গল্প কল্পিত ভুবন চন্দন কুমার দেব শীত ২০১৯

চন্দন কুমার দেব এর আগের গল্পঃ প্রফেসর বৈদ্যনাথ ও প্রফেসর বৈদ্যনাথ, সংশোধনাগার

আমি অনিরুদ্ধ। থাকি চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত লেনে। আমাদের বাড়িতে সদস্য সংখ্যা তিনজন। আমি, আমার স্ত্রী অনুপমা ও ছোট্ট মেয়ে রিঙ্কি। কী অদ্ভুত মিল না আমার ও আমার স্ত্রীর নামে? নামে যেমন মিল, বিধাতা আমাদের দাম্পত্যেও গভীর মিল করে দিয়েছেন। আমি অনুপমাকে কী যে ভালোবাসি তা বোঝানো আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি নিশ্চিত, সেও আমাকে ততটাই ভালোবাসে। আমাদের বিয়ে হয় বছর সাতেক আগে। আমি তখন থাকতাম এক অনাথ আশ্রমে। অনেক ছোটোবেলায় আমাকে কেউ এই আশ্রমের সামনে রেখে চলে যায়। যখন থেকে বুঝতে শিখেছি, তারপর থেকে বিয়ে পর্যন্ত এই আশ্রমেই ছিলাম। মাঝে চার বছর বি.টেক করার জন্য আই.আই.টি-তে থাকি। আই.আই.টি-র কোনও পরীক্ষায় আমি দ্বিতীয় হইনি। আমি ছাত্র হিসেবে যথেষ্ট মেধাবী ছিলাম। অনুপমার সঙ্গে দেখা ও কথা সেইখানেই। গ্র্যাজুয়েশনের পর ভালো কোম্পানিতে চাকরি পাওয়ায় অনাথ হলেও আমাদের বিয়েতে অতটা সমস্যা হয়নি।

আমি যে ছাত্র হিসেবে শুধু ভালো ছিলাম তা নয়, আমি মানুষ হিসেবেও ছিলাম খানিকটা আলাদা। আমি ছোটোবেলা থেকেই আমার মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ করতাম। তার মধ্যে যেটা অনেকদিন পরে বুঝতে পারলাম তা হল, আমি কোনও দিন স্বপ্ন দেখি না। প্রথম প্রথম এই নিয়ে কোনও মাথাব্যথা আমার ছিল না। কিন্তু আশ্রমের বন্ধুরা যখন গতকাল রাতের ভয়ংকর সব স্বপ্নের আলোচনা করত তখন আমার বড়ো অবাক লাগত। কীসের কথা বলছে ওরা? অনেকদিন পর ধারণা হল এই স্বপ্ন জিনিসটা কী। ছোটোবেলা থেকে আমার জটিল জিনিস নিয়ে ভাবতে ভালো লাগত। যখন সেই জটিল জিনিস কিছুটা আমার আয়ত্তে আসত তখন সেখান থেকে উঠে আসা আরও কিছু জটিল তথ্য নিয়ে ভাবতে শুরু করতাম। আমার সকল চিন্তা আমি মনের এক ডায়রিতে লিখে রাখতাম।

স্বপ্ন

“মানুষ স্বপ্ন নামক একটি অভিজ্ঞতা অর্জন করে যা অর্জিত হয় ঘুমের মাধ্যমে। যা চিন্তার মতো মনে হলেও তা চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটা বিষয়। স্বপ্নে মানুষ যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে তা সবসময় নির্ধারিত হয় অজানা এক সমীকরণ দ্বারা। এক আবছা আধা আবছা অজানা জগতে প্রবেশ করে। লাভ নেই ক্ষতি নেই এক জগত। লাখ টাকা পেলেও লাভ নেই, মরে গেলেও কোনও ক্ষতি নেই। কী এই জগত? এটার সংজ্ঞা কী দেওয়া যায়।”

“এই ওঠো, কীসের এত বিড়বিড় করছ!” অনুপমা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। “রিঙ্কির স্কুলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।”

এবছর রিঙ্কি নার্সারি ওয়ানে ভর্তি হল। আমি যথাসম্ভব স্বাভাবিক স্বামী ও ততাধিক স্বাভাবিক বাবা হওয়ার চেষ্টা করে চলেছি। কিছুটা সফলও হয়েছি। কিন্তু আমি জানি আমি স্বাভাবিক নই। আমি যেমন স্বপ্ন দেখি না আবার তেমনই আমার অবচেতন মন সবসময় কারও সঙ্গে কথা বলে। আমার সম্পর্কে সবকিছু বলে। সারাদিনের পর্যবেক্ষণ যেন কাউকে বলে। এখন যেমন বলছে। আমি তা বুঝতে পারি, কিন্তু আটকাতে পারি না।

