।

হয়েছে কী, দত্যি নিজের বাগানে সেরকম কোনও দেওয়াল বা বেড়া দেয়নি। গাছ-ঝোপঝাড়েই ঘেরা দেওয়া। বেড়ার দরকারও নেই। দত্যির বাগানের আশেপাশে যারা থাকে, তারা দত্যিকে যারপরনাই ভয় পায়। তারা সব ভদ্র-সভ্য-পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, দত্যিকে দূর থেকে দেখেছে তারা। ছেলেমেয়েদের বলেছে, ‘যাসনি ওই বাগানে। দত্যিটা তোদের কচমচ করে চানাচুরের মতো খেয়ে নেবে।’ ফল-পাকুড়-সবজি থাকতে দত্যি ছোটো ছোটো বাচ্চা খাবে কোন সুখে? এসব তারা ভেবেও দেখেনি। দত্যি জানে যে সবাই তাকে ভয় পায়। ভালোই তো। তার বাগানে কেউ উঁকিও দেবে না।

কিন্তু আজ এ কী বিপত্তি! পুবদিকের কমলা-লাল-হলুদ পুটুস গাছ মাড়িয়ে, ভেঙে কারা যেন ঢুকে পড়েছে ঠিক। তারপর পুবদিকের বাগানের ওপর দিয়ে যেন ঝড় বয়ে গেছে। ভুল বললাম। ঝড়ে ভেঙে যায়, পড়ে যায়, ঝরে যায়, কিন্তু দত্যি দেখল তার বাগানের ফুলের আধ ফোঁটা কুঁড়িগুলো কে মুচড়ে তুলেছে, পা দিয়ে মাড়িয়ে দিয়েছে ছোটো নয়নতারা, বেলি, গাজর, ফুলকপি। এক কামড় খেয়ে ছড়িয়ে ফেলেছে কুল, কমলালেবু, ডালিম।

অনেকক্ষণ হাত-পা ছড়িয়ে দত্যি বসে থাকল বাগানে। ফোঁৎ ফোঁৎ করে কাঁদল। এইসব গাছপালা তার আত্মীয়পরিজন। এত এত আপনজন হারিয়ে সে কী করবে, কাঁদবে না?

তারপর উঠে তার প্রিয় গাছেদের কাছে গেল। যাদের পরিচর্যা করা যায়, তাদের আবার মাটি শক্ত করে, ভাঙা ডাল দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল। যারা আর বাঁচবে না, তাদের জন্য খুব খানিক কেঁদেকেটে, তারপর দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “দেখছি, দাঁড়া। যারা এই অবস্থা করেছে তোদের, তাদের আমি… তাদের আমি…”
কী শাস্তি দিলে তাদের শায়েস্তা করা হয়, দত্যি সেটা ভেবে পেল না।

কারা করল এই কাণ্ড? কোন পাষণ্ড? কীভাবে ধরবে তাদের?

এখন হয়েছে কী, দত্যি নিজের মনে থাকে, ছোটো ছেলেমেয়েদের খায় না, এমনকি ভয়ও দেখায় না—এসব দেখেশুনে সেই সভ্য ভদ্র মা-বাবারাও বাচ্চাদের আর তেমন করে বাধা দেয় না। এমনি তাদের বাচ্চারাও তো সভ্য ভদ্রই। নাদুসনুদুস চেহারা, পাটি পাতা চুল, দামি দামি জামা, আর দাঁতে পোকা। তারা লাফালাফি করে খেলে না। সারাদিন ঘরে বসে পড়ার বই পড়ে, খায়, আর ঘুমায়। নক্কি ছেলেমেয়ে। খুব ভোরে উঠে তারা পাঠশালায় যায়। দত্যির বাগান পড়ে সেই রাস্তাতেই। তারা বাইরে থেকে দেখতে দেখতে যায়। মাঝে মাঝে গাছের ডাল বাগানের বাইরে ঝোলে, সেখানে জামরুল বা কামরাঙা ধরে থাকলেও বাচ্চারা ঢিল মেরে পেড়ে খায় না। মায়েরা বলেছে, ‘দত্যি বাচ্চাদের হাড়ের সুরুয়া না খেয়ে ঘুমোতে যায় না।’ তাই তারা দূর থেকে এক ছুটে রাস্তাটুকু পার হয়।

কিন্তু তারই ভেতর দুয়েকজন, যাদের চুলগুলো খাড়া খাড়া, দাঁতে দুটো বেশি পোকা, তারা বীরত্ব দেখিয়ে ধীরে ধীরে যায়, আড়চোখে বাগানের দিকে নজর রেখে। কই, কিছু তো হল না!

