মুচিপাড়ার প্রবীণতম বাসিন্দা কুট্টিবাবু নিজে কিন্তু চিরনবীন। একসময় ছেলেছোকরাদের কাছে স্বার্থপর দৈত্য বলে পরিচিত ছিলেন। কাজকর্ম কিছু করেন কি না কেউ জানে না, তবে অজস্র বই পড়েন। সকাল থেকে বারান্দায় একটা ইজি-চেয়ারে বসে বই পড়তেন তিনি, মুখে থাকত গড়গড়ার নল। এ যুগে একটু খাপছাড়া ঠেকে বটে, কিন্তু কুট্টিবাবু মানুষটিও তো নেহাত আধুনিক নন। ভয়ে বা ভক্তিতে ছেলেছোকরারা তাঁকে একটু এড়িয়েই চলত। অবশ্য বয়স্ক কাউকেও কখনও ওঁর সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়নি তেমন।
খেলতে খেলতে একদিন পাড়ার ছেলেদের টেনিস বল কুট্টিবাবুর বারান্দায় চলে যায়। ছেলেগুলো রাজ্যের কুলাঙ্গার, মায়ে তাড়ানো বাপে খেদানো চারজন, নাম ভোঁদড়, ভ্যাবলারাম, নেপাল আর গোবিন্দ। ভালো নাম ওদের একটা করে আছে বটে, কিন্তু তা শুধু স্কুলের খাতায়। বলটা ‘সেলফিশ-জায়ান্ট’ কুট্টিবাবুর বারান্দায় যেতেই ওদের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেছে কে যাবে তা উদ্ধার করতে। ঠিক করতে না পেরে শেষমেশ চারজনেই গিয়ে কড়া নাড়ল তাঁর দরজায়। কুট্টিবাবুর চাকর দরজা খুলে দিতেই ভেতর থেকে হাঁক এল, “হারুন, ওদের চারটেকেই ভেতরে পাঠিয়ে দে।”
শুনেই তো ওদের হাত-পা ঠাণ্ডা। ওরকম ঘটোৎকচ মার্কা বিশাল চেহারা, চারজনকে গিলে খেতে না পারলেও পিটিয়ে মারতে পারেন। তবুও সাহস করে এগোল ওরা।
“ক্রিকেট খেলছিলি? তোদের মাঠখানা তো অনেকটা দূরে দেখছি। এত জোরে মারল কে?”
“দাদু, ভ্যাবলা মেরেছে।” ভোঁদড়ের কাতরোক্তি।
“অ্যাই হতচ্ছাড়া, আমাকে দেখে কি তোদের দাদু মনে হচ্ছে? নাম কী তোর?”
“আজ্ঞে জেঠু, আমি ভোঁদড়।”
“জেঠু! জ্যেঠু আবার কী? আমার বয়স কত হবে বল তো?” এবার প্রশ্ন নেপালকে।
“জানি না স্যার, ষাট-সত্তর হবে।”
“বলিস কী রে! ষাট-সত্তর-আশি হয়ে তাহলে তো বুড়ো হয়ে কোনদিন মরেই যাব। জানিস, আমার বয়েস এখন আঠেরো। তোরা আমাকে এবার থেকে কুট্টিবাবু বলবি, কেমন?”
বোঝা গেল, বেশ একটা রসিকতা করলেন কুট্টিবাবু। গোবিন্দ ওদের মধ্যে খুব সুকুমার ভক্ত, নিজেও একটি পাগলা দাশুর অবতার। ও বলে, “হ-য-ব-র-ল’র বুড়োর মতো বয়সটাকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন বুঝি?”