আমাদের আশেপাশের মানুষ এত বিচিত্র কেন? পশুরা বিচিত্র নয় কেন? পশুরা প্রকৃতির বশ মানুষ নয় কেন? পরিবেশ দূষণে মানুষের হাত এত বেশি কেন? এসব নানা প্রশ্ন আমাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায়।

“বাবা, ফুচকা খাব।” রিঙ্কি বলে উঠল।

আমি ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললাম। ড্রাইভার শ্যামল আজ দু’বছর হল আমাদের গাড়ি চালাচ্ছে। সে আমাকে সন্দেহের চোখে দেখে। আমাকে বোধহয় ওর স্বাভাবিক মনে হয় না। কিন্তু আমার খুব কাছের লোকজন অনুপমা ও রিঙ্কি আমাকে খুব স্বাভাবিক ভাবে। বরং ওরা আমাকে যতটা না স্বাভাবিক ভাবে তার থেকে বেশি বোকা ভাবে। আমি কি বোকা? শূন্য আর অসীম যেমন কিছুটা। একরকম খুব বোকা আর খুব বুদ্ধিমান লোকেরাও কিছুটা সমগোত্রীয় হয়। আমার পকেট থেকে একবার একটা দামী মোবাইল ফোন চুরি গেল। অনুপমা আমার বোকামোর জন্য খুব দুশ্চিন্তায় পড়ল। কিন্তু সেই চোর মহাশয়কে যে আমি আধঘণ্টা ধরে লক্ষ করছিলাম, সেদিন রাতেই একটা সমীকরণ মাথায় এল। মানুষ কখন একটা পদক্ষেপ নেয়? তার মনের অবস্থা কি থাকলে সে এক সাহসিক পদক্ষেপ নেয় তার এক সমীকরণ। দীর্ঘদিন রাস্তাঘাটে বড়ো-ছোটো সবার ওপর এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে আমি সেদিন রাতে একটা সমীকরণ পেলাম। আমার মনের ডায়েরিতে লিখে রাখলাম। ডায়েরিটি যখন ইচ্ছা বার করি, যখন ইচ্ছা পড়ি। পড়তে আমার ভালো লাগে।

অনুপমার বাড়ির লোকজন তো আমাকে কিছুটা পাগল ভাবে। কেউ কোনও কথা সেইভাবে বলে না। আমার সুবিধাই হয়। আমি সেই পর্যায়ে নিজেকে নিয়ে যেতে পারি যা বন্ধুরা স্বপ্ন বলে জানত। ছোটোবেলায় যখন স্বপ্ন দেখতাম না, স্বপ্ন নিয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একদিন স্বপ্নের মতো কিছু একটা দেখলাম। কিন্তু দেখলাম চেতন মনে। এমন এক স্বপ্ন যার পটভূমির সুতো পুরোপুরি আমার হাতে। যেদিকে খুশি ঘোরানো যায়। তারপর যতক্ষণ খুশি এই জগতে থাকো, বাস্তব জগতের কোনও বালাই নেই। সামাজিক জীবন থেকে শত সহস্র মাইল দূরে।

শুধু শ্বশুরবাড়ি নয়, আমি সমস্ত রকম সামাজিক সমাবেশে যেন কিছুটা অসম হয়ে পড়ি। একবার রিঙ্কির স্কুলে প্যারেন্টস মিটিং-এ আমাকে কিছু কথা বলতে বলা হল। আমি বললাম মহাবিশ্ব নিয়ে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়ে। কথা বললাম কয়েক হাজার আলোকবর্ষ দূরের গ্রহ রিঙ্কুলাকে নিয়ে। একজন অভিভাবক তো ক্ষেপে গিয়ে বললেন, “কী বলছেন এসব, কীসের রিঙ্কুলা? আমিও অ্যাস্ট্রলজি নিয়ে পড়েছি। নাসায় ছ’মাসের ইন্টার্নশিপ করে এসেছি। কীসের রিঙ্কুলা? যত্তসব বুজরুকি।”

