রুমা ব্যানার্জি
১
“মিথ্যে কথা।”
“না রে, সত্যি বলছি দেখিস।”
“না, সত্যি বলছ না তুমি। তুমি মিথ্যেবাদী।” বলেই হাতের বলটা দুম করে ছুড়ে দেয় কুট্টুস। তারপর দৌড়ে গিয়ে মুখ লুকায় ঠাম্মার কোলে।
ঠাম্মা রান্নাঘরে বসে বসে রান্নার আয়োজন করছিল; কুট্টুস গিয়ে কোলে মুখ লুকাতেই বলে উঠল, “কী হয়েছে, গোপাল?”
“ঝরনাপিসিকে খুব করে বকে দাও ঠাম্মি তুমি।” কাঁদো কাঁদো গলায় বলে ওঠে কুট্টুস।
“ও মা, কেন! সে আবার কী করলে?” হাতের শাকগুলো বেছে ঝুড়িতে রাখতে রাখতে ঠাম্মা বলে ওঠে।
“ঝরনাপিসি বাজে, পচা, মিথ্যে কথা বলে।”
গৌরীদেবী এবার ডাক দেন, “ঝরনা, ও ঝরনা, কোথায় গেলি রে?”
ঝরনা হি হি করে হাসতে হাসতে এসে মাছের চুপড়িখানা রান্নাঘরের দাওয়ায় রাখে। তারপর দাওয়ার এককোণে রাখা নুন আর হলুদের কৌটো থেকে নুন-হলুদ নিয়ে মাছে মাখাতে মাখাতে বলে, “ও গো, ওকে বলেছি কাল তোর মা তোর জন্যে একটা বোন নিয়ে আসবে। সেই শুনেই কান্না। কিছুতেই বিশ্বাস করবেনি আমার কথা।”
গৌরীদেবী কিছু বলার আগেই কুট্টুস বলে ওঠে, “না। মায়ের শরীর খারাপ, তাই ডাক্তার আঙ্কেলের কাছে গেছে। আসবার সময় আমার জন্যে গিফট আনবে বলেছে। তুমি কিচ্ছু জানো না।”
এবার ঠাম্মাও হেসে ওঠে বলে, “ওরে বোকা, বোনটাই তোর সবথেকে বড়ো গিফট রে।”
কুট্টুস থমকে গিয়ে ঠাম্মার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। ঠাম্মা বলে যায়, “ঝরনাপিসি তো ঠিকই বলেছে। দেখবি কালকে মা তোর জন্যে একটা ছোট্ট বোন আনবে। বাবা যাবে, আমি যাব, গাড়ি করে গিয়ে বোনটাকে নিয়ে আসব আমাদের বাড়ি।”
কুট্টুস বড়ো বড়ো চোখ করে শোনে ঠাম্মার কথা। শুনতে শুনতে চোখদুটো জলে ভরে ওঠে। ঠাম্মা তাড়াতাড়ি ওকে কোলে টেনে নেয়। “ও মা, সোনা কাঁদছ কেন!”