এবার হা হা করে প্রাণখোলা অট্টহাস্য করে উঠলেন কুট্টিবাবু। ব্যস, এক নিমেষেই সবার বন্ধু হয়ে গেলেন তিনি।
“মাঝে মাঝে আসবি, কেমন? আর আপনি নয়, তুমি। আঠেরো বছরের মানুষকে কেউ কখনও ‘আপনি’ বলে! যা, বল নিয়ে পালা এখন।”
চার বন্ধুই এখন কুট্টিবাবুর মুগ্ধ ভক্ত। এক রবিবার সকালে কুট্টিবাবু বসে আছেন তাঁর সেই বিখ্যাত আরামকেদারাটিতে আয়েশ করে। ওটা নাকি নবাব সিরাজউদ্দৌলার নিলাম করা সম্পত্তি থেকে কেনা, কে জানে কতটা সত্যি সে গল্প। উনি গড়গড়ার নলটা সবে টেনেছেন, এমন সময় হুড়মুড় করে ভ্যাবলারাম এসে হাজির। “হেল্প কুট্টিবাবু, বাঁচাও!” ভ্যাবলারামের আর্তনাদ।
“কী ব্যাপার রে, কেউ তাড়া করেছে নাকি? সাতসকালে কার হাঁড়ি ভাঙতে গিয়েছিলে চাঁদ?”
“না, মানে ভোঁদড়ের কাছে খবরটা শুনেই তাড়াতাড়ি…”
“অ্যাঁ! তাড়ির হাঁড়ি ভেঙেছিস? আহা রে, না ভেঙে যদি নিয়ে আসতিস! না না, সবাই মিলে ভাগ করেই খাওয়া যেত।”
“দুত্তেরি তোমার তাড়ি! এবার পাততাড়ি গোটাতে হবে দেখছি এখান থেকে। আমার কিনা এখন শিরে সংক্রান্তি, শিরা ছিঁড়ে যাবার যোগাড়!”
“সংক্রান্তি? বলিস কী রে! আজ যে মোটে দোসরা পৌষ। আহা, সংক্রান্তিটা কবে আসবে রে? বেশ পিঠে খাওয়া যাবে।”
“ভালো জ্বালা! তোমার কেবলই দেখি খাওয়ার চিন্তা। আসলে আমার শিরেসংক্রান্তি নয়, সংস্কৃত।” ভ্যাবলারাম ভুলটা সংস্কার করে নেয়।
“সংস্কৃত? ঐ মানে অং-বং-চং?”
“হ্যাঁ, কাল আমার সংস্কৃত পরীক্ষা। অন্যগুলো কোনওমতে পার হয়েছি, তা এইটে হল গিয়ে বিভীষণ। না, কী যেন… বিসূচিকা!”
“বিভীষিকা?”
“ও হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই। মানে খুব ভয়ের ব্যাপার। ভোঁদড় তাই শুনে তোমার কাছে পাঠাল। বলল, কুট্টিবাবু আমাদের বহুরূপী!”
“অ্যাঁ! তা হ্যাঁ রে, ভোঁদড়কে দেখছি না তো!”
বলতে বলতেই ভোঁদড় হাঁপাতে হাঁপাতে হাজির। “উরিব্বাস, খুব বেঁচে গেছি! এই রবিবারেও দেখি অঙ্কের টিউটর। পরশু অঙ্ক পরীক্ষা কিনা, আজও এসে হাজির। আমি তো দেখেই ভোঁ দৌড়।”
“নামের উপযুক্ত কাজটিই করেছ।” কুট্টিবাবু স্বীকৃতি দেন। “তা হ্যাঁ রে, আমার সম্বন্ধে কীসব উলটোপালটা বলেছিস ভ্যাবলাকে?”
“আমি? কই, না তো!”
“ঐ যে বহুরূপী। জানিস সেটা একধরনের গিরগিটি, যারা ঘন ঘন রঙ বদলায়?”