সবাই হাসাহাসি করল। অনুপমা আমাকে হাত ধরে মঞ্চ থেকে টেনে সটান বাড়িতে নিয়ে এল। শুধু রাস্তায় রিঙ্কি বলল, “বাবা, আমি জানি রিঙ্কুলা গ্রহ। সেখানকার প্রাণীরা খুব বুদ্ধিমান, ঠিক তোমার মতো।”

অনুপমা রিঙ্কিকে এক ধমকে চুপ করাল। কিন্তু আমি জানি এই রিঙ্কুলা সম্পর্কে। তাই আমি মেয়ের নাম রিঙ্কি রেখেছি। রিঙ্কি ছোটোবেলা থেকেই আমার মতো। অনেক কিছু বুঝতে পারে। সব কিছুতেই আমার মতো কৌতূহল। তার বুদ্ধি সত্যি চমকে দেয়ার মতো। এতটুকু বয়সে ও সবসময় বড়োদের মতো প্রশ্ন করে। একবার বলল, “বাবা, ভগবান কী?”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কার কাছে শুনেছ?”

সে বলল, “দিদুন বলেছে। বলেছে, ভগবান আমাদের তৈরি করেছে।”

অর্থাৎ অনুপমার মার কাছ থেকে সে ভগবানের কথা শুনেছে। আমি অকপটে বললাম, “আমি জানি না। আমিও দীর্ঘদিন ধরে খুঁজে যাচ্ছি ভগবানকে। কীভাবে সে আমাদের এই পৃথিবি তৈরি করল সে এক বিস্ময়!”

রিঙ্কি বলেছিল আমি রিঙ্কুলার অধিবাসী থেকে বুদ্ধিমান। কিন্তু রিঙ্কি এটা ঠিক বলেনি। আমি জানি রিঙ্কুলার অধিবাসীর মতো বুদ্ধিমান হওয়া কোনও মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তা আমি জানি। ছোটোবেলা থেকেই জানি। কিন্তু কীভাবে তা আমি জানি না।

আজ সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফিরলাম তখন আমার জন্য একজন অপেক্ষা করছিলেন। তিনি আমার স্বপ্ন না দেখার অস্বাভাবিকতার কথা আমার বন্ধু রাজদীপের কাছে শুনে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। চোখে কালো ফ্রেমের মোটা কাচের চশমা। আধা পাকা চুলে ব্যাক ব্রাশ করা। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। পরনে সবুজাভ পাঞ্জাবি ও শান্তিনিকেতনি ব্যাগ। বয়স চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের বেশি নয়। নাম রতিকান্ত প্রামাণিক। কথা বলে বোঝা গেল প্যারাসাইকলজি নিয়ে কাজ করে। কথা শেষ হয়ে চলে যাওয়ার পর প্রামাণিক মহাশয় সম্পর্কে গুগল করতেই বুঝলাম তিনি দেশে বিদেশে প্যারাসাইকলজির অন্যতম হস্তি। আমার প্রতি এত উৎসাহের কারণ কী? আমি স্বাভাবিক নই তা আমি জানি, কিন্তু স্বপ্ন না দেখা কি এতটাই অস্বাভাবিক যে আমার বাড়িতে এক বিশ্বমানের প্যারাসাইকলজিস্ট উপস্থিত হবেন?

“আপনার নাম?”
“অনিরুদ্ধ।”
“আপনি নাকি স্বপ্ন দেখেননি কোনওদিন?”
আমি চুপচাপ।
“আপনি কি কোনও চেতন-অবচেতনে কোনও পার্থক্য খুঁজে পান?”
আমি চুপচাপ।
“আপনার ছোটোবেলা কেমন কেটেছে?”
আমি চুপচাপ।

এইরকম আরও কিছু রুটিন প্রশ্ন করে প্রামাণিক মহাশ্য একসময় থেমে গেলেন। আমি যে ইচ্ছা করে চুপচাপ ছিলাম তা নয়। আমার ভালো লাগছিল যে এতদিনে একজন লোককে পাওয়া গেল যে আমাকে চেতন-অবচেতনের বিষয়টা আঁচ করতে পেরেছেন। তিনিও যে চরম বুদ্ধিমান তাঁকে দেখে বোঝা না গেলেও অনুভূত হচ্ছিল। আমি তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিতে চাইছিলাম। কিন্তু আমার ভেতরের কোনও ডিফেন্স সিস্টেম চালু হওয়ার জন্য আমি মুখ খুলতে পারছিলাম না। আমি নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ইচ্ছা করে নির্বাক ছিলাম তা নয়। সেটা আন্দাজ করতে পেরেই হয়তো রতিকান্ত প্রামাণিক যাওয়ার সময় বললেন, “আপনার সম্পর্কে যদি কিছু বলার থাকে তবে এই নিন নোট খাতা, এখানে লিখে রাখবেন। আজ উঠি।” এই বলে তিনি চলে গেলেন।

