ছোট্ট একটা পাখির বাচ্চা কোথা থেকে পড়ল এসে বাগানে ফুলগাছটার নিচে। পাখিটার গায়ে পালক নেই, ঠোঁটটা গোলমতো। পড়ে থাকা পাখির বাচ্চাটাকে দেখেই রুমি হাতে তুলে নিল। ভাবল, এটাকে তুলে নিয়ে যাই, একটু জল খাওয়াই। সকলে এসে দেখল পাখিটাকে। কেউ বলে ময়নার বাচ্চা, কেউ বলে টিয়ার বাচ্চা। একেকজন একেক কথা বলে।
রুমি অত কিছু চিন্তা করছে না। পাখিটা বাঁচবে কি না তারই ঠিক নেই। একটা পালকও নেই ওর গায়ে। চামড়া সার। লালচে ছোট্ট একটা বাচ্চা পাখি। রুমি হাতে তুলে না নিলে কাকেরাই ওকে তুলে খেয়ে নিত।
পাখির বাচ্চাটাকে একটা রুমাল দিয়ে জড়িয়ে একটু জল খাওয়াল রুমি। তারপর মায়ের মতন যত্ন করে ঘরের এককোণে একটুকরো কাপড়ের উপরে ওকে শুইয়ে দিল। রুমির ছোট্ট দুই ভাই আর বোন সবসময় বাচ্চা পাখিটাকে পাহারা দেয়, খেতে দেয়। বেশ কয়েকদিন এইভাবে থাকার পর রুমি মাকে ডেকে বলল, “দেখো মা, আওয়াজ শুনলেই পাখির বাচ্চাটা কেমন চোখ ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে।”
ঠিক তাই। মা দেখলেন, কিছু দানা বা ফলের টুকরো খেতে দিয়ে ‘খা খা’ বললেই ছোটো পাখির বাচ্চাটা খাবারের দিকে এক পা এক পা করে এগিয়ে যায়। মা বললেন, “এত ছোট্ট পাখি! ওর মা মুখে করে নিয়ে যাচ্ছিল নিশ্চয়ই, মুখ থেকে বোধহয় পড়ে গেছে বাগানে। আহা, ওর কত লেগেছে! এতদিনে একটু চলতে পারছে বাচ্চা পাখিটা।”
দিনে দিনে রুমি দেখল পাখিটা ওদের সবকথা বুঝতে পারছে। সবকথা মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শোনে। ‘আয় আয়’ বললে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসে। ওর এমন সুন্দর আচরণ দেখে রুমির কী আনন্দ! ওকে ডাকলে চোখ মেলে ঠোঁট দিয়ে টকটক করে আওয়াজ করে। সুন্দর ছোট্ট পাখিটার এমন আচরণ রুমি আর ওর ভাইবোন দেখে আর সারাটা দিন ওর পিছনে পড়ে থাকে। যত্ন করে খাওয়ায়, গায়ে কিছু একটা চাপা দিয়ে শুইয়ে দেয়।
বেশ কিছুদিন পরে রুমি একদিন দেখল, রুমালে তলায় পাখিটা নেই। “মা মা, আমার পাখিটা কোথায় গেল!” বলে কাঁদতে থাকল। একটু পরেই রুমির ছোট্ট ভাইটা মেঝে থেকে পাখিটাকে তুলে এনে বলে, “এই নে দিদি, তোর পাখি। ও হেঁটে হেঁটে চলে গিয়েছিল আলমারির তলাতে।”
রুমি পাখির বাচ্চাটাকে হাতে নিয়ে কত আদর করতে লাগল। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “ও সোনা, তুমি হাঁটতে শিখেছ! তোমার মার কাছে যাবে? কিন্তু তুমি উড়ে চলে গেলে আমরা তো কাঁদব তোমার জন্য।”
রুমির কথাগুলো পাখিটা শোনে। তারপর ওর দিকে চেয়ে গোল গোল ঠোঁট দুটো ফাঁক করে টকটক করে কীসব আওয়াজ করে। মা এসে একটা লাল রুমাল জড়িয়ে দিয়ে বললেন, “এবার হারিয়ে গেলে ওকে তাড়াতাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে।”
লাল রুমালটা ওর গায়ে কী যে সুন্দর লাগছিল! এরপর রুমির মা উল দিয়ে পাখিটার মাপে একটা খোলস করে দিলেন। হলুদ খোলস, মনে হচ্ছিল হলুদ পাখি।
কিন্তু পাখিদের স্বভাব। একটু বড়ো হতে না হতেই ডানা মেলতে চায়। বাচ্চা পাখি, ওর ডানা এখনও শক্ত হয়নি। তাই পা দিয়ে হেঁটে হেঁটে বারান্দার খোলা জায়গায় গেলেই চড়াই-শালিক এরা কিচিরমিচির করে ওকে ডাকে। কিন্তু ও তো উড়তে পারে না। তাই বাগানে যেতে পারে না। কিন্তু ওকে অন্য পাখিরা দেখতে পেলেই কিচিরমিচির আওয়াজ করে, মাটিতে নেমে আসে। ওকে চিনতে পারে না। ওটা কি পাখির বাচ্চা? তখনই রুমির পোষা বাচ্চা পাখিটা ডানা ঝাপটাতে থাকে আর ঠোঁট ফাঁক করে কু-কু মি-মি বলে ডাকতে থাকে। ও তো উড়তে পারছে না, তবে চেষ্টা করে চলেছে।
কিছুদিন পরে হঠাৎ একদিন রুমির পাখিটা এমনভাবে চেঁচাল যে সকলে অবাক হয়ে ছুটে এল। দেখল, বাগানে কয়েকটা রঙিন পাখি এসে কিচমিচ করে ওকে কীসব বলছে। আর রুমির খোলস পরা পাখিটা রুমিকে ডাকছে ‘রুমি রু-মি এ-সো এ-সো’।
সবাই অবাক। এ কী রে! পাখিটা তো কথা বলছে! তাহলে ও কি কথাবলা পাখি?
