গল্প কালু শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় শরৎ ২০২০

শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরো গল্প  শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমস্ত লেখা

কালু

শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়

সেসময় লালগোলা এক্সপ্রেস চলত কয়লার ইঞ্জিনে। জানালার ধারে বসে যাবার সময় মাথায় মুখে কয়লার মিহি ধুলো এসে উড়ে উড়ে চোখে মুখে পড়ত। শেয়ালদা থেকে লালগোলা, এই ছিল তার গতিপথ। যেমনটা আজও। দুপুর সাড়ে বারোটায় একটা লালগোলা ছাড়ত। কুউউ-ঝিক-ঝিক করে বিপুল শব্দ আর বিস্তর ধোঁয়া উড়িয়ে সাড়ে চার ঘণ্টা সময় নিয়ে রেলগাড়ি পৌঁছত দেবগ্রাম স্টেশনে। শীতের বেলা পড়ে আসার মুখে আমরা স্টেশনে নামতাম। ওই সময়ে ডিসেম্বরে ফাইনাল পরীক্ষার পর ইস্কুলে একটা লম্বা ছুটি। ফলে আমরা বাড়ি যেতাম। দেবগ্রামের বাড়িটা ছিল বাড়ি আর কলকাতায় বাসা। কখনও কলকাতার বাসস্থানটিকে আমার বাবা-কাকা-পিসে-পিসি-মা-ঠাকুমারা বাড়ি বলতেন না। বলতেন বাসা। বাড়ি মানে দেবগ্রাম।

নদীয়া জেলার উত্তরপ্রান্তে পলাশীর দুটো স্টেশন আগে দেবগ্রাম। পলাশী, যেখানে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রবার্ট ক্লাইভের যুদ্ধ হয়। সেই আমবাগান, যেখানে যুদ্ধ হয়েছিল, সেটা তখনও ছিল। যাত্রাপথে দুটো বড়ো স্টেশন ছিল যেখানে একটু বেশিক্ষণ ট্রেনটা থামত, রানাঘাট আর কৃষ্ণনগর। রানাঘাটের একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিল। ওটা ছিল পুরো যাত্রার মাঝামাঝি, আর সেখানে বেশ খানিকক্ষণ ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকত ইঞ্জিনে জল ভরা, কয়লা তোলা ইত্যাদির জন্য। তবে আকর্ষণের বস্তু ছিল ভিন্ন। ওখান থেকে মিষ্টির ফেরিওয়ালারা উঠতেন। কাঁধে ক্যানভাসের স্ট্র্যাপ দিয়ে ঝোলানো একটা টিনের বাক্স। তার একপাশে কাচ লাগানো যাতে ভেতরের মিষ্টিগুলো দেখা যায়, আর তার সঙ্গে আরেকটা বড়ো টিনের কৌটোতে জল, কৌটোর মুখে ওয়েল্ডিং করে একটা বাঁকানো টিনের পাইপ লাগানো, কলের মতো। তা থেকে জল ঢেলে দিতেন ব্যবসায়ী ভদ্রলোক। খুব মৃদু স্বরে হাঁক দিতে দিতে যেতেন, “খাবার, খাবার” বলে। ডাকটা শুনতে পেলেই বেশ চঞ্চল হত মন। আমাদের, ছোটোদের। উৎকর্ণ হয়ে থাকতাম কখন সেই ডাক আরও নিকটে আসবে, আর খাকি পোশাকের সেই লোকটিকে ভিড়ের ফাঁক দিয়ে দেখা যাবে। আর অবশ্যম্ভাবী এক-দুটো মিষ্টি শালপাতা মোড়া দোনায় আমাদের হস্তগত হবে। যতক্ষণ খাওয়া চলত, ভদ্রলোক সামনে দাঁড়িয়ে বা আশেপাশেই থাকতেন আরও কাউকে ‘খাবার’ হস্তগত করানোর জন্য। তারপর মিষ্টি খাওয়া হলে গেলাসে জল ঢেলে দিতেন। অমন সুশীতল এবং স্বাদু জল আর কখনও খাইনি। অথবা হতে পারে সেই জলে মিশে ছিল ছেলেমানুষ বয়েসের কল্পনা আর অনেকটা কুসুম কুসুম আবেগ। তাই হয়তো সে জলের অসামান্য স্বাদ এখনও মনে রয়ে গেছে। সেই সময় থেকে ‘খাবার’ আর ছানার মিষ্টি প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছে। যতদূর মনে পড়ে রসগোল্লা, পান্তুয়া, ছানার জিলিপি, কাঁচাগোল্লা আর লেডিকেনি ছিল মূল বিক্রয়বস্তু। তবে স্মৃতির মধ্যে অনবরত বুড়বুড়ি কাটতে থাকে ওই মধুর ডাকটি।