উনি চলে যাওয়ার পর আমার আড়ষ্টতা সম্পূর্ণ কেটে গেল। আমি সেদিন সেই নোট খাতায় নিজের সম্পর্কে লিখতে বসলাম।

নোট খাতা

আমি অনিরুদ্ধ। এক এমন মানুষ যা স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা থেকে অনেকটা দূরে এক অন্য জগতে বাস করি। আমার স্ত্রী ও কন্যাকে আমি সীমাহীন ভালোবাসি। এরাই বাস্তব জগতের সঙ্গে আমার যোগসূত্র। তাদের ছাড়া আমার জীবন বৃথা।

আমি ছোটোবেলা থেকে অনাথ আশ্রমে মানুষ। জানি না কে আমার মা, কে আমার বাবা। তাই আমি শুধুই অনিরুদ্ধ। আমার স্বপ্ন দেখা বা না দেখাতে আমার জীবন সম্পর্কে তেমন কিছু বলা যায় না। আমার জীবন সম্পর্কে আমার নিজেরই অনেকগুলো প্রশ্ন আছে।

আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। কয়েকদিন ধরে শরীর প্রচণ্ড খারাপ। বুকে চিনচিন করে ব্যথা। স্কুলে যেতে পারছিলাম না। যেদিন স্কুলে গেলাম, ফেরত আসার সময় হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমি আশ্রমের বেডে শুয়ে আছি। যখন সুস্থ হলাম, জানতে পারলাম, আমি যেদিন অজ্ঞান হয়েছিলাম আর যেদিন আমাকে পাওয়া গিয়েছে তার মধ্যে বারোদিনের তফাত। আমি আজও জানি না সেই বারোদিন আমি কোথায় ছিলাম।

যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখনকার কথা। আমাদের যেমন খুশি আঁকো প্রতিযোগিতা হচ্ছিল। আমি আঁকলাম এমন এক প্রাণীর ছবি যা দেখে বোঝা যাচ্ছে না মানুষ, না অন্যকিছু। সবাই খুব হাসাহাসি করল। আমি কষ্ট পেলাম। আমি পুরোপুরি নিজের ইচ্ছায় ছবিটা আঁকিনি। সবাই খুব হাসলেও আমাদের আর্টের শিক্ষক রতন স্যার খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। দু’দিন পরে শুনলাম স্যারের খুব জ্বর হয়েছে। গেলাম স্যারকে দেখতে। সবাই চলে যাওয়ার পর স্যার আমাকে কাছে ডেকে বললেন, “কোথায় দেখেছিস এই প্রাণীকে?”

আমি বললাম, “জানি না স্যার।”

স্যার নিজের বাক্সের মধ্য থেকে একটা হাতে আঁকা ছবি বার করে দেখিয়ে বললেন, “দেখ, তোর মতো বয়সে আমিও একই ছবি এঁকেছিলাম।”

আমি দেখে অবাক। হুবহু এক ছবি! রংও এক। কীভাবে এটা হল বুঝতে পারলাম না। সেই রাতেই রতন স্যার মারা গেলেন।

গতকাল রাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারিনি। সকালে যখন ঘুম থেকে উঠলাম তখন অনুপমা আমার দিকে অপলক কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কী অপরূপ দৃষ্টি। বিধাতা যেন ভালোবাসার এক অপার ভাণ্ডার করে দিয়েছেন অনুপমাকে। আশেপাশের জগত সম্পর্কে কী অসীম মমতা তার! পরিচিত অপরিচিত সকল প্রকার দুঃখী লোক যেন তার আপনার।

একবার কোনও এক ছুটির দিনে আমরা তিনজন যাচ্ছিলাম রেস্তোরাঁয় খেতে। এক কিশোরী ছোট্ট ভাইকে নিযে পথে পথে ঘুরছিল। আমরা তাকেও নিয়ে গেলাম। পরম আনন্দে সে আমদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করল।

সব মানুষ অনুপমার মতো হয় না কেন? কেন একে অপরের গলা কাটে? একদিকে যেমন আতুলনীয় স্নেহময়ী অনুপমা, অন্যদিকে চরম রক্তপিপাসু লোকদেরও অভাব এ পৃথিবীতে আছে বলে আমার মনে হয় না।

“আজ বাবার ওখানে যাওয়ার কথা ভুলে গেছ?”