ঝরনাপিসি আবার হি হি করে হেসে ওঠে। কুট্টুস এবার আরও জোরে কেঁদে ওঠে।
২
ছাদের এককোণে কুট্টুসের নিজের জগত। সেখানে ছাউনির তলায় বসে বসে সে খেলে। যদিও মা তাকে মোটেই ছাদে আসতে দেয় না, কিন্তু ছাদটাই যে কুট্টুসের সবচেয়ে প্রিয়। তাই যখনই কেউ ছাদে আসে কুট্টুসও তার সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে। ছাদে কত সুন্দর গাড়ি চালানো যায়। গাড়ি গাড়ি খেলা কুট্টুসের খুব পছন্দের খেলা। পিপ পিপ পিপ পিপ করে গাড়ি ছোটে। কিন্তু আজ কিছুতেই মন নেই কুট্টুসের। বাড়িতে এখন শুধু সে, দাদু আর ঝরনাপিসি। অন্যদিন হলে ঝরনাপিসি তার পিছনে পিছনে দৌড়ে দৌড়ে হাঁপিয়ে যেত। কিন্তু আজ কুট্টুস চুপ করে বসে আছে ছাদে দাদুর কাছে। দাদু কাগজ পড়ছে বসে বসে।
ঠাম্মা, বাবা সবাই গেছে মাকে নিয়ে আসতে। মা আসবে ভাবলেই মনটা খুশিতে ভরে যাচ্ছে। মাকে ছেড়ে কুট্টুস কোনোদিন থাকেনি। কিন্তু যখন শুনেছিল মায়ের শরীর খারাপ, ডাক্তারখানায় থাকতেই হবে শরীর ভালো করতে তখন ও আর বায়না করেনি। মা বলেছিল, “কুট্টুস আমার খুব ভালো ছেলে। আর ও তো বড়ো হয়ে গেছে, মায়ের কষ্ট বোঝে। আমি আসবার সময় ওর জন্যে গিফট নিয়ে আসব।”
কুট্টুস সেই বিশ্বাস নিয়েই ছিল। কিন্তু এখন তো সবাই বলছে, ঝরনাপিসি, ঠাম্মা, বাবাই সবাই, যে মা আসলে একটা বোন নিয়ে আসছে। কুট্টুস তো ভেবেছিল মা ওর জন্যে নিশ্চিত একটা এরোপ্লেন নিয়ে আসবে। কুট্টুস তো মাকে বলেই রেখেছিল ঋজুদাদার মতো একটা এরোপ্লেন কিনে দেবার কথা। মা কেন সত্যি কথাটা বলল না ওকে? ভাবতে-ভাবতেই ওর চোখ আবার জলে ভরে যায়। মা তার মানে আর ওকে ভালোবাসে না। কারণ, কুট্টুস যখনই মাকে মিথ্যে কথা বলে আর মা ধরে ফেলে, তখন মা সবসময় বলে, “তুমি মাকে মিথ্যে বলছ, কুট্টুস? তার মানে তুমি মাকে আর ভালোবাসো না।”
আর এখন মা মিথ্যে বলল কুট্টুসকে!
“কুট্টুসবাবু, কী এত ভাবছ? খিদে পেয়েছে নাকি?” দাদু খবরের কাগজের আড়াল সরিয়ে বলে ওঠে।
কুট্টুস ঘাড় নাড়ে।
দাদু কাগজের পরের পাতা ওলটাতে ওলটাতে বলে ওঠে, “তাহলে মনখারাপ করছ কেন? মা তো আর একটু পরেই এসে যাবে।”
কুট্টুস চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ায়। রাস্তার দিকে তাকিয়ে একবার দেখে গাড়িটা আসছে নাকি। তারপর আবার বসে নিজের খেলনা গাড়িটা নিয়ে খুটখুট করতে শুরু করে। কুট্টুস জানে ভাই, বোন হলে আগের জনকে আর কেউ ভালোবাসে না। মনশ্রী ওদের ক্লাসেই পড়ে, ওদের পাড়াতেই থাকে। ওর একটা বোন হয়েছে কিছুদিন আগে। কুট্টুস শুনেছিল, মনশ্রীদের পাশের বাড়ির কাকিমা মনশ্রীকে বলছিল, “দেখবি তোকে আর কেউ ভালোবাসবে না। নতুন বোনটাকেই খেলনা, মিষ্টি সব দেবে।”
মনশ্রীও সেদিন কাঁদছিল শুনে। না। কুট্টুস কিচ্ছু দেবে না নতুন বোনটাকে। সব খেলনা লুকিয়ে রেখে দেবে। ওর মিষ্টিও দেবে না। বাবা অফিস থেকে আসবার সময় রোজ ওর জন্যে মিষ্টি নিয়ে আসে। এবার থেকে বাবা বাড়ি ফিরলেই ও ব্যাগ থেকে বের করে নেবে। আচ্ছা, বোনটা কি ওদের সঙ্গেই রাত্রে ঘুমাবে? মায়ের পাশেই শোবে? কুট্টুস কি আর তাহলে শোবে না মায়ের পাশে? ওর যে মায়ের পাশে না শুলে ঘুমই আসে না। এইসব ভাবতে ভাবতে কুট্টুস আবার উঠে দাঁড়ায়। আর ঠিক তখনই নিচে একটা গাড়ির আওয়াজ শোনা যায়। ঝরনাপিসি নিচে থেকে চিৎকার করে ওঠে, “কুট্টুস, দেখবি আয় বোন এসেছে!”