তো দেবগ্রাম পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা তো পড়ে এল। নামার পর থলের ভেতর থেকে বাবা অথবা পিসেমশাই, যে যখন থাকতেন, হাতকাটা একটা হাতে বোনা সোয়েটার বার করে বলতেন, “পইরা ফালা। ঠাণ্ডা লাগব।”

পিসেমশাইকে দেখেছি বরাবর ধুতি-শার্টের ওপর নস্যি রঙের আলোয়ান গায় দিতে। অন্য কোনও পোশাক নয়। ভারী চেহারা, ছ’ফুটের কাছাকাছি লম্বা, চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পায়ে কালো স্ট্র্যাপের চামড়ার চটি। বরাবর। বাবা অবশ্য ছোটোখাটো চেহারার, শার্ট-প্যান্টই পরতেন, আর খুব ফিটফাট। প্যান্টের ক্রিজ বরাবর সোজা থাকত। আজ যখন ইস্তিরি ছাড়া প্যান্ট হরবখত অতশত না ভেবেই পরে ফেলছি, বাবার অসন্তুষ্ট মুখটা মনে পড়ে। মোটেই পছন্দ করতেন না। বাড়িতে অবশ্য দু’জনে ধুতিই পরতেন।

তো দেবগ্রাম স্টেশনে নামতে হলে তখন রেলকামরার সিঁড়ির তিনখানি পাদানি বেয়ে নেমে আরও ফুট দেড়েক লাফ দিতে হত। ইট-বাঁধানো দুটি প্ল্যাটফর্মেরই ধারের দিকে ইটগুলি দেখা গেলেও মাঝের অংশ মাটিই ছিল আর এখানে ওখানে গজিয়ে ওঠা ঘাস। প্রতিটা প্ল্যাটফর্মেই বড়ো বড়ো পাঁচ-ছ’খানা গাছ—তেঁতুল, শিরিষ আর বকুল ফুলের। একখানা কদমগাছও ছিল কি? গাছগুলির গোড়া ইট-বাঁধানো। তাতে যাত্রীরা বসে থাকত ট্রেনের প্রতীক্ষায়। একটিই লাইন, যাবার ও আসার। উলটোমুখে ট্রেন এলে অন্যটিকে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হত। ট্রেন চলে যেতে একটু বাদেই স্টেশনটা টুপ করে আবার নিস্তরঙ্গ আর শান্ত হয়ে যেত। আমরা প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে উত্তরমুখে এসে পশ্চিমদিকের পাকা রাস্তা ধরতাম বাড়ি যাব বলে। হেঁটেই যেতাম। পাকা রাস্তা ধরে মিনিট সাতেক হাঁটার পর ডানহাতে একখানা প্রকাণ্ড মাঠ। গ্রামের লোকেরা বলত বল-খেলা মাঠ। পাকা রাস্তা ছেড়ে দিয়ে সেটা কোনাকুনি পার হতে কচি পায়ে মিনিট পাঁচেক সময় লাগত। তারপরেই সরু মেঠো রাস্তা গাছগাছালির ফাঁকে ঝুপসি অন্ধকারের মধ্যে ঢুকে পড়ত আর বীর দর্পে সামনে হেঁটে চলা আমি হঠাৎই গতি কমিয়ে পিসেমশাইয়ের যতটা সম্ভব কাছ ঘেঁষে আসতাম। কেননা এর পরেই আসবে এলাসিনের পুকুর আর তার পাড় দিয়ে রাস্তা ঘুরে গিয়ে পড়বে বড়ো বড়ো দুটো শিমূল আর তেঁতুলের তলায়। আর কে না জানে ওই গাছেই তেনারা থাকেন। তায় আবার সন্ধের মুখে! পিসেমশাই বলেছিলেন, পৈতে থাকলে বামুনদের ওঁরা কিছু বলেন না। কিন্তু আমার তো পৈতে হয়নি। আমি পিসেমশাইয়ের শার্টের তলায় পৈতে খুঁজতে থাকি, “ও পিসুন! তোমার পৈতেটা দাও না।”