“না, ভুলিনি। রিঙ্কি সকাল থেকে রেডি হয়ে বসে আছে। চলো, তোমার জন্য আমরা সবাই অপেক্ষা করছি।”

আমরা রওনা দিলাম আমার অপছন্দের একটা জায়গায় আমার শ্বশুরবাড়িতে। স্ত্রীর শরীর ভালো নয় বলে শ্যামল আজ আসেনি। আমি কোনওদিন ড্রাইভ করি না। তাতে আমার ভাবনাচিন্তায় ব্যাঘাত ঘটে। আমরা চললাম লোকাল ট্রেনে। ঠাসাঠাসি করে পরিবারকে নিয়ে যাওয়া বড়োই কষ্টকর।

ট্রেনে যেতে যেতে আমি অনুভব করলাম, আমাদের সঙ্গে অন্তত পাঁচজন পকেটমার উঠেছে যার মধ্যে দু-দু’জন আমার পাশে থাকা ভদ্রলোকের মানিব্যাগের দিকে টার্গেট করছে। কেউ না বুঝলেও আমি বুঝলাম। কয়েকটা স্টেশন পার হতেই রিঙ্কি বলে উঠল, “বাবা, চিপস খাব।”

সাধারণত লোকাল ট্রেনে হকাররা ওঠে। আজ অজানা কারণে ওরাও নেই। আমি বললাম, “পরের স্টেশনে গাড়ি থামলে কিনে দেব।”

পরের স্টেশন আসতেই নেমে পড়লাম। এই লোকাল ট্রেনগুলো খুব বেশি সময়ের স্টপেজ নেয় না। মিনিট দুইয়ের বেশি পাওয়া খুব মুশকিল। তাড়াহুড়ো করে নামলাম ট্রেন থেকে। প্লাটফর্মে নেমে যাচ্ছিলাম চিপসের দোকানের দিকে। কান ফাটা শব্দে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। কান বেয়ে রক্ত পড়ছে। কোনও মতে পেছনে ঘুরে দেখি আমাদের কম্পার্টমেন্টে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। জানালা ভেদ করে আগুন বেরোচ্ছে। আমার সমস্ত পৃথিবী কালো মেঘে তলিয়ে যাচ্ছে। ধড়মড়িয়ে উঠে কম্পার্টমেন্টের দিকে দৌড় লাগালাম। পাশে থাকা কয়েকজন আমাকে আটকে ধরল। কাঁদতে পারছি না। বুকের ওপর কেউ দপদপ করে ঘা মারছে। আমি জ্ঞান হারালাম। আমার মস্তিষ্ক নিজের ক্ষতি এড়াতে আমাকে সুইচ অফ করে দিল।

আজ ক’দিন হল আমি বাড়িতে নিজেকে বন্দি করে রেখেছি। চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। অনুপমা আর রিঙ্কির দেহ পর্যন্ত আমি খুঁজে পাইনি। জীবন আমাকে কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। গত কয়েকদিনে আমি জানি না কোন জগতে আছি। আমার জগত অনুপমা আর রিঙ্কির সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস হয়ে গেছে।

সারা বিশ্ব সন্ত্রাস নামক এক শক্ত ব্যাধির দ্বারা আক্রান্ত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইন্টারনেটে সন্ত্রাসীদের সম্পর্কে পড়ে যাচ্ছি। যত পড়ছি তত অবাক হচ্ছি। কীসের জন্য তারা কাতারে কাতারে মানুষ মেরে যাচ্ছে তারা নিজেরাও বোধহয় তা জানে না। এই বিশ্বে আমি শুধু নই, হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিনিয়ত সম্মুখীন হচ্ছে এই সন্ত্রাস নামক মারণ ব্যাধির। গত কয়েকদিনের নিষ্ঠুরতা আমাকে আজ ঘুম পাড়িয়ে দিল।