“ও কি কথা বলতে পারবে, মা?” রুমি জিজ্ঞাসা করে।
রুমির মা বললেন, “এটা তবে কাকাতুয়ার বাচ্চা নাকি?”
এরপর যখনই রুমিকে বলেন, ‘রুমি পড়তে বসো। পাখি রেখে দাও।’ অমনি পাখিটাও বলতে থাকে, ‘রু-মি রু-মি ব-সো ব-সো।’
পাখিটার মুখে অমন কথা শুনে রুমির মা রুমিকে বললেন, “ওর হলুদ খোলসটা এবার ছাড়িয়ে দিই।”
তাই হল। ছোট্ট পাখিটার খোলসটা যেই ছাড়িয়ে দেওয়া হল, খোলস ছাড়ানোর পর দেখা গেল, পাখিটার গায়ে অল্প অল্প সাদা পালক বেরিয়েছে। এবার রুমির মা পাখিটাকে একটা সাদা খোলস পরিয়ে দিলেন।
পরদিন রুমির পোষা পাখিটা বাগানে গাছের তলায় বসে ছিল। রুমি দেখল, কতকগুলো ময়না আর একটা কাকাতুয়া এসে ওর পাশে বসেছে। পাখিটাকে কী যেন বলছে, ‘চলো চলো, আমার সঙ্গে চলো।’
বিকেলে পাখিটাকে ঘরে এনে রাখল রুমি। পাখিটা এবার রুমিকে বলতে লাগল, ‘রুমি, রুমি, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি মার কাছে যাব। আমি কাকাতুয়া।’
রুমি প্রথমে ওর কথা বুঝতে পারেনি। পরে রুমির মা রুমিকে বললেন, “হ্যাঁ, ওটা কাকাতুয়া। কিছুদিন পরে ও উড়তে পারবে। কাল ওর খোলসটা খুলে দেব।”
তাই হল। পরদিন মা কাকাতুয়ার খোলসটা খুলে দিলেন। দেখলেন, ক’দিনে পাখিটার অনেক সাদা পালক গজিয়েছে। কী সুন্দর দেখতে লাগছে ওকে! ঠোঁটটাও আস্তে আস্তে লালচে হচ্ছে। মা রুমিকে বললেন, “ওকে এবার ছেড়ে দাও মা, ও ঠিক ওর মার কাছে চলে যাবে।”
রুমি কাকাতুয়াটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বলে, “তুই আমার পোষা পাখি। পাখি, তুই উড়ে চলে গেলে আমার খুব কষ্ট হবে রে।” বলতে বলতে ওর মাথায়-ঠোঁটে হাত বোলাতে থাকে। আর চোখের জল ফেলে।
মা বললেন, “রুমি রুমি, কেঁদো না। ও যখন তোমার নাম ধরে একবার ডেকেছে তখন ও ঠিক আবার তোমার বাগানে ফিরে আসবে। এখন ওর মা ওকে নিতে এসেছে। কোথাও অপেক্ষা করছে। ওকে যেতে দাও। দেখো তো ও উড়তে পারে কি না।”
রুমি মায়ের কথামতো পাখিটাকে বাগানের একটা নিচু ডালে বসিয়ে দিল। রুমির পাখিটা উড়তে পারল না। ঐ গাছের ডালেই বসে থাকল। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর পাখিটা রুমিকে ডাকতে থাকল, ‘রুমি, রু-মি, এ-সো এ-সো।’
বেশ কয়েকদিন রুমি ওকে ওর খাবার এনে গাছের ডালেই দিয়ে যায়। রুমি পাখিটাকে খাঁচায় বন্দী করেনি কোনোদিন। যেই ও উড়তে শিখল তখনই ওকে গাছের ডালে এনে বসিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু রুমির কথাবলা বাচ্চা পাখিটা ঐ ডালেই বসে থাকত। ও কোথাও উড়ে চলে গেল না। ঐ গাছেই থাকত। আর রাতে ঘরে আসত। মাঝে মাঝে ও বাগানে বসে রুমিকে ডাকত, ‘রু-মি রু-মি, এ-সো এ-সো।’
রুমি দিনে দিনে কথা বুঝতে পারল, পাখিটার ডাক চিনে ফেলল। ডাক শুনলেই দৌড়ে বাগানে যায় ফলমূল নিয়ে। খাওয়া হয়ে গেলে পাখিটা নিজেই ঘরে এসে বসে। ওর বাটিতে জল রাখা থাকে। নিজেই খেয়ে নেয়, আর রোজই আপনমনে ডাকে, ‘রু-মি রু-মি, এ-সো এ-সো।’ রুমি যা যা বলে, পাখিটাও তাই বলে। রুমির সেই বাচ্চা পাখিটা এখন কী সুন্দর দেখতে হয়েছে! সাদা পালক গায়ে, মাথায় ঝুঁটি, লাল টকটকে ঠোঁট। ও এখন রুমির কাকাতুয়া, রুমিকে ছেড়ে কোথাও যায় না।
অলঙ্করণঃ ইন্দ্রশেখর
জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে
খুব সুন্দর গল্প । ঠিক শিশুদের মনের মতো
LikeLike