পিসেমশাই মৃদু হেসে গেঞ্জির তলা থেকে পৈতের একটু অংশ বার করে দিলে সেটা ধরে মনে সাহস সঞ্চয় করে বিপদসঙ্কুল পথ পার হয়ে আসতাম। দিনমানে অবশ্য অতটা ভয় লাগত না, তবে দুপুরের দিকে, বিশেষ করে, একলা যাবার সাহস দেখাতাম না মোটেও। সন্ধেয় তো কথাই নেই। বাড়ি পৌঁছে যেতেই অবশ্য ঠাকুমা-পিসিমার আদরে পথের ওই সমস্ত ভয়ভীতি মোটেই মনে থাকত না। শুধু রাতে বাইরে হিসি করতে হলে কাউকে না কাউকে এসে দাঁড়াতে হত। সামনের নিকষ কালো অন্ধকারটাকে নিরেট লাগত আর মনে হত এই বুঝি কেউ এসে পড়ল ধাঁ করে। কতক্ষণে ঘরে ঢুকে পড়তে পারি নিজের সঙ্গে নিজের প্রতিযোগিতা চলত। বাড়ির পেছনেই ছিল পুকুর আর তার ওপাশে এত গাছপালা যে মনে হত গভীর অরণ্য। দিনের বেলা যথারীতি সেই পুকুরপাড়ে আর জঙ্গলে অবাধে ঘোরাঘুরি চলত, ভয়ডর লাগত না।

সেবারে গিয়ে শুনি, দু’দিন বাদে ওই অঞ্চলের সবচেয়ে বড়ো ফুটবল টুর্নামেন্টে আমাদের গ্রামের দল ফাইনালে উঠেছে। চারদিকে সাজো সাজো রব। খেলা নিয়ে আলোচনা, খেলোয়াড়দের দিয়ে অনুশীলন করানো—সব নিয়ে বেশ একটা হৈ হৈ কাণ্ড সারা গ্রামে। বল-খেলা মাঠের মিনিট দশেকের মধ্যে আমাদের বাড়ি হওয়াতে, সকাল বিকেল আমাদের অবশ্য-গন্তব্য হল ওই মাঠ। এই মাঠেই অনুশীলন করে গ্রামের বহু খেলোয়াড় পরে কলকাতার মাঠে ফার্স্ট ডিভিশনে বিভিন্ন নামীদামী ক্লাবে গিয়ে খেলে নামও করেছে। এমনকি বিখ্যাত অ্যাথলিট জ্যোতির্ময়ী শিকদারও এই গ্রামেরই মেয়ে আর এখানেই সেও দৌড় অনুশীলন করত। তো মাঠে গিয়ে বল কুড়নোর কাজটা মুফতেই মিলে গেল। গ্রামের দু-চারজন কর্তাব্যক্তিও মজুত সেখানে।

খেলার দিন সকালে আমাদের পাড়া থেকে জনা বিশেকের দর্শক-দল হল। খেলা হবে ভাবতা গ্রামে। বেলডাঙা পেরিয়ে সারগাছির কাছাকাছি ভাবতা গ্রাম। সেখানে হাই মাদ্রাসার ইস্কুল মাঠে খেলা। আমার পিসতুতো দাদারা তো আছেই, তার বন্ধুরা, আমার বন্ধুরা সকলে মিলে ট্রেনে করে চললাম। দুপুর আড়াইটে থেকে খেলা। সত্তর মিনিটের। আমার একটা কোট ছিল, ঠাণ্ডা লাগবে বলে, ঠাকুমা জোর করে সে কোটটা পরিয়ে পাঠিয়েছিল। ট্রেন অবধি ব্যাপারটা ঠিকই ছিল। ট্রেন থেকে নেমে যত মাঠের দিকে যাচ্ছি আমার নিজেকে কেমন বেকুবের মতো লাগতে থাকল। গোটা গ্রামের মিছিলে আমাকে খুব সহজে আলাদা করা যাছে, হাফ প্যান্টের ওপরে একখানা কোট পড়া, স্পষ্টত বেমানান এবং চারপাশের সমবয়সীদের চেয়ে আলাদা। আমার গ্রামের বন্ধুরা কলকাতায় থাকি বলে আলগা তোল্লা দেবার চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে কেমন গুটিয়ে যেতে থাকি। শেষে ধুত্তোর বলে কোটটা খুলে দাদার কোলে ফেলে দিয়ে আমাদের গোল পোস্টের কাছে এসে দাঁড়াই। সেখানে আমার বন্ধুরাও ছিল। তখনই একটা কালো রঙের ঝাঁকড়া চুলের ছেলের দিকে নজর পড়ল। কালো হাফ প্যান্ট, হলদে সবুজ জার্সি আর পায়ে কালো স্পাইক শ্যু। মাঝ-মাঠে বল নাচাচ্ছে।