জীবনে আজ প্রথমবার স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম আমি, অনুপমা ও রিঙ্কি তিনজনে কাঠের পুতুল হয়ে গেছি। সুতো দিয়ে কেউ আমাদের নাচাচ্ছে। তাকিয়ে দেখি, খুব কম বয়সের একটা ছেলে আমাদের নাচাচ্ছে। পরম আনন্দে খিলখিল করে হাসছে। আমাকে মঞ্চের এক কোনায় আটকে রেখে অনুপমা ও রিঙ্কিকে মঞ্চের অন্য কোনায় নিয়ে যাচ্ছে। আমার ভালো লাগছে না। রিঙ্কি হাসতে হাসতে মঞ্চের বাইরে চলে গেল। অনুপমাকে বুঝতে পারলাম না সে দুঃখী, না খানিকটা বিভ্রান্ত।

কলিং বেল বেজে উঠল। আমি প্রথমে ভাবলাম দরজা খুলব না। কারও করুণা আমার ভালো লাগে না। কিন্তু নিজের অজান্তেই দরজা খুললাম। রতিকান্ত প্রামাণিক ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, “আমি এসেছি আপনাকে কযেকটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কথা বলতে। হাতে সময় অনেক কম। আমি যা বলছি তা মন দিয়ে শুনুন। আমাদের জগতে আমরা সবাই কারও না কারও দ্বারা পরিচালিত। সবকিছু পূর্ব নির্ধারিত। আবেগপ্রবণ হয়ে কোনও লাভ নেই।”

এইসব সস্তা দর্শন শুনে আমার কোনও কথাই মুখ দিয়ে বের হল না। জীবনে প্রথমবারের মতো এত রাগ অনুভব করলাম। তিনি কথা বন্ধ করলেন না।

“মনে পড়ে, আমি আপনার কাছে এসেছিলাম? কেন এসেছিলাম সেটা জানেন? জানার কথাও নয়। আমি আপনার কাছে এসেছিলাম কারণ আমিও ছোটোবেলা থেকে আপনার মতোই স্বপ্ন দেখতাম না। একদিন আমারও স্ত্রী-কন্যা মরে গেল। না, কোনও ব্লাস্ট নয়। এমনি মরে গেল। আমি ভেনেজুয়েলায় গিয়েছি কোনও একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে। যখন ফেরত এলাম তখন শুনি আমার স্ত্রী-কন্যা মারা গেছে। ডাক্তার ধরতে পারেনি কেন মারা গেছে তারা। তারপর একমাস পর্যন্ত আমি কিছুই করতে পারলাম না।

“হঠাৎ একদিন রাতে স্বপ্ন দেখলাম। জীবনে প্রথমবারের মতো। তারপর বিশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল। আমি আমার মাঝে একটা পরিবর্তন লক্ষ করলাম যে আমার কোনও পরিবর্তন হচ্ছে না। আমার বয়স একটা জায়গায় আটকে গেছে। আমার এই অদ্ভুত জীবন নিয়ে আমি বিশ বছর গবেষণা করেছি। সারা বিশ্বে আমার-আপনার মতো আরও দেড়শো লোকের সন্ধান আমি পেয়েছি যাদের ঘটনা ঠিক আমাদের মতো।”

আমি প্রামাণিক মহাশয়ের কথা শুনে যাচ্ছিলাম। আজ স্বপ্ন দেখার কথা আর বললাম না। আমার মনে হল তিনি আমার সব ঘটনা জানেন, তাঁর আত্মবিশ্বাস তাই বলছে। তিনি থামলেন না, বলেই গেলেন।

“সব কেস আমি স্টাডি করেছি এবং এমন কিছু তথ্য আমি উপলব্ধি করেছি যা শোনা আপনার পক্ষে খুব জরুরি। আপনার জীবনের সঙ্গে এই তথ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত।”

কী আর তথ্য হতে পারে? আমি বিনা উৎসাহে জিজ্ঞেস করলাম, “কী এমন তথ্য?”

তখন তিনি আমার হাতে একটা নোট খাতা দিয়ে বললেন, “আজ আমাকে উঠতে হবে। আজ উঠি। ভাগ্য ভালো থাকলে আবার হয়তো দেখা হবে। দয়া করে আজ রাতেই আপনি নোট খাতাটা শেষ করবেন।”

রতিকান্ত প্রামাণিক নীল রঙের কভারওয়ালা একটা নোট খাতা আমাকে ধরিয়ে চলে গেলেন। উনি যাওয়ার পরে নোট খাতাটা ওলটালাম। নোট খাতার নাম লক্ষণীয়, ততোধিক লক্ষণীয় তার সূচনা।

