পল্লব চট্টোপাধ্যায়-এর আগের গল্প কুট্টিবাবুর মুগ্ধবোধ
আমাদের মুচিপাড়ার প্রবীনতম বাসিন্দা চিরনবীন কুট্টিবাবু তাঁর সিরাজউদ্দৌলার সম্পত্তি থেকে নিলামে কেনা আরামকেদারাতে সকাল সকাল বসে বসে দোল খাচ্ছেন, এমন সময় ভোঁদড়, নেপাল আর গোবিন্দের হই-হই করে আবির্ভাব।
“বুঝলে কুট্টিবাবু, পড়াশুনা করে আর কী হবে?” ভোঁদড়ের ব্যাকুল আক্ষেপ, “বড়লোক হয়ে হয়তো দুটো টাকাই কামাতে পারব। নাম কামানোটা আর অত সহজ রইল না।”
“ব্যাপারটা কী বল দিকিন?” কুট্টিবাবু শুধোন, “এখনও দাড়ি কামাতে শিখলি না, আর নাম কামাবার চিন্তা! ক্যান রে, তোকে আটকাচ্ছে কে?”
“মানে এই নিউটন-মার্কনিদের কথা বলছি। দুনিয়ার যেখানে যা কিছু দেখছি সব আবিষ্কার করে রেখেছে! আমাদের জন্যে আর কিছুই নেই।”
“আচ্ছা কুট্টিবাবু, সত্যি কি পৃথিবীতে কোনও প্রশ্নের উত্তর অজানা নেই?” নেপাল শুধোয়।
“আরে তোরা যেমন!” কুট্টিবাবু ভরসা দেন। “অনেক প্রশ্নই এমন আছে যা লোকে জানে না, তায় উত্তর দেবে কী?”
“যেমন?”
“এই যেমন ধর, শ্রীলঙ্কার লঙ্কার থেকে আমেরিকার লঙ্কা কেন বেশি ঝাল? বম্বেটের উৎপত্তি কি বম্বে থেকে? শিং নেই, গর্জনটাও sing নয়, তবুও সে সিংহ কেন? কোনটা বেশি ভয়ের, মেশিন গান না হিন্দি সিনেমার গান? অঙ্ক আর আতঙ্ক—দুটো শব্দে এত মিল কেন? ভূগোলের নম্বরের জায়গায় মাঝেমাঝেই জোড়া গোল বসে কেন…”
“থাক থাক, অনেক বুঝেছি।” গোবিন্দ কুট্টিবাবুকে থামিয়ে দেয় মাঝপথে।
ইতিমধ্যে ভ্যাবলাকান্ত এসে হাজির হয়েছে। কুট্টিবাবুর মুগ্ধবোধ পরামর্শে কান দিয়ে ও সংস্কৃত খাতায় যা লিখেছিল তাই দেখে পরীক্ষক নাকি মুগ্ধ হয়ে নম্বর দিতেই ভুলে গেছিলেন। তারপরেই কুট্টিবাবুর সঙ্গে ভ্যাবলার কট্টি, মানে আড়ি। শেষে আর থাকতে না পেরে এই ক’দিন হল আড্ডায় আবার নিয়মিত হাজিরা দিতে শুরু করেছে। কিন্তু প্রতিজ্ঞা প্রতিজ্ঞাই—আর কোনও কথায় কান দেবে না কুট্টিবাবুর।
আরে মোলো, চুপ করে কাঁহাতক থাকা যায়! পেটের মধ্যে মোচড় খেতে খেতে কথাটা শেষপর্যন্ত বেরিয়েই পড়ল। “কুট্টিবাবু, এরকম কেন হয় বলতে পারো? বাবা জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ রে তোদের অঙ্ক কে পড়ান? প্রহ্লাদবাবু বলতে গিয়ে ভুল করে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল জল্লাদবাবু।”
কুট্টিবাবু মিনিট দুই একটু হেঁ হেঁ করে হেসে আরাম-কুর্সিটায় একটু নড়েচড়ে নিলেন। তারপরেই হুঁকোয় দুটো টান দিয়ে হঠাৎ গম্ভীর গলায় বললেন, “হ্যাঁ রে নেপাল, তোর ঠাকুমার দাঁত নড়ছিল, ভালো আছেন তো? তারপর, ভোঁদড়ের ভাগ্নের অন্নপ্রাশন কেমন কাটল? উহ্, তুইও মামা হয়ে গেলি শেষপর্যন্ত! বাপস, পেঁয়াজের দাম বাড়ছে হু হু করে! বিরাট সচিনের রেকর্ডটা ভাঙবেই একদিন, কী বলিস?”