“এই দ্যাখো! বহুরূপী কেন হতে যাবে, আমি বলেছি বহুদর্শী, মানে যে অনেক কিছু দেখেছে।”
“তা দেখেছি বটে। একবার কী দেখেছিলাম জানিস? একটা গরু একটা গাছের মগডালের পাতা খাচ্ছে।”
“যাহ্, সে তো কেবল গল্পে হয়, গরু গাছে ওঠে।”
“হ্যাঁ রে, পুরোটা শুনবি তো! গাছটা ছিল চার ফুট উঁচু একটা জংলি কুলগাছ।”
এমন সময় নেপাল আর গোবিন্দ এসে ঢোকে। ভোঁদড় আর ভ্যাবলাকে হাসতে দেখে ওরা ভাবে নিশ্চয়ই একটা কিছু হাসির ব্যাপার ঘটেছে, তাই ওরাও বোকার মতন খুব হাসতে থাকে। হঠাৎ ভ্যাবলা মুখটাকে কাঁদো কাঁদো করে বলে, “কুট্টিবাবু, আমাকে রেসক্যু করো, আমি সং…”
“ওহ্, আবার ইংরেজি বুলি ঝাড়া হচ্ছে! তোকে সং সাজতে কে বলেছিল?”
“আরে না না কুট্টিবাবু, ভ্যাবলা সং সাজেনি, কাল ওর সংস্কৃত পরীক্ষা, তাই বলছিল।”
“ও, তাই বল। জানিস, আমি একবার সংস্কৃতে ছিয়ানব্বই পেয়েছিলাম?”
“অসম্ভব!” সবাই একযোগে নস্যাৎ করে দেয় দাবিটাকে।
“কী বললি? পাইনি! প্রমাণ চাস?”
“ওরে ব্বাবা! প্রমাণ চাইব তোমার কাছে? তার চেয়ে বরং কী করে পেয়েছিলে তাই বলো, শুনে মুগ্ধ হই।” নেপাল একটু তোয়াজ করে কুট্টিবাবুকে।
“তবে শোন।” কুট্টিবাবু শুরু করেন তাঁর কাহিনি। “মুগ্ধবোধ থেকেই শুরু করি। তখন আমরা পড়ি বোপদেবের মুগ্ধবোধ আর বিদ্যাসাগরের কৌমুদী। পণ্ডিতমশাই ক্লাসে ঢুকতেই আমরা তারস্বরে পড়তে শুরু করে দিতাম – নরঃ নরৌ নরাঃ। ভুল করলেই পণ্ডিতের ধমক, বেঞ্চির উপর দাঁড়াঃ। অমনি সমবেতকণ্ঠে শুরু হত,
গজঃ গজৌ গজাঃ
খেতে বড়ো মজা।
ফলম ফলে ফলানি
পরের গাছে ঝোলানি।
আমরা কুড়োই তলানি,
পাড়তে গেলেই প্যাঁদানি।
ইত্যাদি ইত্যাদি…
“পণ্ডিতমশাই পদ্য শুনতে খুব ভালোবাসতেন। তাই এভাবে কিছুক্ষণ দুলে দুলে পড়তেই ঘুমপাড়ানি ছড়া শুনে বাচ্চাদের যেমন হয়, উনিও নাক ডাকাতে শুরু করতেন। সঙ্গে-সঙ্গেই আমাদের পলায়ন। কাজেই পড়াশুনো কেমন হত বুঝতেই পারছিস!” কুট্টিবাবু থামলেন।
“তাহলে নাইনটি সিক্স!” গোবিন্দের ব্যাকুল প্রশ্ন।
“বলছি, বলছি। সম্রাট বিক্রমাদিত্য আর কালিদাসের সেই গল্পটা শুনেছিস কি, সেই যে এক চিত্রকর রাজমহিষী ভানুমতীর ছবি এঁকেছিল, কালিদাস তা দেখেই বললেন ‘একদম হয়নি’?”
“না, শুনিনি। শুনছি, বলে যাও।” নেপাল বলে।
“শুনে সম্রাট তো অবাক। ‘কী বলতে চাও, মহাকবি?’ তিনি জানতে চান। ‘আমি লিখে জানাচ্ছি’ বলে কালিদাস কলম ডোবান কালিতে। কিন্তু বেশ কিছুটা কালি ছিটকে পড়ে ছবিতে ভানুমতীর পায়ে, একটা তিলের মতো হয়ে যায়। ‘এবার ঠিক হয়েছে,’ কালিদাস বলেন। কিন্তু সম্রাট রেগে আগুন, ‘রানির চেহারা এত নিখুঁতভাবে তুমি কী করে জানলে হে কালিদাস?”