কুট্টুস ছুটে গিয়ে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়ে। সে কিছুতেই বোনটাকে দেখবে না, নিচেও যাবে না যতক্ষণ না মা বোনটাকে ফেরত দিয়ে আসে।
৩
“আড়ে বাড়ে, লম্বে বাড়ে, মা ষষ্ঠীকে গড়টি করে।”
কুট্টুস আড়চোখে তাকিয়ে দেখে, ঠাম্মা বোনটাকে তেল মাখাচ্ছে বারান্দায় রোদে মাদুর পেতে শুইয়ে। কুট্টুস বসে বসে ছবি আঁকছে বারান্দায়। ওর মনটা খুব খারাপ। কতদিন হয়ে গেল মা আর ওকে খাইয়ে দেয় না। সেদিন রাত্রে কুট্টুস বায়না করছিল, মায়ের হাতে ছাড়া খাবে না। বায়না শুনে যেই মা খাওয়াতে গেল, অমনি বোনটা কাঁদতে শুরু করল। আর মা ওকে খাওয়ানো ফেলে বোনটাকে কোলে নিয়ে নিল। কুট্টুসের খুব রাগ হচ্ছিল। কী হিংসুটে বোন রে বাবা! অবশ্য বাবাইকে একথাটা বলায় বাবাই খুব হেসেছিল কেন কে জানে। বোনটা আসার পর থেকে বাড়ির সবাই যেন ওকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত হয়ে গেছে।
মা যেদিন প্রথম বোনটাকে বাড়ি নিয়ে এসেছিল, কুট্টুস তো ছাদের দরজার আড়ালে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। জেদ ধরেছিল, বোনটাকে ফেরত দিয়ে ওর জন্যে একটা সুন্দর গিফট নিয়ে আসতে। বাবাই ওকে অনেক বুঝিয়ে কোলে করে ছাদ থেকে নামিয়ে নিয়ে এসেছিল। মা বলেছিল, এই গিফটটা সান্তাক্লজ নিজে ওর জন্যে পাঠিয়েছে। এর থেকে ভালো গিফট নাকি আর হয়ই না। ঠাম্মা বলেছিল, “এটা হল জ্যান্ত ডল। দেখবি তোর সঙ্গে কত খেলবে।” কিন্তু কোথায় কী! বোনটা তো এখন কিছুই খেলতে পারে না। সারাদিন খালি পটি আর হিসি করে। তাও আবার বিছানায় শুয়ে-শুয়েই। আবার ঝরনাপিসি বলে কিনা কুট্টুসও একদিন এরকমই করত। ঝরনাপিসিটা কিচ্ছু জানে না। কুট্টুস আবার কবে এরকম করল? ওর তো মনেই নেই।
কুট্টুস অবশ্য একটা উপায় ভেবেছে। সেদিন ঋজুদাদারা এসেছিল ওর বোনকে দেখতে। ঋজুদাদার খুব পছন্দ হয়েছে বোনটাকে। ঋজুদাদার কোনও বোন নেই বলে মনখারাপ করছিল। বায়না করছিল এই বোনটাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবার জন্যে। কেন যে ওকে দিয়ে দিল না! তাহলে আর কুট্টুসের কোনও ঝামেলা থাকত না। তাই কুট্টুস ঠিক করেছে, ও একদিন গিয়ে বোনটাকে ঋজুদাদার বাড়ি দিয়ে আসবে।
“এই যে গোপাল।”