“কুট্টিবাবু!” ভ্যাবলা শুরু করে।
“ও হ্যাঁ ভ্যাবলা,” কুট্টিবাবু মাঝপথেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, “তোর বাবা ভালো আছেন তো?”
“হ্যাঁ ভালোই তো।” ভ্যাবলা একটু থতমত খায়।
“আর তাঁর ছেলে?”
“ছেলে? বাহ্, এই তো আমি এখানে!”
“সে তো দেখতেই পাচ্ছি জলজ্যান্ত চোখের সামনে। কিন্তু তার মস্তিষ্কের কোনও কোষে কষে গিঁট নাকি স্নায়ুতন্ত্রীতে গ্রন্থি পড়ে গেছে তা তো আমরা জানি না।”
“তার মানে? বলতে চাও আমার মাথা খারাপ হয়েছে, আমি পাগল!”
“অত প্রাঞ্জল করে বলিসনে বাপ! পাগলের নামেই আমার প্রাণ জল হয়ে আসে। পাগল আমিই, নইলে তোকে মুগ্ধবোধ শিক্ষা দিই, তোর মতো মুগ্ধ, মানে মূর্খকে!”
“ঘাট হয়েছে, কুট্টিবাবু।” এইবার ভ্যাবলানন্দের মুখে হাসি ফুটল। “মাপ চাইছি। যা হয়েছে, হয়েছে। আমার কথাটা শুনেছ? প্রহ্লাদবাবু…”
“ও, ভুলের কথা বলছিস? হ্যাঁ, ওই হল একটা শব্দ যা বিশ্বসুদ্ধু লোক ভুল বলে, ভুল পড়ে, ভুল উচ্চারণ করে, ভুল লেখে। ভুল সম্বন্ধে সিংহমুণ্ড মানে আমার বন্ধু ফ্রয়েড বলেছিলেন…”
এই ফাঁকে চুপিচুপি জানিয়ে রাখি, গোবিন্দদের সঙ্গে কুট্টিবাবুর একটা অলিখিত চুক্তি আছে যে গুলকে গুল বলে দাবি করা তো দূরের কথা, গুল ভাবতে পর্যন্ত পারবে না তারা, যদি তা কুট্টিবাবুর মুখনিঃসৃত হয়। সুতরাং কুট্টিবাবু কী বলেন শোনাই যাক।
“…যাক গে, কিছু একটা বলেছিলেন, অতশত মনে নেই, অনেকদিন হল কিনা! আচ্ছা একটা ঘটনা বলি। বললে তোরা কেউ বিশ্বাস করবি না…”
“একদম করব না। স্বচ্ছন্দে চালিয়ে যাতে পার।” গোবিন্দ আশ্বাস দেয়।
ইতিমধ্যে কুট্টিবাবুর মধ্যযুগীয় বান্দা হারুণ এসে দাঁড়াল। হারুণের পরনে বরাবরের মতো চোঙা পাজামা, চিকনের কুর্তা, মাথায় মোগলাই পাগড়ি, হাতে ট্রে, তাতে পাঁচ কাপ গরম কফি। এটা আমাদের কুট্টিবাবুর বাসার আড্ডার একটা অন্যতম আকর্ষণ। কফিপান শেষ করে কুট্টিবাবু শুরু করলেন তাঁর কাহিনি।
“তবে শোন। স্বাধীনতার সময়কার ঘটনা, তখন আমি কলকাতায়। সেবার ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার মশারাও যেন স্বাধীনতা ঘোষণা করল। রাস্তায়-ঘরে-বাইরে, আলসেয়-উঠোনে-ছাতে সর্বত্র সংঘবদ্ধ হয়ে তারা মশাদের জাতীয় সঙ্গীত গাইতে লাগল—জয় জয় মঁসিয়ে মশক মহাশয়, মসীকালো মশানের ধারে—জয় তার মশকেতে বয় তাজা খুন যারা ভারে ভারে।