“ও হইল কালু। ওর মতো ফুটবল খেলতে এ-তল্লাটে আর কেউ পারে না। খালি ওরেই ভয়।”

“ও কি অন্য দলে?”

“তয় কি? আমগো নাকি?”

আমাদের দলেরও প্যান্ট কালো রঙের তবে জার্সি গাঢ় নীল। সতুদা গোলে। সত্যব্রত মিত্র। মিত্রবাড়ির ছোটো ছেলে। মিত্ররা গ্রামের বড়ো ঘর। ও একটা লাল ফুল হাতা জার্সি পরা। পিঠে নিরানব্বই নম্বর। ক্যাপ্টেন প্রসাদদা। ইস্টবেঙ্গলের প্লেয়ার। প্রসাদ তরফদার। বল-খেলা মাঠের পাশেই ওদের বাড়ি। মাঠে ওর হাঁটাচলাই অন্যরকম। আবার বড়ো ক্লাবের প্লেয়ার বলে কথা! এদিক ওদিক বাকি সকলেই বল নিয়ে দৌড়োচ্ছে, শট করছে। খেলা শুরুর আগে খানিক গা ঘামিয়ে নিচ্ছে আর কী।

খেলা শুরু হতে মিনিট দশ পনেরো বাকি। আমার থেকে থেকেই চোখ চলে যাচ্ছে কালুর দিকে। টানটান ইস্পাতের মতো ঝকঝক করছে ছেলেটা। বল নিয়ে দু’পায়ে নাচাতে নাচাতে ঘুরে গিয়ে আবার মাথায় রিসিভ করে পায়ে নামাচ্ছে, মাটিতে পড়তে দিচ্ছে না। লোকজন হৈ হৈ করে উঠছে। চারপাশে একটুও জায়গা ফাঁকা নেই। লোকে লোকারণ্য। মাঝ-মাঠ বরাবর লাইনের ধারে একটা মঞ্চ করা হয়েছে। সেখানে গণ্যমান্যরা বসে। পুরস্কার-টুরস্কারগুলো সব সেইখানেই রাখা।

খেলা শুরুর মিনিট তিনেকের মাথায় বিপক্ষ সারগাছি স্পোর্টিং ক্লাবের গোলে বল ঢুকে গেল। ওদের পেনাল্টি বক্সের বাইরে থেকে প্রসাদদার নেয়া একটা বাঁ পায়ের কোনাকুনি শট জালে জড়িয়ে গেল। গোল কিপার বুঝতেই পারেনি। আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলাম। খেলা চলল। নজর কাড়ার মতো না হলেও কালু ভালোই খেলছিল। কিন্তু গোল দিতে পারছিল না। আমরা অবশ্য অনেকেই ঠাকুরকে ডাকছিলাম যাতে ও গোল না দিতে পারে। আমাদের খেলোয়াড়রাও ভালো খেলছিল, কিন্তু বিপক্ষের দু’জন ডিফেন্ডার বারবারই আক্রমণ রুখে দিচ্ছিল। মাঠ জুড়ে দর্শকদের তুমুল চিৎকার। বিরতি হবে হবে, এমন সময় কেউ একজন মাঠের পাশ থেকে সব চিৎকার ছাপিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “কালু, তরে গোল পিছু পঞ্চাশ টাকা দিমু। তুই ঢুকাইয়া যা!”