“কী আবোলতাবোল বকছ, কুট্টিবাবু? ধান ভানতে শ্যামাসঙ্গীত! সংস্কৃতের সঙ্গে এর কী সম্বন্ধ?”
“কথাটা শ্যামাসঙ্গীত নয়, শিবের গীত। আছে হে ভ্যাবলানন্দ, সম্পর্ক আছে। ঠিক এরকম ব্যাপারই সেদিন ঘটেছিল কিনা! সংস্কৃত পরীক্ষার দিনে পেপারটা দেখেই না আমার ভীষণ ঘুম পেয়ে গেল। রাত জেগে পড়া, অথচ কিছুই প্রায় জানি না। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কী যে লিখেছিলাম মনে নেই, বোধ করি উত্তরগুলো বাংলায় লিখে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ হেঁড়ে গলার চিৎকারে তন্দ্রা ছুটল। ‘কী র্যা কুট্টি, তুই এখানে বসে ঘুমোবি, আর পরীক্ষাটা বুঝি আমি দেব?’ পণ্ডিতমশাইয়ের গলা। আজ ব্যাপারটা গেছে উলটে, অর্থাৎ কিনা তিনি জেগে আর আমি ঘুমিয়ে। আমি তো চমকে জেগে উঠেছি। কলমটা ছিল হাতে ধরা, তখনকার দিনের ফাউন্টেন পেন, বুঝলি কিনা, সেটা ফসকে গেল হাত থেকে, পড়ল গিয়ে খোলা খাতার উপর। পরীক্ষার ফল বেরোতে দেখা গেল আমি পেয়েছি নাইনটি সিক্স!”
“পণ্ডিতমশাই নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে-ঘুমিয়েই মার্কিং করেছিলেন।” ভোঁদড় নিশ্চিত।
“হেঁ হেঁ, তোরা ছেলেমানুষ, অতশত কি বুঝিস?” এবার আলোয় আসেন কুট্টিবাবু। “আসলে কী হয়েছিল জানিস, কলমটা হাত থেকে ছিটকে পড়ে কালি ছিটকে যেখানে যেখানে পড়ার কথা, পড়ে গেছিল, পড়ে অনুস্বার-বিসর্গ-চন্দ্রবিন্দু জায়গামতো লেগে গিয়েছিল। আর জানিসই তো বাংলাভাষায় অনুস্বার-বিসর্গ লাগলেই সংস্কৃত। কালিদাস তাই বলেছিলেন সম্রাট বিক্রমাদিত্যকে, মাঝে যদিও একটা স-সে-মি-রা’র গল্প আছে-
‘দেবতার প্রসাদেতে গুরুর কৃপায়,
জিহ্বা-অগ্রে সারদা বিরাজে মহাশয়।
নতুবা এ রূপ কথা কোনজন জানে,
ভানুমতী ঊরুদেশে তিলের সন্ধানে?’*
“হেঁ হেঁ, অবিকল কালিদাসের গল্পটা। কালিদাস যা পারেন তা তোদের কুট্টিবাবু পারবে না, বলিস কী রে!”
“আলবাত পারে, আলবাত পারে। আর কুট্টিবাবু যা পারেন তা এই ভ্যাবলারাম পারবে না? যাই, কলমে কালি ভরি গিয়ে।” ভ্যাবলা ছুট দিল।
তারপরে অবশ্য ভ্যাবলারামের ভাগ্যে কী জুটেছিল তা এখনও জানা যায়নি, কারণ কুট্টিবাবুর সঙ্গে তার কাট্টি, মানে আড়ি, এখনও, আজ পর্যন্ত।
* মাধবচন্দ্র পাল ও বিশ্বম্ভর লাহা প্রণীত ‘বত্রিশ সিংহাসন’ পুস্তক থেকে।