“এইভাবে চলতে লাগল তাদের তর্জন-গর্জন। মশাদের দাপটে তটস্থ হরিদাস পাল থেকে রাজ্যপাল, না রাজ্যপাল বস্তুটা তখন ছিল না, তবে বেহাল নগরপাল—কেউ দিতে পারে না সামাল। প্রচণ্ড রায়ট শুরু হয়ে গেল। রক্তগঙ্গা বইতে লাগল। বড়ো বড়ো মশকে… মশক জানিস তো? রাজমিস্ত্রির ভিস্তিরা যে চামড়ার থলিতে জল বইত—ওই তাতে করে বড়ো বড়ো ব্লাড ব্যাঙ্ক ভর্তি করে তুলল। অবশেষে ডাক পড়ল আমার।”
“তোমাকে কেন? তোমার শরীরে আর কতটুকু রক্ত ছিল!” একটা খোঁচা দিল গোবিন্দ।
“কী বললি? ন্যাপলা!” ইশারা বুঝতে নেপালের সময় লাগল না। মুহূর্তে হাজির হল ‘ইন্টারাপশন ফাইন বক্স’, একটাকা গচ্ছা গেল গোবিন্দের। এবার সন্তুষ্ট হয়ে কুট্টিবাবু আবার চালু করলেন তাঁর কাহিনি।
“তবে শোন। আমার হাতে দেওয়া হল মশক-বিতাড়নের দায়িত্ব। সঙ্গে-সঙ্গেই আমি রওনা হয়ে গেলাম ওমান দেশের মশকাট শহরে, নিয়ে এলাম দুটো বড়ো বড়ো কামান।”
“কামান আনতে ওমান! কেন, আন্দামানে পাওয়া যেত না?”
“মশকরা হচ্ছে! তার চেয়ে বল না, বর্ধমান গেলেই হত! এ কি তোদের মশাগ্রামের মশা পেয়েছিস—একেকটা চড়ুইপাখির মতো সাইজ, হ্যাঁ! যেমন মশা তেমনি তার কামান। একটা বসানো হল মনুমেন্টের মাথায়—বনবন করে ঘুরছে আর গোলা ছুটছে শ্যামবাজার থেকে শ্যালদা, আলিপুর থেকে আউট্রাম ঘাট। অন্যটা থাকল উল্টোডাঙা ব্রিজের উপর, তার লং রেঞ্জ, গোলা ছুটছে টালা থেকে টালিগঞ্জ, বালি থেকে বালিগঞ্জ! সে এক প্রচণ্ড যুদ্ধ। ভাবলাম বুঝি এবার পোস্থুমাস অ্যাওয়ার্ড-ফ্যাওয়ার্ড পেয়ে যাব কিছু একটা।”
“পোস্থুমাস কেন গো? সে তো মরণোত্তর, বেঁচে থেকে পাওয়া যায় নাকি?”
“তা হবে। বেশ গালভরা কথাটা, তাই না ভেবে বলে ফেললাম। যাক গে, একটা পরমবীর চক্রও তো পেতে পারতাম!”
কুট্টিবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করলেন এবার।
“তারপর? মশারা দূর হল?” চারজনেরই উৎসুক প্রশ্ন এবার।
“বুঝলি ভ্যাবলা, সকলই কপাল! আসলে সেদিন বাজারে শুনছিলাম একজন পূর্ববঙ্গীয় বয়স্ক ভদ্রলোক এক দোকানদার বন্ধুকে বলছেন, ‘দ্যাশ ভাগ হইসে মশায়, দুই দ্যাশে দাঙ্গা। ঢাকা-বরিশালের মাইনষে দলে দলে আইসে, চাউলের দাম বাড়ব। এই ত সুযোগ মশায়, কামান, এই সুযোগে মশায়, কামান!’ ব্যস, রাত্রে গণ্ডগোলে আর ঘুম আসে না। শুধু মনে পড়ছে ‘মশায় কামান’, আর বাইরে রায়টের দাপট, গুড়ুম গুড়ুম বোমা আর পুলিশের বন্দুকের আওয়াজ! দুঃস্বপ্ন কি আর সাধে হয়! এইজন্যেই তো ফ্রয়েড বলেছিলেন…”
বলা বাহুল্য, কী যে বলেছিলেন সেটা আর সম্পূর্ণ করেন না কুট্টিবাবু।
ছবিঃ জয়ন্ত বিশ্বাস