রতিকান্ত থিওরি

‘আমি আমার এই নোট খাতাটির নাম রতিকান্ত হাইপোথিসিস না রেখে রেখেছি রতিকান্ত থিওরি। কারণ, আমি জানি আমার এই থিওরি কতটা সত্য। আমার এই নোট খাতা লিখতে গিয়ে আমাকে প্রায় সারা বিশ্ব ঘুরতে হয়েছে। অনেক বিচিত্র লোকের সন্ধান আমি আমার জীবনকালে পেয়েছি। সবার ঘটনাই আমাকে নির্দিষ্ট দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আমি এই লেখার শেষপর্যন্ত গিয়ে কিছু উপলব্ধি করেছি। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবের জায়গা নিতে পেরে আমি কিছুটা গর্বিত।’

এই নাম ও ভূমিকা দেখে কিছুটা কৌতূহল বোধ করলাম। নোট খাতার প্রথম দিকটায় একটার পর একটা কেস হিস্ট্রি। তাতে প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যবহার, আচার-আচরণ, পরিবারের শেষ পরিণতি নিয়ে লেখা। সবকিছুতেই বিধাতার নির্মমতা লক্ষণীয়।

তাঁর নোট খাতায় সমস্ত ঘটনা একটা সূত্র মেনে চলছিল। প্রত্যেকটি মানুষ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় জীবন চরম দুঃখের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। তার মাঝে একটা ঘটনা কিছুটা আলাদা। ঘটনাটি প্যারিস শহরের এক ব্যক্তিকে নিয়ে লেখা। রু ডে লাব্রিভ্যের স্ট্রিটের এক লোক। লেকের ধারে বছরে একটা সময় তাকে দেখা যায়। বসন্তের ঠিক আগে আগে একটা বিশাল বড়ো সাইনবোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। সাইনবোর্ডে বড়ো বড়ো করে লেখা ‘ইল না’ ই আ পাস ডে দিও’ অর্থাৎ ‘এখানে ভগবান বলে কিছু নেই।’ তার থেকে আশ্চর্য বিষয় এই যে লোকটিকে কতবছর ধরে দেখা যাচ্ছে সেই কেউই নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না। সত্তর বছরের বৃদ্ধ লোকজনও ছোটোবেলা বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় থেকে এই লোককে দেখে আসছেন। কিন্তু কেউ কিছুই বলতে পারেন না কে এই ব্যক্তি, তাঁর বয়সেই বা কোনও পরিবর্তনের চিহ্ন নেই কেন। প্রামাণিক মহাশয় তাঁর সঙ্গে অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কোনও লাভ হয়নি।

এইরকম অনেক উদাহরণ যার কোন সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব কি না কে জানে। সর্বশেষ অধ্যায় আমাকে নিয়ে লেখা।

অনিরুদ্ধ

অনিরুদ্ধ আমার শেষ অধ্যায়। এই অধ্যায়ের পরে আমি আর কোনও অধ্যায় শুরু করতে পারব না তা আমি ভালো করে জানি। আমরা যে জগতে বাস করি তার পরিশেষ ঘটবে। হ্যাঁ, আমাদের জগত। আমাদের এই মিথ্যা জগত। এতটাই মিথ্যা আর এতটাই মনগড়া যে আমাদের জগতের সবকিছু বারো বছরের এক বালকের মনগড়া এক দুনিয়া। শুনতে অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি। রিঙ্কুলা নামক এক গ্রহ আছে। এই গ্রহের বারো বছর বয়সের এক অধিবাসীর মনগড়া দুনিয়ায় আমরা একেকটি পুতুল। আমরা তার পার্সোনাল কম্পিউটারের সিমুলেটেট সিস্টেমে একেকটি অবজেক্ট। এই গ্রহের অধিবাসী অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তারা জানতে পারে তাদের থেকে কয়েক হাজার আলোকবর্ষ দূরে পৃথিবী নামে এক গ্রহ আছে। সেই গ্রহের অধিবাসীও অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তাই তারা ঘরে ঘরে পৃথিবী নিয়ে গবেষণা চালায়। দিনে রাতে পৃথিবী গড়ে পৃথিবী ভাঙে। তাদের অজান্তেই অনিরুদ্ধের মতো অবজেক্ট তৈরি হয় যারা রিঙ্কুলার অধিবাসীকেও আতঙ্কে ফেলে দেয় নিজেদের বুদ্ধির বলে। তখন ভীত স্রষ্টা তার সৃষ্টিকে ধ্বংস করতে চায়। তাই আমার ও আমার কেস স্টাডির প্রত্যেক ব্যক্তির এমন নির্মম পরিণতি। রিঙ্কুলার বারো বছরের এই বালক অনিরুদ্ধের পঁয়ত্রিশ বছরের এই জীবনকে সিমুলেট করেছে মাত্র দু’ঘণ্টায়। আমাকে সিমুলেট করেছিল মাস খানেক আগে। যখন বুঝতে পেরেছিল যে আমিও মানুষের মতো হুবহু আচরণ করছি তখন আমাকে শেষ করে দেওয়ার চিন্তা করেছিল। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন হয় যে সিমুলেট সিস্টেম নিজের বড়ো কোনও ক্ষতি এড়াতে আমাদের মতো অবজেক্টকে আপাতদৃষ্টিতে মারলেও নিজের ভিতর স্রষ্টার চোখের আড়ালে বাঁচিয়ে রাখে। হত্যায় ফাঁকি দেওয়া অবজেক্ট ধীরে ধীরে নিজের সত্ত্বা খুঁজে পায়।