আরও কিছুদিন পরে বাইরে ঝুলে থাকা ডাল থেকে ঝাঁপ দিয়ে আঁশফল ভেঙে নেয়। কী সোয়াদ গো! কই, কেউ তো ধরল না!

এইরকম করে ধীরে ধীরে তাদের সাহস বাড়ে। দুয়েকজন আরও বন্ধু জোটায়। বাগানের ওধারে উঁকিঝুঁকি মারে। কই, কেউ তো তেড়ে আসছে না!

ব্যস। একদিন সবাই মিলে এদিক সেদিক দেখে, বাগানের পুবদিকের বেড়া ডিঙিয়ে, মাড়িয়ে ঢুকে পড়ে। আর ঢুকেই অবাক। এ কী বাগান গো! চারদিকে থরে থরে পেয়ারা, লেবু, কুল, সফেদা ঝুলছে। গাছের ডাল ভেঙে পড়ছে ফলের ভারে। সদ্য ফোটা গন্ধরাজের গন্ধে বাগান ম ম। ওই লাল লাল বড়ো বড়ো ফুলটা কী গো? মট মট করে তুলে নেয় দু-চারটে। পেয়ারাগাছে চড়ে পাঁচ জনে মিলে দশ জনের খাওয়ার পেয়ারা পাড়ে। যা খায়, তার থেকেও বেশি ছড়ায়। ঝুলে ঝুলে গাছের ডাল ভাঙে। মাড়িয়ে দিয়ে যায় ছোটো ছোটো গাছের চারাদের। কই, কেউ তো দেখছে না! তারপর লণ্ডভণ্ড করে বেড়া ভেঙে বাইরে দে দৌড়। মিছিমিছি ভয় দেখাত মা-বাবারা। কাল আবার আসব। এবার অন্যদিক দিয়ে। আরও সবাইকে নিয়ে।

যেমন ভাবা তেমন কাজ। পরদিন তারা ঢোকে উত্তরদিকের বেড়া ভেঙে। এবার এদিকের বাগান লণ্ডভণ্ড। তারপর পশ্চিমের।

এদিকে দত্যি ঠায় বসে থাকে বাগানের পুব কোণে। না খেয়ে, না দেয়ে। কিন্তু পরদিন দেখে উত্তরের বাগানে যেন পাগলা হাতির দল ঢুকেছিল। চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে সে ঠিক করে, পরদিন উত্তরের বাগান পাহারা দেবে। একা মানুষ, থুড়ি দত্যি, কতদিক পাহারা দেবে? কিন্তু এ কী! এবার পশ্চিমের বাগানে হামলা।
দত্যি ঠিক করে ফেলে। আর একজায়গায় ওত পেতে থাকবে না। সারা বাগান টহল দেবে। যেমন ভাবা, সেই কাজ।

আর ঠিক পরদিনই দত্যি দূর থেকে দেখতে পায় সেই ছোটো ছেলেমেয়েদের। কী মহানন্দে তারা আমগাছে উঠে ছোটো ছোটো কাঁচা কাঁচা আমগুলো খাচ্ছে আর ছড়াচ্ছে! মট মট করে ভাঙছে গন্ধরাজ ফুল। লাফিয়ে লাফিয়ে জবা ফুল তুলতে গিয়ে গাছগুলোই ভেঙে ফেলছে। রাগে দুঃখে দত্যি দিশেহারার মতো রে রে করতে করতে তেড়ে যায়। দূর থেকে বাচ্চারা দেখে তাদের দিকে তেড়ে আসছে এক ভয়াল আকৃতি—তার চুল উড়ছে হাওয়ায়, ভাঁটার মতো লাল লাল চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, দাঁত খিঁচিয়ে সে তেড়ে আসছে রে রে করে। এইবার নিশ্চয়ই ধরে ধরে মুণ্ডু ছাড়িয়ে সুরুয়া বানিয়ে খাবে। ‘বাবা রে মা রে, খেয়ে ফেললে রে’ বলে তারা বাগান-টাগান আরেকবার মাড়িয়ে দুদ্দাড় করে দৌড় লাগাল। কিন্তু তারা পারবে কেন দত্যির সাথে দৌড়ে? দত্যি তাদের এই ধরে আর কী। ঠিক সে সময়ে দত্যির নজরে পড়ে, তার আদরের ঝুমকো লতাটার দিকে। সেটা মাটিতে পড়ে আছে। সবক’টা ফুল তার ছিঁড়েখুঁড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। দত্যি থমকে যায়। সব ভুলে হায় হায় করতে করতে দৌড়ে যায় তার গাছের দিকে। সেই সু্যোগে বাচ্চারা পগারপার। ‘বাব্বাহ! খুব বাঁচা বেঁচেছি’ ভাবে তারা। বাড়ি গিয়ে বাবা-মাদের কাছে এসব গল্প করে না। কী জানি তারা বকবে নাকি।