চট করে ওপাশে তাকিয়ে দেখি, কালু হঠাৎ থেমে একবার মঞ্চের দিকে দেখল কয়েক সেকেন্ড, তারপর অদ্ভুত কায়দায় বলটা দু’পায়ে পেছন থেকে শূন্যে তুলে লাফ দিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে আবার বলটা ধরে ফেলেই ছুটে আসতে লাগল আমাদের দিকে। এর মধ্যেই আমাদের চন্দনদা, পলাশ আর বাবুদা ওকে আটকাতে গিয়ে বল তো দূর, ছুঁতেও পারেনি ওকে। পেটের মধ্যে কেমন গুড়গুড় করছিল, গোল খাবার ভয়েই বোধহয়। খানিকটা ধুলো উড়ল দেখলাম, আর আমাদের জালে বল। সতুদা ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে। বল কুড়িয়ে ফেরত দিতে দিতে হাফ টাইমের বাঁশি পড়ে গেল। বিরতির সময় বিস্তর কথাবার্তা হল; কৌশল, কায়দা, অন্ধি সন্ধি অনেক কিছু ঠিক করা হল, আমরাও আমাদের দর্শকাসন বদলে ফেললাম। এবারে গোল পোস্ট বদল হবে। আমরা উলটোদিকের গোল পোস্টে চলে এলাম। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বার পোস্ট ছুঁয়ে তুকতাক করে এল, যাতে আর গোলে বল না ঢোকে।

হা হতোস্মি! কিছুতেই কিছু হল না। শেষমেশ আমরা হেরেই ফিরলাম। রানার্স আপ। আমাদের খেলোয়াড়রা যথেষ্ট ভালো খেলেও জিততে পারল না। সেকেন্ড হাফে দেখার যেন ম্যাজিক দেখাতে লাগল কালু। ফার্স্ট হাফের কালু যেন নয়, এ যেন অন্য লোক। আরও তিন-তিনটে গোল সে একাই দিল। মাঠে ওকে ফুটবলের রাজপুত্রের মতো লাগছিল। যেন গোটা মাঠে ওই একটাই নায়ক। মাথায় সোনার মুকুট। ওকে দেখে ওর দলের খেলোয়াররাও জানপ্রাণ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। যথারীতি ম্যান অব দা ম্যাচের একশো টাকাও ও-ই পেল।

বলাই বাহুল্য, খেলা শেষে আমাদের মন ভালো ছিল না। সারা মাঠ একটাই আলোচনা, কালু কালু কালু…

“অরে হায়ার কইরা আনে সারগাছি। ও সারগাছির ছেলে না।” ফেরার পথে ট্রেনে বসে আমাদের বড়োদের কেউ বলল।

“তয়? কই থাকে ও?”

“জামালপুর।”

“ও ফুটবলের খেপ খেইলাই শ্যাস হইব। অভাবের সংসার! কী করব! কলকাতায় গেলে বড় প্লেয়ার হইত।”

***

তখন রাত্রি নেমে গেছে। সাতটার ডাউন লালগোলা পাগলাচণ্ডী স্টেশনে ঢুকছে। রেল কামরার ম্রিয়মাণ হলদে আলোয় কোনাকুনি জানালার ধারের একলা সিটে দু’জন বসে আছে। একটি যুবক, গায়ে মেটে রঙের চাদর। তার পাশে একটি হাফ প্যান্ট পরা বালক। একই সিটে ঠাসাঠাসি বসে আছে। বালকটি বলছে, “দাদা! আজ কত টাকা পাইলি?”

“তিনশো।”

“কাল মাংসভাত হইব? বাড়িতে?” বালকটির চোখ চকচক করে ওঠে।

যুবকটি সস্নেহে হাত বুলিয়ে দেয় ভাইয়ের মাথায়। যুবকটিকে কেমন চেনা চেনা ঠেকে অনেকের, কিন্তু মেলাতে পারে না। কেননা যার সঙ্গে তার মিল, তার দেহে ছিল ঘোড়ার ক্ষিপ্রতা, চোখ ধারালো। এখনকার ছেলেটি নিষ্প্রভ, গায়ে একটা আধময়লা চাদর, দু’চোখভরা মায়া মায়া নরম দৃষ্টি।

স্টেশনে নেমে যাবার মুখে যুবকটির চাদরের নিচ থেকে কালুর কিট ব্যাগটা উঁকি মারল হঠাৎ।

ছবি:মৌসুমী

জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে

3 thoughts on “গল্প কালু শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় শরৎ ২০২০

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s