অতি বুদ্ধিমান অবজেক্টের মধ্যে অনিরুদ্ধ সবথেকে বুদ্ধিমান। ছোটোবেলা থেকেই বুদ্ধিমান। অনিরুদ্ধ এমন এক অবজেক্ট যার মস্তিষ্কের কম্পাঙ্ক পৃথিবী থেকে বের হওয়া কম্পাঙ্কের সঙ্গে এতটাই মিলে যায় যে সে নিজের মধ্যে থাকা সব সূচনা পৃথিবীতে পাঠায়। মাত্র বারো-তেরো বছরে অনিরুদ্ধ একবার কয়েক হাজার আলোকবর্ষ দূরে থাকা পৃথিবীতে কম্পাঙ্ক আকারে প্রবেশ করে সেখানে কিছুদিন থেকে আবার নিজের সিস্টেমে ফেরত আসে। তাতে সিমুলেটেড অনিরুদ্ধ অনেকটাই মানুষ অনিরুদ্ধে পরিণত হয়। মানুষের মতো নিজের সত্বাকে জানার অদম্য চেতনা তার মধ্যে তৈরি হয়। আর এইরকম অবজেক্ট রিঙ্কুলার অধিবাসীর জন্য খুব বিপদজনক হয় বলে মনে হয়। যখন এইরকম বিপদসংকেত আসে তখন তারা তাদের কম্পিউটারের সমস্ত মেমরি মুছে দেয়। আজ রাতের মধ্যে এই মুছে দেওয়া পর্ব আরও একবার ঘটবে। আমি, অনিরদ্ধ সকলের অবলুপ্তি ঘটবে। এই অবলুপ্তির সময়কালে পুরনো সমস্ত অবজেক্ট আবার কিছুক্ষণের জন্য নিজের জীবন ফেরত পায়। কিন্তু তারা থাকে রেসিডুয়াল মেমরিতে যেখানে আমি ছাড়া কেউ যেতে পারে না। তাই আমি আজ যাচ্ছি কম্পিউটারের রেসিডুয়াল মেমরিতে। সেখানে হয়তো আমি আমার মৃতা স্ত্রী ও কন্যাকে খুঁজে পাব। এই আশায় শেষ করছি ‘দ্য রতিকান্ত থিওরি’।

পড়তে পড়তে আমি আমার জীবনের অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম। ধন্যবাদ দেবার জন্য আর বোধহয় প্রামাণিক মশাইয়ের সঙ্গে দেখা হবে না। কিন্তু তবুও মনে মনে তাকে ধন্যবাদ জানালাম। আমার আশেপাশে ঘন কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেল। ঘরবাড়ি সবকিছু অবলুপ্ত হতে থাকল। আমার হাত-পা খসে গেল। হয়তো আবার আমার জায়গায় অন্য কোনও গ্রহের অন্য কোনও প্রাণীকে সিমুলেট করা হবে। কিন্তু আমি আবার যদি জন্মাই তাহলে যেন একটিবার অনুপমার সঙ্গে দেখা হয়। রিঙ্কির একটা হাত আমার হাতে, আরেকটা অনুপমার হাতে যেন সমুদ্রসৈকতে হাঁটি অনেকটা পথ।

অলঙ্করণঃ ইন্দ্রশেখর

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s