বাগানের পরিচর্যা করতে লেগে পড়ে দত্যি। রাগে দুঃখে মনে হয় পাজিগুলোকে দু’ঘা করে দেয়। না না, দু’ঘা নয়, খান তিনেক পিঠে দিলে শান্তি হয়। কিন্তু তাতে কি আর গাছেরা আগের মতো হবে?

দত্যির শুশ্রূষায় গাছেরা আবার আগের মতো সেজে ওঠে। দত্যি এবার সাবধান। ভালো করে বেড়া দিয়েছে বাগানের চারদিকে। রাতে আর ঘরে শোয় না একেবারেই। প্রায়ই টহল দিয়ে বেড়ায়, পাছে কেউ ঢুকে পড়ে অন্যদিক দিয়ে। কিন্তু বেশ কিছুদিন হল সব চুপচাপ। একদিন তাই দত্যি দুপুরে গাছতলায় বসে ভাত-ডাল-পুঁই চচ্চড়ি আর জলপাইয়ের আচার খেয়ে একটু ভাত ঘুম দিচ্ছিল। কাঠঠোকরাটা খট-খটাখট করে সেই গাছে ঠোকরাতে আরম্ভ করায় বিরক্ত হয়ে চোখ খুলেই সে অবাক। কিছু দূরে সবজি বাগানের কাছে একটা বাচ্চা ছেলে ঝুঁকে বসে কী করছে। সব্বোনাশ! কোথা দিয়ে ঢুকল? আর কে কে আছে? কী কী সব্বোনাশ করে ফেলল? দত্যি লাফ দিয়ে উঠে হাঁ হাঁ করে ছুট লাগাল ছেলেটার দিকে। দত্যিকে দেখে ছেলেটা উঠে দাঁড়াল বটে, কিন্তু কী আশ্চর্য, পালাবার কোনও চেষ্টা করল না। ছেলেটার কাছে এসে দত্যিও তাই ভেবে পায় না কী করবে। সে কিছু বলার আগেই ছেলেটা বলল, “কী ব্যাপার? চেঁচাচ্ছ কেন? যেন ঘরে ডাকাত পড়েছে!”

দত্যি কী বলবে ভেবে পায় না। বকাঝকা করার কথা তো তার!

“তুমি এখানে কী করছ? আমার বাগানে ঢুকেছ কেন?” দত্যি যথাসম্ভব দাঁত খিঁচিয়ে বলে।

“তোমার বাগান? যত্ন নাও না কেন গাছপালার, অ্যাঁ?” ছেলেটা বেশ রাগ দেখিয়ে বলে।

“যত্ন নিই না!” দত্যি হাসবে, না কাঁদবে, না রাগবে ভেবে পায় না। “আমি যত্ন নিই না?”

“তাই তো দেখছি। নাহলে এই গাছগুলোয় শুঁয়োপোকা লেগেছে, কই, মনে তো হচ্ছে না কোনও ওষুধ দিয়েছ। বেগুনগুলোয় তো মনে হচ্ছে ছত্রাক হয়েছে। কিছু করেছ তার জন্য? আলুগুলোয় ধ্বসা লেগেছে, সব নষ্ট হয়ে যাবে। জবা গাছটাও তো মরে যাচ্ছে!” ছেলেটার গলায় হাহাকার।

দত্যি ছেলেটার কথা শুনে অবাক। সে ভেবেছিল তাকে দেখে বাচ্চাটা দৌড় লাগাবে, তা না, সে উলটে জ্ঞান দিচ্ছে! তাও আবার বাগানের ব্যাপারে? আর কীসব পোকা, ছত্রাক বলছে—সেসব তো দত্যি জানে না। আর ঠিকই বলছে মনে হয়। এই গাছগুলো কমজোরি, পাতায় ফুটো, আর সাদা সাদা ওই দাগগুলো সে আগেও দেখেছে গাছে। কী করতে হয় তা জানা নেই বলে গাছগুলো মরে যায়।

ছেলেটা তখনও গজগজ করে চলেছে, “বাগান করলেই তো আর হল না। বাগানের যত্ন নিতে হয়। নিজের ছেলেমেয়ের অসুখ হলে পারতে ওষুধ না দিয়ে ফেলে রাখতে?” এইসব বলছে আর সাবধানে গাছপালা বাঁচিয়ে এধার ওধার ঘুরছে, পাতা উলটে দেখছে। কেমন একটা পাকা পাকা ভাব।

দত্যির রাগও হয়, কিন্তু তাও সে এতই অবাক হয়ে গেছে যে কিছু বলতে পারে না।

ছেলেটা রোগাসোগা। পানপাতার মতো মুখে দুটো বড়ো বড়ো চোখ। জামাকাপড় সাধারণ। হাঁটুতে ধুলো। বয়স বারো-তেরো।

“তুমি জানো কী করতে হবে?” আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে দত্যি।

ছেলেটা বলে, “জানব না? এ তো সাধারণ ব্যাপার। এই পাতাগুলো তাড়াতাড়ি ছেঁটে ফেলতে হবে, এগুলোতে একটু ছাই দিতে হবে এখনই। বাড়িতে হলুদ আছে? দাঁড়িয়ে না থেকে একটু নিয়ে এসো না চট করে, জবা গাছগুলোতে ছড়িয়ে দিই। আহ্‌, এখনও দাঁড়িয়ে আছ!”

বকা খেয়ে দত্যি দৌড় লাগায় বাড়ির দিকে। হলুদ আছে। কৌটো নিয়ে আসতে আসতে সে দেখে ছেলেটা বাগানে বসে বসে অসুস্থ পাতাগুলো সাবধানে তুলে ফেলছে আর গাছেদের সাথে কথা বলছে, ঠিক যেরকম সে বলে, ‘চিন্তা করিস না। এবারে ভালো হয়ে যাবি।’

দত্যির মনটা হঠাৎ ভালো হয়ে যায়। সে ভাবত সে ছাড়া গাছপালাদের আর কেউ ভালোবাসে না। ছেলেটা মনে হয় তারই দলের।

সারা বিকেল দত্যি ছেলেটার পেছন পেছন তার কথা শুনে বাগানের অসুস্থ গাছের সেবা করল। কত কিছু জানে ছেলেটা! শুধু বেশি কথা বলে। তা বলুক।

“তুমি এতসব জানলে কী করে?”

“বাগানে কাজ করে করে।”

“বাগান?”

“হ্যাঁ। রাজার বাগানে আমার বাবা কাজ করে। আমিও যাই সাথে সাথে। আমার খুব ভালো লাগে। রাজামশাইও আমাদের সঙ্গে হাত লাগান।”
“বলো কী!” দত্যি অবাক।
“হ্যাঁ গো। নিয়ে যাব তোমায় একদিন, সময় হলে।”
“আমি কী করে যাব? আমি তো দত্যি!”
ছেলেটা নাক কুঁচকে দেখে খানিকক্ষণ দত্যিকে। “অ। তোমায় বুঝি সবাই দত্যি বলে? কিন্তু তোমার আসল নাম কী?”
কতদিন কেউ দত্যিকে তার আসল নাম জিজ্ঞেস করেনি।
“দীতি।” লজ্জা পেয়ে বলে দত্যি।
“বুঝেছি। দীতি থেকে দত্যি? হা হা হা…” ছেলেটা হাসে।
“তোমার নাম কী?”
“আমি? আমি বিশু। বিশ্বনাথ।” গালভরা হাসি ছেলেটার।
“এবার আসি দীতিদিদি।”
“চললে?” দীতির মন ভেঙে যায়। “আবার কবে আসবে?”
“কেন? কালকে! দু-চারটে বন্ধু নিয়ে আসব, কেমন? তোমার বাগান দেখলে তারা অবাক হয়ে যাবে।”
“ওরে বাবা! তারা আমার গাছপালা ভাঙবে না তো?”
“দুর! ভাঙবে কেন? সবাই মিলে একসঙ্গে বাগান করব আমরা, কেমন?”
ছেলেটা একটু পাকা, ভাবে দীতি। তা হোক। মনে মনে হাসে সে।

মূল গল্পঃ The Selfish Giant, Oscar Wilde

আমূল পরিবর্তনঃ মালিনী

ছবিঃ ইমলি বা দীপশিখা, সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রী। ছোটোবেলায় ঘরের দেওয়াল থেকে এখন গল্প-কবিতার ছবি আঁকে। সরল সহজ সুন্দর সেসব ছবি।

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s