ঠাম্মার তেল মাখানো হয়ে গেছে। তেলের শিশি, বাটি গোছাতে গোছাতে বলল কুট্টুসের দিকে তাকিয়ে, “একটু বোনকে পাহারা দাও তো, আমি ততক্ষণ এগুলো রেখে আসি।”
কুট্টুস রং করতে করতে বলে, “পারব না, তুমি ঝরনাপিসিকে ডাকো।”
ঠাম্মা হেসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, “অমন বলে না দাদা। তোমার বোন, তুমি পারবে না তো কে পারবে? জানো, মা আজ তোমার জন্যে চাউমিন বানাচ্ছে।”
কুট্টুসের মনটা আনন্দে নেচে ওঠে। মা চাউমিন বানাচ্ছে, ওর জন্যে, কী মজা! ঝরনাপিসি এই ক’দিনে ওকে মাঝে মাঝে বানিয়ে দিচ্ছে চাউমিন, কিন্তু একদম মায়ের মতো হয়নি। কুট্টুস আর উত্তর দেয় না, একমনে রং করে যায়।
ঠাম্মা চলে যায় তেলের বাটি নিয়ে।
শীতকাল। বারান্দায় হালকা রোদ এসে পড়েছে। বোনটা বেশ হাত-পা নেড়ে নেড়ে খেলছে। কুট্টুস ওর দিকে তাকায় একবার। অবাক হয়ে দেখে বোনটা নিজের মনেই হাসছে, ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওকে দেখছে। কুট্টুসও হেসে ফেলতে যায় কিন্তু আবার কী মনে পড়ে গম্ভীর হয়ে যায়। মুখ ঘুরিয়ে নেয় ওর দিক থেকে। আর তখনই ওর চোখে পড়ে একটা লাল কাঠপিঁপড়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। এই পিঁপড়েগুলো কামড়ালে ভীষণ জ্বালা করে। কুট্টুস তাড়াতাড়ি করে হাতের পেন্সিল দিয়ে পিঁপড়েটাকে ঠেলে দেয়। আর ও মা, অমনি পিঁপড়েটা ছিটকে যায়, তারপরেই মুখ ঘুরিয়ে সোজা বোনটার দিকে এগিয়ে যায়। কুট্টুস কী করবে ভেবে পায় না। ঠাম্মাটা যে কোথায় গেল! মাই বা কোথায়? ঝরনাপিসি? কেউ নেই এখানে। এদিকে পিঁপড়েটা এগিয়ে যাচ্ছে বোনটার দিকে। হঠাৎ করেই কুট্টুসের মনে পড়ে যায়, সেদিন ইঞ্জেকশন দিয়েছিল বলে বোনটা কত কাঁদছিল সারাদিন। কুট্টুসকেও যখন ডাক্তার আঙ্কেল ইঞ্জেকশন দেয় কত লাগে! আজকে ওই পিঁপড়েটা কামড়ালেও তো বোনটার খুব লাগবে, খুব কাঁদবে! কুট্টুস টুক করে আঁকার খাতার কোণ থেকে পাতাটা ছিঁড়ে নেয়। তারপরে এক লাফে গিয়ে পাতাটা দিয়ে পিঁপড়েটাকে ধরে চিপে জানালা দিয়ে ফেলে দেয়। তারপর পা টিপে টিপে বোনটার কাছে গিয়ে বসে। ছোট্ট বোনটা ফোকলা মুখে তখনও হেসেই যাচ্ছে। কুট্টুস ওর আঙুলটা ওর দিকে বাড়িয়ে দেয়। বোনটা মুঠো বাড়িয়ে আঙুলটা জড়িয়ে ধরে। কুট্টুস হেসে ওঠে।
জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে